পুষ্পধনু

পুষ্পধনু

রস কী?

অর্থাৎ যখন কোনও উত্তম ছবি দেখি, কিংবা রসের সঙ্গীত শুনি অথবা ভালো কবিতা পড়ি, কিংবা নটরাজের মূর্তি দেখি, তখন যে রসানুভূতি হয় সে রস কী, সৃষ্ট হয় কী প্রকারে?

এ রসের কাছাকাছি একাধিক রস আছে। গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে, ধাঁধার উত্তর বের করে, মনোরম সূর্যোদয় দেখে, প্রিয়াকে আলিঙ্গন করে যেসব রসের সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে যে পূর্বোল্লিখিত রসের কোনও মিল নেই সেকথা জোর করে বলা চলে না। এমনকি শোনা কথা বার্ট্রান্ড রাসূল নাকি বলেছেন, গণিতের কঠিন সমস্যা সমাধান করে তিনি যে আনন্দ অনুভব করেন সেটি নাকি হুবহু কলারসের মতোই। কিন্তু এসব রসে এবং অন্যান্য রসে পার্থক্য কী সে আলোচনায় এবেলা মেতে উঠলে ওপারে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমার জ্ঞানও অতিশয় সীমাবদ্ধ, প্রকাশশক্তি ততোধিক সীমাবদ্ধ। (তা হলে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, আমি আদৌ লিখতে যাচ্ছি কেন? উত্তরে সবিনয় নিবেদন, বহুদিন সাহিত্য রচনা করার ফলে আমার একটি নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠী জমায়েত হয়েছেন; এদের কেউই পণ্ডিত নন– আমিও নই- অথচ মাঝে-মধ্যে এঁরা কঠিন বস্তুও সহজে বুঝে নিতে চান এবং সে কর্ম আমার মতো বে-পেশাদারি নন-প্রফেশনালই করতে পারে ভালো। রচনার গোড়াতেই এতখানি ব্যক্তিগত সাফাই হয়তো ঠিক মানানসই হল না, তবু পণ্ডিতজন পাছে আমার ওপর অহমিকা দোষ আরোপন করেন তাই সভয়ে এ ক’টি কথা কইতে হল)।

রস কী সে আলোচনা অল্প লোকেই করে থাকেন। আলঙ্কারিকের অভাব প্রায় সর্বত্রই। কারণ রসের প্রধান কার্যকারণ আলোচনা করতে হলে অন্তত দুটি জিনিসের প্রয়োজন। একদিক দিয়ে রসবোধ, অন্যদিক দিয়ে রসকষহীন বিচার-বিবেচনা যুক্তি-তর্ক করার ক্ষমতা। তাই এর ভিতর একটি দ্বন্দ্ব লুকনো রয়েছে। যারা রসগ্রহণে তৎপর তারা তর্কের কিচিরমিচির পছন্দ করে না, আর যারা সর্বক্ষণ তর্ক করতে ভালোবাসে তারা যে ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে’ হয়ে রসিকজনের ভীতির সঞ্চার করে সে তো জানা কথা।

সৌভাগ্যক্রমে এদেশে কিন্তু কখনও আলঙ্কারিকের অনটন হয়নি। ভরত থেকে আরম্ভ করে, দণ্ডিন মন্মট ভামহ হেমচন্দ্র অভিনবগুপ্ত ইত্যাদি ইত্যাদি অন্তহীন নির্ঘন্ট বিশ্বজনের প্রচুর ঈর্ষার সৃষ্টি করেছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মুখে শুনেছি, তাঁকে যখন রাসূল প্রশ্ন শোধান, রস কী, হোয়াট ইজ আর্ট, তখন তিনি এঁদের স্মরণে রাসূলকে প্রচুর নতুন তত্ত্ব শোনান। অন্য লোকের মুখে শুনেছি, রাসল রীতিমতো হকচকিয়ে যান।

বিদেশি আলঙ্কারিকদের ভিতর জর্মন কবি হাইনরিষ হাইনের নাম কেউ বড় একটা করে না। কারণ তিনি অমিত্র অলঙ্কার নিয়ে আলোচনা করেননি। জর্মন কবিদের নিয়ে আলোচনা করার সময় মাঝে মাঝে রস কী তাই নিয়ে তিনি চিন্তা করেছেন, এবং রস কী তার সংজ্ঞা না দিয়ে তুলনার মারফত, গল্পচ্ছলে সবকিছু অতি মনোরম ভাষায় প্রকাশ করেছেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ যেরকম কোনওকিছু বলতে গেলে সংজ্ঞা নিয়ে মাথা ফাটাফাটি না করে গল্প বলে জিনিসটা সরল করে দিতেন– অনেকটা সেইরকম!

বাগদাদের শাহ্ ইন-শাহ্ দিনদুনিয়ার মালিক খলিফা হারুন-অর-রশিদের হারেমের সর্বশ্রেষ্ঠা, সুন্দরী, খলিফার জিগরের টুকরো, চোখের রোশনী রাজকুমারীটি ছিলেন ‘স্বপনচারিণী,’ অর্থাৎ ঘুমের ঘোরে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতেন।

গভীর নিশীথে একদা তিনি নিদ্রার আবেশে মৃদু পদসঞ্চারণে চলে গিয়েছেন প্রাসাদ-উদ্যানে। সখীরা গেছেন পিছনে পিছনে। রাজকুমারী ন্দ্রিার ঘোরে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সম্পূর্ণ মোহাবস্থায় ফুল আর লতা-পাতা কুড়োতে আরম্ভ করলেন আর মোহাবস্থায়ই সেগুলো অপূর্ব সমাবেশে সাজিয়ে বানালেন একটি তোড়া। আর সে সামঞ্জস্যে প্রকাশিত হয়ে গেল একটি নবীন বাণী, নতুন ভাষা। মোহাবস্থায়ই রাজকুমারী তোড়াটি পালঙ্কের সিথানে রেখে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লেন।

ঘুম ভাঙতে রাজকুমারী দেখেন একটি তোড়া যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। সখীরা বললেন, এটি তাঁরই হাতে তৈরি। কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস হয় না। এমনকি ফুলপাতার সামঞ্জস্যে যে ভাষা যে বাণী প্রকাশ পেয়েছে সেটিও তিনি সম্পূর্ণ বুঝতে পারছেন না– আবছা আবছা ঠেকছে।

কিন্তু অপূর্ব সেই পুস্পস্তবক। এটি তা হলে কাকে দেওয়া যায়? যাঁকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। খলিফা হারুন-অর-রশিদ। খোজাকে ডেকে বললেন, ‘বত্স, এটি তুমি আর্যপুত্রকে (খলিফাকে) দিয়ে এস।’

খোজা তোড়াটি হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, “ও হো হো, কী অপূর্ব কুসুমগুচ্ছ! কী সুন্দর গন্ধ, কী সুন্দর রঙ! হয় না, হয় না, এরকম সঞ্চয়ন সমাবেশ আর কোনও হাতে হতে পারে না।’

কিন্তু সে সামঞ্জস্যে যে বাণী প্রকাশিত হয়েছিল সে সেটি বুঝতে পারল না। সখীরাও বুঝতে পারেননি।

খলিফা কিন্তু দেখামাত্রই বাণীটি বুঝে গেলেন। তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে গেল। দেহ শিহরিত হল। সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হল। অভূতপূর্ব পুলকে দীর্ঘ দাড়ি বেয়ে দরদরধারে আনন্দাশ্রু বইতে লাগল।

এতখানি গল্প বলার পর কবি হাইনরিষ হাইনে বলেছেন, ‘হায় আমি বাগদাদের খলিফা নই, আমি মহাপুরুষ মুহম্মদের বংশধর নই, আমার হাতে রাজা সলমনের আঙটি নেই, যেটি আঙুলে থাকলে সর্বভাষা, এমনকি পশুপক্ষীর কথাও বোঝা যায়, আমার লম্বা দাড়িও নেই, কিন্তু পেরেছি, পেরেছি, আমিও সে ভাষা সে বাণী বুঝতে পেরেছি।’

এস্থলে গল্পটির দীর্ঘ টীকার প্রয়োজন। কিন্তু পূর্বেই নিবেদন করেছি সে শক্তি আমার নেই। তাই টাপেটোপে ঠারেঠোরে কই।

রাজকুমারী = কবি; ফুলের তোড়া = কবিতা; ফুলের রঙ পাতার বাহার = তুলনা অনুপ্রাস, খোঁজা = প্রকাশক-সম্পাদক-ফিলিম-ডিস্ট্রিব্যুটর (তাঁরা সুগন্ধ সুবর্ণের রসাস্বাদ করতে পারেন, কিন্তু ‘বাণীটি’ বোঝেন না); এবং খলিফা = সহৃদয় পাঠক!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *