পূজারি বামুন বা পুরোহিত

পূজারি বামুন বা পুরোহিত 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

একটা চুরির মালায় সমস্ত দিন কঠোর পরিশ্রম করিয়া যখন থানায় ফিরিয়া আসিলাম, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। আহারাদির পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিতেছি, এমন সময়ে একজন কনেষ্টবলের সহিত এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ আমার নিকটে উপস্থিত হইলেন। 

ভয়ানক পরিশ্রমে ক্লান্ত হইয়া আমি চক্ষু মুদ্রিত করিয়া বিশ্রামসুখ লাভ করিতেছিলাম, সহসা গৃহমধ্যে কাহার পদশব্দ শুনিয়া চক্ষু উন্মীলন করিলাম। দেখিলাম, এক ব্রাহ্মণ, বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ ও হৃষ্টপুষ্ট। কিন্তু তাঁহার দেহের মাংস শিথিল হইয়া পড়িয়াছে, চক্ষু কোটরগ্রস্ত হইয়াছে, তাহার নিম্নে কালিমা-রেখা পড়িয়াছে, ললাট প্রশস্ত কুঞ্চিত ও চিন্তারেখা-সমন্বিত, মস্তক মুণ্ডিত, কেবল মধ্যে একগুচ্ছ কেশ শিখাকারে বৃদ্ধের পৃষ্ঠে লম্বমান। নাসিকা ও ললাটে সিন্দুর-রেখা। গলে ও হস্তে রুদ্রাক্ষ মালা! পরিধানে কাশের বস্ত্র – লাল চেলি। সৰ্ব্বাঙ্গ এক পট্টবস্ত্রে আবৃত। 

— 

গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বৃদ্ধ “বাবু” “বাবু” বলিয়া আমার মনোযোগ আকর্ষণ করিলেন এবং আমি চক্ষু উন্মীলন করিয়ামাত্র বদ্ধাঞ্জলি হইয়া অতি বিনীত ভাবে বলিলেন “মহাশয়! আমার কোন গোপনীয় কথা আছে। এখানে এই সমস্ত লোকের সাক্ষাতে সে কথা বলিতে পারিব না। যদি দয়া করিয়া আমার সহিত একবার বাহিরে আসেন, তাহা হইলে অত্যন্ত উপকৃত হই।” 

সমস্ত দিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর বিশ্রাম করিতেছিলাম; বৃদ্ধের কথা শুনিয়া আন্তরিক বিরক্ত হইলাম। ভাবিলাম, জগদীশ্বর আমার অদৃষ্টে আজ বিশ্রামসুখ লিখেন নাই। প্রকাশ্যে বলিলাম “বাহিরে যাইবার প্রয়োজন কি? আমি ইহাদিগকে এখান হইতে বিদায় করিয়া দিতেছি। সকলে প্রস্থান করিলে পর তোমার কি কথা তাহা বলিতে কোন আপত্তি আছে?” 

বৃদ্ধ কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিলেন, পরে বলিলেন “যদি নিতান্ত না আসিতে পারেন, তবে তাহাই হউক। কিন্তু বাহিরে আসিলে ভাল হইত। বড় গোপনীয় কথা, অপরের কর্ণ গোচর হইলে আমার সর্ব্বনাশ হইবে।” 

আমি আর দ্বিরুক্তি করিলাম না। সে ঘর হইতে বাহির হইয়া অপর একটি নির্জ্জন গৃহে প্রবেশ করিলাম। ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলাম এখানে বলিতে কোন আপত্তি আছে কি না? 

ঘরটি সত্য সত্যই অতি নিৰ্জ্জন; সেদিকে অপর কোন লোকের যাইবার প্রয়োজন হয় না। ব্রাহ্মণ ওই স্থানে তাঁহার মনের কথা বলিতে সম্মত হইলেন। 

উভয়ে একখানি বেঞ্চের উপর উপবেশন করিলে ব্রাহ্মণ পুনরায় বদ্ধাঞ্জলি হইয়া অতি নম্রস্বরে বলিলেন “অসময়ে আপনার বিশ্রামে বাধা দিয়া অতি গর্হিত কাৰ্য করিয়াছি; তজ্জন্য অধীনকে ক্ষমা করিবেন। কিন্তু আমার সর্ব্বনাশ হয় বলিয়াই আমি এ সময়ে আসিতে সাহস করিয়াছি। আমার নাম রামচন্দ্র; আমি-স্থানের কালীমন্দিরের প্রধান পুরোহিত।” 

আমি সেই মন্দিরের সম্বন্ধে অনেক সুখ্যাতি শুনিয়াছিলাম। প্রবাদ আছে, মন্দিরের কালী জাগ্রত। সেখানকার পুরোহিতের দোর্দণ্ড প্রতাপ। তাঁহারা যাহা ইচ্ছা তাহাই করিয়া থাকেন। 

ব্রাহ্মণের কথা শুনিয়া, এবং তাঁহাকে সেখানকার প্রধান পুরোহিত জানিয়া আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। বলিলাম “আমি সেই মন্দিরের নাম শুনিয়াছি, কিন্তু কখনও চক্ষে দেখি নাই। আপনি যদি সেখানকার প্রধান পুরোহিত, তবে সেইমত পোষাক পরিধান করেন নাই কেন? শুনিয়াছি, মায়ের পুরোহিতগণের পোষাক সন্ন্যাসীর মত।” 

ব্রাহ্মণ সবিস্ময়ে উত্তর করিলেন “আপনি একথা শুনিলেন কোথা হইতে? যাহাই হউক, আমরা যতক্ষণ মন্দিরে থাকি, ততক্ষণই আমাদের বেশ সন্ন্যাসীর মত থাকে। কিন্তু যখন কোন কার্য্যের জন্য বাহিরে যাইতে বাধ্য হই, তখন কাশেয়বস্তু ও উত্তরীয় লইয়া থাকি।” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “এ পদ্ধতি কে প্রচলন করিল? আপনি কতকাল ওই মন্দিরে পুরোহিতের কার্য্য করিতেছেন?” 

ব্রা। প্রায় সাত বৎসর। কে যে এই নিয়ম প্রচলিত করিয়াছেন, তাহা বলিতে পারি না। 

আ। এখন আপনি যে জন্য আসিয়াছেন, তাহা বলুন? 

ব্রাহ্মণ কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন, পরে বলিলেন “আমার সর্ব্বনাশ উপস্থিত। আজ হউক, কাল হউক কিম্বা দুইদিন পরেই হউক, শীঘ্রই আমার মৃত্যু হইবে।” 

আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কেন, আপনি এমন হতাশ হইয়াছেন কি জন্য? কি হইয়াছে, পরিষ্কার করিয়া বলুন? সকল কথা জানিতে না পারিলে আমি আপনার কোন উপকার করিতে পারিব না।”

ব্রাহ্মণ একখানি পত্র বাহির করিলেন এবং উহা আমার হস্তে দিলেন। বলিলেন,–”আজ প্রাতে আমি এই পত্রখানি একখানি চাপাটীর ভিতর পাইয়াছি। আপনি একবার পড়িয়া দেখুন, তাহা হইলেই আমার কি সর্বনাশ হইতেছে জানিতে পারিবেন।” 

পত্রখানি গ্রহণ করিয়া আমি পাঠ করিলাম। উহাতে লেখা ছিল,–”কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী তিথিতে রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় সেই পার্চমেন্ট কাগজখানি লইয়া সতী পাথরের নিকট আসিতে চাও। সাবধান, যেন সঙ্গে অপর কোন লোক না থাকে। নির্দিষ্ট দিন ও সময় যেন স্মরণ থাকে, নতুবা তুমি স্বয়ং বিপদে পড়িবে।” 

কাগজখানি পাঠ করিয়া আমি বিস্ময়াপন্ন হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম “কে এই পত্র পাঠাইয়াছে বলিতে পারেন?” ব্রা। আজ্ঞে না, পত্রের নিম্নে কোন স্বাক্ষর নাই। আর হস্তলিপিও আমার পরিচিত নহে। 

আ। পত্রে যে পার্চমেন্ট কাগজের কথা লেখা আছে সেই পার্চমেন্টখানিই বা কি? আপনি সে সম্বন্ধে যাহা জানেন, আমায় পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়া দিন। 

ব্রাহ্মণ অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিলেন “সমস্ত কথা ব্যক্ত করিতে হইলে আমাকে প্রথম হইতে বলিতে হয়। যদি তাহাতে আপনার সময় নষ্ট হইতেছে বলিয়া বোধ হয়, তাহা হইলে যে অংশ আপনার শুনিতে বাসনা হইয়াছে, আমি সেই অংশই বলিতে পারি।” 

আমি প্রথম হইতে সমস্ত কথা আদ্যোপান্ত শুনিতে ইচ্ছা করিলাম। তাহাতে আগন্তুক ব্রাহ্মণ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন, এবং অতি বিনীত ভাবে বলিলেন “প্রায় তিন শত বৎসর অতীত হইল, একজন প্রধান জমীদার মায়ের মূর্তি স্থাপনার জন্য অনেক অর্থ দিয়া যান। তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই সেই মন্দির নির্ম্মিত ও মহামায়ার মূর্তি স্থাপিত হইয়াছিল। যতকাল এখানে হিন্দুদিগের প্রাধান্য ছিল, ততকাল এই মন্দিরের কার্য্য অতি সুচারুরূপে সম্পন্ন হইত। কিন্তু মুসলমানদিগের আমলে ইহার ধ্বংসের সূত্রপাত হয়। স্থানীয় মুসলমান শাসন-কর্তা মন্দিরের সুখ্যাতি শুনিয়া সদলবলে আক্রমণ করেন এবং নগদ ও অনেক মূল্যবান সামগ্রী লইয়া যান। কেবল অর্থ লইয়াই যে তিনি সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন তাহা নহে, তিনি মায়ের অনেক সেবককে মুসলমান-ধর্ম্মে দীক্ষিত করিয়াছিলেন। যখন এই ঘটনা হয়, তখন আমারই বৃদ্ধ প্রপিতামহ বাসুদেব সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। তিনি মন্দিরের এই প্রকার অবস্থা দেখিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হন এবং আপনার পৌরোহিত্য ত্যাগ করিয়া প্রকৃত সন্ন্যাসধর্ম্ম গ্রহণ করিতে কৃতসংকল্প হন।” 

এই সময় আমি ব্রাহ্মণকে বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “পুরোহিত নির্ব্বাচনের কাজ কাহার উপর ছিল?” ব্রা। প্রধান পুরোহিতই আপনার উত্তরাধিকারী স্থির করিতেন এবং এখনও করিয়া থাকেন। এখন অপরাপর পুরোহিতদিগের মধ্যে কোন লোক প্রধান পুরোহিতের পদে নিযুক্ত হইবামাত্র অনেকেই তাঁহার উত্তরাধিকারী মনোনীত করিয়া থাকেন। কারণ যদি সহসা তাঁহার মৃত্যু হয়, তাহা হইলে কে তাঁহার পদে উন্নীত হইবেন, এই লইয়া মহা আন্দোলন হইয়া থাকে। সেই কারণেই তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করিতেন। প্রধান পুরোহিতের মৃত্যু হইলে, উত্তরাধিকারী স্বয়ং সেই পদে প্রতিষ্ঠিত হন এবং সত্বর আপনার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এ পর্যন্ত অন্য কোন লোক এই পদের জন্য গোলযোগ করেন নাই। আমার বৃদ্ধ প্রপিতামহ বাসুদেব মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে তাঁহার উত্তরাধিকারীকে নিকটে আহ্বান করিয়া ওই পার্চমেন্ট কাগজের কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলিয়া যান যে, মন্দিরের নিম্নে এক সুড়ঙ্গ আছে। সেই সুড়ঙ্গের ভিতর প্রবেশ করিয়া একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ দেখিতে পাইবে। তাহার ভিতর এক লৌহনিৰ্ম্মিত সিন্দুকে একখানি পার্চমেন্ট কাগজ আছে। এই কাগজ সহসা পাঠ করিবার আদেশ নাই। যখন হিন্দুধৰ্ম্ম পুনঃ স্থাপিত হইবে, তখন পাঠ করিতে পারিবেন। সেইদিন হইতে দুইজন করিয়া পুরোহিত এই পার্চমেন্ট কাগজের বিষয় অবগত আছেন; – প্রধান পুরোহিত ও তাঁহার উত্তরাধিকারী। এই দুইজন ব্যতীত আর কেহই এ বিষয় অবগত নহেন। কিন্তু আবার যে দুইজন ইহার বিষয় জ্ঞাত আছেন, তাঁহারাও কাগজখানি দৃষ্টি গোচর করেন নাই, কেবল উহার সত্তা অবগত আছেন মাত্র। 

বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “পুরোহিতগণের মধ্যে কি এমন কোন লোক ছিলেন না, যিনি ওই কাগজখানির সন্ধান পান?” 

ব্রা। আজ্ঞে না। সকলেরই বিশ্বাস, উহা সেই সিন্দুকের ভিতরে আছে। ইচ্ছা করিলেই দেখিতে পারিতেন কিন্তু সম্ভবতঃ সে বিষয়েও নিষেধ ছিল। আমি সে কথা ঠিক বলিতে পারি না। সে যাহা হউক, বসুদেবের মৃত্যুর পর হইতে সাতজন প্রধান পুরোহিত ক্রমান্বয়ে পৌরোহিত্য কার্য্য করিয়া গিয়াছেন। আমি অষ্টম। পূর্ব্বোক্ত সাতজনের মধ্যে শেষের তিনজন চাপাটীর ভিতর এই প্রকার পত্র পাইয়াছিলেন। কেহই পত্রের কথামত কাগজখানি বাহির করিতে কিম্বা লেখকের হস্তে প্রদান করিতে সাহস করেন নাই। এমন কি, তাঁহারা পত্রের কথা গ্রাহ্যও করেন নাই। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তিনজনেই অতি অদ্ভুতরূপে মারা পড়েন। 

আমি আরও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “পত্র পাইবার কতদিন পরে তাঁহারা মারা যান?” ব্রা। একমাসের মধ্যেই। 

আ। কি রকমে তাঁহারা মারা যান? 

ব্রা। একজন পথ দিয়া যাইতেছিলেন, এমন সময়ে কোথা হইতে একখানি প্রকাণ্ড পাথর তাঁহার মস্তকে পড়িল। তাঁহার মাথার খুলি ভাঙ্গিয়া গেল–তিনি তখনই মারা পড়িলেন। 

আ। আর একজন? 

ব্রা। একদিন তিনি রাত্রিকালে মাঠের মধ্য দিয়া যাইতেছিলেন, হঠাৎ একটি ভয়ানক কেউটে তাঁহাকে দংশন করিল। তিনিও তখনই ভূমিতলে পড়িয়া গেলেন এবং সত্বর প্রাণত্যাগ করিলেন। 

আ। তৃতীয়? 

ব্রা। মন্দির মেরামতের জন্য কতকগুলি প্রস্তর আনা হইয়াছিল। তৃতীয় পুরোহিতকে একদিন প্রাতঃকালে সেই প্রস্তরগুলির নিকটে মৃতাবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়। সেই জন্যই পত্র পাইয়া আমার বড় ভয় হইয়াছে। বোধ হয়, একমাসের মধ্যে আমারও ওইরূপ কোন প্রকার অপঘাত মৃত্যু ঘটিবে। এখন আপনিই আমার ভরসা। 

ব্রাহ্মণের কথা শুনিয়া আমি অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। এরূপ অদ্ভুত রহস্য পূর্ব্বে আর কখনও আমার কর্ণ গোচর হয় নাই। কিছুক্ষণ ভাবিয়া আমার বোধ হইলে যে, পুরোহিতদিগের মধ্যে দুইজন ভিন্ন আর কোন লোক সেই পার্চমেন্ট কাগজের কথা না জানিলেও পত্রলেখকগণ যে বংশপরম্পরায় ওই কাগজের বিষয় অবগত আছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। পূর্ব্বের তিনজন পুরোহিতের মৃত্যুর কথা শুনিয়া স্পষ্টই বোধ হইল যে, এই ব্রাহ্মণ রামচন্দ্র যদি পত্রের কথামত কার্য্য না করেন, তাহা হইলে ইঁহারও একমাসের মধ্যেই মৃত্যুর সম্ভাবনা। যদি ইনি মৃত্যুর হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য কোনরূপে কাগজখানি বাহির করিয়া নির্দিষ্ট স্থানে গমন করতঃ উহা পত্রলেখকের হস্তে প্রদান করেন, তাহা হইলেই যে ইনি প্রাণে রক্ষা পাইবেন, তাহাও নহে। রামচন্দ্রের জীবন বাস্তবিকই সঙ্কটাপন্ন।। 

কিছুক্ষণ এই প্রকার চিন্তা করিয়া আমি ব্রাহ্মণকে বলিলাম “পত্রে লেখা আছে, কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী তিথিতে আপনাকে সেখানে যাইতে হইবে। আজ তৃতীয়া, সুতরাং এখনও চারিদিন সময় আছে। আপনি এক কাৰ্য্য করুন। কাগজখানা কাল ঠিক সন্ধ্যার সময় আমার কাছে আনিবেন, তাহাতে কি লেখা আছে জানিতে না পারিলে, আমি পত্র-লেখকের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিব না। যখন ওই কাগজের জন্য তিনটি জীবন নষ্ট হইয়াছে এবং আর একটি যাইবার সম্ভাবনা, তখন উহাতে নিশ্চয়ই কোন গুরুতর কথা লেখা আছে।” 

আমার কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণের মুখ মলিন হইয়া গেল। এতক্ষণ তাঁহার যাহা কিছু আশা ছিল, তাহাও যেন শেষ হইল। তিনি অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। পরে অতি কষ্টে বলিলেন “আমি ত কাগজখানি আর কাহাকেও দেখাইতে পারি না। গুরুদেবের নিকট শপথ করিয়াছি যে, উহার বিষয় আর কাহাকেও জানাইব না। কাগজখানি আপনাকে দেখাইলে কি জানি মার যদি ক্রোধ হয়।” 

আমি বলিলাম ‘আপনি ত পূৰ্ব্বেই সে শপথ ভঙ্গ করিয়াছেন? কাগজের কথা ত আপনি আমাকে অগ্রেই বলিয়াছেন?” 

ব্রাহ্মণ চমকিত হইলেন। বলিলেন “সত্য! কিন্তু কাগজের উল্লেখ না করিয়া, আমি আপনার নিকট কিরূপে সাহায্য প্রার্থনা করিতে পারি। মহামায়া কি সেজন্য এ গরিব ব্রাহ্মণকে ক্ষমা করিবেন না?” 

বাধা দিয়া আমি বলিয়া উঠিলাম “নিশ্চয়ই করিবেন। তিনি আদ্যাশক্তি, কিছুই তাঁহার অবিদিত নাই; সেজন্য কোন চিন্তা করিবেন না। তাঁহার এমন ইচ্ছা নহে যে, তাঁহার উপাসকের অপঘাত মৃত্যু হয়! সেই মৃত্যু নিবারণ করিবার কোন উপায় অন্বেষণের জন্য যদি সেই কাগজের কথা উল্লেখ করিতে হয় কিম্বা তাহার মৰ্ম্ম জানাইতে হয়, তবে তিনি কখনও রাগ করিবেন না।” 

আমার কথায় ব্রাহ্মণের প্রত্যয় জন্মিল, তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন “তবে তাহাই হউক, কাল এমন সময়ে আমি কাগজ লইয়া আসিব। দিবাভাগে সে জিনিষ আনিতে সাহস হয় না।” 

এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং আমার নিকট বিদায় লইলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

পরদিন রাত্রি নয়টার পর রামচন্দ্র আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং আমার ঘরে আর কোন লোককে দেখিতে না পাইয়া চুপি চুপি বলিলেন “এই দেখুন মহাশয়! সেই কাগজ আনিয়াছি।” 

এই বলিয়া তিনি একখানি পার্চমেন্ট কাগজ আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি সেখানি তাঁহার নিকট হইতে লইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কাগজখানি বাহির করিতে কি কোন কষ্ট হইয়াছিল?” 

রামচন্দ্র ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন “আজ্ঞে কিছুমাত্র না। যেখানে লেখা ছিল, ঠিক সেইখানেই উহা রক্ষিত ছিল। কিন্তু পাছে অন্য কোন পুরোহিত বা মায়ের কোন সেবক জানিতে পারেন, এই ভয়ে আমাকে মধ্যরাত্রে সেই সুড়ঙ্গমধ্যে নামিতে হইয়াছিল। সৌভাগ্যের বিষয়, সেই লোহার সিন্দুকটি খোলাই ছিল।” 

আ। আর কোন লোক সেই সুড়ঙ্গের কথা জানে? 

ব্রা। বোধ হয় না। 

আ। কেন, সুড়ঙ্গের দরজা কি আর কেহই জানে না? 

ব্রা। দরজাটি এমন স্থানে আছে যে, সেখানে সচরাচর কোন লোকের যাইবার প্রয়োজন হয় না। 

আ। আজ রাত্রিকালে যে এখানে আসিয়াছেন, তাহাও কি কেহ জানে না? 

ব্রা। আজ্ঞে না। আমি অতি গোপনেই এখানে আসিয়াছি। 

আ। আর সেই চাপাটী মধ্যস্থ পত্রের কথা? সে কথা কি কাহাকেও বলিয়াছিলেন? 

ব্রা। আজ্ঞে না। এখনও কেহ সে সকল কথা জানে না। 

রামচন্দ্রের কথা শুনিয়া আমি আনন্দিত হইলাম। বলিলাম “আপনি অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি। যিনি গোপনে এই সকল কার্য্য করিতে পারেন, তাঁহার কখনও বিপদ হয় না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার কোন কষ্ট হইবে না।” 

এই বলিয়া কাগজখানি খুলিয়া পড়িতে চেষ্টা করিলাম। দেখিলাম, উহা সংস্কৃত বা দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত। বাল্যকালে যখন বিদ্যালয়ে পাঠ করিতাম, তখন আমি সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলাম বটে কিন্তু সে অতি সামান্য। ওই কাগজের লিখিত সমুদায় বিষয়ের অর্থবোধ করা দূরে থাক, আমি পড়িতেই পারিলাম না। বিদ্যালয়ে যতটুকু সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলাম, অভ্যাস না থাকায় তাহা সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হইয়াছিলাম। 

দুই একবার কাগজখানি এদিক-ওদিক করিয়া আমি কিছু লজ্জিত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি ইহা পড়িয়াছেন কি?” 

রামচন্দ্র হাসিয়া উত্তর করিলেন “পড়িয়াছি, কিন্তু মৰ্ম্মবোধ করিতে পারি নাই।” 

আ। ইহা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। আপনারা মায়ের সেবক, দেবভাষা আপনাদের বিলক্ষণ জানা আছে। তবে এই সামান্য কয়েক পংক্তির অর্থবোধ করিতে পারিলেন না কেন, তাহা আমি বুঝিলাম না। 

ব্রা। অর্থবোধ করিয়াছি বৈ কি। লেখা অতি সরল–অর্থও সামান্য। কিন্তু উহার মর্ম্ম কি বুঝিতে পারিলাম না। আমি কাগজখানি ব্রাহ্মণকে ফিরাইয়া দিয়া বলিলাম “আমাকে ইহার অর্থ বুঝাইয়া দিন। দেখি, আমি কিছু করিতে পারি কি না?” 

রামচন্দ্র ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “কাগজখানি আপনার কাছেই থাক। কয়েকেবার পাঠ করিয়া ওই কয় পংক্তি আমার মুখস্থ হইয়া গিয়াছে। উহাতে লেখা আছে— 

গচ্ছোত্তরঃ প্রাচর্দিশদক্ষিণস্যাং। 
দশমস্যার্দ্ধং সমাহিতঃ চিত্তঃ।। 
প্রাচীতরদক্ষিণস্যাং গতির্দ্ধয়োদ্বিগুণস্য। 
গৃহাণ দ্বাদশং নিম্নাদুর্দ্ধস্যহি ষষ্ঠং।।
প্রোজ্জ্বলং নক্ষত্ৰং তথা চ দ্রষ্টব্যং। 
রক্ষৈতদ্ধনং সৰ্ব্বং প্রফুল্লং সযত্নং।। 

এই শ্লোকটি তিনি আবৃত্তি করিবার পর, আমি তাঁহাকে উহার বাঙ্গলা অর্থ করিয়া আমাকে বুঝাইয়া দিতে বলিলাম। তিনি আমাকে ওই শ্লোকের যেরূপ অর্থ করিয়া বুঝাইলেন, আমি তাহা হইতে নিম্নলিখিত কবিতাটি বাঙ্গলায় প্রস্তুত করিলাম।- 

উত্তর পুরুষ হতে দক্ষিণে গমন।
দশের অর্দ্ধেক যাবে হ’য়ে একমন।।
পশ্চিম দক্ষিণে গতি দ্বিগুণ দুয়ের।
লবে বার নিম্ন হ’তে ছয় উপরের।। 
উজ্জ্বল তারকা তবে পাইবে দর্শন। 
রাখহ সে ধন তুমি করিয়া যতন।। 

“আমি রামচন্দ্রকে ওই বাঙ্গলা কবিতাটি শুনাইয়া তাঁহাকে কহিলাম “সংস্কৃত কবিতাটির সহিত এখন মিলাইয়া দেখুন, ঠিক হইয়াছে কি না?” 

রামচন্দ্রও হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে হাঁ- অনুমান ঠিক হইয়াছে বটে কিন্তু ইহার প্রকৃত মর্ম্ম কি তাহা এখনও বুঝিতে পারি নাই। কখনও যে পারিব, এমন বোধ হয় না।”

আমি বলিলাম “এ বড় বিষম সমস্যা। কথাগুলির নিশ্চয়ই যে কোন গূঢ় তাৎপর্য আছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু উহা কি, তাহা সহজে বোধগম্য হইতেছে না।” 

রামচন্দ্র আমার কথা শুনিয়া অত্যন্ত বিমর্ষ হইলেন। বলিলেন “যখন কাগজখানি এত গোপনে রক্ষিত হইয়াছিল, এবং ইহা পাছে প্রকাশ হয়, সেই জন্য এত শপথ ছিল, তখন ইহার যে কোন গূঢ় মর্ম্ম আছে, তাহা আমিও বুঝিয়াছি। কিন্তু যখন আপনিও তাহা বুঝিতে পারিতেছেন না, তখন উপায় কি? আমাকেও কি ওই প্রকার অপঘাতে মরিতে হইবে?” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “সে কথা আমি জোর করিয়া বলিতে পারিতেছি না। তবে আমি যে আপনাকে রক্ষা করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিব, তাহা সাহস করিয়া বলিতে পারি। যে কথার মর্ম্মবোধ করিবার জন্য আপনি সমস্ত রাত্রি চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা আমি যে অতি সহজে বুঝিতে পারিব, এমন আশা করা যায় না। যাহা হউক, আপনি কি সত্য সত্যই কিছুই বুঝিতে পারেন নাই?” 

রামচন্দ্র গম্ভীরভাবে উত্তর করিলেন “আপনার নিকট আমি কখনও মিথ্যা বলিব না। বিশেষতঃ মায়ের সেবগণ কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। বাস্তবিকই আমি উহার বিন্দু-বিসর্গ বুঝিতে পারি নাই।” 

আমি বলিলাম “ভাল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমাকে কিছুক্ষণ ভাবিতে দিন। যদি অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যে কিছু জানতে পারি ভালই, নতুবা কাগজখানি আমার কাছে রাখিয়া যাইতে হইবে। অবশ্য আমি ইহাকে অতি যত্নের সহিত রাখিয়া দিব। আমি ভিন্ন এখানকার আর কোন লোক এ বিষয় জানিতে পারিবে না।” 

এই বলিয়া আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম। ভাবিলাম, মন্দিরটি না দেখিলে ওই কবিতার অর্থবোধ করা অসম্ভব। সুতরাং একবার আমাকে সেখানে যাইতে হইবে। আর কার্ত্তিক মাসের ৭ই তারিখে রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় যদি সেই সতী পাথরের নিকট অপেক্ষা করিতে পারি, তাহা হইলে সকল দিকেই সুবিধা হইতে পারে। কিন্তু সতী পাথরটা কি? মন্দির হইতে কতদূরেই বা স্থাপিত? 

এই মনে করিয়া ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলাম “সতী পাথর কোথায়?” 

ব্রাহ্মণ উত্তর করিলেন “মন্দির হইতে প্রায় চারিশত গজ দূরে একখানি প্রকাণ্ড শ্বেত মাৰ্ব্বল প্রস্তর বহুকাল হইতে পড়িয়া আছে। কথিত আছে, মহামায়া মানবী-বেশে ওই প্রস্তরের উপর বসিয়া থাকিতেন। 

আ। সেখান হইতে কি মন্দির দেখা যায়? 

ব্রা। বেশ দেখা যায়। 

ব্রাহ্মণকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। ভাবিলাম, তিনি এ পর্যন্ত যে সকল কথা বলিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য। তিনি যে অত্যন্ত ভয় পাইয়াছেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি যে সেদিন রাত্রে একা ওই কাগজ লইয়া সেই স্থানে যাইতে সাহস করিবেন, তাহাও বোধ হয় না। 

এইরূপ নানা চিন্তার পর আমি পরদিনই সেই স্থানে যাইতে মনস্থ করিলাম। কিন্তু পাছে পুলিসের বেশে যাইলে সেখানকার লোকের মনে সন্দেহ হয়, এই জন্য ছদ্মবেশে যাওয়াই স্থির করিলাম।

এই স্থির করিয়া ব্রাহ্মণকে বলিলাম “ পূর্ব্বে আমি কখনও আপনাদের মন্দির দেখি নাই। একবার উহা না দেখিলে ওই কাগজে লিখিত কবিতার কোন মর্ম্ম ভেদ করিতে পারিব না। সেই জন্য মনে করিয়াছি, কালই একবার মহামায়ার চরণ দর্শন করিয়া আসিব। কিন্তু আমার এ বেশে যাওয়া চলিবে না। আমি ছদ্মবেশেই যাইব। আপনিও কোন কৌশলে আমার সহিত দেখা করিবেন। কিন্তু সাবধান, আপনি যে আমার পরিচিত, কিম্বা আমি যে আপনারই কার্য্যে সেখানে গিয়াছি, এমন ভাব দেখাইবেন না। অপর লোকে যেন ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ না করে যে, আমরা পরস্পর পরস্পরের পরিচিত। আর এক কথা, যে লোক ওই পত্র লিখিয়াছে, সে বড় সাধারণ লোক নহে। যখন পুরুষানুক্রমে তাহারা ওই প্রকার পত্র লিখিয়া পুরোহিতগণকে হত্যা করিয়া আসিতেছে তখন তাহারা যে ভয়ানক দুর্দান্ত লোক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সেই জন্যই বলিতেছি যে, আপনাকে যথাসময়ে সেই নির্দিষ্ট প্রস্তরের নিকট যাইতে হইবে। আপনি তাহাতে কি সম্মত আছেন?” 

পুরোহিত আমার কথায় কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন “সর্বনাশ! আমাকেই যাইতে হইবে? কাগজখানিও কি লইয়া যাইতে হইবে?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম, “সে কথা পরে বলিতেছি। অগ্রে বলুন, আপনি যাইতে সম্মত আছেন কি না?” 

ব্রাহ্মণ অত্যন্ত ভীত হইয়া উত্তর করিলেন “যদি একান্তই যাইতে হয়, তাহা হইলে কি করিব? যাইতেই হইবে। কিন্তু যদি কোন উপায় থাকে বলুন?” 

আ। একটি উপায় আছে। 

ব্রা। কি? 

আ। আপনার পরিবর্তে আর কোন লোককে পাঠাইতে পারি। 

ব্রা। কাহাকে পাঠাইবেন? আমার এমন ইচ্ছা নয় যে, এ সকল কথা আর কোন লোক জানিতে পারে। 

আ। না, আর কোন লোক নহে-মনে করিয়াছি, আমি স্বয়ংই সে রাত্রে সেখানে উপস্থিত হইব। ব্রাহ্মণ আন্তরিক আহ্লাদিত হইলেন। বলিলেন “জগদীশ্বরী মহামায়া আপনার মঙ্গল করিবেন। যদি আপনি এ কার্য্য করেন, তাহা হইলে কোন গোলযোগই নাই। কিন্তু কাগজখানির কি… 

আ। কাগজখানিও লইয়া যাইব। 

ব্রা। যদি সে কোনরূপে উহা হস্তগত করিয়া পলায়ন করে? 

আ। আসল কাগজখানি লইয়া যাইব না। উহার একখানি নকল প্রস্তুত করিয়া লইব। 

ব্রা। এ অতি উত্তম পরামর্শ। কিন্তু আপনাকে দেখিয়া লোকটা ভয়ে যদি সেখানে না আইসে। 

আ। আমি আপনার ছদ্মবেশ পরিধান করিব। 

ব্রা। বেশ কথা। কিন্তু আমার পোষাক পাইবেন কোথায়? আমি ত তাহা এখানে আনিতে পারিব না! 

আ। কাল যেস্থানে আমার লাঠি দেখিবেন, সেইখানে আপনার সন্ন্যাসীর একটা পোষাক গোপনে সন্ধ্যার পর রাখিয়া দিবেন। মন্দিরে সদাসর্বদা আপনি যে পোষাক পরিধান করেন, সেইরূপ একটি পোষাক রাখিবেন, আমি সেখান হইতে উহা গ্রহণ করিব। 

আমার কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণ অত্যন্ত পুলকিত হইলেন এবং আমাকে শত শত আশীৰ্ব্বাদ করিয়া আমার নিকট বিদায় লইলেন। 

ব্রাহ্মণ প্রস্থান করিলে পর আমি আরও কিছুক্ষণ ওই বিষয় চিন্তা করিলাম কিন্তু বিশেষ কোন সুবিধা করিতে পারিলাম না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

ওই কালীমন্দিরের প্রায় এক ক্রোশ দূরে আমার একজন পরিচিত লোক বাস করিতেন। তাঁহার বাড়ীর পার্শ্বেই একটা প্রকাণ্ড উদ্যান ছিল। সেই উদ্যানের ভিতর একটি পুষ্করিণীতে অনেক মৎস্য ছিল। 

যদিও তখন কার্ত্তিক মাস, অল্প অল্প শীতের বাতাস বহিতেছিল, তথাপি আমি মাছ ধরিবার আশায় উপযুক্ত সরঞ্জাম লইয়া এবং চারিজন কনেষ্টবলকে ছদ্মবেশ পরিধান করাইয়া বেলা দশটার মধ্যেই সেই স্থানে যাত্রা করিলাম। 

বেলা দ্বিপ্রহরের পর আমি বন্ধুর গৃহে উপনীত হইলাম। সেদিন রবিবার – বন্ধুবরের তখনও আহার হয় নাই। তিনি আমাকে অসময়ে দেখিয়া যুগপৎ আশ্চৰ্য্যান্বিত ও আনন্দিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন “ভায়ার কি এই শীতকালে মাছ ধরিবার ইচ্ছা হইল? মাছ ধরিবার উপযুক্ত সময় বটে!” 

আমি তাঁহার কথায় হাসিয়া উঠিলাম এবং তাঁহার নিকটে গিয়া চুপি চুপি বলিলাম “ভাই, এ কেবল রথ দেখা নহে, সঙ্গে সঙ্গে কলাও বেচিতে হইবে।” 

সুধাংশুবাবুও হাসিলেন। বলিলেন “সে কথা পূর্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছি।” 

আ। কেমন করিয়া বুঝিতে পারিলেন? 

সু। কেন? অসময়ে আপনাদিগকে মাছ ধরিবার নিমিত্ত আসিতে দেখিয়াই ওইরূপ সন্দেহ করিয়াছি। সে যাহাই হউক, আগে আহারাদি শেষ করুন, তাহার পর যাহা ইচ্ছা করিবেন। 

আমি বলিলাম “আহার করিয়া আসিয়াছি। কিন্তু তিনি সে কথায় কর্ণপাতও করিলেন না। বলিলেন “আপনার মত লোক বেলা দশটার মধ্যে আহারাদি করিয়া বাহির হইতে পারেন না। আর যদিও আহার হইয়া থাকে, তাহা হইলে দুই ঘণ্টা পথশ্রমের পর তাহা জীর্ণ হইয়া গিয়াছে। হয় ত আবার আপনার ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছে। ইত্যবসরে আমি আপনার মাছ ধরিবার যোগাড় করিয়া দিতেছি।” 

এই বলিয়া তিনি আমাদিগকে লইয়া বাগানের ভিতর প্রবেশ করিলেন এবং আমাদের মৎস্য ধরিবার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিলেন। আমরা মাছ ধরিতে বসিলাম। 

পুষ্করিণীতে যথেষ্ট মৎস্য ছিল। যখনই যিনি ওই পুকুরে মাছ ধরিতে আসিয়াছেন, তখনই তিনি সফল হইয়াছেন, একবারও নিষ্ফল হন নাই। এক ঘণ্টা অতীত হইতে না হইতে আমি একটি প্রায় আট সের ও আমার একজন লোক একটি প্রায় পাঁচসের মাছ ধরিল। 

মাছ ধরা আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু যে কাৰ্য্যে গিয়াছি, সন্ধ্যা না হইলে সে কাৰ্য্য হইতে পারে না জানিয়া আমি আরও কিছুক্ষণ মাছ ধরিলাম। পরে বন্ধুবরের নিতান্ত অনুরোধে সকলে আহারাদি সমাপন করতঃ তাঁহার বৈঠকখানায় বসিয়া নানা কথায় দিনপাত করিতে লাগিলাম। 

সন্ধ্যায় প্রায় একঘণ্টা পূৰ্ব্বে দুইজন মাত্র লোক লইয়া আমি কালীমন্দিরের দিকে যাত্রা করিলাম। অবশিষ্ট দুইজনকে সেই পরিচিতের বাড়ীতেই রাখিয়া যাইলাম। বলিলাম, প্রত্যাগমন করিবার সময় তাহাদিগকে লইয়া যাইব। 

সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে আমরা সেই মন্দিরে উপস্থিত হইলাম। বলা বাহুল্য, আমরা পদব্রজেই গিয়াছিলাম। সেখানে গিয়া প্রথমে সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে দেখিতে পাইলাম না। 

আমার সঙ্গে ভৃত্য দুইজনকে দেখিয়া অন্যান্য পুরোহিতগণ আমাকে ধনবান বলিয়া বিবেচনা করিলেন এবং যতক্ষণ আমি মন্দিরের ভিতর রহিলাম, ততক্ষণ তাঁহারা আমাকে সঙ্গে লইয়া নানা স্থান প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। 

মহামায়ার শ্রীচরণ দর্শন করিবার পর নাটমন্দিরে আসিলাম। মায়ের মন্দির হইতে প্রায় দশ গজ দূরে নাটমন্দির, অনেকগুলি স্তম্ভের উপর প্রাকাণ্ড প্রস্তরের ছাদ। মন্দির অপেক্ষা নাটমন্দিরের শোভা আরও চমৎকার। থামগুলি শ্রেণীবদ্ধ। এক এক শ্রেণীতে ছয়টি করিয়া স্তম্ভ, এমন দশ শ্রেণী স্তম্ভের উপর ছাদ ছিল। নাটমন্দিরের ভিতর ও বাহির লাল রং করা। মায়ের মন্দিরের রং গেরুয়া মাটীর মত। 

সৰ্ব্বশুদ্ধ যাইটটি স্তম্ভ ছিল। উহাদের উপরিভাগ এরূপ সূক্ষ্ম কারুকর্ম্মযুক্ত যে, সেরূপ কাৰ্য্য আজ কাল দৃষ্টি গোচর হয় না। এক একটি থাম প্রস্তর করিতে কত অৰ্থ যে ব্যয় হইয়াছিল, তাহা অনুমান করা যায় না, কত লোককে পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল, তাহারও ইয়ত্তা করা যায় না। 

এই স্তম্ভগুলি দেখিয়া আমার সেই কবিতা মনে পড়িল। ভাবিলাম “দশের অর্দ্ধেক আর দুইয়ের দ্বিগুণ” এ সকল কথা এই থামগুলিকেই বুঝাইতেছে। কবিতাটির সহিত যে এই স্তম্ভ সকলের বিশেষ সম্বন্ধ আছে তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম। 

কবিতাটির মর্ম্মভেদ করিবার আশায় আমি দেবীমন্দির ও নাটমন্দির পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করিলাম। দেখিলম, মায়ের মুখ ঠিক দক্ষিণ দিকে ছিল। তখনই আবার সেই কবিতার অপর অংশ মনে পড়িল। 

এইরূপ কিছুক্ষণ পরীক্ষার পর আমরা মন্দির হইতে বাহির হইলাম এবং সেই প্রস্তরের অন্বেষণে নিযুক্ত হইলাম। ব্রাহ্মণ যেরূপ বলিয়াছিলেন, সেই মত কার্য্য করিয়া অতি সহজেই সেখানে উপস্থিত হইলাম। মন্দির হইতে চারিদিকে প্রায় দুই শত গজ পরিমাণ ভূমি নানা জাতীয় ফল ও পুষ্পবৃক্ষে পরিপূর্ণ। এই উদ্যানের চারিদিকে বাঁশের বেড়া। এই বেড়া পার হইলে সরকারী পথ। সেই পথের অপর পার্শ্বে প্রকাণ্ড মাঠ। এই মাঠের মধ্যে মধ্যে অনেকগুলি ঝোপ ছিল। পথের অপর পার্শ্ব হইতে অতি সামান্য দূর গমন করিয়া সেই প্রকাণ্ড শ্বেত মাৰ্ব্বল প্রস্তর অবলোকন করিলাম। পাথরখানি গোলাকার, এত বড়, মসৃণ ও উজ্জ্বল শ্বেতমার্ব্বল আর কখনও নয়নগোচর করি নাই। 

সরকারী পথ ও এই প্রস্তরের মধ্যে দুইটি ঝোপ ছিল। এতদ্ব্যতীত মাঠে এত বড় বড় ঘাস জন্মিয়াছিল যে, সেখান দিয়া যাইবার সময় কোমর পর্যন্ত ঢাকা পড়ে। একটি ঝোপের নিকট অতি সামান্য একটু স্থানে ঘাস ছিল না। সেই স্থান উপযুক্ত মনে করিয়া আমার হস্তস্থিত লাঠী সেখানে রাখিতে মনস্থ করিলাম। ভাবিলাম, বৃদ্ধ পুরোহিত যদি সেদিন ওই স্থানে তাঁহার পরিধেয় বস্ত্রাদি রাখিয়া দেন, তাহা হইলে আমি অনায়াসে পাইতে পারি, অথচ কেহই জানিতে পারিবে না। এই মনে করিয়া আমি সেই ঝোপের নিকট গমন করিলাম। 

নির্দ্দিষ্ট স্থানে গিয়া একবার পথের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। কারণ মন্দির হইতে বাহির হইবার সময় কয়েকজন লোক আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছিল এবং তখনও পথের অপর পার্শ্বে দাঁড়াইয়া ছিল। তাহাদের নিকট হইতে প্রায় দশহস্ত দূরে আমার পরিচিত পুরোহিত রামচন্দ্র আমার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়াছিলেন। চারি চক্ষু মিলিত হইবামাত্র তিনি ইঙ্গিত করিয়া মস্তক অবনত করিলেন। তাঁহার ইঙ্গিতে স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন এবং কেন যে আমি সেই স্থানে দাঁড়াইয়া আছি, তাহাও বুঝিতে পারিয়াছেন। 

সকলকে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিতে দেখিয়া আমি সেই স্থানে বসিয়া পড়িলাম। তখনও সকলে আমার দিকে চাহিয়াছিল। আমি লাঠীগাছটি একবার সেইস্থানে রাখিয়া রামচন্দ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, তিনিও আমার কার্য্য লক্ষ্য করিতেছেন, এবং আমাকে সেই স্থানে লাঠীগাছটি রাখিতে দেখিয়া এরূপ ভাবে মাথা নাড়িলেন যে, আমি ভিন্ন আর কেহ সেই মস্তক সঞ্চালন দেখিতে পাইল না। 

রামচন্দ্র এরূপে মস্তক সঞ্চালন করিয়াছিলেন যে, আমি তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় স্পষ্টই বুঝিতে পারিয়াছিলাম। তিনি যে আমার সঙ্কেত বুঝিয়া লইয়াছেন এবং উপযুক্ত সময়ে সেই স্থানেই যে তাঁহার কাপড় থাকিবে, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ রহিল না। 

কাৰ্য্যসিদ্ধ হইয়াছে জানিয়া আমি সেখান হইতে পথে আসিয়া সকলের সহিত মিলিত হইলাম। অনেকেই সেই সতী প্রস্তরের সুখ্যাতি করিতে লাগিল। আমিও তাহাদের সহিত যোগ দিলাম। সতী প্রস্তর নাম হইল কেন? উহার মাহাত্ম্যই বা কি, এ বিষয়ে অনেক জনশ্রুতি শুনিতে পাইলাম। 

পুনরায় মন্দিরে গমন করিয়া আর একবার মায়ের চরণ-দর্শন করতঃ আমরা বন্ধুর আলয়ে উপস্থিত হইলাম। সেখান হইতে অপর দুইজন কনষ্টেবল ও আমার শিকার দ্রব্য লইয়া শীঘ্রই থানায় ফিরিয়া আসিলাম, এবং পথশ্রমে ক্লান্ত হইয়া শীঘ্রই বিশ্রামলাভ করিলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

চারিদিন সময়ের মধ্যে দুইদিন অতীত হইয়া গিয়াছে। আর দুইদিন মাত্র অবশিষ্ট আছে। দ্বিতীয় দিনের রাত্রি দ্বিপ্রহরে আমাকে একখানি নকল পার্চমেণ্ট লইয়া সতী প্রস্তরের নিকট গিয়া সম্ভবতঃ এক অপরিচিত ভয়ানক দস্যুর অপেক্ষা করিতে হইবে। যাহারা পুরুষানুক্রমে নরহত্যা করিয়া আসিতেছে, তাহারা যে কি প্রকার ভয়ানক লোক, তাহা সহজেই অনুমান করা যায়। একে কার্তিক মাসের রাত্রি স্বভাবতই অন্ধকার, তাহার উপর কৃষ্ণপক্ষ। এই দ্বিগুণ অন্ধকারে সেই ভয়ানক লোকের অপেক্ষা করা কিরূপ বিপজ্জনক তাহাও সহজে জানিতে পারা যায়। সে দিন সপ্তমী, চৌদ্দ দণ্ড পরে চন্দ্রের উদয় হইবে। সন্ধ্যার পর হইতে চৌদ্দ দণ্ড প্রায় মধ্যরাত্রি। সেই সময়েই সাক্ষাতের কথা আছে। একে সপ্তমীর চন্দ্র—অর্দ্ধেক, তাহার উপর নবোদিত। আলোক অতি সামান্য হওয়াই সম্ভব। তাহার উপর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহা হইলে ত কথাই নাই। এই সকল বিপদ স্মরণ করিয়া ভাবিলাম, রামচন্দ্রের নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়া বড় অন্যায় করিয়াছি। পরের জন্য নিজের প্রাণ দেওয়া বড় সামান্য কথা নহে। যদিও আমি একাকী যাইব না, যদিও অনেকের চক্ষু আমার উপর থাকিবে, তথাপি সেই নরঘাতক দুর্বৃত্ত যদি হঠাৎ আমাকে আক্রমণ করে, তাহা হইলে আমাকে নিশ্চয়ই পরাস্ত হইতে হইবে। 

এই সকল চিন্তার পর ভাবিলাম, হিন্দুগণ অত্যন্ত অদৃষ্টবাদী। জগতের আর কোন জাতি বোধ হয়, অদৃষ্টের উপর এত নির্ভর করে না, অদৃষ্টের এত দোহাই দেয় না। তাই মনে করিলাম, যদি অদৃষ্টে তাহাই লেখা থাকে, তাহা হইলে আমি যথেষ্ট সাবধান হইলেও উহা ঘটিবে, কিছুতেই অন্যথা হইবে না। বিশেষত যখন এ কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইয়াছি, তখন প্রাণের মায়া করিলে চলিবে না, চোর ডাকাত দস্যুদিগকে নিপীড়িত করাই আমাদের কার্য্য। এ কার্য্যে পদে পদে বিপদের সম্ভাবনা। কিন্তু যখন জানিয়া শুনিয়া এ কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইয়াছি, তখন ভয় করিলে চলিবে কেন? 

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি একবার সেই কবিতাটি দেখিবার ইচ্ছা করিলাম, ও সেই কাগজখানি পকেট হইতে বাহির করিলাম। 

দুই তিনবার কবিতাটি মনে মনে পাঠ করিয়া দেখিলাম যে, অন্ততঃ প্রথম পংক্তিটি নাটমন্দিরের থামগুলির উদ্দেশেই লিখিত হইয়াছে, এই ভাবিয়া একখানি কাগজে থামগুলি যেমন সাজান দেখিয়া আসিয়াছিলাম, সেইরূপ অঙ্কন করিলাম। পূৰ্ব্বেই উক্ত হইয়াছে যে, প্রতি শ্রেণীতে ছয়টি করিয়া থাম ছিল এবং ওই প্রকার দশটি শ্রেণী ছিল। নিম্নে তাহার অনুরূপ একটি প্রতিকৃতি দেওয়া হইল। প্রত্যেক অঙ্ক এক একটি স্তম্ভের নিদর্শন মাত্র। 

কাগজখানি সম্মুখে রাখিয়া কবিতাটি আবার পড়িতে লাগিলাম;— 

‘উত্তর পূরব হইতে দক্ষিণে গমন” উত্তর পূর্ব্ব কোণ ৬ চিহ্নিত স্তম্ভ, ওই স্থান হইতে দক্ষিণে গমন করিতে হইবে। কতদূর গমন আবশ্যক? “দশের অর্ধেক যাবে হ’য়ে একমন” দশের অর্দ্ধেক পাঁচ, ইহাতে আমার মনে হইল, ৬ চিহ্নিত স্তম্ভ হইতে আরম্ভ করিয়া পাঁচ স্তম্ভ পর্য্যন্ত গমন করিতে হইবে, তাহা হইলে ৩০ চিহ্নিত স্তম্ভে আসিয়া উপস্থিত হইতে হয়। তাহার পর “পশ্চিম দক্ষিণে গতি দ্বিগুণ দুয়ের। দুইয়ের দ্বিগুণ চারি। ওই স্তম্ভ হইতে চারি স্তম্ভ দক্ষিণ-পশ্চিমে গমন করিলে ৪৫ চিহ্নিত স্তম্ভে আসিয়া উপনীত হওয়া যায়। “লবে বার নিম্ন হতে ছয় উপরের।” নিম্ন হইতে স্তম্ভের উপরি ছয় গ্রহণ করিলে বার হইবে, অর্থাৎ আমি এই মাত্র বুঝিলাম যে, সমতল স্থান হইতে ছয় হস্ত নিম্নে ওই স্তম্ভের সন্নিকটে “উজ্জ্বল তারকা” অর্থাৎ উজ্জ্বল ধনের সন্ধান পাওয়া যাইবে। 

এই ব্যাপার লইয়া এত ব্যস্ত ছিলাম যে, আমি সেদিন আর কোন কার্য্যে মনোযোগ করিতে পারিলাম না; সমস্ত দিনই কেবল ওই চিন্তায় অতিবাহিত করিলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

পরদিন প্রাতে আমার অধীনস্থ একজন কর্মচারীকে ডাকিয়া বলিলাম “সেদিন যে চারিজন কনেষ্টবলকে লইয়া আমার সহিত মাছ ধরিতে গিয়াছিলে, আজও তাহাদিগকে প্রস্তুত হইতে বল। সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে আমরা এখান হইতে রওনা হইব। সেদিন তোমরা যে প্রকার ছদ্মবেশ পরিধান করিয়াছিলে আজও সেইরূপ বেশ করিবে। প্রত্যেকেই যথাপযোগী অস্ত্র শস্ত্র লইবে।” 

কর্ম্মচারী আমাকে জিজ্ঞাসা করিল “আমরা কি আপনার সঙ্গেই যাইব?” 

কিছুক্ষণ ভাবিয়া উত্তর করিলাম “না, তোমরা আমার কিছু পূর্ব্বেই এখান হইতে যাত্রা করিবে। হয় ত আমি পথেই তোমাদিগকে ধরিতে পারিব। যদি দেখা হয়, তাহা হইলে তোমরা কোন সঙ্কেত করিবে। তোমাদের সঙ্কেত জানিতে পারিলে আমিও গাড়ি হইতে অবতরণ করিব এবং অবশিষ্ট পথ তোমাদের সঙ্গে পদব্রজেই যাইব।” 

বেলা সাড়ে পাঁচটার সময় চারিজন কনেষ্টবলের সঙ্গে সেই কর্মচারী কালীমন্দিরের অভিমুখে যাত্রা করিল। আমার হাতে কাৰ্য্য ছিল, তাহা শেষ না করিয়া যাইতে পারিলাম না। 

এক ঘণ্টার পর একখানি সেকেণ্ড ক্লাস গাড়ি করিয়া আমিও থানা হইতে বহির্গত হইলাম। গাড়ি দ্রুতবেগে সেই কালীবাড়ী অভিমুখে ছুটিতে লাগিল। 

মন্দির হইতে প্রায় এক মাইল দূরে আমি আমার সঙ্গীগণকে দেখিতে পাইলাম। আমি তখনই গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম। পরে কোচম্যানকে ভাড়া দিয়া বিদায় করতঃ উহাদিগকে উপযুক্ত পরামর্শ প্রদান করিলাম। বলিলম, সতী প্রস্তরের চারিদিকে প্রায় পঞ্চাশ হস্ত দূরে তাহারা পাঁচজনে অপেক্ষা করিবে। পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে যে, সেখানকার ঘাসগুলি এত বড় যে, তাহারা অনায়াসেই প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকিতে পারিবে। রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় তাহারা সেই প্রস্তরের নিকট আমাকে ছদ্মবেশে ও অপর কাহাকেও দেখিতে পাইলে তখনই চারিদিক হইতে আমার সাহায্যে আগমন করিবে। আমার অনুচরগণ মনোযোগ সহকারে আমার পরামর্শ শ্রবণ করিল এবং আমার কথামত কার্য্য করিতে প্রতিজ্ঞা করিল। 

যখন আমরা মন্দিরের নিকট উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি প্রায় নয়টা। আমরা কেহই মন্দিরের ভিতর গমন করিলাম না। সৌভাগ্য বশতঃ সে সময় কেহ সেখানে না থাকায় আমার অনুচরগণ স্ব-স্ব নির্দিষ্ট স্থানে গমন করিল। আমিও সেই ঝোপের নিকট খোলা জায়গায় প্রস্থান করিলাম। দেখিলাম, রামচন্দ্র প্রতিজ্ঞামত কার্য্য করিয়াছে। 

আমি তখন রামচন্দ্রের পোষাক পরিধান করিলাম এবং নিজের কাপড় প্রভৃতি সেই ঝোপের ভিতর রাখিয়া দিলাম। পরে সেই প্রস্তরের নিকট গিয়া একস্থানে উপবেশন করিলাম। 

সময় আর যায় না। এক মিনিট একঘণ্টা বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। একা সেই ঘোর অন্ধকারময় রজনীতে এক নিবিড় অরণ্যের ভিতর বিশেষতঃ বিপদের আশঙ্কায় বসিয়া থাকা যে কতদূর কষ্টকর, তাহা ভুক্তভোগীমাত্রেই অনুমান করিতে পারিবেন। 

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন; গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ মেঘ সকল অন্ধকারের মাত্রা চৌগুণ বৃদ্ধি করিয়াছিল। শন্ শন্ শব্দে বাতাস বহিতেছিল, অল্প অল্প শীত অনুভব করিতে লাগিলাম। 

নিকটে ঘড়ী ছিল। দেখিলম, রাত্রি সাড়ে এগারটা বাজিয়া গিয়াছে। অন্ধকারে ঘড়ীর কাঁটাগুলি দেখিবার জন্য পূর্ব্বে উহাদের গাত্রে ফসফরাস ঘর্ষণ করিয়াছিলাম। 

হঠাৎ মনে হইল, কোন লোক যদি আমার পশ্চাৎ দিক হইতে আসিয়া হঠাৎ আক্রমণ করে, তাহা হইলে আমাকে সহজেই পরাস্ত হইতে হইবে। এই মনে করিয়া আমি যেমন পশ্চাৎ দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম, অমনই কোন লোককে সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিলাম। 

নিমেষ মধ্যে আমি লম্ফ দিয়া কিছুদূরে গমন করিলাম। পরে চীৎকার করিয়া বলিলাম “তুমি কে?” 

আগন্তুক বোধ হয় রামচন্দ্রের কণ্ঠস্বর চিনিত। সে আমাকে উচ্চৈঃস্বরে ওই কথা বলিতে শুনিয়া যেন হতবুদ্ধি হইল। 

ঠিক এই সময়ে চারিদিক হইতে আমার সঙ্গীগণ প্রজ্বলিত লণ্ঠন লইয়া বেগে সেই স্থানে উপস্থিত হইল, এবং উপস্থিত দুইজনের মধ্যে আমাকে দেখিয়া কেবল সেই আগন্তুককে গ্রেপ্তার করিল। 

লোকটিকে দেখিবামাত্রই আমি চিনিতে পারিলাম ও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “কি বাপু! আজকাল কলিকাতায় রাজমিস্ত্রীর রোজ কত?” 

লোকটা আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কোন উত্তর করিল না। আমি আবার ওই কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। এবার সে উত্তর দিল। বলিল “আট আনা।” 

আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “গঙ্গার ওপারের দর কত?” সে আবার আমার মুখের দিকে চাহিল। বলিল “সাত আনা।” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “কেন বাপু মিথ্যা কথা বলিতেছ? ওপারের একটা মিস্ত্রীর রোজ ছয় আনা। প্রতিদিন দুই আনা করিয়া লাভ, এ লোভ সহজে সংবরণ করা যায় না। আর তা ছাড়া, সেই সঙ্গে সঙ্গে এই পুরোহিতেরও সন্ধান লইয়াছ।” 

লোকটা স্তম্ভিত হইল। কিছুক্ষণ সে কোন কথা বলিল না। তাহার পর জিজ্ঞাসা করিল “আপনি কে? কেমন করিয়াই বা আমাকে রাজমিস্ত্রী বলিয়া জানিতে পারিলেন?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “যাহারা পুরুষানুক্রমে ওই প্রকার পত্র দিয়া মায়ের প্রধান সেবককে হত্যা করিয়া আসিতেছে, যাহারা এই মন্দিরের কোন স্থানে গুপ্তধন আছে তাহা অবগত আছে, বিশেষতঃ সেই পার্চমেন্ট কাগজের বিষয় জ্ঞাত আছে, তাহারা যে রাজমিস্ত্রী হইবে, এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। পরে তোমাকে দেখিয়াই বুঝিলাম, আমার ধারণা মিথ্যা হয় নাই।” 

লোকটা উত্তর করিল “আপনি কে? আমি ত আপনাকে চিনিতে পারিতেছি না।” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “সামান্য মানুষ! তোমরা যে কার্য্য পুরুষানুক্রমে করিয়া আসিতেছ, তাহাতে তোমাকে এখনই হত্যা করা উচিত।” 

শেষ কথা শুনিয়া সে অতি কষ্টে হাত জোড় করিল ও কহিল “আমার কোন অপরাধ নাই। আমি কোন দোষ করি নাই। যদি করিতাম, তাহা হইলে নিশ্চয়ই মারা পড়িতাম।” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “দোষ কর নাই? প্রধান পুরোহিতকে কে পত্ৰ দিল?” 

লোকটা উত্তর করিল “আমি দিয়াছি। কিন্তু তাহাকে এমন কোন অন্যায় কথা লেখা হয় নাই, যাহাতে আমি প্ৰাণে মারা পড়িতে পারি।” 

আ। কেমন করিয়া তুমি ওই পার্চমেন্ট কাগজের কথা জানিতে পারিলে? নিশ্চয়ই তোমার পিতা মৃত্যুর ঠিক পূর্ব্বে তোমায় ওই কথা বলিয়া গিয়াছেন। 

লো। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। তোমার বাপ আবার তাহার পিতার নিকট হইতে শুনিয়াছিল। কেমন? 

লো। আজ্ঞে হাঁ। যখন এই মন্দির গঠিত হয়, তখন আমার পূর্ব্বপুরুষগণ এই কার্যে নিযুক্ত হইয়াছিল। শুনিয়াছি, সেই সময় মুসলমানদিগের উৎপাতে লোকে ধন-সম্পত্তি অতি গোপনে রাখিত। এই মন্দিরের দেবীর অনেক সম্পত্তি ছিল, তাহার মধ্যে কতকগুলি বহুমূল্য সামগ্রী সেই সময়ে কোথাও পোঁতা হইয়াছিল। সেই স্থান নির্দ্দেশ করিয়া পার্চমেন্ট কাগজে একটি কবিতা লিখিত হয় এবং কাগজখানি কোন নিভৃত স্থানে রক্ষিত হয়। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কেবল সেই কাগজের কথা অবগত আছেন। কাজেই পত্রখানি তাঁহাকেই দেওয়া হইয়াছিল। 

এই কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার নাম কি?” 

সে উত্তর করিল – “রমণ” 

আ। রমণ কর্ম্মকার? 

লো। আজ্ঞে না, রমণ দাস। 

আ। আর তোমার পিতার নাম? 

লো। বাসব দাস। বাবার মৃত্যুর কিছু পূর্ব্বে তিনি আমায় ডাকিয়া ওই কাগজের কথা বলেন। তিনি বলেন, যদি কালীর সম্পত্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা করি, যদি মায়ের বিরক্তির পাত্র হইতে সাহস করি, তাহা হইলে কালীর মন্দিরের প্রধান পুরোহিতকে একখানি পার্চমেন্ট কাগজ দিবার জন্য গোপনে এক পত্র লিখিতে হইবে। কাগজখানি আদায় করিবার জন্য আমার পূর্ব্বপুরুষগণ বহুকাল হইতে চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন কিন্তু এ পর্যন্ত কেহই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। কাগজখানি যদি সহজেই আদায় হয় ভালই, নতুবা পুরোহিতকে হত্যা করিতে কুণ্ঠিত হইও না। কাগজখানি পাইলে কোন পণ্ডিতকে ডাকাইয়া অর্থ বুঝিয়া লইবে। পরে সেই সঙ্কেতমত কার্য্য করিলে অনেক অর্থ পাইবে। আমি ওই উদ্দেশ্যেই পত্র লিখিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, যদি সহজে কাগজখানি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে তাঁহাকে এই নির্জ্জন স্থানে হত্যা করিয়া পিতৃ আজ্ঞা পালন করিব। কিন্তু আমার মনের সাধ মনেই রহিল। ইচ্ছা থাকিলে কি হয়? অদৃষ্টই মূলাধার। হয় ত এই অপরাধে আমাকেই ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, আপনি সেই কাগজের কথা কোথা হইতে জানিতে পারিলেন? আপনার আকৃতি দেখিয়া আমার স্পষ্টই বোধ হইতেছে, আপনি মন্দিরের কোন লোক নন্। পুরোহিতগণের সহিত আপনার কোন সম্বন্ধ নাই বলিয়াই মনে হইতেছে। 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “মন্দিরের কোন লোক না হইলে কি সেই পার্চমেন্ট কাগজের কথা জানিতে নাই?” 

রমণ বলিল “আমি ত সেই প্রকারই শুনিয়াছি। মন্দিরের লোকের কথা কি বলিতেছেন, বাবার মুখে শুনিয়াছি, একা প্রধান পুরোহিত ভিন্ন আর কোন লোক ওই কাগজের কথা জানিতে পারে না। শুনিয়াছি, দুইজন ব্যতীত আর কাহারও সে কথা জানিবার সম্ভাবনা নাই।”

আ। যখন তিনজন পুরোহিত ওই প্রকার পত্র পাইবার এক মাসের মধ্যেই সহসা মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন, তখন বর্ত্তমান পুরোহিত যে তোমার পত্র পাইয়া অত্যন্ত ভীত হইয়াছিলেন, সে কথা বেশ বুঝিয়াছ। পাছে তাঁহাকেও এক মাসের মধ্যে এ জগৎ ত্যাগ করিতে হয়, এই ভয়ে তিনি আমার নিকট গিয়া সমস্ত কথা প্রকাশ করেন। 

র। আপনি তবে কে? 

আ। এখনও কি বুঝিতে পার নাই? আমি একজন পুলিসের লোক। আর এই চারিজন আমারই কনেষ্টবল। আমার কথা শুনিয়া রমণের মুখ মলিন হইয়া গেল। সে ভাবিল, তাহার মৃত্যুকাল সন্নিকট। কিন্তু যতদূর আমি বুঝিতে পারিলাম, তাহাতে লুক্কায়িত অর্থ অপহরণ করিবার চেষ্টা ভিন্ন তাহার আর কোন দোষ দেখিতে পাইলাম না। যে পত্র সে প্রধান পুরোহিতকে লিখিয়াছিল, তাহাতেও কোন ভয়ের কথা ছিল না। সে পত্র লিখিবার জন্য তাহার এমন কোন দোষ হয় নাই, যাহাতে তাহার উপর কোন মোকদমা দায়ের করা যাইতে পারে। 

এই ভাবিয়া তাহাকে মন্দিরের মধ্যে লইয়া যাইবার জন্য আমার সঙ্গীগণকে আদেশ করিলাম। তাহারা তখনই তাহাকে মায়ের মন্দিরে লইয়া গেল। আমিও তাহাদের অগ্রে অগ্রে গমন করিলাম 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

রমণকে বন্দী করিয়া যখন আমরা সেই মন্দিরের ভিতর গমন করিলাম, তখন সকলেই গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত ছিল। আমাদের কথাবার্তায় দুই একজনের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তাহারা মন্দিরে ডাকাত পড়িয়াছে ভাবিয়া, চীৎকার করিয়া উঠিল। তাহাদের বিকট চীৎকারে সকলেই জাগ্রত হইল। রামচন্দ্র জাগ্রত ছিলেন, তিনিও অপর সকলের সহিত চীৎকারে যোগ দিলেন। 

রামচন্দ্র নিশ্চয়ই আমাদিগকে চিনিতে পারিয়াছিলেন। কিন্তু পাছে চীৎকার না করিলে অপর পুরোহিতগণ তাঁহার উপর কোন সন্দেহ করেন, এই ভয়েই তিনি আমাকে চিনিতে পারিলেও অপর সকলের সহিত চীৎকার করিয়াছিলেন। সে যাহা হউক, তাঁহাদের চীৎকার শেষ হইলে, আমি বলিলাম, “আপনারা বৃথা চীৎকার করিয়া সময় নষ্ট করিতেছেন কেন? আমরা চোর বা ডাকাত নহি, বরং এক দুর্দান্ত দস্যুকে গ্রেপ্তার করিয়া আনিয়াছি দেখুন।” 

দস্যুকে গ্রেপ্তার করিবার কথা শুনিয়া সকলেই স্তম্ভিত হইলেন। তাঁহারা তখনই বড় বড় মশাল জ্বালিয়া ফেলিলেন। নিমেষ মধ্যে সমস্ত মন্দির আলোকিত হইল। তখন আমি সকলকে উদ্দেশ্য করিয়া জিজ্ঞাসিলাম “এখানকার প্রধান পুরোহিত কে?” 

রামচন্দ্র আমার সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “এই লোককে আপনি চেনেন?” 

রামচন্দ্র একবার রমণের দিকে চাহিলেন, তাহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন, কিন্তু চিনিতে পারিলেন না। বলিলেন “না মহাশয়, ইহাকে আর কখনও দেখি নাই।” 

আমি তখন তাঁহাকে এক নিভৃত স্থানে লইয়া যাইলাম। উভয়ে সেই স্থানে যাইলে পর আমি বলিলাম, “আপনার জন্য আজ আমায় যে বিপদে পড়িতে হইয়াছিল, তাহা মুখে প্রকাশ করা কেবল আত্ম- গরিমা মাত্র। প্রকৃত কথা এই যে, যদি আমি বিশেষ সতর্ক না থাকিতাম, তাহা হইলে এতক্ষণ আমি মারা পড়িতাম।” 

এই বলিয়া সমস্ত কথা আদ্যেপান্ত প্রকাশ করিলাম। রামচন্দ্র যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিলেন। বলিলেন “আপনি ছিলেন বলিয়াই আমি এ যাত্রা নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারিলাম; নতুবা আমারও যে ওই দশা ঘটিত, তাহা আমি পূৰ্ব্বেই আশঙ্কা করিয়াছিলাম। কিন্তু আপনি আমার পোষাক পরিধান করেন নাই কেন? আমি ত যথাস্থানে উহা রাখিয়া আসিয়াছিলাম।” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “এই মন্দিরে আসিবার সময় পাছে অপর কোন লোক সন্দেহ করে, এই ভয়ে আমি যে বেশে আসিয়াছিলাম, সেই বেশ পরিধান করিয়া আসিয়াছি। আপনার পোষাক যেখানে রাখিয়াছিলেন, সেইখানেই রাখিয়া আসিয়াছি। যদি আমি এ বেশ না করিতাম, তাহা হইলে এই লোক সহসা আমার নিকট আসিতে সাহস করিত না। সে যাহাই হউক, এখন ইহার সাহায্যে যদি সেই কাগজে লিখিত কবিতার কোনপ্রকার মর্ম্মভেদ করিতে পারা যায়, তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। আপনি অপর সমস্ত লোককে অন্যত্র যাইতে আদেশ করুন।” 

আমার কথায় রামচন্দ্র সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি তখনই আমার নিকট হইতে চলিয়া গেলেন এবং মন্দিরের অপর লোকগুলিকে মন্দির হইতে কিছুক্ষণের জন্য বিদায় দিলেন। 

রামচন্দ্র পুনরায় আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। আমিও সেই নিভৃত স্থান হইতে বাহির হইয়া যেখানে আমার কনেষ্টবলগণ সেই বন্দীকে লইয়া অপেক্ষা করিতেছিল, সেইখানে যাইলাম। 

ক্রমে ঊষার আলোক চারিদিকে প্রকটিত হইল। কৃষ্ণপক্ষ, সুতরাং শেষ পর্যন্ত চন্দ্রের বিমল কিরণে সমস্ত পৃথিবী প্রতিভাত ছিল। ক্রমে সেই আলোক মলিন হইতে লাগিল এবং তাহার স্থানে ঊষার অস্পষ্ট আলোক চারিদিকে উদ্ভাসিত হইল। 

আমি দেখিলাম, আমাদিগের কার্য্য শেষ হইয়াছে, সুতরাং আমরা রমণকে লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। যাইবার সময় প্রধান পুরোহিতকে গোপনে ডাকিয়া, ওই পার্চমেন্ট লিখিত কবিতার অর্থ আমি যেরূপ বুঝিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাকে কহিলাম ও আমার বিবেচনা মত স্থানটি অর্থাৎ সেই স্তম্ভটি তাঁহাকে দেখাইয়া দিলাম ও সময়মত ওই স্থানটি কোন উপায়ে গমন করিয়া তাঁহাকে দেখিতে বলিলাম। 

প্রায় এক সপ্তাহ পরে তিনি আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন ও কহিলেন, তিনি ওই স্থান খনন করিয়া একটি স্বর্ণকুম্ভের ভিতর অনেকগুলি মূল্যবান জহরত প্রাপ্ত হইয়াছেন ও সেই অর্থ যাহাতে ওই দেবতার কার্য্যে ব্যয়িত হয়, তাহার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। 

তাঁহার কথা শুনিয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম, তাঁহার কাগজ তাঁহাকে ফিরাইয়া দিলাম। তিনিও আমায় পুরস্কৃত করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। 

রমণের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় সে অব্যাহতি লাভ করিল। 

সম্পূর্ণ 

[ পৌষ, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *