পুলিস-বুদ্ধি (অর্থাৎ সামান্য পুলিশ কর্মচারীর বুদ্ধিবলে সেসন জজের রায় পরিবর্তনের আশ্চর্য রহস্য!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
এদেশীয় পুলিস-কৰ্ম্মচারীদিগের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি যেরূপ কৌশল অবলম্বন করিয়া অন্যায়রূপে অর্থ উপার্জ্জন করিয়া থাকেন, তাহার একটি দৃষ্টান্ত আজ পাঠকগণকে দেখাইতে বাসনা করিলাম। পাঠকগণ মনে রাখিবেন, যে দৃষ্টান্ত দেখাইতে আজ আমি প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহা আমার নিজের ঘটনা নহে, বা এই ঘটনার সহিত আমার কোনরূপ সংস্রব নাই। উহা মফঃস্বল পুলিসের জনৈক দারোগার কার্য্য। সেই দারোগা আমার নিকট পরিচিত, এবং এখন পর্যন্ত দারোগাগিরিতে নিযুক্ত; সুতরাং তাঁহার নাম এই স্থানে প্রকাশ করিলাম না। কিন্তু তাঁহার সম্বন্ধে এইমাত্র বলিতে পারি যে, পুলিস বিভাগে এই প্রকৃতির অনেক কর্ম্মচারী আছেন বলিয়া বর্তমান পুলিসের এত দুর্নাম। যে, ঘটনা নিম্নে বিবৃত হইল, তাহা আমার স্বকপোল-কল্পিত ঘটনা নহে। বরং ইহা এত অল্প দিবসের ঘটনা যে নিয়মিতরূপ সংবাদপত্র পাঠকারী এই প্রবন্ধ পাঠ করিয়া কহিবেন যে, এই ঘটনার সময় বোধ হয়, এখনও তিন বৎসর অতীত হয় নাই।
প্রাতঃকালে দারোগাবাবু তাঁহার থানায় বসিয়া আছেন, এমন সময় একজন গ্রাম্য চৌকিদার আসিয়া থানায় উপস্থিত হইল, এবং দারোগাবাবুর নিকট গমন করিয়া কহিল, “ধর্ম্মাবতার! যে গ্রামে আমি চৌকি দিয়া থাকি, সেই গ্রামে জমীদারে জমীদারে একটি ভয়ানক দাঙ্গা হইয়া গিয়াছে, এবং একটি খুনও হইয়াছে। দাঙ্গার সময় সাহস করিয়া আমরা সেইস্থানে উপস্থিত হইতে পারিয়াছিলাম বলিয়া, দাঙ্গার দলস্থ লোকেরা সেই হতব্যক্তির লাসটি লইয়া যাইতে পারে নাই; ঘটনার স্থলে উহা ফেলিয়া গিয়াছে। কিন্তু উহার মস্তকটি কাটিয়া লইয়া গিয়াছে। আজ একজন চৌকিদারকে সেই লাসের নিকট রাখিয়া আমি থানায় সংবাদ দিতে আসিয়াছি।”
চৌকিদারের কথা শ্রবণ করিয়া দারোগাবাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন্ কোন্ জমীদারে এই দাঙ্গা হইয়াছে? তাহাদিগের নাম এবং বাসস্থান কোথায়? আর উক্ত দাঙ্গার কারণই বা কি, বলিতে পার?”
উত্তরে চৌকিদার কহিল, “একখণ্ড জমীর দখল লইয়া জমীদারদ্বয়ের মধ্যে এই দাঙ্গা উপস্থিত হয়। সেই জমীদারদিগের মধ্যে একজনের নাম পুলিনবাবু। তাঁহার বাসস্থান আমাদিগের গ্রামে। অপর আর একজন জমীদারের নাম যামিনীবাবু। তাঁহার বাসস্থান একটু দূরে, আমাদিগের গ্রাম হইতে প্রায় তিন চারি ক্রোশের ব্যবধান হইবে।”
চৌকিদারের এই কথা শুনিয়া দারোগাবাবু মনে মনে ভাবিলেন, ‘অনেক দিবস হইতে এমন কোন মোকদ্দমা আইসে নাই যে, যাহাতে কিছু অর্থের সংস্থান করিয়া লইতে পারি। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আজ যে মোকদ্দমার সংবাদ পাইলাম, তাহাতে আমার পূর্ব্বক্ষতির পূরণ হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এরূপ সময়ে আমার ঊর্দ্ধতন—কর্মচারীর সহিত আমার মিল নাই, ইহাই একাত্ত দুঃখের বিষয়। যাহা হউক, কালবিলম্ব না করিয়া অগ্রে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া তাগ্রে নিজ বন্দোবস্তের সংগ্রহ করিয়া লই। তাহার পর যাহা হয়, দেখা যাইবে।’
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া দারোগাবাবু ‘প্রথমে এতলা’ বহিতে সেই চৌকিদারের প্রদত্ত সংবাদ বিস্তারিতরূপে স্বহস্তে লিখিয়া লইলেন। কোন তারিখে, কোন সময়ে, কোন স্থানে, কোন কোন জমীদারের মধ্যে এই দাঙ্গা হইয়াছে, এবং কিরূপ অবস্থায় লাস পড়িয়া আছে, তাহার বিবরণ চৌকিদারের বর্ণনানুসারে লিখিয়া লইয়া লোকজন সমভিব্যাহারে দ্রুতপদে ঘটনাস্থলে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই পথিমধ্যে পুলিনবাবুর জনৈক কৰ্ম্মচারীর সহিত দারোগাবাবুর প্রথমে সাক্ষাৎ হইল। কৰ্ম্মচারী দারোগাবাবুকে সঙ্গে লইয়া আপনার মনিবের বাড়ীতে গমন করিলেন। সেইস্থানে পুলিনবাবুর সহিত দারোগাবাবুর সাক্ষাৎ হইল, এবং দারোগাবাবু আপনার মনোভিলাষ পূর্ণ করিয়া যত শীঘ্র পারেন, সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলেন।
দারোগাবাবু অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে পুলিনবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন, একথা ক্রমে যামিনীবাবুর কর্ণগোচর হইল। যামিনীবাবু ভাবিলেন, ‘এরূপ অবস্থায় দারোগাবাবুর হস্তে অনুসন্ধানের ভার থাকিলে, তাঁহারই সবিশেষ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা।’ এই ভাবিয়া, তিনিও গোপনে দারোগাবাবুর নিকট গমন করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। সুচতুর দারোগা উভয় পক্ষ হইতেই তাঁহার অভিরুচি মত অর্থ সংগ্রহ করিয়া মূল মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। এদিকে উভয় জমীদারের নিকটই প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, তাঁহাদিগের পক্ষীয় কোন লোককে এই খুনি মোকদ্দমার আসামী করিলেও কাহাকেও দণ্ডিত হইতে দিবেন না।
এইরূপে উভয় জমীদারের নিকট হইতে বন্দোবস্ত করিয়া দারোগাবাবু ঘটনাস্থলে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেইস্থানে গমন করিয়া তিনি যাহা অবলোকন করিলেন, তাহাতে তাঁহার মস্তক ঘুরিয়া গেল।
দেখিলেন,—গ্রামের বাহিরে ময়দানের ভিতর একস্থানে উভয় পক্ষীয় ভয়ানক দাঙ্গার চিহ্ন সকল এখন পর্যন্ত বর্তমান রহিয়াছে। সেইস্থানের উদ্ভিদ এবং শস্য সকল একেবারে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। কোনস্থানে ভগ্নাবশিষ্ট লাঠি সকল পড়িয়া রহিয়াছে। কোনস্থানে চাকচিক্যময় সড়কির ফলার উপর সূর্যকিরণ পতিত হওয়ায়, দূরস্থিত পথিকের নয়ন সেইদিকে আকর্ষণ করিতেছে। কোনস্থানে নররুধির রঞ্জিত তরবারির অর্দ্ধাংশ পতিত হইয়া দর্শকবৃন্দের মনে ভয়ের সঞ্চার করিয়া দিতেছে। স্থানে স্থানে বা অর্দ্ধ দগ্ধ মশাল পড়িয়া রহিয়াছে। এই সকল দেখিতে দেখিতে দারোগাবাবু সেই সুবিস্তৃত ময়দানের ভিতর প্রবেশ করিলেন। কিয়দ্দূর গমন করিয়া দেখিতে পাইলেন, জনৈক চৌকিদার একটি মৃতদেহের সন্নিকটে দণ্ডায়মান রহিয়াছে।
দারোগাবাবু উক্ত মৃতদেহের নিকট গমন করিয়া তাহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সকল উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন যে, শরীরের স্থানে স্থানে ভীষণ অস্ত্রের চিহ্ন সকল বর্তমান রহিয়াছে। দেহ মস্তকহীন এবং পরিধানে বস্ত্রাদি কিছুই নাই, উলঙ্গ অবস্থায় সেইস্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। সেই প্রকাণ্ড ময়দানের ভিতর, এবং তাহার নিকটবর্ত্তী স্থানে, লোকজনের সাহায্যে দারোগাবাবু সেই মৃতব্যক্তির পরিহিত বস্ত্রের এবং মস্তকের অনেক সন্ধান করিলেন; কিন্তু কোনস্থানেই তাহার কিছুই প্রাপ্ত হইলেন না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পাঠকগণ! পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন, দারোগাবাবুর সহিত তাঁহার ঊর্দ্ধতন-কর্ম্মচারী ইনস্পেক্টারবাবুর সহিত মনোমালিন্য আছে। তথাপি সরকারী কার্য্যের নিয়মানুসারে যখন তিনি এই অনুসন্ধানে আগমন করেন, সেই সময়ে ইনস্পেক্টারবাবুকেও সংবাদ দিয়া আসিতে হয়।
সেই ময়দানের ভিতর যে সময় দারোগাবাবু মৃতব্যক্তির মস্তক এবং বস্ত্রের অনুসন্ধান করিতেছিলেন, সেই সময় ইনস্পেক্টারবাবু আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন। বলা বাহুল্য, তিনি সেইস্থানে আসিবামাত্রই জানিতে পারিয়াছিলেন যে, দারোগাবাবু প্রথমেই দাঙ্গাকারী উভয় পক্ষীয় জমীদারদ্বয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় এই দারোগাবাবুর হস্তে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার ন্যস্ত থাকিলে, কোনরূপেই সুবিচারের সম্ভাবনা নাই। ইহা ভাবিয়া অনুসন্ধানের কার্য্য তিনি আপন হস্তে লইলেন, এবং দারোগবাবুকে সেইস্থান হইতে বিদায় করিয়া দিলেন।
ইনস্পেক্টারবাবু দারোগাবাবুর চরিত্রের লোক ছিলেন না, একথা প্রায় সকলেই জানিতেন। সুতরাং কোন পক্ষীয় কোন জমীদার তাঁহার সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিতে সাহসী হইলেন না। ইনস্পেক্টারবাবু নিজে যেরূপ বুঝিলেন, অনুসন্ধানও সেইরূপেই করিতে লাগিলেন। তাঁহার অনুসন্ধানের প্রধান কার্য্য হইল—যাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই ব্যক্তি কে, তাহার বাসস্থান কোথায়, এবং কোন পক্ষীয় জমীদার কর্তৃক সে হত হইয়াছে, তাহার প্রকৃত তত্ত্ব বাহির করা।
আমাদিগের দেশে একটি প্রবাদ আছে যে, দেবচরিত্র ও নারীচরিত্র বুঝিতে পারা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। আমি বলি,—এ দেশীয় “জমীদার চরিত্রও” সেই প্রবাদ বাক্যের অন্তর্গত করিয়া দিলে, নিতান্ত অসঙ্গত হইত না। নিম্নের দৃষ্টান্তটি তাহার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।
ইনস্পেক্টারবাবু অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছেন, সেই সময় পুলিনবাবুর জনৈক কর্ম্মচারী একজন কনষ্টেবলকে চুপি চুপি বলিয়া দিল, “যে ব্যক্তি হত হইয়াছে, তাহার নাম ছমির। এইস্থান হইতে চারি পাঁচ ক্রোশ ব্যবধানে তাহার বাসস্থান।” কনষ্টেবল এই কথা ক্রমে ইনস্পেক্টারবাবুর কর্ণে উঠাইয়া দিল।
ইনস্পেক্টারবাবু যে সংবাদের নিমিত্ত নিতান্ত লোলুপ ছিলেন, এখন সেই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া যে কি পৰ্য্যন্ত আনন্দিত হইলেন, তাহা বলা যায়। কালবিলম্ব না করিয়া অশ্বারোহণে তিনি ছমিরের গ্রামে গমন করিলেন, অনুসন্ধান করিয়া ছমিরের বাড়ীও পাইলেন। বাড়ীতে গিয়া দেখিলেন, ছমিরের স্ত্রী ভিন্ন সেই বাড়ীতে অপর আর কেহ নাই। তিনি তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তুমিই কি ছমিরের পত্নী?”
স্ত্রীলোক। হাঁ মহাশয়! তিনিই আমার স্বামী।
ইনস্পেক্টার। তোমার স্বামী এখন কোথায়?
স্ত্রীলোক। তিনি বাবুদিগের বাড়ীতে কর্ম্ম করিতেন সেইস্থানে আছেন কি না, জানি না। কিন্তু অনেকে অনেক কথা বলিতেছে।
ইনস্পেক্টার। তিনি কোন বাবুর বাড়ীতে কৰ্ম্ম করিয়া থাকেন?
স্ত্রীলোক। আমাদিগের জমীদারের বাড়ীতে কর্ম্ম করিয়া থাকেন।
ইনস্পেক্টার। তোমাদিগের জমীদার কে?
স্ত্রীলোক। পুলিনবাবু।
ইনস্পেক্টার। তুমি কহিলে না যে, তোমার স্বামী সম্বন্ধে অনেকে অনেক কথা কহিতেছে?
স্ত্রীলোক। হাঁ মহাশয়! অনেক কথা শুনিতে পাইতেছি।
ইনস্পেক্টার। কি প্রকারের কথা শুনিতেছ?
স্ত্রীলোক। কেহ কেহ বলিতেছে, বাবুর কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে আমার স্বামী স্থানান্তরে গমন করিয়াছিল। সেই স্থানের জমীদার যামিনীবাবুর লোক তাহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে।
ইনস্পেক্টার। হাঁ, একটি লাস পাওয়া গিয়াছে সত্য; কিন্তু সেই লাস দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে যে, সেই মৃতদেহ তোমার স্বামীর কি না?
স্ত্রীলোক। আমার স্বামীর দেহ দেখিলে আর আমি চিনিতে পারিব না?
ইনস্পেক্টার। যে লাস পাওয়া গিয়াছে, তাহার দেহ আছে মাত্র; মস্তক পাওয়া যায় নাই। এরূপ অবস্থায় কেবলমাত্র দেহ দেখিয়া তুমি বলিতে পারিবে যে, উহা ছমিরের দেহ কি না?
স্ত্রীলোক। মস্তক না থাকিলেও আপনার স্বামীর দেহ স্ত্রীলোকমাত্রই চিনিতে পারে। তাহার শরীরের কোন অংশ দেখিলেই আমি চিনিতে পারিব, সেই দেহ আমার স্বামীর কি না।
এই স্ত্রীলোকের কথা শুনিয়া ইনস্পেক্টারবাবু তাহাকে সঙ্গে লইয়া যে স্থানে সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন এবং সেই মস্তকহীন দেহটি সেই স্ত্রীলোকটিকে দেখাইলেন। সেই দেহ দেখিবামাত্র স্ত্রীলোকটি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল এবং কহিল, “ইহা আমার স্বামীর দেহ।”
স্ত্রীলোকটির কথা শুনিয়া ইনস্পেক্টারবাবু মনে মনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। ভাবিলেন—যখন মৃতদেহ সনাক্ত হইল, তখন এই মোকদ্দমার উদ্ধার হইতে আর বিলম্ব হইবে না। বিশেষতঃ এইস্থানে উভয় জমীদার—পুলিনবাবু ও যামিনীবাবুর মধ্যে যে দাঙ্গা হইয়াছে, সে সম্বন্ধে প্রমাণের অভাব নাই। এদিকে ছমির পুলিনবাবুর লোক। সেই ছমির যখন হত হইয়াছে, তখন পুলিনবাবুর লোকজন কর্তৃক হত হইবে, তাহা অনুমিত হয় না। অধিকন্তু তাহার বিপক্ষ অর্থাৎ যামিনীবাবুর লোকের দ্বারাই হত হইবার সম্ভাবনা।
ইনস্পেক্টারবাবু স্থিরচিত্তে বসিয়া মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছেন, এবং কোন্ পক্ষীয় কোন্ কোন্ ব্যক্তিকে ধৃত করিতে হইবে, তাহার আন্দোলন করিতেছেন, এরূপ সময়ে একজন লোক জোড়হস্তে তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল।
এই অপরিচিত লোককে দেখিয়া ইনস্পেক্টারবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি? কি চাও?”
অপরিচিত ব্যক্তি। মহাশয়! আমার নাম সেখ সরিফ। এইস্থান হইতে আমার বাসস্থান চারি পাঁচ ক্রোশ হইবে। এরফান নামক আমর একটি ভাই ছিল। আমার ভাই হত হইয়াছে, বাড়ীতে বসিয়াই লোকমুখে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া আমি দেখিতে আসিয়াছিলাম। যে মৃতদেহ ঐ স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে, সেই মৃতদেহ আমি উত্তমরূপে দেখিয়াছি। উহা আমার ভাই এরফানের মৃতদেহ।
ইনস্পেক্টার। যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, উহার মস্তক পাওয়া যায় নাই। মস্তকহীন মৃতদেহ দেখিয়া তুমি কি প্রকারে স্থির করিলে যে, উহা তোমার ভ্রাতা এরফানের মৃতদেহ?
সরিফ। এরফান আমার সহোদর ভ্রাতা। বাল্যকাল হইতে প্রতিনিয়ত তাহাকে দেখিয়া আসিতেছি। তাহার দেহ দেখিলে আমি আর চিনিতে পারিব না? দেহ ত পরের কথা—তাহার ছায়া দেখিলে আমি বলিতে পারি, উহা আমার ভ্রাতার ছায়া কি না।
ইনস্পেক্টার। তুমি ঠিক চিনিতে পারিয়াছ যে, সেই মৃতদেহই তোমার ভ্রাতা এরফানের মৃতদেহ?
সরিফ। ঠিক্ চিনিতে না পারিলে কি আর আমি আপনার নিকট আসিতে সাহসী হইতাম।
ইনস্পেক্টার। এরফান তোমার কিরূপ ভাই?
সরিফ। ভাই আর কি প্রকার হইয়া থাকে? আমার সহোদর ভাই।
ইনস্পেক্টার। এরফানের স্ত্রী কোথায়? তাহাকে আনাইয়া তাহার স্বামীর লাস একবার তাহাকে দেখাইতে পার কি?
সরিফ। তাহার স্ত্রী থাকিলে অবশ্য তাহাকে আনিয়া দেখাইতে পারিতাম। অদ্যাবধি এরফান বিবাহ করে নাই।
ইনস্পেক্টার। এরফান কি কার্য্য করিত?
সরিফ। জমীদার সরকারে সে পাইক ছিল।
ইনস্পেক্টার। কোন্ জমীদারের নিকট সে পাইকের কার্য্য করিত?
সরিফ। যামিনীবাবুর সরকারে সে পাইক ছিল।
ইনস্পেক্টার। তুমি ব্যতীত তাহার আত্মীয় আর কে আছে?
সরিফ। আমি ব্যতীত আত্মীয় বলিবার তাহার আর কেহই নাই।
ইনস্পেক্টার। এই স্ত্রীলোকটি বলিতেছে, ঐ মৃতদেহ তাহার স্বামী ছমিরের মৃতদেহ। অথচ তুমি বলিতেছ যে, উহা তোমার সহোদর ভ্রাতা এরফানের মৃতদেহ। এরূপ অবস্থায় আমি কাহার কথা বিশ্বাস করিব, এবং কাহাকেই বা মিথ্যাবাদী স্থির করিয়া লইব?
সরিফ। ধর্মাবতার! আপনি বিচারক, আপনি হাকিম! ইহা অপেক্ষাও গোলযোগের আরও কত মোকদ্দমায় আপনি হস্তক্ষেপ করিয়াছেন। এখন এই সামান্য মোকদ্দমায় কোন্ ব্যক্তি প্রকৃতকথা বলিতেছে, তাহা আর আপনি জানিতে পারিবেন না? আপনি একটু ভালরূপ অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেই জানিতে পারিবেন যে, এই স্ত্রীলোকটি তাহার কোন গূঢ় অভিসন্ধি-সাধন করিবার নিমিত্ত এইরূপ মিথ্যা কথা কহিতেছে। যাহার মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে, সে উহার স্বামী ছমির কখনই হইতে পারে না, সে আমার ভ্রাতা এরফান।
স্ত্রীলোকটিও সেইস্থানে উপস্থিত ছিল। সরিফের কথা শুনিয়া সে কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, “ধর্ম্মাবতার! এ কখনই উহার ভ্রাতার নহে, এ আমার স্বামীর মৃতদেহ।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সেই স্ত্রীলোকের এবং সরিফের কথা শুনিয়া ইনস্পেক্টারবাবু বড়ই গোলে পড়িলেন। এ মৃতদেহ যে কাহার, তাহা স্থির করা বড়ই কঠিন হইয়া দাঁড়াইল। উভয় গ্রামের ভিতরই অনুসন্ধান করিলেন। একস্থানে জানিতে পারিলেন যে, ছমির নামক এক ব্যক্তি প্রকৃতই তাহার স্ত্রীর সহিত সেই গ্রামে বাস করিত; কিন্তু তিন চারি দিবস হইতে কেহই তাহাকে গ্রামের মধ্যে দেখে নাই। অপর গ্রামের সমস্ত ব্যক্তিই কহিল, সরিফ ও এরফান উভয়ে সহোদর ভ্রাতা। উভয়েরই বিবাহ হয় নাই, এবং গ্রামের কেহই এরফানকে দুই তিন দিবস পর্য্যন্ত দেখিতে পায় নাই।
এইরূপ গোলযোগে পড়িয়া ইনস্পেক্টারবাবু প্রথমে কোনমতেই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না যে, এই মৃতদেহ কাহার। প্রকৃত তত্ত্ব জানিবার নিমিত্ত লোকজন নিযুক্ত করিয়া নানারূপ চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন; কিন্তু কোন প্রকারেই উপরি-উক্ত জমীদারদ্বয়ের চক্রান্ত ভেদ করিতে পারিলেন না।
মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত নিয়মিতরূপে জেলায় প্রেরণ করিয়া, ইনস্পেক্টারবাবু আপাততঃ খুনি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে বিরত, এবং দাঙ্গা মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। সাক্ষী-সাবুদ যতদূর পারেন, সংগ্রহ করিয়া উভয় জমীদারের পক্ষ হইতেই কয়েকজন করিয়া লোককে ধৃত করিলেন, এবং পরিশেষে বিচারার্থ মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করিলেন। আপন আপন লোকদিগকে উদ্ধার করিবার নিমিত্ত জমীদারদ্বয়ও প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
এই ঘটনার তিনি চারি দিবস পরে ইনস্পেক্টারবাবু যখন দেখিলেন, জমীদারদ্বয় মোকদ্দমার উপায়ান্বেষণ করিবার নিমিত্ত ও উকীল মোক্তারদিগের পরামর্শ লইবার নিমিত্ত আপন আপন গ্রাম ছাড়িয়া সবডিবিজানে গমন করিয়াছেন, সেই সময় তিনি প্রকাশ করিলেন, “যে লাস পরীক্ষার্থ জেলায় পাঠান হইয়াছিল, তাহার পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে পরীক্ষায় জানা গিয়াছে যে, যে সময় সেই ব্যক্তির মস্তক কাটিয়া লওয়া হয়, তখন তাহার মৃত্যু নাই, মস্তক কাটিয়া লওয়ার পর তাহার মৃত্যু হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় অনুমান হয় যে, দাঙ্গার সময় আহত হইয়া সেই ব্যক্তি পতিত হয়, কিন্তু ইহার মৃত্যু হয় নাই। এইরূপ অবস্থায় সেই ব্যক্তি সেইস্থানে পড়িয়া থাকিলে, সেই ব্যক্তি যে পক্ষীয় লোক, সেই পক্ষীয়দিগের কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই, এই ভাবিয়া জীবিতাবস্থাতেই উহার মস্তক উহার পক্ষীয় লোক কাটিয়া লইয়া গিয়াছে। কারণ উহাদিগের বিশ্বাস যে, মস্তক না থাকিলেই উহা কাহার দেহ, তাহা স্থির করিতে পারা যাইবে না। মৃতদেহ সনাক্ত না হইলে সেই ব্যক্তি কোন্ পক্ষীয় লোক, তাহাও কেহ জানিতে পারিবে না। সুতরাং খুনি মোকদ্দমার প্রকৃত প্রস্তাবে অনুসন্ধান বা অপরাধীদিগের হত্যা-অপরাধে দণ্ড হইবার সম্ভাবনাও থাকিবে না।”
ইনস্পেক্টারবাবু আরও প্রকাশ করিলেন, “পুলিনবাবুর পক্ষীয় লোকজনের দ্বারা যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, এবং পুলিনবাবু যেরূপভাবে তাঁহার লোকজনদিগের বিষয় সমর্থন করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার বা তাঁহার কর্ম্মচারীবর্গের আর বলিবার ক্ষমতা নাই যে, যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা ছমিরের দেহ নহে, এবং যামিনীবাবুরও বলিবার ক্ষমতা নাই যে, উহা এরফানের দেহ নহে। আরও এক কথা—ইতিপূর্ব্বে বিষমভ্রমে পতিত হইয়া পুলিনবাবু প্রমাণ করিয়াছিলেন, যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, তাহা তাঁহার পক্ষীয় লোক ছমিরের দেহ। এইরূপ ভাবে প্রমাণ করিবার তাঁহার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, ছমির যদি তাঁহার পক্ষীয় লোক বলিয়া স্থির-সিদ্ধান্ত হইয়া যায়, তাহা হইলে তাঁহার পক্ষীয় কোন লোক ছমিরকে হত্যা করে নাই; সে বিপক্ষ পক্ষীয় অর্থাৎ যামিনীবাবুর পক্ষীয় লোক কর্তৃক হত হইয়াছে, এইরূপ ভাবে মোকদ্দমা দাঁড়াইবে। পুলিনবাবু যে ভ্রমে পতিত হইয়াছিলেন, যামিনীবাবুও ঠিক সেই ভ্রমে পতিত হইয়া, এরফান যে তাঁহার লোক, তাহা উত্তমরূপে প্রমাণ করিয়া দিয়াছিলেন। তিনিও ভাবিয়াছিলেন, তাঁহার পক্ষীয় লোকের হত্যার নিমিত্ত তাহার বিপক্ষ পক্ষীয় জমীদারবাবুই দায়।”
মৃতদেহ পরীক্ষা সম্বন্ধে ডাক্তারবাবু যেরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন বলিয়া, ইনস্পেক্টারবাবু সকলকে বুঝাইলেন, তাহাতে সকলেই বুঝিল,—যদি সেই মৃতদেহ প্রকৃতই ছমিরের দেহ হয়, তাহা হইলে জীবিত অবস্থায় উহার মস্তক কাটিয়া লওয়ার নিমিত্ত পুলিনবাবুই এক্ষণে দায়ী। দাঙ্গা মোকদ্দমায় যাহাতে কোন পক্ষীয় লোক বলিয়া কোন মৃতব্যক্তিকেও কেহ সনাক্ত করিতে না পারে, এই ভাবিয়া প্রত্যেকে পক্ষীয় লোকই যখন আপন পক্ষীয় মৃতদেহ লইয়া প্রস্থান করিতে না পারে, তখন সেই মৃত ব্যক্তির মস্তক কাটিয়া লইয়া প্রস্থান করে, এরূপ কথা প্রায়ই শ্রবণ করা যায়। বর্ত্তমান মোকদ্দমায় যে সেইরূপ হয় নাই, তাহার প্রমাণ কি? অধিকন্তু পুলিনবাবু যখন ছমিরের আপনার পক্ষীয় লোক বলিয়া স্বীকার করিয়া লইতেছেন, অথচ জানা যাইতেছে যে, জীবিত অবস্থাতেই ছমিরের মস্তক কাটিয়া লওয়া হইয়াছে, তখন নিশ্চয়ই এই হত্যার জন্য দায়ী হইবেন—পুলিনবাবু।
আবার পুলিনবাবু যেরূপে দায়ী, যামিনীবাবুও এদিকে ঠিক সেইরূপে এরফানের হত্যার নিমিত্ত দায়ী হইতেছেন। সেই মৃতদেহ যদি এরফানের হয়, তাহা হইলে জীবিত অবস্থাতেই এরফানের মস্তক কাটিয়া লওয়া হইয়াছে, এবং সেই কার্য্য যামিনীবাবুর লোকের দ্বারাই হইয়াছে। সুতরাং উহার হত্যার নিমিত্ত যামিনীবাবু দায়ী হইয়াছেন।
ইনস্পেক্টারবাবু আরও কহিলেন, কেবল পুলিনবাবু ও যামিনীবাবুই যে ছমির বা এরফানকে হত্যা করিবার নিমিত্ত অপরাধী, তাহা নহে। তাঁহাদিগের প্রধান প্রধান কৰ্ম্মচারীমাত্রকেই সম্যকরূপে দায়ী হইতে হইবে। কারণ, প্রধান প্রধান কর্ম্মচারীমাত্রই যে এই দাঙ্গার সময় উপস্থিত ছিলেন, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
ইনস্পেক্টারবাবু উক্ত জমীদারদ্বয় ও তাঁহাদিগের কর্ম্মচারী ব্যতীত ছমিরের স্ত্রীকে, এবং এরফানের ভ্রাতা সরিফকে হত্যার সহায়তা করা অপরাধে প্রথমেই আসামী করিবেন কহিলেন। আরও কহিলেন, “এখন দেখা যাউক, ইহাদের মধ্যে কে এত মিথ্যা কথা বলিয়া আমাকে প্রতারণা করিতে সমর্থ হয়।”
ইনস্পেক্টারবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া ছমিরের স্ত্রী, এবং সরিফ নিতান্ত ভীত হইয়া পড়িল। তাহারা আইনানুযায়ী ধৃত না ইহলেও বলা বাহুল্য যে, তাহার পুলিসের নজরের উপর রহিল।
ইনস্পেক্টারবাবু যে অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন, দেখিতে দেখিতে লোকমুখে ক্রমে তাহা প্রচার হইয়া পড়িল। ইনস্পেক্টারবাবুর মনে যে অভিসন্ধি ছিল, তাহা পূর্ণ হইয়া গেল। উভয় জমীদারের প্রধান প্রধান কর্ম্মচারীমাত্রই ভীত হইয়া আর প্রকাশ্যরূপে বাহির হইলেন না। এদিকে ইনস্পেক্টারবাবু সেই সকল কর্ম্মচারীগণকে ডাকিয়া আনিবার নিমিত্ত ক্রমে লোক পাঠাইতে লাগিলেন। প্রেরিত লোকমাত্রই প্রত্যাগমন করিয়া বলিতে লাগিল, “যাহার নিমিত্ত আমি গমন করিয়াছিলাম, অনেক অনুসন্ধান করিয়া তাহার কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না। ভাবগতিতে বোধ হইল, সে পলায়ন করিয়াছে।”
ছমিরের স্ত্রী এবং সরিফ একাদিক্রমে দুই তিন দিবস পুলিসের সবিশেষ নজর-বন্দীতে থাকায় এবং উভয় পক্ষীয় জমীদারদিগের নিকট হইতে বা তাহাদিগের কর্মচারীগণের নিকট হইতে কোনরূপ সাহায্য না পাওয়াতে, ক্রমে তাহার অত্যাধিক ভীত হইয়া পড়িল, এবং তাহাদিগকে ছাড়িয়া দিবার নিমিত্ত ইনস্পেক্টারবাবুর নিকট বিনীতভাবে মিনতি করিতে লাগিল। ইনস্পেক্টারবাবু তাহাদিগের কথায় কর্ণপাতও করিলেন না। অধিকন্তু কহিলেন, যে পর্য্যন্ত তোমরা প্রকৃতকথা না বলিবে, সেই পর্য্যন্ত আর কিছুতেই তোমাদিগের নিষ্কৃতি নাই, এখন তোমরা আমার নিকট রহিয়াছ, ইহাতে তোমাদিগের সবিশেষ কোনরূপ কষ্ট হইতেছে না। এইরূপভাবে আরও দুই এক দিবস তোমাদিগকে এইস্থানে রাখিব। ইহার মধ্যেও যদি প্রকৃত কথা না বল, তাহা হইলে তোমাদিগকে জেলের হাজতে পাঠাইয়া দিব। সেইস্থানে গমন করিলেই তোমরা প্রকৃতকথা আর গোপন করিয়া রাখিতে পারিবে না।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ইনস্পেক্টারবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া উহারা আরও ভীত হইয়া পড়িল, এবং পরিশেষে একদিবস উভয়েই ইনস্পেক্টারবাবুকে কহিল, “মহাশয়! আমরা উত্তমরূপে চিনিতে না পারিয়া, সেই মৃতদেহ সনাক্ত করিয়াছিলাম। এখন বুঝিতে পারিতেছি, আমাদিগের কার্য্য ভাল হয় নাই, আমরা নিতান্ত অন্যায় কার্য্য করিয়াছি।”
উহাদিগের কথার উত্তরে ইনস্পেক্টারবাবু কহিলেন, “মৃতদেহ সনাক্ত করিয়া তোমরা কিছুই অন্যায় কার্য্য কর নাই, বরং ভালই করিয়াছ, তবে তোমাদের উভয়ের মধ্যে একজন মিথ্যা বলিতেছ, কি উভয়েই মিথ্যা বলিতেছ, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, এখনও তোমরা প্রকৃত কথা না বলিলে এক হত্যায় দুই হত্যার কাজ করিয়া লইব,—অর্থাৎ ছমিরকে হত্যা করার সহায়তায় তাহার স্ত্রীকে ফাঁসী যাইতে হইবে। আবার এরফানকে হত্যা করার সহায়তা করিবার নিমিত্ত সরিফকে চরমদণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় তোমরা এখনও বিবেচনা করিয়া দেখ যে, প্রকৃতকথা বলিয়া তোমরা আপন আপন জীবনরক্ষা করিতে প্রস্তুত আছ কি না।”
ইনস্পেক্টারবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া উহারা পুনরায় কহিল, “মহাশয়! আমরা এখন প্রকৃতকথা বলিতেছি। আমরা ভালরূপে চিনিতে না পারিয়া, সেই মৃতদেহ সনাক্ত করিয়াছিলাম।”
ইনস্পেক্টার। এখনও তোমরা মিথ্যা কথা কহিতেছ। কি কারণ তোমরা সেই মৃতদেহ সনাক্ত করিয়াছিলে, তাহার প্রকৃত অবস্থা না বলিলে, আমি কখনই তোমাদিগকে ছাড়িয়া দিব না। আমি তোমাদিগকে এক এক করিয়া গুটি কতক কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহার উত্তর শুনিলে আমি বুঝিতে পারিব যে, তোমরা মিথ্যা কথা কহিতেছ, কি সত্য কথা বলিতেছ। সরিফ! তুমি এখন প্রকৃতরূপে আমাকে বল দেখি, তুমি যে মৃতদেহ দেখিয়াছিলে, তাহা তোমার ভ্রাতা এরপানে মৃতদেহ কি না।
সরিফ। না মহাশয়! উহা আমার ভ্রাতার মৃতদেহ নহে, সেই সময় আমি ঠিক চিনিয়া উঠিতে পারি নাই।
ইনস্পেক্টার। তোমার একথা আমি কি প্রকারে বিশ্বাস করিতে পারি?
সরিফ। আমি এখন যাহা কহিতেছি, তাহা প্রকৃত কথা। এখন আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করিতে পারেন।
ইনস্পেক্টার। যদি তুমি চিনিতে না পারিয়া থাক, এবং সেই মৃতদেহ যদি এরফানের মৃতদেহ না হয়, তাহা হইলে তোমার ভাই সেই এরফান কোথায়?
সরিফ। তিনি যে এখন কোথায় আছেন, তাহা আমি জানি না।
ইনস্পেক্টার। একথা বলিলে চলিবে না। যে পর্য্যন্ত আমি তোমার ভাই এরফানকে দেখিতে না পাইব, সেই পৰ্য্যন্ত কিছুতেই আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করিতে পারিব না। কারণ, ইহা নিশ্চিত কথা যে, যে ব্যক্তি একবার মিথ্যা কথা বলিতে পারে, সে অনায়াসে সহস্র মিথ্যা কথাও কহিতে পারে।
সরিফ। আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন আর না করুন, জানিবেন যে, এখন আমি প্রকৃতকথা কহিতেছি। কিন্তু আমি আমার ভ্রাতাকে কোনরূপেই আপনার নিকট আনিতে সমর্থ হইব না।
ইনস্পেক্টার। তুমি তাহাকে আনিতে না পার; কিন্তু সে কোথায় আছে, তাহা যদি আমাদিগেকে বলিয়া দেও, তাহা হইলে আমরা তাহাকে আনিতে পারিব।
ইনস্পেক্টারবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া সরিফ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, এবং পরিশেষে কহিল, “প্রকৃতকথা কি বলিব মহাশয়! আমার কাপল পুড়িয়া গিয়াছে। এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি যে, আমার দুষ্কর্ম্মের ফল আমাকে গ্রহণ করিতে হইবে। মিথ্যা বলিলেও আপনার হস্ত হইতে আমার পরিত্রাণের উপায় নাই! সত্য কথা বলিলেও আমার নিষ্কৃতি নাই।”
ইনস্পেক্টার। আমি প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিতেছি, যদি তুমি এখনও সত্য কথা বল, এবং সত্য কথা বলিতেছ বলিয়া আমার প্রতীতি জন্মাইতে পার, তাহা হইলে আমা কর্তৃক তোমার কোনরূপেই অনিষ্ট হইবে না। আর আমি বর্ত্তমান থাকিতে অপর কেহই তোমার কোন অনিষ্ট সাধন করিতে পারিবে না।
সরিফ। আপনি প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিতেছেন যে, কোন প্রকারে আপনি আমার অনিষ্ট করিবেন না, এবং অপর কোন ব্যক্তি আমার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিলে, আপনি আমাকে রক্ষা করিবেন?
ইনস্পেক্টার। একথা আমি পূৰ্ব্বেই তোমাকে বলিয়াছি, এবং এখন কহিতেছি। তুমি প্রকৃতকথা বল; তোমার কোনরূপে অনিষ্ট হইবে না।
সরিফ। প্রকৃতকথা কহিলে জমীদারদ্বয়ের মধ্যে কেহ আমার অনিষ্ট করিতে পারেন, এরূপ অবস্থায় আপনি আমার উপর লক্ষ্য রাখিবেন?
ইনস্পেক্টার। তুমি প্রকৃতকথা বল, তোমার কোন ভয় নাই। আমি বর্ত্তমান থাকিতে কোন জমীদার তোমার উপর কোনরূপ অত্যাচার করিতে সমর্থ হইবেন না।
সরিফ। আমার অদৃষ্ট যাহাই হউক, আমি আর মিথ্যা কথা কহিব না। আমি পূর্ব্বে আপনাকে বলিয়াছি যে, এরফান আমার সহোদর ভ্রাতা এবং জমীদার যামিনীবাবুর সরকারে তিনি কর্ম্ম করেন; ইহা মিথ্যা কথা নহে। যে রাত্রিতে এই দাঙ্গা হইয়া যায়, তাহার পরদিবস একজন লোক পাঠাইয়া যামিনীবাবু আমাকে তাঁহার বাড়ীতে ডাকাইয়া লইয়া যান। ইহার পূর্ব্বে অনেকবার আমি জমীদার মহাশয়ের বাড়ীতে গমন করিয়াছি, কিন্তু সেই দিবস আমাকে যে স্থানে লইয়া যান, সেইস্থান আমি পূর্ব্বে কখনও দেখি নাই। উহা যামিনীবাবুর বাহির বাড়ী নহে, বা অন্দর বাড়ীও নহে, উহা সদর ও অন্দরমহল বাড়ীর মধ্যস্থিত একটি স্থান। সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, আমার ভ্রাতা এরফান সেইস্থানে বসিযা আছে। জমীদারবাবুর একজন প্রধান কৰ্ম্মচারী সেইস্থানে বসিয়া এরফানের সহিত কথা কহিতেছেন। আমি সেইস্থানে গমন করিবামাত্র সেই কৰ্ম্মচারী মহাশয় আমাকে সেইস্থানে বসিতে কহিলেন। আমি সেইস্থানে উপবেশন করিলে কর্ম্মচারী মহাশয় আমার উপস্থিতি সংবাদ যামিনীবাবুর নিকট প্রেরণ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে যামিনীবাবুও আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন। যামিনীবাবু সেই সময় আমাকে কহিলেন, তোমরা দুই ভাই আমার বহুদিবসের অনুগত প্রজা; সুতরাং বিপদ আপদের সময় তোমাদিগের ভরসা আমি সবিশেষরূপে করিয়া থাকি। সম্প্রতি তুমি শুনিয়া থাকিবে যে, পুলিনবাবুর লোকের সহিত আমার পক্ষীয় লোকের একটি ভয়নাক দাঙ্গা হইয়া গিয়াছে, এবং সেই দাঙ্গার সময় একটি খুনও হইয়া পড়িয়াছে। আমি শুনিলাম, ছমিরের স্ত্রী ইনস্পেক্টারবাবুর নিকট প্রকাশ করিয়াছে যে, সেই মৃতব্যক্তিই তাহার স্বামী ছমির। এতদঞ্চলস্থ সকলেই অবগত আছে যে, ছমির পুলিনবাবুর নিকট কর্ম্ম করে। এরূপ অবস্থায় যখন সে হত হইয়াছে, তখন সকলেই স্থির-সিদ্ধান্ত করিয়া বসিবেন, পুলিনবাবুর লোক ছমিরকে, পুলিনবাবুর পক্ষীয় কোন ব্যক্তি হত্যা করে নাই; সে নিশ্চয়ই যামিনীবাবুর লোকের দ্বারা হত হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় হত্যার সমস্ত দোষ আমাদিগের উপর পড়িবে; সুতরাং আমরা সবিশেষরূপে বিপদ্গ্রস্থ হইব। যাহাতে আমাদিগের উপর এই বিপদ না পড়িতে পারে, আমি তাহার এক উপায় স্থির করিয়াছি। তোমরা দুই ভাই সেই বিষয় আমাকে সাহায্য করিলে, আমাদিগের ভয়ের আর কোন কারণ থাকিবে না।
“বাবুর কথা শ্রবণ করিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, যখন আমরা দুই ভাই আপনার অন্নে প্রতিপালিত, তখন এই সামান্য উপকার আর আমাদিগের দ্বারা ইহবে না? কি করিলে আপনাকে কোনরূপ বিপদে পতিত হইতে না হয়, তাহা আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলুন, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি।”
“আমার কথার উত্তরে যামিনীবাবু কহিলেন, ‘তোমার ভ্রাতা এরফান আমার নিকট কৰ্ম্ম করে, ইহা সকলেই অবগত আছে। আমি এরফানকে আমার বাড়ীর ভিতর এরূপ গুপ্তভাবে রাখিয়া দিব যে, বাহিরের কোন লোক তাহাকে দেখিতে পাইবে না। আবশ্যক হইলে কেবল তুমি গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিবে। এদিকে এরফান আমার বাড়ীর ভিতর লুক্কায়িত ভাবে অবস্থিতি করুক, ওদিকে তুমি গিয়া সেই মৃতদেহ সনাক্ত করিয়া ইনস্পেক্টারবাবুর নিকট এজাহার দেও যে, যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা তোমার ভ্রাতা এরফানের মৃতদেহ। এইরূপ করিলে অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিবেন না যে, সেই মৃতদেহ কোন ব্যক্তির। কারণ, মস্তক না থাকায় সেই মৃতদেহ অপর কোন ব্যক্তি কর্তৃক সনাক্ত হইবার সম্ভাবনা নাই। লাস সনাক্ত সম্বন্ধে এইরূপ গোলযোগ বাঁধিলে, উভয় পক্ষীয় লোকের মধ্যে কোন ব্যক্তিই হত্যা-অপরাধে ধৃত হইবে না। পরিশেষে গোলযোগ মিটিয়া গেলে, তোমার ভাইকে এই গুপ্তস্থান হইতে বাহির করা যাইবে।
“জমীদারবাবুর কথা নিতান্ত অসঙ্গত হইলেও আমি দেখিলাম, ইহাতে আমার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই। সুতরাং আমি এরফানের অনুমতিক্রমে জমীদারবাবুর প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। এরফান সেই স্থানেই রহিল। আমি সেইস্থান. হইতে বহির্গত হইয়া যে স্থানে সেই মৃতদেহ পড়িয়াছিল, সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং স্বচক্ষে মৃতদেহটি উত্তমরূপে দর্শন করিলাম। পরিশেষে আপনার নিকট উপস্থিত হইয়া যাহা যাহা কহিয়াছিলাম, তাহা আপনি সেই সময়েই লিখিয়া লইয়াছিলেন। মহাশয়! এই ত প্ৰকৃত অবস্থা। এখন আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন বা নাই করুন।”
ইনস্পেক্টার। তোমার কথায় আমি এখন সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিতেছি। তুমি যে এখন প্রকৃত কথা বলিয়াছ, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু তোমার ভাই এরফান কোথায় আছে, তাহা বলিতে পার কি?
সরিফ। প্রথম দিবস যে গৃহের মধ্যে আমি এরফানকে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলাম, তাহার পর যে দিবস আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম, সেই দিবসও সেই গৃহের ভিতর তাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। আজ তিন দিবস হইতে আপনি আমাকে কোনস্থানে গমন করিতে দেন নাই; সুতরাং এই তিন দিবসের সংবাদ আমি বলিতে পারি না। তবে আমার বোধ হয়, তাহাকে সেইস্থান হইতে স্থানান্তরিত করা হয় নাই কারণ, যামিনীবাবু আজ কয়েক দিবস হইতে বাড়ীতে নাই।
সরিফের কথা শুনিয়া ইনস্পেক্টারবাবু আর কালবিলম্ব করিতে পারিলেন না। সরিফকে সঙ্গে লইয়া তৎক্ষণাৎ যামিনীবাবুর বাড়িতে গমন করিলেন, এবং যে স্থানে সরিফ তাহার ভ্রাতাকে দেখিয়া আসিয়াছিল, সেই গৃহের ভিতরই এরফানকে প্রাপ্ত হইলেন।
এরফানকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় তিনি তাঁহার অনুসন্ধানের স্থানে গমন করিলেন, এবং ছমিরের স্ত্রীকে ডাকাইয়া কহিলেন, “সরিফ প্রকৃতকথা বলিয়া আমার হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিয়াছে। এখন তুমি প্রকৃতকথা বলিতে চাই, কি মিথ্যা কথা বলিতে চাহ?”
স্ত্রীলোক। আমি প্রকৃতকথা কহিব।
ইনস্পেক্টার। প্রকৃতকথা কি বল দেখি।
স্ত্রীলোক। মৃতদেহ আমি ভালরূপ চিনিতে না পারিয়া ভ্রমক্রমে আমার স্বামীর দেহ বলিয়াছিলাম। এখন বুঝিতে পারিতেছি, সেই মৃতদেহ আমার স্বামীর নহে।
ইনস্পেক্টার। ইহাই কি তোমার প্রকৃত কথা।
স্ত্রীলোক। হাঁ মহাশয়।
ইনস্পেক্টার। ইহাই যদি তোমার প্রকৃত কথা হয়, তাহা হইলে সরিফ যেমন সত্যকথা প্রকাশ করিয়া তাহার ভ্রাতা এরফানকে দেখাইয়া দিয়াছে, তুমিও সেইরূপ তোমার স্বামী ছমিরকে দেখাইয়া দেও, তাহা হইলে আমি তোমাকে নিষ্কৃতি প্রদান করিব।
ইনস্পেক্টারবাবুর এই কথা শ্রবণ করিয়া ছমিরের স্ত্রী আর কোন উত্তর করিতে পারিল না। ক্রমে তাহার চক্ষু দিয়া জলধারা বহির্গত হইল, এবং পরিশেষে সে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল।
ইহার এই অবস্থা দেখিয়া ইনস্পেক্টারবাবু বুঝিতে পারিলেন যে, পূর্ব্বে সে প্রকৃত কথাই বলিয়াছিল, তাহার স্বামী ছমির প্রকৃতই হত হইয়াছে। কিন্তু সরিফ তাহার কথার পরিবর্তন করিয়া যেমন নিষ্কৃতিলাভ করিল, এও সেইরূপে পুলিসের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিতে চাহে, এবং এই নিমিত্ত সরিফের মত সেও তাহার কথার পরিবর্তন করিতেছে। যাহা হউক, ইনস্পেক্টারবাবু সেই স্ত্রীলোকটিকে সান্ত্বনা করিয়া পুনরায় কহিলেন, “তোমার কোনরূপ ভয় নাই। সরিফ তাহার পূর্ব্ব কথার পরিবর্ত্তন করিল বলিয়াই যে তোমাকেও তাহাই করিতে হইবে, তাহার কোন অর্থ নাই। প্রকৃতকথা যাহা, তাহাই তুমি বল, তোমার কোন ভয় নাই। এখনই আমি তোমাকে ছাড়িয়া দিতেছি।”
ইনস্পেক্টারবাবুর এই কথা শ্রবণ করিয়া ছমিরের স্ত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, “আপনি আমাকে ছাড়িয়া দিন আর নাই দিন, আমি পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছিলাম, তাহাই প্রকৃত। সেই মৃতদেহ আমার স্বামীর দেহ ভিন্ন অপর কাহারও নহে। যখন আমার স্বামীই হত হইয়াছে, তখন কিসের নিমিত্ত আর মিথ্যা কথা কহিব? তবে এতক্ষণ যে মিথ্যা কথা কহিতেছিলাম, সে কেবল সরিফের পরামর্শ অনুযায়ী। আমি আর মিথ্যা কথা কহিব না, পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছিলাম, তাহাই বলিব। ইহাতে আমার অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা হইবে।”
ছমিরের স্ত্রীর এই কথা শুনিয়া ইনস্পেক্টারবাবু তাহাকে বিদায় দিলেন। কিন্তু বলিয়া দিলেন, “যখনই আমার প্রয়োজন হইবে, ডাকিবামাত্র তখনই আমার নিকট আগমন করিবে।” ইনস্পেক্টারবাবুর কথায় ছমিরের স্ত্রী সম্মত হইয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিল।
বোধ হয়, পাঠকগণকে বলিয়া দিতে হইবে না যে, যে উপায় অবলম্বনে ইনস্পেক্টারবাবু লাসের প্রকৃত তত্ত্ব অবগত হইতে পারিলেন, তাহা ডাক্তারের পরীক্ষার ফল নহে, উহা ইনস্পেক্টারবাবুর স্বকপোল-কল্পিত ঘটনামাত্র। ডাক্তারবাবুর লাস পরীক্ষার রিপোর্টের কোনস্থানে এমন কোন কথা দৃষ্টিগোচর হয় না যে, তিনি বলিয়াছেন,—যে সময়ে সেই দেহের মস্তক ছেদিত হইয়াছিল, সেই সময় সে আহত ছিল মাত্র; কিন্তু মৃত্যুমুখে পতিত হয় নাই, বা মস্তক ছেদন করাই তাহার মৃত্যুর কারণ।
লাসের সনাক্ত লইয়া ইনস্পেক্টারবাবু যেরূপ গোলযোগে পতিত হইয়াছিলেন, অতঃপর সেই গোলযোগ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া খুন সম্বলিত দাঙ্গা মোকদ্দমার অনুসন্ধান যতদূর সম্ভব, ক্রমে তাহাই করিতে লাগিলেন। ঘটনাস্থলে বসিয়া ক্রমে ক্রমে তিনি যেমন প্রমাণ সংগ্রহ করিতে লাগিলেন, অমনি উভয় জমীদার পক্ষীয় লোকজনকে ধৃত করিয়া মাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করিতে লাগিলেন।
যে সকল আসামী প্রেরিত হইল, বিনাক্লেশে তাহাদিগের বিপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ সংগৃহীত হইয়া গেল। কারণ পুলিনবাবুর লোকজনের বিপক্ষে যামিনীবাবুর লোক সকল সাক্ষ্য প্রদান করিল, এবং যামিনীবাবুর কর্মচারীগণের বিপক্ষে পুলিনবাবুও তাঁহার সাধ্যমত প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া দিলেন। জমীদারদ্বয়ের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হইলে বিচক্ষণ পুলিস-কর্মচারীগণকে প্রায় কোন কার্য্যই করিতে হয় না। পরস্পরের লোকের সাহায্যে পরস্পরের লোকদিগকে অনায়াসে জেলে পাঠাইতে সমর্থ হইয়া থাকেন। সুতরাং ইনস্পেক্টারবাবু এক স্থানেই বসিয়া উভয় জমীদারের সাহায্যে উভয় জমীদারেরই সর্ব্বনাশ সাধন পূর্ব্বক অনায়াসেই আপন কার্য্য উদ্ধার করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
খুন সংযুক্ত দাঙ্গা করা অপরাধে দশজন লোক আসামী হইল। তাহার মধ্যে পাঁচজন লোক যামিনীবাবুর পক্ষীয় এবং অবশিষ্ট পাঁচজন লোক পুলিনবাবুর পক্ষীয়। দশজনেই একরূপ অভিযোগে অভিযুক্ত হইল। ডেপুটিবাবুর এজলাসে অনেকগুলি সাক্ষীর দ্বারা প্রমাণিত হইল, যে গ্রাম লইয়া বিবাদ, সেই গ্রামের বাহিরে ময়দানের ভিতর অনেক লোকের সমাগম হয়। বিবাদস্থল গ্রাম পূর্ব্বে যাঁহার ছিল, তাঁহার নিকট হইতে যামিনীবাবু এক সময় সেই গ্রাম পত্তনি লইয়াছিলেন, এবং সেই সময় হইতে সেই গ্রাম দখল করিয়া আসিতেছেন। সম্প্রতি খাজনা না দেওয়ার নিমিত্ত সেই গ্রাম বিক্রীত হইয়া যায়, এবং পুলিনবাবু উহা ক্রয় করিয়া লন। নিলামে খরিদ করার পর হইতে পুলিনবাবু কয়েকবার সেই গ্রাম দখল করিতে যান; কিন্তু একবারও কৃতকার্য হইতে পারেন নাই, কয়েকবারই যামিনীবাবুর নিকট পরাভূত হইয়া আসিয়াছিলেন। সম্প্রতি সেই গ্রাম দখল করিবার নিমিত্ত তিনি রীতিমত লোকজন সংগ্রহ করেন। যামিনীবাবুও পুলিনবাবুর অভিসন্ধির বিষয় অবগত হইতে পারিয়া, পূর্ব্ব হইতেই লোকজনের সংগ্রহ করিয়া রাখেন। ইহার পরই একদিবস উভয় পক্ষীয় লোক সকল গ্রামের বাহিরে ময়দানের ভিতর সমবেত হয়, এবং পরিশেষে রাত্রি এক প্রহর হইতে না হইতেই উভয় পক্ষে ভয়ানক দাঙ্গা উপস্থিত হয়; লাঠি, সড়কি, ঢাল, তরবারি প্রভৃতির ত কথাই নাই। সাক্ষীর মুখে আরও প্রকাশ—এই ভয়ানক দাঙ্গায় আগ্নেয় অস্ত্র পর্য্যন্ত ব্যবহৃত হইয়াছিল। কত লোক যে এই দাঙ্গায় আহত হইয়াছে, তাহার স্থিরতা নাই। কিন্তু পুলিস অনুসন্ধান করিয়া আহত লোকদিগের মধ্যে কাহাকেও প্রাপ্ত হন নাই। যে দশজন লোক বিচারার্থে প্রেরিত হইয়াছে, তাহাদিগের মধ্যে কাহারই শরীরে আঘাতের চিহ্ন নাই। এই ভয়ানক দাঙ্গা প্রায় একঘণ্টা কাল হইয়াছিল, ইহার মধ্যে কোন পক্ষীয় লোকই পরাভূত হয় নাই। কিন্তু পরিশেষে যামিনীবাবুর পক্ষ হইতে একটি গুলি গিয়া ছমিরের বক্ষঃস্থলে বিদ্ধ হয়, দেখিতে দেখিতে ছমির সেইস্থানে পতিত হয়, ও ইহজীবন পরিত্যাগ করে। ছমিরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই দাঙ্গাও শেষ হয়। পুলিনবাবুর লোকজন আর গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে নাই, তাহারা সেইস্থান হইতে পশ্চাদগামী হয়। গান করিবার সময় পুলিনবাবুর লোকজন ছমিরের মৃতদেহ লইয়া যাইবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিয়াছিল; কিন্তু কোনরূপে কৃতকার্য না হইয়া তাহার মস্তকটি কাটিয় লইয়া প্রস্থান করে। ছমিরের মস্তক যে কোথায় লুক্কায়িত হইয়াছে, পুলিস অনুসন্ধান করিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে পারেন নাই।
ডেঙ্গুটীবাবার নিকট এই সকল কথা সাক্ষীর দ্বারা প্রমাণিত হইলে, তিনি দশজন আসামীকেই বিচারার্থ দায়রায় প্রেরণ করিলেন!
এই মোকদ্দমা দায়রায় অর্পিত হইলে, জমীদারদিগের উভয়েরই চেতনা হইল। তখন তাঁহারা মনে মনে ভাবিলেন যে, ‘যে দারোগাবাবু অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত স্বর্ব্বপ্রথম আগমন করিয়াছিলেন, তিনি নিজের অভিসন্ধি পূর্ণ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু যাহা বলিয়া আমাদিগকে বুঝাইয়াছিলেন, কই তাঁহার ত কিছুই করিলেন না। ইহাতে স্পষ্টই অনুমান হয় যে, হয় শঠতা করিয়া তিনি আমাদিগের নিকট হইতে অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন, না হয় ইনস্পেক্টারবাবু তাঁহাকে মোকদ্দমার অনুসন্ধান হইতে বিরত করিয়াছেন বলিয়া, তিনি তাঁহার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিতে সমর্থ হন নাই।’ এই ভাবিয়া জমিদারদ্বয়ই মনের কষ্ট মনেই গোপন করিলেন, সে কথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ করিলেন না। ভাবিলেন, বুদ্ধির দোষে এত অর্থ নিরর্থক জলে নিক্ষিপ্ত হইল।
দায়রায় মোকদ্দমা উঠিবার কেবলমাত্র দুই তিন দিবস বাকি আছে, সেই সময় যামিনীবাবু কথায় কথায় দারোগাবাবুর কথা তাঁহার উকীলের নিকট প্রকাশ করিলেন। উকীলবাবু দারোগাবাবুর আচরণের কথা শুনিয়া মনে মনে অসন্তুষ্ট হইলেন সত্য, কিন্তু যামিনীবাবুকে কহিলেন, “একবার গোপনে সেই দারোগাবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলে বোধ হয়, সবিশেষ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই। অধিকন্তু কোনরূপ উপকার হইলেও হইতে পারে।”
উকীলবাবুর পরামর্শ মত যামিনীবাবু এক রাত্রিতে গিয়া দারোগাবাবুর সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিলেন। যামিনীবাবুকে দেখিবামাত্র দারোগাবাবু কহিলেন, “কি মহাশয়! এতদিবস পরে কি মনে করিয়া আপনার আগমন হইয়াছে?”
যামিনী। আপনার সহিত অনেক দিবস হইতে সাক্ষাৎ হয় নাই, সেই নিমিত্ত আজ একবার সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি।
দারোগা। তাহা নহে। আমি আপনাদিগের মোকদ্দমার অনুসন্ধান করি নাই বলিয়া আপনার প্রদত্ত টাকাগুলি ফেরত লইতে আগমন করিয়াছেন।
যামিনী। আপনি অনুসন্ধান করুন আর না করুন, যাহা আপনাকে প্রদান করিয়াছি, তাহা পুনরায় পাইবার প্রত্যাশা করি না।
দারোগা। আপনি প্রত্যাশা করুন আর না করেন, এই মোকদ্দমায় আপনাদিগের লোকজনের যদি দণ্ড হইয়া যায়, তাহা হইলে নিশ্চয় জানিবেন যে, আপনাদিগের প্রদত্ত অর্থ আমি কোনরূপেই গ্রহণ করিব না।
যামিনী। সে পরের কথা। আপনি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান না করিয়া ঘটনাস্থল হইতে চলিয়া আসিলেন কেন?
দারোগা। আপনারা বোধ হয় অবগত আছে যে, ইনস্পেক্টারবাবুর সহিত আমার মনোমালিন্য আছে। কিন্তু কি করি, তিনি আমার ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারী; সুতরাং তাঁহার আদেশ আমাকে প্রতিপালন করিতে হয়। এই ঘটনার সংবাদ পাইয়া তিনি ঘটনাস্থলে আসিয়া উপস্থিত হন, এবং স্বহস্তে অনুসন্ধানের ভার গ্রহণ করেন। সুতরাং আমাকে এই অনুসন্ধান কাৰ্য্য হইতে চলিয়া আসিতে হয়। আমি স্বয়ং অনুসন্ধান করি নাই বলিয়া যে আপনাদিগের কোন কাৰ্য্য করি নাই, তাহা নহে। আমার হস্তে অনুসন্ধানের ভার থাকিলে আমি আপনাদিগের নিমিত্ত যাহা করিতাম, স্বয়ং অনুসন্ধান না করিয়াও তাহাই করিয়াছি। আপনি নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া থাকুন, এ মোকদ্দমা হইতে আপনার সমস্ত লোকজন মুক্তিলাভ করিবে।
যামিনী। কিরূপে মুক্তিলাভ করিবে, তাহার কোন উপায় বলিয়া দিন।
দারোগা। উপায় নূতন করিয়া আমাকে আর কিছুই বলিতে হইবে না; সমস্ত উপায় কাগজ পত্রের ভিতরই আছে, আপনিই প্রকাশ হইয়া পড়িবে। তবে একটি কথা আপনাকে বলিয়া রাখি, আপনি আপনার উকীলকে কহিবেন, ‘প্রথম এতলার’ কাগজ নথির সামিল হইয়াছে, কি না? যদি না হইয়া থাকে, তাহ হইলে যাহাতে সেই কাগজ নথির সামিল হয়, তাহার যেন চেষ্টা করা হয়।
যামিনী। আপনি যখন এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান নিজে করেন নাই, তখন কি প্রকারে জানিলেন যে, আসামীগণের মুক্তিলাভের সমস্ত উপায়ই কাগজ পত্রের ভিতর আছে। আপনি কাগজপত্র দেখিয়াছেন কি?
দারোগা। অনুসন্ধানের কাগজপত্র না দেখিলেও আপনাকে যাহা কহিলাম, তাহা করিবেন। দেখিবেন, আমার কথা কতদূর প্রকৃত। এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান আমা কর্তৃক সমাপ্ত হয় নাই সত্য। কিন্তু সৰ্ব্বপ্রথমে যখন আমি উহা আপন হস্তে গ্রহণ করিয়াছিলাম, তখনই আমি আপনাদিগের বিষয় চিন্তা করিয়া লইয়াছিলাম। সুতরাং সেই সময় হইতে তাহার উপায়ও স্থির করিয়া রাখিয়াছি।
দারোগাবাবুর নিকট এই সকল কথা অবগত হইয়া যামিনীবাবু তাঁহার সেই উকীলের নিকট পুনরায় গমন করিলেন, এবং তাঁহার সহিত দারোগাবাবুর যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহার আদ্যোপান্ত বর্ণন করিলেন।
যামিনীবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া উকীলবাবু কহিলেন, “আমি এই মোকদ্দমার কাগজপত্র সকল ভালরূপে দেখিয়াছি। তিনি যে প্রথম এতলা নথির সামিল করিতে কহিয়াছেন, নিম্ন আদালত হইতে তাহা নথির সামিল হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু ‘প্রথমে এতলার’ ভিতর এমন কোন কথা আমি দেখিতে পাই নাই যে, যাহাতে তাহার দ্বারা আমার কোন প্রকার উপকারের প্রত্যাশা করিতে পারি। আপনার নিকট হইতে যখন তিনি উপকৃত হইয়াছেন, তখন যাহাতে আপনি নিরাশ না হয়েন, তাহারই নিমিত্ত যাহা তাঁহার মনে উদয় হইয়াছে, তাহাই বলিয়া আপনাকে বুঝাইয়া দিয়াছেন। যে ব্যক্তি নিজে কোনরূপ অনসুন্ধান করিতে পান নাই, তিনি ইচ্ছা করিলেও কোন পক্ষের কোনরূপ উপকার করিতে সমর্থ হইবেন না।”
উকীলবাবুর কথাতে যামিনীবাবু বুঝিলেন যে, দারোগাবাবু তাঁহার সহিত প্রতারণা করিয়াছেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
দায়রায় এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল। পুলিনবাবুর পক্ষীয় যে কয়েকজন লোক আসামী ছিল, তাহাদিগের বিপক্ষে যামিনীবাবুর অনুগত কয়েকজন লোক সাক্ষ্য প্রদান করিল। তাহাদিগের দ্বারা প্রমাণিত হইল—পুলিনবাবুর পক্ষীয় কয়েকজন আসামীই সেই দাঙ্গায় উপস্থিত ছিল, ও তাহারা যামিনীবাবুর পক্ষীয় লোকদিগকে আক্রমণ করিয়াছিল।
যামিনীবাবুর লোকজনের মধ্যে যে কয়েকজন আসামী হইয়াছিল, তাহাদিগের বিপক্ষেও সাক্ষ্য প্রদান করিল,—পুলিনবাবুর কয়েকজন প্রজা। তাহারা প্রমাণ করিল যে, যামিনীবাবুর লোকেরাই পুলিনবাবুর লোককে নিতান্ত অন্যায়রূপে আক্রমণ করিয়াছে, এবং ছমির নামক একজন লোককে হত্যা করিয়াছে।
ছমিরের স্ত্রীর কথা শুনিয়া সকলে বুঝিতে পারিলেন যে, যে স্থানে দাঙ্গা হইয়াছিল, সেইস্থানে প্রাপ্ত লাসকে ছমিরের স্ত্রী দর্শন করিয়াছিল, এবং উহা তাহার স্বামীর মৃতদেহ বলিয়া চিনিতেও পারিয়াছিল।
এইরূপে নানা সাক্ষী দ্বারা নানা বিষয় প্রমাণিত হইলে জজসাহেব সরকারী উকীলকে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয় জিজ্ঞসা করিলেন। জজসাহেব যাহা জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহা পূর্ব্বে সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছিল; তথাপি সরকারী উকীল জজসাহেবকে সেই সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করিলেন।
জজসাহেব। যখন দেখা যাইতেছে যে, জমীদার পুলিনবাবু ও যামিনীবাবুর মধ্যে এই ভয়ানক দাঙ্গা ও হত্যা হইয়া গিয়াছে, তখন উভয় জমীদারকে এই দাঙ্গা মোকদ্দমায় আসামী করা হয় নাই কেন?
সরকারী উকীল। পুলিসের রিপোর্টে প্রকাশ যে, যে সময় এই দাঙ্গা উপস্থিত হয়, সেই সময় উভয়েই সেই দাঙ্গা হইবার স্থানে অনুপস্থিত ছিলেন। সেই সময়ে তাঁহারা যে যে স্থানে ছিলেন, সেই সেই স্থানের মান্য গণ্য লোকদিগের দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে যে, জমীদারদিগের কথা প্রকৃত। পরন্তু তাঁহাদিগের বিপক্ষে কোনরূপ প্রমাণ সংগৃহীত হয় নাই বলিয়া, তাঁহাদিগকে এই মোকদ্দমায় আসামী করা হয় নাই। কিন্তু আমাদিগের ইচ্ছা আছে, বর্তমান মোকদ্দমার বিচার শেষ হইয়া গেলে, উভয় জমীদারকে মুচলেকায় আবদ্ধ করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করা যাইবে।
জজসাহেব। অধিকাংশ সাক্ষীর মুখে প্রকাশ যে, এই দাঙ্গায় সড়কি, লাঠি, তরবারী এবং বন্দুক পৰ্য্যন্ত ব্যবহৃত হইয়াছিল। ইহা যদি প্রকৃত হয়, তাহ হইলে নিশ্চয়ই অনেক লোক আহত হইয়াছে; কিন্তু আসামীগণের মধ্যে কোন ব্যক্তিরই কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইতেছে না, ইহারই বা কারণ কি?
সরকারী উকীল। জমীদারে জমীদারে দাঙ্গা হইলে, আহত লোকদিগকে প্রাপ্ত হওয়া নিতান্ত সামান্য ব্যাপার নহে। কারণ, জমীদারগণ ভালরূপে অবগত আছেন যে, যদি আহত লোকদিগকে পুলিস অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারে, তাহা হইলে মোকদ্দমা উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়া যায়। সুতরাং যাহাতে আহত লোকদিগকে পুলিস কোন প্রকারেই প্রাপ্ত না হইতে পারে, তাহার নিমিত্ত জমীদারগণ বিশেষরূপে যত্ন করিয়া থাকেন। এই নিমিত্তই আহত লোকদিগকে পুলিস ধৃত করিতে পারে নাই।
জজসাহেব। সাক্ষীদিগের দ্বারা যদিও উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়াছে যে, আসামীগণের মধ্যে সকলেই সেই দাঙ্গায় উপস্থিত ছিল। তথাপি আপনার নিকট হইতে আমি জানিতে ইচ্ছা করি যে, রাত্রিকালের দাঙ্গায় সাক্ষীগণের ভুল হইবার সম্ভাবনা আছে কি না, ভুল করিয়া একের পরিবর্তে অপরকে সনাক্ত করিতে পারে কি না?
সরকারী উকীল। জগতের সকলেই যে অভ্রান্ত, তাহা আমি বলিতে পারি না। কারণ, যাহার ভুল না হয়, এমন মনুষ্যই নাই। কিন্তু বৰ্ত্তমান মোকদ্দমায় সাক্ষীগণের ভুল হইবার সম্ভাবনা নিতান্ত অল্প! কারণ, যে ময়দানের ভিতর এই দাঙ্গা হইয়াছে, সেই ময়দান অতি পরিষ্কার, এবং তাহার মধ্যে দৃষ্টিগোচর হইতে পারে, এমন একটি বৃক্ষ পৰ্য্যন্তও নাই। এই দাঙ্গা রাত্রি এক প্রহরের মধ্যেই শেষ হইয়া যায়, একথা সাক্ষীমাত্রেরই মুখে প্রকাশ। যে রাত্রিতে এই দাঙ্গা হয়, সেই রাত্রিতে প্রায় দেড় প্রহর পর্যন্ত পরিষ্কার জ্যোৎস্নার আলোকে সৰ্ব্বস্থান আলোকিত ছিল; সুতরাং সেই সুবিস্তৃত পরিষ্কার ময়দানের ভিতর পূর্ব্ব পরিচিত লোকদিগকে দেখিতে প্রায় কাহারই ভুল হইবার সম্ভাবনা নাই।
জজসাহেব। আপনার বিবেচনায় সাক্ষীগণ আসামীগণকে পরিষ্কার জ্যোৎস্নালোকে দেখিয়াছে; সুতরাং সনাক্ত সম্বন্ধে তাহাদিগের কোনরূপ ভুল হইবার সম্ভাবনা নাই।
সরকারী উকীল। আমার এই প্রকারই বিবেচনা হয়।
জজসাহেব। এই আসামীগণের মধ্যে ছমির কাহাদ্বারা হত হইয়াছে?
সরকারী উকীল। সে সম্বন্ধে কোনরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।
সরকারী উকীলকে এই কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার পর জজসাহেব উভয় পক্ষীয় উকীলদিগের বক্তৃতা শ্রবণ করিয়া, পরিশেষে জুরিদিগকে কহিলেন, “এই মোকদ্দমায় অভিমত প্রকাশ করিবার পূর্বে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয় আপনাদিগের একটু চিন্তা করিয়া দেখা নিতান্ত আবশ্যক।—
১ম। দাঙ্গা হইয়াছিল কি না।
২য়। যদি দাঙ্গা হইয়া থাকে, তাহা হইলে কিসের নিমিত্তই বা দাঙ্গা হয়।
৩য়। যামিনীবাবু ও পুলিনবাবুর মধ্যে যে গ্রাম লইয়া বিবাদ, সেই গ্রাম উপলক্ষে যদি এই দাঙ্গা হইয়া থাকে, তাহ হইলে এই দাঙ্গায় কোন্ কোন্ জমীদারের স্বার্থ আছে।
৪র্থ। এই দাঙ্গায় যদি যামিনীবাবু ও পুলিনবাবুর স্বার্থ থাকে, তাহা হইলে তাঁহাদিগের বশীভূত, আশ্রিত, এবং বেতনভুক্ত লোকদিগের দ্বারা এই দাঙ্গা ও হত্যার সম্ভাবনা কি না।
৫ম। এই মোকদ্দমায় যে সকল লোক অভিযুক্ত হইয়াছে, তাহারা পূর্ব্বকথিত জমীদারদ্বয়ের লোক কি না। ৬ষ্ঠ। যে সময় এই দাঙ্গা হইয়াছে, সেই সময় প্রকৃত জ্যোৎস্না ছিল কি না। আর থাকিলেই সেই জ্যোৎস্নার আলোকে সাক্ষীগণের আসামীদিগকে উত্তমরূপে চিনিবার সম্ভাবনা কি না।”
জুরিগণ এই মোকদ্দমার অবস্থা আদ্যোপান্ত উত্তমরূপে অবগত হইয়াছিলেন, এবং সাক্ষীগণের এজাহারও উত্তমরূপে শ্রবণ করিয়াছিলেন। তথাপি জজসাহেবের উপদেশ মত পূৰ্ব্ববর্ণিত প্রশ্ন ছয়টি সম্বন্ধে উত্তমরূপে বিবেচনা করিয়া সকলেই একবাক্যে কহিলেন, “ছমিরকে হত্যাকরা অপরাধে আসামীগণের বিপক্ষে কোনরূপ প্রমাণ নাই; সুতরাং হত্যা-অপরাধে ইহারা সকলেই নির্দোষ। কিন্তু দাঙ্গায় মিলিত হওয়া ও দাঙ্গা করা অপরাধে সকলেই দোষী।”
জজসাহেবও জুরিগণের মতের পোষকতা করিলেন এবং প্রত্যেক আসামীকেই দশ দশ বৎসরের নিমিত্ত কারাগারে প্রেরণ করিলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ইতিপূর্ব্বে যামিনীবাবুর সহিত দারোগাবাবুর যে কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহা যামিনীবাবুর উকীল ব্যতীত আর কেহ অবগত ছিলেন না। যামিনীবাবু ও উকীলের বিবেচনায় পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, দারোগাবাবু অনর্থক কতকগুলি অর্থ হস্তগত করিয়াছেন; একথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ করা উচিত নহে। এই ভাবিয়া যামিনীবাবু আপনার বুদ্ধির নিন্দা করিয়া পরিশেষে চুপ করিয়াই রহিলেন।
এই ঘটনার কিছুদিবস পরে হঠাৎ একদিবস পুলিনবাবুর সহিত সেই দারোগাবাবুর সাক্ষাৎ হইল। অন্যান্য কথার পর একটু ব্যঙ্গ করিয়া তিনি দারোগাবাবুকে কহিলেন, “কই মহাশয়! আসামীদিগের একজনকেও ত খালাস করিতে পারিলেন না?”
দারোগা। আজ যে আপনার সে কথা মনে পড়িয়াছে, ইহাই মঙ্গল। মোকদ্দমার পূর্ব্বে যদি এই কথা আপনার মনে পড়িত, তাহ হইলে আসামীগুলিকে জেলে গমন করিতে হইতে না।
পুলিন। উহাদিগকে বাঁচাইবার তবে কি উপায় ছিল?
দারোগা। উপায় ভালই ছিল। কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় যে, সে দিকে কাহারও নয়ন আকৃষ্ট হইল না।
পুলিন। কি উপায় ছিল?
দারোগা। তাহা আর এখন বলিয়া লাভ কি? যদি আপীল করিবার ইচ্ছা থাকে, তাহা হইলে আমার নিকট আসিবেন, তখন আমি তাহার উপায় বলিয়া দিব।
পুলিন। আপীল করিতে সকলেই নিষেধ করিতেছে ও কহিতেছে যে, আপীলে কিছু হইবে না।
দারোগা। আমি বলিতেছি, আপীলে আপনারা নিশ্চয় ফল পাইবেন। আপনারা আপীল করুন, কিন্তু কোন বিচক্ষণ লোকের হস্তে যেন আপীলের ভার অর্পিত হয়।
পুলিন। আপনার বিবেচনায় আপীল করাই কৰ্ত্তব্য?
দারোগা। খুব আবশ্যক। পূর্বে যদি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতেন, তাহা হইলে আপনাদিগকে আপীল আদালত পর্য্যন্ত গমন করিতে হইত না। যদি আপীল করা আপনাদিগের স্থির-সিদ্ধান্তই হয়, তাহা হইলে পুনরায় আর একবার আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। সেই সময় আমার এ মোকদ্দমা সম্বন্ধে যাহা যাহা বক্তব্য আছে, তাহ আপনাদিগকে বলিয়া দিব।
দারোগাবাবুর কথায় সম্মত হইয়া পুলিনবাবু সেই দিবস সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং সমস্ত কাগজ পত্রের নকল সহ আপীলের বন্দোবস্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়া কলিকাতায় গমন করিলেন। কলিকাতার একজন সুপ্রসিদ্ধ দেশীয় কৌন্সলীর সহিত এ সম্বন্ধে পরামর্শ করিয়া কাগজপত্র তাঁহাকে দেখিতে দিলেন। সেই সময় পুলিনবাবু অবকাশ মতে দেশে গমন করিয়া দারোগাবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন এবং কহিলেন “আপনার উপদেশ মত আপীলের সমস্ত বন্দোবস্ত শেষ হইয়া গিয়াছে। এখন আপনি কি উপদেশে প্রদান করেন, তাহাই অবগত হইবার নিমিত্ত আপনার নিকট আগমন করিয়াছি।”
উত্তরে দারোগাবাবু কহিলেন, “যদি উপযুক্ত লোকের হস্তে আপনি এই মোকদ্দমা অর্পণ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার কোন উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন নাই। তাঁহাকে কেবল এইমাত্র কহিবেন যে, কাগজপত্রগুলি যেন তিনি উত্তমরূপে পাঠ করেন।” এই কথা শ্রবণ করিয়া পুলিনবাবু একটু অসন্তুষ্ট হইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং মনে মনে কহিলেন, দারোগা বাবু নূতন কথা আর কি কহিলেন? কাগজপত্র উত্তমরূপে না দেখিয়া কোন উকীল কৌন্সলী মোকদ্দমা করিতে কি প্রবৃত্ত হন?’
পুলিনবাৰু দ্বিতীয়বার কলিকাতায় আগমন করিয়া যখন তাঁহার কৌন্সলীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, তখন তাঁহার কৌন্সলী তাঁহাকে কহিলেন, “এই মোকদ্দমার কাগজপত্র আমি দেখিয়াছি। কিন্তু আমার বোধ হয় না যে, আপীলে আমাদিগের সবিশেষ উপকার হইবে।”
কৌন্সলীর কথা শ্রবণ করিয়া পুলিনবাবু কহিলেন, আমারও ইচ্ছা ছিল যে, আমি এই মোকদ্দমার আপীল করিতে আর কোনরূপ চেষ্টা করিব না। কিন্তু যে দারোগা সর্ব্বপ্রথমে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে গমন করিয়াছিলেন, কেবল তাঁহারই অনুরোধে আমি এই আপীল করিতে প্রবৃত্ত হই। তিনি আমাকে কেবলমাত্র হই। বলিয়া দেন যে, ভাল লোকের হস্তে এই মোকদ্দমার কাগজপত্র অর্পণ করিবেন, আর তাঁহাকে বলিয়া দিবেন যে, তিনি যেন ভালরূপে কাগজপত্রগুলি একবার পাঠ করিয়া দেখেন। তাহা হইলেই তিনি বেশ বুঝিতে পারিবেন যে, আপীলে আসামীগণ অব্যাহতি পাইবেন, কি না।”
যে কৌন্সলীর হস্তে পুলিনবাবু এই মোকদ্দমার কাগজ পত্র অর্পণ করিয়াছিলেন, তিনি অতিশয় বিচক্ষণ লোক। পুলিনবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া তিনি কহিলেন, “দারোগাবাবু যখন এরূপ বলিয়াছেন, তখন কাগজপত্রের ভিতর নিশ্চয়ই কিছু না কিছু উপায় আছে, যাহা সহজে আমাদিগের চক্ষে পতিত হইতেছে না। সুতরাং আপনি সেই দারোগাবাবুর সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে কেবলমাত্র এই কথাটি জিজ্ঞাসা করুন যে, নথির ভিতরস্থিত কোন কাগজখানি সবিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করা আবশ্যক।
কৌন্সলীর কথা শ্রবণ করিয়া অনিচ্ছা হইলেও পুলিনবাবু পুনরায় দারোগাবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন এবং কৌন্সলীর আদেশানুযায়ী তাঁহাকে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে দারোগাবাবু কহিলেন, “নথির সমস্ত কাগজ পত্রই উত্তমরূপে পাঠ করা আবশ্যক। তাহার মধ্যে এইরূপ মোকদ্দমায় প্রথম এতলার দিকে বিশেষরূপে দৃষ্টি রাখা বুদ্ধিমান উকীল কৌন্সলীর প্রধান কাৰ্য্য।”
দারোগাবাবু যেরূপ কহিলেন, পুলিনবাবুও সেইরূপ ঠিক্ তাঁহার কৌন্সলীকে কহিলেন। পুলিনবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া তিনি বুঝিলেন যে, প্রথম এতলাখানি ভাল করিয়া দেখা উচিত। এই বলিয়া নথির ভিতর হইতে প্রথম এতলার কাগজখানি সন্ধান করিয়া বাহির করিলেন, এবং সবিশেষ মনোযোগের সহিত এক এক বার করিয়া, ক্রমে দুই তিনি বার পাঠ করিলেন। উহাতে অতি সামান্য কথাই লেখা ছিল।
এই দারোগার দপ্তরের যে সকল পাঠক পুলিস-কৰ্ম্মচারী নহেন, তাঁহাদিগকে বোধ হয় প্রথম এতলা কি, এ কথাটির অর্থ একটু বলিয়া দেওয়া আবশ্যক।
পুলিস ষ্টেশন মাত্রেই একে প্রকারের পুস্তক আছে,—তাহার নাম “প্রথম এতলা বহি” (First Infromation Report)। যে ব্যক্তি থানায় গিয়া সৰ্ব্বপ্রথম কোন অপরাধের সংবাদ প্রদান করে, তাহার বিবরণ তৎক্ষণাৎ এই পুস্তকে লিপিবদ্ধ করিতে হয়—ইহাই নিয়ম। এইরূপ লিপিবদ্ধ করিবার উদ্দেশ্য এই যে, প্রথম অবস্থায় যে ব্যক্তি সংবাদ প্রদান করে, সে প্রায়ই প্রকৃতকথা বলিয়া থাকে। ভাবিয়া চিন্তিয়া বা ষড়যন্ত্র করিয়া সংবাদ প্রদান করিবার অবকাশ প্রায়ই সেই সময়ে ঘটে না। এই নিমিত্ত পুলিসের পরবর্তী রিপোর্ট অপেক্ষা প্রথম এতলাকে বিচারকগণ অধিক পরিমাণে বিশ্বাস করিয়া থাকেন। বিশেষতঃ এই এতলা প্রথমে একরূপ লিখিয়া পরে তাহার পরিবর্ত্তন করিবার উপায় নাই। কারণ, প্রথম অবস্থাতেই উহা একবারে তিন প্রস্থ লিখিতে হয়। এক প্রস্থ থানায় থাকে, দ্বিতীয় প্রস্থ ইনস্পেক্টার বা সুপারিন্টেন্ডেন্টের নিকট প্রেরিত হয়, তৃতীয় প্রস্থ মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট গমন করে। সুতরাং এক প্রস্থে যদ্যপি কিছু পরিবর্তিত হয়, অপর প্রস্থের সহিত মিলাইয়া দেখিলে, তখনই তাহা জানিতে পারা যায় বলিয়া, কোন পুলিস কর্মচারীই প্রথম এতলার পরিবর্ত্তন করিতে সাহসী হন না।
এই দাঙ্গা মোকদ্দমার সংবাদ প্রথমে একজন চৌকিদার প্রদান করে, এবং দারোগাবাবু তাহা স্বহস্তে লিখিয়া লন, একথা পাঠকগণ পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত আছে।
কৌন্সলী সাহেব যখন প্রথম এতলাখানি বাহির করিয়া দুই তিন বার পাঠ করিলেন, তখন সেইস্থানে যে যে ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, তাহারা উহা শ্রবণ করিলেন। উহাতে লিখিত ছিল :—
“আমার নাম গদাধর ডোম; যে গ্রামে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, আমি সেই গ্রামের চৌকিদার। গত রাত্রিতে গ্রামের বাহিরে লোকজনের চীৎকার শুনিয়া আমি সেই দিকে গমন করি। আমার বোধ হয় যে, রাত্রি প্রায় এক প্রহর থাকিতে এই দাঙ্গা হইয়াছিল। আমি গ্রামের বাহিরে গমন করিয়া দেখিলাম, জমীদার পুলিনবাবু ও যামিনীবাবুর লোকদিগের মধ্যে ভয়ানক দাঙ্গা উপস্থিত হইয়াছে। আমি একাকী, সুতরাং সেই দাঙ্গা নিবারণ করিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ দাঙ্গা হইবার পর উভয় দল উভয় দিকে প্রস্থান করিল। সেই সময় আমি দাঙ্গার স্থলে গমন করিয়া দেখিলাম যে, সেউ সুবিস্তৃত ময়দানের ভিতর একটি মৃতদেহ উলঙ্গ অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে; কিন্তু কে উহার মস্তক কাটিয়া লইয়া গিয়াছে। এই ব্যাপার দেখিয়া নিকটবর্তী গ্রামের অপর একজন চৌকিদারকে সেইস্থানে রাখিয়া, আমি থানায় সংবাদ দিতে আগমন করিয়াছি।”
প্রথম এতলার লিখিত বিবরণ শ্রবণ করিয়া পুলিনবাবু কহিলেন, “ইহার ভিতর এমন আর কি কথা আছে যে, যাহাতে আমরা এই মোকদ্দমায় জয়লাভ করিতে পারিব? যে সকল বিষয় পরে সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে, ইহাতে তাহারই সারাংশ আছে মাত্র।”
পুলিনবাবুর সহিত সেই সময় সেইস্থানে অপরাপর যে সকল লোক ছিল, তাহারাও পুলিন বাবুর মতে মত দিল, এবং দারোগাকে সকলেই মিথ্যাবাদী বলিয়া গালি প্রদান করিতে লাগিল।
ইহাদিগের কথা শ্রবণ করিয়া কৌন্সলী সাহেব কহিলেন, “আপনারা এত ব্যস্ত হইতেছেন কেন? দারোগাবাবু যাহা বলিয়াছেন তাহা প্রকৃত। এই মোকদ্দমার আপীল করিতেই হইবে। কারণ, এই প্রথম এতলা আমাদিগের পক্ষে বিশেষ উপকারী। এই প্রথম এতলার বলে আমরা নিশ্চয়ই এই মোকদ্দমায় জয়লাভ করিব।
কৌন্সলী সাহেবের এই কথা শ্রবণ করিয়া কোন ব্যক্তি আর কোন কথা কহিলেন না; অধিকন্তু এই মোকদ্দমার আপীল করাই একান্ত কর্তব্য, ইহা অবধারিত হইলে, সকলে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
সময়-মত এই মোকদ্দমার আপীল হইল, ও আপীলের দিনও স্থির হইল। ক্রমে এই সংবাদ যামিনীবাবুর কর্ণগোচর হইল। তিনি জানিতে পারিলেন, এই মোকদ্দমার আপীলের কোনরূপ উপায় ছিল না; কিন্তু দারোগাবাবু কি এক পন্থা উদ্ভাবন করিয়া দিয়াছেন যে, যাহাতে জজ সাহেব পুলিনবাবুর পক্ষীয় আসামীগণের আপীল মঞ্জুর করিয়াছেন। এই কথা শ্রবণ করিয়া যামিনীবাবু দারোগার নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, “শুনিয়াছি, আপনি পুলিনবাবুর পক্ষীয় আসামীগণের পক্ষ অবলম্বন করিয়া কি এক উপায় বাহির করিয়া দিয়াছেন, যাহাতে তাহাদিগের আপীল মঞ্জুর হইয়াছে। এই নিমিত্ত আমিও আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। আমার পক্ষীয় আসামীগণকে উদ্ধার করিবার যদি কোনরূপ উপায় থাকে, তাহা আমাকে বলিয়া দিন। আমিও আমার অনুগত লোকদিগকে উদ্ধার করিবার চেষ্টা দেখি।
যামিনীবাবুর কথার উত্তরে দারোগাবাবু কহিলেন, ‘এই মোক্কদমায় কোন নূতন উপায় বাহির হয় নাই, এবং পুলিনবাবুকে আমি সবিশেষ কোন পরামর্শও দেই নাই। আপনি যেমন একদিবস আমার নিকট আসিয়াছিলেন, তিনিও সেইরূপে একদিবস আমার নিকট আগমন করেন। আপনাকে আমি যেরূপ দুই চারিটি কথা বলিয়া দিয়াছিলাম, তাঁহাকেও ঠিক সেই প্রকারের দুই চারিটি কথা বলিয়া দিয়াছি। কিন্তু প্রভেদের মধ্যে এই ছিল, আপনি বিচারের পূর্ব্বে আমার নিকট আগমন করিয়াছিলেন, আর পুলিন বাবু আগমন করিয়াছিলেন, আসামীগণের মেয়াদ হইবার পর। আমি শুনিয়াছি যে, আমি তাঁহাকে প্রথম এতলাখানি ভাল করিয়া দেখিতে বলিয়া দেওয়ার পর তাঁহার কৌন্সলী উহা উত্তমরূপে পাঠ করেন, এবং তিনিই উহার মধ্য হইতে কি এক কথা বাহির করিয়াছেন, যাহাতে উচ্চ আদালতের জজসাহেবও আসামীগণের আপীল মঞ্জুর করিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় প্রথমেই যদি আপনার উকীল একটু বুদ্ধি ও বিবেচনার সহিত কার্য্য করিতেন, তাহা হইলে বোধ হয় যে, আসামীগণের মধ্যে কেহই জেলে গমন করিত না।”
দারোগাবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া পুলিনবাবু সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং পরিশেষে পূর্ব্বকথিত সেই জেলা কোর্টের উকীলের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দারোগাবাবুর কথিত সমস্ত কথাই কহিলেন। এই মোকদ্দমার অন্যান্য কাগজপত্রের সহিত প্রথম এতলার নকল উকীলবাবুর নিকট ছিল। তৎক্ষণাৎ তিনি তাহা বাহির করিয়া ভালরূপে পাঠ করিলেন। কিন্তু তাহার ভিতর এমন কোন কথাই পাইলেন না যে, যাহাতে তাঁহারা বিশেষভাবে উপকৃত হইতে পারেন। উকীলবাবুর পরামর্শমত পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, “যামিনীবাবুর পক্ষীয় আসামীগণের আপীল যখন মঞ্জুর হইয়াছে, তখন সেই আপীলের ফল কি হয়, তাহা প্রথমে দেখা যাউক। কারণ উহারা কি উপায় অবলম্বন করিয়াছে, তাহা সেই সময় জানিতে পারা যাইবে। যদি ভাল বিবেচনা হয় তাহা হইলে সেই সময় যাহা কর্তব্য হয় করা যাইবে।
এদিকে নির্ধারিত দিবসে হাইকোর্টের দুইজন মান্যবর জজ সাহেব একত্র এই মোকদ্দমার বিচার করিতে বসিলেন। তাঁহার আসামীগণের পক্ষীয় কৌন্সলীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “এই মোকদ্দমায় আসামীগণের পক্ষে আপনাদের কি বলিবার আছে, তাহা এখন বলিতে পারেন।” মান্যবার জজদিগের কথার উত্তরে কৌন্সলী সাহেবের যাহা কিছু বলিবার ছিল, তাহা তিনি মান্যবর জজদিগকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলেন, এবং তাঁহার স্বমত পোষক যে সকল কাগজ পত্র জজসাহেবকে দেখাইবার নিমিত্ত ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহাও তন্ন তন্ন করিয়া দেখাইয়া দিলেন। কৌন্সলীর কথা শেষ হইয়া গেলে, আসামীগণের বিপক্ষ পক্ষীয় সরকারী কৌন্সলীও দুই চারি কথা বলিয়া তাহার প্রতিবাদ করিলেন। পরিশেষে মান্যবর জজ সাহেবদ্বয় উভয়ে একমত হইয়া এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে নিম্নলিখিত মতটি প্রকাশ করিলেন।
“এই মোকদ্দমার কাগজপত্র অমরা সবিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করিয়াছি। সাক্ষীগণ যেরূপ সাক্ষ্য দিয়াছে, তাহাতে কোন বিচারকই আসামীগণকে মুক্তি প্রদান করিতে পারেন নাই, সুতরাং নিম্ন আদালতের বিচারকগণ এই মোকদ্দমায় বিষম ভ্রমে পতিত হইয়াছেন। কারণ, সাক্ষীগণ যখন একরূপ এজাহার দিয়াছে, এবং প্রথম এতলায় অনরূপ লিখিত আছে, তখন তাহাদিগের পক্ষে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া এ বিষয়ের সত্যসত্য নির্ণয় করা উচিত ছিল। এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান প্রণালী প্রথম হইতেই অদ্ভুত বলিয়া বোধ হয়। গদাধর ডোম নামক জনৈক চৌকিদার থানায় আগমন করিয়া সর্ব্বপ্রথমে এই ঘটনার সংবাদ থানার দারোগার নিকট প্রদান করে। আইন অনুযায়ী দারোগা তাহারই কথা প্রথম এতলায় লিখিয় লইয়া অনুসন্ধানের নিমিত্ত ঘটাস্থলে গমন করেন। কিন্তু তাহার পর দেখিতে পাওয়া যায় যে, দারোগা এই অনুসন্ধান হইতে অপসারিত এবং ইনস্পেক্টারবাবু এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হন। কর্মচারীদ্বয়ের মধ্যে কেন যে হঠাৎ এইরূপ অবস্থা উপস্থিত হয়, তাহার কোন নিদর্শন কাগজ পত্রের মধ্যে পাওয়া যায় না। এ সম্বন্ধে আসামীগণের কৌন্সলী সাহেব যে আভাষ প্রদান করেন, মহারাণীর পক্ষীয় কৌশলী সাহেব সন্তোষ-জনকরূপে তাহার প্রতিবাদ করিতে সমর্থ হন নাই। আসামীগণের কৌন্সলী সাহেব কহেন, “দারোগা বাবু প্রকৃত অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলেন বলিয়া ইনস্পেক্টারবাবু তাঁহাকে সেই স্থান হইতে বিদায় করিয়া দেন। কারণ, তিনি বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, প্রকৃত আসামী ধৃত না হইলে যাহার তাহার স্কন্ধে এই মোকদ্দমা সংক্রান্ত দোষের ভার চাপাইতে এই দারোগাবাবু সম্পূর্ণরূপে অসম্মত। সুতরাং তিনি স্বহস্তে এই মোকদ্দমার ভার গ্রহণ করিয়া কতকগুলি নির্দোষ লোকের উপর এই গুরুভার চাপাইয়া দিয়াছেন।”
“এই মোকদ্দমার প্রথম এতলা লিখিত হইবার সময় ঘটনাস্থলের অবস্থা কোন কর্মচারীই অবগত ছিলেন না। সুতরাং কিরূপভাবে প্রথম এতলা লিখিলে ভবিষ্যতে আসামীগণের বিপক্ষে উহা প্রমাণিত করিতে পারে, তাহাও ভাবিবার ক্ষমতা সেই সময় কাহারও হইতে পারে না। এরূপ অবস্থায় চৌকিদার গদাধর ডোম মিথ্যা কথা বলিয়াছে, বা দারোগাবাবু মিথ্যা কথা লিখিয়াছেন, তাহা অনুমান করা যাইতে পারে না। আমাদিগের বিবেচনায় প্রথম এতলায় যে সকল কথা লিখিত আছে, তাহা সম্পূর্ণরূপে সত্য।
“যদি প্রথম এতলার কথা প্রকৃত বলিয়া লওয়া যায়, তাহা হইলে এই দাঙ্গা ঘটিবার সময় কর্মচারী বা সাক্ষীগণের নির্দেশমত এক প্রহর রাত্রি নহে, অর্থাৎ রাত্রির প্রথম অংশে এই ঘটনা ঘটে নাই। উহা এক প্রহর রাত্রি থাকিতে অর্থাৎ রাত্রির শেষ অংশে ঘটিয়াছে।
“এখন দেখা আবশ্যক যে, যখন প্রকৃত দাঙ্গা ঘটিয়াছে, তখন এরূপ সময় পরিবর্তনের প্রয়োজন কি? এই প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ যে দিবস এই ঘটনা ঘটে, সেই দিবস শুক্লপক্ষের পঞ্চমী। সুতরাং রাত্রির প্রথম দশ খণ্ড পৰ্য্যন্ত জ্যোৎস্না ছিল, তাহার পরই অন্ধকার। সেই দিবস রাত্রি এক প্রহর থাকিতে যদি দাঙ্গা হইয়া থাকে তাহা হইলে অন্ধকারের ভিতর এক পক্ষীয় লোক অপর পক্ষীয় লোকদিগকে কখনই চিনিয়া উঠিতে পারে নাই। সুতরাং যে সকল আসামী দাঙ্গায় আহত হয় নাই, তাহার কোন প্রকারে সনাক্ত হইতে পারে না। কিন্তু রাত্রি এক প্রহর হইলে অর্থাৎ জ্যোৎস্নার সময় এই ঘটনা ঘটিলে আসামীগণের বিপক্ষে প্রমাণ করিবার বিলক্ষণ সুবিধা হয়। এই নিমিত্ত বোধ হয় যে, ইন্পেক্টারবাবু ঘটনার সময় ‘এক প্রহর থাকিতে’ এই কথার পরিবর্তে ‘এক প্রহর হইতে’ করিয়া আসামীগণের বিপক্ষে এই মোকদ্দমার দোষ প্রমাণিত করিবার সবিশেষ সুবিধা করিয়া লইয়াছেন। বিশেষতঃ যে সেকল আসামী এই দাঙ্গায় নিযুক্ত হইয়াছিল, তাহাদিগের শরীরে একবারে কোনরূপ চিহ্ন বা আঘাত না থাকাও একবারে অসম্ভব।
যাহা হউক, উপরি-উক্ত কারণে আমাদিগের বিবেচনায় এই দাঙ্গা এক প্রহর রাত্রি থাকিতে অর্থাৎ অন্ধকারের সময় ঘটিয়াছিল। সেই সময়, বর্তমান আসামীগণ উপস্থিত ছিল কিনা, তাহা বলা নিতান্ত কঠিন। সুতরাং আসামীগণকে আমরা বিনা শাস্তিতে অব্যাহতি প্রদান করিলাম।”
ইহাকেই বলে পুলিসবুদ্ধি!
যাহা হউক পুরাতন কৰ্ম্মচারী হইয়াও ইনস্পেক্টারবাবু এই মোকদ্দমায় যথাসাধ্য সৎ পথ অবলম্বন করিলেও মিথ্যা মোকদ্দমা সাজাইবার অপরাধে দণ্ডিত হইলেন ও তাঁহার বেতন কমিয়া গেল। পরিশেষে অনেক কষ্টে বহু চেষ্টায় পদ পরিত্যাগে পেন্সন গ্রহণ করিলেন।
এদিকে দারোগাবাবু ইনস্পেক্টারের অবস্থা দেখিয়া মনে মনে রুষ্ট হইলেন। মিথ্যা করিয়া মোকদ্দমা উল্টাইয়া দিলেও এ মোকদ্দমায় তাঁহার কোনরূপ শাস্তি হইল না। কিন্তু সৰ্ব্বনিয়ত্তা জগদীশ্বরের কি অখণ্ডনীয় নিয়ম! এই ঘটনার কিছু দিবস পরে একটি সামান্য মোকদ্দমায় এই দারোগাবাবু সৎ পথে থাকিয়া যথার্থ অনুসন্ধান করিলেও বিনাদোষে অপরাধী হইলেন। এবং নিম্ন পদে অধনীত হইলেন, বেতন কমিয়া গেল! এই নিমিত্তই বলি, অসৎ কর্ম্মের ফল ইহজন্মেই ভোগ করিতে হয়।
[ চৈত্র, ১৩০২]