পুষ্পবৃষ্টি

পুষ্পবৃষ্টি

ফার্স্ট আওয়ারে অফিসের বরাদ্দ চা খেয়ে, বাইরে সিগারেট টেনে এসে, সবে কাজে মন

দিয়েছে উপল। অংশু এসে বলল, উপলদা, গোরাদার বউ এসেছে, সঙ্গে সেই ছেলেটাও। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল উপলের। এই এক ঝামেলা হয়েছে ক’দিন ধরে। গুজগুজ ফিসফাস চলছে স্টাফদের মধ্যে। চাপা অসন্তোষ। গোরার বউয়ের ব্যাপারে একটা বিহিত করতে হবে। উপল যেহেতু ইউনিয়নের সেক্রেটারি, সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকেই। কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে অংশুর দিকে তাকায় উপল। দেখে শুধু অংশু নয়, ডিটিপি রুমের বাকি চারজনও তার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে একটাই আবেদন, গোরার টাকা এভাবে জলে ফেলে দেওয়া আটকাতেই হবে।

চাকা লাগানো চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে উপল। নেতা হওয়ার হ্যাপা তো সামলাতেই হবে। অংশুকে বলে, দাঁড়া দেখি, গুপ্তদা কী বলছে।

কী আবার বলবে। তুমি যা ঠিক করবে, তাই হবে। বলল অংশু। এ হল পাম্প মারা কথা। সব বুঝেও কিছু করার থাকে না উপলের। প্রাইভেট এই প্রিন্টিং প্রেসের ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে তার হাতেই। বছর তিনেক আগেও এখানকার কেউ ইউনিয়নের কথা ভাবতে পারত না। স্টাফ ছিল তিরিশজন। চাকরি যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত দুবেলা।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে উপল। গুপ্তদা অ্যাকাউন্টসের হেড। বসে অফিসের শেষ মাথায়। মালিকের চেম্বারের পাশেই। প্রুফ রিডার আর্টিস্টদের ঘর পেরিয়ে করিডোরে পা রেখে থমকে যায় উপল। এক পাশের দেওয়াল কাচের, ওপারে পরদা টানা। ইচ্ছে করলে পরদার ফাঁক দিয়ে রিসেপশন এরিয়াটা দেখা যায়। একবার দেখবে কি ছেলেটাকে? গোরার বউয়ের সঙ্গে আজ নিয়ে তিনদিন এল। উপল এখনও দেখেনি। ছুটিতে ছিল। স্টাফেরা বলছে, বর মরতে না মরতে একটা ছেলের সঙ্গে ঘুরছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির টাকাগুলো পেলেই বিয়ে করে ফেলবে। কী মেয়ে মাইরি!

অংশু বলেছিল, টাকাটা যাতে সহজে না পায়, তারই ব্যবস্থা করো উপলদা। দেখি ছেলেটা কতদিন ঘোরে— কথাগুলো শোনার পর বিশেষ কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি উপলের। বলেছিল, বিয়েটা হলে তো ভালই হয়, মেয়েটার জীবন নষ্ট হবে না। এই তো বছর দুয়েক হয়তো হল, বিয়ে হয়েছে বেচারির।

ব্যানার্জিদা বলেছিল, বিয়েতে কে বারণ করেছে? বিয়ে করুক। গোরার টাকায় ফুর্তি মারা চলবে না। অফিসে কী পরিশ্রমটাই না করত গোরা। কমবেশি আমরা সকলেই করি। অসময়ে চলে গেল ছেলেটা। বউটা তাকে মনে রাখল না। দু’দিন যেতেই একজনকে জুটিয়ে

নিয়েছে। গোরাকে যখন ভুলতে পেরেছে, ওর টাকাটাকেও ভুলে যাক।

ব্যানার্জিদার সঙ্গে সলিল যোগ করেছিল। আমি শিয়োর ছেলেটা গোরার টাকার লোভেই বউটার সঙ্গে ভিড়েছে। রোজগারপাতি কিছু করে বলে তো মনে হয় না। ওই টাকা দিয়ে কোনও একটা বিজনেস ফিজনেস ফেঁদে বউটাকে ফুটিয়ে দেবে। বয়সে গোরার বউয়ের থেকে ছোটই হবে ছেলেটা।

উপল বলেছিল, ছেলেটা রিলেটিভও হতে পারে। বাপের বাড়ির কেউ।

বয়স্ক কোনও আত্মীয়স্বজন ছিল না? ইয়ং একটা ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে হবে! এই কথাটা জমায়েতের মধ্যে কে বলেছিল, এখন আর মনে নেই উপলের। ব্যাপারটা নিয়ে সে আর বিশেষ ভাবেনি। গোরা তার সহকর্মী ছিল, গভীর কোনও বন্ধুত্ব ছিল না। অ্যাক্সিডেন্টে গোরার মারা যাওয়াটা খুবই দুর্ভাগ্যের। তার পাওনা টাকা নমিনি সময়মতো পাচ্ছে কিনা, সেটা দেখা অবধি উপলের কাজ। তারপর সেই নমিনি, এ ক্ষেত্রে গোরার বউ টাকা নিয়ে কী করছে, সে ব্যাপারে উপল মাথা ঘামাতে যাবে কেন? উপল এখনও বিয়ে করেনি। একজন স্ত্রীর স্বামীর প্রতি কতটা অনুগত থাকা উচিত, স্বামীর মৃত্যুর কতদিন পর তাকে ভুলে যাওয়া যেতে পারে, এ ব্যাপারে কোনও ধারণা নেই উপলের। এই মুহূর্তে করিডরে দাঁড়িয়ে সাধারণ কৌতূহলে উপলের একবার গোরার বউ এবং তার সঙ্গীটিকে দেখতে ইচ্ছে করে। কাচের দেওয়ালের কাছে গিয়ে পরদার ফাঁক দিয়ে খুঁজে নেয় দু’জনকে। প্রথমেই বুকটা কেমন যেন খালি খালি লাগে উপলের। মাথা নিচু করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে ওরা। গোরার বউয়ের পরিষ্কার সিঁথিটা বড্ড বেশি চোখে লাগছে। ছেলেটার বয়স সত্যিই অল্প, একেবারে গা ঘেঁষে বসে আছে গোরার বউয়ের। দৃশ্যটায় গোরার না থাকাটাই সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হচ্ছে। বিমর্ষ হয়ে পড়ে উপল, মনে পড়ে স্বভাবলাজুক, পরিশ্রমী, ভুলের ভয়ে সদাসন্ত্রস্ত গোরাকে। বেচারার অস্তিত্ব এত তাড়াতাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল!

কাচের দেওয়াল থেকে সরে এসে উপল অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের দিকে এগোয়।

উপল ঘরে ঢুকতেই কম্পিউটার থেকে চোখ ফেরায় গুপ্তদা। বলে, তোমার কথাই ভাবছিলাম। গোরার বউ এসেছে। স্টাফেরা কী বলছে শুনেছ তো, কী করা যায় এখন? প্রভিডেন্ট ফান্ডের ক্লেম সরকারের ঘরে পাঠিয়েছেন? জানতে চায় উপল। গুপ্তদা বলে, এখনও পাঠাইনি। এদিকে ওরা ঘনঘন আসছে।

ঘোরানো যাবে? তা, না ঘোরানো কিছু নেই। মাস ছয়েক তো ইজিলি। এখন তুমি কী বলো, সেটার উপর নির্ভর করছে।

ঘোরান। বলে, ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে উপল। বুঝতেই পারে, গুপ্তদার ইচ্ছে বাকি স্টাফেদের মতোই।

সিটে ফিরে এসেছে উপল। মন বসছে না কাজে। গোরার স্মৃতি ঘুরেফিরে আসছে মাথায়। একদিন হঠাৎ বিয়ের কার্ড নিয়ে হাজির। উপলদা, আমার বিয়ে। একটা কার্ডে অল স্টাফ লিখে নেমন্তন্ন করে দিলাম। সবাইকে এমনিতে মুখে বলেছি, তুমি সেক্রেটারি, কার্ড তোমার কাছেই থাক। যেয়ো কিন্তু।

সে কী রে, তোর বিয়ে! তুই তো আমার থেকে ছোট। বলেছিল উপল।

গোরা বলে, তাতে কী হয়েছে? তোমার অনেক আগে চাকরিতে ঢুকেছি। আর তুমিই বা বিয়ে করছ না কেন? এরপর তো বুড়ো হয়ে যাবে।

গোরার পিছনে তখন আরও বেশ কয়েকজন স্টাফ জমা হয়েছে। নন্দী বলেছিল, উপলের টেস্ট অনেক উপরের দিকে। নায়ক-নায়ক দেখতে তো। এদিকে চাকরি করে পাতি প্রাইভেট কোম্পানিতে, ঠিকঠাক নায়িকা জুটছে না আর কী।

সলিল বলেছিল, ওর সুন্দরী বউ হয়ে তো আমাদের কোনও লাভ নেই। খাওয়া দাওয়াটা যেন জম্পেস হয়। সেখানে ফাঁকি মারলে কিন্তু ছেড়ে দেব না।

কথাটা বাকিরা হইহই করে সমর্থন করে। প্রসঙ্গ ছিল গোরার বিয়ে, কেন্দ্রে এসে পড়েছিল উপল। আত্মীয়বন্ধুরাও বিয়ের ব্যাপারে খোঁচায়। উপল কিন্তু ‘বিয়ে করব না’ বলে পণ করে বসে নেই। সাংসারিক নানা কারণে বিয়েটা জাস্ট হয়ে ওঠেনি। উপলের গ্র্যাজুয়েশনের পরই বাবা মারা গেলেন। তখনও বোনের বিয়ে বাকি, ভাইয়ের পড়াশোনা চলছে। ছাত্র হিসেবে ভাই লেখাপড়ায় বেশ ভাল। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রস্তুতির কারণে দামি টিউশন ফি লাগছে তার পিছনে। স্কুল শিক্ষক বাবার পেনশনের টাকা সংসার চালানো পক্ষে বেশ কষ্টকর। উপল এম এ-তে ভরতি না হয়ে টিউশন পড়াতে শুরু করল। ভেবেছিল প্রাইভেটে মাস্টার্সটা করবে। সে আর হল কই! এক ফাঁকে কম্পিউটারটা শিখেছিল, ঢুকে পড়ল চাকরিতে। বোনের বিয়েটা দিতে পেরেছে। ভাই এখন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ফাইনাল ইয়ার। কোথা দিয়ে যে সময় চলে গেছে, টেরই পায়নি। মা ইদানীং বিয়ে বিয়ে করে খুব খেপে উঠেছে। মেয়ে দেখাশোনা চলছে। আজই একটা মেয়ের সঙ্গে মিট করার কথা আছে উপলের। চৌত্রিশ বছরের জীবনে সাকুল্যে তিনটে প্রেম এসেছিল, কোনওটাই দানা বাঁধেনি। গোরার বিয়েটা ছিল উপলের কাছে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। বউভাত খেতে গিয়ে চমকে গিয়েছিল ওদের ঐশ্বর্য দেখে। তিনতলা চক মিলানো বাড়ি। বড় বড় ঘর। প্রচুর আলো। বিপুল খাওয়া দাওয়া। সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ ছিল গোরার বউ। দুর্দান্ত দেখতে। এক গা গয়না পরে যেন জমিদারকন্যা। গোরা বউয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল এই বলে, ভাল করে দেখে রাখো। এই হচ্ছে আমাদের আসল মালিক। ইউনিয়নের লিডার উপলদা। এর ভরসাতেই রোজ অফিস যাই।

গোরার বউ একটু বেশি ঝুঁকে নমস্কার জানিয়েছিল। তারপরই গোরাকে সাইডে টেনে নিয়ে গিয়েছিল উপল। বলেছিল, হ্যাঁরে, তোদের যে এত বড় বাড়ি, কখনও বলিসনি তো!

অধোবদন হয়ে গোরা বলেছিল, এ আর নিজের মুখে কী বলব? এইসব উৎসব অনুষ্ঠানে লোকে জানতে পারে। তা ছাড়া এই বাড়ির পিছনে তো আমার কোনও ক্যালি নেই। বাবার করা। ওপার বাংলা থেকে এসে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। তোর বাবা কী করে রে?

আমাদের সোনার দোকান। এখন টিমটিম করে চলে। যা ইনকাম, ওই বন্ধকি কারবারে।

মেয়েটাও বাবার দেখে দেওয়া, নাকি প্রেম? জানতে চেয়েছিল উপল।

আমার দ্বারা আবার প্রেম, কী যে বলো ! আরও লজ্জা পেয়ে বলেছিল গোরা। ওইটুকুতেই যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল উপল। যে তেলচিটে মার্কা নামওয়ালা সহকর্মী, গোরার গোটা নাম গোরাচাঁদ, টাইটেল সাহা, হাইট মেরেকেটে পাঁচ দুই-তিন, সিঁথি কেটে চুল আঁচড়ায়, নিয়মিত তেল দেয় চুলে, পোশাক মোস্ট অর্ডিনারি। এ সবই তার বহিরঙ্গ মাত্র, কর্মীটির আর্থিক অবস্থা খুবই মজবুত, যার ভিত্তিতে এ বাড়িতে পা রেখেছে সালাংকারা সুন্দরী। গোরার পেটে খুব বেশি বিদ্যে নেই। বউ যে গ্র্যাজুয়েট ফলাও করে বলেছে বউভাতের দিনই। উপল যখন চাকরিতে ঢোকে, গোরা অফিসের পিয়ন। ক্রমে কাজ শিখে ডিটিপি সেকশানে আসে। গোরার সৌভাগ্যে খুশিই হয়েছিল উপল। ছেলেটা দিব্যি ছোট থেকেই প্রাচুর্যের মধ্যে কাটাচ্ছে! যার দশ শতাংশ অর্জন করতে দু’পুরুষ লেগে যাচ্ছে উপলদের। বাবা যে সময় শিক্ষকতা করেছেন, স্কুলের মাইনে ভাল ছিল না। নীতিগতভাবে টিউশন পড়াতেন না বাবা। পিতার আদর্শের ঠেলা ভাল মতোই সহ্য করতে হয়েছে উপলসহ বাড়ির সবাইকে। মা হামেশাই বাবাকে বলত, তোমার নীতি ধুয়ে জল খেলে কি পেট ভরবে, না ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো মানুষ হবে?

বাবা এসব কথায় কর্ণপাত করত না। নিজের মতোই চলত। তবে নীতি শব্দটা উপলদের অভাবের সংসারে টনিকের মতো কাজ করত। উপলরা জানত, সাধারণের থেকে তারা আলাদা। তাদের স্বভাব-রুচি উঁচু পরদায় বাঁধা। সেই কারণেই কিনা, কে জানে! উপলের তিনবার প্রেম নষ্ট হওয়াতে এতটুকু মনঃকষ্ট হয়নি। তিন প্রেমিকাই ছিল রূপেগুণে নিতান্ত অ্যাভারেজ। গোরার এমন সুন্দরী বউ দেখে মস্ত শিক্ষা হয়েছিল উপলের। বুঝেছিল, রুচিবান একটা শূন্যগর্ভ ব্যাপার। সুন্দরী বউ পেতে গেলে অর্থই আসল কথা। তা যে পথেই আসুক। তবে বউটি যদি ঝগড়ুটে হয়, রূপের কোনও মানেই থাকে না। গোরা বিয়ে করে সুখেই ছিল। বউয়ের ব্যাপারে কখনও নিন্দেমন্দ করতে শোনা যায়নি। বিয়ের পর হপ্তাখানেক গোরার পিছনে লাগত স্টাফেরা। নতুন বউকে জড়িয়ে নানা আদি রসাত্মক টিপ্পনী। অফিসের যে কেউ বিয়ে করলে এমনটা ক’টা দিন এভাবে কাটে। এসব খেলো ব্যাপারে উপল কখনওই যোগ দেয় না। ঠাট্টা, ইয়ারকি হাসিমুখে মেনে নিত গোরা। দিন যেতে আলোচনা থেমে গেল। গোরার যে বিয়ে হয়েছে, একসময় ভুলেই গিয়েছিল উপল। একদিন বাড়ি ফিরেছে, সলিলের ফোন, তাড়াতাড়ি চলে আয়। গোরাকে ধাক্কা মেরেছে

বাসে। চিত্তরঞ্জনে আছি।

ভীষণ উৎকণ্ঠায় উপল জানতে চেয়েছিল, কন্ডিশান কেমন? ভাল নয় মোটেই।

উপল ট্যাক্সি ধরে চলে এসেছিল হাসপাতালে। গোরা তখনও বেঁচে৷ কোম্পানির মালিকও ছিলেন। বললেন, নার্সিংহোমে শিফট করো। খরচ যা হবে কোম্পানি বেয়ার করবে।

শিফট করার মতো অবস্থা ছিল না গোরার। গোটা মাথায় ব্যান্ডেজ, স্যালাইন, অক্সিজেন চলছে। সহকর্মীদের কাঁধের উপর দিয়ে উপল দেখেছিল গোরার স্যালাইনের সুচ বেঁধানো হাতটা নিথর থাকলেও, হাতের আঙুলগুলো নড়ছে। যেভাবে কম্পিউটারের কী বোর্ডের

উপর আঙুল চলে। আচ্ছন্ন অবস্থায় বিড়বিড় করে কী যেন বলছে গোরা। মুখের কাছে কান নিয়ে গেছে শম্ভু। অফিস বেয়ারা শম্ভু পরে বলেছিল, গোরা নাকি তখন বলছিল, শম্ভু তাড়াতাড়ি ম্যাটার দে।

এই বাক্যবন্ধটি ডিটিপি সেকশানের সকলেই বলে থাকে। যখন বাড়ি যাওয়ার সময় হয়। গোরার বাড়ি ফেরা হল না। উপল পৌঁছোনোর এক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেল। বাইরের থেকেও বেশি গোরার শরীরের ভিতরটাকে জখম করেছিল বাসটা। মৃত্যু চোখের সামনে একবারই দেখেছে উপল। বাবার মৃত্যু। পরের বার দেখল তার চেয়ে বয়সে ছোট গোরার এভাবে আকস্মিক চলে যাওয়া। সেদিন দু’ঘণ্টা ওভারটাইম করে অফিস থেকে বেরিয়েছিল গোরা। রোজকার মতোই রাস্তায় দাঁড়িয়ে চটি ছেড়ে ফুটপাতের শিবমন্দিরের উদ্দেশে চোখ বুজে প্রণাম করছিল, বাসটা তখনই ধাক্কা মেরে চলে যায়। ওরকম একটা নিবেদিত অমলিন মুহূর্তেও যে মৃত্যু মানুষকে রেহাই দেয় না, এটা ভাবতে ভাবতে ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল উপল। গোরার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ওদের পাইকপাড়ার বাড়িতে, সেখান থেকে শ্মশানঘাট। গোটা যাত্রাপথে উপল উপস্থিত থাকলেও, একটু বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। কোনও কাজেই সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়নি। দূর থেকে দেখেছিল গোরার আত্মীয়স্বজনের কান্না, সিঁথি ভরতি সিঁদুর নিয়ে গোরার বউয়ের অস্থির পরিতাপ। বারবার আছড়ে পড়ছিল গোরার বুকে। ধরে রাখা যাচ্ছিল না। যেন সহমরণের ইতিহাস প্ররোচনা দিচ্ছিল ওকে।

গোরার শ্রাদ্ধে উপল যায়নি। এড়িয়ে গেছে শোকাবৃত পরিমণ্ডল। নাছোড় একটা বিষণ্নতা অফিসের সকলকেই গ্রাস করেছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছিল সেটা। এর মধ্যেই দেখা গেল সমস্ত সত্তাপ ধুয়ে-মুছে গোরার বউ এসেছে স্বামীর পাওনাগন্ডা বুঝে নিতে। সঙ্গে এক যুবক, সম্ভবত গোরার বউয়ের প্রেমিক, যাকে সে বিয়ে করবে। যদিও এ সবই অনুমান। আর বিয়ে যদি করেই, তাতে আপত্তিটা কোথায়? সব কর্মীদের মতো উপলও কি চায়, গোরার বউ বাকি জীবনটা স্বামী হারানোর শোক বুকে নিয়ে কাটাক? গোরার শেষ যাত্রায় ওর বউয়ের কান্নাকাটি দেখে, ভিতর ভিতর কোথাও কি পরিতৃপ্ত হচ্ছিল উপলের পুরুষসত্তা? বাইরে থেকে যাকে কষ্ট বলে ভ্রম হচ্ছিল! যখনই গোরার বউ শোক কাটিয়ে নতুনভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে, সহ্য হচ্ছে না বাংলার কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইতিহাসের শরিক উপলের। গুপ্তদাকে গিয়ে বলে এসেছে গোরার বউকে ঘোরাতে। পাওনাগন্ডা যেন সহজে না পায়। যে শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে বড় হয়েছে উপল, এই পরিপ্রেক্ষিতে কোনও কাজেই লাগেনি… মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বারবার ভুল হচ্ছে কাজে৷ গোরার বউকে ফেরানো তার উচিত হয়নি।

ঘরে এল আংশু। বলল, উপলদা, বাইরে গিয়ে একবার দেখে এসো। গুপ্তদা ঘুরিয়ে দেওয়ার পর গোরাদার বউ আর ছেলেটা বসেছে সতীনাথের চায়ের দোকানে। দু’জনের কী ঢলাঢলি ! বউটার মাইরি কোনও হুঁশ নেই, একমাসও হয়নি, সতীনাথের চায়ের দোকানের কুড়ি ফুটের মধ্যেই পড়েছিল গোরাদা।

কোনও উত্তর করে না উপল। মনটা ক্রমশ বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে। মনের এই অবস্থা নিয়ে

কি মায়ের দেখে দেওয়া মেয়েটার সঙ্গে মিট করা ঠিক হবে? ফোন করে আসতে মানা করে দেবে কি?

পরের দিন সকালে কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙল উপলের। বসন্তের প্রথম কোকিল। মেজাজ ভাল হয়ে ওঠার কথা, হল না। উপল লক্ষ করল, কোকিলের ডাকের মধ্যে কেমন একটু বিনয়ের সঙ্গে উত্ত্যক্ত করার ভাব আছে। এটা আবিষ্কার করতে এতদিন লেগে গেল! এখনও কত কিছু যে বুঝতে বাকি!

বিছানায় উঠে বসে উপল। মা পায়ের দিকে জানলার একটা পাল্লা খুলে রেখেছে। ক’দিন আগেও শীত ছিল, বন্ধ থাকত জানলা। বাইরে সামান্য কুয়াশা মতন। গাছপালাও দেখা যাচ্ছে। বেহালার এই প্রান্তে এখনও কিছু একতলা বাড়ি সংলগ্ন বাগান, ফাঁকা জমি, খেলার মাঠ পড়ে আছে। কলকাতার প্রকৃতি যেন ঋতু পরিবর্তনের সময় এখানে ড্রেস চেঞ্জ করতে আসে। উপলের ছোটবেলায় এলাকাটা প্রায় গ্রাম ছিল। এখন পুকুরগুলো বেশিরভাগ উধাও হয়েছে। তবু যতটুকু যা আছে, বসবাসের পক্ষে বেশ উপযুক্ত। এখানে বাড়ি করার জন্য বাবাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় উপল। কোথাও থেকে এসে বাড়ি ঢোকাটা সত্যিই ঘরে ফেরার মতন। বাইরের জগৎকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। কাল কিন্তু যায়নি। অনেক এলোপাতাড়ি চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল উপল।

ব্যগ্রকণ্ঠে মা জানতে চেয়েছিল, হ্যারে গিয়েছিলি? হল দেখা?

জুতো খুলতে খুলতে উপল বলেছিল, হয়েছে।

বলার ধরন দেখে মা একটু চিন্তায় পড়ে যায়। বলে, হ্যাঁরে, মনে হচ্ছে পছন্দ হয়নি? তা বলা যায় না। আবার হয়েছেও, বলতে পারছি না।

উপলের উত্তর শুনে ধন্দে পড়ে যায় মা। হতাশ হয়ে বলে, যাঃ, সে আবার কী ধরনের কথা! মানেটা কী দাঁড়াল?

মানে পরে বুঝো। আপাতত চা-জল দাও বলে সোফায় এসে গা ছেড়ে দিয়েছিল উপল। মায়ের সম্মান রক্ষার্থেই কাল মেয়েটির সঙ্গে সে দেখা করে। ওরকম তেতো মন নিয়ে যাওয়া একেবারেই ঠিক হয়নি।

দামি কোনও হোটেলে দেখা করার কথা ছিল না। উপলের পে স্লিপের উপযুক্ত ধর্মতলার এক রেস্তরাঁর সামনে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করেছিল উপল। মেয়েটিকে তখনও দেখেনি। মা ছবি দেখিয়েছিল। ছবির সঙ্গে মেয়েটির মিল খুবই সামান্য। রেস্টোরেন্টের সামনের ফুটপাতে গা ঢাকা দিয়ে তাঁতের শাড়ি পরা ঈষৎ অস্থির মেয়েটিকে দেখে, উপল বাকিটা আন্দাজ করে নেয়। কাছে গিয়ে বলতে যাবে, আপনিই… হ্যাঁ, আমি

সুপর্ণা। চলুন।

রেস্তরাঁয় গিয়ে কোনও কেবিনে বসেনি উপল, ওপন এরিয়ায় টেবিল নেয়। সেটা ছিল

আর একটা ভুল সিদ্ধান্ত। যথেষ্ট চালু দোকান। আশেপাশে হইচই। কথা কিছুতেই দানা বাঁধছিল না। উপল প্রায় কিছুই জিজ্ঞেস করছে না দেখে, সুপর্ণা লাজুক ভাব ছেড়ে ফেলে কথা বলায় উদ্যোগী হয়। জিজ্ঞেস করে, আপনি সত্যিই বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে কারও বাড়ি যাননি?

না, ব্যাপারটা আমার রুচিবিরুদ্ধ। বলেছিল উপল।

সুপর্ণা বলে, আর কত মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছেন রেস্তরাঁয়?

আপনাকেই প্রথম। ছবি দেখে মনে হল ডেকে পাঠানো যায়।

উপলের কথার পরে খানিক প্রগল্ভ হওয়ার সাহস দেখিয়েছিল সুপর্ণা। বলেছিল, আমি বিয়ের জন্য মেয়ে সিলেকশানের কথা বলছি না। তার আগের জীবনের কথা জানতে চাইছি।

সে তো সকলেই যায়, কলেজ লাইফে। নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দিয়েছিল উপল। সুপর্ণা এবার চলে যায় উপলের অফিস সংক্রান্ত খবরাখবরে, অফিসটা কোথায়, স্টাফ কতজন, কতদিনের কোম্পানি… আসলে বুঝে নিতে চাইছিল চাকরির নিরাপত্তার ব্যাপারটা। একই সঙ্গে বলে নিল সে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালবাসে, তাই নিয়েছে কিন্ডারগার্টেনের চাকরি। উপলও বাচ্চাদের পছন্দ করে কিনা জানতে চাইল, অনর্থক প্রশ্ন। যে-কোনও সুস্থ মানুষই শিশুদের সাহচর্য পেতে ভালবাসে। আসলে ওই প্রশ্নের আড়ালে সুপর্ণা জানতে চেয়েছিল, বিয়ের পর চাকরিটা বজায় রাখতে পারবে কিনা? উপলও কিছু বাঁধাগতের প্রশ্ন করে, কোন ধরনের গান ভালবাসেন, সিনেমা দেখার ঝোঁক আছে কি? সুপর্ণা বলে, সে নাটক দেখতে বেশি পছন্দ করে— আলটিমেটলি কেউই কাউকে সেভাবে বুঝে উঠতে পারে না। খাওয়া শেষ হয়ে যায়। বিল নিয়ে আসে ওয়েটার। পেমেন্ট করে উঠে পড়ে উপল। আলাপে ইতিবাচক কিছু না পেয়ে সুপর্ণার মুখ তখন থমথমে। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে উপলকে বলেছিল, আপনার মোবাইল নাম্বার আমার কাছে আছে, ফোন করলে বিরক্ত হবেন না তো?

করবেন ফোন। ঘাড় হেলিয়ে বলেছিল উপল। সুপর্ণা চলে যাওয়ার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে৷ অতক্ষণ ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে কাটিয়েছে সে। সুপর্ণাকে দেখে কোনও ফিলিংস হচ্ছিল না তার। ভেবে অবাক লাগছিল, এরকম একটা গোটা মেয়ে, চেনাজানা নেই, দু’দিন পর আমার সঙ্গে একই বিছানায় শোবে। আমি এখানে আসলে একটা সেক্সুয়াল কন্ট্রাক্ট করতে এসেছি। আবার একথাও মনে হচ্ছিল, সুপর্ণা তো গোরার বউয়ের মতো সুন্দরী নয়, বিয়ের পর আমি যদি তাড়াতাড়ি মরে যাই, বেচারি চট করে কোনও প্রেমিক পাবে না— এসব অবান্তর ভাবনার জন্য অফিসের পরিস্থিতিই দায়ী, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না উপলের। সুপর্ণার সঙ্গে দেখা করাটা কাল এড়িয়ে গেলেই পারত।

বাড়িতে ফিরে এসে মাকেও কনফিউজ করে দিয়েছে। বেচারি মা, বোনের বিয়ের পর সারাদিন বাড়িতে একা। কথা বলার কেউ নেই। ভাই থাকে হস্টেলে। বাবার সময় বাড়িটা থাকত সরগরম। মা সেরকম আবহাওয়া ফিরে পেতে চায়। চাওয়াটাই স্বাভাবিক। কথাবার্তাই তো হচ্ছে যে-কোনও বাড়ির প্রাণস্পন্দন। ফোন এলে মা কেমন ঝাঁপিয়ে গিয়ে ধরে, দুটো

কথার বলার জন্য কী আকুলতা! ঠিকে কাজের মেয়েটা আসে মিনিট কুড়ির জন্য, বকবক করে তার কান ঝালাপালা করে দেয় মা।

কী রে, সেই থেকে উঠে বসে আছিস! মুখ ধুবি না, চা দেব তো। ঘরে ঢুকে এসে বলল মা। কোকিলটা একঘেয়ে ডেকেই যাচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে আসে উপল।

দাঁত মেজে বাইরের ঘরের সোফায় বসে উপল খবরের কাগজ ওলটাচ্ছে। কত খবর! কতকিছু ঘটে যাচ্ছে কলকাতায়। পার্টি-পলিটিক্স, খেলাধুলো, গান-বাজনা, সাধারণ মানুষের খবর বলতে গৃহবধূর অস্বাভাবিক মৃত্যু, ট্যাক্সিড্রাইভারের সততা। প্যাসেঞ্জারের ফেলে যাওয়া টাকা ভরা ব্যাগ ফেরত দেওয়া। বাস চাপা পড়ে মারা যাওয়ার খবর চার লাইনের বেশি হয় না। বাসটা ভাঙচুর হলে ছবিসহ বিক্ষোভের খবর উঠে আসে ফ্রন্ট পেজে। গোরাকে জখম করে যাওয়া বাসটার নাম্বার দেখেনি কেউ। কোন রুটের বাস সেটা আন্দাজ করা গেছে। খবরটা নামী কাগজে চোখে পড়েনি। আপাতত অনুল্লেখযোগ্য খবরের প্রতিক্রিয়া কত সুদূরপ্রসারী। সুপর্ণাকে পছন্দ না হওয়ার পিছনে হয়তো ওই কারণটাই জড়িয়ে আছে।

টেবিলে চায়ের মগ রেখে, উপলের হাতে বিস্কিট দিয়ে মা বসল পাশের সোফায়। বলল, ওদের তা হলে কী বলি বল তো?

মগ তুলে নিয়ে চুমুক মেরে উপল বলে, বলে দাও ভাবছি।

ভাবছি আবার কী কথা! কতদিন অপেক্ষা করবে ওরা? অবাক হয়ে জানতে চায় মা। চা খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ রেখে উপল বলে, অপেক্ষা করতে যাবে কেন! ওরা নিজেদের মতো পাত্র দেখুক।

তা বলে ‘ভাবছে’ তো আর বলা যায় না।

সময় চাইছে বলো।

খুশি হয় মা। বলে, এটা তবু বলা যায়। কিন্তু মেয়েটার ব্যাপারে সমস্যাটা কোথায়? দেখতে ভাল লাগেনি নাকি কথাবার্তা সুবিধের নয়?

উপল কোনও উত্তর না দিয়ে কাগজ পড়ার ভান করে যায়। একটু অপেক্ষা করে উঠে পড়ল মা। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে অনুযোগের সুরে বলে গেল, একেবারে বাবার মতো হয়েছিস। পেটের কথা মুখে আনার নাম নেই।

আত্মীয়স্বজনরা প্রায়শই বাবার সঙ্গে তুলনা টানে উপলের। আচরণগত কিছু সাদৃশ্য থাকলেও, থাকতে পারে। চরিত্রের সঙ্গে কোনও মিল নেই। বাবা সিদ্ধান্ত নিতেন খুব নিশ্চিত করে। নিজের বিশ্বাসের প্রতি ছিল প্রবল আস্থা। পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ক্ষমতার লোভ ছিল না। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বড় ক্ষেত্র জুড়ে। উপলের সঙ্গে যার কোনও তুলনাই চলে না। অফিসের ইউনিয়ন সামলাতেই হিমসিম খেয়ে যায়।

দেওয়াল ঘড়িতে চোখ যায়। অফিসের জন্য তৈরি হতে হবে এবার।

বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে অফিসের দিকে এগোচ্ছে উপল। দেখে, গেটের কাছে অংশু দাঁড়িয়ে। পাশে একটা ছেলে। দু’জনেই তাকিয়ে আছে উপলের আসার দিকে। মনে

হচ্ছে উপলের সঙ্গে কোনও দরকার আছে ছেলেটার। অংশুকে ধরেছে। চেনাচেনা লাগছে ছেলেটাকে।

ওদের সামনে আসতেই অংশু বলল, গোরাদার ভাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ছেলেটাকে এবার মেলাতে পারে উপল। গোরার বিয়েতে, হাসপাতালে, শেষ যাত্রায় দেখেছে। গোরার চেহারার সঙ্গে অবশ্য কোনও মিল নেই। ছেলেটা লম্বা, ফরসা। উপল বলে, বলো, কী বলবে?

গোরার ভাই করুণ মুখ করে দাঁড়িয়েছিল। সেটা এক পরত বাড়িয়ে বলে, দাদার টাকার জন্য বউদি শুনলাম খুব যাতায়াত করছে।

সতর্ক হয় উপল। ছেলেটা কী ধান্দায় এসেছে বোঝা যাচ্ছে না। বলে, হ্যাঁ আসছে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

বউদি কিন্তু এখন আর আমাদের সঙ্গে থাকে না দাদা।

তাতে টাকা পাওয়া আটকাবে না। প্রসঙ্গ ছোট করতে চেয়ে বলে উপল।

গোরার ভাই বলে, দাদার কাজটাজ মিটে যাওয়ার পর আমরা অফিসে ডেথ সার্টিফিকেট, অন্যান্য কাগজপত্তর জমা দিলাম। বউদি সমস্ত গয়নাগাটি নিয়ে বাপের বাড়িতে উঠল। আমরা যেগুলো দিয়েছি, সেইসব সমেত। এবার দাদার টাকাটাও নেবে। ক’দিন ঘর করল বলুন?

তাতে আর কী করা যাবে? আইনমতোই তো কাজ হবে। গয়নাগাটির ব্যাপারে অবশ্য আমাদের কিছু বলার নেই।

উপলের ঠিকমতো সাড়া পাচ্ছে না দেখে গোরার ভাই একটু বুঝি অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। বলল, চোখের সামনে একটা অন্যায় হচ্ছে দেখেও আপনারা চুপ করে থাকবেন! অংশুদার থেকে তো শুনেছেন, বউদির একটা রিলেশান আছে। ওটা বিয়ের আগেই ছিল। এই নিয়ে দাদার সঙ্গে অনেক অশান্তি হয়েছে। ভীষণ মন খারাপের মধ্যে থাকত দাদা। অন্যমনস্ক ছিল বলেই না এতবড় অ্যাক্সিডেন্টটা হল।

কথাগুলো যুক্তির মতো শুনতে লাগলেও, আবেগটাই বেশি। প্রকৃত কারণ বোঝা মুশকিল। উপল কী বলবে ঠিক করে উঠতে পারছে না। গোরার ভাই ফের বলে ওঠে, দাদা মারা যাওয়ার পর বাবা মায়ের শরীর এখনই খুব ভেঙে গেছে। বউদি যা কাণ্ড করছে, তাতে অবস্থা আরও খারাপ। বউদি যখন আমাদের বাড়িতে থাকছে না, বিয়ে করবে আবার, দাদার টাকাটা ন্যায্যত বাবার প্রাপ্য। বাবা বলছে, ও টাকা আমরা আশ্রমে দান করে দেব। তবু ওই মেয়েকে দেব না।

উপলের আর ভাল লাগছে না এসব কথার মধ্যে থাকতে। গোরা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, ওর টাকাটাই এখন প্রধান বিষয়। উপল বলে, দেখো ভাই, আমরা ক’টা দিন তোমার বউদিকে ঘোরাতে পারি। তার বেশি কিছু নয়। বউদি যদি দুম করে বিয়ে করে না বসে, ক্লেম সে আইনানুযায়ী পাবেই। আর যদি কালই লেবার কোর্টে যায়, এক সপ্তাহের মধ্যে সুড়সুড় করে টাকা বার করে দেবে কোম্পানি। আমাদের মালিক কোর্ট-কাছারির ঝামেলায় বড় একটা যেতে চায় না।

সেইজন্যই তো আপনার কাছে আসা। কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।

দেখি। বলে উপল এগিয়ে যায় অফিসের দরজার দিকে। কাজের টেবিলে একঘণ্টাও কাটেনি, সলিল এসে দাঁড়াল পাশে। বলল, হ্যাঁরে, অংশু বলল তুই নাকি গোরার টাকার ব্যাপারে একটু বেসুরো গাইছিস?

কী বোর্ডে আঙুল থেমে যায় উপলের। বুঝতে পারে গোরার ইস্যুটা ভীষণ স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। কলিগরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, টাকাটা গোরার বউ পাক। উপল বলে, বেসুরো নয়। একটু সেফ খেললাম। টাকা আটকানোর ক্ষমতা যখন আমাদের নেই, মিছিমিছি দায় নিতে যাব কেন?

খানিকটা কনভিন্স হল সলিল। বলল, তা অবশ্য ঠিক। তবে তুই নাকি কী সব কোর্টফোর্টের কথা তুলেছিস?

হ্যাঁ, বলেছি। সবটাই ওদের জেনে রাখা ভাল।

কোর্টকাছারিতে ওরাও কিন্তু কম যায় না। ছেলের বউ চরিত্রহীন বলে কেস ঠুকে দিতে পারে। ইনজাংশান বার করলে, ও টাকা জীবনে পাবে না। তা ছাড়া বউটার কেসফেস লড়ার ক্ষমতা নেই। খুবই গরিব ঘরের মেয়ে।

খানিক বিরক্ত গলায় উপল বলে, এসব ভেবে আমরা কী করব! এগুলো আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। ওরা যা ভাল বোঝে করুক।

সলিল চুপ করে রইল। পাশ থেকে গেল না। বলে ওঠে, আমাদের কিন্তু একটা পক্ষ নেওয়া উচিত। গোরার বউয়ের অন্যায় কাজটা মেনে নেওয়া যায় না। তুই তো বিয়ে করিসনি, বিষয়টা ঠিক ফিল করবি না।

সরে গেল সলিল। কলিগদের অনুধাবন করতে মোটেই কোনও অসুবিধে হচ্ছে না উপলের। ওরা সকলেই নিজের বউয়ের জায়গায় গোরার বউকে বসাচ্ছে। শরীরহীন স্বামীর প্রতি কেন অনুগত থাকবে না স্ত্রী? শোধ নিচ্ছে তারই। সহকর্মীদের কে বোঝাবে, কাউকে ভুলে যাওয়ার পিছনে অর্ধেকটা যাকে ভুলে যাওয়া হচ্ছে, সেও দায়ী। মনে রাখার মতন কিছুই সে করে উঠতে পারেনি। আর প্রেম কোনও অবস্থাতেই অন্যায় নয়। গোরা বেঁচে থাকতে অথবা মৃত্যুর পর কারও প্রেমে পড়তেই পারে ওর বউ, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু প্রেমটা লুকিয়ে গিয়ে বিয়ে করাটা উচিত হয়নি। অবিচার করা হয়েছে প্রেমিক এবং গোরার প্রতি। শোকাহত শ্বশুর শাশুড়িকে ফেলে ওভাবে বাপের বাড়ি চলে যাওয়াটাও ঠিক হয়নি। তবে গয়না সঙ্গে নিতেই পারে, কেননা সেগুলো তারই। উপল এখন কোন পক্ষ নেবে? এ সময় বাবার কথা মনে পড়ে, কী সিদ্ধান্ত নিতেন, জানতে ইচ্ছে হয়। বাবা একটা কথা প্রায়শই বলতেন, সমস্যা আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে, তাকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। সে আপনিই সমাধানের পথ বার করে নেবে।

বাবার উপদেশ শিরোধার্য করে আপাতত যে লেখাটা কম্পোজ করছে উপল, ঢুকে যায় তার বিষয়বস্তুতে।

কিছু কিছু সমস্যা আছে, অনেকটা বেয়াড়া বেড়ালের মতো। যেখানেই ছেড়ে দিয়ে এসো, ঠিক বাড়ি ফিরে আসবে। গোরার ব্যাপারটাও প্রায় তাই। এক সপ্তাহ পর গোরার বউ অফিসে এসেছে। ছেলেটিও আছে সঙ্গে। খবরটা উপলকে দিয়েছে সলিল। উপল শুধু শুনে গেছে, কী বোর্ডে হাত থামায়নি। কিন্তু নিস্তার মিলল কই! অংশু এসে বলল, উপলদা, গোরাদার বউ তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।

আমার সঙ্গে কেন? কথা তো যা বলার বলবে গুপ্তদার সঙ্গে! ঝাঁঝিয়ে বলে উঠল উপল। অংশু বলল, গুপ্তদা যেমন ঘোরানোর ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমি বাইরে সিগারেট টানছিলাম।

এগিয়ে এসে বলল, তোমাকে ডেকে দিতে।

বললি না কেন, আমি আসিনি অফিসে!

ফেঁসে যেতে পারতাম। গুপ্তদার কাছে হয়তো খবর নিয়ে রেখেছে, তুমি আছ।

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে উপল। এড়ানোর রাস্তা নেই। অংশু উপদেশ দেয়, একদম স্ট্রিক্ট থাকবে। কান্নাকাটিতে গলবে না। মেয়েরা সব পারে। এখানে কেঁদেকেটে, দেখবে ধর্মতলায় গিয়ে ম্যাটিনি শোয়ে ছেলেটার সঙ্গে সিনেমা দেখছে।

অংশু এখনও বিয়ে করেনি, করলে ওর বউয়ের কপালে যে কী দুঃখ আছে, সেটা এখনই বেশ টের পাওয়া যায়।

অফিসের সুইংডোর ঠেলে বাইরে এল উপল। ঝলমলে রোদ, গোরার বউয়ের চোখ কুঁচকে গেছে, তাকিয়ে আছে উপলের দিকে। পাশে শিখণ্ডির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ছেলেটা। উপল ওদের সামনে যায়। গোরার বউকে বলে, বলুন?

কিছু মনে করবেন না, আপনাকে ডাকতেই হল। অফিস থেকে আমাকে এত ঘোরাচ্ছে কেন বলুন তো?

এই প্রথম গোরার বউয়ের কণ্ঠস্বর শুনল উপল, বেশ ভাল। মুখটা গম্ভীর রেখে উপল বলে, এসব কাজে একটু দেরি হয়।

উপলের কথা যেন বিশ্বাস হল না গোরার বউয়ের। বলল, ও কিন্তু বলত, আপনাদের কোম্পানি প্রাইভেট হলে কী হবে, টাকাপয়সার ব্যাপারে জেনুইন। গুপ্তদার সঙ্গে কথা বলে সেরকমটা মনে হচ্ছে না। নানারকম ফ্যাকড়া তুলছেন।

উপল চুপ করে থাকে। বলবেই বা কী! গোরার বউ ফের বলে, আপনার কথা ও খুব বলত। শ্রদ্ধা করত আপনাকে। বলত, আপনি থাকতে ওর চাকরি কোনওদিন যাবে না। ও নিজেই তো রইল না, টাকাটা যেন পাই, কাইন্ডলি একটু দেখুন।

খুবই বিব্রত বোধ করছে উপল। সবচেয়ে অস্বস্তি হচ্ছে গোরার বউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার জন্য। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে উপলের দিকে। চাউনিতে সন্দিগ্ধতার ছায়া। উপল ছেলেটির চোখে চোখ রাখে। মাথা নামিয়ে নেয় সে। উপল কিন্তু তাকিয়েই থাকে। মানেটা ধরতে পারে গোরার বউ। ছেলেটাকে বলে, রঞ্জু, তুই বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়া। আমি আসছি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুরে গিয়ে হাঁটা দেয় ছেলেটি। ‘তুই’ সম্বোধনটা কি উপলকে শোনানোর জন্য? গোরার বউ বোঝাল, ছেলেটা ভাই গোত্রীয়। সে যাইহোক, উপল এবার জরুরি দরকারটা বলে, আপনার সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলতে পারলে ভাল হয়। অফিসের সামনে হবে না।

গোরার বউ চট করে মুঠো থেকে বার করে সেলফোন। বলে, আপনার নাম্বারটা বলুন। পরে আমি যোগাযোগ করে নেব।

উপল নিজের নাম্বারটা বলে। সেভ করে নিয়ে গোরার বউ বলে, চলি, তা হলে। গুপ্তদা বলেছেন সামনের মাসে আসতে। আপনার সঙ্গে কথা বলে, তবেই আসব। রোজ এভাবে ঘুরে যেতে ভাল লাগে না।

গোরার বউ চলে যাচ্ছে। কেন জানি উপলের মনে হচ্ছে, মেয়েটি গোরার বউ ছিল না। সেলফোন যখন বার করল, দেখা গেল হাতে একগাছি চুড়ি, গলায় কিছু নেই, কানেও না। টিপও পরেনি। বউভাতের দিন দেখা সালংকারা সেই বউটির সঙ্গে এর কোনও মিলই নেই! গোরার না থাকার শোক-বিষাদও লেগে নেই চেহারায়। এ যেন আনকোরা একটি মেয়ে, জীবনযুদ্ধে সবে পা রাখতে চলেছে। বয়সটাও আগের চেয়ে অনেক কম লাগছে। বোঝার উপায় নেই একটা এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে ওর জীবনে। বন্যা, ভূমিকম্পে ছিন্নভিন্ন জনপদ যেমন দুর্যোগের স্মৃতি মুছে দ্রুত ফিরে যায় পুরনো ছন্দে, এই মেয়েটির বেলায় হয়েছে তাই। ভালই হয়েছে। ধ্বংস চিহ্ন নিয়ে বাঁচার কোনও অর্থ হয় না।

উপল ফিরে এসেছে নিজের সেকশানে। চেয়ারে বসতে যাবে, সলিল কাজ করতে করতে বলে উঠল, তোর ফোন নাম্বার দিলি নাকি ওকে?

মাথা গরম হতে থাকে উপলের, কী পরিমাণে গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছে কলিগরা ! নিজেকে সংযত রেখে বলে, দিলাম। চাইল।

না দিলেই বুদ্ধিমানের কাজ করতিস। এবার অফিসে না এসে তোকেই ফোন করে বিরক্ত করবে।

করুক। আমি বুঝে নেব।

উপল জানে, তার কথাটা এ ঘরের কারওই পছন্দ হল না। গোরার ব্যাপারটাতে স্টাফেদের থেকে সে স্পষ্ট একা হয়ে গেল।

ছুটি হতে এখন আধঘণ্টাও বাকি নেই। ফোন এল উপলের মোবাইলে। ‘হ্যালো’ বলার পর ওপারের মহিলাকণ্ঠ বলে, কোথায় আছেন?

গলাটা চিনতে পারে না উপল। ‘কে বলছেন’ বলতে খারাপ লাগছে। খুবই নিশ্চিত হয়ে ফোন করছে মেয়েটা। উপলের নীরবতার মানে বুঝে নিয়ে ওপ্রান্তে বলে, এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন!

না, মানে, কাজের মধ্যে আছি তো। ইতস্তত করে বলে উপল। মেয়েটা বলে, তার মানে অফিসে। ফ্রি হচ্ছেন ক’টায়?

একটু পরেই।

দেখা করা যায়, আগের দিনের রেস্তোরাঁয়?

উপল চিনতে পেরে বলে ওঠে, সুপর্ণা?

যাক, তবু চিনতে পেরেছেন। হেঁয়ালি করে দেখছিলাম পারেন কিনা চিনতে। লিস্টে তার মানে অন্য নাম যোগ হয়নি।

হেসে ফেলে উপল। বলে, না, হয়নি। আপনি ওখানে চলে আসুন। আধঘণ্টার মধ্যে যাচ্ছি।

থ্যাঙ্ক ইউ। বলে ফোন অফ করে দেয় সুপর্ণা। উপলের মাথাটা অনেকক্ষণ পর বেশ নির্ভার লাগে। গোরার বউকে নিয়ে সলিলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি পর সে সারাক্ষণ অফিসে গুম মেরেই ছিল।

অফিসের পর সুপর্ণার সঙ্গে একঘণ্টা রেস্তোরাঁয় কাটিয়ে, পাড়ায় একটু আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরেছে উপল। এখন মুড়ি খেতে খেতে টিভির নিউজ চ্যানেল দেখছে। ভাবছে, মাকে বলবে কিনা সুপর্ণার সঙ্গে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা। মা জানে না এই অ্যাপোর কথা। সুপর্ণা নিজের উদ্যোগে ফোন করেছিল উপলকে। মিটিং-এ লাভের লাভ কিছু হয়নি। সময়টা মন্দ কাটেনি, এই যা। দেখা হওয়ার ঘটনাটা মাকে না বলাই বোধহয় ভাল, প্রত্যাশা করে বসবে বিয়ের ব্যাপারে।

উপলের মুড়ি খাওয়া শেষ। দু’মগ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল মা। উপলের জন্য টেবিলে রেখে নিজেরটা নিয়ে বসল সোফায়। তারপরই যে কথাটা বলল, চমকে উঠল উপল। বলল, ওদের বাড়িতে আজ না করে দিলাম।

মানে, কখন! বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে উপল

তুই অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর। বলে দিলাম, আপনারা পাত্র দেখুন। আমার ছেলে কবে বিয়ে করবে ডিসিশান নিতে পারছে না।

উপল পুরোপুরি থ বনে গেছে। মা সকালে ‘না’ জানিয়ে দিয়েছে অথচ বিকেলে সুপর্ণা ফোন করে ডেকে নিল উপলকে! ও কি জানে না মায়ের ফোনের কথা? জানে নিশ্চয়ই, বাড়ির লোকের কাছে শুনেছে। প্রত্যাখ্যানটা সহ্য হয়নি। দেখা করতে চেয়েছে উপলের সঙ্গে। উপল যদি মিট করতে না চাইত, সুপর্ণা হয়তো জিজ্ঞেস করত তাকে পছন্দ না করার কারণ। উপল দেখা করাতে, সুপর্ণা ধরে নিল, না বলছে মা, উপল নয়। তাই আজকের কথাবার্তায় সুপর্ণা একবারও জিজ্ঞেস করেনি, আমার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিলেন? এমনই একটা খোলামেলা আড্ডা হল। আজ কেবিনে বসেছিল উপল। সুপর্ণা নিজের স্কুল, বাড়ির লোকেদের নিয়ে অনেক কথা বলল। একসময় গান শিখত জানাল তাও। উপলের বাড়ি বন্ধুবান্ধব বিষয়ে জানতে চাইল। আজ জানার আড়ালে খোঁজ নেওয়ার ব্যাপারটা ছিল না। উপলও বেশ প্রাণ খুলে কথা বলেছে। সুপর্ণাকে বেশ বন্ধুর মতোই লাগছিল। এখন বুঝতে পারছে, মনে বাতিল হয়ে যাওয়ার কষ্ট চেপে সারাক্ষণ অভিনয় করে গেছে মেয়েটা। কেন? ইচ্ছে করলেই ভুলে যেতে পারত উপলকে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ যখন করবেই ঠিক করেছে, এক, দু’জন পাত্র তাকে অপছন্দ করতেই পারে। সুপর্ণা তেমন দেখতে খারাপ নয়

যে সব পাত্রের কাছেই বাতিল হয়ে যাবে। তবু এভাবে উপলকে ডেকে পাঠানোর উদ্দেশ্য কী? কোনও কারণে কি উপলের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়েছে তার? প্রেমের প্রসঙ্গ একবারই তুলেছিল। বলেছিল, আপনার মায়ের কাছে শুনেছি, অনেক কষ্টে বিয়েতে রাজি করানো গেছে আপনাকে। ব্যাপার কী মশাই, কাউকে ভালবাসেন নাকি? যাকে পাওয়া সম্ভব নয়।

চোখ ছোট করে, মজার সুরে বললেও, বিষয়টাকে এত গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করায় হেসে ফেলেছিল উপল। বলেছিল, না-না সেরকম কিছু নয়। এই তো দু’বছর হল বোনের বিয়ে দিলাম। একটু থিতোই, অনেক টাকা খরচ হয়েছে।

কথাটাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি সুপর্ণা। বলেছিল, শুনুন মশাই, আপনি যাকে ভালবাসেন, তার কাজল পরে অন্য মেয়েকে খুঁজতে যাবেন না। কোনও মেয়েই পছন্দ হবে না আপনার।

কথাগুলো শুনতে বেশ মায়াবী, খানিক বিভ্রমে উপল বিগত তিন প্রেমিকাকে মনে করে, চিত্রা, বর্ণালী, কেয়া। এদের মধ্যে কেউ কি অবচেতনে এখনও ছায়া ফেলে রেখেছে? মনের আঁতিপাতি খুঁজেও কাউকে পাওয়া যায়নি। চিত্রা, বর্ণালী বিয়ে হয়ে গিয়ে এখন কোথায়, জানে না। কেয়ার বাপের বাড়ি উপলদের পাড়ায়। উৎসব অনুষ্ঠানে দেখা হয়। কোনও অণুরণন জাগে না হৃদয়ে। কেয়ারও না। মুখ দেখে দিব্যি আন্দাজ করা যায়।

সুপর্ণার কথাটা কিন্তু মাথায় রয়ে গেছে। কেন সেভাবে কোনও মেয়েকেই ভাল লাগে না উপলের। সত্যিই কি তার মানসপ্রেমিকা আছে? ছেলেমানুষি ভাবনায় হাসিও পেয়ে যাচ্ছে। মানসপ্রেমিকা আসলে সোনার পাথরবাটি, উপল জানে। সুপর্ণা আর কিছু না পারুক, উপলকে খানিকটা রোম্যান্টিক করে দিয়ে গেছে। আজ বাড়ির ফিরল বাসে। ওঠার আগে জিজ্ঞেস করেছিল, এরপরও কি আমাকেই ডেকে পাঠাতে হবে?

মুখে হাসি এনে উপল বলেছে, না। আমি ডেকে নেব।

সুপর্ণা চলে যাওয়ার পর উপল বাড়ি ফেরার বাসে বসে সারাক্ষণ নিজেকে বুঝিয়ে গেল, সুপর্ণাকে আমার বিয়ে করতে অসুবিধেটা কোথায়? যে-কোনও একজনকে তো করতেই হবে। মেয়েটার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল, কথাবার্তা ভাল। দেখতে চলে যায় গোছের। বুদ্ধিশুদ্ধিও আছে। কিন্তু যখনই ওকে বউ হিসেবে কল্পনা করতে যাচ্ছে উপল, হোঁচট খাচ্ছে। মেয়েটার সঙ্গে এই নিয়ে দু’দিন দেখা হল। বিন্দুমাত্র আকর্ষণ তৈরি হয়নি। আর যদি কখনও দেখা নাও হয়, কিছুই যায় আসে না উপলের। এরপরও যদি মেয়েটিকে বিয়ে করতে হয়, এর চেয়ে অবিবেচনার কাজ আর হয় না। মা ‘না’ বলে দিয়ে ভালই করেছে।

টিভির খবর চলছে, মাথায় কিছু ঢুকছে না উপলের। মা তাকিয়ে আছে স্ক্রিনেরদিকে উসখুস করছে সামান্য। বোধহয় সিরিয়াল দেখার ইচ্ছে। সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে উপল। মাকে বলে, যাই, একটু আড্ডা মেরে আসি পাড়ায়।

স্বপ্ন দেখার ব্যাপারে উপলের হাতযশ আছে। প্রত্যেক ঘুমেতেই সে স্বপ্ন দেখে। যেগুলো মনে থাকে, সেসব একেবারে সিনেমার মতো। যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছবি কিন্তু পরিষ্কার। ঘটনাক্রমও বেশ সাজানো। নিজের স্বপ্নের কথা যখনই কাউকে জানিয়েছে, বিশ্বাস করেনি। সবাই বলে বানানো। সেই কারণেই এখন স্বপ্ন দেখলে কাউকে বলে না উপল।

গত রাতে বেশ ক’টা স্বপ্ন দেখেছে। শেষের দুটো মনে আছে ভাল মতোই। একটা স্বপ্নের প্রেক্ষাপট, গাড়ি সারানোর গ্যারেজ। সময় নিভুনিভু বিকেল। গ্যারেজে লোকজন বড় একটা দেখা যাচ্ছে না। বিকল গাড়ি অবশ্য অনেক। একটা টায়ারের উপর বসে আছে গোরা। মুখোমুখি কিছু একটার উপর বসেছে উপল। গোরাকে জিজ্ঞেস করছে, তুই এখানে কেন এলি? এই কালিঝুলির মধ্যে!

গোরা বলছে, দেখো, যে খুনি বাসটা আমায় মেরে গেল, তাকে কেউ চেনে না। সে দিব্যি বীরদর্পে রাস্তায় চরে বেড়াচ্ছে। আমি তো তাকে ভুলিনি। কোনও না কোনওদিন বাসটাকে এই গ্যারেজে আসতেই হবে। মেশিনফেশিন এমন ওলটপালট করে দেব, নড়তেই পারবে না। কী ডেঞ্জারাস বাস বলো তো উপলদা! ও তো আরও লোক মারবে।

উপল স্বপ্নে বলছে, তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু তোর তো এখানে কষ্ট হচ্ছে। উত্তরে গোরা দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলে উঠ সে আর কী করা যাবে উপলদা, মানুষের জীবন তো সবসময় একরকম চলে না।

হঠাৎ বাসের ঘড়ঘড় শব্দ। গোঙাচ্ছে। মেন রোড থেকে নেমে গ্যারেজেই ঢুকছে বাসটা। উঠে গেল গোরা। যেতে যেতে বলল, দাঁড়াও, দেখে আসি ওই বাসটাই কিনা।

ছোটখাটো চেহারার গোরা। হাত তুলে অল্প দৌড় লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাসটার দিকে। ধূসর রঙের বাসটা প্রায় টিলার মতন। নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে কাঁপতে কাঁপতে গোরার একেবারে মুখোমুখি। এই বুঝি চাপা দিয়ে দিল… আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল উপলের। রীতিমতো হাঁপাচ্ছিল। বাথরুম ঘুরে এসে ফের শুয়েছে। ভোররাতে দেখল সুপর্ণার স্বপ্ন। রেস্তোরাঁয় ঢুকেছে উপল। এখানে আগে কখনও আসেনি। এক ওয়েটার কীভাবে জানি, তাকে চিনল। আঙুল দেখাল একটা কেবিনের দিকে। বলল, ওখানে আছেন।

কেবিনের সামনে গিয়ে পরদা সরালো উপল। দেখে, সুপর্ণা একটা ছেলের সঙ্গে বসে গল্প করছে। খুব একটা চমকাল না উপল। যুগলের উদ্দেশে বলল, সরি। সরে এল কেবিন থেকে। সম্ভবত সে অন্য মেয়ের সঙ্গে মিট করতে এসেছে। ওয়েটারের আঙুল নির্দেশ বুঝতে ভুল হয়েছে উপলের। পাশের কেবিনে যায়। পরদা সরাতেই আবার দেখে সুপর্ণাকে, সঙ্গে এবার অন্য ছেলে। ফের ‘সরি’ বলে সরে আসে উপল। পরের কেবিনে যায়, সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ে উপল। কোথাও একটা ভীষণ গন্ডগোল হচ্ছে। আর একটা কেবিন ট্রাই করে, একই ব্যাপার! এবার ‘সরি! বলার আগে সুপর্ণা বলে ওঠে, ওরা সবাই আমায় দেখতে এসেছে… ঘুম ভাঙে উপলের। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘরে সকালের আলো ঢুকে এসেছে। ফিরে এসেছে ক’দিন আগের সেই কোকিলটা, তারস্বরে

8

ডেকে যাচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে উপল প্রথমে এক গ্লাস জল খেয়েছিল। কিছু কিছু স্বপ্নে এমন ঝক্কি যায়!

উপল এখন বাসে। অফিস যাচ্ছে। বেহালা থেকে তাদের অফিস এন্টালি পদ্মপুকুর, একটা বাসেই যাওয়া যায়। অনেকটাই রাস্তা। সিট পাওয়া যায় মোটামুটি নিয়মিত। আলগা করে একটা ঘুম দিয়ে নিতে পারে। উপলের স্বপ্নের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দেখতে দেখতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর, অনেকটা গ্যাপ দিয়ে পরের ঘুমে একই স্বপ্নের কন্টিনিউয়েশন চলে। সবসময় যে হবে, এমন কোনও কথা নেই। তবে মাঝে মধ্যেই হয়। এর পিছনে উপলের সেই স্বপ্নটা দেখার ইচ্ছেটাও যোগ হতে হবে। আজ বাসে বসে সুপর্ণার স্বপ্নটার পরবর্তী অংশ দেখতে চাইছিল উপল। স্বপ্নটা দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও, পরে ভেবে দেখেছে বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। স্বপ্নের কোনও মানে হয় না, উপল জানে। তবে আবছা একটা বার্তার বিভ্রম তৈরি করে। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য। কিন্তু আজ যে কিছুতেই ঘুম আসছে না বাসে। প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে টুকটাক বচসা চলছেই। একটা ইস্যু থামে তো আর একটা তৈরি হয়। এখন যেমন বেমানান চড়া সাজের এক মেয়ে ঝগড়া করছে শ্যামলা রঙের মিনমিনে একটা লোকের সঙ্গে। মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে লোকটা যে কী বলছে, কিছুই শোনা যাচ্ছে না। খানিক বাদে বাদেই মেয়েটা উঠছে তেড়েফুঁড়ে। এখন বলছে, আপনি সেই থেকে আমায় ফলো করছেন। বাসেও উঠে পড়লেন। আপনার ধান্দা আমি বুঝি।

উত্তরে লোকটা কিছু বলল। মেয়েটা আর এক ধাপ গলা তুলে বলল, বাড়িতে বউ-মেয়ে আছে, নাকি খাটতে পাঠিয়েছেন…

আর শোনার প্রবৃত্তি হয় না উপলের। মেয়েটি সম্ভবত রোডসাইড কলগার্ল। ধরনধারণ দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে। উপলের দুটো ব্যাপারে ভীষণ আতঙ্ক, চেকার আর কুকুর। পকেটে টিকিট আছে নিশ্চিত জেনেও ট্রেনে চেকার দেখলেই উপলের মনে হয় টিকিট ফেলে এসেছে বাড়িতে। কুকুরে আতঙ্ক তো অনেকেরই আছে। এই দুই ভয়ের প্রায় সমান সমান ভয় পায় রোডসাইড কলগার্লদের। রেডলাইট এরিয়ার মেয়েদের ব্যাপারে উপলের কোনও ধারণা নেই। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে ও পাড়ায় কোনওদিন উঁকিও মারেনি। কলেজে পড়াকালীন একবার ক্লাসমেট কল্লোলকে বলে ফেলেছিল, তোরা যে বলিস ধর্মতলায় খারাপ মেয়েরা কাস্টমারের অপেক্ষায় দাঁড়ায়, আমি তো তাদের চিনতে পারি না!

কথাটা লুফে নিয়ে কল্লোল বলেছিল, চ, আজ তোকে চিনিয়ে দেব।

কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলায় এসেছিল দুই বন্ধু। রিগ্যাল হলের পিছনে নিয়ে গেল কল্লোল। সিল্কের শাড়ি, হাতকাটা ব্লাউজ, উৎকট সাজের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কল্লোল বলেছিল, এই হল স্যাম্পেল। দাঁড়া, একটু কথা বলি।,

ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল উপল। কল্লোল এদের সঙ্গে কথাও বলতে পারে! কী কথা বলবে?

কল্লোল শুধু মেয়েটার সঙ্গে কথা বলল তাই নয়, দু’জনে হাসতে হাসতে এগিয়ে

আসছিল। উপলের বিমূঢ় অবস্থা। সামনে এসে কল্লোল বলেছিল, চ, একে নিয়ে একটা নুন শো দেখি।

চমকে উঠে প্রায় আর্তনাদের কণ্ঠে উপল বলতে পেরেছিল, না, আমি যাব না। বিচ্ছিরি রকমের হাসি হেসে মেয়েটা উপলের কনুই ধরে নেয়। ইঙ্গিতবাহী সুরে বলে, চলো না। হেভি আরাম করে দেব।

মেয়েটার আর একহাত ততক্ষণে চলে গেছে উপলের প্যান্টের জিপের উপর। কিছুক্ষণের জন্য বরফের চাঁই হয়ে গিয়েছিল উপল। তারপরই ছিটকে সরে এসে, প্রায় দৌড়োতে শুরু করে।

পরের দিন থেকে কল্লোলের সঙ্গে সে কথা বন্ধ করে দেয়। ঘটনাটা নিয়ে গুলিয়ে গিয়েছিল উপল, মেয়েটার থেকে সে ঘেন্নায় সরে আসেনি। নিষিদ্ধ জগৎ সম্বন্ধে অজ্ঞ উপল, পরিস্থিতির আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়েছিল। পরে মেয়েটার প্রতি করুণাই হয়েছে তার। মনে হয়েছে আমার সঙ্গে একই জল হাওয়ায় মেয়েটাও বেঁচে আছে। পৃথিবীর সুন্দর দিকগুলো বেচারির জানা হচ্ছে না। পেটের খিদে তাকে শরীর ছাড়া আর কিছুই বুঝতে দেয়নি। মানুষ হয়েও সে আসলে মানুষের ডাস্টবিন হয়ে গেছে। এইসব মেয়েদের প্রতি উপলের একটা সিমপ্যাথি আছে। তবে সেটা দূর থেকে। সামনে যেতে অস্বস্তি হয়, মনে হয় ডাস্টবিনের গন্ধ পাবে। এক ধরনের বিকর্ষণ। প্রতিক্রিয়াটার জন্য কল্লোল দায়ী।

কার্জন পার্কে এসে গেছে বাস। নেমে গেল মেয়েটা। পিছন পিছন মিনমিনে লোকটাও নেমেছে। কী সব বলে টিটকিরি মারল বাসের প্যাসেঞ্জার। লোকটার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। মেয়েটাকে নিয়ে ঘোরের মধ্যে আছে। ওরা নেমে যেতে বড় করে শ্বাস নেয় উপল। এতক্ষণ যেন বাতাসে অক্সিজেন কম পড়ে গিয়েছিল।

মিনিট কুড়ির মধ্যেই পৌঁছে গেল অফিসের স্টপে। বাস থেকে নেমে দু’পা এগিয়েছে, পিছন থেকে কে যেন ডাকল, উপলদা!

ঘাড় ফিরিয়ে উপল দেখে গোরার ভাই। এখানে দাঁড়িয়ে কেন? উপলের সঙ্গে দরকার থাকলে অফিসে যেতে পারত। কাছে এল গোরার ভাই। কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল, প্রাইভেট।

বলো। বলল উপল।

গোরার ভাই বলে, আপনি শুনলাম বউদির ফরে হয়ে গেছেন।

কে বলল?

আপনাদের স্টাফেরাই বলছিল। বলল, ওই টাকা পেতে গেলে উকিলের কাছে যেতে হবে। বাবা উকিলের সঙ্গে কথা বলেছে। উকিল বলছে, অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট প্রথমে কোনও প্রবলেম খাড়া করুক। তারপর উনি দেখবেন।

তো? আসল কথাটা জানতে চায় উপল।

গোরার ভাই বলতে থাকে, বাবা আমায় বলল, উকিলের চক্করে না গিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে। টাকাটা যদি কোনওভাবে আমাদের পাইয়ে দেন, ইউনিয়ন ফান্ডের জন্য কিছু খরচা করব আমরা।

অনেক কষ্টে নিজের ডান হাতটাকে বশে রাখল উপল। এক্ষুনি আছড়ে পড়ত গোরার ভাইয়ের গালে। তার বদলে বলল, তোমার বাবাকে বোলো, তাঁর ছেলের অফিসের বন্ধুরা এতটা অমানুষ হয়ে যায়নি যে, মৃত কলিগের শেষ পাওনা থেকে কাটমানি খাবে।

গোরার ভাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। উপল এগিয়ে যায় অফিসের গেট লক্ষ্য করে।

ডিপার্টমেন্টে ঢুকে সিনিয়র মোস্ট সলিলকে গোরার ভাইয়ের কাণ্ডটা বলল উপল। জানতে চাইল, কে ওকে বলেছে, আমি গোরার বউয়ের ফরে হয়ে গেছি? ফোন নাম্বার দেওয়া মানেই পক্ষে চলে যাওয়া!

সলিল বলল, আমি কিছু বলিনি। ওর সঙ্গে কথাই হয়নি আমার।

অংশু উঠে এল সিট থেকে। বলল, বিশ্বাস করো, আমিও কিছু বলিনি। আমার সঙ্গে ওর দু’-একবার কথা হয়েছে বটে, কোথা থেকে কী জেনেছে, ওই জানে!

কিছু তো হিন্টস পেয়েছে এবং সেটা আমাদের স্টাফেদের থেকেই, নয়তো সাহস পেত না এরকম প্রপোজাল দেওয়ার। বলল উপল। এত রেগে আছে, থামার পর মনে হল পুরোটা বলা হল না। ফের বলে, ছেলেটা এত সেয়ানা, কোনও সাক্ষী না রেখে আমাকে আলাদাভাবে কথাটা বলেছে, সুযোগ করে দিচ্ছে টাকাটা একা খাওয়ার।

সলিল চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। হাত রাখে উপলের কাঁধে। বলে, গোরাদের ফ্যামিলিটা একটু ইডিয়ট টাইপ। আমাদের কারও মুখ থেকে এক শুনে অন্য মানে করেছে। ওদের উপর রাগ করে তুই আবার গোরার বউকে টাকাটা পাইয়ে দিস না। গুপ্তদা যেমন আটকে রেখেছে, থাকুক।

উপল হতাশ হয়। স্টাফেরা নিজেদের স্ট্যান্ড থেকে এতটুকু সরছে না। তাদের হিসেবে গোরার বাড়ির প্রস্তাবটা বোকামি। গোরার বউয়ের কাজটা নষ্টামি। খামোকা এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে উপল। এরা তাকে মালিকের থেকে পাওনাগন্ডা বুঝে নেওয়ার দালাল হিসেবে গণ্য করে। গোরার বাড়ির লোকের থেকে ঘুষ খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়। এতটাই ছোট ভাবে উপলকে! সিটে ফিরে যেতে যেতে উপল সিদ্ধান্ত নেয়, খুব তাড়াতাড়ি রেজিগনেশন দেবে সেক্রেটারির পদ থেকে।

নারকোলডাঙার এই অঞ্চলে আগে কখনও আসেনি উপল। ঠিকানা অনুযায়ী রাস্তা থেকে গলি তস্য গলিতে এসে পড়েছে। একটা গোটা রিকশা এখান দিয়ে যেতে পারবে না। তবু ভাল স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলছে। বেশিরভাগ বাড়ি একতলা, দরমার বাড়িও চোখে পড়ছে দু’একটা। উপল চলেছে গোরার বউয়ের বাপের বাড়িতে। আজ অফিসে টিফিন টাইমে ফোন করেছিল মেয়েটা। উপল তখন বাড়ি থেকে আনা টিফিন খেয়ে, সতীনাথের দোকানে চা খেতে গেছে। একাই ছিল। গোরার ভাই প্রস্তাবটা দেওয়ার পর থেকে দু’দিন ধরে কলিগদের

সে এড়িয়ে চলছে। ফোন বাজার পর কানে তুলে হ্যালো বলতে, ওপ্রান্তের মহিলা কণ্ঠ বলেছিল, আমি পিয়ালি বলছি। আপনাদের গোরার বউ।

গত বেশ কিছুদিন ধরে এই ফোনটার অপেক্ষায় ছিল উপল। একটু যেন শাসনের সুরেই বলে ওঠে, এতদিন পরে ফোন করছেন! নাম্বার তো দিয়েছি অনেক আগে।

না, আসলে কখন করলে আপনাকে বিরক্ত করা হবে না, ভাবতে গিয়ে…

কথা সম্পূর্ণ করে উঠতে পারে না অপর প্রান্তের দ্বিধাজড়িত কণ্ঠ। উপল বলে, শুনুন, গোরার টাকা নিয়ে অফিসে একটু গন্ডগোল চলছে। আপনাকে পুরো বিষয়টা বোঝাতে হবে। আপনার সঙ্গে দেখা করা দরকার।

কোথায় যাব বলুন?

কোথাও যেতে হবে না। আমি আজই আপনার বাড়ি যাব। ঠিকানাটা দিন।

তখনই রাস্তার নাম, বাড়ির নাম্বার জানিয়ে দিয়েছিল পিয়ালি। সেটা যে এত গলিঘুঁজির মধ্যে হবে, ভাবতে পারেনি উপল। এত গরিব পাড়ার ছায়া পিয়ালির চেহারায় নেই। এখান অবধি পৌঁছোতে বহু লোককে জিজ্ঞেস করতে হয়েছে। ক্রমশ মলিন হয়ে এসেছে পাড়াটা। বাঁদিকে বাড়ির বারান্দায় এক বুড়োকে দেখা গেল ভাঙা টুল সারানোর চেষ্টা করছে। উপল এগিয়ে গিয়ে ঠিকানাটা বলতে যাবে, কে যেন ডাকে, এই তো এখানে। চলে আসুন।

মুখ তুলে উপল দেখে, ডানদিকের দুটো বাড়ি পরেই একটা বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে পিয়ালি। মুখে সহজ-সরল হাসি। পরনে সালোয়ার কামিজ।

সদর বেশ নিচু। মাথা হেঁট করে ঢুকতে হল উপলকে। বাড়িতে পাকা ছাদ নেই, অ্যাসবেস্টাসের চাল। ঘরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে পিয়ালি বলে, খুব অসুবিধে হল তো, বাড়ি চিনে আসতে?

না, ঠিক আছে। বলতে হয়, বলল উপল।

উঠোন থেকে ঘরে ঢুকে পিয়ালি বলল, আমাদের কোনও বসার ঘর নেই। দুটি ঘর, শোওয়ার। আপনি বিছানাতেই বসুন।

উপল জুতো ছেড়ে ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে। পিয়ালি বলে, দাঁড়ান, আপনাকে আগে জল দিই। অফিস থেকে এলেন।

পিয়ালি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে, চারপাশে চোখ বোলায় উপল, বোঝাই যাচ্ছে, খুব টেনেটুনে চলে সংসার। গোরাদের বাড়ির সঙ্গে এ বাড়ির কোনও তুলনাই চলে না। সম্বন্ধটা হল কীভাবে, কে জানে!

হাতে গ্লাস নিয়ে ঢুকল পিয়ালি। বলল, জলটা খান, পরে চা দিচ্ছি।

জল খেয়ে গ্লাসটা পাশের টেবিলে রাখে উপল। টেবিলে রাজ্যের জিনিস। পড়াশোনার জন্য ব্যবহার হয় না, তাক হিসেবে আছে। একটা টুল টেনে মুখোমুখি বসেছে পিয়ালি। উপল বলতে শুরু করে, আপনি সোজা রাস্তায় গোরার টাকাটা পাবেন না। স্টাফেরা আপনার উপর অসন্তুষ্ট। তাদের মধ্যে আমি কিন্তু নেই।

অসন্তুষ্ট কেন? আমি কী করলাম? অবাক হয়ে জানতে চায় পিয়ালি।

উপল বলে, স্টাফেরা খবর পেয়েছে, আপনি নাকি গোরার টাকা পাওয়ার পরই বিয়ে করছেন।

বিয়ে! বলে থমকে যায় পিয়ালি। অভিব্যক্তিতে হতাশা।

উপল বলতে থাকে, আপনার সঙ্গে যে ছেলেটি আমাদের অফিসে যায়, তার সঙ্গে নাকি আপনার বিয়ের আগে থেকেই রিলেশান ছিল। এমনটা বলে গেছে গোরার ভাই। আপনার শ্বশুরবাড়ির লোকও চায় না, টাকাটা আপনি পান।

মাথা নামিয়ে নিয়েছে পিয়ালি। কথাগুলোতে আহত হল মনে হচ্ছে। উপল বলে, আমি কিন্তু আবারও বলছি, আপনার বিয়ে নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। বিয়ে করুন, না করুন, গোরার টাকা আপনার প্রাপ্য। তবে সেটা পাওয়ার আগেই যদি বিয়ে করে ফেলেন, কিছুই পাবেন না।

মুখ তোলে পিয়ালি। চোখ ভিজে গেছে জলে। কথাগুলো এভাবে না বললেই ভাল হত। আঘাত পেয়েছে খুব। উপল মনে মনে আপশোস করে। ওড়নায় চোখ মুছে পিয়ালি বলে, ও হচ্ছে রঞ্জু। আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে। ভাইয়ের মতো। একা একা বরের অফিসে টাকার জন্য তদ্বির করতে যাচ্ছি দেখে, বলাইকাকা মানে রঞ্জুর বাবা রঞ্জুকে আমার সঙ্গে থাকতে বলেছে। ডাকব ওকে? কথা বললেই আপনি বুঝতে পারবেন।

না না, ডাকার দরকার নেই, শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে উপল।

আধঘোমটা দেওয়া এক মহিলা মিষ্টির প্লেট, জল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আন্দাজ করা যায় পিয়ালির মা। পরনের শাড়িটা বহু পুরনো। প্লেটটা বিছানায় নামিয়ে গ্লাস রাখলেন টেবিলে। বললেন, টাকাটা যেন পাওয়া যায়, একটু দেখো না বাবা। বড়লোক ঘরের ছেলে দেখে, উনি ধারদেনা করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। সোনাদানা তো সব গেছে। ওই টাকাটা দিয়ে ধারগুলো কিছুটা মেটানো যাবে।

উপলের খটকা লাগে। বলে, কেন? গোরার ভাই যে বলল, সব গয়নাগাটি বউদি নিয়ে চলে গেছে।

ফুঁসে উঠল পিয়ালি, মিথ্যে কথা। আমার সামনে এসে বলুক দেখি। ও মারা যাওয়ার পর রাতদিন খোঁটা দিত। বলত, আমি অলুক্ষুনে। আমার জন্যই মারা গেছে ছেলে। একদিন অতিষ্ঠ হয়ে এক কাপড়ে চলে আসি এ বাড়ি। থাকার মধ্যে সঙ্গে ছিল একজোড়া চুড়ি আর মোবাইলটা। ওরা আজ পর্যন্ত আমার খোঁজ নিতে আসেনি এখানে।

উপল অবাক হয়। এত বড় মিথ্যে নির্দ্বিধায় চালিয়ে দিল গোরার ভাই! পিয়ালির মা বলতে থাকেন, আত্মীয়স্বজন, পাড়ার লোককে দেখাবে বলে সুন্দরী মেয়ে ঘরে তুলল। মিথ্যে বলব না, নগদ টাকা নেয়নি। সোনা দিয়ে সাজিয়ে দিতে হয়েছে মেয়েকে। বলেছে, আমরা বেনেবাড়ি, ওটুকু না দিলে চলে! নিজেরাও বউকে গয়না দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। পরের দিনই খুলে নিয়েছে সব। উদয়াস্ত খাটাত মেয়েটাকে। কিছু মনে কোরো না, তোমাদের অফিসের গুণধর স্টাফটি ছিল একেবারে বাপ-মায়ের হাতের পুতুল। বউয়ের হয়ে একটা কথাও বলত না। ওখানে বিয়ে দেওয়াই আমাদের ভুল হয়েছিল। আসলে লোভে পড়ে…

কথা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে দেখে প্রসঙ্গ ঘোরায় উপল। পিয়ালিকে বলে, আপনাকে এখন

একটা কাজ করতে হবে। একটা চিঠি দিতে হবে আমাদের কোম্পানির মালিককে। উনি সত্যিই টাকাকড়ির ব্যাপারে কাউকে ঘোরানো পছন্দ করেন না। গোরা আপনাকে ঠিক তথ্যই দিয়েছিল। আপনার সঙ্গে এখন যে ব্যবহারটা করছে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট, মালিক জানেন না। ওঁর নামে ডাইরেক্ট চিঠি করে জানাতে হবে। লিখতে হবে এইরকম, স্বামীর মৃত্যুর পর আমি এখন বাবার সংসারে। আমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। বারংবার আপনার অফিসে গিয়ে আমার প্রাপ্য, স্বামীর প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, ফ্যামিলি পেনশানের ব্যবস্থা, কোনওকিছুই পাচ্ছি না। আপনি অনুগ্রহ করে এই অসহযোগিতার কারণ অনুসন্ধান করুন— একটু থামে উপল, জিজ্ঞেস করে, বাই দ্য ওয়ে, আপনার বাবা কী কাজ করেন?

পিয়ালি বলে, হাতিবাগানে শাড়ির দোকানের সেলসম্যান।

সেটাও উল্লেখ করবেন, বলল উপল।

অনুনয়ের সুরে পিয়ালি বলে, এত যখন করলেন, একটা রিকোয়েস্ট রাখবেন? কী?

চিঠির বয়ানটা যদি আপনিই লিখে দেন, ভাল হয়। ওইসব অফিশিয়াল চিঠি আমি কখনও লিখিনি। আর একটা কথা, আমায় কেন আপনি আপনি করছেন! ওকে তো ভাইয়ের মতো ভেবে ‘তুই’ বলে ডাকতেন। আমায় অনায়াসে ‘তুমি’ বলতে পারেন।

ঠিক আছে। কাগজ-পেন দাও। বলে উপল।

পিয়ালির মা বললেন, মিষ্টি ক’টা খেয়ে নাও বাবা। আমি যাই। চা ভিজিয়ে এসেছি।

ঘর থেকে চলে গেলেন মহিলা। টেবিলে রাখা জিনিসপত্রের মধ্যে থেকে পিয়ালি পেন, ডায়রি বার করল। উপল মিষ্টি চারটে সাবাড় করে, জল খেয়ে চিঠি লেখায় মন দিল। অফিস থেকে সোজা চলে এসেছে, খিদে পেয়েছিল বেশ। পিয়ালি গ্র্যাজুয়েট, ওর হয়ে চিঠিটা ইংরেজিতেই লিখছে উপল। লেখার ফাঁকে জানতে চায়, টাকাগুলো ডিসবার্স হয়ে গেলে, তা দিয়ে লোন শোধ হবে। তুমি কী করবে ঠিক করেছ?

চাকরিবাকরির চেষ্টা করছি। সেভাবে যোগাযোগ হচ্ছে না। একটা হোমডেলিভারির

রান্নার কাজ পেয়েছি। টাকা দেবে খুবই কম।

তুমি তো গ্র্যাজুয়েশন করেছ, কোন সাবজেক্ট?

আর্টস। অনার্স ছিল না। আপনি কী করে জানলেন?

গোরা বলেছিল। রান্নার কাজের চেয়ে ভাল কাজ তুমি পাবে। একটু খোঁজ করে দেখো। কম্পিউটার জানো?

না। শেখার মতো পয়সাও নেই। সময়ও নেই। তাড়াতাড়ি কোনও একটা কাজে ঢুকতেই হবে। আমার পর দুটো ভাইবোন। দু’জনেই ছোট। আমি ফিরে আসাতে সংসারে চাপ পড়ে গেছে। উপল চুপ করে থাকে। কথা বলতে বলতে অসুবিধে হচ্ছে চিঠি লিখতে। লেখাটা শেষ করে, যা বলার বলবে।

খানিকক্ষণের মধ্যেই শেষ হল চিঠি। উপল বলল, সাদা ফুলস্কেপ পেপারে চিঠিটা কপি করবে, নীচে সই করে ঠিকানা লিখবে, কেমন?

ঘাড় হেলিয়ে ডায়েরিটা নেয় পিয়ালি। চোখ বোলায় চিঠির বয়ানে। আশার আলোয় উজ্জ্বল হয় মুখ। বলে, আমি হলে এরকম লিখতেই পারতাম না।

ঘরে ঢুকলেন পিয়ালির মা। হাতে চায়ের কাপ। উপল কাপটা নেয়। পরিবেশ হালকা করবার জন্য পিয়ালির মাকে বলে, ছোট দু’জন কোথায়?

ওরা টিউশান পড়তে গেছে বাবা। পড়ালেখায় আজকাল যা খরচ। বড় মেয়েকে বলি, আর কিছু না পাস, দু’-চারটে টিউশান পড়া। সে রাজি নয়। মাথায় ঢুকেছে চাকরি। তুমি বলো, এখনকার বাজারে চাকরি পাওয়া কি মুখের কথা! টিউশানির বদলে মেয়ে রান্নার কাজে রাজি।

মায়ের বলা শেষ হতেই পিয়ালি ধরে নেয়, টিউশানি পাওয়াও সোজা নয়। সবাই স্কুলটিচারের কাছে পড়তে চায়। না হলে নাকি নাম্বার পাবে না। টিউশানির পসার জমাতে সময় লাগে অনেক। এতদিন অপেক্ষা করলে আমার চলবে না।

এতসব সমস্যা শুনে উপল কী করবে! তার যতটুকু সাধ্য সে করেছে। চা খাওয়া হয়ে গেছে উপলের। টেবিলে কাপ রেখে বলে, আমি উঠি। পারলে কালই চিঠিটা রিসেপশানে গিয়ে দেবে। চিঠির মাথায় যেমনভাবে অ্যাড্রেস করা আছে, একই লেখা লিখবে খামের উপর।

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় উপল। পিয়ালি বলে, চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিই। কী দরকার? আমি ঠিক চলে যেতে পারব।

না-ও পারতে পারেন। যা গোলকধাঁধা আমাদের পাড়া। মুচকি হেসে বলে পিয়ালি। বাড়ির গুমোটভাব অনেকটাই কেটে গেছে, পরিস্থিতি আরও সহজ করতে চেয়ে উপল বলে, তা হলে নয় এ পাড়াতেই বাড়ি ভাড়া করে রয়ে যাব। অফিস যাতায়াত করব এখান থেকেই।

খিলখিল করে হেসে ফেলে পিয়ালি। বলে, অফিস যেতে পারবেন, বাড়ি ফিরতে পারবেন না!

দু’জনে এখন পাড়ার গলিতে। উনুনে আঁচ দিয়েছে কোনও গৃহস্থ, ধোঁয়ায় ভরে গেছে গলি। উপলের পাশে হাঁটতে হাঁটতে পিয়ালি বলে, আপনি যে আমার জন্য কিছু করবেন, সে বিশ্বাস আমার ছিল। সেই কারণেই অফিসে আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বিশ্বাসটা তৈরি হল কী করে? জানতে চায় উপল।

পিয়ালি বলে, বউভাতের দিন আপনাকে দেখে।

ওরে বাবা, সে তো অনেকদিনের কথা, এখনও মনে আছে! উপলের গলায় বিস্ময়। পিয়ালি স্বাভাবিক। বলে, বেশিদিন তো নয়, মাত্র দু’বছর।

প্রসঙ্গ বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে পারে বুঝে কথা ঘোরায় উপল। বলে, তোমাকে এভাবে হেল্প করছি, স্টাফেরা যেন ঘুণাক্ষরেও না জানে।

আমি যে

সে বুদ্ধিটুকু আমার আছে। রঞ্জুকেও সঙ্গে নেব না। একাই যাব কাল। সেই ভাল। তেমন বুঝলে বাবাকে সঙ্গে নিতে পারো।

বাবার সময় হবে না। ছুটি পায় না একদম।

দু’জনে কথা বলতে বলতে পার হচ্ছে একটার পর একটা গলি। পিয়ালি এখন এতটাই সহজ, উপলের মনে হচ্ছে এর সঙ্গে বুঝি আগেও অনেকবার কথা হয়েছে। এসেছে পিয়ালিদের বাড়ি! এই গলি দিয়েই।

আজ শনিবার। উপলদের হাফ ডে৷ বাসে করে বাড়ি ফিরছে উপল। সব শনিবার এত তাড়াতাড়ি ফেরে না। আড্ডা মারতে যায় বাগবাজারে সুমিতদের বাড়িতে। কলেজবন্ধুরা জমা হয়। কোনও কোনও শনিবার সিনেমা, নাটক দেখে। কখনও বা বোনের বাড়ি যায়। আজ ফিরতে হচ্ছে পাড়ার ক্লাবে মিটিং আছে বলে, পিয়ালির ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না। চিঠিতে কাজ হয়েছে। পরের দিনই গ্র্যাচুইটির চেক নিয়ে গেছে পিয়ালি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের চেক যাবে ওর বাড়ির ঠিকানায়। তারপর আছে ফ্যামিলি পেনশান, এসব ব্যাপারে গুপ্তদার সঙ্গে আবার কী কথা হল, কিছুই জানে না উপল। পিয়ালি এখনও পর্যন্ত কোনও ফোন করেনি। হয়তো করবে না। এদিককার সমস্ত ব্যাপার মিটে গেছে। বুঝতে পারছে, বাকি পাওনা পেতে উপলকে আর দরকার পড়বে না। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটা ফোন করতে পারত। না করার একটাই কারণ থাকতে পারে, সেদিন যে চোখের জল ফেলে সিনটা করল, সবই নাটক। কলিগরাই ঠিক বলছে, ছেলেটাকে বিয়ে করবে পিয়ালি। গোরার ভাইয়ের তথ্যও হয়তো ঠিক, গয়নাগাটি সব নিয়ে এসেছে ও বাড়ি থেকে। ঘটনাগুলো তো জানাজানি হবেই একসময়, জবাবদিহির ভয়ে দূরত্ব বাড়াতে ফোনটা করল না পিয়ালি। সত্যি, মানুষ যে কতরকম হয়! এদিকে উপল নয় নয় করে দশ-বারোজনকে বলে রেখেছে পিয়ালির জন্য চাকরি দেখতে। এমনকী সুপর্ণাকেও বলেছে, তোমাদের স্কুলে যদি কিছু একটা হয় দেখো।

সুপর্ণা বলেছে, দেখব। তারপর জানতে চায়, এই কি সেই মেয়ে, যার জন্য আপনার কোনও মেয়েই পছন্দ হচ্ছে না?

উত্তর দিতে সময় নিয়েছিল উপল। পিয়ালির উপর সত্যিই কি যার কোনও আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে? ওদের বাড়িতে যতক্ষণ ছিল, একবারও মনে হয়নি মেয়েটিকে করুণা করছে। ওর জন্য কিছু করতে ভাল লাগছিল। এমন নয় তো, গোরার বউ যেমন দু’বছর আগে একবার দেখায় উপলকে মনে রেখেছিল, তেমনই উপলের মনে রয়ে গিয়েছিল পিয়ালিকে। বউ সাজে অত সুন্দর মেয়ে শেষ কবে দেখেছে উপল, মনে পড়ে না। তবে এ সবই সম্ভাবনার অঙ্ক। বিষয়টাতে এত গুরুত্ব না দেওয়াই ভাল। ফোনের ও প্রান্তে অপেক্ষা করে থাকা সুপর্ণাকে উপল বলে, না সেরকম কেউ নয়। আমার কলিগের ওয়াইফ। কলিগ কিছুদিন হল মারা গেছে।

ও, আই অ্যাম সরি। আমাদের স্কুলের স্যালারি কিন্তু খুব কম।

হোক। আপাতত কিছু একটা পেলেই ওর চলবে।

এরপর সুপর্ণা বলে, আপনি কিন্তু কথা রাখেননি। বলেছিলেন, ডাকবেন। ডাকব। একটু ঝামেলায় আছি।

ফর্মালিটি করছেন। তবু প্রয়োজনে বন্ধু ভেবে যে ফোনটা করেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ।

সুপর্ণা ফোন অফ করার পর উপল ঠিক করে মাঝেমধ্যে ওকে ফোন করবে। মেয়েটা ভাল, বন্ধুত্বটা রাখাই যায়।

অফিসের কলিগরা আর বন্ধু রইল না। ওরা আন্দাজ করেছে, উপলের বুদ্ধিতেই মালিককে সরাসরি চিঠি দিয়েছে পিয়ালি। মালিকের ধরনধারণ উপলের থেকে ভাল কেউ জানে না। কিছুদিন থেকে উপল এড়িয়ে চলছিল কলিগদের। খুব দরকার আর সৌজন্যমূলক দু’–একটা কথা ছাড়া বাক্য বিনিময় করছিল না। পিয়ালি চিঠি দেওয়ার পর সেটুকুও তারা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে উপলের কোনও সমস্যা নেই। ইউনিয়ন থেকে সরে আসবে। কাজ যা জানে, কোম্পানি কোনওদিনই তাকে তাড়াবে না… নানা ভাবনা মাথায় নিয়ে উপল বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির গেটে পৌঁছোয়। বাড়িতে কেউ এসেছে, সব ঘরের আলো জ্বলছে। মা আলো সহজে অপচয় করে না। বোন এল কি?

দোরগোড়ায় লেডিস চটি। চৌকাঠ ডিঙিয়ে জুতো ছাড়ে উপল। মাথা তুলে দেখে, ভিতর ঘর থেকে পরদা সরিয়ে বেরিয়ে আসছে পিয়ালি। উপল হাঁ হয়ে গেছে! পিয়ালির পরনে আজ শাড়ি, সরল মিষ্টি সেই হাসিটা হাসছে।

উপল বলে, তুমি এখানে!

ফোনে কৃতজ্ঞতা জানাতে খারাপ লাগছিল। তাই চলে এলাম।

উপল সোফায় এসে বসে। অফিসব্যাগ নামিয়ে রাখে মেঝেতে। জানতে চায়, বাড়ি চিনলে কী করে?

খুব সহজ। গুপ্তদার থেকে আপনার বাড়ির ফোন নাম্বারটা নিলাম। মাসিমাকে ফোন করে জেনে নিলাম কীভাবে আসতে হবে এখানে। ওঃ, সেদিন আপনাদের মালিক আমাকে চেম্বারে বসিয়ে গুপ্তদাকে ডেকে পাঠিয়ে এমন বকুনি দিলেন, আপনি যদি দেখতেন…

মা জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল। বলল, আর বলিস না, এমন মেয়ে, এক কাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে এসেছে। আমরা দুটো মানুষ, কে খাবে বল তো এত মিষ্টি!

মায়ের থেকে গ্লাস নিয়ে জল খেয়ে উপল পিয়ালিকে বলে, এসব মিষ্টি ফিষ্টির কী দরকার ছিল!

আমি কিছু জানি না। বাবা বাগবাজার থেকে মিষ্টি এনে আমাকে বলল, ওঁর বাড়িতে দিয়ে আয়। উনি আমাদের জন্য যা করলেন, কেউ করবে না।

কথার ধুয়ো ধরে মা বলে, ও চিরকালই ওরকম। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের জন্য কী করেছে, তোমাকে তো বললাম। পাড়ার লোকের বিপদ-আপদে সবসময় দৌড়ে যায়। আমাদের আত্মীয়স্বজন…..

আঃ, মা, তুমি থামবে। ধমকাতে বাধ্য হয় উপল, এমন অস্বস্তির মধ্যে ফেলে। মা একটুও রাগ করে না। হঠাৎ যেন সুইচ অফ করে দেওয়া হয়েছে কথা বলা পুতুলের, উপলের হাত থেকে ফাঁকা গ্লাসটা নিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে।

পিয়ালি এসে বসল উলটোদিকের সোফায়। বলল, আমি কোনও ইন্টিমেশন না দিয়ে, এভাবে বাড়ি চলে আসাতে আপনি কি রাগ করেছেন?

স্বাভাবিক মেজাজে ফিরে গিয়ে উপল বলে, রাগ করব কেন! তবে অবাক হয়েছি তো বটেই।

কী মনে হচ্ছে, মেয়েটা খুব বেহায়া?

হঠাৎ এ কথা উঠছে কেন? ঈষৎ গম্ভীর হয়ে জানতে চায় উপল।

স্বগতোক্তির ঢঙে পিয়ালি বলে, না, আমারই কেন জানি মনে হচ্ছে, বেশ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। আমি যদি আসতে রাজি না হতাম, জোর করে ঠেলে পাঠাতে পারত না বাবা-মা। হাসিখুশি একটা সাংসারিক পরিবেশে কিছুক্ষণ থাকার লোভ হয়েছিল আমার। আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল, আপনাদের বাড়িটা সেরকমই। নয়তো মনটা এত উদার হয়! আমি যে দুটো বাড়িতে কাটিয়েছি, একটাতে অভাব, অন্যটাতে শাসন। স্বাভাবিক সংসার কেমন হয় ভুলতেই বসেছি।

আমাদের বাড়িতে আর হাসিমজা কোথায়? মা একা থাকে, আমি বেশিরভাগটাই বাইরে। বলল উপল।

পিয়ালি বলে, এটা সাময়িক। আপনি বিয়ে করলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। মাসিমার কাছে গল্প শুনলাম, একসময় আপনাদের বাড়ি কত জমজমাট ছিল। আপনার বাবা পার্টি করতেন, বাড়িতে লোকের যাতায়াত লেগেই আছে। দফায় দফায় চা-মুড়ি। বোন খুব কটকটি, ভাই দুরন্ত। তুলনায় আপনি বরাবরই শান্ত। সব মিলিয়ে একটা প্রাণোচ্ছ্বল সংসারের ছবি। আমার শ্বশুরবাড়িতে এসবের কোনও বালাই নেই। সবাই মুখ গোমড়া করে আছে, আর খালি অর্ডার…

গোরা ভালবাসত না তোমাকে? কথাটা মুখ দিয়ে অজান্তে বেরিয়ে যায় উপলের। ডুবে গিয়েছিল পিয়ালির কথায়।

উত্তরে পিয়ালি বলে, হ্যাঁ, ভালবাসত। নিজের মতো করে। আমার কী ভাল লাগে না লাগে কিছুই বুঝতে পারত না। ও বাড়িতে যে আমি সুখে নেই, সেটুকু ধরতে পারত। রাতে দরজা বন্ধ করে বলত, একটু হাসো না। আমরা তো এখন স্বাধীন। জানি, সারাদিন বাড়িতে তোমার উপর কী অত্যাচার হয়। কিন্তু কী করব বলো? আলাদা হয়ে গেলে, বাবা সম্পত্তির কানাকড়িও দেবে না। মিছিমিছি অত টাকা ছেড়ে দেওয়ার কোনও মানে হয়? বাবা মা আর কতদিন? কোনও কোনও রাতে মদ খেত বন্ধ ঘরে। আমাকেও খেতে বলত। খারাপ পোশাক কিনে নিয়ে এসে বলত পরতে। না পরলে জোর করত না। একটু পীড়াপীড়ি করে ঘুমিয়ে পড়ত একসময়। সেই মানুষটাই বদলে যেত সকালে দরজা খোলার পর। মুখ দেখলে বোঝা যাবে না রাতে কী কী কাণ্ড করেছে। তখন বাবা-মায়ের অতিবাধ্য ছেলে।

ধর্মভীরু নিরীহ গোরার এইসব কীর্তি শুনে ভারী অবাক হচ্ছে উপল, মানুষ কতরকমের

হয়। জীবন অভিজ্ঞতায় পিয়ালি উপলের থেকে এগিয়ে আছে। স্বাভাবিক কৌতূহলে উপল জিজ্ঞেস করে, দু’বছর ঘর করলে গোরার সঙ্গে, কোনওদিনই কি ভালবাসতে পারোনি? সত্যি বলব, না মিথ্যে?

সত্যিটাই বলো।

পারিনি ভালবাসতে। চেষ্টাই করিনি। ওর সমস্ত কিছু আমার অপছন্দ হত। ও যদি মারা না-ও যেত, আমি বেশিদিন ওর সঙ্গে থাকতে পারতাম না। তবে ও মারা যেতে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। আত্মীয়স্বজন কারও মৃত্যু হলে মানুষের যেমন কষ্ট হয়। আমার কখনোই মনে হয় না, বিধবা হয়ে গেছি।

পিয়ালির শেষ কথাটার অভিঘাতে উপলের হৃৎপিণ্ড যেন চলকে উঠল। কোনও মেয়ে তার বৈধব্যকে এভাবে তাচ্ছিল্য করতে পারে। কল্পনাতেও ছিল না উপলের। হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে পিয়ালির দিকে। কথাটা যে বেশ ওজনদার হয়ে গেছে, টের পায় পিয়ালিও, পরিবেশ সহজ করার জন্য দ্রুত সচেষ্ট হয়। আড্ডার মেজাজে ফিরে গিয়ে বলে, ও কিন্তু আপনার মস্ত বড় ফ্যান ছিল। বউভাতের দিন কত লোক এল গেল। রাতে প্রথমে আপনার কথাই তুলল, কেমন দেখলে আমাদের লিডারকে? উপলদাকে মালিক, স্টাফ সকলেই খুব মানে। দেখতেও খুব হ্যান্ডসাম, তাই না?

তুমি কী উত্তর দিয়েছিলে?

সত্যিটা বলিনি। পাছে ও কষ্ট পায়। প্রথম রাত তো।

সত্যিটা কী? মজা করে জানতে চায় উপল।

হুঁশ ফেরে পিয়ালির। লজ্জা পেয়ে বলে, আপনি ভীষণ চালাক, মুখ থেকে নিজের প্রশংসা টেনে বার করছেন।

হেসে ফেলে উপল। কী যেন মনে পড়ে যেতে পিয়ালি শশব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে সোফা ছেড়ে। বলে, এই রে, মাসিমাকে লুচি বেলে দিচ্ছিলাম, আপনার সঙ্গে গল্প করতে বসে সব ভুলে গেছি। ছিঃ ছিঃ, কী মনে করবেন।

কিচেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল পিয়ালি। উপল বলে, আচ্ছা শোনো, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ থাকছি না বাড়িতে। খেয়েই বেরিয়ে যাব। মিটিং আছে পাড়ায়।

আমি একটু থাকি না। গল্প করি মাসিমার সঙ্গে। অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল পিয়ালি।

এর কী উত্তর দেবে উপল! মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে। বাইরের হাত-মুখ এখনও ধোয়া হয়নি।

আজ টিফিনের পর থেকেই ঝড়ের গতিতে কী বোর্ডে হাত চালিয়েছে উপল। কম্পোজ তবু শেষ হল না। অনেক পাতার কাজ। আর্জেন্টও আছে। ছ’টা বাজতে চলল। মুখে এক-দু’বার বিরক্তিসূচক শব্দ করে ফেলে উপল। সলিল নিজের সিট থেকে জানতে চায়, কোথাও যাবি নাকি?

ইদানীং কলিগদের সঙ্গে একটু আধটু কথাবার্তা চলছে। রোজ দেখা হচ্ছে, কথা না বলে থাকাও যায় না। উপল বলে, বাড়িতেই ফিরব। লোক আসবে। পাত্রীপক্ষ?

এখন ঠাট্টার সময় নয়, সলিলের কথার উত্তর দেয় না উপল। ফের সলিল বলে, কাজগুলো আমায় বুঝিয়ে চলে যা। আমি এখনও ঘণ্টা দুয়েক থাকব।

হাতে যেন চাঁদ পেল উপল। সলিল ওভারটাইম করছে ওর কাজের ফাঁকে উপলেরটাও করে দেবে। তাড়াতাড়ি নিজের কাজ গুছিয়ে সলিলকে গিয়ে বোঝায় উপল।

অফিস থেকে বেরোল ছ’টার একটু আগেই। বাইরে এখনও শেষ বিকেলের আলো। দিন বাড়ছে। আলোটুকুতে যেন স্বস্তি পায় উপল। পিয়ালিকে ভুল জায়গায় দাঁড়াতে বলা হয়ে গেছে। মেট্রো হলের সামনে দিনের বেলাতেই ঘরে-বাইরের মেয়ের মধ্যে তফাত করতে পারে না পাবলিক।

ফাঁকা মিনিবাস পেয়ে গেছে উপল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে। দেখা করতে চেয়ে পিয়ালি ফোন করেছিল কাল রাতে। কী যেন পরামর্শ করার আছে। বলেছিল, আপনাদের বাড়ি যাব। উপল বলেছে, এত দূর আসার কী দরকার? আমার ছুটির পর কোথাও দাঁড়িয়ো। দেখা করে নেব।

কোথায় দাঁড়াব, অফিসের বাসস্টপে? জানতে চেয়েছিল পিয়ালি।

কলিগদের চোখে পড়তে না চেয়ে উপল তড়িঘড়িতে মেট্রো হলের নামটাই বলেছিল। মিট করার সুপ্রাচীন স্পট। এখন মনে হচ্ছে অন্য কোনও জায়গা বললে ভাল হত। কী ব্যাপারে পরামর্শ করতে চাইছে পিয়ালি, আন্দাজ করতে পারছে না উপল। অফিসের ব্যাপার তো সব মিটে গেছে! ফ্যামিলি পেনশানের ডিক্লারেশন দিয়েছে পিয়ালি। নতুন কোনও প্রবলেম অ্যারাইজ করল কি? অফিসে উকিলের চিঠি দিল নাকি গোরার বাড়ির লোক? সেরকম কিছু হলে গুপ্তদা উপলকে ডেকে বলত। মালিকের ধমক খাওয়ার পর থেকে গুপ্তদা পিয়ালির পক্ষে হয়ে গেছে। গুপ্তদা এটাও জানে, স্টাফেদের আক্রোশ থেকে নিজেকে আড়াল করতে গেলে, উপলের দ্বারস্থ হতেই হবে।

এমনও হতে পারে পিয়ালির পরামর্শ করতে চাওয়াটা আসলে বাহানা, সঙ্গ পেতে চায় উপলের। সে যে উপলের বেশ অনুরক্ত হয়ে পড়েছে, বাড়িতে যেদিন এসেছিল, ধরা যাচ্ছিল ভালমতোই। এখানেও আবার একটা সংশয় আছে, উপলের, নাকি বাড়ির প্রতি বেশি অনুরক্ত পিয়ালি বোঝা যাচ্ছে না। উপল পাড়ার মিটিং সেরে রাত করে ফিরেছিল বাড়ি। মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কখন গেল পিয়ালি?

মা বলল, এই তো মিনিট দশেক হল।

ওরে বাবা, তা হলে বাড়ি ফিরবে কখন! সেই নারকেলডাঙা।

তোমরা এতক্ষণ কী কথা বললে? জিজ্ঞেস করেছিল উপল।

ওর শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির গল্প। এই বয়সেই অনেক কষ্ট পেয়েছে বেচারি। অকালে চলে গেল স্বামী। সংসার করার বাসনা অপূর্ণ রয়ে গেছে। সারাক্ষণ আমার সঙ্গে সেঁটে রইল। ভগবানের যে এ কেমন বিচার, কে জানে!

মায়ের সঙ্গে উপল আর কথা বাড়ায়নি। পিয়ালির প্রসঙ্গ মানেই বিষণ্নতা। উপল ভুলতে চেয়েছে ওর কথা, পারেনি। গত চারদিন ধরে নানা কাজের ফাঁকে মনে পড়েছে ওকে। মনের চোখে ভেসে উঠেছে ওর চাউনি, চিবুক, কপাল, কচি বটপাতার মতো কানের লতি, ফরসা পায়ের পাতা, হাঁটলে যেখানে আলতার মতো রক্ত জমা হয়। আঙুরের মতো ফোলা ফোলা ঠোঁট, থোড়ের মতন মসৃণ বাহু। উপলের সচেতন মনের পাশেই এখন পিয়ালির প্রবল উপস্থিতি। এর আগে কখনও কোনও মেয়ের প্রতি এতটা দুর্বল হয়ে পড়েনি উপল। কলিগের সদ্য বিধবা স্ত্রীর উপর এই অনুরাগ ভাল চোখে দেখবে না চেনা পরিচিতরা।

ধর্মতলার কাছাকাছি চলে এসেছে বাস, উপল এগিয়ে যায় গেটের দিকে।

মেট্রো হলের সামনে রাজেন্দ্রাণীর মতো দাঁড়িয়ে আছে পিয়ালি। পরনে দামি কোনও শাড়ি নয়। সুতির উপর প্রিন্ট, কালার কম্বিনেশন দারুণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওর পরি পরি রূপ। উপল নিশ্চিত হয়, মস্ত বড় গাড়লও ভুল করে ওকে খারাপ কোনও ইঙ্গিত দেয়নি।

পাতাল রেল ধরে উপলরা চলে এসেছে রবীন্দ্রসদন চত্বরে। উপল রেস্তোরাঁয় খাওয়াবে অফার দিয়েছিল। পিয়ালি বলেছে, আমার দম বন্ধ লাগে। খোলামেলায় হাঁটি চলুন।

এখানেও ভিড় কিছু কম নয়। তবে যুগলরা নিজেদের মতো নিভৃত জায়গা বেছে নিয়েছে। উপলও বেছে নিতে পারত, কিন্তু তাদের রিলেশানটা যে ওদের মতো নয়। পিয়ালীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে উপল বলে, পরামর্শ করার কথা কী বলছিলে?

পিয়ালীর হাঁটার গতি মন্থর হয়ে যায়। বলে, একটা চাকরি পেয়েছি। ওল্ড এজ হোমে। আবাসিকদের দেখাশোনার কাজ।

কোথায় হোমটা?

একটু দূরে। বোলপুরে। মাইনে ভালই দেবে।

তার মানে তো ওখানে থাকতে হবে?

থাকতে তো হবেই। চাকরির শর্তই তাই।

কী করবে, নেবে চাকরিটা?

সেটার জন্যই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। বাবাও বলল, আপনার পরামর্শ নিতে। আপনি তো এখন আমাদের বাড়ির গার্জেন।

পিয়ালির কথার পর ভাবতে একটু সময় নেয় উপল। তারপর বলে, অত দূর চলে গেলে

কলকাতার চাকরির হদিস পাবে না। থাকবে আবার বয়স্কদের মধ্যে। নিজেই তো বুড়িয়ে যাবে। অত বড় একটা জীবন পড়ে আছে।

জীবনে আর কী পাওয়ার আছে আমার?

অনেক কিছু আছে। নতুন করে শুরু করা যায়। চাকরি-বাকরি, বিয়ে-থা…

উপলের কথার পিঠে পিয়ালি বলে, আমার বিয়ে হওয়া খুব কঠিন। আত্মহত্যার ঘটনা ঘটা বাড়ি যেমন বিক্রি হতে চায় না, ভাড়াও আসতে চায় না কেউ, তেমনই অ্যাক্সিডেন্টে মৃত স্বামীর বিধবাকে বিয়ে করতে ভয় পাবে লোকে।

উপল বিরক্তির গলায় বলে, আজকের এই দু’হাজার দশ সালে দাঁড়িয়ে এসব মধ্যযুগীয় কথাবার্তার কোনও মানে হয় না।

সবাই তো আপনার মতো উদার নয়। খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠে কথাটা পিয়ালি উচ্চারণ করলেও, উপলের কেমন যেন খটকা লাগে। বলে, ঠিক বুঝলাম না।

এর থেকে সোজা করে বলতে পারব না আমি। আপনার মা কথাটা তুলতে বলেছিলেন, তুললাম ব্যস। বলে, লজ্জায় একটু দূরে সরে গেল পিয়ালি।

যা বোঝার বুঝে গেছে উপল। একটা খুশি ছড়িয়ে পড়ছে তার সারা শরীরে। এখানকার গাছের শরীর যেভাবে কল্লোলিত হচ্ছে ঘরে ফেরা পাথির ডাকে। উপল পিয়ালির কাছে গিয়ে মজার গলায় জানতে চায়, চাকরির ব্যাপারটা সত্যি, নাকি প্ল্যান?

খুবই অপ্রতিভ হয়ে পড়ে পিয়ালি। বলে, এই না, ওটা একেবারে সত্যি। রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ছুঁয়ে বলতে পারি।

উপলরা দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের স্ট্যাচু ঘেরা ছোট্ট বাগানটার পাশে। পিয়ালি ফের বলে, আপনি যদি রাজি না হন, চাকরিটা আমি নেব। অন্য কাউকে বিয়ে করার কোনও ইচ্ছে নেই আমার।

আজও দেখা হবে পিয়ালির সঙ্গে। তবে সেরকম কোনও তাড়া নেই। পিয়ালি কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবে না। উপলই যাবে ওদের বাড়ি। পিয়ালিকে বিয়ে করতে চায়, বলবে ওর বাবাকে। উপলের মা বলেছে, এমনটাই করা উচিত। মেয়ের বাড়ির লোক ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে মরমে মরে আছে, মাথা উঁচু করে বিয়ের প্রস্তাবটা উপলকে দিতে পারবে না। ওদের ছোট না করে প্রসঙ্গটা উপলেরই তোলা ঠিক হবে। মায়ের বিচক্ষণতাকে মনে মনে তারিফ করেছিল উপল। ঔদার্যেও মা অবাক করছে উপলকে। পিয়ালির কাছে বিয়ের কথা শুনে উপল ধরেছিল মাকে, ওর মাধ্যমে বলালে কেন? তুমিই জিজ্ঞেস করতে পারতে আমাকে।

মা বলেছিল, তোদের রিলেশান কতটা কীরকম আমি তো জানি না। আগ বাড়িয়ে তোকে বলতে গিয়ে বকুনি খাই আর কী।

আমাদের রিলেটিভদের কথা ভেবেছ তো? এরকম মেয়ে বিয়ে করলে, তারা কিন্তু তোমায় নানা কথা শোনাবে। উপল খেয়াল করিয়েছিল মাকে।

মা বলল, শোনাক। ওটুকু কষ্টের চেয়ে পিয়ালির দুঃখ অনেক বেশি। মেয়েটা তোকে বিয়ে করলে সুখী হবে। খুবই পছন্দ করে তোকে।

মায়ের কথার পর দু’দিন ভেবেছে উপল, কোনও ভুল করছে না তো? সিদ্ধান্তের পিছনে পিয়ালির প্রতি দয়া করছে, নাকি বিধবাকে বিয়ে করতে চেয়ে মহানুভবতার তৃপ্তি পাচ্ছে উপল? সত্যিই কি প্রেমে পড়ে গেছে পিয়ালির? এই দু’দিন পিয়ালি একটাও ফোন করেনি। সম্ভবত ভাবতে দিয়েছে উপলকে। আর কী আশ্চর্য, উপল পিয়ালিকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবলেও, স্বপ্নে পিয়ালি একবারও আসেনি। আজ সকালে উপল মনস্থির করে নেয়। ফোন করে পিয়ালিকে বলে, অফিসের পর তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি। তোমার বাবা-মা’র কাছে তোমাকে চাইতে।

ও প্রান্তে পিয়ালি চুপ করে ছিল। উপল বলে, তুমি কি বাড়িতে এ ব্যাপারে কিছু বলেছ?

না, বলিনি এখনও। বলব?

থাক, আমি গিয়েই বলি।

মা এদিকে বিয়ের কথা ফোনে জানিয়ে দিয়েছে ভাই-বোনকে। দু’জনেই খুব এক্সাইটেড। ফোনে কথা বলেছে দাদার সঙ্গে। বোন বলেছে, তোর পছন্দ যখন, নিশ্চয়ই দারুণ দেখতে। বিয়ের আগে আমি একবার দেখব। সেই অনুযায়ী চয়েস করব বেনারসি।

উপল বলেছে, দেখিস। তবে দ্বিতীয় বিয়েতে সে বেনারসি পরতে রাজি হবে কিনা, বলতে পারছি না।

তা হলে অন্য শাড়ি কিনব। শাড়ির অভাব আছে নাকি!

ভাই বলেছে, বিয়ে উৎসব অনুষ্ঠান না করে হলেও, আমার ছুটির টাইমে যেন ডেট ফেলা হয়। দাদার বিয়েতে মজা করব, কবে থেকে ভেবে আসছি।

অফিসে ছুটির সময় যত এগিয়ে আসছে, নার্ভাস ফিল করছে উপল। কোনও একটা কারণ দেখিয়ে পিয়ালির বাবা বিয়ের প্রস্তাবটা খারিজ করে দেবে না তো? পিয়ালি যদি বাবার কথাই মেনে নেয়…

কাঁধের উপর কে যেন হাত রাখল। মুখ ঘুরিয়ে উপল দেখে সলিল। চোখে অদ্ভুত একটা করুণাঘন চাউনি। বলল, ছুটির পর কী করছিস?

ভিতর ভিতর চমকে উঠল উপল। তড়িঘড়ি করে বলে, কিছু না, বাড়ি। বাড়িই ফিরব। তোর সঙ্গে আমাদের ক’টা কথা আছে। ছুটির পর সতীনাথের দোকানে বসব।

উপল ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। সরে যায় সলিল। ‘আমাদের’ মানে ইউনিয়নের কয়েকজন। কথাটাও আন্দাজ করা যাচ্ছে, ওরা উপলকে বলবে সেক্রেটারিশিপ ছেড়ে দিতে। কেননা ইদানীং ইউনিয়নের কোনও ব্যাপারেই মাথা ঘামাচ্ছে না উপল। কলিগদের সঙ্গে সম্পর্ক তো আগেই শিথিল হয়ে গিয়েছিল। ওরা কেন উপলের উপর নিজেদের ভাল-মন্দর ভার ছেড়ে দেবে!

ছুটির পর উপল সতীনাথের দোকানে ঢোকে। একেবারে কোনার দিকের টেবিল ঘিরে বসে আছে তিন কলিগ অংশু, সলিল, ব্যানার্জিদা। উপল আরও কয়েকজনকে আশা করেছিল। ইউনিয়নের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে ভেবে, নিজেকে বেশ ভারহীন লাগছে উপলের। এমনটাই তো সে চাইছিল। নিজের মুখে বললে পালিয়ে যাওয়া হত।

টেবিলের ফাঁকা চেয়ারটায় গিয়ে বসে উপল। সলিল গলা তুলে অর্ডার দেয়, চারটে স্পেশাল। তারপর উপলের মুখের দিকে তাকায়। বেশ কয়েক সেকেন্ড একই ভঙ্গিতে বসে রইল সলিল। অস্বস্তি এড়াতে উপল বলে, বল, কী বলছিলি?

সলিল বোঝানোর সুরে বলতে থাকে, দেখ উপল, গোরার ব্যাপারটার পর থেকে তুই যে আমাদের উপর অখুশি, আমরা জানি। স্টাফদের উপর তোর যে এক ধরনের বিতৃষ্ণা জন্মেছে, বুঝতে পারি সেটাও। আমরা কিন্তু তোকে আগের মতোই মান্য করি। তুই আমাদের ম্যরাল।

থামল সলিল। উপল মনে মনে বলে, কেন খামোকা ভূমিকা বড় করছিস? আসল কথাটা বলে ফেল। আমিও উঠে পড়ি।

ফের সলিল বলে ওঠে, তোর কোনও ক্ষতি হোক আমরা চাই না।

কপালে ভাঁজ পড়ে উপলের, কোন ক্ষতির কথা বলতে চাইছে এরা? উপলের কি মারধর খাওয়ার চান্স আছে? গোরার ভাইয়ের কথাটাই মাথায় প্রথম আসে। গুন্ডা দিয়ে মার খাওয়াবে কি? খবর পেয়ে সতর্ক করছে পুরনো তিন সহকর্মী।

এবার ব্যানার্জিদা বলে, গোরার বউয়ের সঙ্গে তুই যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, আমাদের খুব চিন্তা হচ্ছে।

এতক্ষণে লাইনে এল কথা। উপল জানতে চায়, কে বলল, ঘুরে বেড়াচ্ছি?

এই তো ক’দিন আগেই অংশু তোদের রবীন্দ্রসদন চত্বরে দেখেছে। বলল ব্যানার্জিদা।

উপল বলে, রবীন্দ্রসদনে আমরা একদিনই গেছি। অংশুর তখন অফিসে থাকার কথা। তার মানে আমাকে ফলো করা হচ্ছে।

হ্যাঁ, ফলো করেছি। তোমার ভালর জন্যই নজর রাখছিলাম। বেশ বিরক্তির সঙ্গে বলল অংশু।

উপলও ঝাঁঝিয়ে ওঠে, কী ভালর কথা তোরা তখন থেকে বলছিস?

সলিল বলে, মাথা গরম করিস না। আমি বলছি গুছিয়ে। একটু থেমে সলিল বলতে থাকে, তুই যেরকম সিরিয়াস ছেলে, গোরার বউকে দু’দিন ঘুরিয়ে ছেড়ে দিবি না। বিয়ে করে ওকে উদ্ধার করবি।

যদি করিই বিয়ে, তাতে তোদের অসুবিধেটা কোথায়? একইরকম ঝাঁঝের সঙ্গে জানতে চায় উপল।

সলিল কিছু বলতে যাচ্ছিল, থেমে যায়। দোকানের ছেলে চা নিয়ে এসেছে। কাপডিশ টেবিলে নামিয়ে রেখে চলে যায় ছেলেটা। সলিল বলে, গোরা খারাপ পাড়ায় যেত, সোনাগাছি, হাড়কাটা…

সামনে যেন বাজ পড়ল উপলের। চমকানোর আগেই স্থির হয়ে গেছে বজ্রাহতের

মতোই। সলিল বলে যাচ্ছে, আমাদের অফিসের অনেকেই নিয়মিত যায়। বলতে লজ্জা নেই, আমিও গেছি, জাস্ট এক্সপেরিয়েন্সের জন্য। গোরাই ছিল আমাদের পাণ্ডা। তোর সঙ্গে তো এসব নিয়ে আলোচনা করা যায় না, তুই হচ্ছিস অন্য গ্রহের লোক। এইসব শুনলে হয়তো আমাদের সঙ্গে বসে কাজ করতে ঘেন্না পাবি।

উপলের শ্রবণযন্ত্রটুকু শুধু কাজ করছে, সারা শরীরে কোনও সাড় নেই। অংশু বলছে, বাজারের মেয়ের সঙ্গে কাটিয়ে গোরাদা বউয়ের সঙ্গেও শুয়েছে। কে বলতে পারে গোরাদার বউয়ের শরীরে কোনও খারাপ রোগ ঢুকে বসে নেই?

শরীর ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে উপলের, মনে পড়ে যাচ্ছে রিগ্যাল হলের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার কথা। যে ছুঁয়ে দিতেই বরফ হয়ে গিয়েছিল উপল।

নে চা-টা খা। বলে নিজের কাপ তুলে নিল সলিল। বাকি দু’জন কাপ তুলে চা খেতে শুরু করেছে। উপল নিজের কাপের দিকে তাকায়, ভয় করছে এখন কিছু খেতে, যদি বমি হয়ে যায়।

চেয়ার থেকে উঠে পড়ে উপল। বড় বড় পা ফেলে ফুটপাতে চলে আসে। কোনদিকে যাচ্ছে, কোনও হুঁশ নেই। মাথাটাও টলছে যেন। এই নড়বড়ে অবস্থার মধ্যে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, ওরা যা বলল, সব মিথ্যে। ষড়যন্ত্র। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, সত্যতা প্রমাণ করতে সলিল কিন্তু নিজের অপকর্মের কথা লুকোয়নি। বউ-বাচ্চা নিয়ে সলিলের স্টেডি সংসার। এই খবর যদি উপল সলিলের বাড়িতে পৌঁছে দেয়, ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে যাবে। তবু ঝুঁকিটা নিয়েছে সলিল, অবশ্যই উপলের ভালর জন্য। কলিগদের এভাবে সন্দেহ করার কোনও মানে হয় না।

ফুটপাতে ডানহাতি ছোট্ট পার্ক দেখে ঢুকে পড়ে উপল। একটা গাছের নীচে সিমেন্টের বেঞ্চের উপর বসে পড়ে। পার্কে কেউ নেই। রাস্তার আলো পার্কের অন্ধকারকে জড়ো হতে দিচ্ছে না, শাসনে রেখেছে।

রোগ নিয়ে ভাবছে না উপল, তার জন্য চিকিৎসা আছে। উপলের মাথা আচ্ছন্ন করে রেখেছে প্রবল এক ঘৃণাবোধ। পিয়ালি একটি পুরুষের সঙ্গে থেকেছে, এটা মেনে নিয়ে বিয়েতে সম্মত হয়েছিল উপল। যা ওর সংস্কারের সঙ্গে বড়ই বেমানান। ফাঁকটুকু ভরাট করেছিল ভালবাসার টানে। তখন তো জানত না গোরা মানে একটি লোক নয়, জড়িয়ে আছে সমাজের ক্লেদ— আর কিছু ভাবতে পারছে না উপল। মাথা কাজ করছে না। এসব কথা বলা যাবে না পিয়ালিকে, তা হলে ওর নিজের উপর ঘেন্না জন্মাবে। পিয়ালির তো কোনও দোষ নেই। বেচারি নিমিত্ত মাত্র… এভাবে কতক্ষণ সময় কাটল, কে জানে! বুকপকেটে মোবাইল বেজে উঠতেই ঘোর ভাঙে উপলের। ফোন বার করে দেখে পিয়ালির নাম। অন করে কানে নেয় সেট। একটু সময় নিয়ে ‘হ্যালো’ বলে। ও প্রান্তে বিষম উৎকণ্ঠার গলায় পিয়ালি বলে, কী হল, এখনও এলেন না?

উপল কোনওক্রমে বলল, আটকে গেছি। কাজ ছিল অফিসে।

একটা ফোন করে দিলেই হত। এদিকে আমি চিন্তায় মরছি। জানেন তো পথঘাটের ব্যাপারে আমার কেমন টেনশন হয়। যাই হোক, আসছেন তো?

যাচ্ছি। বলে ফেলেই কেঁপে ওঠে উপল। কথাটা অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওপ্রান্তে ফোন অফ করে দিয়েছে পিয়ালি। ‘যাচ্ছি’ মানে যাওয়ার ইচ্ছেটা মনের অজানা কোনও পবিত্র, নির্মল কুটিরে লুকিয়ে আছে। খুঁজে নিতে হবে। মনে ডুব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপলের শরীরও চলতে শুরু করল। পার্ক থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিল সে।

পিয়ালিদের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে উপল। সেই অমলিন হাসি নিয়ে পিয়ালি বলে, আমি জানতাম, আপনি ঠিক আসবেন। দেরি দেখে মা বলছিল, দেখ, হয়তো মত বদলেছে। মাকে বলেছ, বিয়ের কথা? জানতে চায় উপল।

মাকেই শুধু বলেছি। বাবা এখনও জানে না। বলার পরই পিয়ালির চোখ যায় উপলের মাথার দিকে। বলে, একী, কোথায় বসেছিলেন! মাথায় পাতা, কুটো। ছোট ছোট ফুল। দেখি মাথাটা নামান।

মাথা হেঁট করে উপল। চুলের উপর থেকে পাতা, ফুল ফেলে দিতে থাকে পিয়ালি। ও তো জানে না, ওগুলো পুষ্পবৃষ্টি। যখনই পার্কে বসে ‘যাচ্ছি’ কথাটা বলে উঠেছিল উপল, গাছ থেকে ঝরে পড়েছিল ফুল।

সানন্দা নববর্ষ, ২০১০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *