পূজা ও রমণী
পূজা নয়, আজকাল সাধারণত পুজোই লিখি, সেটাই এখানকার রেওয়াজ। কিন্তু এই রচনায় পজূা শব্দটিই কাম্য, পূজা ও রমণী যে শুচিস্নিগ্ধা পরিমণ্ডল রচনা করে সেই জগতে পুজো শব্দটি একটু হালকা ও খেলো।
নতুন যুগের পাঠক-পাঠিকা হয়তো আমার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত নাও হতে পারেন। কিন্তু আমি যে অনেককালের লোক। পূজা-অর্চনা-আরাধনার যুগের লোক। তখনও দুর্গাপূজা দুগ্গাপুজো হয়নি, অন্তত লেখার ভাষায়।
শুধু লেখার ভাষাই বদলে গেছে তা তো নয়। একটা মজার অপ্রাসঙ্গিক কথা বলি—‘পূজা ও রমণী’ শীর্ষক এই সময়োচিত নিবন্ধটির জন্য যে তরুণী সাংবাদিক ফোন করেছিলেন, তাঁকে আমি ভাল করে চিনি না, তাই ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছিলাম। সেই নবীনা বললেন, ‘আপনি আমাকে আপনি বলছেন কেন? আমাকে তুমি বলবেন।’
নতুন যুগের আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু ‘হায়রে, কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল’! ‘হায়রে, কবে কেটে গেছে তারাপদর কাল’!
একদা, এই তো মাত্র চল্লিশ বছর আগে, হন্যে হয়ে তরুণীদের খুঁজেছি। এই আশায় যদি কেউ আমাকে তুমি বলে! দু’-চারজন তুই বলেছে, অন্যেরা সবাই আপনি বলেছে।
এতকাল পরে কেউ বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, বামাকণ্ঠে ‘তুমি’ সম্বোধন শোনার জন্যে আমাকে বিয়ে করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আর এখন তরুণী নিজেই উপযাচিকা হয়ে বলছেন তাঁকে তুমি বলতে।
পাঠিকা ঠাকুরানি মনে করতে পারেন ‘পূজা ও রমণী’ নামক নিবন্ধে এসব কী অবান্তর কথা! পূজা ও রমণীদের বদলে এ যে রমণী পূজা!
অবান্তর কথা বাদ দিয়ে তা হলে মূল প্রসঙ্গে আসি। তবে প্রথমেই সরাসরি ‘পূজা ও রমণী’তে যাচ্ছি না। ধাপে ধাপে যাব।
পূজার বদলে আরম্ভ করা যাক ‘পূজা সংখ্যা ও রমণী’ দিয়ে। হাতের কাছে সদ্য প্রকাশিত কয়েকটি পর্বতপ্রতিম পূজা সংখ্যা রয়েছে। একটার পর একটা কাগজ তুলে নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগলাম। সেই সঙ্গে খাতা-কলম নিয়ে গুণে অঙ্ক কষে ফেললাম।
সবসমেত একশো আটাশিটি বিজ্ঞাপন দেখলাম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। তার মধ্যে একশো একান্নটি রমণীমোহন। বাকিগুলি শিশু, পুরুষ প্রকৃতি ইত্যাদি।
এরপর বিভিন্ন গল্প উপন্যাসের অলংকরণ দেখলাম। স্বাভাবিকভাবেই প্রায় প্রতিটি উপন্যসে স্ত্রী-চরিত্র থেকে পুরুষ-চরিত্র বহুগুণ বেশি। সেই রাম লক্ষ্মণ ও সীতা, অচলা মহিম ও সুরেশের অনুপাত আজকাল আরও ছড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু শতকরা নব্বুইটি অলংকৃত চিত্রে প্রধানা একাকিনী রমণী।
দূরদর্শনের সিরিয়ালেও পূজার নানারকম বিজ্ঞাপনে রমণীই প্রধানা। শাড়ির বিজ্ঞাপনে তো মহিলা থাকবেই কিন্তু সাবান, টুথপেস্ট সবরকম প্রসাধন দ্রব্য, কাপড়কাচা সাবান,গায়েমাখা সাবান, মিলের নামী-দামি সুটের কাপড়, পুষ্টি-পানীয় ইত্যাদি প্রায় সব বিজ্ঞাপনই নারীঘটিত।
তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই। শুধু এটুকু সংক্ষিপ্ত করে বলা যেতে পারে মহিলারা যে পূজা-মণ্ডপেও সংখ্যাগুরু হবেন সেটা স্বতঃসিদ্ধ। তারাই আলপনা দেবেন, ফুল চন্দন নৈবেদ্য বন্দোবস্ত করবেন। তাঁরাই ফল কুটবেন, পুজোর শেষে প্রসাদ বিলি করবেন।
ঠাকুর মশায়ের মন্ত্র উচ্চারণ যখন তুঙ্গে উঠবে তাঁরাই যথাসময়ে শাঁখ বাজাবেন, উলুধ্বনি দেবেন।
মহাষষ্ঠীর কলাবউ বরণ থেকে, অষ্টমীর সন্ধিপুজোর সমারোহ অবশেষে বিসর্জনের বাজনার সঙ্গে জগজ্জননীকে কপালে সিঁদুর দিয়ে মিষ্টিমুখ করিয়ে বিদায় অনুষ্ঠান—সব কিছুতেই রমণী-মহল। সেখানে পুরুষের কোনও প্রবেশাধিকার নেই।
‘পূজা ও রমণী’ এই দুই শব্দের অনুষঙ্গ আমাদের মনের মধ্যে একটা ছবি এনে দেয়। সেই ছবিটি রবীন্দ্রনাথের একটি সর্বপরিচিত কবিতার:
‘সেদিন শারদ দিবা অবসান
শ্ৰীমতী নামে সে দাসী
পূণ্যশীতল সলিলে নাহিয়া
পুষ্পপ্রদীপ থালায় বাহিয়া’…
কবি জীবনানন্দ ‘বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতের কথা বলেছিলেন, শ্রীমতী-নাম্নী এই পূজারিনী সেই সময়কার।’
শ্ৰীমতীর সাজসজ্জা, অলংকার ইত্যাদি আজকাল প্লাস্টার অব প্যারিসে নৃত্যকরা দেবদেবীর যে মূর্তি মেলায়-বাজারে কিনতে পাওয়া যায় কিংবা ‘উৎসব’ চলচ্চিত্রে লাস্যময়ী নায়িকা রেখা যে রকম পোশাক পরেছিলেন—সে রকম নাও হতে পারে।
ওই জটিলতার মধ্যে না গিয়ে বলি পূজা ও রমণী অথবা সরাসরি পূজারিনী বলতে যে ইমেজ আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে সেটা সাবেকি বাংলার।
বাংলা থিয়েটারে, যাত্রাগানে, সিনেমায়—এমনকী সাম্প্রতিক দূরদর্শন ধারাবাহিকে পূজার্চনার দৃশ্যে সেই রমণীটির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়।
কপালে ঘোমটা, সিঁথিতে সিঁদুর, আর চোখ দুটি টানটান। পরনে লাল পাড় তাঁতের কোরা শাড়ি, হাতে লাল বা সাদা শাঁখা ও কঙ্কন। হয়তো শঙ্খ বাজাচ্ছে কিংবা হাতে তাম্রপত্রে কুসুমাঞ্জলি অথবা দীপাবলী। নম্র নেত্রপাতে আবহমতী সুন্দরী আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁকে আমরা আজন্ম জানি। তাঁর মুখের আদল আমাদের খুব চেনা। আমাদের খুব কাছের, খুব ভালবাসার নিকটজনের মতো তাঁর মুখশ্রী।
সালোয়ার কামিজ, জিন্স-টপ, ফ্রক, মিডি-মিনি-ম্যাক্সির ভিড়েও তাঁকে আমরা আজও হারিয়ে ফেলিনি। সেই সুন্দরীর সঙ্গে এখনও দেখা হয়। এই পড়ন্ত বয়সে যখন আর পুরনো দিনের সঙ্গে কিছু মেলে না, যখন সবকিছুই বদলিয়ে গেছে, শুধু সেই পূজারিনীর মুখশ্রী চিরদিনের, তাঁর পবিত্র সুষমা, তাঁর স্নেহলতার কুসুম অমলিন। এখনও তাঁকে যে কোনও ভূমিকাতেই দেখি চিনতে পারি, যে কোনও পোশাকেই দেখি চিনতে পারি। প্রাচীন মন্ত্র মনে পড়ে, সেটা একটু বদল করে বলি,
‘যা দেবী সর্বভূতেষু স্মৃতিরূপেণ সংস্থিতা।’
শঙ্খধ্বনি, উলু জোকার, ঢাকের বাজনা। তারও পরে কাঁসর ঘন্টার শব্দ সবকিছু বিলীন হয়ে যাওয়ার পরে তখনও থাকে ধূপের ধুনোর গন্ধ, চন্দন-অগুরুর সৌরভ, ফুল-বেলপাতা-আম্রপল্লবের আবহ। সেই প্রেক্ষাপটে কুঁচবরণ কন্যা মেঘবরণ চুল সেই পূজারিণীর সঙ্গে দেখা হয়।
আমি বলি, ‘হে চিরদিনের রমণী, আজ এই পূজার দিনে কোথায় তোমার সেই শঙ্খবালা, কোথায় তোমার সেই অলক্তরাগ?’
‘আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?
‘…হে পূজারিণী, এ জন্মে আমি তোমার কেউ নই, অন্য জন্মে তোমার পূজারী ছিলাম।’