পূজারি
কলিং বেলটা বেশ মিষ্টিভাবে টুং টাং টুং টাং শব্দে বাজে।
সুপ্রিয়া একটি ইংরেজি উপন্যাসের মধ্যে গভীরভাবে ডুবে ছিল দুপুরবেলাটা। এই সময়ে সে বিছানায় শুয়ে বই পড়ে, কিন্তু ঘুমোয় না। কলিং বেলের শব্দ শুনে সে শিয়রের কাছে ঘড়িটা দেখল। তিনটে বাজে। এই সময় তো কারুর আসবার কথা নয়।
অনেক সময় ফেরিওয়ালারা এসে বিরক্ত করে। কিন্তু দরজা না খোলা পর্যন্ত বেল বাজিয়েই যাবে। উপায় নেই, বই মুড়ে রেখে সুপ্রিয়াকে উঠতে হল।
সুপ্রিয়া খেয়াল করেনি, বাইরে কখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বারান্দায় অনেক জামাকাপড় মেলা আছে, সেগুলো এক্ষুনি না তুললে একেবারে ভিজে যাবে। অথচ কলিং বেলটা বাজল তৃতীয়বার।
সুপ্রিয়া দৌড়ে গিয়ে আগে দরজাটা খুলল।
হাতে একটি ছাতা, ধুতির ওপর শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে শশধর। মুখে বিগলিত হাসি। সে বলল, অসময়ে এসে বিরক্ত করলাম নাকি?
সুপ্রিয়া অবাক হবারও সময় পেল না। আপনি বসুন বলেই সে ছুটে গেল বারান্দায়।
এর মধ্যেই জামা-কাপড়গুলো একটু একটু ভিজে গেছে। আকাশ কালো, বৃষ্টি আরও বাড়বে, তাই সুপ্রিয়া জামা-কাপড়গুলো তুলে ফেলাই ঠিক করল। ঘরের মধ্যে মেলে দিতে হবে। কাপড় তুলতে তুলতে সুপ্রিয়ার ভুরু কুঁচকে গেল। হঠাৎ এই সময় ওই লোকটা এসেছে কেন?
শশধর সুপ্রিয়ার স্বামী সিদ্ধার্থর বন্ধু! ঠিক বন্ধুও বলা যাবে না, এক সময় সিদ্ধার্থ আর শশধর একসঙ্গে স্কুলে পড়ত। তারপর দুজনের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু স্কুলের পুরোনো বন্ধুকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারে না সিদ্ধার্থ। রাস্তায় দেখা হলে দু-চারটে কথা বলে। সিদ্ধার্থর খুব তাস খেলার নেশা। ছুটির দিনে কোথাও না কোথাও তাস খেলতে যাবেই। মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও সে তাসের আসর বসায়। সেই রকমই দু-একটা তাস খেলার আসরে শশধরকে দেখেছে সুপ্রিয়া।
সুপ্রিয়া আবার ভাবল, অফিসের দিনে দুপুরবেলা লোকটা কি মনে করেছে যে এখানে তাস খেলা চলছে? অদ্ভুত তো!
পরক্ষণেই তার মনে হল, লোকটা টাকা ধার চাইতে আসেনি তো? সিদ্ধার্থর কাছে যেন দু-একবার শুনেছে যে, ওই লোকটার অবস্থা ভালো নয়। ওর চেহারা এবং পোশাকও সিদ্ধার্থর বন্ধু হিসেবে একেবারে বেমানান। সিদ্ধার্থর আর কোনো বন্ধু ধুতির ওপর শার্ট পরে রাস্তায় বেরোয় না। হাতে আবার একটা পুরোনো ছাতা!
কাপড়-টাপড়গুলো গুছিয়ে সুপ্রিয়া এল বসবার ঘরে।
শশধর একটি পত্রিকার ছবি দেখছিল, সেটা নামিয়ে রেখে সে আবার ঠোঁটে বিগলিত হাসিটুকু এঁকে জিজ্ঞেস করল, বৌদি, ছেলে কেমন আছে?
ছেলে? কেন?
শশধর একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, পরশুদিন অজয়বাবুর বাড়ি থেকে সিদ্ধার্থ তাস খেলা ছেড়ে তাড়াতাড়ি উঠে এল। বলল, ওর ছেলের জ্বর। আমি কালই আসব ভেবেছিলাম, হয়ে ওঠেনি। আজ এ পথ দিয়ে যাবার সময়ে মনে করলাম, আপনার ছেলেকে একবার দেখে যাই।
সুপ্রিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। হঠাৎ কেউ এসে ছেলের কথা জিজ্ঞেস করলেই বুক কেঁপে ওঠে। সে হেসে বলল, বাবলু! হ্যাঁ পরশু বিকেল থেকে ওর গা-টা একটু গরম হয়েছিল। বৃষ্টিতে ভেজে তো…কিন্তু কালই কমে গেছে…আজ তো বাবলু স্কুলে গেছে!
স্কুলে গেছে? দু-একদিন বিশ্রাম দিলে পারতেন। এই সময়টা ভালো না, বাচ্চাদের প্রায়ই জ্বর হচ্ছে শুনতে পাই।
ওরা কি আর এমনি বিছানায় শুয়ে থাকতে চায়। ছটফটে ছেলে, বাড়িতে থাকতেই চায় না।
না না, তবু সাবধান হওয়া ভালো। বুকে ঠান্ডা বসে গেলে অনেক ঝামেলা হতে পারে, এই তো আমার এক ভাগ্নে ব্রংকাইটিসে ভুগছে।
শশধরের কাছ থেকে সুপ্রিয়া এসব ব্যাপারে কোনো উপদেশ শুনতে চায় না। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে তার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। ছেলের কী করে যত্ন নিতে হয় সে জানে। বন্ধুর ছেলের সাধারণ একটু জ্বর হলেই কেউ এমন দুপুরবেলা দেখতে আসে? অদ্ভুত!
শশধর এক পায়ের চটি থেকে পা বার করে অন্য পায়ের ওপরে উঠিয়ে বসল!
এই রে, লোকটা আরও অনেকক্ষণ বসবে নাকি? সুপ্রিয়ার মন টানছে রহস্য গল্পের বইটি।
কিছুদিন সিদ্ধার্থ বোম্বাইতে বদলি হয়েছিল। প্রায় বছর তিনেক। বোম্বাইয়ের বেশিরভাগ মেয়েই আজকাল বাড়ির মধ্যে শাড়ি পরে না। সেই থেকে সুপ্রিয়ারও অভ্যেস হয়ে গেছে, কলকাতাতেও সে বাড়িতে একটা লম্বা ঢোলা ম্যাক্সি পরে থাকে। এই গরমে, লোডশেডিং-এ শাড়ির চেয়ে ম্যাক্সি অনেক আরামের। বিশিষ্ট কোনো লোক এলে সুপ্রিয়া এর ওপর একটা মোটা ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে দেয় তাড়াতাড়ি।
কোনো ফেরিওয়ালা-টেরিওয়ালা বেল দিয়েছে ভেবে সুপ্রিয়া ড্রেসিং গাউনটা না চাপিয়েই দরজা খুলেছিল। এখন তার একটু অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু এখন আবার ড্রেসিং গাউনটা পরে এলে এ লোকটা ভাবতে পারে, সে তাকে আরও কিছুক্ষণ বসতে বলছে। তা ছাড়া এ তো আর বিশিষ্ট লোক নয়। চলে গেলে কিছু যায় আসে না। সুপ্রিয়া চেয়ারে না বসে দাঁড়িয়ে রইল।
শশধর সরাসরি সুপ্রিয়ার শরীর বা মুখের দিকে তাকায় না। লাজুকভাবে মুখ নীচু করে আছে। সে আবার বলল, বৌদি, কখনও দরকার হলে বলবেন, আমার চেনা খুব ভালো ডাক্তার আছে, ড. জি. সি. দাস নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?
সুপ্রিয়া বলল, আমার নিজের দাদা ডাক্তার।
ও, তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। তবু বলে রাখলাম, যদি কখনও দরকার হয় ড. জি. সি. দাসকে আমি ডাকলে না বলতে পারে না কখনও।
সুপ্রিয়া বুঝল লোকটা নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করবার চেষ্টা করছে। কে, কোথাকার জি. সি. দাস তার ঠিক নেই। সুপ্রিয়ার দাদা নাম করা ডাক্তার। কলকাতার সব বড়ো বড়ো ডাক্তাররা তাঁকে চেনেন।
সুপ্রিয়ার একটুও ইচ্ছে করছে না লোকটার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু মুখের ওপর তো বলা যায় না, আপনি এখন চলে যান।
শশধর পকেট থেকে একটি কাগজের ঠোঙা বার করল। তার মধ্যে একটা লাল টুকটুকে আপেল। খুব সলজ্জভাবে সেটি টেবিলের ওপর রেখে বলল, আপনার ছেলের জন্য এনেছিলাম। ভাবলুম, জ্বর মুখে যদি ভালো লাগে।
সুপ্রিয়া হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। তার বাড়িতে সব সময় আপেল থাকে। বাবলু একদম খেতে চায় না। আজকালকার ছেলেরা ভালো জিনিস পছন্দ করে না, আপেল এক কামড় দিয়ে ফেলে দেবে, কিন্তু ফুচকাওয়ালা আসুক কিংবা ঝালমুড়ি, অমনি গপাগপ করে খাবে।
এই লোকটা আপেল নিয়ে এসেছে, তাও একটা। মোটে একটা আপেল কেউ কারুর বাড়িতে নিয়ে আসে? তা ছাড়া ওই লাল টুকটুকে আপেলগুলো ভীষণ টক হয়। লোকটা আপেলও চেনে না।
এ কি, আপনি আবার এ সব আনতে গেছেন কেন?
এমনিই, ভাবলাম, খালি হাতে যাব। রেখে দিন, ওকে খেতে বলবেন।
সুপ্রিয়া আবার দু-একবার আপত্তি জানাল। কিন্তু কেউ ছোটোদের জন্য কিছু জিনিস নিয়ে এলে তা জোর করে ফেরত দেওয়া যায় না।
এবার লোকটাকে কিছু একটা খেতে-টেতে বলা উচিত। সুপ্রিয়া দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। কাজের লোকটি ছুটি নেওয়ায় এমন মুশকিল হয়েছে। গতকাল তার ফেরার কথা ছিল, ফেরেনি। ওরা কথা রাখে না।
ফ্রিজে মিষ্টি-টিষ্টি কিছুই নেই। থাকলে বড্ড ভালো হত। থাকবার মধ্যে আছে কিছু আপেল আর কলা। ও আপেল এনেছে, এখন ওকে ও আপেল খেতে বলা যায় না। আপনি একটু কলা খাবেন? এ কথাও কি বলা যায়! ধুৎ।
বাধ্য হয়েই সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, আপনি চা খাবেন?
শশধর বলল, না, থাক। আপনার অসুবিধে হবে, এই অসময়ে।
না, অসুবিধে আর কি?
তাহলে খেতে পারি আপনার হাতের চা।
সুপ্রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেল। রহস্য গল্প পড়তে পড়তে উঠে আসা যে কি কষ্টকর! এখন আবার তাকে চা বানাতে হবে। বাড়িতে কফিও নেই। কফি চায়ের চেয়ে তাড়াতাড়ি বানানো যেত?
গ্যাস স্টোভে গরম জল চাপিয়ে সুপ্রিয়া এবার ড্রেসিং গাউনটা পরে নিতে গেল। যতই এলেবেলে হোক, তবু একজন পুরুষ মানুষ তো, বেশিক্ষণ এই পাতলা, ম্যাক্সিটা পরে সহজভাবে ঘোরাফেরা করা যায় না।
শশধরের চেহারা রোগা-পাতলা, মুখখানাও শুকনো, নাকের নীচে সরু গোঁফ। সে অধিকাংশ সময়ই মাটির দিকে চেয়ে থাকে, দু-একবার চকিতে সুপ্রিয়াকে দেখে নেয়। এখনও কোনো নেমন্তন্ন বাড়িতে গেলে অনেকে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে, ওই সুন্দরী মহিলাটি কে?
চা তৈরি হবার আগে খুব ঝেঁপে বৃষ্টি এল। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করার পরও খানিকটা জল গড়িয়ে এল ভেতরে। বৃষ্টির ঝাট লেগে লেগে দরজাটার অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে। সুপ্রিয়া আপন মনেই বলল, এই এক ঝামেলা, যখন তখন বৃষ্টি আর অমনি ভেতরে জল আসবে!
শশধর উঠে গিয়ে দরজাটা পরীক্ষা করল। তারপর বিজ্ঞভাবে বলল, খানিকটা অ্যালুমিনিয়ামের পাত দরজার নীচের দিকে লাগিয়ে দিলে বৃষ্টি আটকাতে পারে। তাতে আর জল ঢুকবে না।
এই উপদেশ সুপ্রিয়াকে আরও দু-একজন দিয়েছে। এর বিরুদ্ধেও বলেছে কয়েকজন। সে চুপ করে রইল।
লাগাবেন অ্যালুমিনিয়ামের পাত? আমি জোগাড় করে দিতে পারি!
তাতে কোনো লাভ হবে।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই হবে। আমি নিয়ে আসব। চেনা মিস্তিরিও আছে, সে-ই ঠিকঠাক করে।
নাঃ, দরকার নেই। দরজাটাই পালটে ফেলতে হবে।
পুরো-দরজাটা পালটাবেন? কেন, আগে খানিকটা অ্যালুমিনিয়ামের পাত লাগিয়ে দেখুন না। তাতে খরচ কম পড়বে—আমার চেনা আছে।
বসবার ঘরের দরজার খানিকটা অংশে অ্যালুমিনিয়ামের পাত লাগালে যে বিচ্ছিরি দেখায়, তা বোঝবার ক্ষমতা নেই এই লোকটার।
সুপ্রিয়া দৃঢ়ভাবে বলল, না, দরজাটাই পালটাব ঠিক করে ফেলেছি।
মাত্র এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এল সুপ্রিয়া।
শশধর জিজ্ঞেস করল, এ কী, আপনি খাবেন না?
না। আমি বেশি চা খাই না। আপনার বন্ধু ফিরলে ছ-টার সময় ওর সঙ্গে এক সঙ্গে এক কাপ খাই।
সিদ্ধার্থ তো খুব চা খায়।
হ্যাঁ, ও খায়।
ইশ, শুধু শুধু আমার জন্য আপনাকে চা বানাতে হল কষ্ট করে।
না, এতে কষ্টের কী আছে?
লোকটা বুঝি ভেবেছিল, সুপ্রিয়াও ওর সামনে চায়ের কাপ নিয়ে বসবে। তাতে ও আরও গল্প জমাবার সুযোগ পাবে। সুপ্রিয়া এ পর্যন্ত একবারও ওর সামনে বসেনি। এই ধরনের লোকদের সঙ্গে সুপ্রিয়ার গল্প করার মতন কিছুই নেই।
শশধর একটি সিগারেট ধরাল।
এই রে, আরও কতক্ষণ বসে থাকবে কে জানে! এই ধরনের লোকদের যে কীভাবে বিদায় করা যায়, তা সুপ্রিয়া জানে না। এর চেয়ে আরও কত বেশি ঠান্ডা ব্যবহার করবে।
আপনি নিজেই চা নিয়ে এলেন, আপনাদের সেই কাজের লোকটি কোথায়?
সে ছুটি নিয়েছে। এমন মুশকিলে পড়েছি।
ওরা ছুটি নিলে সহজে ফিরতে চায় না। কত দিনের জন্য গেছে?
বলেছিল সাত দিন, এই তো বারো দিন হয়ে গেল।
তাহলে দেখুন, ফেরে কিনা সন্দেহ।
ছেলেটা খুব বিশ্বাসী ছিল। এখন লোক পাওয়া এমন শক্ত।
আর কথা না বাড়িয়ে সুপ্রিয়া চলে গেল অন্য কোনো ঘরের জানলা দিয়ে জল ঢুকছে কিনা দেখতে।
শশধর উঠল বৃষ্টি ধরে যাবারও দশ মিনিট পরে। টেবিলের ওপর পড়ে রইল তার আনা টুকটুকে লাল রঙের আপেলটা। ওটা সুপ্রিয়া তার ঠিকে ঝিকে দিয়ে দেবে ঠিক করল। তারপর আবার সে ফিরে গেল ওর গল্পের বইয়ে।
রাতে সুপ্রিয়া তার স্বামীকে বলল, আজ দুপুরে তোমার এক বন্ধু এসেছিল।
কে?
ওই যে শশধর না কি যেন নাম?
সিদ্ধার্থ হাসতে আরম্ভ করল উঁচু গলায়।
হাসছ কেন?
আমি ভাবলুম, আমার কোনো বন্ধু বুঝি লুকিয়ে লুকিয়ে দুপুরবেলা আসছে তোমার সঙ্গে প্রেম করতে। বাড়িতে সুন্দরী স্ত্রী থাকার বিপদ অনেক।
বাজে কথা বলো না!
তাহলে শশা এবার তোমার ওপর ভর করবে মনে হচ্ছে।
তার মানে?
রমেন বলছিল, কিছুদিন ওর বাড়িতেও যাতায়াত শুরু করেছিল শশা। রমেন যখন থাকে না, সেই সময়ে যায়। রমেনের বউ রত্না তো একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিল। অথচ মজা কি জানো, শশা কক্ষনো কোথাও খারাপ ব্যবহার করে না, কোনো অসভ্যতা করে না, দুচোখ দিয়ে বিশ্রীভাবে মেয়েদের শরীর চাটে না, শুধু চুপচাপ বসে থাকে।
আজ দুপুরেও সেই রকম বসেছিল!
ওই তো বললুম। আমরা স্কুলে ওকে বলতুম শশা। শশা জিনিসটারও কোনো গুণও নেই, দোষও নেই। ও ঠিক সেই রকম।
রত্না শেষ পর্যন্ত কী করল?
রত্না তোমার থেকে অনেক বেশি ভদ্র। রোজ দুপুরে ওকে চা করে খাওয়ায়। বেচারির আবার দুপুরে ঘুমোনো অভ্যেস। রত্নাকে ছেড়ে এখন তোমার কাছে কেন এসেছে তা অবশ্য বুঝতে পারছি না।
একদিনই তো মোটে এসেছে। বাবলুকে দেখতে এসেছিল। তুমি পরশু বলেছিলে না বাবলুর জ্বর?
হ্যাঁ, তা বোধহয় বলেছিলাম। আমাদের তাস খেলার আসরে ও চুপচাপ বসে থাকে। আজকাল তো ওকে খেলতে নেওয়া হয় না।
কেন, খেলতে নাও না কেন?
আমরা তো স্টেকে খেলি। ও পয়সা পাবে কোথায়?
উনি চাকরি-টাকরি করেন না?
করপোরেশানে কী যেন একটা সামান্য চাকরি করে! শুনেছি ওদের ডিপার্টমেন্টে খুব ঘুষের ব্যাপার আছে। তা শশধরটা এমনই অপদার্থ যে, ঘুষও নিতে পারে না। শুধু ওই অফিসে কাজ করার একটা সুবিধে, যখন তখন বেরিয়ে পড়া যায়।
বাবলুর জন্য একটা আপেল এনেছিলেন।
ওরেব বাবা! পয়সা খরচ করেছে শশা? ও যে হাড় কিপটে। তাহলে খুব গুরুতর ব্যাপার বলতে হবে। তুমি এর মধ্যে খুব সেজেগুজে কোনোদিন বেরিয়েছিলে? আর সে সময় ও তোমায় দেখেছে?
ধ্যাৎ!
পরদিন দুপুরে লোডশেডিং। কলিং বেল বাজবে না। দরজায় আওয়াজ হচ্ছে ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক।
সুপ্রিয়া শিয়রের দিকে চেয়ে দেখল ঠিক তিনটে বাজে। উঠে এসে সে দরজায় ম্যাজিক আই দিয়ে দেখল! কোনো সন্দেহ নেই, আজও শশধর এসেছে!
দরজা না খুললে তো ঠুক ঠুক করতেই থাকবে। আজ কোন ছুতোয় এসেছে লোকটা? শুধু যেন সেই জানার কৌতূহলেই দরজা খুলল সুপ্রিয়া।
আজও সেই একই পোশাক, হাতে ছাতা, মুখে বিগলিত হাসি।
আজও প্রথম কথাটি একই, অসময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম।
সুপ্রিয়া আজ আগেই মোটা হাউস কোটটা পরে শরীর ভালো করে ঢেকে নিয়েছে। সে কোনো কথা বলল না।
একটু দূরে দাঁড়ানো কাকে যেন ডেকে শশধর বলল, এই আয়, এদিকে আয় দেখুন তো একে আপনার পছন্দ হয় কি না।
সুপ্রিয়া সবিস্ময়ে তাকাল। মলিন ধুতি ও গেঞ্জি পরা আর একটি লোক দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।—এ কে?
আমাদের অফিসের একজন বেয়ারার ভাই। সবে দেশ থেকে এসেছে, চাকরি খুঁজছে। তাই আমি ভাবলাম, আপনার এখানে নিয়ে আসি। আপনার রান্নার লোক নেই…একে দিয়ে যদি কাজ চালানো যায়।
লোকটির চেহারা দেখে মনে হয় না সে কোনোদিন কোনো গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করেছে। কেমন যেন বুনো বুনো ভাব। গ্রামের দিকে কোনো নৌকার মাঝি কিংবা মোষের পালের রাখাল হলেই যেন একে মানায়।
আমতা আমতা করে সুপ্রিয়া বলল, এ কি রান্নাবান্নার কাজ পারবে?
হ্যাঁ সব পারবে। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখুন না।
এই যে, তোমার নাম কী?
জীবনকৃষ্ণ দাস।
তুমি কোথাও রান্নার কাজ করেছ কখনও?
আজ্ঞে না।
সুপ্রিয়া শশধরের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তবে?
শশধর সঙ্গে সঙ্গে বলল, কখনও করেনি বলে যে পারবে না তার তো কোনো মানে নেই। শিখিয়ে নিলে সবই পারবে। বৌদি, ভালো করে শেখালে বাঘকে দিয়েও হাল চাষ করানো যায়। ঠিক কি না!
শশধর বোধহয় সিদ্ধার্থের চেয়ে বয়েসে বড়োই হবে, অন্তত চেহারায় সেই রকম দেখায়। সে সুপ্রিয়াকে বৌদি বলে ডাকে বলে সুপ্রিয়ার বেশ অস্বস্তি হয়।
এই শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা সুপ্রিয়ার ঠিক পছন্দ নয়। ঝি, চাকর, রান্নার লোককে অনেক চেষ্টায় কাজ-টাজ ঠিক মতন শেখালে তারপর সে একদিন ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। তখন রাগ ধরে দারুণ। তার চেয়ে বাবা তৈরি লোক নেওয়াই ভালো।
শশধর সেই লোকটিকে বলল, তুই একটু বাইরে বোস।
তারপর সুপ্রিয়াকে বলল, ভেতরে চলুন, আপনাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।
সুপ্রিয়া এতক্ষণ শশধরকে ভেতরে আসতে বলেনি। কথাবার্তা সব হচ্ছিল বাইরে দাঁড়িয়ে।
ভেতরে ঢুকে নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিল শশধর। তারপর যেন একটা ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল, মাইনে দিতে হবে খুব কম। এমনকি প্রথম মাসে কিছু না দিলেও চলবে!
সুপ্রিয়া হেসে ফেলল।
শশধর বলল, হ্যাঁ, ও কিছু চাইবে না। ওর তো এখন খাওয়া থাকারই জায়গা নেই। আজকাল কোনো লোককে মাইনে না দিয়ে কাজ করানো যায়?
আমি বলছি বৌদি, ও বর্তে যাবে! এমন ভালো বাড়িতে থাকবে।
শশধর চেয়ার টেনে বসল। এবার বোধহয় সে চায়ের আশা করবে।
সুপ্রিয়া হঠাৎ কণ্ঠস্বর বদলে বলল, আমার এখন লোক দরকার নেই।
শশধরের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল, অ্যাঁ!
আমি এখন লোক রাখব না।
আপনার লোক নেই, আপনার এত অসুবিধা হচ্ছে—
শুনুন, আমার যে লোক আছে, সে খুব বিশ্বাসী।
এও খুব বিশ্বাসী, বৌদি। আমি গ্যারান্টি।
আমার লোকটি কাজকর্ম খুব ভালো জানে। ছুটি নিয়ে গিয়ে ফিরতে দু-চারদিন দেরি করছে বটে, কিন্তু আমি জানি, সে ঠিকই ফিরে আসবে। এখন আমি নতুন লোক রাখব না।
অন্তত দু-চারদিনের জন্য রাখুন। আপনার অসুবিধে হচ্ছে ভেবেই ওকে এনেছি।
নতুন লোক রাখার অসুবিধে আছে। তাতে কাজের ঝঞ্ঝাট আরও বাড়ে।
ওঃ। বলে শশধর একটুক্ষণ মাথা নীচু করে চুপ করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে মুখ তুলে সুপ্রিয়ার দিকে একবার কাতরভাবে তাকাল। সে যেন সুপ্রিয়ার কাছ থেকে কিছু একটা দয়া চায়।
বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিলে এই ফ্ল্যাটটা একেবারে আলাদা হয়ে যায় গোটা বাড়ি থেকে। পরপর কয়েকটা দুপুর সুপ্রিয়া একদম একা আছে। শশধর কি তা জেনে শুনেই এসেছে?
অবশ্য শশধরকে দেখে একটুও ভয় পায় না সুপ্রিয়া।
শশধর তার দৃষ্টি, সুপ্রিয়ার মুখে নয়, তার নগ্ন ডান বাহুর ওপর স্থির রেখেছে। খুব ফরসা রং বলে সুপ্রিয়ার হাতখানি মাখনের তৈরি বলে মনে হয়।
সুপ্রিয়া জানে শশধরের ওই লোকটিকে রাখলে আবার কাল দুপুরে আসবে শশধর। তখন তো ও ভালো রকম ছুতো পেয়ে যাবে। তার দেওয়া লোক কেমন কাজ করছে, সে খবর নিতে শশধর তো আসতেই পারে।
তাহলে ওকে রাখবেন না বৌদি?
না।
শশধর কি এখন চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। রোজ রোজ সুপ্রিয়া কাউকে চা তৈরি করে খাওয়াতে পারবে না।
আমার দিদির জ্বর। একবার দেখতে যাবো…আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে।
শশধর আবার বলল, অ্যাঁ?
আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে আজ।
শশধর এমন বোকা নয় যে, এই ইঙ্গিত বুঝবে না। সে খুব লজ্জিত ভাব করে বলল, ও! আপনাকে অসময়ে এসে বিরক্ত করলাম।
সুপ্রিয়া ভদ্রতা করেও কোনো উত্তর দিল না। শশধর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি তাহলে আজ যাই। আপনাকে বেরুতে হবে যখন।
দরজার কাছে গিয়েও মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করে শশদর আবার বলল, আপনি কোন দিকে যাবেন?
সুপ্রিয়া গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, যোধপুর পার্কে।
আপনি কীসে যাবেন? একটা ট্যাক্সি ডেকে দেব?
ট্যাক্সির দরকার নেই, আমি রিকশা করে চলে যাব।
তাহলে রিকশা ডেকে দিই?
আমাদের বাড়ির নীচেই রিকশা পাওয়া যায়? আমার তৈরি হতে খানিকক্ষণ সময় লাগবে।
ও। আচ্ছা চলি, বৌদি।
এবার সত্যি সত্যি চলে গেল শশধর।
দরজা বন্ধ করে হাউস কোটটা খুলে ফেলল সুপ্রিয়া। লোডশেডিং-এর গরমের মধ্যে এই মোটা জিনিসটা এতক্ষণ পরে থাকতে তার রীতিমতন কষ্ট হচ্ছিল।
দুপুরবেলা এই ধরনের উটকো জ্বালাতন কারুর ভালো লাগে না।
বিছানায় ফিরে গিয়ে গল্পের বই খোলার একটু পর সুপ্রিয়ার হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। লোকটা বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নেই তো?
হয়তো শশধর যাচাই করতে চায় সুপ্রিয়া সত্যিই এখন বাড়ি থেকে বেরুবে কি না। অথবা মিথ্যে কথা বলে তাকে বিদায় করা হল। কথাটা মনে পড়া মাত্র সুপ্রিয়া আবার উঠে বাইরের দিকের বারান্দায় চলে এল।
এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখতেই চোখে পড়ল মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে শশধর। সিগারেট টানছে আর এই বাড়ির দিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছে। সুপ্রিয়ার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। শশধরের কী তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি!
সুপ্রিয়া দৌড়ে চলে এল ভেতরে।
হাউসকোট ছাড়া শুধু এই একটা পাতলা জামা পরে সে কখনও বাইরের দিকের বারান্দায় দাঁড়ায় না। পাড়ার ছেলেরা হ্যাংলা ভাবে তাকায়। সুপ্রিয়া সেটা খেয়ালই করেনি।
বিছানায় ফিরে এসে সে আপন মনে হাসতে লাগল। একলা একলা হাসতে অনেক সময় দারুণ ভালো লাগে। শশধর দাঁড়িয়ে থাক যতক্ষণ খুশি। সে কি আবার জিজ্ঞেস করবে, কই বৌদি, বেরুলেন না তো! এতখানি সাহস তার হবে?
ঘন্টাখানেক বাদে সুপ্রিয়া আর একবার গায়ে হাউসকোট চাপিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখে এল। না, শশধর নেই।
সেদিন রাতে সিদ্ধার্থকে সুপ্রিয়া বলল, তোমার বন্ধু আবার এসেছিল।
সিদ্ধার্থ বলল, কে? শশা! এত ঘন ঘন!
সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, ওদের কি অফিসে কাজ-টাজ কিছুই থাকে না? ঠিক তিনটের সময়।
ওদের কাজকর্ম না করলেও চলে। আজ কি ছুতো নিয়ে এসেছিল?
আমার জন্য রান্নার লোক জোগাড় করে এনেছিল।
শশাটা করিৎকর্মা আছে তো। একদিনে লোক জোগাড় করে ফেলল! লোকে আজকাল মাথা কুটেও চট করে একজন রান্নার লোক পায় না। তাকে রাখলে না?
একদম গাঁইয়া। আমাদের কাজ চলবে না।
তোমার দিদির বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে না কেন? তার তো একদম লোক নেই।
হ্যাঁ দিদির বাড়িতে ওকে পাঠাই, তারপর তোমার বন্ধু শশধর রোজ দুপুরে দিদির কাছে গিয়ে উৎপাত করুক আর কি। দিদিও দুপুরে একলা থাকে।
তোমাকে ছেড়ে ও এখন চট করে অন্য কোনো মহিলার কাছে যাবে না। তোমাকেই ওর পছন্দ।
আমি আজ ওকে চা দিইনি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিদায় করে দিয়েছি।
কী করে তাড়ালে?
সুপ্রিয়া সবিস্তারে ঘটনাটি খুলে বলল।
সিদ্ধার্থ আফসোসের সুরে বলল, ইস, বেচারাকে তাড়িয়ে দিলে! তোমার এলেম আছে বলতে হবে…মাত্র দুদিনেই! রমেনের বউ রত্না কিন্তু দু-মাসের মধ্যেও ওকে কিছু বলতে পারেনি।
আমি রত্নার মতন অমন ভালোমানুষ নই।
শশাটা এমনিতেই খুব নিরীহ। বিয়ে-টিয়ে করেনি, নিরালায় সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে গল্প করাটা ওর নেশা। সুন্দরী মেয়েদের ও মনে মনে পুজো করে।
বিয়ে করেনি কেন?
খুব সুন্দরী মেয়ে ছাড়া ওর অন্য কোনো মেয়ে পছন্দ নয়। আমাদের একদিন বলেছিল। যে-সে মেয়েকে ও বিয়ে করবে না। খুব সুন্দরী মেয়ে ওর মতন একটা লোককে বিয়ে করবেই-বা কেন? তাই বেচারার বিয়েই করা হল না।
ইস, ওই চেহারায় আবার সুন্দরী বিয়ে করার শখ! ও বুঝি নিজের চেহারাটা কোনো দিন আয়নায় দেখেনি?
ও কথা বলো না। দ্যাখো, দুর্গাঠাকুর কিংবা সরস্বতী পুজো করে কারা? অধিকাংশই তো রোগা, সিড়িঙ্গে, বিচ্ছিরি চেহারার পুরুষ। দেবীরা খুব রূপসী, তা বলে পূজারিকেও যে সুন্দর হতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই। ও আগে প্রত্যেকদিন দুপুরের শো-তে হিন্দি সিনেমায় যেত, সুন্দরী অভিনেত্রীদের দেখবার জন্য। এখন বোধহয় জ্যান্ত সুন্দরীদের দেখতে চায়।
আমার কাছে আর আসবে না। রোজ রোজ দুপুরে ও সব ন্যাকামো আমার ভালো লাগে না। দুপুরে একটু পড়াশুনো করি।
সুপ্রিয়া ফিলসফিতে এম এ পাস। আজকাল অবশ্য তার পড়াশুনো বিলিতি হালকা গল্পের বইতেই সীমাবদ্ধ।
সিদ্ধার্থ পাশ ফিরে ঘুমোবার আগে বলল, দেখো, ও ঠিক আর একটা কোনো ছুতো খুঁজে আসবে। তোমাকে ওর খুব পছন্দ। আমি আগেও লক্ষ করেছি তোমার নাম শুনলেই ওর মুখখানা কেমন গদ গদ হয়ে যায়।
পরদিন দুপুরে সুপ্রিয়া আবার দরজায় খুট খুট শব্দ শুনল। সেদিনও লোডশেডিং। রীতিমত রেগে গেল সুপ্রিয়া। আজ আর শশধরকে ভেতরে ঢুকতেই দেওয়া হবে না। দরজার কাছ থেকেই তাকে কড়া কথা বলে বিদায় দিতে হবে। হাউসকোটটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সুপ্রিয়া এসে দরজা খুলল। কেউ নেই।
সুপ্রিয়া বাইরে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখল। কই, কেউ নেই তো? কোনো দুষ্টু ছেলে দরজায় টোকা দিয়ে পালিয়েছে। আগে তো কোনোদিন এরকম হয়নি। তাহলে কি সুপ্রিয়ার মনের ভুল! কেউ টোকা দেয়নি! আশ্চর্য!
দরজা বন্ধ করে কাছেই দাঁড়িয়ে সুপ্রিয়া একটুক্ষণ অপেক্ষা করল, না, আর কেউ টোকা দিল না। বিনা কারণে সুপ্রিয়া একবার রাস্তার দিকের বারান্দাটাতেও ঘুরে এল। রাস্তায় কেউ নেই।
এমন ভুল করার জন্য সুপ্রিয়া নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে উঠল।
হাউসকোটটা খুলে সবেমাত্র বিছানায় শুয়েছে। আবার দরজায় টোকা। সুপ্রিয়া উৎকর্ণ হয়ে রইল। এবারেও মনের ভুল?
এরপর বেশ জোরে শব্দ হল দরজায়। এটা কিছুতেই মনের ভুল হতে পারে না। ফের এসে রাগত ভঙ্গিতে দরজা খুলেই সুপ্রিয়ার মুখটা খুশির হাসিতে ভরে গেল। দরজার সামনে অপরাধীর মতন মুখ করে দাঁড়িয়ে রঘু। ওদের রান্নার লোক।
খুশির চোটে তাকে বকুনি দিতেও ভুলে গেল সুপ্রিয়া। স্নেহের স্বরে বলল, তোরা কী করিস? এমন চিন্তায় ফেলিস! আমি ভাবলুম, দেশে গিয়ে তোর আবার কোনো অসুখ বিসুখ হল নাকি!
রঘু কোনো উত্তর দিল না।
আয় ভেতরে। কী হয়েছিল?
রঘু আমতা আমতা করে বলল, এবার দেরিতে বৃষ্টি হল, জমিতে ধান রোওয়া বাকি ছিল…
ধান রোওয়া-টোওয়ার ব্যাপার সুপ্রিয়া কিছু বোঝে না। রঘু ওকে যা খুশি মিথ্যে বুঝিয়ে দিতে পারে। কিন্তু খুশির আতিশয্যে সেসব ভুলে গিয়ে সুপ্রিয়া বলল, ইস! কদিনের জন্য দেশে গিয়ে এমন রোগা হয়েছিস? ওখানে ভালো করে খেতে পেতিস না বুঝি? রান্নাঘরে দ্যাখ আলুর দম আর রুটি আছে। খেয়ে নে।
সুপ্রিয়ার স্বস্তির কারণ, রঘু এসে গেছে। আর তাকে নিজে এসে দরজা খুলতে হবে না। এই যে ধোপা কিংবা ডিমওয়ালা কিংবা ঠিকে ঝি এলেও সুপ্রিয়াকে গিয়ে দরজা খুলতে হয়েছে এই কদিন, এটা তার কাছে বিরক্তিকর।
সুপ্রিয়া নিজের ঘরে ফিরে এল। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগল পাখা। রঘু আসার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছে সুসময়।
একটু পরে বেজে উঠল কলিং বেল।
এখন তো বাবলুর ফেরার সময় হয়নি! তাহলে কি—
সুপ্রিয়া শুয়ে শুয়েই টের পেল, রঘু দরজা খুলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে।
কে রে, রঘু?
রঘু বলল ইস্তিরিওয়ালা। যে জামাকাপড় মেলা ছিল আমি দিয়ে দিচ্ছি।
যাক, রঘু এসে গেছে, এখন সব নিশ্চিন্ত। রঘুই সব ব্যবস্থা করবে।
রঘুকে বলে দিতে হবে, দুপুরবেলা যে-সে এসে দরজায় ধাক্কা দিলে রঘু যেন জানিয়ে দেয়, বাড়িতে কেউ নেই। চেনা লোক হলেও রঘু যেন হুট করে তাকে ভেতরে না ঢুকতে দেয়।
পরদিন কিংবা তার পরদিনও শশধর আর এল না।
কিন্তু পরের শনিবার সুপ্রিয়া তার দিদির সঙ্গে নিউ মার্কেটে শাড়ি কিনতে গেছে, হঠাৎ দেখল একটা স্টলের পাশে শশধর দাঁড়িয়ে। সুপ্রিয়ার দিকে তার পিঠ ফেরানো। সে যেন সুপ্রিয়াকে দেখছে না। দোকানের জিনিস দেখছে খুব মন দিয়ে। সুপ্রিয়া ওকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেল।
ফেরার পথে সুপ্রিয়ার মনে একটা খটকা লাগল। ওই শশধরটা কি ওখানে হঠাৎ গেছে? পুরুষ মানুষ দুপুরবেলা নিউ মার্কেটে একলা একলা ঘুরে বেড়ায়? অথবা সে জানে যে সুপ্রিয়া ওখানে যাবে? কী করে জানল? শশধর ওদের বাড়ির কাছ থেকে অনুসরণ করেছে?
যাক গে, এটা এমন কিছু মাথা ঘামাবার ব্যাপার নয়, এই ভেবে সুপ্রিয়া চিন্তাটাকে উড়িয়ে দিল!
দুপুরবেলা কলিং বেল বাজলেই কিংবা দরজায় খুটখাট শব্দ হলেই সুপ্রিয়া চমকে চমকে ওঠে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে। ধোপা কিংবা কোনো ফেরিওয়ালা কিংবা পাশের ফ্ল্যাটের কেউ। আগেও যে প্রায় দুপুরেই এ রকম কেউ না কেউ আসত, সুপ্রিয়ার যেন মনেই ছিল না।
একদিন সকাল এগারোটায় সুপ্রিয়া লেডিজ কর্নার থেকে তার অর্ডারি ব্লাউজ ও শায়া আনতে গেছে, দেখল যে পাশের পানের দোকানের সামনে ধুতি ও নীল শার্ট পরা একজন রোগা, চিমসে চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা খয়েরি হয়ে আসা ছাতা। খুব মন দিয়ে দেশলাই কিনছে শশধর।
সুপ্রিয়া না-দেখার ভান করে দোকানের মধ্যে ঢুকে গেল। এই দোকানটা শুধু মেয়েরাই চালায়। লোকটা এখানে এই মেয়েদের দেখতে আসে? সকাল এগারোটায়? অফিসে যাওয়া কি একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে? এই দোকানের কোনো মেয়েকেই তো খুব সুন্দরী বলা যায় না।
সে দোকানে প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগল সুপ্রিয়ার। মাপ-টাপ মিলিয়ে নেবার ব্যাপার আছে।
যখন সে দোকান থেকে বেরুল, তখন চকিতে একবার দেখে নিল, শশধরের এখনও যেন দেশলাই কেনা শেষ হয়নি। সেই একই ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে।
শশধর একবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল সুপ্রিয়ার দিকে।
কিন্তু চোখাচোখি হবার আগেই সুপ্রিয়া উঠে পড়ল একটা রিকশায়। সুপ্রিয়ার হাসিও পায়, রাগও ধরে। এ কী শুরু করেছে লোকটা? পাগল হয়ে গেছে নাকি? সুপ্রিয়ার যেন মনে পড়ছে, এর মধ্যে আরও কয়েকবার সে শশধরকে তার কাছাকাছি ঘোরাফেরাও করতে দেখেছে। লোকটা সব সময় তাকে অনুসরণ করে? কিন্তু এজন্য রাস্তার মাঝখানে তো ওকে গিয়ে ধমক দিতে পারে না।
মেট্রো সিনেমায় ছবি ভাঙার পর ওপরের সিঁড়ি দিয়ে সুপ্রিয়া তার দিদি ও দুই বান্ধবীর সঙ্গে নামছে, এমন সময় সে বলে উঠল, এই রে।
সিঁড়ির নীচে কাচের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শশধর। সেই একই রকম পোশাক, কদিন ধরে বৃষ্টির নাম গন্ধ নেই, তবু হাতে সেই ছাতা। করুণ, তৃষ্ণার্ত চোখ মেলে চেয়ে আছে সুপ্রিয়ার দিকে।
দিদি জিজ্ঞেস করল, কী হল?
সুপ্রিয়া বলল, কিছু না। ভাবছিলাম, বুঝি চাবিটা ফেলে এসেছি। না। ব্যাগের মধ্যে আছে।
দিদি কিংবা বান্ধবীদের কাছে কথাটা বলা যায় না। ওরা নিশ্চয়ই হাসি-ঠাট্টা করবে।
শশধর কিন্তু সরে গেল না। সুপ্রিয়ারা নীচে নেমে যখন কাচের দরজা পেরিয়ে যাচ্ছে, তখনও সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে সুপ্রিয়ার দিকে। যেন তার উষ্ণ নিশ্বাস এসে লাগল সুপ্রিয়ার ঘাড়ে। সুপ্রিয়া মুখখানাকে সোজা রাখল, ওর দিকে একবারও তাকাল না।
যখন সঙ্গে সিদ্ধার্থ থাকে, কিংবা জামাইবাবু কিংবা যে-কোনো পুরুষ মানুষ, তখন কিন্তু শশধরকে কক্ষনো দেখা যায় না। সে সুপ্রিয়াকে একা দেখতে চায়। কিংবা অন্য মেয়েরা সঙ্গে থাকলেও ক্ষতি নেই। এটা সুপ্রিয়া লক্ষ করেছে। কিন্তু রাস্তায় বেরুলেই যদি মনে হয়, দূর থেকে কেউ তাকে লক্ষ করছে, তাহলে খুব অস্বস্তি লাগে না? এর একটা প্রতিকার করা দরকার। এ ব্যাপারটা সিদ্ধার্থকে বলবে কি বলবে না, সুপ্রিয়া মনস্থির করতে পারে না। সিদ্ধার্থ হয়তো হেসে উঠবে। যা হালকা স্বভাব ওর।
একদিন মুখোমুখি হয়ে গেল।
সুপ্রিয়ার পরনে গাঢ় লাল শাড়ি। পায়ে লাল চটি, মাথায় লাল ছাতা। তার গৌরবর্ণ এই রক্তিম আভরণে যেন সোনার মতন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সুপ্রিয়ার দিকে রাস্তায় অনেক মানুষই তাকায়। সেটা সুপ্রিয়ার ভালোই লাগে, কিন্তু একজন বিশেষ কেউ তাকিয়ে থাকলেই আর স্বাভাবিক হওয়া যায় না।
গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে দিয়ে হাঁটছে সুপ্রিয়া, বিকেল পৌনে ছ-টা, আকাশটাও তার পোশাকের মতন রক্তবর্ণ, সেই সময় উলটো দিক থেকে ঠিক মুখোমুখি হেঁটে এল শশধর। চোখে সেই একই রকম করুণ, তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি! সুপ্রিয়া থমকে দাঁড়িয়ে সোজা তাকাল ওর দিকে।
শশধর আরও দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল। তার মুখে যেন আলো ফুটে উঠেছে। সুপ্রিয়ার মুখে সে হাসি দেখতে পেয়েছে।
একেবারে কাছাকাছি এসে সে কথা বলার জন্য সবে ঠোঁট ফাঁক করেছে, সুপ্রিয়া সেই সময় তার পোশাকের মতন চোখও রক্তবর্ণ করে ফেলল, তারপর দারুণ ঘৃণার সঙ্গে বলল, ছিঃ।
ওই একটা মাত্র শব্দ, আর কিছু না। তারপরই সুপ্রিয়া ডানদিকে ফিরে একটা রিকশা ডাকল। রিকশায় উঠে আর একবার পিছন ফিরে তাকাল না পর্যন্ত। ইচ্ছে করেই একটু বেশি খারাপ ব্যবহার করতে হল সুপ্রিয়াকে। ওই লোকটাকে আর বেশি প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। দিনের পর দিন পথেঘাটে একজন লোককে নিয়ে ঘোরা, এ যেন একটা দারুণ বোঝা। এ অন্য কেউ বুঝবে না। সবাই শুনলে বলবে, এতে আর এমন কি হয়েছে, লোকটা তো কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু এ যে এক সাংঘাতিক মানসিক চাপ। সবসময় একটা লোক তাকিয়ে থাকবে? ওর লোভী দৃষ্টি যেন সুপ্রিয়ার পিঠে ফোটে।
আজ একটু হেসে কথা বললেই আর কোনো উপায় ছিল না। আবার ঠিক বাড়িতে আসতে আরম্ভ করত। এরা এক ধরনের রোগী, এদের শিক্ষা দেওয়া দরকার। সেইজন্যই সুপ্রিয়া আজ ইচ্ছে করে বেশি সাজগোজ করে বেরিয়েছিল।
কদিন বাদে রাস্তায় বেরিয়ে সুপ্রিয়ার মনে হল, তার শরীরটা যেন বেশ হালকা হয়ে গেছে। মেজাজটাও ভালো লাগছে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল। না, শশধর কোথাও নেই। সত্যিই নেই। সুপ্রিয়া ঠিক বুঝতে পেরেছে।
তারপর আর কোনো দিনই শশধরকে দেখা গেল না।
রাস্তায় এমনিই তো মানুষের সঙ্গে মানুষের হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। শশধরের সঙ্গে সেরকমও দেখা হয় না কখনো। সুপ্রিয়ার পথ থেকে শশধর নিজেকে যেন সম্পূর্ণ সরিয়ে ফেলেছে। যাক নিশ্চিন্ত!
নিছক কৌতূহলেই সুপ্রিয়া একদিন তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, তোমার সেই বন্ধুর কী খবর। ওই যে শশধর না কি যেন নাম? তোমাদের তাসের আড্ডায় আর আসে-টাসে না?
সিদ্ধার্থ বলল, শশা? না, সে তো আর অনেক দিন আসে না। সবাই মিলে ওর পেছনে খুব লাগা হত তো। রমেন বলেছিল, ওরে শশা, ইংলন্ডের রাজকুমারীর ডিভোর্স হয়েছে তুই তাকে বিয়ে করবি নাকি? বল তাহলে সম্বন্ধ করি।
যাঃ, একটা নিরীহ লোককে নিয়ে তোমরা এরকম নিষ্ঠুর রসিকতা করো।
নিরীহ ভালোমানুষদেরই তো পিছনে লাগে সবাই। আমাকে নিয়ে কি কেউ ওরকম বলতে পারবে?
আর আসে না?
নাঃ! একদম যেন হারিয়েই গেছে। আগে বলত, আমি ভাই ব্যাচেলার মানুষ, সন্ধের পর সময় কাটে না। তাই তোমাদের কাছে আসি। তাস খেলায় ওকে নেওয়া হত না, তবু চুপচাপ বসে থাকত। হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেছে।
এরপর শশধর মুছে গেল ওদের জীবন থেকে। তবে, পেন্সিলের লেখা ও ইরেজার দিয়ে খুব ভালো করে মুছলেও একটু না একটু সূক্ষ্ম দাগ থেকে যায়।
রাস্তায় বেরিয়ে সুপ্রিয়া এখনও হঠাৎ পিছন ফিরে তাকায়! সেই শুকনো মুখওয়ালা মানুষটা চট করে কোথাও সরে পড়ল না তো? পানের দোকানের পাশ দিয়ে একটা ছায়া সরে গেল না? কিন্তু না, এ সব ব্যাপার বুঝতে ভুল হয় না। মেয়েদের পিঠেও চোখ থাকে।
সুপ্রিয়া মাঝেমাঝেই ভাবে, লোকটা গেল কোথায়?
পরক্ষণেই সে ভাবে, এ কী, আমি লোকটার কথা ভাবছি কেন? লোকটা গেছে, বাঁচা গেছে! কম জ্বালান জ্বালিয়েছে এই ক-মাস!
দুপুরবেলা কেউ কলিং বেল বাজালে সুপ্রিয়া এখনও চমকে চমকে ওঠে। সুপ্রিয়া যেন শশধরের জন্যই প্রতীক্ষা করে। লোকটা যে সত্যিই আর আসবে না কিংবা রাস্তায় অনুসরণ করবে না, সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে, এটা সুপ্রিয়ার কাছে এখনও অবিশ্বাস্য মনে হয়।
একদিন নির্জন দুপুরে আবার বেল বাজে। দরজা খুলে দেয় রঘু। অচেনা বা অল্প চেনা লোক হলে দুপুরে ঢুকতে দেওয়া হবে না, এরকম নির্দেশ আছে রঘুর ওপর। কিন্তু একজন অচেনা আগন্তুক রঘুকে গ্রাহ্যই না করে দরজা খোলা মাত্র সরাসরি ভেতরে ঢুকে পড়ে করুণ গলায় ডাকে, সুপ্রিয়া! সুপ্রিয়া।
সেই ডাক শুনে সুপ্রিয়ার বুক ধড়াস ধড়াস করে ওঠে। খাট থেকে নেমে ড্রেসিং গাউন পরতে ভুলে গিয়ে, প্রায় দৌড়েই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে! তারপর থমকে গিয়ে বলে, তুমি?
সব সুন্দরী রমণীদেরই একাধিক প্রেমিক থাকে। রূপের কিছু স্তাবক না থাকলে রূপ কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। শুধু নিজের স্বামীর জন্য কোনো বিবাহিতা রমণী বছরের পর বছর রূপচর্চা বা সৌন্দর্যচর্চা করে? মেয়েরা প্রসাধন করে বাইরে বেরুবার সময়।
চেনাশুনোদের মধ্যে সুপ্রিয়ার চার-পাঁচজন ঘনিষ্ঠ স্তাবক আছে বটেই, তা ছাড়া আছে একজন বাল্যপ্রেমিক।
সেই সময় মেয়েরাই ভাগ্যবতী, যাদের একজন বাল্যপ্রেমিক থাকে, কিন্তু তার সঙ্গে বিয়ে হয় না, বিয়ে হয় একজন বেশ স্বাস্থ্যবান, সচ্ছল, নির্ভরযোগ্য মানুষের সঙ্গে, তারপর বাকি জীবন সেই বাল্যপ্রেমিকটির সঙ্গে কাছাকাছি বা দূরত্বে একটি মধুর সম্পর্ক থেকে যায়। সুপ্রিয়া সেই রকম ভাগ্যবতী।
তার বাল্যপ্রেমিকটির নাম অভিজিৎ। সব দিক থেকেই রোমান্টিক প্রেমিক হবার যোগ্যতা আছে তার। সে শুধু সুদর্শন নয়, তাকে দেখা যায় খুব কম। সে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য চাকরির কারণে। এবং সে বিয়ে করেনি।
অভিজিৎ আসে ন-মাসে ছ-মাসে একবার। এবার এল ঠিক পৌনে দু-বছর পর। সুপ্রিয়া খুশি ও অভিমান মিশিয়ে জিজ্ঞেস করল, মনে আছে, তাহলে?
চিঠি লেখার অভ্যেস নেই অভিজিতের। তা ছাড়া চিঠি লেখার অসুবিধেও আছে। সে বলল, তুমি জানতে না, আমি বাঙ্গালোরে আছি এখন?
অভিজিতের সঙ্গে একটা ক্ষীণ সূত্র আছে যোগাযোগের। অভিজিতের মাসতুতো বোন স্বপ্না আবার সুপ্রিয়ার বান্ধবী। তবে স্বপ্নার সঙ্গেও আজকাল বেশি দেখা হয় না, আর দেখা হলেও সুপ্রিয়া মুখ ফুটে তার কাছে অভিজিতের কথা জিজ্ঞেস করতে পারে না!
বাঙ্গালোর বুঝি পৃথিবীর ওপারে? সেখান থেকে কি এতদিন পর পর আসতে হয়?
অভিজিৎ বলল, সত্যিই এর মধ্যে একবারও কলকাতায় আসতে পাইনি। তুমি কেমন আছ?
কেমন দেখছ?
আগের চেয়েও সুন্দর।
অভিজিৎ পূজারি নয় এবং নিছক স্তাবক। সে বাল্যপ্রেমিক। বাল্যপ্রেমিকরা হিংস্র হয়, শুধু মুখের কথা নয়, তারা আরও অনেক কিছু চায়।
‘আগের চেয়েও সুন্দর’ কথাটা উচ্চারণ করে অভিজিৎ গাঢ়ভাবে বেশ কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে সুপ্রিয়ার দিকে। তারপর সে বলে, আমাকে কি বসতে বলবে না?
তোমার সঙ্গে ভদ্রতা করতে হবে বুঝি?
অভিজিৎ একটা চেয়ারে বসে পড়ে আর একটা চেয়ার টেনে কাছে এনে বলে, তুমি বসো এটাতে।
সুপ্রিয়া তবু দাঁড়িয়ে থাকে। সে দেখে অভিজিতের মাথায় গুচ্ছ গুচ্ছ কোঁকড়া চুল ঠিক দশ বছর আগে যেমন ছিল, এখনও সেই রকমই আছে।
অভিজিতের ব্যবহার অত্যন্ত সাবলীল। সে সুপ্রিয়ার উরুতে ডান হাতের পুরো পাঞ্জাটা রেখে বলে, এসো আমার কাছে এসে একটু বসো।
যেন আগুনের স্পর্শ লেগেছে, এইভাবে ভয় পেয়ে সুপ্রিয়া ছিটকে সরে যায়।
চোখ দিয়ে সে ভর্ৎসনা করে অভিজিৎকে। অভিজিতের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। রঘু আছে না?
অভিজিৎ লজ্জা না পেয়ে হাসে।
রঘু দুপুরবেলা দরজার কাছে যেখানে শুয়ে থাকে, সেখান থেকে বসবার ঘরের কথাবার্তা ঠিক শোনা যায় না। কিন্তু রঘু যদি এখানে হঠাৎ এসে পড়ে? সুপ্রিয়া কোনো রকম ঝুঁকি নিতে চায় না। অভিজিৎ যদি আগে খবর দিত তাহলে সুপ্রিয়া একটা কিছু ব্যবস্থা করত। সবচেয়ে সুবিধে, বাইরে কোথাও দেখা করা।
দুপুরবেলা আগন্তুক সম্পর্কে যাতে রঘুর কোনো কৌতূহল না জাগে সেই জন্য সুপ্রিয়া সাড়ম্বরে রঘুকে ডেকে বলল, রঘু, দুকাপ চা করে দে তো। কিংবা কফি থাকলে কফি করে দে!
রঘু যতক্ষণ কফি বানায়, ততক্ষণ অভিজিৎ টুকিটাকি কথা বলে সুপ্রিয়ার সঙ্গে। কিন্তু তার ভেতরটা ছটফট করে। অনেক দিন পর, অনেক দূর থেকে এসে দেখা করলে তার একটুও দূরত্ব পছন্দ হয় না। সুপ্রিয়া কেন অত দূরে বসে আছে?
রঘু কফি দিতে এলে অভিজিৎ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে বলে, যাঃ, সিগারেট আনতে ভুলে গেছি। তারপর সে রঘুর দিকে চেয়ে মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করে, ভাই, এক প্যাকেট সিগারেট এনে দিতে পারবে?
সুপ্রিয়া তীক্ষ্ণভাবে প্রশ্ন করে, কেন, কাছে সিগারেট নেই?
না, একদম ভুলে গেছি।
তাহলে আর সিগারেট নাই-বা খেলে! এখন খেতে হবে না।
চা কিংবা কফি খাওয়ার পর সিগারেট না খেলে চলে? আজকাল অনেক কমিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কফির পর একটা—
সুপ্রিয়া শোবার ঘরে খুঁজতে গেল। এবং সত্যিই সিদ্ধার্থের কোনো সিগারেট খুঁজে পেল না। একটা প্যাকেট আছে, তা-ও খালি।
ততক্ষণে অভিজিৎ টাকা বার করে ফেলেছে। সুপ্রিয়া ফিরে আসা মাত্র সে টাকাটা রঘুকে দিয়ে বলল, ভাই, চট করে এক প্যাকেট নিয়ে এসো। কাছেই দোকান আছে না?
রঘু দরজা টেনে বেরিয়ে গেল। এ এমনই দরজা, একবার টেনে দিলে বন্ধ হয়ে যায়, বাইরে থেকে খোলা যায় না।
রঘু বাইরে যাওয়া মাত্র অভিজিৎ লাফিয়ে উঠল।
অভিজিতের আলিঙ্গনের মধ্য থেকে চুম্বন ভেজানো ঠোঁটে সুপ্রিয়া বলল, শোন, তোমাকে আমি শশধর বলে ডাকব!
অভিজিৎ ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল, শশধর সে কে?
কেউ নয়?
হঠাৎ ওই বিদঘুটে নামটাই বললে কেন?
এমনিই। বিদঘুটে কেন হবে, শশধর মানে চাঁদ। চাঁদও তো তোমারই মতন।
রোহিণীকে ভুলে থাকে।
তুমি বুঝি রোহিণী?
সময় খুব কম, রঘু এক্ষুনি ফিরে আসবে, তাই, অভিজিৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সেই অবস্থার মধ্যেও সুপ্রিয়া মনে মনে একটা সংলাপ তৈরি করে রাখে।
সাবধানতার জন্য আজ রাতেই সে খাওয়ার টেবিলে তার স্বামীকে হাসতে হাসতে বলবে, আজ দুপুরে তোমার সেই বন্ধু হঠাৎ আবার এসে হাজির হয়েছিল।
ওই যে শশধর, না কি যেন নাম?