পুরোনো দেওয়াল

পুরোনো দেওয়াল

হাড় জিরজিরে রোগা ছেলের মতো ইট বের করা দেওয়ালের গলি। দু-পাশেই শুধু দেওয়াল, জানলা নেই, দরজাও না। গলিটা খুব নির্জন। জগদীশ নিশ্বাস টানলে গন্ধটা পায়। অত্যন্ত মৃদু মাটির গন্ধের সঙ্গে ভিজে শ্যাওলার গন্ধ। গন্ধটা মিষ্টি। শরীর অবশ করে নেওয়ার মতো আমেজ যেন গন্ধটার সঙ্গে মিশে থাকে। যেন এইখানে দাঁড়ালে অনেক পুরোনো কথাকে মনে পড়বে।

রোজ না, কিন্তু কখনও-কখনও সন্ধ্যাবেলা এই গলিটা দিয়ে হেঁটে আসতে জগদীশের গা–টা ছমছম করে। ভয় নয়, কেমন বিচিত্র একটা অনুভূতি। একটা টিমটিমে আলো গলিটার কোণে দাঁড়িয়ে জ্বলে। মাটির ওপর নিজের পায়ের শব্দটা অনেক বড় হয়ে তার কানে লাগে। গলিটাকে মনে হয়, একটা প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক গুহার মতো। নিজেকে মনে হয় কোন এক প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মতো, যে অনেক রোদে পুড়ে, জলে ভিজে পরিশ্রান্ত হা–ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ একটা অনাবিষ্কৃত আশ্রয়ের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিল। এই সেই গুহা যেন। চোখ দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু যেন অনুভব করা যায়, দেওয়ালে বিচিত্র সব ছবি খোদাই করা। একটা পবিত্র শুষ্ক হাওয়া গুহাটার ভিতর খুব মৃদু হয়ে বইছে। আর কেবলই মনে হয়, যারা এই গুহাকে পিছনে ফেলে চলে গেছে, তারা আর ফিরে আসবে না। কেন তারা ফিরে আসবে না? জগদীশ ভাবে। তারপর মনে। হয়, বোধহয় প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলে আর ফিরে আসতে নেই।

জগদীশের ইচ্ছে হয়, এইখানে হাঁটু গেড়ে বসে, যারা চলে গেছে তাদের মঙ্গলের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। সত্যিই সে প্রার্থনা করতে বসে না, কিন্তু কথাটা মনে হলেই কেন যে সে নিজেই জানে না, তার কান্না পায়। তার মোলো বছরের অপরিণত ছিপছিপে দেহটা সেই কান্নার আবেগে কাঁপতে থাকে, কুঁকড়ে যেতে চায়, আর তারপর গলার কাছে একটা দলা পাকানো দুঃখকে অনুভব করতে-করতে সে দৌড়তে আরম্ভ করে। গলির শেষে বাঁ-দিকে মিত্তিরদের পোড়ো বাড়িটার উঠোনটা ডিঙিয়ে বাবুপাড়ায় ঢুকে পড়ার পর সে স্বস্তি পায়।

গোপালদার মনোহারী দোকানে একটা মস্তবড় হ্যাজাক জ্বলে। রাস্তাটা সেখানেই দুটো ভাগে ভাগ হয়েছে। আলোটা রাস্তাটার অনেকখানি পর্যন্ত উজ্জ্বল করে রাখে। এই আলোটা দেখলে বেশ ভালো লাগে, মোড়ের মাথায় কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে গল্প করে। গোপালদার দোকান থেকে মৃদু ধূপের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আর তখন শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি অনুভব করতে করতে জগদীশের বাড়ির কথা মনে হয়।

বিকেল বেলায় বাড়ি ফিরে আসাটা বিশ্রী। বিকেল বেলাতে যেন মাকে ভীষণ গম্ভীর আর রাগি বলে মনে হয়। যেন একটু ছুঁতে গেলেই মা ভীষণভাবে ধমকে দেবে। বোধহয় এ-সময়টাতে মা সাজগোজ করে থাকে বলেই ওরকম মনে হয়। ভাবতে-ভাবতে জগদীশবাড়ি ঢুকল।

খিদে পেয়েছে। ভয়ংকর। কলতলার দিকে যেতে-যেতে জগদীশ চেঁচিয়ে বলল , খেতে দাও মা, খিদে পেয়েছে। মা কোথায় আছে না জেনে না ভেবেই সে চেঁচাল। বিকেল বেলা মাকে সাজগোজ করতে দেখলে ভালো লাগে না। সাজগোজ করলেই মায়েরা যেন গম্ভীর হয়ে যায়। কলতলার আবছা অন্ধকারটার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার মনে হল, সে মাকে খুব ভালোবাসে। খুব। হঠাৎ কেন যে কথাটা মনে হল তা সে বুঝতে পারল না। এমনি। হঠাৎ–হঠাৎ কতকগুলো অদ্ভুত কথা মনে হয় যে, তার হাসি পায়। মগটা জলে ডুবিয়ে তারপর তুলে তারপর আবার ডুবিয়ে জলের গুরগুর শব্দটা শুনল সে।

সাবানটা কোথায়। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। সাবানটা হাতড়ে-হাতড়ে খুঁজতে খুঁজতে সে ভাবল কত অদ্ভুত ইচ্ছেই যে মনে আসে।

এই ঘর জগদীশের। ঘরটা ছোট। একটা করে খাট, চেয়ার, টেবিল।

পা দুটোকে নিয়ে অস্বস্তি। টেবিলের তলা দিয়ে পা দুটো ভালো করে ছড়িয়ে দেওয়া যায় না –ওপাশের দেওয়ালে গিয়ে ঠেকে যায়। শরীরটাকে কিছুতেই একভাবে রাখা যায় না। শরীরটাকে মোচড়াতে ইচ্ছে করে, ভাঁজে–ভাঁজে ভাঙতে ইচ্ছে করে, আর একটা অস্থিরতা যেন ক্রমাগত বুকের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। পড়ার বই খোলা থাকে, কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করে না। তারপর হঠাৎ এক সময়ে ঘরটাকে শূন্য নিরর্থক মনে হয়। একটা কিছু যেন ঘটা উচিত, অথচ যা কিছুতেই ঘটছে না। একটা কিছু করা দরকার, কিছু একটা করতে হবে ভাবতে ভাবতেই ঘুম এসে যায়। আর তারপর ঘুমে ঢুলতে–ঢুলতে চেয়ার থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বিছানায় যেতে-যেতে সারাদিনের ভাবনাগুলো তালগোল পাকিয়ে ধোঁয়াটে হয়ে এক সময়ে স্বপ্ন হয়ে যায়। অদ্ভুত সমস্ত স্বপ্ন।

কে যেন তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারল না কে তাকে ডেকেছে। আবছা–আবছা গলার স্বরটা কানে ঢুকছিল, নিজের নামটা শুধু বুঝতে পারছিল। রাত বেশ হয়েছে, খেতে যেতে হবে। ঘুম থেকে উঠে উঠোন রান্নাঘরে খেতে যেতে একদম ইচ্ছে করে না। বরং রাগ হয়। বাড়ির সকলের ওপর রাগ করতে ইচ্ছে হয়। কী দরকার ছিল ডাকবার! এক রাত না খেয়েও বেশ থাকা যেত।

বাঁ-পাশে বাবা, ডান পাশে মিন্টু, বেবী সামনে, জলচৌকির ওপর মা বসে। একটা হারিকেন মেঝেতে রাখা। কালি পড়ে হারিকেনটা আবছা হয়ে এসেছে বলে কিংবা সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে বলে কারুর মুখ ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না জগদীশ। রান্নাঘরের দেওয়ালে তাদের মস্ত মস্ত ছায়াগুলো দুলছে, কাঁপছে। জগদীশের মনে হল যেন তারা সবাই বাবা, সে, পিন্টু, বেবী, সানাই মাকে ঘিরে বসেছে একটা গল্প শুনবে বলে। তারা সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে মা গল্পটা বলতে-বলতে হঠাৎ থেমেছে–এক্ষুনি শুরু করবে।

জিভে কোন স্বাদ পাচ্ছে না সে। পাতে ক’টা তরকারি, তাও যেন গুনতে ইচ্ছে করছে না। বিশ্রী লাগছে।

–আর দুটি ভাত দেব তোকে? মা বলল ।

–না, খিদে নেই।

–বাইরে থেকে কী সমস্ত ছাইপাঁশ খেয়ে আসিস, রাতে তাই খেতে পারিস না।

পিঁড়িটা ঠিকমতো মেঝেতে বসেনি। ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। সামনের দিকে ঝুঁকে ভাত তুলতে গেলে শব্দ হচ্ছে ঠক, পেছন দিকে হেলে মুখের গ্রাসটাকে গিলতে গেলে ঠকঠক, ঠুক ঠাক ঠুক…

–শান্ত হয়ে বসে খেতে পারো না? বাবার গলাটা ভারী আর গম্ভীর। পোড়ো কেরোসিনের গন্ধটা বিশ্রী লাগল জগদীশের। সে খাওয়া বন্ধ করল। পিন্টু বেবীকে কি যেন ফিসফিস করে বলল । বেবী শব্দ করে হাসল। ওরা এত রাত পর্যন্ত জেগে আছে কী করে–জগদীশ ভাবল।

.

ভাত খেয়ে উঠবার পর ঘুমটা যেন কোথায় পালিয়ে যায়। আর যেন ঘুম আসবে না। অথচ শুতে হবে, রাত জাগা চলবে না। নরম বিছানা, সাদা চাদর। জগদীশ হারিকেনের কল ঘুরিয়ে সলতেটাকে কমিয়ে দেয়। ঘরটা প্রায় অন্ধকার।

এই ঘরে যেন একটা উৎসবের গন্ধ লেগে আছে। যেন অনেকদিন আগে এইখানে এক বিত্তশালী সুখী পরিবার থেকে গেছে। বাইরে অন্ধকার জমাট। এপাশে–ওপাশে বাড়িগুলো নিঃশব্দ হয়ে গেছে। আর ঠিক এই সময়ে হালকা তন্দ্রার মধ্যে অস্পষ্টভাবে জগদীশের মনে হয়, এইখানে সে অনেকদিন আগে একবার এসেছিল। বাড়িটা বেশ বড়। প্রত্যেক ঘরের ছাদে আর দেওয়ালে পুরোনো আমলের অদ্ভুত সব নকশা কাটা। আগের দিনের বড়লোকদের বাড়ির মতোই। এখন এত বড় বাড়িটায় তারা কয়েকজন মাত্র মানুষ–পুরো বাড়িটা যেন খাঁ–খাঁ করে। কিন্তু অনেক বছর আগে এখানে একটা মস্ত পরিবার থাকত। অনেক টাকা ছিল তাদের আর অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েগুলো হাসিখুশি মোটাসোটা ছিল! মেয়েগুলো ছিল খুব সুন্দরী। খুব ফরসা, গোলগাল, লম্বাটে ডিমের মতো মুখ, একটু পুরু লাল ঠোঁট, অসাবধানে এসে পড়া একটু লালচে আভার চুলগুলো তাদের সাদা কপালের ওপর খেলা করত।…ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ এক সময়ে থামে জগদীশ। ঠিক এরকম মেয়ে যেন সে কোথায় দেখেছে। কোথায় দেখেছে যেন। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। রাখী আর পাখি। রথতলার মেলার মাঠটা ছাড়িয়ে যেতে সেই নিঃশব্দ প্রকাণ্ড জমিদার বাড়িটাকে তারা বহুবার সবিস্ময়ে দেখেছে। রাখী আর পাখি ও বাড়ির মেয়ে। ওরা। বড়লোক, গাড়ি করে স্কুলে আসে। বেবী স্কুলে ভরতি হওয়ার পর বহুবার রাখী আর পাখির গল্প তাদের সবাইকে শুনিয়েছে। ওরা আজে বাজে মেয়ের সঙ্গে মেশে না, রোজ টিফিনে বাড়ি থেকে চাকর ওদের খাবার নিয়ে আসে, প্রত্যেকবার ছুটিতে ওরা বাইরে বেড়াতে যায় রিজার্ভ করা। গাড়িতে। এমনি আরও কত কী। বেবীটা বাড়িয়ে বলে, সত্যিই কি আর ওদের অত দেমাক! জগদীশ তো দেখেছে ওদের।

রোদটা সোজা হয়ে নেমেছে। ভেতরকার ছায়া ছায়া অন্ধকার আর নেই–গলিটাকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উঁচু হয়ে থাকা ইটগুলোর খাঁজে–খাঁজে ছায়া আলো দিয়ে তৈরি অদ্ভুত নকশা। বাইরে এখন গরম ধুলো ওড়া বাতাসের  ঝাঁপটা, কিন্তু এই গলিটার ভেতরটা ঠান্ডা। দেওয়াল দুটো দু-ধারে অনেক উঁচু। বাতাস ঢুকতে পারে না এই গলিটায়, তাই বোধহয় ঠান্ডা। পায়ের নীচে মাটিটা স্যাঁতস্যাঁতে। এখন এই গলিটাকে ঠিক গির্জার মতো দেখাচ্ছে। গির্জার মতো। পবিত্র, শান্ত ঠান্ডা। গির্জার মতো মস্ত বড় আর উজ্জ্বল। ধারে কাছে কেউ নেই। কেউ আসে না। জগদীশ মাটির ওপর বসল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। একটা ইঁদুর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কোথা থেকে যেন ছুটে এল। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়াল তারপর চকচকে সরু লেজটাকে বর্শার ফলার মতো পেছনের দিকে উঁচিয়ে রেখে খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল। ইঁদুরটা বেশ আছে জগদীশ ভাবল।

এখন ভরদুপুর। ওপর দিকে তাকালে দেখা যায় আকাশটা জ্বলছে। দুপুরটা ঝিমঝিম করছে চারধারে। জগদীশ ভাবল তার ঘুম পাচ্ছে, নেশার মতো ঘুম। আচ্ছন্ন বা। সে যেন একা। ভীষণ একা। দেওয়ালে অনেকগুলো শুয়োপোকা জড়াজড়ি করে আছে। জগদীশ তাকিয়ে রইল। বহু পুরোনো একটা ছবিকে তার মনে পড়ছে। যখন আরও ছোট ছিল সে তখন এই ছবিটাকে সে বোধহয় মনে মনে তৈরি করে নিয়েছিল। ঠিক ছবি নয়–খানিকটা কল্পনা আর খানিকটা স্বপ্নের। মিশেল। তার চারদিকের এখানকার চেহারাটা সেই পুরোনো ছবিটাকে তার মনে জাগিয়ে তুলছে। একটা অস্পষ্ট, গম্ভীর অথচ স্থির ছবি। একটি মেয়ে, তার লাল চুল, নীল চোখ, বাদামি ঠোঁট। আর একটা গির্জার অভ্যন্তর, লম্বা জানলা, গোল খিলান, কাঁচের শার্সি মোমবাতি। সে যেন হাঁটু গেড়ে মোমবাতি–জ্বলা বেদিটার সামনে বসে আছে। মেয়েটি তার কানে কানে খুব কাছ থেকে প্রার্থনার মন্ত্র বলে দিচ্ছে। সে তার গায়ের মিষ্টি কোমল গন্ধ পাচ্ছে। ঘুমে তার চোখ দুলে আসছে। মেয়েটা গানের সুরের মতো কথা বলছে। আরও। কী বলছে ও? আর কেনই বা বলছে! কাঁচের শার্সিটার বাইরে শেষ বেলার সূর্য ডুবে যাওয়া ম্লান ছাই ছাই আলো। জগদীশ চাইছে মেয়েটা আরও কাছে আসুক। সে তাকে স্পর্শ করুক।

কী বিষণ্ণ এই ছবি! জগদীশ ভাবল। ছবিটাকে তার ভালো লাগে না। কিন্তু ছবিটা আছে। থাকবে। কতদিন থাকবে কে জানে! হয়তো আজীবন। জগদীশ জানে না। সন্ধেবেলা বাতি না জ্বালিয়ে পড়ার ঘরে একা-একা বসে থাকলে এই ছবিটাকে মনে পড়ে। মনটা বিষণ্ণ উদাস হয়ে যায়। ছবিটা কখনওই সত্যি হয়ে আসবে না জগদীশ সেটা বুঝতে পেরেছে বড় হয়ে।

এই গলিটা অনেক পুরোনো কথাকে মনে করিয়ে দেয়। বোধহয় ভিজে মাটি আর শ্যাওলার ভারী গন্ধ আর পলেস্তারা খসে যাওয়া পুরোনো দেওয়ালগুলোর জন্যই ওরকম হয়। এখানে এসে বসলেই মনে হয় যেন এখানে সে আর নেই, সে যেন অনেক পুরোনো দিনগুলোয় ফিরে গেছে। এই দেওয়ালগুলোর যদি প্রাণ থাকত কিংবা প্রাণ আছে একথা যদি জগদীশ বিশ্বাস করতে পারত তবে বেশ হত। ছেলেবেলায় সে যখন প্রথম পড়েছিল যে উদ্ভিদের প্রাণ আছে তখন কথাটা তার ভালো লেগেছিল। ঠাকুমাকে বলতেই ঠাকুমা বলেছিলেন শুধু উদ্ভিদ কেন পাথর। পাহাড় নুড়ি, এ সব কিছুরই প্রাণ আছে, সুখ-দুঃখ আছে, ভালোমন্দের অনুভূতি আছে। ঠাকুমার কথাটা তার বিশ্বাস হয়েছিল। অনেক বাধা পেয়ে, ঘা খেয়েও সেই বিশ্বাসটা মনের কোণে তলিয়ে থিতিয়ে অনেকদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল। তারপর আস্তে-আস্তে কেমন করে সে নিজেই জানে না সেই বিশ্বাসটা হারিয়ে গেল। ঠাকুমারা মরে গেলেই কিংবা হয়তো বয়স বাড়লেই এই অদ্ভুত বিশ্বাসগুলো ভেঙে যায়। কিন্তু এই বিশ্বাসগুলো যখন ভেঙে যায় তখন ভালো লাগে না, মন খারাপ লাগে। যেন অনেক দিনের পুরোনো বন্ধুরা আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে এরকম মনে হয়। মন তখন যেন চায় এই বিশ্বাসগুলো আবার চুপিচুপি ফিরে আসুক। সে বিশ্বাস করতে পারুক যে এই দেওয়ালগুলো, এই মাটি, ওই মিত্তিরদের ভাঙা পোডড়া বাড়িটার ভেতরেও প্রাণ আছে। ওদেরও যেন প্রিয়জন আছে যারা চলে গেলে ওরা দুঃখ পায়। সেই প্রিয়জনদের কথা ওরা জগদীশকে বলুক।…এই কথাগুলো ভাবতে-ভাবতেই যেন জগদীশনিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেল। ছটফট করে উঠে দাঁড়াল। বিকেল হয়ে আসছে এক্ষুনি মাঠে যেতে হবে। দল বেঁধে তাকে খুঁজতে এসে বোধহয় ফিরে গেছে বন্ধুর দল।

.

সন্ধ্যাবেলা রত্না এল। রত্না বেবীর চেয়ে একটু বড় আর জগদীশের চেয়ে দু-এক বছরের ছোট। কাছাকাছি বাড়ি, কিন্তু রত্না যে রোজ আসে তা নয়। কেন যে আসে না তা জগদীশ জানে না। আগে কিন্তু আসত।

হারিকেনটা উজ্জ্বলভাবে জ্বলছিল। রত্নাকে শাড়ি পরতে এর আগে দেখেনি জগদীশ। নীল রঙের ফ্রকটাকে ব্লাউজের মতো নীচে পরেছে, তার ওপর নীল শাড়ি। চেনা রত্নাকে অচেনা মনে। হচ্ছে।

এই, বেবী কোথায় রে? রত্না জিগ্যেস করল। খুব ভালো করে জগদীশের দিকে না তাকিয়েই জিগ্যেস করল। ওর মুখটা লাল লাল। গলার স্বরটা ক্ষীণ। লজ্জার সুরে কাঁপল, তারপর কাঁপতে কাঁপতে বাতাসের শরীরের সঙ্গে মিশে গেল এবং তারপরেও যেন কাঁপতে লাগল।

–কেন, বেবীকে দিয়ে কী হবে? জগদীশ অনেকক্ষণ পরে বলল ।

–তা দিয়ে তোর দরকার কী! ভারী সর্দার হয়েছিস আজকাল।

–হয়েছিই তো। জগদীশ হেসে-হেসেই বলল ।

–থাক, তোকে বলতে হবে না। আমি মাসিমার কাছে যাচ্ছি।

–না, মাও জানে না বেবী কোথায় আছে। শেষ কথাটা কানে নিল না রত্না। রত্না ঘুরে দাঁড়াল। দরজার দিকে। এক পা এগোল। জগদীশ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। একটা কিছু করা দরকার না হলে ও চলে যাবে।

জগদীশ বলল ,–দাঁড়া, এইখানে বোস। আমি বেবীকে খুঁজে আনছি।

–ইশ। দাঁড়াব না, আমাকে মীরাদের বাড়ি যেতে হবে।

–বুঝতে পেরেছি, শাড়িটা দেখাতেই এসেছিলি, বেবীকে খুঁজতে নয়।

রত্না শরীরটাতে একটা মোচড় দিল। ঘুরে একটু রুখে দাঁড়ানো ভঙ্গিতে মাথাটা সোজা করে চোখের কোণ দিয়ে জগদীশের দিকে তাকাল। এই ভঙ্গিটা তার চেনা। ছেলেবেলায় খেলতে খেলতে রেগে গেলে জগদীশের দিকে অমনি ভাবে রুখে দাঁড়াত রত্না। ভঙ্গিটা দেখে জগদীশ বরাবর হয়তো, ভয় পেত না।…কিন্তু আজ রত্নাকে অচেনা মনে হচ্ছে। যেন নতুন কোনও মেয়ের সঙ্গে এই প্রথম আলাপ হচ্ছে তার। জগদীশ ভয় পেল যেন। বুকের কাছটা একটু কাঁপল। দৃষ্টিটা পিছলে নামল যেখানে শার্টিনের নীল রঙের ফ্রকটা বুকের কাছে সামান্য একটু টাল খেয়েছে। শাড়ির ওপর থেকেও বোঝা যায়। জগদীশ মেঝের দিকে তাকাল।

জগদীশ চোখ না তুলেও বুঝতে পারল রত্না হাসছে। খুব মৃদু সে হাসিটা। হাসিটা অদ্ভুত যেন অনেক কথা ওই হাসিটার ভেতর বলা থাকে কিন্তু সেগুলো যে কি তা জগদীশ বুঝতে পারে না। রত্নার পায়ের শব্দটা এগিয়ে এল। জগদীশমুখ তুলল।

রত্না হাসছেনা। রত্না ভীষণ গম্ভীর।

জগদীশ তাকাল। তাকিয়ে রইল।

রত্না বলল ,লজ্জা করল না ও কথা বলতে? বাঁদর কোথাকার!

জগদীশ ভীষণ অবাক হল। হঠাৎ কোথা থেকে এত সাহস পেল রত্না। জগদীশের হাত দুটো নিসপিস করে উঠল। দাঁতে দাঁত চাপল জগদীশ। আর একটা কিছু বললেই…। কিন্তু তবু কেন। যেন মনে হচ্ছে রত্না তার চেয়ে ঢের-ঢের বড় হয়ে গেছে। যেন রত্নার কাছে সত্যিই সে ছেলেমানুষ। ও এত বড় হয়ে গেল কেমন করে? নিজেকে খুব অসহায় লাগল তার। কিছু একটা করতে হবে ভেবেও সে চুপ করে বসে রইল। না, রত্নার গায়ে হাত দেওয়া যায় না। ওকে অনেক বড় মনে হচ্ছে। বড় মেয়েদের গায়ে হাত দিতে নেই। ওর বেণী দুটো সামনের দিকে ছাড়া রয়েছে। ইচ্ছে করলে জগদীশ ওই বেণী দুটোতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ওকে শিক্ষা দিতে পারত। কিন্তু কেন যেন জগদীশের ইচ্ছে হল না।

রত্না চলে গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ। জগদীশ অবাক হলেও কথা বলল  না। রত্না ওর বেণী দুটো নিয়ে নাড়া চাড়া করল কিছুক্ষণ। তারপর হাসল। সেই অদ্ভুত হাসিটা যেন অনেক কথা ওই হাসিটার ভেতর বলা থাকে, কিন্তু সেগুলো যে কি তা জগদীশ বুঝতে পারে না। জগদীশ চুপ করে রইল।

–কীরে কথা বলছিস না যে! রত্না বলল ।

–এমনিই।

–ইস এমনি বইকি! নিশ্চয়ই তুই—

রত্নার চোখের দিকে এবার স্পষ্ট করে তাকাল জগদীশ। রত্না যেন ভীষণ অবাক হয়েছে। খুব বড়-বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে সেই অদ্ভুত হাসিটা হাসছে রত্না। অবাক হওয়ার সঙ্গে সব বুঝে ফেলেছি ধরনের একটা ভাব। জগদীশ ভাবল, বোধহয় রত্না আশা করেছিল যে সে রেগে যাবে। রেগে গিয়ে ঠিক আগের মতোই ওর বেণী ধরে টেনে কিংবা হাত মুচড়ে দিয়ে কিংবা চড় মেরে শোধ নেবে জগদীশ। কিন্তু তা করেনি বলেই যেন অবাক হয়েছে ও। কিন্তু ওতো জানে না ওকে আজ কতো বড় আর অস্পষ্ট দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রত্না বলল , বোকার মতো মুখ করে বসে আছিস কেন?

জগদীশ চুপ করে রইল। রত্না এগিয়ে এল আর তারপর জগদীশের চেয়ারের মুখোমুখি খাটের একপাশে খুব সন্তর্পণে বসল।

ইস, রাগ হয়েছে বাবুর। রত্না আবার বলল । জগদীশ খুব স্পষ্টভাবে একটা সুগন্ধ পেল। পাউডার স্নো আর বোধহয় তেলের গন্ধ। গন্ধটা চেনা। তবু যেন জগদীশ অস্বস্তি বোধ করল। কেমন যেন সঙ্কোচে জড়সড়ো হয়ে বসল সে। রত্নাটা এত কাছাকাছি এসে বসেছে যে ওর দিকে ভালো করে তাকাতে পারছে না জগদীশ।

যেন খুব গোপন একটা কথা কানে-কানে বলবে এইভাবে মুখটা জগদীশের কাছে এগিয়ে আনল রত্না। রত্নার মুখটা খুব কাছাকাছি যেন তাকে ছোঁয়–ছোঁয়। জগদীশ একটা ঠান্ডা ভয়কে তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যেতে অনুভব করল। কেমন জ্বালা করল বুকটা। বুকটা জ্বালা করল আর কাঁপতে লাগল। রত্নার মুখটা হাসি-হাসি। রত্না বলল –এই, একটা কথা বলবি?

নিজের মুখটা দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটু পেছন দিকে হেলে জগদীশ প্রায় অস্ফুট স্বরে বলল –কী?

রত্না বলল  কাছে আয় না, অমন হেলছিস কেন?

হারিকেনটা বড় বেশি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। জগদীশ ভাবল। আলোটা আরও কম হলে–আরও কম হলে কী যে হত সে ভেবে পেল না। রত্নার মুখটা লাল–লাল। যেন কী একটা কথা নিয়ে মনে-মনেই ও লজ্জা পাচ্ছে। জগদীশ সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকল! প্রায় কাঁপা গলায় বলল –কী বলছিস বল না।

–ঠিক বলবি তো?

–হ্যাঁ।

–আজকে–আজকে আমায় কী রকম দেখাচ্ছে রে!

জগদীশের হঠাৎ হেসে উঠতে ইচ্ছে করল। খুব জোরে। হাসিটাকে সে বুকের ভেতর অনুভবও করল, কিন্তু কিছুতেই সেটা ঠোঁটে এলো না। হাসিটা বুকের ভেতরই কাঁপতে-কাঁপতে মরে গেল। জগদীশ উজ্জ্বল চোখে রত্নার দিকে তাকাল। যেন রত্না তাকে অনেক সম্মান দিয়েছে। এই যেন প্রথম নিজের মূল্য বুঝতে পারল জগদীশ। জগদীশ খুশি হল। সঙ্গে-সঙ্গে তার মনে হল –রত্নাটা কী ছেলেমানুষ!

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল জগদীশ। বারান্দায় পায়ের শব্দ। মা আসছে। মার পায়ের শব্দটা জগদীশের চেনা। একটু যেন চমকে উঠল জগদীশ। অথচ চমকানোর কোনও দারকারই ছিল না, কেন না সে এমন কিছু করছে না যে–। মনে-মনে তার নিজের ওপর রাগ হল। সে কিছুই বলল  না রত্নাকে।

–একী, রত্না কখন এলি? ঘরের দরজা থেকেই মা জিগ্যেস করল।

–এই মাত্র। রত্নর উত্তর।

কী মিথ্যুক–জগদীশ মনে-মনে ভাবল। মিথ্যে কথা বলবার কোনও দরকার ছিল কি রত্নার! ও তো অনেকক্ষণ এসেছে;–সেকথা বললেই বা কী হত।

মা ঘরে এল। হাতে এক রাশ ধোয়া শুকনো জামাকাপড়। সেগুলো আলনায় ভাঁজ করে রাখবার জন্য এগিয়ে যেতে-যেতেই মা রত্নাকে বলল –তুই ও ঘরে যা, আমি আসছি।

রত্না চলে গেল। যাওয়ার সময় দরজা থেকে ঘুরে জগদীশের দিকে তাকাল। ওর তাকানোর মধ্যে একটু হাসি ছিল। জগদীশ ভাবল।

মার মুখটা গম্ভীর, রাগ–রাগ। রোজ এই সময়টাতে যেন মাকে ভীষণ রাগি আর গম্ভীর বলে মনে হয়। যেন একটু ছুঁতে গেলেই মা ধমকে দেবে। বিকেলবেলা গা ধুয়েছে মা। সাবানের মৃদু গন্ধ। খোঁপাটা পরিপাটি করে বাঁধা, পরনের শাড়িটা ধপধপে পরিষ্কার। এইরকম সাজপোশাকে মাকে যেন ভালো লাগে না, যেন মা–মা মনেই হয় না। যেন অন্য বাড়ি থেকে কোনও ভদ্রমহিলা বেড়াতে এসেছে। কাজ করতে-করতে যখন মার চুল এলোমেলো হয়ে যায়, কাপড়টা নোংরা আর হলুদের ছোপধরা হয়, আর মুখে ঘাম জবজব করতে থাকে, তখন যেন মাকে ভীষণ ভালো লাগে, আদর করতে ইচ্ছে হয়। বারবার মনে হয় মার বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছে কাজ করতে। বোধহয় মা’র কষ্টের জন্যেই তখন মাকে অত ভালো লাগে।

মা জগদীশের দিকে তাকাল। বলল ,–তুই পড় না। রাতদিন বসে-বসে কী যে ভাবিস ছাইভস্ম।

–মা, তুমি আমার কাছে একটু বসবে? জগদীশ বলল ।

–কেন রে!

–এমনিই। ভালো লাগছেনা। বোলোনা।

–বসবো কী করে, ও ঘরে রত্না বসে আছে একা-একা।

–কেন, বেবী আসেনি?

–কোথায়, দেখছি না তো। তার তো আড্ডার শেষ নেই।

–তাহলে রত্নাকেও এই ঘরে ডাকো।

মা কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তাকাল আমার দিকে। যেন হঠাৎ আমাকে নতুন করে দেখছে মা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, তবুও জগদীশের মনে হল মার মুখটা যেন বদলে গেল। মা খুব গম্ভীর হল। মা খুব আস্তে বলল ,–না। তুমি পড়ো।

মা চলে গেল।

নিজেকে ভীষণ বোকা বলে মনে হল জগদীশের। মাকে যেন সে বুঝতেই পারল না। তারপর আস্তে-আস্তে সে অনুভব করল যে, একটা বিরক্তি মেশানো ক্ষোভ আর লজ্জা তার মন জুড়ে বসেছে। তার রাগ হল। ইচ্ছে হল একটা কিছু  ছুঁড়ে ভেঙে ফেলে রাগটা মেটায়। তারপর কেমন একটা হতাশায় ভেঙে পড়তে-পড়তে সে টেবিলের ওপর দু-হাত রেখে মুখ গুজল। একবার ইচ্ছে হল এ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বারান্দায় কিংবা ও ঘরে। তারপর একটা সঙ্কোচ এল। না, যাওয়া যায় না। একটা যেন অলিখিত অকথিত আইন আছে। সে আইনটা আঙুল উঁচিয়ে বলল , না তুমি যাবে না। সে অনুভব করল, খানিকটা স্বাধীনতা সে হারিয়ে ফেলেছে। বুকটা জ্বালা করছে। আজকের বিকেলটা যেন খুব ভালো হতে গিয়ে খুব খারাপ হয়ে গেল।

জগদীশ ভেবেছিল রত্না চলে গেছে। কতক্ষণ সে ঘুমিয়েছিল তা সে জানে না। খুব বেশিক্ষণ নয় নিশ্চয়ই। পিঠে কিল খেয়ে উঠে দেখল, রত্না। রত্না হাসছে।

পিঠে হাত বোলাতে-বোলাতে জগদীশ বলল ,–মারলি কেন?

–এমনিই।

–হাসছিস কেন?

–এমনিই।

–তোকে মারলে কেমন হয়?

–ইল্লি। মারা এত সোজা!

রত্না ঘুরে দাঁড়াল। রত্না চলে যাবে। দরজাটা খোলা। হারিকেনটা উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে। জগদীশের মনে হল রত্নার সঙ্গে কার যেন মিল আছে। ঘুরে দাঁড়ানোর ভঙ্গী আর হাসিটার সঙ্গে কার যেন মিল আছে। কার? কেন জানে! কে জানে কেন শরীরে কাঁটা দিল তার!

–কালকে সকালে আবার আসব আমি। বেবীকে থাকতে বলিস। বলতে-বলতে দরজার চৌকাঠের ওপাশে একটা পা বাড়াল রত্না।

–দাঁড়া, তোকে একটা কথা বলা হয়নি। জগদীশ তাড়াতাড়ি বলল ।

–কী?

–রাখী আর পাখিদের চিনিস?

–হ্যাঁ। কেন?

–তোকে দেখতে ঠিক রাখির মতো লাগছে। কেন যেন হঠাৎ কথাটা বলল  জগদীশ তা সে নিজেই বুঝল না।

রত্না বলল , যা।

রত্না লাল হল একটু, যেন খুশি হল। তারপর একটু কী যেন ভেবে নিয়ে বলল –রাখীর বিয়ে, জানিস?

জগদীশ চমকে উঠল। কথা বলল  না, বলতে পারল না। রত্না নিজেই আবার বলল ,–এ মাসের সাতাশে।

–তুই কী করে জানলি? জগদীশ অবিশ্বাসের সুরে বলল ।

তার বুকের ওপর দিয়ে খুব ভারী পায়ে কে যেন মাড়িয়ে গেল! বুকটা মোচড় দিল, তারপর শূন্য হয়ে গেল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। খুব জোরে চিৎকার দিতে গিয়েও পারল না সে। সে যেন মরে যাচ্ছে আর মৃত্যুর অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েও সে যেন দেখতে পাচ্ছে তার চারপাশে অনেক লোক। তাদের মুখগুলো দেখা যাচ্ছে না। তারা সব অশরীরী মূর্তির মতো নিঃশব্দে তার চারপাশে ঘুরছে ফিরছে, আর চাপা গলায় কথা বলছে। কী এত কথা ওদের। কোথা থেকে যেন মৃদু আর গভীর নীল আলো ঘরটার মধ্যে এসে পড়েছে। ঘরটা ভীষণ ঠান্ডা। কে যেন খুব কাছে এল আর চাপা গলায় তাকে জানাল যে, তার মা-ও মরে গেছে। জগদীশের ভীষণ কান্না পেল। কিন্তু সে কাঁদতে পারছে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। দরজা খুলে কারা যেন ঢুকল একটা দেহকে বহন করে নিয়ে। জগদীশ টের পেল ওই দেহটা তার মার। মা মরে গেছে। ওরা মার দেহটা ঠিক তার পাশেই শুইয়ে রাখল। জগদীশ ভাবল, তার যেন বিশ্বাস হল মা আবার বেঁচে উঠবে। ঠাকুমা যখন। মরে গিয়েছিল তখনও জগদীশ ঠিক এ কথাটাই ভেবেছিল, ঠাকুমা নিশ্চয়ই বেঁচে উঠবে আবার। যেমন করেই হোক। কিন্তু ঠাকুমা বাঁচেনি। তার শিয়রে বসে কারা যেন কাঁদছে। জগদীশ চোখ তুলল। রাখী আর পাখি। আর তার পায়ের কাছে বসে রত্না। ওরা সবাই কাঁদছে। জগদীশ একটুও অবাক হল না। যেন সে এরকমটাই ভেবেছিল। জগদীশের কান্না পাচ্ছে। যেন কাঁদতে পারলেই সব দুঃখ জুড়িয়ে যাবে। কিন্তু কে যেন তার গলাটা চেপে ধরে আছে। কিছুতেই সে কাঁদতে পারছে না। রাখী–পাখি–রত্না তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা জগদীশকে মরে যেতে দেখছে। জগদীশদাঁতে দাঁত চাপল। সে মরবে না, কিছুতেই না…।

ঘুম ভেঙে তড়বড় করে উঠে বসল জগদীশ। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকটা ধড়ফড় করছে। হ্যারিকেনটা তেমনি জ্বলছে। বইগুলো খোলা। জগদীশ উঠে দাঁড়াল। খুব আশ্বস্ত হয়ে সে অনুভব করল, মা-বাবা–পিন্টু–বেবী সবাই জেগে আছে। বেঁচে আছে। এখনও খাওয়ার ডাক পড়েনি।

মা ডাকছে। জগদীশ উত্তর দিল না। মা এ ঘরে এল,–ওমা, তুই জেগে আছিস। আমি ভাবলাম বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিস। খেতে যাবি না!

–হুঁ।

–আয়, সবাই বসে আছে তোর জন্যে।

–তুমি আমার কাছে এসো একটু।

মা কাছে এল,–কেন রে; শরীর–টরীর খারাপ নয় ত’? জগদীশমাকে ছুঁলো। মাকে খুব ভালো লাগছে। মা বেঁচে আছে। মা হাসছে। জগদীশমার কাঁধে মুখটা গুঁজে দিল,মা, মা, মা, মাগো, মামণি গো।

তার চোখে জল এল হঠাৎ। কেন যে কান্না পাচ্ছে তার, তা সে বুঝতে পারল না। কান্নাটা বুক ছাপিয়ে, গলা ছাড়িয়ে, শিরায় শিরায় আলোড়ন তুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গলাটা বুজে আসতে চাইছে।

–কী হল তোর হঠাৎ?

জগদীশ কথা বলতে পারল না। জগদীশ কান্নাটাকে প্রাণপণে চেপে রাখল।

দুপুর। ঘরটা বিশ্রী গরম। ঘর থেকে জগদীশ বাইরে এল। তারপর আস্তে-আস্তে হাঁটতে শুরু করল।

মিত্তিরদের নির্জন পোডড়া ভিটেটা প্রায় নিঃশব্দে ডিঙিয়ে গলিটার ভেতর এসে দাঁড়াল সে। মাটির ওপর বসল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। একটা নরম ঠান্ডা মৃদু বাতাস যেন তাকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরল। খুব ভালো লাগল তার। দুপুরের রোদ্দুরটা চোখ রাঙিয়ে তাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। গলিটা স্নেহশীলা ঠাকুমার মতো, মায়ের মতো তাকে আগলে নিল। দুপুরটা গলির বাইরে দাঁড়িয়ে শাসাচ্ছে!

জগদীশ চুপ করে বসে রইল। জগদীশের মনে হল এই দেওয়াল দুটো একদিন ভেঙে পড়বে, কিংবা কেউ এসে ভেঙে ফেলবে। কোন কিছুই চিরকাল থাকে না। থাকবে না। যেদিন এ দেওয়াল দুটো ভেঙে পড়বে সেদিন জগদীশ খুব দুঃখ পাবে, খুব কষ্ট হবে তার। এই দেওয়াল দুটো তাকে অনেকদিন আশ্রয় দিয়েছে, শান্তি দিয়েছে। পোষা কুকুরছানা মরে গেলে সকলের সামনে কাঁদতে না পেরে এইখানে এসে কেঁদেছে ছেলেবেলায়। কতবার ডাঁশা পেয়ারা, কাঁচা আম কিংবা মা-বাবার চোখের বিষ তার ধনুকটা ছেলেবেলায় এইখানে এসে লুকিয়ে রেখেছে সে। কেউ টের পায়নি। এই দেওয়াল দুটো তার বিশ্বস্ত আত্মীয়ের মতো, সমবয়স্ক বন্ধুর মতো তাকে সঙ্গ দিয়েছে। কিন্তু একদিন এই গলিটাও ধ্বংস হয়ে যাবে, মরে যাবে। যেভাবে তার ঠাকুমা মরে গেছে। কেউ বেঁচে থাকবে না। মা, বাবা, বেবী, পিন্টু, রত্না, রাখী, পাখি–এরা সবাই একদিন মরে যাবে। শেষ হয়ে যাবে।

ঠাকুমাকে সে ভয়ংকর ভালোবাসতো। একদিন রাত্রিবেলা কে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। সবাই কাঁদছিল, জগদীশকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে মা কাঁদছিল। জগদীশ ভেবেছিল ওরা বোকার মতো কাঁদছে। আসলে ঠাকুমা বেঁচে উঠবেই। ঠাকুমা কি মরে যেতে পারে? দূর তাই কখনও হয়! ঠাকুমার ফিরে আসার অপেক্ষায় জগদীশ অনেকদিন উৎকণ্ঠ হয়েছিল।

কেন যে এমন হয়! ঠাকুমা মরে যায়, রাখী–পাখিদের বিয়ে হয়ে যায়, দেওয়ালগুলো ভেঙে পড়ে।

অস্পষ্ট ধোঁয়া ধোঁয়া অনুভূতির সঙ্গে সিরসিরে বাতাসের মতো কিছু যেন একটা বুঝতে পারল জগদীশ। যেন বুঝতে পারল এগুলোকে হতেই হয়। রত্না–রাখী–পাখিরা একদিন বড় হবে তারপর বড় হতে-হতে একদিন ঠাকুমার মতো বুড়ি হয়ে একদিন মরে যাবে। মনে হতেই যেন কেমন। খারাপ লাগল তার।

গলিটা শূন্য। জগদীশের মনে হল তার চারদিকের জগৎটা যেন একটা খোলস ছাড়িয়ে আস্তে-আস্তে নতুন হয়ে তার চোখের সামনে ফুটে উঠছে। চোখ বুজে সে দেখতে পাচ্ছে পুরোনো পৃথিবীটা যেন দূরে-দূরে সরে যেতে-যেতে তার দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। জগদীশের ঘুম পেল।

সে যেন সেই গির্জাটার ভেতরে বসে আছে। সামনে মোমবাতি–জ্বলা বেদি। খুব কাছে থেকে সেই মেয়েটি তার কানে-কানে প্রার্থনা মন্ত্র বলে দিচ্ছে। আজ তার আর ঘুম আসছে না। সে মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটি রত্না! না, রত্না নয়, বোধ হয় রাখী। হ্যাঁ, রাখীই, যার বিয়ে হবে যাবে এ মাসের সাতাশে। জগদীশের দুঃখ হল। মেয়েটি হাসছে। হাসতেই মেয়েটার মুখটা যেন তার মায়ের মতো হয়ে গেল। জগদীশ আশ্চর্য হয়ে দেখল মেয়েটির মুখে রত্না–রাখী–পাখি আর তার মা–সকলেরই মুখের আদল যেন আছে। সবাই মিলে যেন এই মেয়েটি।

মেয়েটি আরও কাছে এল। তাকে চুল। জগদীশ চমকে উঠল। তার চোখের সামনে থেকে একটা মস্ত পরদা যেন হঠাৎ সরে গেল। তখন রাখী, পাখি আর রত্নাদের সব রহস্য যেন তার জানা হয়ে গেছে। এখন যেন অনেক–অনেক কিছু, জগদীশ যা এতদিন বুঝতে পারত না, তা যেন বুঝতে পারছে। জগদীশকে ভেঙে ধ্বংস করে আবার যেন কে তাকে বাঁচিয়ে তুলছে।

জগদীশ জেগে উঠল। প্রবল যন্ত্রণার মতো একটা কান্না তার বুক থেকে উঠে আসছে। এই কান্নাটাকে জগদীশ এতদিন চেপে রেখেছিল। ইটের খাঁজে হাত দুটোকে চেপে ধরল সে। ঝুর ঝুর করে বালি পড়ল। বালি পড়তেই লাগল,–জগদীশের মাথায়, গায়ে, চোখে।

জগদীশ ফুলে-ফুলে কাঁদতে লাগল। সেই কান্নার মধ্যে খুব সামান্য, ছুঁচের মুখের মতো ছোট্ট একটা সুখ ছিল।

দুপুরটা ঘন হয়ে তার রক্তের মধ্যে জ্বলতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *