পুলিশ এবং রবীন্দ্রসংগীত
‘কুচকাওয়াজ অন্তে পুলিশও গাইল রবীন্দ্রসংগীত।’ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই বিখ্যাত পঙ্ক্তিটি বোধহয় এ রকমই ছিল। বোধহয় বলছি এই কারণে যে, স্মৃতিশক্তির ওপর এখন আর তেমন ভরসা নেই।
কত স্মরণযোগ্য পঙ্ক্তি স্মৃতির গভীরে তলিয়ে গিয়েছে। তা যা হোক, এই পঙ্ক্তিটি, বড় জোর একটু রকম-সকম হতে পারে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রায় এই কথাই লিখেছিলেন। বেশ কয়েক দশক আগেকার কবিতা। লোকেরা পড়ে বেশ হাসাহাসি করেছিল।
পুলিশ এবং রবীন্দ্রসংগীত সেকালে মেলানো কঠিন ছিল। আজকাল অবশ্য পুলিশ খুব সংস্কৃতিবান হয়েছে। এই তো সেদিন মফস্বলে বেড়াতে গিয়ে পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ডে মাইকে গান শুনলাম—
‘আরও আরও প্রভু, আরও আরও এমনি করেই আমায় মারো…’
শক্তির এই কবিতার কাছাকাছি সময়ে অকালমৃত কবি তুষার রায় তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে আর একটি চমৎকার কবিতায় পুলিশের সঙ্গে ‘খুলিস’ মিল দিয়ে পুলিশকে অনুরোধ করেছিলেন,
‘ও ভাই পুলিশ।
কবির সঙ্গে দেখা হলে
টুপিটা তোর খুলিস।’
কী জানি, এই পঙ্ক্তিটিও ভুল উদ্ধৃতি হল কি না। বাসা বদল করার পর সব বইপত্র একাকার হয়ে গিয়েছে। কোথায় তুষার রায়, কোথায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সেদিন দেখলাম মধুসূদনের ঘাড়ে জীবনানন্দ উঠে বসে আছেন। বইগুলো মিলিয়ে দেখা সম্ভব হল না। পুলিশ সম্পর্কে এত কথা মনে পড়ছে, পাড়ার মেলায় ‘তিন পয়সার পালা’ নাটক হচ্ছে দেখে। সেই কবেকার ‘তিন পয়সা’, যখন তিন পয়সায় তিনটে চারমিনার সিগারেট পাওয়া যেত। সে যুগে অজিতেশ-কেয়ার তিন পয়সার পালা আমরা দল বেঁধে দেখেছি। সেই ‘তিন পয়সার পালা’য় মহাদেবের ত্রিশূল হাতে রুদ্রপ্রসাদের ধেই ধেই নাচ, ‘অর্ধেক দেবতা তুমি, অর্ধেক পুলিশ’, সে কি ভোলা যায়!’ পুলিশকে নিয়ে আমরা যাই ভাবি না কেন, পুলিশ নিজেও কম ভাবে না।
বছর-পনেরো আগে তখনও আমি সরকারি কর্মচারী। হাওড়ার এক তরুণ পুলিশসাহেব আমাকে বললেন, ‘জানেন দাদা, পুলিশকে কেউ মানুষ বলে গণ্য করে না।’ আমি বললাম, ‘প্রমাণ দাও।’ পুলিশসাহেব বললেন, ‘সেদিন দায়রার একটা গোলমেলে মামলার ব্যাপারে সরকারি উকিলের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে আরও দু’জন সহকারী সরকারি উকিল ছিলেন। এঁদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে-বাড়িতে গিয়ে ডোর বেল টিপতে একটি মেয়ে বেরিয়ে এল। সে আমাদের দেখে কিছু জিজ্ঞেস না করে বাড়ির ভেতরে গিয়ে সরবে ঘোষণা করল, দু’জন মানুষ আর একজন পুলিশ এয়েচেন।’ আমি চট করে কিছু ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাতে কী হয়েছে?’ প্রশ্ন শুনে তরুণ পুলিশসাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আপনিও বুঝতে পারছেন না, পুলিশ কি মানুষ নয়? বলতে পারত না তিনজন মানুষ এসেছেন?’
পুনশ্চ: বিবাদী বাগে একটা কাজে গিয়েছিলাম, দেখি লালবাজারের সামনে ফুটপাতে একজন ভিখিরি শীতের রোদে চিত হয়ে শুয়ে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান গাইছে। ‘অনেক কিছু ছেড়েছ তো জিলিপি ও সন্দেশ।’ কিছুক্ষণ পরে কাজ সেরে ফেরার পথে দেখি লোকটি উপুড় হয়ে শুয়ে গাইছে, সুমনেরই অন্য একটা গান। তাকে জিজ্ঞেস করলাম; ‘আগে চিত হয়ে গাইছিলে, এখন উপুড় হয়ে গাইছ কেন?’ তখন সে বলল, ‘দাদা এটা ক্যাসেটের উলটো পিঠ।’ এটা লালবাজারের সামনেই সম্ভব।