প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

পুরোনো কলকাতার জনগোষ্ঠী : একটি রূপরেখা – দেবাশিস বসু

পুরোনো কলকাতার জনগোষ্ঠী : একটি রূপরেখা – দেবাশিস বসু

সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা। ভাগীরথী তীরবর্তী এই গ্রামসমষ্টিকে সম্বল করেই একদিন এদেশে ব্রিটিশ শক্তির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। ব্রিটিশের ক্ষমতার শিকড় গভীরে ছড়িয়ে যাওয়ার পর সেই গ্রামত্রয় থেকেই জন্ম নিয়েছিল আজকের ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’—কলকাতা। এ ইতিহাস সবার-ই জানা।

কোনো গ্রামাঞ্চল যখন ধীরে ধীরে নগরে পরিণত হয়, তখন তার গ্রাম্য নৈঃশব্দকে মুছে দিয়ে শুরু হয় নাগরিক কর্মচাঞ্চল্য, গ্রাম্য নির্জনতার স্থান নেয় জনবাহুল্যের জোয়ার। কলকাতার ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনটি শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তার কর্মব্যস্ততা বেড়েছে, ক্রমাগত ঊর্দ্ধগামী হয়েছে তার জনসংখ্যা। মহাযুদ্ধের সময়ে বোমার আতঙ্কে বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংকটে সাময়িকভাবে সুনসান হয়ে গিয়েছে কলকাতা। কিন্তু সে ভীতি কাটিয়ে উঠতে বিশেষ সময় লাগেনি। তারপর আবার ‘যথা পূর্বং’ চঞ্চলতায় মেতে উঠেছে কলকাতা শহর।

প্রতিদিনই কলকাতার লোকসংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ, রোজই কিছু বহিরাগত ব্যক্তি বা পরিবার ডেরা বাঁধছেন এই শহরে, নাম লেখাচ্ছেন কলকাতার নতুন বাসিন্দাদের তালিকায়। অন্যদিকে কিছু মানুষ আবার সরেও যাচ্ছেন কলকাতা থেকে। বিগত তিন-শো বছর ধরে অব্যাহত আছে এই চলাচল। শহরে গুরুত্ব যতই বাড়ছে, ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে এই চলাচলের গতি।

তিন-শো বছর ধরে কীভাবে বহির্ভূত হয়েছে এই চলাচলের চরিত্র? সে প্রসঙ্গে একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা রচনা করাই বর্তমান নিবন্ধের উদ্দেশ্য। তবে পুরো তিন-শো বছরের কথা আমরা আলোচনা করব না। হাল আমলের কলকাতা আমাদের অনেকটাই চেনা। তাই সাম্প্রতিক অতীত বা বর্তমান কলকাতার রূপবর্ণনার ভার থাক ভবিষ্যতের আলোচকের উপরে। আমরা শুধু সাবেকি আমলের কথাই জানার চেষ্টা করি।

কলকাতার আদিম বাসিন্দা

১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলা জোব চার্নক পদার্পণ করেছিলেন সুতানুটির গঙ্গাতীরে। এই দিনটিকেই আমরা শহর কলকাতার জন্মদিন বলে গ্রহণ করেছি, কিন্তু তার যৌক্তিকতা কতটুকু? কৃষ্ণরাম দাসের ‘কালিকামঙ্গল’ বা সনাতন ঘোষাল অনূদিত শ্রীমদ্ভাগবত-এর পুথি থেকে আমরা দেখতে পাই যে, চার্নকের পদার্পণের আগেও কলকাতায় জনবসতি ছিল। কাজেই ‘বন কেটে বসত’ স্থাপন করার কৃতিত্ব চার্নকের উপর আরোপ করা যায় না। দায়ে পড়ে এ অঞ্চলে আশ্রয় নেওয়ার তিন বছর পরে চার্নকের মৃত্যু হয়। ওই তিন বছরে অর্থাৎ, চার্নকের জীবৎকালের মধ্যে, সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতার সামান্যই পরিবর্তন ঘটেছিল। সেই নগণ্য পরিবর্তনকে ‘নগরায়ণ’ বলে অভিহিত করলে তা অনর্থক অতিশয়োক্তি হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং, চার্নককে কলকাতার ‘জন্মদাতা’-র আসনে বসিয়ে ২৪ আগস্ট কলকাতার ‘জন্মদিন’ পালন করার পিছনে যতটা আবেগ, উচ্ছ্বাস বা ঔপনিবেশিক দাস্য-মনোভাব আছে, ঐতিহাসিক সত্য কিন্তু ততটা নেই।

এ প্রসঙ্গে দু-টি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এক, প্রাক-চার্ণক যুগে কলকাতায় কারা বসবাস করতেন? দুই, কলকাতার নগরায়ণ পদ্ধতি কবে থেকে শুরু হল? প্রথম প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া দুরূহ। আজও আমরা প্রাক-চার্নক যুগের কলকাতাবাসীদের কথা সঠিকভাবে জানি না। কয়েকটি পরিবারের কুলপঞ্জীতে দেখা যায়, তাদের পূর্বপুরুষদের ‘সাকিন’ ছিল কলকাতা বা সন্নিহিত অঞ্চলে। কিন্তু তথ্যসূত্র হিসেবে কুলজি-সাহিত্য খুব বেশি নির্ভরযোগ্য নয়। তাই সহযোগী প্রমাণ পাওয়ার আগে এসব কথা মেনে নেওয়া শক্ত। কলকাতার যাঁরা আদিম বাসিন্দা ছিলেন, তাঁরা পরবর্তীকালে অধিকতর শক্তিশালী বাসিন্দাদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে আস্তে আস্তে সরে গিয়েছেন। কলকাতার বাড়ি-জমির বিক্রয় কবালাগুলি ভালোভাবে পরীক্ষা করলে জমির আদিম মালিকদের সম্পর্কে হয়তো কিছু তথ্য মিলতে পারে। কিন্তু, বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে সে-কাজ এখনও সম্পাদিত হয়নি। সহস্রাধিক বছর আগে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত যখন প্রাক-চার্নক যুগের অদিবাসীদের সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন, তখন তাঁকেও হতাশ হতে হয়েছিল। কলকাতার একটি পুরোনো পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন :

ইংরাজ আগমন অধিক দিনের নহে, দুই শত বৎসরের কথামাত্র অথচ তাহার পূর্বের অধিবাসীদিগের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। আমরা কলিকাতার অতি পুরাতন অধিবাসী হইয়াও অনেকদিন হইতে যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করিয়া অতি সামান্যমাত্র সন্ধান পাইতেছি।

সেই প্রাচীন বাসিন্দাদের সন্ধান পাওয়া যে এখন আরও অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

প্রাক-চাণক্য যুগের কথা আমরা তাহলে কীভাবে জানতে পারব? স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের দলিলগুলি যে এ বিষয়ে আকর-সূত্রের কাজ করতে পারে, তা আমরা আগেই বলেছি। আর একটি কথাও এখানে বলা দরকার। কোম্পানির আমল থেকে সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজিভাষা স্বীকৃতি লাভ করে। তাই ব্রিটিশ আমলের নথিপত্রের পাঠোদ্ধার কোনো গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করে না। কিন্তু প্রাক-ইংরেজ যুগের প্রশাসনিক ভাষা ছিল ফারসি। নবাবী আমলে কলকাতা অঞ্চল কেমন ছিল, তা জানতে হলে সে যুগের ফারসি দলিলপত্র ঘাঁটতে হবে। ফারসি ভাষায় দক্ষতাসম্পন্ন কোনো গবেষক যতদিন না নবাবি আমলের নথিপত্র থেকে কলকাতা সংক্রান্ত তথ্য চয়ন করছেন, ততদিন প্রাক-চার্নক যুগ সম্পর্কে আমরা অন্ধকারেই থাকব।

এবারে আসা যাক, কলকাতার নগরায়ণের প্রসঙ্গে। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ করার ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির শক্তি সুসংহত হয়ে ওঠে, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও পায়ের তলায় নতুন মাটি পায়। ব্যবসাবৃদ্ধির ফলে কোম্পানির অধীনে বাঙালিদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্ট হয়। এই চাকরির লোভেই দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে কলকাতায়। সেই জনস্রোতের স্পর্শেই কলকাতার নগরায়ণ পর্ব শুরু হয়।

পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয় চার্নকের আগমনের প্রায় সাতষট্টি বছর পরে। এই সাতষট্টি বছরের ইতিহাসও খুব স্পষ্ট নয়। কলকাতার অজস্র প্রাচীন পরিবার দাবি করেন যে, তাঁদের আদি নিবাস ছিল গোবিন্দপুরে। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজ কোম্পানি যখন গোবিন্দপুরের দুর্গ (ফোর্ট উইলিয়াম) নির্মাণ করে, তখন তাঁদের পূর্বপুরুষরা স্থানচ্যুত হন। কোম্পানির কাছ থেকে বদলি জমি নিয়ে তাঁরা উত্তর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে বাস স্থাপন করেন। কিন্তু এ কিংবদন্তির সত্যতা সম্পর্কেও সন্দেহের অবকাশ আছে।

১৭০৬ সালে সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা গ্রাম তিনটির জরিপ হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, সুতানুটিতে ১৩৪ বিঘা ৪ কাঠার উপরে বাড়িঘর রয়েছে, টাউন কলকাতায় বাস্তুজমির পরিমাণ ২৪৮ বিঘা ৬ কাঠা। অথচ, গোবিন্দপুরে তখন বাড়িঘর রয়েছে মাত্র ৫৭ বিঘা ৯ কাঠা জমিতে। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সুতানুটি এবং টাউন কলকাতার তুলনায় গোবিন্দপুর ছিল জনবিরল এবং ঢের কম বর্ধিষ্ণু। সাতান্ন বিঘার মতো জমিতে ক-টি পরিবার আর বাস করতে পারে? বিশেষত গোবিন্দপুর তো তখন গ্রাম, এক-একটি বাড়ির আয়তন তো সেখানে কিঞ্চিৎ বিস্তৃত হওয়ারই কথা। ১৭০৬ সালে যে গোবিন্দপুর এ-রকম জনবিরল, ১৭৫৮ সালে সেই গোবিন্দপুর থেকে শত শত পরিবার স্থানান্তরিত হয় কী করে? এ সমস্যার দু-রকম সমাধান হতে পারে—১. যেসব পরিবার নিজেদের গোবিন্দপুর থেকে স্থানান্তরিত বলে দাবি করছে, তাদের সবার দাবি যথার্থ নয়। ২. ১৭০৭ থেকে ১৭৫৮ সালের মধ্যে বহু নতুন নতুন পরিবার গোবিন্দপুরে এসে ডেরা বেঁধেছিল। এখন পর্যন্ত যা তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তাতে দু-টি সম্ভাবনাই আংশিকভাবে সত্য বলে মনে হয়।

চলাচলের সূত্রপাত

চার্নকের আগমন এবং পলাশির যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে যে বহু পরিবার কলকাতা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল, গোবিন্দপুরের উদাহরণ থেকে আমরা তা জেনেছি। এই জনস্রোতের গতি এবং আয়তন যে পলাশির যুদ্ধের পর বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল, তা-ও আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। বণিকের মানদন্ড রাজদন্ডে রূপান্তরিত হওয়ার পর একদিকে যেমন কোম্পানির ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠল আর একদিকে তেমনই গজিয়ে উঠল অসংখ্য স্বতন্ত্র ইউরোপীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা ‘এজেন্সি হাউস’। এই বিপুল ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য দরকার হল বিরাট আমলাতন্ত্রের। সারা বাংলা দেশ জুড়ে ‘বার্তা রটি গেল ক্রমে’ যে, কলকাতায় গেলেই চাকরি মিলবে, ভাত-কাপড়ের দুঃখ ঘুচে যাবে। অল্পশিক্ষিত ভাগ্যান্বেষীর দল তাই যাত্রা করল কলকাতার দিকে। সেকালের ছড়ার ভাষায়—

রাতারাতি বড়লোক হইবার তরে।

ঘর ছেড়ে কলিকাতা গিয়ে বাস করে।।

প্রাক-পলাশি আমলে যাঁরা কলকাতায় ডেরা বেঁধেছিলেন, তাঁরা ততদিনে থিতিয়ে বসেছেন। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজের জয়লাভ তাঁদের সামাজিক অবস্থানকে নিরাপদ করে তুলল। যুদ্ধের ডামাডোলেও অনেকের ভাগ্য ফিরে গেল। এঁরাই হলেন কলকাতার নব্য অভিজাততন্ত্রের আদি পুরুষ। কুমারটুলির মিত্রবংশের প্রতিষ্ঠাতা ‘ব্ল্যাক জমিদার’ গোবিন্দরাম মিত্র বা শোভাবাজার রাজবংশের স্থাপয়িতা মহারাজ নবকৃষ্ণ এই শ্রেণির পুরোধা পুরুষ।

পলাশির যুদ্ধের পরবর্তী পর্বে যাঁরা কোম্পানি বা এজেন্সি হাউসগুলিতে চাকরি নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিত্তের মুখ দেখলেন। ইংরেজদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠাগুলির প্রধান কর্মচারীকে বলা হত ‘বেনিয়ান’। এ শব্দটি ‘বেনিয়া’ শব্দের ইংরেজি রূপ। বেনিয়াদের সংজ্ঞা ছিল এ-রকম :

A banian is a person by whom all purchases and all sales of goods, merchandise and produce are made and through whom all shipments are made on account and on behalf of the merchants on mercantile firm in whose establishment he is a banian…. The banian receives a dustooree or a percnetage of the sale and produce of goods and merchandise.

বেনিয়ানদের বাংলায় বলা হত ‘মুৎসুদ্দি’। নিয়োগকারীর ছত্রছায়ায় থেকে এঁরা আমদানি-রপ্তানির ব্যক্তিগত ব্যবসা করে বেশ দু-পয়সা কামিয়ে নিতেন। এদিক থেকে এঁরা ছিলেন চীনের Comparador-দের সমগোত্রীয়। সে-দিনের ভাগ্যান্বেষীদের মধ্যে অনেকেই বেনিয়ানের চাকরি জোটাতে পেরেছিলেন। নানা ফন্দিফিকিরের মাধ্যমে তাঁরা অধিগত করলেন কাঞ্চন-কৌলিন্য। ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচারের সময় এডমণ্ড বার্ক তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায় বেনিয়ানদের চরিত্র সম্পর্কে বলেছিলেন :

A gentoo banian is a person a little lower, a little more penurious, a little more exacting, a little more cunning, a little more money-making than a Jew. There is not a Jew in the meanest corner of London that is so crafty, so much a usurer, so skilful how to turn money to profit and so resolved not to give any money but for profit as a gentoo broker.

মুৎসুদ্দি বা এই ধরনের উঠতি আমলারা তাঁদের বিত্তগৌরবের মাধ্যমে ক্রমে মিশে গেলেন কলকাতার নবজাত অভিজাততন্ত্রের মধ্যে।

এভাবে যখন কলকাতায় এক বাঙালি অভিজাত শ্রেণির জন্ম হল, তখন তাঁদেরই চাহিদা মেটাতে শ্রমজীবী মানুষরা হাজির হলেন কলকাতায়। সব মিলিয়ে একটি নতুন সমাজ গড়ে উঠল পরিবর্তনশীল কলকাতায়।

জনগোষ্ঠীর বর্ণবিন্যাস

একটি লৌকিক ছড়ায় কলকাতা পত্তনের কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে চারটি গোষ্ঠীকে—পিরালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, তন্তুবায় এবং সুবর্ণ বণিকদের। প্রভাব-প্রতিপত্তির চাবিকাঠি যে এই চার সম্প্রদায়ের হাতে ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্য জাতি-বর্ণের মানুষেরও অভাব ছিল না পুরোনো কলকাতায়। তাঁরাও অনেকক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্পদ ও সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন।

কলকাতার প্রথম যুগের এই বাসিন্দারা ছিলেন গ্রাম থেকে সরে আসা গ্রাম্য বাঙালি। কলকাতায় পাড়াগুলির গড়নে তাই ছাপ ফেলেছিল বর্ণ ও পেশাভিত্তিক পল্লিবিন্যাসের গ্রাম্যরীতি। কপালিটোলা, কমবুলেটোলা, কলুটোলা, কসাইটোলা (বর্তমান বেন্টিক স্ট্রিট), কাঁসারিপাড়া, কুমোরটুলি, খালাসিটোলা, গোয়ালটুলি, গোয়ালপাড়া, চাষাধোপাপাড়া, ছুতোরপাড়া, জেলেপাড়া, ডোমটুলি (বর্তমান এজরা স্ট্রিট), ঢুলিপাড়া, তেলিপাড়া, দপ্তরিপাড়া, দর্জিপাড়া প্রভৃতি পল্লিনামগুলি থেকে বোঝা যায় যে, তৎকালীন জনগোষ্ঠী পেশা ও বর্ণের ভিত্তিতে নিজেদের বিন্যস্ত করে নিয়েছিল। কোথাও একই জাতি-বর্ণের লোক দলবদ্ধ হয়ে বসতি করেছিল, কোথাও আবার বিচ্ছিন্ন বর্ণ বা ধর্মের লোক পেশার খাতিরে একই পল্লির মেলবন্ধনে ধরা দিয়েছিল। ১৯৭৪ সালের একটি তালিকায় আমরা দেখেছি, দর্জিপাড়ায় অজস্র মুসলমান ‘ওস্তাগর’-দের মধ্যে এক হিন্দু দর্জিও রয়েছেন—তাঁর নাম মধুসূদন। আশ্চর্যের বিষয়, মুসলিম দর্জিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ‘ওস্তাগর’ অভিধাতেই তিনি বর্ণিত হয়েছেন। বোঝা যায়, সংখ্যাগুরু প্রতিবেশীদের রীতি ছাপ ফেলেছে তার উপরে। বহুজাতিক নগর-সভ্যতার এক সূক্ষ্ম চারিত্রিক দিক এই নির্বিরোধ সহাবস্থানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।

জনগোষ্ঠীর কুলগৌরব

কলকাতার আদি পর্বে যাঁরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন আক্ষরিক অর্থে ‘ভাগ্যান্বেষী’। তাঁদের না ছিল সামাজিক কৌলীন্য, না ছিল কাঞ্চন কৌলিন্য। সেই প্রারম্ভিক যুগের প্রবাদপুরুষের তালিকা করলে দেখা যাবে যে, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ভক্ত, বংশজ, পতিত (যেমন—পিরালি বা সাতশতী ব্রাহ্মণ) বা জাত-হারানো মানুষ। সামাজিক পালাবদলের সুযোগে সদ্যলব্ধ বিত্তকে প্রয়োগ করে কেউ জাত ভাঁড়িয়েছিলেন, কেউ-বা কুলজি পালটে মধ্যযুগীয় খ্যাতিমানতা থেকে বংশলতিকা টেনেছিলেন। এ দু-টি পন্থার কোনোটিই যাঁরা করায়ত্ত করতে পারেননি, তাঁরা একটি তৃতীয় পথ ধরেছিলেন। নবাবী আমলের সাবেক বনেদি পরিবারগুলির আভিজাত্য তখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। রাজশক্তি বদলে যাওয়ায় একদিকে যেমন নতুন গোষ্ঠীর ভাগ্যোদয় হয়েছে, তেমনই পুরোনো অভিজাতদের ভাগ্যে নেমে এসেছে বিপর্যয়ের অন্ধকার। টাকার জোরে কলকাতার নব্য ধনীরা অভিজাত বংশের দরিদ্র উত্তরপুরুষদের টেনে এনে তাঁদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। এভাবেই রজত মুদ্রার বিনিময়ে বিকিয়ে গিয়েছিল যুগসঞ্চিত কুলগৌরবের অভিমান।

হীন অবস্থা থেকে উঠে আসা পরিবারগুলির আমন্ত্রণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এইভাবে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় কিছু খানদানী পরিবার। হীন কুলজাত নব্য ধনীদের ছত্রছায়ায় তাঁদের জামাতা বা দৌহিত্ররা পরিণত হলেন এক একটি বংশের প্রতিষ্ঠাতায়। একটি হীন বংশের সঙ্গে বৈবাহিক ক্রিয়াকলাপ করে যেটুকু সম্মানহানি ঘটেছিল, সেটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য এঁরা আবার নিজেদের পালটি ঘরগুলিকে প্রলুব্ধ করে টেনে আনেন এবং তাঁদের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করে তাঁরা অগৌরবের কাহিনিটা চাপা দিতে সচেষ্ট হন। কলকাতার সমাজ, যা প্রারম্ভিক পর্বে ছিল বংশগরিমাহীন ভাগ্যান্বেষীদের সমাজ, মধ্যগগনে পৌঁছে তা এভাবেই নীল রক্তের সন্ধান পেল।

পল্লিবিন্যাসে পরিবার ও ব্যক্তির ভূমিকা

কলকাতার পল্লিবিন্যাসে বৈবাহিক সম্পর্ক বা আত্মীয়তা (kinship) একটি বিচিত্র ভূমিকা পালন করেছিল। নব্য ধনী পরিবারগুলির সঙ্গে সম্বন্ধের সূত্র ধরে যাঁরা কলকাতায় এসেছিলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা বসতি করতেন পৃষ্ঠপোষক পরিবারটির আশেপাশে। আমন্ত্রক পরিবারটিই সেইভাবে তাঁদের বসাতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধনকুবের রামদুলাল (দে) সরকার তাঁর জামাতা বা দৌহিত্রদের বাড়ি করে দিয়েছিলেন নিজের ভদ্রাসনের সংলগ্ন পল্লিতে। শোভাবাজার রাজপরিবার বা হাটখোলার দত্তবংশও এ রীতি অনুসরণ করেছিলেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে ধনী পরিবারগুলি স্থানাভাবের জন্য কন্যাকুলকে কাছে রাখতে পারেননি। কিছুটা দূরে একটা জায়গা তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। হাতিবাগান অঞ্চলের নলিন সরকার স্ট্রিটের পাশাপাশি অনেকগুড়ি বাড়ি ঠাকুর-পরিবার জামাতাদের যৌতুক দিয়েছিলেন। এই পাড়াটি তাই ঠাকুরবংশের দৌহিত্রদের পাড়া হয়ে উঠেছিল। একটি পরিবার একটি বিশেষ পাড়ায় এভাবে স্বশ্রেণির অনেকগুলি গোষ্ঠীকে বসতি করানোয় পল্লিবিন্যাসে জাতপাতের ছাপ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। পৃষ্ঠপোষক পরিবারের কৌলিক শ্রেণি অনুযায়ী কোনা পাড়ায় পিরালি ব্রাহ্মণদের, কোনো পাড়ায় দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থদের, আবার কোনো পাড়ায় সপ্তগ্রামী সুবর্ণবণিক বা সত্রীশ আশ্রমভুক্ত গন্ধবণিকদের প্রাধান্য সূচিত হয়।

পল্লিবিন্যাসে প্রভাবশালী কৃতী পুরুষদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। পন্ডিত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ছিলেন দাক্ষিণাত্য বৈদিক শ্রেণির ব্রাহ্মণ। তিনি তাঁর রাজাবাজারের ভদ্রাসনের আশেপাশে স্বশ্রেণির অসংখ্য পরিবারকে বসতি স্থাপনে সহায়তা করেছিলেন। তাই এক সময়ে রাজাবাজার, গড়পাড়, বাদুড়বাগান অঞ্চলে দাক্ষিণাত্য বৈদিকরা কেন্দ্রীভূত হয়েছিলেন। গিরিশচন্দ্র যেমন স্বশ্রেণিকে, সহায়তা করেছিলেন, গোয়াবাগানের কালীপ্রসন্ন বিশ্বাস তেমনই স্বগ্রামবাসীদের সহায় হয়েছিলেন। বারাসাতের নিকটবর্তী ছোটো জাগুলিয়া গ্রামে ছিল কালীপ্রসন্নের পিতৃভূমি। সে গ্রামের বহু পরিবারকে তিনি গোয়াবাগানে বসতি করান। ফলে গোয়াবাগানে ওই গ্রামের মানুষদের একটি ছোটোখাটো উপনিবেশ গড়ে ওঠে। একই গ্রামের মানুষের একটি পল্লিতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার এ-রকম উদাহরণ আরও অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়।

স্থানচ্যুতির ইতিকথা

উপরের আলোচনা থেকে আমরা কলকাতার বাসিন্দাদের আগমন, সমৃদ্ধিলাভ এবং বিন্যস্ত হওয়ার ইতিহাস জানালাম। কিন্তু, কলকাতার চলাচলের ক্ষেত্রে তো শুধু আগমনই ঘটেনি নির্গমনও ঘটেছে। সমৃদ্ধিশালী নতুন বাসিন্দাদের স্থান দিতে অনেক সাবেক বাসিন্দাকেই কলকাতা ছেড়ে সরে যেতে হয়েছে, আজও যেতে হচ্ছে। কারা এভাবে স্থানচ্যুত হয়েছেন? বলা বাহুল্য, অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর গোষ্ঠীই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে খড়্গাঘাতের বলি হয়েছেন।

কলকাতার আদি পর্বে যে গ্রাম্যরীতি অনুযায়ী পেশা ও বর্ণভিত্তিক পল্লিনাম প্রচলিত ছিল, তা আমরা আগেই দেখেছি। ক্রমশ সে রীতি পরিহার করে কলকাতা পরিগ্রহ করেছে পথ-নাম ব্যবহারের শহুরে পদ্ধতি। পল্লিনাম এবং পথনামের তালিকা পাশাপাশি রাখলে একটা জিনিস জলের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। পল্লিনামে শ্রমজীবী বা নিম্নবর্গের মানুষের একচ্ছত্র প্রাধান্য ছিল। কলকাতার বুকে সগর্বে বিরাজ করত ডোমপাড়া, হাড়িপাড়া, চাঁড়ালপাড়া। কিন্তু, পথনামের তালিকায় চোখ বোলালে দেখা যাবে, সেখানে উচ্চবর্ণের মানুষের অবাধ আধিপত্য। সে আধিপত্যের সিংহভাগ কায়স্থদের হাতে। বোঝা যায়, কলকাতা যতই শহর হয়ে উঠেছে, ততই লিপিকর জাতির (Scribes) প্রতিপত্তি বেড়েছে, তাঁদের হাতে নিজেদের পাড়া তুলে দিয়ে সরে যেতে হয়েছে শ্রমজীবীদের। স্থানচ্যুতির প্রধান শরিক হয়েছেন তাঁরাই। এটি একটি অপরিকল্পিত ঔপনিবেশিক শহরের নগরায়ণের প্রত্যক্ষ ফসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *