পুলিশ
না। যতদূর মনে করতে পারছি, এ পর্যন্ত এই মারাত্মক বিষয়ে আমি একবিন্দু কালিও ব্যয় করিনি।
ইঁদুর থেকে হাতি, মাতাল থেকে ভগবান। ইয়ারকি করার লোভে ভূভারতের যাবতীয় বিষয় ছুঁয়ে দেখেছি। কিন্তু বিনা কারণে, (নাকি অবচেতন মনে সত্যিই কোনও গুঢ় কারণ আছে), পুলিশকে চিরকাল এড়িয়ে গেছি।
সে যা হোক প্রথমেই সরাসরি পুলিশের ব্যাপারে যাচ্ছি না। এমন একটা গল্প দিয়ে শুরু করি যে গল্পে পুলিশ নেই এবং গল্পটা সেই জন্যেই।
ময়দানের মধ্যে দিয়ে কোনাকুনি ভাবে এক ভদ্রলোক শর্টকাট করছিলেন। সময়টা শেষ সন্ধ্যা, চারপাশে লোকজন নেই, নিঝুম শীতের রাতের শুরু। হঠাৎ মাঠের মাঝখানে এক ব্যক্তি ওই ভদ্রলোকের মুখোমুখি হন্তদন্ত হয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদা, ওই দিকে কোনও পুলিশ-টুলিশ দেখলেন?’ সরলচিত্ত দাদা বললেন, ‘না তো, ওদিকে পুলিশ দেখলাম না তো, কেন কী হয়েছে?’
আগন্তুক ব্যক্তিটি এবার বলল, ‘না কিছুই হয়নি, এবার হবে।’ দাদা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হবে?’ পকেট থেকে একটা ছোরা বার করে আগন্তুক এবার স্বমূর্তি ধারণ করে বলল, ‘এবার ছিনতাই হবে। নিন, ভাল ছেলের মতো ঘড়ি, আংটি খুলে দিন, পকেট থেকে টাকাপয়সা সব তাড়াতাড়ি বার করুন। না হলে খুনও হবে।’
এ গল্পটা পুরনো, এর মধ্যে পুলিশ নেই বলে এটা দিয়েই আরম্ভ করতে বাধ্য হলাম। এর পরের গল্পটা সদ্য শুনেছি। এ এক পুলিশসাহেবের মুখে শোনা।
পুলিশসাহেবকে একদিন এক ডিউটিরত সান্ত্রী ফোন করলেন রাস্তার পাশের এক ব্যাঙ্ক থেকে, ‘স্যার, এই একটু আগে এই ব্যাঙ্ক থেকে একজন টাকা তুলে রাস্তায় বেরনো মাত্র তার কাছ থেকে কয়েকটা লোক রিভলবার দেখিয়ে টাকাটা ডাকাতি করে নিয়ে গেছে।’
উদ্বিগ্ন পুলিশসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাউকে ধরতে পেরেছ?’ টেলিফোনে উত্তর এল, ‘একজনকে ধরেছি স্যার। যার টাকা ডাকাতি হয়েছে, তাকে আটকে রেখেছি।’
পুলিশকে নিয়ে রসিকতা করা অবশ্য ঠিক নয়। পুলিশ ঠিক ঠাট্টার পাত্র নয়, বরং বিপরীত দিকে যথেষ্ট সম্ভ্রম এবং সমীহের বিষয়।
এই সেদিন পর্যন্ত কোনও এলাকায় যদি একজন নিরস্ত্র পুলিশ কনস্টেবলও যেত, চারপাশে সবাই শশব্যস্ত এবং সন্ত্রস্ত হয়ে উঠত। গ্রাম্য কবি তাঁর গানে পুলিশকে রাজা বানিয়ে দিয়েছিলেন, শুধু রাজা নয় ভগবান আর শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পুলিশকে এক করে ফেলেছিলেন। চমৎকার সেই গান, নিশ্চয় অনেকেই শুনেছেন, ‘লাল পাগড়ি দিয়ে মাথে, তুমি রাজা হলে মথুরাতে।’
এরও বহুদিন পরে বিখ্যাত পশ্চিমি নাটকের ছায়ানুসারী এক আধুনিক বাংলা নাটকে চমৎকার একটি গান ছিল, যার মধ্যে প্রায় এ রকম একটা লাইন ছিল, ‘অর্ধেক দেবতা তুমি অর্ধেক পুলিশ।’
দেবতা প্রসঙ্গে একটা বিলিতি গল্প মনে পড়ছে। দুটি সাহেব শিশু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। প্রথমজন বলছে, ‘রোববার উপাসনার দিন। ওদিন কোনও কাজ করতে নেই।’ দ্বিতীয়জন বয়েসে কিছু ছোট, সে বলল, ‘রোববার কাজ করলে কী হবে?’ প্রথমজন তখন বিজ্ঞের মতো গম্ভীর হয়ে জানাল, ‘রোববারে যে কাজ করবে সে স্বর্গে যেতে পারবে না।’ দ্বিতীয় ছেলেটির বাবা। পুলিশের কাজ করে, সে চিন্তায় পড়ে বলল, ‘কিন্তু পুলিশের বেলায় কী হবে, পুলিশকে তো রোববার কাজ করতে হয়। আমার বাবা তো রোববার ডিউটি করে।’ প্রথমজন অতি বুদ্ধিমান, সে সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার সমাধান করে দিল, বলল, ‘পুলিশ রোববার কাজ করে, স্বর্গে যাবে না। আর যাবেই বা কেন, স্বর্গে তো আর পুলিশের কোনও দরকার নেই।’
পুলিশের ডিউটির একটা অন্যরকম কাহিনী আছে। বোধহয় কাহিনীটি মিথ্যে নয়। এক পুলিশ অফিসারের বাড়িতে মধ্যরাতে চোর ঢুকেছে। পুলিশ অফিসার বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছেন, তাঁর স্ত্রী পাশের ঘরে লোকের পায়ের শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি স্বামীকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে ‘ওগো, শিগগির ওঠো, আমাদের বাড়িতে চোর ঢুকেছে।’ বিছানায় পাশ বদলিয়ে স্বামী ঘুমজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি কিছু জানি না। আমার এখন ডিউটি নেই।’
বাংলা গল্প-উপন্যাসে ততটা না হলেও বাংলা সিনেমায় পুলিশ নিয়ে অনেক হাসি ঠাট্টা হয়েছে। স্বৰ্গত জহর রায় কিংবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত এ জাতীয় দু’-একটি চরিত্র এখনও মনে পড়লে হাসি পায়। মাঝেমধ্যে রাস্তাঘাটে জীবন্ত পুলিশ চরিত্রের মধ্যে সেসবের ছায়া দেখতে পাই।
এককালে বিলিতি হাসির সিনেমারও বিশেষ উপজীব্য ছিল পুলিশ, ভীরু ও গোবেচারা ধরনের চরিত্র ছিল সেটা। একটা দৃশ্য মনে পড়ছে। এক কুয়াশাচ্ছন্ন নির্জন রাস্তা। রাত এগারোটা, টিপটিপ করে বষ্টি পড়ছে। নায়িকা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমন সময়ে পুলিশ কনস্টেবল মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে এঁগিয়ে এসে বলল, ‘আপনার বাস যতক্ষণ না আসে আপনার পাশে আমি দাঁড়াচ্ছি। আপনার কোনও ভয় নেই।’
মেয়েটি রীতিমতো সাহসিকা এবং আধুনিকা, সে বলল, ‘না, আমি কোনও ভয় পাচ্ছি না। আমার জন্যে আপনাকে দাঁড়াতে হবে না।’ এবার পুলিশ বেচারা ভীত সন্ত্রস্তভাবে চারপাশে তাকিয়ে দেখে বলল, ‘আসলে আমার কেমন ভয় করছে। আপনি যদি অনুমতি করেন আপনার পাশে আমি একটু দাঁড়াই।’
পুলিশ ও মাতাল নিয়ে মজার কাহিনী অনেক। মাতাল গল্পমালায় তার কিছু কিছু লিখেছি, একটা গল্প লেখা হয়নি। সেটা অবশ্য বোধহয় সবাই জানে। তবু ভুলে যাওয়ার আগে লিখে রাখছি।
এক মাতালকে ধরার জন্যে পুলিশ মাতালের পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছিল। চেতলা পুলের কাছে এসে মাতালটির দম ফুরিয়ে যায়, পুলিশ তাকে প্রায় ধরে ফেলে। তখন বেগতিক দেখে মাতালটি ডানদিকে ঘুরে কালীঘাট খালের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে। নাছোড়বান্দা পুলিশও তখন খালে নেমে তাকে ধরতে যায়। কিন্তু মাতালটি অতি চতুর। আইনের কূট প্রশ্ন তুলে পুলিশকে সে আটকিয়ে দেয়। সে গলাজলে গিয়ে বলে যে, ‘আমি এখন জলের মধ্যে আছি। এটা জলপুলিশের এলাকা। তুমি আমাকে ধরবার কে? আমাকে ধরবে না ছেড়ে দেবে সেটা জলপুলিশ বুঝবে, তুমি বিদায় হও।’
শেষ গল্পটি ট্র্যাফিক পুলিশের। এক ভদ্রলোক খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ ট্র্যাফিক পুলিশ তাঁকে রাস্তায় আটকাল, আটকিয়ে তাঁর লাইসেন্স দেখতে চাইল।
ভদ্রলোক প্রতিবাদ করলেন, ‘আমি তো কোনও আইনভঙ্গ করিনি। কোথাও গুঁতো লাগাইনি, কাউকে চাপা দিইনি। আমাকে খামোকা কেন হয়রানি, আমি এত সাবধানে, যত্ন করে গাড়ি চালাচ্ছি।’
ট্রাফিক পুলিশ মৃদু হেসে বললেন, ‘সেই জন্যই গাড়িটা থামালাম। লাইসেন্স থাকলে কি কেউ এত সাবধানে গাড়ি চালায়?’