পূজারিনী

অবদানশতক

       নৃপতি বিম্বিসার 
নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইলা 
       পাদনখকণা তাঁর । 
স্থাপিয়া নিভৃত প্রাসাদকাননে 
তাহারি উপরে রচিলা যতনে 
অতি অপরূপ শিলাময় স্তূপ 
       শিল্পশোভার সার । 
  
  
সন্ধ্যাবেলায় শুচিবাস পরি 
       রাজবধূ রাজবালা 
আসিতেন ফুল সাজায়ে ডালায় , 
স্তূপপদমূলে সোনার থালায় 
আপনার হাতে দিতেন জ্বালায়ে 
       কনকপ্রদীপমালা । 
  
  
অজাতশত্রু রাজা হল যবে , 
       পিতার আসনে আসি 
পিতার ধর্ম শোণিতের স্রোতে 
মুছিয়া ফেলিল রাজপুরী হতে — 
সঁপিল যজ্ঞ - অনল - আলোতে 
       বৌদ্ধশাস্ত্ররাশি । 
  
  
কহিল ডাকিয়া অজাতশত্রু 
        রাজপুরনারী সবে , 
‘ বেদ ব্রাহ্মণ রাজা ছাড়া আর 
কিছু নাই ভবে পূজা করিবার 
এই ক ' টি কথা জেনো মনে সার — 
       ভুলিলে বিপদ হবে ।' 
  
সেদিন শারদ - দিবা - অবসান — 
       শ্রীমতী নামে সে দাসী 
পুণ্যশীতল সলিলে নাহিয়া , 
পুষ্পপ্রদীপ থালায় বাহিয়া , 
রাজমহিষীর চরণে চাহিয়া 
       নীরবে দাঁড়ালো আসি । 
  
  
শিহরি সভয়ে মহিষী কহিলা , 
       ‘ এ কথা নাহি কি মনে , 
অজাতশত্রু করেছে রটনা 
স্তূপে যে করিবে অর্ঘ্যরচনা 
শূলের উপরে মরিবে সে জনা 
       অথবা নির্বাসনে ? ' 
  
  
সেথা হতে ফিরি গেল চলি ধীরে 
      বধূ অমিতার ঘরে । 
সমুখে রাখিয়া স্বর্ণমুকুর 
বাঁধিতেছিল সে দীর্ঘ চিকুর , 
আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর 
      সীমন্তসীমা - ' পরে । 
  
  
শ্রীমতীরে হেরি বাঁকি গেল রেখা , 
      কাঁপি গেল তার হাত — 
কহিল , ‘ অবোধ , কী সাহস - বলে 
এনেছিস পূজা ! এখনি যা চলে । 
কে কোথা দেখিবে , ঘটিবে তা হলে 
      বিষম বিপদপাত ।' 
  
  
অস্তরবির রশ্মি - আভায় 
     খোলা জানালার ধারে 
কুমারী শুক্লা বসি একাকিনী 
পড়িতে নিরত কাব্যকাহিনী , 
চমকি উঠিল শুনি কিংকিণী — 
     চাহিয়া দেখিল দ্বারে । 
  
শ্রীমতীরে হেরি পুঁথি রাখি ভূমে 
     দ্রুতপদে গেল কাছে । 
কহে সাবধানে তার কানে কানে , 
‘ রাজার আদেশ আজি কে না জানে , 
এমন ক ' রে কি মরণের পানে 
      ছুটিয়া চলিতে আছে ! ' 
  
  
দ্বার হতে দ্বারে ফিরিল শ্রীমতী 
     লইয়া অর্ঘ্যথালি । 
‘ হে পুরবাসিনী' সবে ডাকি কয় 
‘ হয়েছে প্রভুর পূজার সময় ' — 
শুনি ঘরে ঘরে কেহ পায় ভয় , 
     কেহ দেয় রাতে গালি । 
  
  
দিবসের শেষ আলোক মিলালো 
     নগরসৌধ - ' পরে । 
পথ জনহীন আঁধারে বিলীন , 
কলকোলাহল হয়ে এল ক্ষীণ — 
আরতিঘণ্টা ধ্বনিল প্রাচীন 
     রাজদেবালয়ঘরে । 
  
  
শারদনিশির স্বচ্ছ তিমিরে 
     তারা অগণ্য জ্বলে । 
সিংহদুয়ার বাজিল বিষাণ , 
বন্দীরা ধরে সন্ধ্যার তান , 
‘ মন্ত্রণাসভা হল সমাধান ' 
     দ্বারী ফুকারিয়া বলে । 
  
  
এমন সময়ে হেরিল চমকি 
     প্রাসাদে প্রহরী যত — 
রাজার বিজন কানন - মাঝারে 
স্তূপপদমূলে গহন আঁধারে 
জ্বলিতেছে কেন যেন সারে সারে 
     প্রদীপমালার মতো ! 
  
মুক্তকৃপাণে পুররক্ষক 
     তখনি ছুটিয়া আসি 
শুধালো , ‘ কে তুই ওরে দুর্মতি , 
মরিবার তরে করিস আরতি ! ' 
মধুর কণ্ঠে শুনিল , ‘ শ্রীমতী , 
     আমি বুদ্ধের দাসী ।' 
  
  
সেদিন শুভ্র পাষাণফলকে 
     পড়িল রক্তলিখা । 
সেদিন শারদ স্বচ্ছ নিশীথে 
প্রাসাদকাননে নীরবে নিভৃতে 
স্তূপপদমূলে নিবিল চকিতে 
      শেষ আরতির শিখা ! 
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *