পূজার ভূত – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
প্রথম অধ্যায় ভয়ঙ্কর বাড়ি
আমার নাম তারক। কলিকাতায় আমি বোর্ডিংয়ে থাকি। পূজার সময় আমি বাড়ি আসিয়াছি। আমার নিজের বাড়ি নয়, মামার বাড়ি। মামার বাড়িতেই আমরা মানুষ হইয়াছি। আমি ও আমার ভগিনী প্রভা। শামীমাসি আমাদিগকে মানুষ করিয়াছে। আমার মাকেও সে মানুষ করিয়াছিল। শামীমাসি সদগোপের মেয়ে।
সন্ধ্যার সময় আমরা শামীমাসিকে ঘিরিয়া বসিলাম। আমি, প্রভা, আর আমার মামাতো ভাই ও ভগিনীগণ। আমি বলিলাম, ‘শামীমাসি, আজ তোমাকে একটি গল্প বলিতে হইবে। কেমন মেঘ করিয়াছে দেখ। কেমন অন্ধকার হইয়াছে। কেমন টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। আর বাতাসের একবার জোর দেখ। গাছের পাতার ভিতর দিয়া শোঁ শোঁ করিয়া চলিতেছে। যেন রাগিয়া কি বলিতেছে। এই অন্ধকারে এমন দুর্যোগের সময় ভূত—প্রেত সব বাহির হয়। বাপ রে! গা যেন শিহরিয়া উঠে।’
শামীমাসি বলিল, ‘এই পূজার সময়—এইরূপ দুর্যোগের সময় তোমার মাকে লইয়া আমি বড়ো বিপদে পড়িয়াছিলাম। এখনও সে কথা মনে করিলে ভয়ে আমার বুক ধড়ফড় করে।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি হইয়াছিল শামীমাসি?’
শামী উত্তর করিল, ‘না, সে কথা এখন তোমাদিগকে আমি বলিব না। তোমরা ছেলেমানুষ। সে কথা শুনিলে তোমাদের ভয় করিবে।’
আমরা সকলেই বলিলাম,—’সে কথা শুনিলে আমাদের ভয় করিবে না।’
যাহা হউক, অনেক জেদাজেদির পর শামীমাসি সে গল্প বলিতে সম্মত হইল। শামীমাসি বলিল, ‘তারক ও প্রভার মায়ের নাম সীতা ছিল। সীতার মা, অর্থাৎ তোমাদের মাতামহীর নাম তারামণি ছিল। মৃত্যুশয্যায় তিনি আমাকে বলিয়া যান, ‘শামী! আমার কাছে তুই সত্য কর যে সীতাকে তুই কখনো ছাড়িয়া যাবি না। সীতা পাঁচ বৎসরের শিশু, পৃথিবীতে তাহার আর কেহ নাই।’
সীতাকে আমি দিদিমণি বলিয়া ডাকিতাম। আমি বলিলাম, ‘মাঠাকরুণ! দাদাবাবু (অর্থাৎ তোমাদের মা—র ভাই) ও দিদিমণি কোথায় কাহার কাছে থাকিবে, তাহা আমি জানি না। দিদিমণি যাহাদের কাছে থাকিবে, তাহারা যদি আমাকে ছাড়াইয়া দেয়, তাহা হইলে আমি কি করিতে পারি? কিন্তু তাহারা যদি আমাকে রাখে, তাহা হইলে তোমার গায়ে হাত দিয়া আমি দিব্য করিয়া বলিতেছি যে, দিদিমণিকে আমি কখনো ছাড়িব না।’
তোমাদের মাতামহীর মৃত্যু হইল, তোমাদের মামা, যাঁহার এই বাড়ি, তিনি তখন বালক। লেখাপড়া শিখাইবার নিমিত্ত একজন আত্মীয় তাঁহাকে কলিকাতায় লইয়া গেলেন। সীতা তাহার মামার বাড়িতে গেল। সীতার মামা আমাকে ছাড়াইলেন না। আমি দিদিমণিকে মানুষ করিতে লাগিলাম।
দিদিমণির মামারা একসময়ে খুব বড়োমানুষ ছিলেন। শুনিলাম যে, তাহার মাতামহ জগমোহন রায়চৌধুরী একজন দুর্দান্ত লোক ছিলেন। দিদিমণিকে লইয়া আমি যখন তাঁহার বাড়িতে যাইলাম, তখন তিনি জীবিত ছিলেন না। দিদিমণির মামাও দেশে থাকিতেন না, পশ্চিমে কোথায় কর্ম করিতেন। দিদিমণিকে বাড়িতে রাখিয়া তিনি সে স্থানে চলিয়া গেলেন। সে বাড়ী কী ভয়ঙ্কর! তিনমহল বাড়ি, বাহির—বাড়িতে, মাঝের—বাড়িতে, ভিতর—বাড়িতে, একতলায় দোতলায় কত যে ঘর, তাহা গণিতে পারা যায় না। কিন্তু সব ভোঁ ভোঁ, দেখিলেই যেন ভূতের বাড়ি বলিয়া মনে হয়; বাহিরের বাড়িতে কি মাঝের বাড়িতে জনপ্রাণী বাস করে না। এতবড়ো বাড়িতে আমরা কেবল ছয়জন রহিলাম; (১) তোমার মায়ের পিসি অলক ঠাকরুণ, তাঁহার বয়স প্রায় আশি হইয়াছিল, আর তিনি সম্পূর্ণ কালা ছিলেন। (২) আর একজন ব্রাহ্মণী, তাঁহার নাম সহচরী, তাঁহারও বয়স বড়ো কম হয় না। তিনি রন্ধন করিতেন। (৩) একজন চাকর, তাহার নাম পিতেম। (৪) পিতেমের স্ত্রী, তাহার নাম বিলাসী। (৫) তাহার পর আমি ও (৬) তোমাদের মা, আমার দিদিমণি, সীতা। বাড়ির ভিতর দোতলায় তিনটি ঘরে আমরা ছয়জনে বাস করিতে লাগিলাম। প্রথম অলক ঠাকরুণ ও সহচরীর ঘর; তাহার পার্শ্বে আমার ও দিদিমণির ঘর। তাহার পার্শ্বে পিতেম ও বিলাসীর ঘর। পশ্চিমদিকে এই তিনটি ঘর ছিল। উত্তর ও পূর্ব দিকে অনেক ঘর পড়িয়াছিল। বিলাসীর ঘরের পার্শ্বে আর একটি ঘর লইয়া আমি দিদিমণির খেলাঘর বাঁধিয়া দিয়াছিলাম। বাটীর চারিদিকে অনেকদূর পর্যন্ত আঁব, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারি প্রভৃতি নানা গাছের বাগান ছিল। বাগানের ভিতর চারি—পাঁচটি পুকুর ছিল। উত্তরদিক ভিন্ন বাটীর আর চারিদিকে গ্রাম ছিল। কিন্তু সে মিথ্যা গ্রাম, ম্যালেরিয়া জ্বরের উপদ্রবে অনেক লোক মরিয়া গিয়াছে; অনেক লোক ঘরদ্বার ছাড়িয়া পলাইয়া গিয়াছে। বাটীর উত্তরদিকে মাঠ, যতদূর দেখিতে পাই, ততদূর মাঠ ধূ ধূ করিতেছে।
শ্মশানের ন্যায় সেই বাড়িতে গিয়া আমি মনে করিলাম, ওমা! এ বাড়িতে আমি কি করিয়া থাকিব, ভয়েই মরিয়া যাইব!
যাহা হউক, যেখানে আমার দিদিমণি, সেখানে সব ভালো—সেইখানে আলো— সেইখানেই সুখ। দিদিমণির দৌড়াদৌড়ি, দিদিমণির খেলা, দিদিমণির কথা, দিদিমণির হাসিতে সেই শ্মশানভূমি যেন স্বর্গতুল্য হইল। এমন যে অলক ঠাকরুণ, যাঁহার গোমড়া মুখ দেখিলে ভয় হয়, দিদিমণিকে দেখিলে তাঁহারও মুখ যেন একটু উজ্জ্বল হইত, তাঁহারও মুখে যেন একটু হাসি দেখা দিত। দিদিমণির যেমন রূপ, তেমনি গুণ। তেমন ফুটফুটে, দুধে—আলতার রং আমি আর কোনো মেয়ের দেখি নাই। কেমন পুরন্ত গাল দুইটি, কেমন ছোট্ট হাঁ—টুক। কেমন টুকটুকে ঠোঁট, কেমন পটলচেরা ঢুলু ঢুলু উজ্জ্বল চক্ষু, কেমন কালো কালো চক্ষুর পাতা, কেমন সরু সরু চকচকে রেশমের মতো নরম চুল! হা কপাল! সে দিদিমণিকে ছাড়িয়া এখনও আমি প্রাণ ধরিয়া বাঁচিয়া আছি। তারপর দিদিমণি যখন কথা কহিত, তখন প্রাণ যেন শীতল হইত, প্রাণের ভিতর দিদি আমার যেন সুধা ঢালিয়া দিত।
দিদিমণিকে লইয়া আমি সেই স্থানে বাস করিতে লাগিলাম। একবার এই সময় ঘোরতর দুর্যোগ করিয়াছিল। বাহিরে বাতাস হুহু করিয়া বহিতেছিল। দিদিমণিকে লইয়া আমি শুইয়া আছি। সহসা বাহির—বাড়িতে বেহালার শব্দ হইল। রাত্রি তখন প্রায় দুই প্রহর হইয়াছিল। আমি মনে করিলাম যে, এত রাত্রিতে আমাদের বাহির—বাড়িতে বেহালা বাজায় কে? বাহির—বাড়িতে তো কেহ বাস করে না!
পরদিন আমি বাহির—বাড়িতে গিয়া চারিদিক দেখিলাম। জনপ্রাণীকেও সে স্থানে দেখিতে পাইলাম না। পোড়ো ভাঙা বাড়ির যেরূপ অবস্থা হয়, বাহির—বাড়ির সেইরূপ অবস্থা হইয়াছিল।
সেদিন বিলাসীকে একবার একেলা পাইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘বিলাসী কাল রাত্রিতে বাহির—বাটীতে বেহালা কে বাজাইতেছিল?’
আমার কথা শুনিয়া বিলাসীর মুখ শুষ্ক হইয়া গেল। আমতা আমতা করিয়া সে উত্তর করিল, ‘বেহালা! বেহালা আবার কে বাজাইবে? ও বাতাসের শব্দ।’
বিলাসীর কথায় আমার প্রত্যয় হইল না। আমি নিশ্চয় বুঝিলাম যে, সে আমার নিকট কোনো বিষয় গোপন করিতেছে।
বিলাসী পুনরায় বলিল, ‘যাহা হউক, দিদিমণিকে তুমি সদর—বাড়িতে যাইতে দিয়ো না। সাপ—খোপ কি আছে না আছে, কাজ কি ওদিকে গিয়া।’
আরও কিছুদিন গত হইয়া গেল। একবার নয়, আরও অনেকবার আমি সেই বেহালার শব্দ শুনিতে পাইলাম। যখনই রাত্রিকালে বাদলা ও দুর্যোগ হয়, তখনই বাহির—বাড়িতে কে যেন প্রাণপণে বেহালা বাজায়। কেবল বেহালা নহে, সে বৎসর পূজার সময় মহা—অষ্টমীর রাত্রিতে বাহির—বাড়িতে আমি শাঁক—ঘণ্টার শব্দও শুনিয়াছিলাম, ধূপ—ধূনার গন্ধও পাইয়াছিলাম। বলিদানের সময় যেমন একজন ভক্ত বিকট স্বরে মা মা বলিয়া চীৎকার করে, সে শব্দ শুনিয়াছিলাম। এ সমুদয় ব্যাপারের অর্থ কি, তাহা জানিবার নিমিত্ত বৃদ্ধা সহচরীকে, পিতেমকে, বিলাসীকে আমি বারবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। কিন্তু কেহই আমাকে বলে নাই। ‘ও কিছু নয়’, এই কথা বলিয়া সকলে প্রকৃত তত্ত্ব আমার নিকট গোপন করিতে চেষ্টা করিয়াছিল।
এইরূপে সে স্থানে আমাদের দিন কাটিতে লাগিল। কত শতবার আমি সেই বেহালার শব্দ শুনিতে পাইলাম। পুনরায় পূজার সময় আসিল। মহাষ্টমীর দিন দুই প্রহরের সময় দিদিমণি পিতেম ও বিলাসীর সহিত গ্রামের ভিতর পূজা দেখিতে গিয়াছিল। আমি বিদেশি লোক, আমাকে কেহ নিমন্ত্রণ করে নাই, সেজন্য আমি তাহাদের সঙ্গে যাই নাই। পূজা দেখিয়া বেলা পাঁচটার সময় দিদিমণি ফিরিয়া আসিল। বিলাসী আমাকে বলিল, ‘যদু ভড়ের বাড়ি পূজার এবার খুব ধূম। আহা! কি চমৎকার প্রতিমা করিয়াছে। আর শামীদিদি, ভড়গিন্নি তোমাকে অনেক করিয়া যাইতে বলিয়াছে।’
এই কথা শুনিয়া আমি ভড়েদের বাড়ি ঠাকুর দেখিতে যাইলাম। ভড়গিন্নি আমাকে অনেক আদর করিলেন। অনেকগুলি খই—মুড়কি; নারিকেল—সন্দেশ, রসকরা—আরও কত কি আমার কাপড়ে বাঁধিয়া দিলেন। ফিরিয়া আসিতে আমার সন্ধ্যা হইয়া গেল।
দ্বিতীয় অধ্যায় আয় না ভাই
বাড়ি আসিয়া তাড়াতাড়ি আমি বিলাসীর ঘরে যাইলাম। দিদিমণিকে সে স্থানে দেখিতে পাইলাম না।
বিলাসী বলিল, ‘বোধহয় অলক ঠাকরুণের ঘরে আছে।’ রুদ্ধশ্বাসে সে ঘরে আমি দৌড়িয়া যাইলাম। অলক ঠাকরুণ ও সহচরী দুইজনেই তখন সে ঘরে ছিল। দিদিমণিকে দেখিতে না পাইয়া সহচরীকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম। সহচরী উত্তর করিলেন, ‘কৈ! সীতা তো এ ঘরে আসে নাই।’
এই কথা শুনিয়া প্রাণ আমার উড়িয়া গেল। পুনরায় আমি বিলাসীর ঘরে যাইলাম। কাঁদিতে কাঁদিতে আমি বিলাসীকে তিরস্কার করিতে লাগিলাম।
বিলাসী কাঁদিতে লাগিল। সে বলিল, ‘এইমাত্র আমার ঘরের বারান্দায় সে খেলা করিতেছিল। ঘরের ভিতর আমি কাজ করিতেছিলাম। বোধহয়, অন্য কোনো ঘরে সে খেলা করিতেছে।’
এমন সময় পিতেম আসিয়া উপস্থিত হইল। আমার কান্না ও বিলাসীকে ভর্ৎসনার শব্দ শুনিয়া সহচরীও সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। প্রদীপ হাতে লইয়া সকলে মিলিয়া আমরা বাড়ি আতিপাতি করিয়া খুঁজিতে লাগিলাম। ভিতর—বাড়ি খুঁজিয়া মাঝের—বাড়ি, তাহার পর সদর—বাড়ির সকল ঘর তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিলাম; কিন্তু কোনো স্থানে দিদিমণিকে দেখিতে পাইলাম না। মাথা খুঁড়িয়া বুক চাপড়াইয়া আমি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিলাম। আমি ভাবিলাম যে, হয় গহনার জন্য দিদিমণিকে কেহ মারিয়া ফেলিয়াছে, কিংবা পুষ্করিণীতে পড়িয়া সে ডুবিয়া গিয়াছে। সমস্ত বাড়ি ওলট—পালট করিয়া অবশেষে আমরা বাগান ও পুকুরের ধারগুলি মনোযোগের সহিত দেখিলাম। কিন্তু কোনোস্থানে দিদিমণির চিহ্নমাত্র দেখিতে পাইলাম না। শেষে পিতেম আমাকে বলিল—’তোমাকে দেখিতে না পাইয়া তাহার মন কেমন করিয়াছিল, তোমাকে খুঁজিবার নিমিত্ত নিশ্চয় সে পূজা—বাড়ির দিকে গিয়াছে। আমি এখনই তাহাকে আনিতেছি।’ এই কথা বলিয়া পিতেম গ্রামের দিকে চলিয়া গেল।
কিন্তু তা বলিয়া আমরা নিশ্চিন্তে থাকিতে পারিলাম না। পূর্বেই বলিয়াছি যে আমাদের বাড়ি ও বাগানের উত্তর দিকে দূর পর্যন্ত মাঠ ছিল। দিদিমণিকে খুঁজিবার নিমিত্ত বিলাসী ও আমি সেই মাঠের দিকে যাইলাম। মেঘ করিয়াছিল, খুব অন্ধকার হইয়াছিল। তাহার উপর এখন আবার বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ হইল। কিছুক্ষণ পরে সম্মুখে আমরা একপ্রকার সাদা কি দেখিতে পাইলাম। বিলাসীর বড়ো ভয় হইল। সে বলিল, ‘দিদি, ঐ দেখ একটি শাকচূর্ণী আসিতেছে। এখনি আমাদের খাইয়া ফেলিবে। আর গিয়া কাজ নাই। এসো, বাড়ি ফিরিয়া যাই। এতক্ষণে দিদিমণি বাড়ি আসিয়া থাকিবে।’
কোনো উত্তর না দিয়া বিলাসীর আমি হাত ধরিলাম, আর সেই সাদা জিনিসের দিকে তাহাকে টানিয়া লইয়া যাইতে লাগিলাম। সেও অন্য দিক হইতে আমাদের দিকে আসিতে লাগিল। অল্পক্ষণ পরে তাহার সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হইল। বিলাসী তাহাকে চিনিতে পারিল। সে আমাদের প্রতিবেশী একজন কৃষক! কাপড় ঢাকা তাহার বুকের উপর কি ছিল। আমরা কোনো কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে না করিতে সে বলিল, ‘তোমাদের মেয়েটি মাঠের মাঝখানে গাছতলায় অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল। কী করিয়া সে মাঠের মাঝখানে আসিয়াছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি দেখিতে পাইয়া এখন তোমাদের বাড়ি লইয়া যাইতেছি।’
তাড়াতাড়ি দিদিমণিকে আমি তাহার কোল হইতে আপনার কোলে লইলাম। কিন্তু দিদিমণির সর্ব শরীরই ঠান্ডা দেখিয়া আমার প্রাণ উড়িয়া গেল। আমি ভাবিলাম, সে মরিয়া গিয়াছে। কাঁদিতে কাঁদিতে আমি তাহার নাকে ও বুকে হাত দিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে নাক দিয়া অল্প অল্প নিশ্বাস পড়িতেছে। আর বুক অল্প অল্প ধুক—ধুক করিতেছে। তাহা দেখিয়া আমার প্রাণে কতকটা আশা হইল। তাড়াতাড়ি মাঠ পার হইয়া আমরা বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। অনেক তাপসেঁক করিতে করিতে দিদিমণির চেতনা হইল। সেই চন্দ্রমুখে মধুর হাসি দেখা দিল, সুধামাখা দুই একটি কথা দিদিমণির মুখ হইতে বাহির হইল। অল্প গরম দুধ আনিয়া সহচরী তাহাকে খাইতে দিলেন। তাহার সেই পদ্মচক্ষু দুইটি ঘুমে বুজিয়া গেল। সে রাত্রিতে দিদিমণিকে আমরা কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না।
দূরে মাঠের মাঝখানে একেলা সে কী করিয়া গিয়াছিল, পরদিন সেই কথা দিদিমণিকে আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম। দিদিমণি বলিলেন, ‘বারান্দায় আমি খেলা করিতেছিলাম। তাহার পর যে ঘরে আমার খেলাঘর আছে, আমি তাহার ভিতর যাইলাম। সেই ঘরের জানালার ধারে যেই দাঁড়াইয়াছি, আর দেখি না ঠিক তাহার নীচেতে বাগানে একটি মেয়ে রহিয়াছে। মেয়েটি আমার মতো বড়ো, কিন্তু খুব সুন্দর। উপর দিকে আমার পানে চাহিয়া সে বলিল, ‘সীতা! নেমে আয় না ভাই, আমরা দুইজনে খেলা করি।’ আমি বলিলাম, ‘না ভাই। এখন আমি নীচে নামিয়া যাইতে পারিব না। সন্ধ্যা হইয়াছে, এখন নীচে নামিবার সময় নয়। বিলাসী আমাকে বকিবে, তাহার পর শামী আসিয়া আমাকে বকিবে। কাল সকালবেলা তুমি আসিয়ো, দুইজনে তখন অনেকক্ষণ খেলা করিব।’ মেয়েটি বলিল, ‘এখনও তেমন সন্ধ্যা হয় নাই, এখনও অনেক আলো রহিয়াছে। এই দেখ আমার মাথা দিয়া রক্ত পড়িতেছে, তবুও দেখ আমি খেলা করিতেছি। আয় না ভাই।’
‘তবুও আমি নামিলাম না। নীচে নামিতে মেয়েটি আমাকে বারবার বলিতে লাগিল। শেষে সে মাটির উপর বসিয়া পড়িল, বসিয়া হাপুসনয়নে কাঁদিতে লাগিল। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। নীচে নামিয়া বাড়ির বাহির হইয়া আমি তাহার কাছে যাইলাম। কিছুক্ষণ বাগানের ভিতর আমরা দুইজনে খেলা করিলাম। এক স্থানে অনেকগুলি রজনিগন্ধা ফুল ফুটিয়াছিল, তাহা আমরা তুলিলাম। সাদা টগর ফুল ফুটিয়া আর একটি গাছে আলো করিয়াছিল। নীচে হইতে যত পারিলাম, সেই টগর ফুলও আমরা তুলিলাম। কেমন করিয়া জানি না, তাহার পর বাগান পার হইয়া আমরা মাঠে গিয়া উপস্থিত হইলাম। কেমন করিয়া জানি না, সেই মেয়েটির সঙ্গে অনেক পথ চলিয়া ক্রমে মাঠের মাঝখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সে স্থানে একটি গাছ ছিল। সেই গাছতলায় একটি মেয়েমানুষ বসিয়া কাঁদিতেছিল। আমার মাকে স্বপ্নের ন্যায় আমার মনে পড়ে। সে মেয়েমানুষটি ঠিক আমার মায়ের মতো। সেই রকম রং, সেই রকম মুখ, সেই রকম চুল, সেই রকম কথা। আদর করিয়া তিনি আমাকে কোলে লইলেন, আমার মুখে তিনি হাত বুলাইতে লাগিলেন। তাহার পর কী হইল, আর আমার মনে নাই।’
তৃতীয় অধ্যায় বালিকা ভূত
দিদিমণির এই কথা শুনিয়া সহচরী পিতেমকে চক্ষু টিপিলেন। তাহার পর তিনি বিলাসীর গা টিপিলেন। ইহার মানে আমি কিছু বুঝিতে পারিলাম না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সে মেয়েটি কে? সে তো বড়ো দুষ্ট মেয়ে দেখিতেছি। তাহাকে আর বাগানে আসিতে দেওয়া যাইবে না।’
আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়া সহচরী বলিলেন, ‘এ বিষয় অলক ঠাকরুণকে জানাইতে হইবে। তিনি যেরূপ বলেন, সেইরূপ করিতে হইবে।’ এই কথা বলিয়া সহচরী সে ঘর হইতে চলিয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি আমাকে, পিতেমকে ও বিলাসীকে অলক ঠাকরুণের ঘরে ডাকিয়া পাঠাইলেন। দিদিমণিকে কোলে লইয়া আমি পিতেম ও বিলাসীর সঙ্গে সেই ঘরে যাইলাম। অলক ঠাকরুণ থুড়থুড়ে বুড়ি হইয়াছিলেন। তিনি অধিক কথা বলিতে পারিতেন না। তাঁহার হইয়া সহচরী আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘অলক ঠাকরুণ তোমাকে বলিতে বলিলেন যে, সে মেয়েটি মানুষ নহে। তাহার মা, যাঁহাকে সীতা গাছতলায় দেখিয়াছিল, তিনি অলক ঠাকরুণের ভাইঝি, সীতার মাসি। অনেকদিন হইল তিনি ও তাঁহার কন্যা অপঘাত—মৃত্যুতে মরিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের গতি হয় নাই, এখন তাঁহারা এরূপ হইয়া আছেন। তাঁহারা সর্বদা, বিশেষত ঝড়—বাতাস—বাদলার দিনে, আর এই পূজার সময়, বাড়ির চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ান। পিতেম, বিলাসী আর তুমি শামী, তোমাদের সকলকে অলক ঠাকরুণ বলিতেছেন যে, সীতাকে তোমরা খুব সাবধানে রাখিবে, নিমিষের নিমিত্ত তোমরা তাহাকে চক্ষের আড় করিবে না। সে মেয়েটা এবার যদি সীতাকে ভুলাইয়া লইয়া যায়, তাহা হইলে আর তোমরা সীতাকে পাইবে না।’
এই কথা শুনিয়া আমার আত্মপুরুষ উড়িয়া গেল। কী করিয়া মেয়েকে ভূতের হাত হইতে বাঁচাইব, সেই ভাবনায় আমি আকুল হইয়া পড়িলাম। তোমার মামার তখনও কর্ম—কাজ হয় নাই, একদিন গিয়া দাঁড়াই, একবেলা এক মুঠা কেহ যে ভাত দেয়, এমন স্থান ছিল না। কাদায় গুণ ফেলিয়া দিদিমণিকে লইয়া কাজেই আমাকে সেই ভয়ানক বাড়িতে থাকিতে হইল। কিন্তু সেই দিন হইতে দিদিমণিকে আমরা নিমেষের জন্যও চক্ষুর আড় করিতাম না। হয় আমি, না হয় বিলাসী, না হয় পিতেম, কেহ না কেহ সর্বদা তাহার কাছে থাকিত। কিন্তু মাঝে মাঝে জানালার দ্বারে দাঁড়াইয়া দিদিমণি আমাদিগকে বলিত, ‘ওই সেই মেয়েটি আসিয়াছে, ওই আমাকে হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে। শামী, তুই আমাকে সুন্দর বলিস, কিন্তু ওর পানে একবার চাহিয়া দেখ। আহা! কি চমৎকার রূপ। কেবল ওর পানে চাহিয়া থাকিতে ইচ্ছা করে, অন্যদিকে চক্ষু ফিরাইতে ইচ্ছা করে না। ওই দেখ, আবার আমাকে ডাকিতেছে। আমি যাইতেছি না বলিয়া আহা! মেয়েটি ওই দেখ, কতই না কাঁদিতেছে। তাহার কাপড় সে আমাকে দেখাইতেছে, তাহার কাপড় ভিজিয়া গিয়াছে, টস টস করিয়া তাহার কাপড় হইতে জল পড়িতেছে। এ আবার কি? হাত দিয়া সে আপনার মাথা আমাকে দেখাইতেছে। আহা! মেয়েটির মাথায় কে মারিয়াছে, মাথা হইতে গাল বাহিয়া রক্ত পড়িতেছে। শামী! একবার আমাকে ছাড়িয়া দে। আমি উহার কাছে যাই, উহাকে বাড়ির ভিতর ডাকিয়া আনি। তুই উহার মাথায় ঔষধ দিয়া দিবি। আমার ওই কাপড়খানি আমি উহাকে পরিতে দিব। যাই ভাই, যাই!’
এইরূপ বলিলে তাড়াতাড়ি আমি তোমার মাকে গিয়া কোলে লইতাম। উপর হইতে বাগানের দিকে আমি চাহিয়া দেখিতাম, কিন্তু আমি দেখিতে পাইতাম না। কী করিব। ঘরের দ্বার—জানালা বন্ধ করিয়া মেয়েকে কোলে লইয়া, ভয়ে জড়সড় হইয়া আমি বসিয়া থাকিতাম।
এইরূপ অতি কষ্টে আমরা সেই বাড়িতে দিনপাত করিতে লাগিলাম। পুনরায় পূজার সময় আসিল। এই সময় দিদিমণি সেই মেয়েটাকে ঘন ঘন দেখিতে লাগিল। বাগানের দিকে জানালা এখন আমি সর্বদাই বন্ধ করিয়া রাখিতাম। তথাপি দিদিমণি বলিত, ‘শামী! জানালা খুলিয়া দে। মেয়েটি নীচে আসিয়াছে, সে আমাকে ডাকিতেছে। শামী! তোর পায়ে পড়ি, একবার জানালা খুলিয়া দে, একবার তাহাকে আমি দেখি।’
মহাষ্টমীর দিন মেয়েকে লইয়া আমি বড়োই বিব্রত হইলাম। সেদিন ভয়ানক দুর্যোগ হইয়াছিল। সীতাকে কোলে লইয়া আমি ঘরে বসিয়া ছিলাম। এখন আর বাহিরে নয়, সেদিন দিদিমণি সেই মেয়েটিকে বাড়ির ভিতরেই দেখিতে লাগিল। আমি দ্বার বন্ধ করিয়া ছিলাম, তথাপি দিদিমণি বলিতে লাগিল, ‘ও শামী! মেয়েটি আজ বাড়ির ভিতর আসিয়াছে, ঘরের বাহিরে আমাদের ঘরের নিকট দাঁড়াইয়া আছে। ছাড়িয়া দে শামী। আমি একবার তাহার কাছে যাই। একবার তাহাকে না দেখিলে মরিয়া যাইব।’
এই বলিয়া দিদিমণি হাপুসনয়নে কাঁদিতে লাগিল। কি যে করি, তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না। মেয়ে লইয়া আমি অলক ঠাকরুণের ঘরে যাইলাম। সে স্থানে সহচরী উপস্থিত ছিলেন। আমি বলিলাম—’আজ বাছা, আমাদের খাওয়া—দাওয়াতে কাজ নাই। সকলে মিলিয়া এসো, আজ আমরা মেয়েকে ঘিরিয়া থাকি। তা না করিলে, দিদিমণিকে আজ আমরা বাঁচাইতে পারিব না, সেই দুষ্ট মেয়েটা আসিয়া দিদিমণিকে নিশ্চয় আজ লইয়া যাইবে।’
সহচরী অলক ঠাকরুণকে সকল কথা বলিলেন। অলক ঠাকরুণ আমার কথায় সম্মত হইলেন। পিতেম ও বিলাসীকে ডাকিয়া দ্বার—জানালা বন্ধ করিয়া দিদিমণিকে ঘিরিয়া, সকলে আমরা অলক ঠাকরুণের ঘরে বসিয়া রহিলাম।
বলা বাহুল্য যে, ইতিপূর্বে এই বিড়ম্বনা নিবারণের জন্য অনেক প্রতিকার করা হইয়াছিল। গয়াতে পিণ্ড দেওয়া হইয়াছিল, শান্তি—স্বস্ত্যয়ন করা হইয়াছিল, রোজা আনিয়া ঝাড়ানো ও ভূত নামানো হইয়াছিল, দিদিমণির অষ্টাঙ্গে কবচ, মাদুলি ও নেকড়ার পুঁটলি বাঁধা হইয়াছিল। কিছু কিছুতেই কিছু হয় না।
চতুর্থ অধ্যায় বিষম মহাষ্টমী
সকলে ঘিরিয়া রহিলাম বটে, কিন্তু সেই মহাষ্টমীর সমস্ত দিন দিদিমণি বড়োই ছটফট করিয়াছিল। ‘ওই সেই মেয়েটি আসিতেছে, সে আমাকে ডাকিতেছে, তাহার কাপড় ভিজিয়া গিয়াছে, তাহার মাথা দিয়া রক্ত পড়িতেছে; দাও আমাকে ছাড়িয়া দাও, আমি তাহার কাছে যাই।’ এই বলিয়া দিদিমণি বার বার কাঁদিতেছিল, আর আমার কোল হইতে উঠিয়া আমার হাত ছাড়াইয়া বার বার বাহিরে পলাইতে চেষ্টা করিতেছিল। অতি কষ্টে আমি তাহাকে ধরিয়া রাখিতেছিলাম।
সন্ধ্যার পর দিদিমণি ঘুমাইয়া পড়িল। আমি ভাবিলাম যে, এইবার বুঝি আমাদের বিপদ কাটিয়া গেল, আর বুঝি কোনো উপদ্রব হইবে না। কিন্তু আমরা কেহ নিদ্রা যাইলাম না, ঘরে দুইটা আলো জ্বালাইয়া সকলে জাগিয়া বসিয়া রহিলাম।
রাত্রি প্রায় দুই প্রহর হইয়াছে। এমন সময় সহসা বাহির—বাটীতে সেই বেহালা বাজিয়া উঠিল। কেবল বেহালা নহে, তাহার সঙ্গে ঢাক—ঢোল, শাঁক—ঘণ্টা, কাঁসর—ঘড়িও বাজিয়া উঠিল। সেই সকল বাজনা ছাপাইয়া বলিদানের সেই ভয়ানক ‘মা মা’ চিৎকারে আমাদের যেন কানে তালা লাগিতে লাগিল, আতঙ্কে আমাদের প্রাণ শিহরিয়া উঠিল, ভয়ে আমাদের শরীর রোমাঞ্চ হইয়া উঠিল। হতভম্ব হইয়া আমরা বসিয়া আছি, এমন সময় ধড়মড় করিয়া দিদিমণি উঠিয়া বসিল। আমরা কিছু বলিতে না বলিতে চোঁৎ করিয়া সে দ্বারের নিকট গিয়া খিল খুলিয়া ফেলিল। তাহার পর আমরা তাহাকে ধরিতে না ধরিতে রুদ্ধশ্বাসে বাহির—বাড়ির পূজার দালানের দিকে সে দৌড়িল। ‘ও মা, কি হইল, সর্বনাশ হইল।’ এই কথা বলিতে বলিতে অলক ঠাকরুণ ছাড়া আর সকলেই আমরা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িলাম। কিন্তু তাহাকে ধরিতে পারিলাম না। দিদিমণি আমাদের আগে আগে গিয়া বাহির—বাড়ির পূজার দালানে উপস্থিত হইল। সে স্থানের অদ্ভুত ব্যাপার দেখিয়া আমরা জ্ঞানহারা হইলাম। এখন আর সে ভাঙ্গা জনশূন্য বাড়ি নাই। খুব ধূমধামের দুর্গোৎসব হইলে যেরূপ হয়, সে স্থানে এখন সেইরূপ হইয়াছে। দালানের মাঝখানে প্রতিমা রহিয়াছে—বৃহৎ প্রতিমা, নানা সাজে সুসজ্জিত। প্রতিমার চারিদিকে নৈবেদ্য প্রভৃতি পূজার আয়োজন রহিয়াছে। সম্মুখে পুরোহিতগণ বসিয়া আছেন। এক পার্শ্বে একজন চণ্ডীপাঠ করিতেছেন। সমুখের প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য হইয়াছে, ধূপ—ধূনার গন্ধে চারিদিক আমোদিত হইয়া আছে। দালানে, উঠানে, সকল স্থানে ঝাড়লণ্ঠন জ্বলিতেছে। ফলকথা, এমন ধূমধামের পূজা আমি কখনও দেখি নাই।
দিদিমণি কাহারও প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া দালান পার হইয়া দালানের পূর্বদিকে চলিয়া গেল। ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে আমরাও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। দালানের পূর্বদিকে একটি ঘর ছিল। সেই ঘরের ভিতর তক্তপোষের উপর একজন বৃদ্ধ বসিয়া ছিলেন। তাঁহার বাম হাতে বেহালা, আর দক্ষিণ হাতে যাহা দিয়া বাজায় তাহাই ছিল। একটি পরমা সুন্দরী স্ত্রীলোক মাটিতে বসিয়া বৃদ্ধের পা দুইখানি ধরিয়া কি বলিতেছেন। সেই স্ত্রীলোকের পার্শ্বে সাত—আট বৎসরের এক বালিকা দাঁড়াইয়া ছিল।
দিদিমণি বরাবর গিয়া সেই ঘরের দ্বারে এক পার্শ্বে দাঁড়াইল। খপ করিয়া আমি গিয়া দিদিমণির হাত ধরিয়া ফেলিলাম। তাহার পর আমরা সকলেই সেই দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া রহিলাম।
যে স্ত্রীলোক বৃদ্ধের পা ধরিয়া ছিলেন, তিনি এখন কাঁদ—কাঁদ মৃদু মধুর স্বরে বলিলেন, ‘বাবা, অপরাধ করিয়াছি সত্য! কিন্তু আমি তোমার কন্যা। শত অপরাধ করিলে কন্যাকে ক্ষমা করিতে হয়! এই মেয়েটিকে লইয়া আমি এখন কোথায় যাই?’
বৃদ্ধ অতি নিষ্ঠুর ভাষায় বলিলেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি যে, তোর আমি মুখ দেখিব না। কালামুখ লইয়া এ বাড়ী হইতে এখনই দূর হইয়া যা।’
স্ত্রীলোক উত্তর করিলেন, ‘বাবা! আমি কোনোরূপ দুষ্কর্ম করি নাই, স্বামীর ঘরে গিয়াছি, এই মাত্র।’
বৃদ্ধ বলিলেন, ‘তুই দূর হ, আমার সম্মুখ হতে দূর হ।’ স্ত্রীলোকটি অবশেষে বলিলেন, ‘আচ্ছা বাবা, আমি দূর হইতেছি কিন্তু আমার কন্যাটি তো কোনো অপরাধ করে নাই। ইহাকে আমি তোমার নিকট রাখিয়া যাইতেছি। পাতের হাতের দুইটি ভাত দিয়া ইহাকে প্রতিপালন করিয়ো।’
সেই কথা শুনিয়া বৃদ্ধ আরও জ্বলিয়া উঠিলেন, ‘তোর ঝাড় আমার এ বাড়িতে থাকিতে পারিবে না। দূর দূর, এখনি দূর হ।’
স্ত্রীলোক ও তাঁহার কন্যা সত্বর দূর হইতেছে না, তাহা দেখিয়া বৃদ্ধ রাগে অন্ধ হইয়া পড়িলেন। ধৈর্য ধরিতে না পারিয়া তিনি সেই বেহালার বাড়ি কন্যার মাথায় মারিয়া বসিলেন। কন্যার মাথা হইতে দর দর ধারায় রক্ত পড়িতে লাগিল। গাল বাহিয়া সেই রক্ত মাটিতে পড়িল।
এই নিষ্ঠুর ব্যবহার দেখিয়া সেই স্ত্রীলোক তখন উঠিয়া দাঁড়াইলেন। চক্ষু দিয়া তাঁহার যেন আগুনের ফিনকি বাহির হইতে লাগিল। তিনি বলিলেন, ‘বাবা! তুমি এ কাজ করিলে!!! যাহা হউক, আমি তোমাকে কিছু বলিব না। কিন্তু আজ হইতে তোমার লক্ষ্মী ছাড়িল।’
এই কথা বলিয়া মেয়েটির হাত ধরিয়া স্ত্রীলোকটি সেই ঘর হইতে বাহির হইলেন। তাহার পর দালানের ভিতর দিয়া উঠানে গিয়া নামিলেন। তাহার পর উঠান পার হইয়া বাড়ির বাহির চলিয়া গেলেন।
যেই তিনি বাড়ির বাহির হইলেন, আর বৃদ্ধ ভয়ানক চিৎকার করিয়া সেই তক্তপোষের উপর শুইয়া পড়িলেন। সেই সময় ঝাড়লণ্ঠন সব নিবিয়া গেল। প্রতিমা, পুরোহিত, লোকজন সব অদৃশ্য হইয়া পড়িল। ঢাকঢোলের কলরব সব থামিয়া গেল।
অন্ধকারে আমি পিতেমের কথা শুনিতে পাইলাম। পিতেম বলিল, ‘শামী! সীতা তোমার কাছে আছে?’
আমি উত্তর করিলাম, ‘হাঁ, আমি তাহাকে ধরিয়া আছি।’
পিতেম পুনরায় বলিল, ‘তবে চল, ঘরে চল।’
পঞ্চম অধ্যায় পূর্ব-বিবরণ
সকলে পুনরায় অলক ঠাকরুণের ঘরে যাইলাম। সীতা তৎক্ষণাৎ ঘুমাইয়া পড়িল। সে রাত্রিতে আর কোনো উপদ্রব হইল না।
কিন্তু সে রাত্রিতে আমাদের নিদ্রা হইল না। আমরা সকলে বসিয়া রহিলাম। পিতেম তখন আমাকে সকল কথা বলিল। পিতেম বলিল—
‘ওই যে বৃদ্ধ দেখিলে, উনি বাড়ির কর্তা ছিলেন। উঁহার নাম জগমোহন রায়চৌধুরী ছিল। উনি বড়ো দুর্দান্ত লোক ছিলেন। একবার যাহা বলিতেন তাহাই করিতেন, তা সে ভালোই হউক আর মন্দই হউক। পৃথিবীতে তাঁহার কেবল একটি শখ ছিল। বেহালা বাজাইতে তিনি বড়ো ভালোবাসিতেন। সময় নাই, অসময় নাই, সর্বদাই তিনি বেহালা বাজাইতেন। বিশেষত ঝড় বাতাস বাদলার রাত্রিতে তাঁহার শখটি কিছু প্রবল হইত। অলক ঠাকরুণ তাঁহার ভগিনী। জগমোহন রায়ের এক পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। পুত্র সীতার মামা, যিনি এখন পশ্চিমে কাজ করেন। বড়ো কন্যার নাম ছিল রামমণি, যাঁহার ভূতকে সীতা মাঠের মাঝখানে গাছতলায় দেখিয়াছিল। ছোটো মেয়ের নাম ছিল তারামণি, তিনি সীতার মা। রায়চৌধুরী বড়োমানুষ লোক, কোন পুরুষে কন্যা শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতেন না। কিন্তু রামমণির এক তেজস্বী পুরুষের সহিত বিবাহ হইয়াছিল। তিনি বলিলেন যে, ‘ঘর—জামাই হইয়া আমি কিছুতেই থাকিব না।’ আপনার স্ত্রীকে তিনি নিজের বাড়ি লইয়া যাইতে চাহিলেন। কিন্তু কর্তা কিছুতেই সম্মত হইলেন না। শ্বশুর—জামাতায় ঘোর বাদ—বিসম্বাদ বাধিয়া গেল। অবশেষে কর্তা একদিন রামমণিকে ডাকিয়া জামাতার সমক্ষে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি ইহাকে চাও—না আমাকে চাও।’ রামমণি উত্তর করিলেন, ‘বাবা! তুমি পিতা বটে, কিন্তু স্ত্রীলোকের পতিই সর্বস্ব।’ এই উত্তর শুনিয়া কর্তা ঘোরতর রাগিয়া উঠিলেন। তিনি বলিলেন, ‘বটে! তবে এখনি আমার বাড়ি হইতে দূর হও। আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আজ হইতে আমি তোমার মুখ দেখিব না।’ রামমণি শ্বশুরালয়ে গমন করিলেন। নয়—দশ বৎসর স্বামীর ঘর করিলেন। তাঁহার একটি কন্যা হইল। পরিবার প্রতিপালনের নিমিত্ত তিনি একটি পয়সাও রাখিয়া যান নাই। রামমণি ঘোর বিপদে পড়িলেন।
পিতাকে কয়েকখানি পত্র লিখিলেন। পিতা কোনো উত্তর দিলেন না। অবশেষে ভাবিলেন, ‘পূজার সময় লোকের মন নরম হয়। এই পূজার সময় বাবার পায়ে গিয়া পড়ি, তাহা হইলে তিনি বোধহয় ক্ষমা করিবেন।’ পূজার সময় কন্যাকে লইয়া রামমণি পিতার বাটীতে আসিলেন। তাহার পর তোমরা এইমাত্র যাহা দেখিলে, অষ্টমীর দিন সত্য সত্যই সেই সমুদয় ঘটনা ঘটিয়াছিল। কন্যার হাত ধরিয়া রামমণি চলিয়া গেলেন। পক্ষাঘাত রোগ হইয়া কর্তা তৎক্ষণাৎ মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন। অল্পক্ষণ পরে তুমুল ঝড় উঠিল, সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। পরদিন সকলে দেখিল যে, রামমণি ও তাঁহার কন্যা দুজনেই মাঠের মাঝখানে গাছতলায় মরিয়া পড়িয়া আছেন। কর্তা আরও কয়েক মাস জীবিত ছিলেন। কিন্তু সেই দিন হইতেই আর তিনি কথা কহিতে পারেন নাই, কী উঠিয়া বসিতে পারেন নাই। সেই তাঁহার লক্ষ্মী ছাড়িয়া গেল। জমিদারি, টাকাকড়ি কীরূপে কোথায় যে উড়িয়া গেল, তাহা কেহ বলিতে পারে না। ঘরজামাই রাখার অহঙ্কারও সেই সঙ্গে দূর হইল। সেজন্য সীতার মাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতে আর কোনো আপত্তি রহিল না। কর্তা রামমণি ও তাঁহার কন্যা—তিনজনেই এখন ভূত হইয়া আছেন। কতবার গয়াতে পিণ্ড দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু কোনো ফল হয় নাই।’
পরদিন প্রাতঃকালে আমি ভাবিলাম যে, ভিক্ষা করিয়া খাইতে হয়, সেও স্বীকার; তবু সীতাকে লইয়া সে বাড়িতে আর আমি থাকিব না। সীতার ভাই, তোমার মামাকে আমি পত্র লিখিলাম। ভাগ্যক্রমে এই সময় তাঁহার একটি কর্ম হইয়াছিল। তিনি আসিয়া আমাকে ও সীতাকে তাঁহার নিজের বাড়িতে লইয়া গেলেন। কিছুদিন পরে সীতার বিবাহ হইল। তাহার পর তুমি ও প্রভা হইলে। কিছুদিন পরে তোমার পিতার কাল হইল। অল্পদিন পরে দিদিমণিও তাঁহার সঙ্গে স্বর্গে গেলেন। দিদিমণিকে হারাইয়া কী করিয়া আমি যে প্রাণ ধরিয়া আছি তাহাই আশ্চর্য। যাহা হউক, তোমাদের দুইজনকে পাইয়া আমি শোক অনেকটা নিবারণ করিতে পারিয়াছি। মা দুর্গা তোমাদিগকে আর যত ছেলেপিলেকে বাঁচাইয়া রাখুন।’