পুরোহিত দর্পণ

পুরোহিত দর্পণ

ভটচায্যিদের বাইরের ঘরটাকে মন্দির বলা হয় কারণ ওখানে একটা কষ্টিপাথরের কালীমূর্তি আছে। নিত্যি পুজো হয়। বারোটা জবাগাছ আছে বাড়িতে। কয়েকটা তুলসী ঝোপ। দুটো বেলগাছ। একটা আমগাছ; সুতরাং বিল্বপত্র, রক্তপুষ্প, তুলসী এবং আম্রপল্লবের ব্যাপারে ভটচায্যিবাড়ি স্বয়ম্ভর। ভটচায্যিদের গৃহপালিত স-বৎসা গাভীও আছে। সুতরাং আসনশুদ্ধি, বেদিশুদ্ধি, দেহশুদ্ধি এবং জলশুদ্ধির জন্য গোময়, গোমূত্র সংগ্রহের জন্য ভটচায্যিদের কাউকে খাটালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। গো-সেবার ভারটা কালাচাঁদের উপর। তবে কালাচাঁদকে নারায়ণপুজো সহ কালীপুজোও করতে হয় যদি গৃহকর্তা শ্রীশিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য যজমানিতে স্থানান্তরে যান। এটা প্রায়ই ঘটে থাকে। ছটি নারকেল গাছও আছে। শুদ্ধবন্ত্রে নারকেল কুরে, আশালতা দেবী নারকেল নাড়ু পাকিয়ে রাখেন যা পুজোয় লাগে। নারকেলের ব্যাপারে স্বয়ম্ভর হলেও চিনির ব্যাপারে ভটচায্যি বাড়িতে সমস্যা রয়ে গেছে কারণ রেশনে মাত্র ৭৫০ গ্রাম চিনি পান। সাড়ে সাতটি রেশন কার্ড। যথা—

শ্রীশিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য। ৬৬

পিতা কৈলাশ

শ্ৰীমতী আশালতা দেবী। ৫২

স্বামী শিবপ্রসাদ

শ্ৰীমতী উমা মুখোপাধ্যায়। ৩৪

স্বামী বিঁকাশ

শ্রীদেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য। ২৯

পিতা শিবপ্রসাদ

শ্ৰীমতী সুরমা ভট্টাচার্য। ২৪

পিতা শিবপ্রসাদ

শ্ৰীমতী সুষমা ভট্টাচার্য। ২০

পিতা শিবপ্রসাদ

শ্রীপঞ্চানন মুখোপাধ্যায়। ৫

পিতা বিঁকাশ।

শ্রীকালাচাঁদ চক্রবর্তী। ৪০

পিতা ভোঁলানাথ।

সিন্নিতেই ওই সাড়ে সাতশো চিনি লেগে যায়। প্রতি শনিবার বারের পুজো হয়, ৩০-৪০ জন লোক আসে, সিন্নি প্রসাদ নেয়। সুষমার চেয়ে সুরমা বেশি ফরসা, ওই সিন্নি মাখে। পুজোটা তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য অনেকে চাপ দিতেন, কারণ ওই দিনে টিভি-তে সিনেমা। বলতেন, সিন্নির দরকার নেই, সন্দেশ দিয়ে দিন। তাঁরা নিজেরাই সন্দেশের বাক্স নিয়ে আসতেন। শিবপ্রসাদ রাজি হননি। সিনেমা অথবা শনি, একটা বেছে নিতে হবে। দোকানের সন্দেশে বিশ্বাসী নন শিবপ্রসাদ। কোনও পুজোতেই দোকানের সন্দেশ ব্যবহার করেন না তিনি। কারণ মিষ্টির দোকানে সিঙাড়া, কচুরি ইত্যাদি তৈরি হয়। শাস্ত্রানুসারে, তণ্ডুল জাতীয় পদার্থে লবণ প্রয়োগে সেই খাদ্য উচ্ছিষ্টতুল্য হয়। এবং সিঙাড়া কচুরির স্পর্শদোষে সন্দেশাদি মিষ্টান্ন দ্রব্যও উচ্ছিষ্টতুল্য হয়। শ্রীশিবপ্রসাদ এতটাই শাস্ত্রাচারী যে বাড়িতে স্টিলের বাসন-কোসন ঢুকলেও পুজোয় স্টিল বা চিনামাটির বাসন ব্যবহার করেন না। কারণ এগুলি ম্লেচ্ছপাত্র। শাস্ত্রে সুবর্ণ রৌপ্য শঙ্খ শুক্তি কাংস তাম্র ও প্রস্তর নির্মিত পাত্রই যে শুদ্ধ এ কথা বলা আছে। জগৎপতি সূর্যদেব উদিত হবার পরে যে দন্তধাবন করে, সে পাপিষ্ঠ। শিবপ্রসাদ সূর্যোদয়ের এক ঘণ্টা পূর্বে শয্যাত্যাগ করেন। নিমডালে দত্তধাবন করেন, পুকুরে অবগাহন করেন। গামছা পরিধানরত অবস্থায় পুষ্পচয়নে যান। নিজগৃহে জবা এবং টগর ভিন্ন অন্য গাছ না থাকায় প্রতিবেশীর বাড়িতে যেতে হয়। যেহেতু মায়ের পুজোর ফুল, কেউ সরাসরি আপত্তি করেন না, তবে মরূদ্যান নামে যে ঢং-এর বাড়িটা, ও বাড়ির একটি ছোঁড়া, যে নাকি জেসপ কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার, বলেছিল, ঠাকুরমশাই, গামছার তলায় একটা আন্ডার প্যান্ট পরে আসবেন প্লিজ, —তখন বারান্দায় বসা, ম্যাক্সি পরা ওর স্ত্রী হাসছিল। লজ্জাহীন। ওই বাড়িতে আর যান না শিবপ্রসাদ। তবে ইদানীং একটা প্রবণতা লক্ষ করছেন তিনি, যে প্রতিবেশীগণ গাঁদা, সূর্যমুখী, বেল ইত্যাদির পরিবর্তে হলিহক, পিটুলিয়া-ফিটুলিয়া ইত্যাদি কী সব ফুলগাছ লাগাচ্ছে। এই সকল ফুলের বিবরণ শাস্ত্রে না থাকায় পুজোর কাজে লাগে না। পুষ্পচয়ন সমাপন করে ক্ষেমবস্ত্র পরিধান করেন শিবপ্রসাদ। গৌহাটি থেকে কেনা গরদ। রেলের চাকরি করতেন শিবপ্রসাদবাবু। রেলের পাশ নিয়ে তীর্থস্থানগুলি ছাড়া অন্যত্র যাননি তিনি। কামাখ্যা ভ্রমণের সময় একজোড়া গরদ কিনেছিলেন, এখন ছিন্নপ্রায়। রেলের পাশ ব্যবহার করে জলশুদ্ধি মন্ত্রে যে, সকল নদীর কথা উল্লেখ আছে, সে-সমস্ত নদীর জল সংগ্রহ করেছেন শিবপ্রসাদ।

যথা—

গঙ্গেচ যমুনেচৈব গোদাবরী সরস্বতী।

নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেস্মিন সন্নিধিং কুরু।

সিন্ধু ছাড়া সমস্ত নদীর জল বোতলে ভরে এনে রেখেছিলেন। পরে একটা কলসে সব জল মিশ্রিত করে পুনরায় বোতলে ভরে ছিপি এঁটে বন্ধ করেছেন। পুজোর সময় আসনশুদ্ধির পর যখন জলশুদ্ধি করতে হয় তখন ওই বোতলের কয়েক ফোঁটা জল অঙ্কুশমুদ্রায় করতলে রেখে গঙ্গেচ যমুনেচৈব মন্ত্রপাঠ করে বাকি জলের মধ্যে মিশিয়ে নেন। এইভাবে তিনি মন্ত্রের সঙ্গে সত্যের মিল ঘটান। সিন্ধুর জন্য সামান্য খুঁতখুঁতি থেকে যায়। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তিনি আরব সাগরের জল মিশিয়েছেন। কারণ সিন্ধুনদ আরব সাগরে পতিত হইয়াছে। পুজোয় ব্যবহৃত যাবতীয় তৈজসপত্রাদির মধ্যে একমাত্র ওই বোতলগুলিই কাচ নির্মিত। পিতলের কলসিতে ঢাকনি দিয়ে রাখলেও বাষ্পীভবন ঠেকানো যেত না। ধর্মশালার দারোয়ানদের কাছ থেকে পয়সা দিয়ে কেনা ওই বোতলগুলির অধিকাংশই যে বিয়ারের, রামের, সেকথা দেবু ভালই জানে। দেবু মানে দেবপ্রসাদ। শিবপ্রসাদের একমাত্র ছেলে। লিখল— এজ: থার্টি, কোয়ালিফিকেশন: বি কম। দেবু দরখাস্ত করছে মিউনিসিপ্যালিটির চাকরির জন্য। একস্ট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি কী লিখবে ও? কালীমন্দিরে ঢুকতেই বাঁ দিকের দেয়ালে সুন্দর হাতের লেখায় মহিম ঘোষকে ভোট দিন দেবুরই কীর্তি, আর ডান দিকের দেয়ালের শ্রীশ্রীরক্ষাকালীমাতা। দেবুর হাতের লেখাটা বড় ভাল। স্কুলের পাঁচিলে লম্বা বোফর্স কামানটা ওরই আঁকা। ওকে বিভিন্ন দেয়ালে অনেক লিখতে হয়েছে, অনেক আঁকতে হয়েছে, অনেক অনেক দেয়ালে। নিজের বাড়ির দেয়ালটা সাফ-সুফ রাখাটা এক্ষেত্রে ভাল দেখায় না যেখানে এত পাবলিক আসে, স্পেশালি শনিবার শনিবার।

আট-ন’ বছর হয়ে গেল দেবু পার্টি করছে। একদিন দুপুরে মহিলা সমিতির যুথিকাদির ঘরে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর ব্যাপারে হঠাৎ ঢুকে গিয়েছিল দেবু। যুথিকাদি থতমত খেয়ে চমকে উঠেছিল। দেবু বলেছিল, এরকম চমকে ওঠেন নাকি মাঝে মাঝে? আমার বাবার কাছে যাবেন, কালীর ফুল দিয়ে দেবে। যূথিকাদি বলেছিলেন, কালীতে বিশ্বাস করো নাকি? দেবু বলল, বাড়ির কালী… যাই বলুন, একটা ইয়ে তো আছে, একটা শক্তি। যুথিকাদি বলেছিলেন, তুমি ব্রাঞ্চ কমিটির মেম্বার না?

হ্যাঁ।

যে কোনও একটা বেছে নেয়া উচিত ছিল। কালী কিংবা মার্কস। ‘অন রিলিজিয়ন’ পড়েছ?

না তো?

এঙ্গেল্‌স?

উঁহু।

রাষ্ট্র ও বিপ্লব?

না, মানে…

পড়ে দিয়ে দিয়ে, দাঁড়াও দিচ্ছি, বলে যুথিকাদি বইয়ের তাক খুঁজছিল। সুকান্তসমগ্র, মানিক গ্রন্থাবলি, চুলের যত্ন, কেক ও আইসক্রিম, গোর্কি, টলস্টয়, একব্যাগ শংকরের ফাঁক-ফোঁকরগুলো খুঁজেও যুথিকাদি যা খুঁজছিলেন পেলেন না। বললেন, কে যে নিয়ে গেছে মনেও নেই। দাস ক্যাপিটাল ছিল, ওই যে। সিলেকটেড ওয়ার্কস অফ লেনিন, কিন্তু আগে বেসিক বইগুলো পড়া দরকার।

শিবপ্রসাদও বলেন ক্রিয়াকর্মবারিধি এবং তন্ত্রসুক্তসার বই দুটি পড়তে। কখন পড়বে দেবু? সকাল থেকেই কাজ। নাগরিক সমিতির জীবনবাবু সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ, বাজার যাবার পথে কালীমন্দিরে প্রণামটা রেখে যান। দেবুর তখন থেকেই কাজ শুরু হয়। ওর হাতে তখন দাঁত মাজার ব্রাশ। ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়া টুথপেস্টের ফেনা সামলে সামলে সংগঠনের কথা বলে নেয় দেবু, যেমন হাশমি স্মরণ, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ট্যাপ ওয়াটারের কানেকশন বণ্টন, স্টেশনের চুল্লুর ঠেক ও স্থানীয় থানার সম্পর্ক।

দরখাস্তে বয়সটা লিখেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল দেবুর। তিরিশ ক্রশ করে ফেলেছে। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরিতে অ্যাপ্লাই করার বয়স আর নেই। স্টেটের কিছু চাকরির এজ লিমিট থার্টিফাইভ। ওসব হবে-টবে না বুঝে গেছে দেবু। জীবনে তিরিশটার উপর ইন্টারভিউ দিয়েছে। ফায়ার ব্রিগেডে খুব চান্স ছিল। ডিসট্রিকট থেকে লিখিয়ে এনেছিল, অধীরদা কথাও দিয়েছিলেন, হল না। এবার লাস্ট চান্স মিউনিসিপ্যালিটিতে। চেয়ারম্যান মোটামুটি কথাও দিয়েছেন। বলেছেন এটা ডিপ টিউবওয়েল, জলের ট্যাংক আর তোমার চাকরি— এই তিনটে কাজ হল আমার আগামী এক বছরের টারগেট।

ইয়োরস সিনসিয়ারলি লিখবার জন্য আবার ডিকশনারি খুলতে হল দেবুর। সিনসিয়ারলি কথাটা জীবনে কতবার লিখেছে, তবু গুলিয়ে যায়। ডিকশনারি খুলতেই বেরিয়ে পড়ে বাবার চিঠি।

হুকুমাচাঁদ ধৰ্মশালা, বারাণসী। দীর্ঘজীবেষু।

হিন্দুসমাজে আজকাল পুরোহিতের ক্রাইসিস দেখা দিয়াছে। যথেষ্ট সমাদর ও অর্থলাভের সম্ভাবনা না থাকায় ব্রাহ্মণ সন্তানগণ এই ব্যবসায়ে মনঃসংযোগ করিতেছে না বলিয়া অনেকে মনে করেন। আমি এই মতে বিশ্বাসী নই। পূর্বে পুরোহিতগণই ছিলেন সমাজের যন্ত্রী। এখনও উত্তম পুরোহিতের কদর আছে বলিয়া মনে করি। গভঃ চাকুরি বর্তমানে মরীচিকা প্রায়। তুমি চাকুরিতে ব্যর্থকাম হইতেছ। বরং কুল-ব্যবসায়ে মনঃসন্নিবেশ করো। আমরা সাধক শ্রীসর্বানন্দের সাক্ষাৎ বংশধর। তুমি নিশ্চয় বুঝিতে পারো যে কেবলমাত্র আমার স্যালারি হইতে এতবড় সংসার প্রতিপালন করা সম্ভব হইত না যদি মন্দিরের আয় এবং যজমানি না থাকিত। তুমি মনস্থির করো। আশা আছে অচিরেই সমাজে পুজো, যাগ-যজ্ঞ, ধর্মাচারণ ইত্যাদির কদর হইবে। বি জে পি উঠিতেছে।

দরখাস্ত শেষ করে ব্রাইট ফিউচার কমার্শিয়াল কলেজ থেকে ওটা টাইপ করিয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসে দেবু। কালচাঁদদা, কাগজটা একবার মায়ের পায়ে টাচ করিয়ে দাও তো।

চেয়ারম্যানের বাড়ি যায় দেবপ্রসাদ। টুং-টাং করতেই চেয়ারম্যানের মেয়ে। কানে ওয়াকম্যান। বলল, উপরে আসুন। খলবল করছে চুল। শিয়োর সুবার্বন বিউটি পার্লারের খদ্দের। উপরে গঙ্গেশদা বসে ছিল। গঙ্গেশদা মিউনিসিপ্যালিটির কন্ট্রাক্টার। সেন্টার টেবিলে পলিথিনের প্যাকে কাজুবাদাম, দারুচিনি, এলাচ। গঙ্গেশদা গোয়া থেকে ফিরেছেন। চেয়ারম্যান দেবুর দরখাস্তটা নিয়েই ব্রিফকেসে ঢোকালেন। বললেন ও-কে। এবং চোখে-মুখে এমন পোজ দিলেন তাতেই দেবু বুঝে নিল— ব্যাপারটা গোপন, এবং মাল ওকে হয়ে গেছে।

বাড়ি ফিরে এসে পচাকে কোলে জড়িয়ে ধরল দেবু, পচার মুখের লালা মুছিয়ে দিল, বলল, ভাগনেরে, তোকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব আমি। কাঁধে চাপিয়ে বাঘ দেখাব, হনুমান! চাকরিটা হয়ে যাক। উমা বড় চুপচাপ থাকে, কথা বলে না। বোনটা বিধবা হয়ে এসেছে তিন বছর। ওর স্বামী বিকাশের দোকানে এখন বিকাশের ছোটভাই বসে। বিকাশের এল আই সি-ও ছিল না। একটা টাকাও পায়নি উমা। ফলে ও পুরোটাই বোঝা। তাই ও পুকুর থেকে কলমি তোলে, জামাকাপড় কাচে, উমা পুকুর পাড় থেকে ধেয়ে আসে। সত্যি নাকি রে দেবু? কথার জবাবে শুধু পচার মাথায় বিলি কাটতে থাকে দেবু।

পচার পোলিও হয়েছিল। আচমকা আদরে ওর সরু সরু পা নড়তে থাকে দ্রুত, উৎফুল্ল মুখ থেকে আরও লালা ঝরতে থাকে। প্রশ্রয় পেয়ে বলে, অ মামু, জিল্‌পি খাব…

দেবুর মায়ের সারাদিন কাজ। কতবার যে কাপড় ছাড়তে হয় ঠিক নেই। ঠাকুরের কাজের জন্য আলাদা কাপড়, রান্নার জন্য আলাদা। খাওয়া-দাওয়া সারা হলে সামান্য বিশ্রাম, তখন আলাদা, সবই লালপাড়ের মোটা কাপড়। শিবপ্রসাদের যজমানির সংগ্রহ। দু-চারটে ছাপা শাড়ি যা মেয়েরা পরে, এইভাবে সংগ্রহ করেন শিবপ্রসাদ:

‘শোন নিশানাথ, স্ত্রী বিয়োগ বড়ই বেদনার। তোমার এখন কর্তব্য তাঁর আত্মার স্যাটিসফ্যাকশনের জন্য যথাসম্ভব সামর্থ অনুযায়ী শ্রাদ্ধকার্য সম্পাদন করা। বৃষোৎসর্গ সম্ভব নয়, তিলকাঞ্জন করো, বৈতরণী করো, ষোড়শ করো। ষোড়শে ভূমি, আসন, জল, দীপ, পাদুকা, ফল, বস্ত্রাদি ষোলোটি দান আছে। ভূমি আর কোত্থেকে দেবে, গঙ্গা মৃত্তিকাই দিয়ে। আর বস্ত্র যে-ক’টা দেবে, ছাপা শাড়ি দিয়ে। তোমার ওয়াইফ খুব শৌখিন ছিলেন। ভাল ভাল শাড়ি পরতেন…’

দেবুর মা ডুমুর কুটতে কুটতে শুনছিলেন পচার সঙ্গে দেবুর ওই খুশি খুশি কথাবার্তা। যতক্ষণ বাড়ি থাকে, দেবুর তো সর্বদাই খিচির-মিচির। এটা হল না কেন, ওটা হল না কেন? একই ছেলে, কিছু বলেন না আশালতা। আশালতা জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে, তোর চাকরি হল নাকি? দেবু বলল, না মা, তবে হয়ে যাবে। আশালতা তক্ষুনি শাড়ি পালটাতে গেলেন এবং গরদটা পরে কালীর চৌকাঠের সামনে দাঁড়ালেন। আশালতার ওই চোখ বুজে থাকা, চৌকাঠের উপর মাথা ঠোকা, এসব দেখে কালাচাঁদ যেন কিছু বুঝল। জবাফুল দিল, সিঁদুর দিল। জিজ্ঞাসা করল, মানত বুঝি কাকি?

আশালতা বলল, হ্যাঁ?

নাতির জন্য?

না।

তবে?

তোর দরকার কী?

পাঁঠা মানত হলে কালাচাঁদের ভালই লাগে! মাংস খাওয়া যায়। পুজো বা মানতের মাংস ছাড়া এ-বাড়িতে অন্য মাংস ঢোকে না। বাজারের মাংস হল জবাই করা। একটিমাত্র কোপে কাটা ছাগ মাংসই শাস্ত্রীয়। মাংসপাকে পিঁয়াজ রসুন ব্যবহার হয় না। গতবার একটু অন্যায় হয়ে গিয়েছিল। দেবুর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব কালীপুজোর দিন কিছুটা কারণবারি নিয়ে এসেছিল। ভাঁড়ে মাংস নিয়ে সবাই চলল বসাকদের সদ্য ছাদ হওয়া বাড়িতে। কালাচাঁদকেও নিয়ে চলল। বলল, তুমি না হলে জমবে না। কারণবারিটা বিলিতি ছিল। হলেদেটে। দেবুর বন্ধু ভটা বড় ফাতড়া। বলে, কালাদা, মিনতিকে বিয়ে করবে? মিনতি বামুনের মেয়ে। প্রফেসর বউদির বাড়িতে কাজ করে, চমকানো বডি। কালাচাঁদের ততক্ষণে ব্রহ্মরন্ধ্রে ক্রিং, ললাটে হ্রিং, নাভিমূলে হুং। দেবুরে দেবু, তুই মাইরি তোর বাবা-শালাকে বলে কয়ে মাইনেটা বাড়িয়ে দে লক্ষ্মী, অন্তত পঞ্চাশটা টাকা বাড়িয়ে দিলে সোমসারি হতুম। এই টাকায় কিছু হয়, বল, তোর বাপ দু’ বছর ধরে একটা নয়া মাইনে বাড়াল না মাইরি। দেবু বলে, একজনের খোরাকি কত আজকাল, তা ছাড়া দান দক্ষিণেটা…

সেও তো দেয় না শালা তোর বাপ। শুধু শনিপুজোরটাই পাই হাফ। ভটা বলে, খুব দুক্‌খু না? আর একটু খাও। কালাচাঁদ আরও খায়। বলে, পঞ্চভূতের এই শরীরে জোয়ার ভাঁটার খেলা সবই মায়ের ইচ্ছে। আমার বাপ সন্নেসী, ভাই নেই, বুন নেই, কেবল মা আছেন। কালীমা! এই দেখ ধেনুমুদ্রা। এই দেখ যোনিমুদ্রা। এই যে ভূতিনীমুদ্রা। হৃদয়ে ক্রিং নমঃ, লিঙ্গে ক্রিং নমঃ।

নাও। আর একটু মাংস খাও। ভাঁড় এগিয়ে দিয়েছিল ভটা। কালাচাঁদ মাংস মুখে নিয়েই বোঝে অন্যরকম। পেঁয়াজের গন্ধ কেন? ভটা বলল, দোকানের। দোকানের কেন? ভটা বলল, দেবু শালা যা কিপটে, ওইটুকুতে হয়? দোকান থেকে এনেছিলাম যে। কালাচাঁদ চিৎকার করে উঠল… দেবুরে, তোর পায়ে পড়ি, তোর বাবাকে এই পেঁয়াজের মাংসর কথা বলিস না। আমি প্রায়শ্চিত্ত করে নেব…

বলো না কাকি, কী মানত করলে, জবা, না পাঁঠা?

পাঁঠা বলে মৃদু হাসি ছুড়ে দিয়ে আশালতা চলে গেলেন। জবার কেসই বেশি হয়—একশো এক জবা, হাজার এক জবা। পাড়াপড়শিরা মানত করে যান। লাস্ট পাঁঠা মানত হয়েছে মাস দুই আগে। কলেজের প্রফেসার এক ভদ্রমহিলা, তাঁর স্বামীও অফিসার, তাঁদের ছেলে হবার জন্য মানত করেছিলেন। এর আগে ওদের দুই মেয়ে। ভদ্রমহিলার কাঁধ-ছাঁটা চুল, বাড়িতে ম্যাক্সি পরে থাকেন, উনি কালীর দয়ায় পুত্রসন্তান লাভ করলেন। পাঁঠা মানত হলে কালাচাঁদই বলি দেয়। উঠানে পারমেন হাঁড়কাঠ আছে। প্রফেসার ভদ্রমহিলা সোনার জিভ দিয়েছিলেন। কালীমায়ের সোনার চোখ আছে, আরও গয়না আছে, সব লকারে। কালীপুজোয় সাজানো হয়। সবই ভক্তরা দিয়েছে। এখন শুধু জিভটাই লাগানো রয়েছে, তবে সোনার নয়, রুপোর। এটা দিয়েছে ভোলা। ভোলা ছ’বছর ঝুলছিল একটা মার্ডার কেসে। ও কংগ্রেস করত বলে দেবু সাফ বলে দিয়েছিল আমাদের মন্দিরে আসবি না। এ নিয়ে দেবুর বাবার সঙ্গে দেবুর মতভেদ হয়। দেবুর বাবার মতে, মায়ের কাছে কংগ্রেস কমিউনিস্ট কী? ভোলা শেষ অবদি পুজো দিয়েছে। যে দিন কেস ডিশমিশ হল, সেদিন রুপোর জিভটা দিয়ে গেছে।

আবার কালীপুজো আসছে। নারকেল মজুত হচ্ছে ঘরে। জবার মায়ের কালো পাঁঠাটার, আহা, কালো কুচকুচে রং। ওকে বলা হয়েছিল যেন পাঁঠাটাকে খাসি না করা হয়। পুজোয় চাই নিখুঁত পাঁঠা। এখন ওর আট মাস হল। খুব লাফাচ্ছে। পাঁঠাটা বায়না করা হয়েছে। সুষমা সুরমা দুই বোন সর আর বেসন মাখতে শুরু করেছে মুখে। ওরা প্রফেসার বউদিকে বলে রেখেছে পান্নালাল, অনুপ জলোটা আর রুনা লায়লার ক্যাসেটগুলো কালীপুজোর সময় নেবে। পচা বলতে লাগল, বাজি ফটাস কব্বে তো মামা?

ফটাস বাস্ট করল দেবপ্রসাদ, কালীপুজোর দিনকয়েক আগে। মিউনিসিপ্যালিটির চাকরিটা দেবুর হয়নি। হয়েছে গঙ্গেশ কন্ট্রাকটারের শালার। আশালতা কালীমূর্তির দিকে কটমট করে তাকাল। তারপরেই বলল, অপরাধ নিয়ো না মাগো। নাগরিক সমিতির জীবনবাবু সকালবেলা কালী নমস্কারে এলে ফ্লোরাইডযুক্ত সাদা ফেনা মুখ থেকে ফক করে ফেলে দেবু প্রথমেই বলল, সব শুয়োরের বাচ্চা। দেবু চেয়ারম্যান টেয়ারম্যান, গঙ্গেশবাবু সবাইকে জড়িয়ে যা-তা বলতে লাগল। জীবনবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চলে যেতে যেতে শুনতে পেল চাইসেস্কি সরকার এমনি এমনি ঝাড় খায়নি, বুঝলেন, সুষমা সুরমা বর্ণালীর ভল্যুম কমিয়ে সব শুনল। বুঝল গার্ডেন শাড়ি হল না। চাকরি হলে হত। কাঁধে হাতের স্পর্শ। পিতৃদেবের। বলল, এ আর আশ্চর্য কী। পায়খানা সেরে একটু আয়। কথা আছে। কী কথা দেবু বোঝে। দেখ, আমরা শ্রীসর্বানন্দের বংশধর…। পায়খানা ঘরে বিড়ি খেতে খেতে মনস্থির করে ফেলে দেবু। বলে, বাবা, রাজি।

গায়ত্রী মন্ত্র মনে আছে তো?

আছে।

রোজ এখানে বসে থাকবি। কাজ দেখবি। আমি হাতে কলমে দেখাব। এখন এটা দেখ। পুরোহিত দর্পণ, তন্ত্রসূক্তসার। এইসব বইগুলির তলা থেকে একটা বাঁধানো খাতা বার করলেন।

১০ই আশ্বিন। শুক্রবার 
প্রণামী বাবদ—৬.০০
নিরাপদবাবুর ক্যাটস্‌-আই শোধন২০.০০
মোট২৬.০০
১১ই আশ্বিন। শনিবার 
কালী প্রণামী বাবদ—১৮.০০
শনি দক্ষিণা বাবদ—৪৮.০০
কালী কবচ—২০.০০
পরমেশ বসুর নীলা শোধন—২০.০০
মোট—১০৬.০০
১২ই আশ্বিন। রবিবার 
সনাতন মুখটির গৃহপ্রবেশ 
দক্ষিণা বাবদ—২০.০০
প্রাপ্ত দানসামগ্রী বিক্রয় 
দি আইডিয়াল ডেকরেটার্স কর্তৃক প্রাপ্ত—১৩৬.০০
কালী প্রণামী—৮.৫০
মোট—১৬৪.৫০

সিনসিয়ারলি মায়ের কাজ করলে মা ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেন। বুঝলি। চাকরি করে আর ক’টাকা পেয়েছি। এতবড় সংসার প্রতিপালন মায়ের দয়াতেই হচ্ছে। বলি কী, চাকরিরও চেষ্টা কর, ক্রিয়াকর্মও শেখ! আমরা শ্রীসর্বানন্দের বংশ…

অঙ্গন্যাস ও করন্যাস শিখতে শিখতেই কালীপুজো চলে এল। অ্যালুমিনিয়াম চুর দিয়ে ৮০টা ইলেকট্রিক তুবড়ি ঠাসল দেবপ্রসাদ। দু’ডজন বুড়িমার চকোলেট বোমা— মুরগিহাটা থেকে। খাঁড়ায় ধার দেয়া হল। চাকরি না হোক, বলি তো হতেই হবে। কাপড় ছোপানো হয়েছে লাল। মায়ের গলায় জবার মালা। পাঁঠার গলায় জবার মালা। বলি হবে। কালাচাঁদ পাঁঠাটাকে স্নান করিয়ে এনেছে। ছোট ছোট শিং দুটোয় সিঁদুরের ফোঁটা। কালাচাঁদ পাঠার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ওঁং হৈং হৌং ইমং পশুং স্বর্গং প্রদর্শয় মুক্তিং নিয়োজয় স্বাহা। তারপর খাঁড়াটা তুলে নিল কালাচাঁদ। মাথাটা টেনে ধরেছে দেবুর এক জ্ঞাতিভাই। প্রতিবারের মতোই ঠ্যাং টেনে ধরেছে দেবু। খড়্গ ওঠাল কালাচাঁদ। চারিদিকে জয় মা। কাসর ঘণ্টা। ইমং ছাগপশু বহ্নিদৈবতং তুভ্যমহং ঘাতয়িষ্যে। খড়্গ নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ— মানুষের আর্তনাদ, কী সর্বনাশ হল রে…

মাথাটা শরীরে রয়েছে। বলি হয়নি। এ কী করলে মা। খড়্গ তোলে কালাচাঁদ। শরীরে সমস্ত শক্তি দিয়ে খড়্গাঘাত করে। আবার আর্তনাদ। আশালতা লুটোপুটি খায় মাটিতে। উমা গড়াচ্ছে। তুই আমায় খা, আমায় খা, আমি অভাগিনী। দেবু পাঁঠাটার পা ছেড়ে দেয়; কালাচাঁদ উন্মাদের মতো নিজের মাথায় কিল মারতে থাকে। শিবপ্রসাদ মাথা ঠান্ডা রাখে। নিজ হাতে খড়্গ তুলে নেয়। বলে স্থির হও। মাতৃনাম জপ করো সব। দেবু, নাও, পা ধরো, চোখ বুজে মন্ত্রোচ্চারণ করো, জয় মা। খড়্গ নেমে আসে। রক্তচ্ছটা। শিরচ্ছিন্ন হয়। জয় মা। ঝটপট করতে থাকে ছাগ কবন্ধ। এবার বিড়ি ধরান শিবপ্রসাদ।

কিন্তু এই ছাগমুণ্ড পুজোয় উৎসর্গীকৃত হবে না। এটা বিঘ্নবলি। এক কোপে শিরচ্ছেদন না হলে বহুদোষ৷ বলিবিঘ্ন হলে সংসারে অমঙ্গল হয়। নিয়মানুযায়ী সেই ছাগপশু এক হাজার আট টুকরো করে হোম করা হল। যে দেবী যত জাগ্রত সেই দেবী তত হিংস্র। পাবলিক এটাই মনে করে। ওই হোমে কি এই কালী খুশি হবেন? প্রফেসার বউদি একদিন শেষরাতে হঠাৎ শুনলেন ভটচায্যি বাড়িতে কান্নার রোল। কালী নিশ্চয়ই কাউকে নিয়েছেন ভেবে ধড়মড় করে উঠে গেলেন, তারপর বুঝলেন ওটা স্বপ্ন। পাড়ায় আলোচনা হতে লাগল, কালী যদি জাগ্রত হয়, নিশ্চয়ই কাউকে খাবেন।

কালাচাঁদ খুব মনমরা। মাঝে মাঝে একা একা কী সব বকে। দেবুকে বলেছে, ওকে যদি মা নেন, নিক, ওর আর কেই-বা আছে, কীই-বা আছে। দোষ তো আমারই, পিঁয়াজ খেয়েছিলাম।

ভটচায্যিদের বাড়ির উলটোদিকেই থাকে যূথিকা। চৌধুরিদের ভাড়াটে। কালো ব্যাগ নিয়ে বিকেলে বার হয়, ফেরে লাস্ট ট্রেনে। ও নাকি প্রায়ই দেখে রাত বারোটায় বাইরের ঘরে উমা ঢুকছে। বাইরের ঘর মানে মন্দির, আর কে না জানে ওপরে কালাচাঁদ শোয়।

লাল খাতা খুললে আজকাল বড় দুঃখ হয় দেবুর।

৬ই অগ্রহায়ণ। বৃহস্পতিবার 
প্রণামী বাবদ—৪.৫০
৭ই অগ্রহায়ণ। শুক্রবার 
প্রণামী বাবদ—৫.০০
কালী কবচ—৫.০০
৮ই অগ্রহায়ণ। শনিবার 
কালী প্রণামী—৬.০০
শনি দক্ষিণা—১২.০০

সংসারে যা হোক একটা অমঙ্গল না এলে ফিউচার বেশ খারাপ, দেবু বুঝতে পারে।

জীবনবাবু আজকাল বাজার যাবার সময় মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে জাস্ট হাতের সঙ্গে কপালটা টাচ করান। সেদিন দেবুর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলে জীবনবাবু বললেন, একদিন আপনার সঙ্গে বসব বুঝলেন, আলোচনা আছে। মায়ের কাজ করেও তো সংগঠনের কাজটাজ করতে পারেন।

কালাচাঁদের হঠাৎ একদিন বুকে ব্যথা! প্রচণ্ড। কথা বলতে পারে না, নিশ্বাস নিতে কষ্ট। একেই বলে ধর্মের মার। হার্ট অ্যাটাক। কালী তবে কালাচাঁদকেই নিলেন। এই মুহূর্তে কালাচাঁদের মরণ অনেক দামি। ওর মৃত্যুর উপর নির্ভর করছে কালীর মাহাত্ম্যকথা, আর একটা গোটা সংসার।

কালাচাঁদ ছটফট করছে। তখন দুপুর। শিবপ্রসাদ ধীরে ধীরে বলল, কী রে দেবু, এখন ডাক্তার-টাক্তার পাবি? ওরা তো বিশ্রাম করছে। দেবু বলল, গিয়ে দেখি। শিবপ্রসাদ বলল, মা যদি নেবেন মনে করেন, ডাক্তার কী করবে। দেপ্রসাদ বলল, তবু বিনা ডাক্তারে তো রাখা যায় না। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে কালাচাঁদের। দেবু ডাক্তার ডাকতে বের হয়। একটা সিগারেট ধরায়। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে সাঁটা গণশক্তিটা পড়ে, অনেকদিন পর। কবিতা পড়ে—‘সংহতি শপথ’।

হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহ

রক্ত মানে আমার দেশের মানুষ

আর তাদের চূর্ণ ইচ্ছামালা

হৃৎপিণ্ড থেকে….

হার্ট। হার্ট অ্যাটাক বেশি সময় দেয় না। আহা রে কালাচাঁদ! আস্তে আস্তে মধুসূদন ডাক্তার ব্যস্তসমস্ত হয়ে এলেন। রুগি দেখলেন। কালাচাঁদ কথা বলছে। বলছে বুকে ব্যথা। কোনখানে? না এইখানে, মধ্যিখানে। মধুসূদন ডাক্তার বললেন, চিন্তার কিছু নেই মনে হচ্ছে। চার চামচ ওষুধ খাইয়ে দিলেন। একটু পরেই লম্বা ঢেঁকুর তুলল কালাচাঁদ। ডাক্তার বললেন, গ্যাস।

ছিঃ

এর কিছুদিন পরই মণিপুর রাজ্য লটারির পঞ্চম পুরস্কারে ৫০০০ টাকা কালাচাঁদের নামে ওঠে। স্টেশনের লটারিওলা বড় বড় করে পোস্টার লিখে রাখে দোকানের সামনে। শিবপ্রসাদ কালাচাঁদকে বিদেয় করেন।

কালাচাঁদ বিহনে প্রচুর কাজ বেড়ে গেছে দেবুর। পুজোর গোছগাছ। মৎস্যাদি দশাবতার, গণেশাদি পঞ্চদেবতা, কত ফ্যাঁকড়া। নৈবেদ্য তৈরি, দুর্বা, তুলসী, চন্দন, নানান কাজ। শিবপ্রসাদ থাকলে কালীপুজোটা তিনি স্বহস্তে করেন। নারায়ণ পুজোটা দেবপ্রসাদ করে। কিন্তু যজমানিতে শিবপ্রসাদ বাইরে গেলে কালীপুজো দেবপ্রসাদকেই করতে হয়। বাজার খুব খারাপ। একটা অমঙ্গল এল না। একটা অমঙ্গলের দেবীমাহাত্ম্য সংসারটাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারত।

এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ডটা রিনিউ করে এসে দুপুরবেলাটা চুপচাপ মন্দিরে বসেছিল দেবপ্রসাদ। সুষমা সুরমা সিনেমায় গেছে। উমা কোথাও যেতে চায় না। ওকেও নিয়ে গেছে ওরা। চিত্রবাণীতে উত্তম সুচিত্রার বই। আশালতা কাঁথা সেলাই করছে ঘরে। শিবপ্রসাদ যজমানিতে গেছে নৈহাটি। বাইরে রোগা রোগা রোদ্দুর। মেঘ মেঘ আকাশ। উত্তরের মৃদু হাওয়া। ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অবলম্বনহীন। একটু অবলম্বন চাই। সামনে মা কালী। করালবদনী। মণ্ডুমালিনী। লোলজিহ্বা। দাঁড়িয়ে আছে। রক্তচন্দনের বাটী থেকে কিছুটা লাল চন্দন তুলে নেয়। কপালে টিপ পরে। অমঙ্গল চাই। একটা ভ্রমর ঘরে ঢুকল। পচা, পঞ্চানন, উমার ছেলেটা গুটিগুটি বের হয়েছে ঘর থেকে। হাতে জুতোর বাক্স। ওটা জাহাজ। কাল একবার ও বলেছিল, মামু এতা জাহাজ, জলে ভোঁ। পচা উঠান অতিক্রম করে। হাঁটে। একবার পড়ে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায়। সরু সরু পায়ে চলতে থাকে পিছল পুকুরের দিকে। ঘট বিসর্জন হয় এই পুকুরে। হেঁটে যাচ্ছে পঞ্চানন। সরু সরু পা। হাতে জাহাজ। জাহাজ ভাসাবে। দেবপ্রসাদ চোখ বোজে। করাল বদনাং ঘোরাং মুক্তকেশী চতুর্ভুজাম। চোখ বন্ধ করে থাকে। কান সজাগ। জলের শব্দ চাই। অমঙ্গলের শব্দ। অমঙ্গলই এখন অবলম্বন। চোখ বন্ধ। ভ্রমরের ভোঁ ভোঁ। এবার জলের শব্দ শোনে। জলেরই শব্দ। পতনের শব্দ। স্থির হও দেবপ্রসাদ…

দেবু লাফিয়ে ওঠে। ছুটে যায় পুকুরের দিকে। জলের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে পচা, পুকুরে ভাসছে গাছ থেকে সদ্য খসে পড়া ঝুনো নারকেল। তখন দেবু দু’হাত বাড়ায়। যোজন বিস্তৃত দু’হাত দিগন্তরেখা স্পর্শ করে। দেবু বুকে জড়িয়ে ধরে পচাকে। ওকে বুকে নিয়ে ছুটে আসে কালীমন্দিরে। কালীর সামনে দাঁড়ায়। কোমরে হাত। ডুকরে কেঁদে ওঠে। জলে গাল ভেজে। পচার মুখ দিয়ে লালা গড়ায়। দেবু পচাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় ঘষতে থাকে নিজের মুখ, আর কপাল থেকে মুছে যেতে থাকে রক্তচন্দন তিলক। কেবলই বলতে থাকে, পচা রে, তুই আমাকে বাঁচা। পচা বলে, অ মামু জিলপি খাব।

প্রতিক্ষণ, ১৯৯২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *