পূজার ভূত – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
প্রথম অধ্যায় : ভয়ঙ্কর বাড়ি
আমার নাম তারক৷ কলিকাতায় আমি বোর্ডিংয়ে থাকি৷ পূজার সময় আমি বাড়ি আসিয়াছি৷ আমার নিজের বাড়ি নয়, মামার বাড়ি৷ মামার বাড়িতেই আমরা মানুষ হইয়াছি৷ আমি ও আমার ভগিনী প্রভা৷ শামীমাসি আমাদিগকে মানুষ করিয়াছে৷ আমার মাকেও সে মানুষ করিয়াছিল৷ শামীমাসি সদগোপের মেয়ে৷
সন্ধ্যার সময় আমরা শামীমাসিকে ঘিরিয়া বসিলাম৷ আমি, প্রভা, আর আমার মামাতো ভাই ও ভগিনীগণ৷ আমি বলিলাম,—‘‘শামীমাসি, আজ তোমাকে একটি গল্প বলিতে হইবে৷ কেমন মেঘ করিয়াছে দেখ৷ কেমন অন্ধকার হইয়াছে৷ কেমন টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে৷ আর বাতাসের একবার জোর দেখ৷ গাছের পাতার ভিতর দিয়া শোঁ শোঁ করিয়া চলিতেছে৷ যেন রাগিয়া কি বলিতেছে৷ এই অন্ধকারে এমন দুর্যোগের সময় ভূত-প্রেত সব বাহির হয়৷ বাপ রে! গা যেন শিহরিয়া উঠে৷’’
শামীমাসি বলিল,—‘‘এই পূজার সময়—এইরূপ দুর্যোগের সময় তোমার মাকে লইয়া আমি বড় বিপদে পড়িয়াছিলাম৷ এখনো সে কথা মনে করিলে ভয়ে আমার বুক ধড়ফড় করে৷’’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘‘কি হইয়াছিল শামীমাসি?’’
শামী উত্তর করিল,—‘‘না, সে কথা এখন তোমাদিগকে আমি বলিব না৷ তোমরা ছেলেমানুষ৷ সে কথা শুনিলে তোমাদের ভয় করিবে৷’’
আমরা সকলেই বলিলাম,—‘‘সে কথা শুনিলে আমাদের ভয় করিবে না৷’’
যাহা হউক, অনেক জেদা-জেদির পর শামীমাসি সে গল্প বলিতে সম্মত হইল৷ শামীমাসি বলিল,—‘‘তারক ও প্রভার মায়ের নাম সীতা ছিল৷ সীতার মা, অর্থাৎ তোমাদের মাতামহীর নাম তারামণি ছিল৷ মৃত্যুশয্যায় তিনি আমাকে বলিয়া যান,—‘শামী! আমার কাছে তুই সত্য কর যে সীতাকে তুই কখনো ছাড়িয়া যাবি না৷ সীতা পাঁচ বৎসরের শিশু, পৃথিবীতে তাহার আর কেহ নাই৷’
সীতাকে আমি দিদিমণি বলিয়া ডাকিতাম৷ আমি বলিলাম,—‘মাঠাকরুণ! দাদাবাবু (অর্থাৎ তোমাদের মা’র ভাই) ও দিদিমণি কোথায় কাহার কাছে থাকিবে, তাহা আমি জানি না৷ দিদিমণি যাহাদের কাছে থাকিবে, তাহারা যদি আমাকে ছাড়াইয়া দেয়, তাহা হইলে আমি কি করিতে পারি? কিন্তু তাহারা যদি আমাকে রাখে, তাহা হইলে তোমার গায়ে হাত দিয়া আমি দিব্য করিয়া বলিতেছি যে, দিদিমণিকে আমি কখন ছাড়িব না৷’
তোমাদের মাতামহীর মৃত্যু হইল, তোমাদের মামা, যাঁহার এই বাড়ি, তিনি তখন বালক৷ লেখাপড়া শিখাইবার নিমিত্ত একজন আত্মীয় তাঁহাকে কলিকাতায় লইয়া গেলেন৷ সীতা তাহার মামার বাড়িতে গেল৷ সীতার মামা আমাকে ছাড়াইলেন না৷ আমি দিদিমণিকে মানুষ করিতে লাগিলাম৷
দিদিমণির মামারা একসময়ে খুব বড়মানুষ ছিলেন৷ শুনিলাম যে, তাহার মাতামহ জগমোহন রায়চৌধুরী একজন দুর্দান্ত লোক ছিলেন৷ দিদিমণিকে লইয়া আমি যখন তাঁহার বাড়িতে যাইলাম, তখন তিনি জীবিত ছিলেন না৷ দিদিমণির মামাও দেশে থাকিতেন না, পশ্চিমে কোথায় কর্ম করিতেন৷ দিদিমণিকে বাড়িতে রাখিয়া তিনি সে স্থানে চলিয়া গেলেন৷ সে বাড়ি কি ভয়ঙ্কর! তিনমহল বাড়ি, বাহির বাড়িতে, মাঝের বাড়িতে, ভিতর বাড়িতে, একতলায় দোতলায় কত যে ঘর, তাহা গণিতে পারা যায় না৷ কিন্তু সব ভোঁ ভোঁ, দেখিলেই যেন ভূতের বাড়ি বলিয়া মনে হয় বাহিরের বাড়িতে কি মাঝের বাড়িতে জনপ্রাণী বাস করে না৷ এতবড় বাড়িতে আমরা কেবল ছয়জন রহিলাম—(১) তোমার মায়ের পিসি অলক ঠাকরুণ, তাঁহার বয়স প্রায় আশি হইয়াছিল, আর তিনি সম্পূর্ণ কালা ছিলেন৷ (২) আর একজন ব্রাহ্মণী, তাঁহার নাম সহচরী, তাঁহারও বয়স বড় কম হয় নাই৷ তিনি রন্ধন করিতেন৷ (৩) একজন চাকর, তাহার নাম পিতেম৷ (৪) পিতেমের স্ত্রী, তাহার নাম বিলাসী৷ (৫) তাহার পর আমি ও (৬) তোমাদের মা, আমার দিদিমণি, সীতা৷ বাড়ির ভিতর দোতলায় তিনটি ঘরে আমরা ছয়জনে বাস করিতে লাগিলাম৷ প্রথম অলক ঠাকরুণ ও সহচরীর ঘর তাহার পার্শ্বে আমার ও দিদিমণির ঘর৷ তাহার পার্শ্বে পিতেম ও বিলাসীর ঘর৷ পশ্চিমদিকে এই তিনটি ঘর ছিল৷ উত্তর ও পূর্ব দিকে অনেক ঘর পড়িয়াছিল৷ বিলাসীর ঘরের পার্শ্বে আর একটি ঘর লইয়া আমি দিদিমণির খেলাঘর বাঁধিয়া দিয়াছিলাম৷ বাটীর চারিদিকে অনেকদূর পর্যন্ত আঁব, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারী প্রভৃতি নানা গাছের বাগান ছিল৷ বাগানের ভিতর চারি-পাঁচটি পুকুর ছিল৷ উত্তরদিক ভিন্ন বাটীর আর চারিদিকে গ্রাম ছিল৷ কিন্তু সে মিথ্যা গ্রাম, ম্যালেরিয়া জ্বরের উপদ্রবে অনেক লোক মরিয়া গিয়াছে অনেক লোক ঘরদ্বার ছাড়িয়া পলাইয়া গিয়াছে৷ বাটীর উত্তরদিকে মাঠ, যতদূর দেখিতে পাই, ততদূর মাঠ ধূ ধূ করিতেছে৷
শ্মশানের ন্যায় সেই বাড়িতে গিয়া আমি মনে করিলাম,—ওমা! এ বাড়িতে আমি কি করিয়া থাকিব, ভয়েই মরিয়া যাইব৷
যাহা হউক, যেখানে আমার দিদিমণি, সেখানে সব ভালো,—সেইখানেই আলো,—সেইখানেই সুখ৷ দিদিমণির দৌড়াদৌড়ি, দিদিমণির খেলা, দিদিমণির কথা, দিদিমণির হাসিতে সেই শ্মশানভূমি,—যেন স্বর্গতুল্য হইল৷ এমন যে অলক ঠাকরুণ, যাঁহার গোমড়া মুখ দেখিলে ভয় হয়, দিদিমণিকে দেখিলে তাঁহারও মুখ যেন একটু উজ্জ্বল হইত, তাঁহারও মুখে যেন একটু হাসি দেখা দিত৷ দিদিমণির যেমন রূপ, তেমনি গুণ৷ তেমন ফুটফুটে, দুধে-আলতার রং আমি আর কোনো মেয়ের দেখি নাই৷ কেমন পুরন্ত গাল দুইটি, কেমন ছোট্ট হাঁ-টুকু৷ কেমন টুকটুকে ঠোঁট, কেমন পটল-চেরা ঢুলু ঢুলু উজ্জ্বল চক্ষু, কেমন কাল কাল চক্ষুর পাতা, কেমন সরু সরু চকচকে রেশমের মতো নরম চুল! হা কপাল! সে দিদিমণিকে ছাড়িয়া এখনো আমি প্রাণ ধরিয়া বাঁচিয়া আছি৷ তারপর দিদিমণি যখন কথা কহিত, তখন প্রাণ যেন শীতল হইত, প্রাণের ভিতর দিদি আমার যেন সুধা ঢালিয়া দিত৷
দিদিমণিকে লইয়া আমি সেই স্থানে বাস করিতে লাগিলাম৷ একবার এই সময় ঘোরতর দুর্যোগ করিয়াছিল৷ বাহিরে বাতাস হুহু করিয়া বহিতেছিল৷ দিদিমণিকে লইয়া আমি শুইয়া আছি৷ সহসা বাহির-বাড়িতে বেহালার শব্দ হইল৷ রাত্রি তখন প্রায় দুই প্রহর হইয়াছিল৷ আমি মনে করিলাম যে, এত রাত্রিতে আমাদের বাহির-বাড়িতে বেহালা বাজায় কে? বাহির-বাড়িতে তো কেহ বাস করে না৷
পরদিন আমি বাহির-বাড়িতে গিয়া চারিদিক দেখিলাম৷ জনপ্রাণীকেও সে স্থানে দেখিতে পাইলাম না৷ পোড়ো ভাঙ্গা বাড়ির যেরূপ অবস্থা হয়, বাহির-বাড়ির সেইরূপ অবস্থা হইয়াছিল৷
সেদিন বিলাসীকে একবার একেলা পাইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘বিলাসী, কাল রাত্রিতে বাহির-বাটীতে বেহালা কে বাজাইতেছিল?’
আমার কথা শুনিয়া বিলাসীর মুখ শুষ্ক হইয়া গেল৷ আমতা আমতা করিয়া সে উত্তর করিল,—‘বেহালা! বেহালা আবার কে বাজাইবে? ও বাতাসের শব্দ৷’
বিলাসীর কথায় আমার প্রত্যয় হইল না৷ আমি নিশ্চয় বুঝিলাম যে, সে আমার নিকট কোনো বিষয় গোপন করিতেছে৷
বিলাসী পুনরায় বলিল,—‘যাহা হউক, দিদিমণিকে তুমি সদর-বাড়িতে যাইতে দিয়ো না৷ সাপ-খোপ কি আছে না আছে, কাজ কি ওদিকে গিয়া৷’
আরো কিছুদিন গত হইয়া গেল৷ একবার নয়, আরো অনেকবার আমি সেই বেহালার শব্দ শুনিতে পাইলাম৷ যখনই রাত্রিকালে বাদলা ও দুর্যোগ হয়, তখনি বাহির-বাড়িতে কে যেন প্রাণপণে বেহালা বাজায়৷ কেবল বেহালা নহে, সে বৎসর পূজার সময় মহা-অষ্টমীর রাত্রিতে বাহির-বাড়িতে আমি শাঁক-ঘণ্টারও শব্দ শুনিয়াছিলাম, ধূপ-ধূনার গন্ধও পাইয়াছিলাম৷ বলিদানের সময় যেমন একজন ভক্ত বিকট স্বরে মা মা বলিয়া চিৎকার করে, সে শব্দ শুনিয়াছিলাম৷ এ সমুদয় ব্যাপারের অর্থ কি, তাহা জানিবার নিমিত্ত বৃদ্ধা সহচরীকে, পিতেমকে, বিলাসীকে আমি বার বার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম৷ কিন্তু কেহই আমাকে বলে নাই—‘ও কিছু নয়’, এই কথা বলিয়া সকলে প্রকৃত তত্ত্ব আমার নিকট গোপন করিতে চেষ্টা করিয়াছিল৷
এইরূপে সে স্থানে আমাদের দিন কাটিতে লাগিল৷ কত শতবার আমি সেই বেহালার শব্দ শুনিতে পাইলাম৷ পুনরায় পূজার সময় আসিল৷ মহাষ্টমীর দিন দুই প্রহরের সময় দিদিমণি পিতেম ও বিলাসীর সহিত গ্রামের ভিতর পূজা দেখিতে গিয়াছিল৷ আমি বিদেশী লোক, আমাকে কেহ নিমন্ত্রণ করে নাই, সেজন্য আমি তাহাদের সঙ্গে যাই নাই৷ পূজা দেখিয়া বেলা পাঁচটার সময় দিদিমণি ফিরিয়া আসিল৷ বিলাসী আমাকে বলিল,—‘যদু ভড়ের বাড়ি পূজার এবার খুব ধুম৷ আহা! কি চমৎকার প্রতিমা করিয়াছে৷ আর শামীদিদি, ভড়গিন্নি তোমাকে অনেক করিয়া যাইতে বলিয়াছে৷’
আমি বলিলাম,—‘আচ্ছা, বিলাসী! তবে আমি একবার মাকে দেখিয়া আসি৷ তুই ভাই দেখিস, যেন দিদিমণি কোথাও না যায়৷’
এই কথা বলিয়া আমি ভড়েদের বাড়ি ঠাকুর দেখিতে যাইলাম৷ ভড়গিন্নী আমাকে অনেক আদর করিলেন৷ অনেকগুলি খই-মুড়কি, নারিকেল-সন্দেশ, রসকরা—আরো কত কি আমার কাপড়ে বাঁধিয়া দিলেন৷ ফিরিয়া আসিতে আমার সন্ধ্যা হইয়া গেল৷
দ্বিতীয় অধ্যায় : আয় না ভাই
বাড়ি আসিয়া তাড়াতাড়ি আমি বিলাসীর ঘরে যাইলাম৷ দিদিমণিকে সে স্থানে দেখিতে পাইলাম না৷
বিলাসী বলিল,—‘বোধহয় অলক ঠাকরুণের ঘরে আছে৷’ রুদ্ধশ্বাসে সে ঘরে আমি দৌড়িয়া যাইলাম৷ অলক ঠাকরুণ ও সহচরী দুইজনেই তখন সে ঘরে ছিল৷ দিদিমণিকে দেখিতে না পাইয়া সহচরীকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম৷ সহচরী উত্তর করিলেন,—‘কৈ! সীতা তো এ ঘরে আসে নাই৷’
এই কথা শুনিয়া প্রাণ আমার উড়িয়া গেল৷ পুনরায় আমি বিলাসীর ঘরে যাইলাম৷ কাঁদিতে কাঁদিতে আমি বিলাসীকে তিরস্কার করিতে লাগিলাম৷
বিলাসী কাঁদিতে লাগিল৷ সে বলিল,—‘এইমাত্র আমার ঘরের বারান্দায় সে খেলা করিতেছিল৷ ঘরের ভিতর আমি কাজ করিতেছিলাম৷ বোধ হয়, অন্য কোনো ঘরে সে খেলা করিতেছে৷’
এমন সময় পিতেম আসিয়া উপস্থিত হইল৷ আমার কান্না ও বিলাসীকে ভর্ৎসনার শব্দ শুনিয়া সহচরীও সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন৷ প্রদীপ হাতে লইয়া সকলে মিলিয়া আমরা বাড়ি আঁতিপাতি করিয়া খুঁজিতে লাগিলাম৷ ভিতর-বাড়ি খুঁজিয়া মাঝের বাড়ি, তাহার পর সদরবাড়ির সকল ঘর তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিলাম কিন্তু কোনো স্থানে দিদিমণিকে দেখিতে পাইলাম না৷ মাথা খুঁড়িয়া বুক চাপড়াইয়া আমি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিলাম৷ আমি ভাবিলাম যে, হয় গহনার জন্য দিদিমণিকে কেহ মারিয়া ফেলিয়াছে, কিংবা পুষ্করিণীতে পড়িয়া সে ডুবিয়া গিয়াছে৷ সমস্ত বাড়ি ওলট-পালট করিয়া অবশেষে আমরা বাগান ও পুকুরের ধারগুলি মনোযোগের সহিত দেখিলাম৷ কিন্তু কোনো স্থানে দিদিমণির চিহ্নমাত্র দেখিতে পাইলাম না৷ শেষে পিতেম আমাকে বলিল,—‘তোমাকে দেখিতে না পাইয়া তাহার মন কেমন করিয়াছিল, তোমাকে খুঁজিবার নিমিত্ত নিশ্চয় সে পূজা-বাড়ির দিকে গিয়াছে৷ আমি এখনই তাহাকে আনিতেছি৷’ এই কথা বলিয়া পিতেম গ্রামের দিকে চলিয়া গেল৷
কিন্তু তা বলিয়া আমরা নিশ্চিন্তে থাকিতে পারিলাম না৷ পূর্বেই বলিয়াছি যে, আমাদের বাড়ি ও বাগানের উত্তর দিকে দূর পর্যন্ত মাঠ ছিল৷ দিদিমণিকে খুঁজিবার নিমিত্ত বিলাসী ও আমি সেই মাঠের দিকে যাইলাম৷ মেঘ করিয়াছিল, খুব অন্ধকার হইয়াছিল৷ তাহার উপর এখন আবার বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ হইল৷ কিছুক্ষণ পরে সম্মুখে আমরা একপ্রকার সাদা কি দেখিতে পাইলাম৷ বিলাসীর বড় ভয় হইল৷ সে বলিল,—‘দিদি, ঐ দেখ একটি শাকচুর্ণী আসিতেছে৷ এখনি আমাদের খাইয়া ফেলিবে৷ আর গিয়া কাজ নাই৷ এস, বাড়ি ফিরিয়া যাই৷ এতক্ষণে দিদিমণি বাড়ি আসিয়া থাকিবে৷’
কোনো উত্তর না দিয়া আমি বিলাসীর হাত ধরিলাম, আর সেই সাদা জিনিসের দিকে তাহাকে টানিয়া লইয়া যাইতে লাগিলাম৷ সেও অন্য দিক হইতে আমাদের দিকে আসিতে লাগিল৷ অল্পক্ষণ পরে তাহার সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হইল৷ বিলাসী তাহাকে চিনিতে পারিল৷ সে আমাদের প্রতিবাসী একজন কৃষক! কাপড় ঢাকা তাহার বুকের উপর কি ছিল৷ আমরা কোনো কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে না করিতে সে বলিল,—‘তোমাদের মেয়েটি মাঠের মাঝখানে গাছতলায় অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল৷ কি করিয়া সে মাঠের মাঝখানে আসিয়াছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না৷ আমি দেখিতে পাইয়া এখন তোমাদের বাড়ি লইয়া যাইতেছি৷’
তাড়াতাড়ি দিদিমণিকে আমি তাহার কোল হইতে আপনার কোলে লইলাম৷ কিন্তু দিদিমণির সর্ব শরীরই ঠাণ্ডা দেখিয়া আমার প্রাণ উড়িয়া গেল৷ আমি ভাবিলাম, সে মরিয়া গিয়াছে৷ কাঁদিতে কাঁদিতে আমি তাহার নাকে ও বুকে হাত দিয়া দেখিলাম৷ দেখিলাম যে নাক দিয়া অল্প অল্প নিশ্বাস পড়িতেছে৷ আর বুক অল্প অল্প ধুক-ধুক করিতেছে৷ তাহা দেখিয়া আমার প্রাণে কতকটা আশা হইল৷ তাড়াতাড়ি মাঠ পার হইয়া আমরা বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম৷ অনেক তাপসেঁক করিতে করিতে দিদিমণির চেতনা হইল৷ সেই চন্দ্রমুখে মধুর হাসি দেখা দিল, সুধামাখা দুই একটি কথা দিদিমণির মুখ হইতে বাহির হইল৷ অল্প গরম দুধ আনিয়া সহচরী তাহাকে খাইতে দিলেন৷ তাহার সেই পদ্মচক্ষু দুইটি ঘুমে বুজিয়া গেল৷ সে রাত্রিতে দিদিমণিকে আমরা কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না৷
দূরে মাঠের মাঝখানে একেলা সে কি করিয়া গিয়াছিল, পরদিন সেই কথা দিদিমণিকে আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম৷ দিদিমণি বলিলেন,—‘বারেন্ডায় আমি খেলা করিতেছিলাম৷ তাহার পর যে ঘরে আমার খেলা-ঘর আছে, আমি তাহার ভিতর যাইলাম৷ সেই ঘরের জানলার ধারে যেই দাঁড়াইয়াছি, আর দেখি না ঠিক তাহার নীচেতে বাগানে একটি মেয়ে রহিয়াছে৷ মেয়েটি আমার মতো বড়, কিন্তু খুব সুন্দর৷ উপর দিকে আমার পানে চাহিয়া সে বলিল,—‘সীতা! নেমে আয় না ভাই, আমরা দুইজনে খেলা করি৷’ আমি বলিলাম,—‘না ভাই! এখন আমি নীচে নামিয়া যাইতে পারিব না৷ সন্ধ্যা হইয়াছে, এখন নীচে নামিবার সময় নয়৷ বিলাসী আমাকে বকিবে, তাহার পর শামী আসিয়া আমাকে বলিবে৷ কাল সকালবেলা তুমি আসিও, দুইজনে তখন অনেকক্ষণ খেলা করিব৷’ মেয়েটি বলিল,—‘এখনো তেমন সন্ধ্যা হয় নাই, এখনো অনেক আলো রহিয়াছে৷ এই দেখ আমার মাথা দিয়া রক্ত পড়িতেছে, তবুও দেখ আমি খেলা করিতেছি৷ আয় না ভাই৷’
‘তবুও আমি নামিলাম না৷ নীচে নামিতে মেয়েটি আমাকে বার বার বলিতে লাগিল৷ শেষে সে মাটির উপর বসিয়া পড়িল, বসিয়া হাপুসনয়নে কাঁদিতে লাগিল৷ আমি আর থাকিতে পারিলাম না৷ নীচে নামিয়া বাড়ির বাহির হইয়া আমি তাহার কাছে যাইলাম৷ কিছুক্ষণ বাগানের ভিতর আমরা দুই জনে খেলা করিলাম৷ এক স্থানে অনেকগুলি রজনীগন্ধা ফুল ফুটিয়াছিল, তাহা আমরা তুলিলাম৷ সাদা টগর ফুল ফুটিয়া আর একটি গাছে আলো করিয়াছিল৷ নীচে হইতে যত পারিলাম, সেই টগর ফুলও আমরা তুলিলাম৷ কেমন করিয়া জানি না, তাহার পর বাগান পার হইয়া আমরা মাঠে গিয়া উপস্থিত হইলাম৷ কেমন করিয়া জানি না, সেই মেয়েটির সঙ্গে অনেক পথ চলিয়া ক্রমে মাঠের মাঝখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম৷ সে স্থানে একটি গাছ ছিল৷ সেই গাছতলায় একটি মেয়েমানুষ বসিয়া কাঁদিতেছিল৷ আমার মাকে স্বপ্নের ন্যায় আমার মনে পড়ে৷ সে মেয়েমানুষটি ঠিক আমার মায়ের মতো৷ সেই রকম রং, সেই রকম মুখ, সেই রকম চুল, সেই রকম কথা৷ আদর করিয়া তিনি আমাকে কোলে লইলেন, আমার মুখে তিনি কত চুমা খাইলেন৷ কোলে বসাইয়া আমার মাথায় তিনি হাত বুলাইতে লাগিলেন৷ তাহার পর কি হইল, আর আমার মনে নাই৷’
তৃতীয় অধ্যায় : বালিকা ভূত
দিদিমণির এই কথা শুনিয়া সহচরী পিতেমকে চক্ষু টিপিলেন৷ তাহার পর তিনি বিলাসীর গা টিপিলেন৷ ইহার মানে আমি কিছু বুঝিতে পারিলাম না৷ আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘সে মেয়েটি কে? সে তো বড় দুষ্ট মেয়ে দেখিতেছি৷ তাহাকে আর বাগানে আসিতে দেওয়া যাইবে না৷’
আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়া সহচরী বলিলেন,—‘এ বিষয় অলক ঠাকরুণকে জানাইতে হইবে৷ তিনি যেরূপ বলেন, সেইরূপ করিতে হইবে৷’ এই কথা বলিয়া সহচরী সে ঘর হইতে চলিয়া গেলেন৷ কিছুক্ষণ পরে তিনি আমাকে, পিতেমকে ও বিলাসীকে অলক ঠাকরুণের ঘরে ডাকিতে পাঠাইলেন৷ দিদিমণিকে কোলে লইয়া আমি পিতেম ও বিলাসীর সঙ্গে সেই ঘরে যাইলাম৷ অলক ঠাকরুণ থুড়থুড়ে বুড়ি হইয়াছিলেন৷ তিনি অধিক কথা বলিতে পারিতেন না৷ তাঁহার হইয়া সহচরী আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন,—‘অলক ঠাকরুণ তোমাকে বলিতে বলিলেন যে, সে মেয়েটি মানুষ নহে৷ তাহার মা, যাঁহাকে সীতা গাছতলায় দেখিয়াছিল, তিনি অলক ঠাকরুণের ভাইঝি, সীতার মাসি৷ অনেকদিন হইল তিনি ও তাঁহার কন্যা অপঘাত-মৃত্যুতে মরিয়া গিয়াছেন৷ তাঁহাদের গতি হয় নাই, যখন তাঁহারা এরূপ হইয়া আছেন৷ তাঁহারা সর্বদা, বিশেষত ঝড় বাতাস বাদলার দিনে, আর এই পূজার সময়, বাড়ির চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ান৷ পিতেম, বিলাসী আর তুমি শামী, তোমাদের সকলকে অলক ঠাকরুণ বলিতেছেন যে, সীতাকে তোমরা খুব সাবধানে রাখিবে, নিমিষের নিমিত্ত তোমরা তাহাকে চক্ষের আড় করিবে না৷ সে মেয়েটা এবার যদি সীতাকে ভুলাইয়া লইয়া যায়, তাহা হইলে আর তোমরা সীতাকে পাইবে না৷’
এই কথা শুনিয়া আমার আত্মাপুরুষ উড়িয়া গেল৷ কি করিয়া মেয়েকে ভূতের হাত হইতে বাঁচাইব, সেই ভাবনায় আমি আকুল হইয়া পড়িলাম৷ তোমার মামার তখনো কর্ম-কাজ হয় নাই, এক দিন গিয়া দাঁড়াই, এক বেলা এক মুঠা কেহ যে ভাত দেয়, এমন স্থান ছিল না৷ কাদায় গুণ ফেলিয়া দিদিমণিকে লইয়া কাজেই আমাকে সেই ভয়ানক বাড়িতে থাকিতে হইল৷ কিন্তু সেই দিন হইতে দিদিমণিকে আমরা নিমিষের জন্যও চক্ষুর আড় করিতাম না৷ হয় আমি, না হয় বিলাসী, না হয় পিতেম, কেহ না কেহ সর্বদা তাহার কাছে থাকিত৷ কিন্তু মাঝে মাঝে জানালার দ্বারে দাঁড়াইয়া দিদিমণি আমাদিগকে বলিত,—‘ঐ সেই মেয়েটি আসিয়াছে, ঐ আমাকে হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে৷ শামী, তুই আমাকে সুন্দর বলিস, কিন্তু ওর পানে একবার চাহিয়া দেখ৷ আহা! কি চমৎকার রূপ৷ কেবল ওর পানে চাহিয়া থাকিতে ইচ্ছা করে, অন্যদিকে চক্ষু ফিরাইতে ইচ্ছা করে না৷ ঐ দেখ, আবার আমাকে ডাকিতেছে৷ আমি যাইতেছি না বলিয়া আহা! মেয়েটি ঐ দেখ, কতই না কাঁদিতেছে৷ তাহার কাপড় সে আমাকে দেখাইতেছে, তাহার কাপড় ভিজিয়া গিয়াছে, টস টস করিয়া তাহার কাপড় হইতে জল পড়িতেছে৷ এ আবার কি? হাত দিয়া সে আপনার মাথা আমাকে দেখাইতেছে৷ আহা! মেয়েটির মাথায় কে মারিয়াছে, মাথা হইতে গাল বাহিয়া রক্ত পড়িতেছে৷ শামী! একবার আমাকে ছাড়িয়া দে৷ আমি উহার কাছে যাই, উহাকে বাড়ির ভিতর ডাকিয়া আনি৷ তুই উহার মাথায় ঔষধ দিয়া দিবি৷ আমার ঐ কাপড়খানি আমি উহাকে পরিতে দিব৷ যাই ভাই, যাই!’
এইরূপ বলিলে তাড়াতাড়ি আমি তোমার মাকে গিয়া কোলে লইতাম৷ উপর হইতে বাগানের দিকে আমি চাহিয়া দেখিতাম, কিন্তু আমি কিছু দেখিতে পাইতাম না৷ কি করিব! ঘরের দ্বার-জানালা বন্ধ করিয়া মেয়েকে কোলে লইয়া, ভয়ে জড়সড় হইয়া আমি বসিয়া থাকিতাম৷
এইরূপে অতি কষ্টে আমরা সেই বাড়িতে দিনপাত করিতে লাগিলাম৷ পুনরায় পূজার সময় আসিল৷ এই সময় দিদিমণি সেই মেয়েটাকে ঘন ঘন দেখিতে লাগিল৷ বাগানের দিকে জানালা এখন আমি সর্বদাই বন্ধ করিয়া রাখিতাম৷ তথাপি দিদিমণি বলিত,—‘শামী! জানালা খুলিয়া দে৷ মেয়েটি নীচে আসিয়াছে, সে আমাকে ডাকিতেছে৷ শামী! তোর পায়ে পড়ি, একবার জানালা খুলিয়া দে, একবার তাহাকে আমি দেখি৷’
মহাষ্টমীর দিন মেয়েকে লইয়া আমি বড়ই বিব্রত হইলাম৷ সেদিন ভয়ানক দুর্যোগ হইয়াছিল৷ সীতাকে কোলে লইয়া আমি ঘরে বসিয়া ছিলাম৷ এখন আর বাহিরে নয়, সেদিন দিদিমণি সেই মেয়েটিকে বাড়ির ভিতরেই দেখিতে লাগিল৷ আমি দ্বার বন্ধ করিয়া ছিলাম, তথাপি দিদিমণি বলিতে লাগিল,—‘ও শামী! মেয়েটি আজ বাড়ির ভিতর আসিয়াছে, ঘরের বাহিরে আমাদের ঘরের নিকট দাঁড়াইয়া আছে৷ ছাড়িয়া দে শামী! আমি একবার তাহার কাছে যাই৷ একবার তাহাকে না দেখিলে মরিয়া যাইব৷’
এই বলিয়া দিদিমণি হাপুসনয়নে কাঁদিতে লাগিল৷ কি যে করি, তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না৷ মেয়ে লইয়া আমি অলক ঠাকরুণের ঘরে যাইলাম৷ সে স্থানে সহচরী উপস্থিত ছিলেন৷ আমি বলিলাম—‘আজ বাছা, আমাদের খাওয়া দাওয়াতে কাজ নাই৷ সকলে মিলিয়া এস, আজ আমরা মেয়েকে ঘিরিয়া বসিয়া থাকি৷ তা না করিলে, দিদিমণিকে আজ আমরা বাঁচাইতে পারিব না, সেই দুষ্ট মেয়েটা আসিয়া দিদিমণিকে নিশ্চয় আজ লইয়া যাইবে৷’
সহচরী অলক ঠাকরুণকে সকল কথা বলিলেন৷ অলক ঠাকরুণ আমার কথায় সম্মত হইলেন৷ পিতেম ও বিলাসীকে ডাকিয়া দ্বার-জানালা বন্ধ করিয়া দিদিমণিকে ঘিরিয়া, সকলে আমরা অলক ঠাকরুণের ঘরে বসিয়া রহিলাম৷
বলা বাহুল্য যে, ইতিপূর্বে এই বিড়ম্বনা নিবারণের জন্য অনেক প্রতিকার করা হইয়াছিল৷ গয়াতে পিণ্ড দেওয়া হইয়াছিল, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা হইয়াছিল, রোজা আনিয়া ঝাড়ান ও ভূত নামানো হইয়াছিল, দিদিমণির অষ্টাঙ্গে কবচ, মাদুলি ও নেকড়ার পুঁটুলি বাঁধা হইয়াছিল৷ কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নাই৷
চতুর্থ অধ্যায় : বিষম মহাষ্টমী
সকলে ঘিরিয়া রহিলাম বটে, কিন্তু সেই মহাষ্টমীর সমস্ত দিন দিদিমণি বড়ই ছটফঠ করিয়াছিল৷ ‘ঐ সেই মেয়েটি আসিতেছে, সে আমাকে ডাকিতেছে, তাহার কাপড় ভিজিয়া গিয়াছে, তাহার মাথা দিয়া রক্ত পড়িতেছে দাও আমাকে ছাড়িয়া দাও, আমি তাহার কাছে যাই৷’ এই বলিয়া দিদিমণি বার বার কাঁদিতেছিল, আর আমার কোল হইতে উঠিয়া আমার হাত ছাড়াইয়া বার বার বাহিরে পলাইতে চেষ্টা করিতেছিল৷ অতি কষ্টে আমি তাহাকে ধরিয়া রাখিতেছিলাম৷
সন্ধ্যার পর দিদিমণি ঘুমাইয়া পড়িল৷ আমি ভাবিলাম যে, এইবার বুঝি আমাদের বিপদ কাটিয়া গেল, আর বুঝি কোনো উপদ্রব হইবে না৷ কিন্তু আমরা কেহ নিদ্রা যাইলাম না, ঘরে দুইটা আলো জ্বালাইয়া সকলে জাগিয়া বসিয়া রহিলাম৷
রাত্রি প্রায় দুই প্রহর হইয়াছে৷ এমন সময় সহসা বাহির-বাটীতে সেই বেহালা বাজিয়া উঠিল৷ কেবল বেহালা নহে, তাহার সঙ্গে ঢাক-ঢোল, শাঁক-ঘণ্টা কাঁসর-ঘড়িও বাজিয়া উঠিল৷ সেই সকল বাজনা ছাপাইয়া বলিদানের সেই ভয়ানক মা মা চিৎকারে আমাদের যেন কানে তালা লাগিতে লাগিল, আতঙ্কে আমাদের প্রাণ শিহরিয়া উঠিল, ভয়ে আমাদের শরীর রোমাঞ্চ হইয়া উঠিল৷ হতভোম্বা হইয়া আমরা বসিয়া আছি, এমন সময় ধড়মড় করিয়া দিদিমণি উঠিয়া বসিল৷ আমরা কিছু বলিতে না বলিতে চোঁৎ করিয়া সে দ্বারের নিকট গিয়া খিল খুলিয়া ফেলিল৷ তাহার পর আমরা তাহাকে ধরিতে না ধরিতে রুদ্ধশ্বাসে বাহির-বাড়ির পূজার দালানের দিকে সে দৌড়িল৷ ‘ও মা, কি হইল, সর্বনাশ হইল৷’ এই কথা বলিতে বলিতে অলক ঠাকরুণ ছাড়া আর সকলেই আমরা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িলাম৷ কিন্তু তাহাকে ধরিতে পারিলাম না৷ দিদিমণি আমাদের আগে আগে গিয়া বাহির-বাড়ির পূজার দালানে গিয়া উপস্থিত হইল৷ সে স্থানের অদ্ভুত ব্যাপার দেখিয়া আমরা জ্ঞানহারা হইলাম৷ এখন আর সে ভাঙ্গা জনশূন্য বাড়ি নাই৷ খুব ধুমধামের দুর্গোৎসব হইলে যেরূপ হয়, সে স্থানে এখন সেইরূপ হইয়াছে৷ দালানের মাঝখানে প্রতিমা রহিয়াছে—বৃহৎ প্রতিমা, নানা সাজে সুসজ্জিত৷ প্রতিমার চারিদিকে নৈবেদ্য প্রভৃতি পূজার আয়োজন রহিয়াছে৷ সম্মুখে পুরোহিতগণ বসিয়া আছেন৷ এক পার্শ্বে একজন চণ্ডীপাঠ করিতেছেন৷ সম্মুখের প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য হইয়াছে, ধূপ-ধূনার গন্ধে চারিদিক আমোদিত হইয়া আছে৷ দালানে, উঠানে, সকল স্থানে ঝাড়লণ্ঠন জ্বলিতেছে৷ ফল কথা, এমন ধুমধামের পূজা আমি কখন দেখি নাই৷
দিদিমণি কাহারও প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া দালান পার হইয়া দালানের পূর্বদিকে চলিয়া গেল৷ ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে আমরাও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম৷ দালানের পূর্বদিকে একটি ঘর ছিল৷ সেই ঘরের ভিতর তক্তাপোষের উপর একজন বৃদ্ধ বসিয়া ছিলেন৷ তাঁহার বামহাতে বেহালা, আর দক্ষিণ হাতে যা দিয়া বাজায় তাই ছিল৷ একটি পরমা সুন্দরী স্ত্রীলোক মাটিতে বসিয়া বৃদ্ধের পা দুইখানি ধরিয়া কি বলিতেছেন৷ সেই স্ত্রীলোকের পার্শ্বে সাত আট বৎসরের এক বালিকা দাঁড়াইয়া ছিল৷
দিদিমণি বরাবর গিয়া সেই ঘরের দ্বারে এক পার্শ্বে দাঁড়াইল৷ খপ করিয়া আমি গিয়া দিদিমণির হাত ধরিয়া ফেলিলাম৷ তাহার পর আমরা সকলেই সেই দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া রহিলাম৷
যে স্ত্রীলোক বৃদ্ধের পা ধরিয়া ছিলেন, তিনি এখন কাঁদ-কাঁদ মৃদু মধুর স্বরে বলিলেন,—‘বাবা, অপরাধ করিয়াছি সত্য! কিন্তু আমি তোমার কন্যা৷ শত অপরাধ করিলেও কন্যাকে ক্ষমা করিতে হয়! এই মেয়েটিকে লইয়া আমি এখন কোথায় যাই৷’
বৃদ্ধ অতি নিষ্ঠুর ভাষায় বলিলেন,—‘আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি যে, তোর আমি মুখ দেখিব না৷ কালামুখ লইয়া এ বাড়ি হইতে এখনই দূর হইয়া যা৷’
স্ত্রীলোক উত্তর করিলেন,—‘বাবা! আমি কোনোরূপ দুষ্কর্ম করি নাই, স্বামীর ঘরে গিয়াছি, এই মাত্র৷’
বৃদ্ধ বলিলেন,—‘তুই দূর হ, আমার সম্মুখ হ’তে দূর হ৷’ স্ত্রীলোকটি অবশেষে বলিলেন, ‘আচ্ছা বাবা, আমি দুর হইতেছি, কিন্তু আমার কন্যাটি তো কোনো অপরাধ করে নাই! ইহাকে আমি তোমার নিকট রাখিয়া যাইতেছি৷ পাতের হাতের দুইটি ভাত দিয়া ইহাকে প্রতিপালন করিও৷’
সেই কথা শুনিয়া বৃদ্ধ আরো জ্বলিয়া উঠিলেন,—‘তোর ঝাড় আমার এ বাড়িতে থাকিতে পারিবে না৷ দূর দূর, এখনি দূর হ৷’
স্ত্রীলোক ও তাহার কন্যা সত্বর দূর হইতেছে না, তাহা দেখিয়া বৃদ্ধ রাগে অন্ধ হইয়া পড়িলেন৷ ধৈর্য ধরিতে না পারিয়া তিনি সেই বেহালার বাড়ি কন্যার মাথায় মারিয়া বসিলেন৷ কন্যার মাথা হইতে দর দর ধারায় রক্ত পড়িতে লাগিল৷ গাল বাহিয়া সেই রক্ত মাটিতে পড়িল৷
এই নিষ্ঠুর ব্যবহার দেখিয়া সেই স্ত্রীলোক তখন উঠিয়া দাঁড়াইলেন৷ চক্ষু দিয়া তাঁহার যেন আগুনের ফিনকি বাহির হইতে লাগিল৷ তিনি বলিলেন,—‘বাবা! তুমি এ কাজ করিলে!!! যাহা হউক, আমি তোমাকে কিছু বলিব না৷ কিন্তু আজ হইতে তোমার লক্ষ্মী ছাড়িল৷’
এই কথা বলিয়া মেয়েটির হাত ধরিয়া স্ত্রীলোকটি সেই ঘর হইতে বাহির হইলেন৷ তাহার পর দালানের ভিতর দিয়া উঠানে গিয়া নামিলেন৷ তাহার পর উঠান পার হইয়া বাড়ির বাহিরে চলিয়া গেলেন৷
যেই তিনি বাড়ির বাহির হইলেন, আর বৃদ্ধ ভয়ানক চিৎকার করিয়া সেই তক্তপোষের উপর শুইয়া পড়িলেন৷ সেই সময় ঝাড়লণ্ঠন সব নিবিয়া গেল৷ প্রতিমা, পুরোহিত, লোকজন সব অদৃশ্য হইয়া পড়িল৷ ঢাকঢোলের কলরব সব থামিয়া গেল৷
অন্ধকারে আমি পিতেমের কথা শুনিতে পাইলাম৷ পিতেম বলিল,—‘শামী! সীতা তোমার কাছে আছে?’
আমি উত্তর করিলাম,—‘হ্যাঁ, আমি তাহাকে ধরিয়া আছি৷’
পিতেম পুনরায় বলিল,—‘তবে চল, ঘরে চল৷’
পঞ্চম অধ্যায় : পূর্ব-বিবরণ
সকলে পুনরায় অলক ঠাকরুণের ঘরে যাইলাম৷ সীতা তৎক্ষণাৎ ঘুমাইয়া পড়িল৷ সে রাত্রিতে আর কোনো উপদ্রব হইল না৷
কিন্তু সে রাত্রিতে আমাদের নিদ্রা হইল না৷ আমরা সকলে বসিয়া রহিলাম৷ পিতেম তখন আমাকে সকল কথা বলিল৷ পিতেম বলিল—
‘ঐ যে বৃদ্ধ দেখিলে, উনি বাড়ির কর্তা ছিলেন৷ উঁহার নাম জগমোহন রায়চৌধুরী ছিল৷ উনি বড় দুর্দান্ত লোক ছিলেন৷ একবার যাহা বলিতেন তাহাই করিতেন, তা সে ভালোই হউক আর মন্দই হউক৷ পৃথিবীতে তাঁহার কেবল একটি শখ ছিল৷ বেহালা বাজাইতে তিনি বড় ভালোবাসিতেন৷ সময় নাই, অসময় নাই, সর্বদাই তিনি বেহালা বাজাইতেন৷ বিশেষত ঝড় বাতাস বাদলার রাত্রিতে তাঁহার শখটি কিছু প্রবল হইত৷ অলক ঠাকরুণ তাঁহার ভগিনী৷ জগমোহন রায়ের এক পুত্র ও দুই কন্যা ছিল৷ পুত্র সীতার মামা, যিনি এখন পশ্চিমে কাজ করেন৷ বড় কন্যার নাম ছিল রামমণি, যাঁহার ভূতকে সীতা মাঠের মাঝখানে গাছতলায় দেখিয়াছিল৷ ছোট মেয়ের নাম ছিল তারামণি, তিনি সীতার মা৷ রায়চৌধুরী বড়মানুষ লোক, কোন পুরুষে কন্যা শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতেন না৷ কিন্তু রামমণির এক তেজস্বী পুরুষের সহিত বিবাহ হইয়াছিল৷ তিনি বলিলেন যে—‘ঘর-জামাই হইয়া আমি কিছুতেই থাকিব না৷’ আপনার স্ত্রীকে তিনি নিজের বাড়ি লইয়া যাইতে চাহিলেন৷ কিন্তু কর্তা কিছুতেই সম্মত হইলেন না৷ শ্বশুর-জামাতায় ঘোর বাদ-বিসম্বাদ বাধিয়া গেল৷ অবশেষে কর্তা এক দিন রামমণিকে ডাকিয়া জামাতার সমক্ষে জিজ্ঞাসা করিলেন,—‘তুমি ইহাকে চাও—না আমাকে চাও৷’ রামমণি উত্তর করিলেন,—‘বাবা! তুমি পিতা বটে, কিন্তু স্ত্রীলোকের পতিই সর্বস্ব৷’ এই উত্তর শুনিয়া কর্তা ঘোরতর রাগিয়া উঠিলেন৷ তিনি বলিলেন,—‘বটে! তবে এখনি আমার বাড়ি হইতে দূর হও৷ আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আজ হইতে আমি তোমার মুখ দেখিব না৷’ রামমণি শ্বশুরালয়ে গমন করিলেন৷ নয় দশ বৎসর স্বামীর ঘর করিলেন৷ তাঁহার একটি কন্যা হইল৷ সে কন্যাটির ভূত সীতাকে মাঠে লইয়া গিয়াছিল৷ নয় দশ বৎসর পরে রামমণির স্বামীর মৃত্যু হইল৷ পরিবার প্রতিপালনের নিমিত্ত তিনি একটি পয়সাও রাখিয়া যান নাই৷ রামমণি ঘোর বিপদে পড়িলেন৷
পিতাকে কয়েকখানি পত্র লিখিলেন৷ পিতা কোনো উত্তর দিলেন না৷ অবশেষে ভাবিলেন,—‘পূজার সময় লোকের মন নরম হয়৷ এই পূজার সময় বাবার পায়ে গিয়া পড়ি, তাহা হইলে তিনি বোধ হয় ক্ষমা করিবেন৷’ পূজার সময় কন্যাকে লইয়া রামমণি পিতার বাটীতে আসিলেন৷ তাহার পর তোমরা এইমাত্র যাহা দেখিলে, অষ্টমীর দিন সত্য সত্যই সেই সমুদয় ঘটনা ঘটিয়াছিল৷ কন্যার হাত ধরিয়া রামমণি চলিয়া গেলেন৷ পক্ষাঘাত রোগ হইয়া কর্তা তৎক্ষণাৎ মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন৷ অল্পক্ষণ পরে তুমুল ঝড় উঠিল, সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল৷ পরদিন সকলে দেখিল যে, রামমণি ও তাঁহার কন্যা দুইজনেই মাঠের মাঝখানে গাছতলায় মরিয়া পড়িয়া আছেন৷ কর্তা আরো কয়েক মাস জীবিত ছিলেন৷ কিন্তু সেই দিন হইতেই আর তিনি কথা কহিতে পারেন নাই, কি উঠিয়া বসিতে পারেন নাই৷ সেই তাঁহার লক্ষ্মী ছাড়িয়া গেল৷ জমিদারী, টাকাকড়ি কিরূপে কোথায় যে উড়িয়া গেল, তাহা কেহ বলিতে পারে না৷ ঘরজামাই রাখার অহঙ্কারও সেই সঙ্গে দূর হইল৷ সেজন্য সীতার মাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতে আর কোনো আপত্তি রহিল না৷ কর্তা রামমণি ও তাঁহার কন্যা—তিনজনেই এখন ভূত হইয়া আছেন৷ কতবার গয়াতে পিণ্ড দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু কোনো ফল হয় নাই৷’’
পরদিন প্রাতঃকালে আমি ভাবিলাম যে, ভিক্ষা করিয়া খাইতে হয়, সেও স্বীকার তবু সীতাকে লইয়া সে বাড়িতে আর আমি থাকিব না৷ সীতার ভাই, তোমার মামাকে আমি পত্র লিখিলাম৷ ভাগ্যক্রমে এই সময় তাঁহার একটি কর্ম হইয়াছিল৷ তিনি আসিয়া আমাকে ও সীতাকে তাঁহার নিজের বাড়িতে লইয়া গেলেন৷ কিছুদিন পরে সীতার বিবাহ হইল৷ তাহার পর তুমি ও প্রভা হইলে৷ কিছুদিন পরে তোমার পিতার কাল হইল৷ অল্পদিন পরে দিদিমণিও তাঁহার সঙ্গে স্বর্গে গেলেন৷ দিদিমণিকে হারাইয়া কি করিয়া আমি যে প্রাণ ধরিয়া আছি তাহাই আশ্চর্য৷ যাহাহউক, তোমাদের দুইজনকে পাইয়া আমি শোক অনেকটা নিবারণ করিতে পারিয়াছি৷ মা দুর্গা তোমাদিগকে আর যত ছেলেপিলেকে বাঁচাইয়া রাখুন৷