পুরোনো অন্ধকারে

পুরোনো অন্ধকারে

সবশেষে এল পাড়ার কাচ্চাবাচ্চারা আর বুড়ো পরসাদি।

আমরা বাচ্চারা দেখছি এক পেল্লায় কফিনবাক্সে মেজাজে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে বুড়ি মেমসাহেব ব্রাগানজা। আর বটের ঝুরির মতো ভুরুর চুলের ফাঁক দিয়ে পিটপিট করে সবকিছু দেখে পরসাদি বলল, আরে ও মেমসাহিবকো সুলানা আসান নেহি হোগা।

মরে গিয়েও থেলমা ব্রাগানজা শোবে না, এ আবার কী! তা হলে তো যে ইজিচেয়ারে পঁচিশ বছর ধরে মেমসাহেব কী দিন, কী রাত বসে কাটাল তাতে করেই ওকে গোর দিলে হত। এই কফিন-ফফিন এনে হত টানাহ্যাঁচড়ার কী দরকার ছিল?

বড়োছেলে সিরিল বলল, নো নো, ড্যাট য়োন্ট ডু। মাডার মাস্ট স্লিপ ইন কফিন। অর হাও গড উইল টেক হার আপ? বলেই সিরিল বুকে ক্রসচিহ্ন আঁকল। সিরিল সবসময় ‘দ’-কে ‘ড’ উচ্চারণ করে দেখে আমরা ছোটোরা যারা হাসি তারা আজ কিন্তু হাসলাম না। গোটা মিন্টো লেন আজ সকালে থ মেরে আছে বুড়ি ব্রাগানজার মৃত্যুতে। সব জাতের লোকরাই এক এক করে আসছে আর শোকদৃশ্যের বদলে একটা আজব ব্যাপার দেখছে।

যাকে কফিনে বয়ে নিয়ে যাওয়া হবে গোরস্থানে সে কফিনে শুচ্ছেই না। ফাদার মাস্কারেনহাস তাঁর গোল গোল সোনালি চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, এভরিথিং ইজ হ্যাবিট, মাই ডিয়ার। পুওর সোল হ্যাজ নট স্লেপ্ট অন আ বেড ফর এজেস। বাট টুডে শি মাস্ট স্লিপ।

মাস্ট স্লিপ তো বটেই, কিন্তু শোয়াবে কে? পাড়ার মুদি ফণীকাকা ফিসফিস করে বলল, আশ্চর্য! শেষ নিঃশ্বাস ফেলার পরও মাথাটা হেলে পড়েনি। তবে কি দানোয়-টানোয় পেল? সত্যি মরেছে তো মেমসাহেব?

এর মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল ক্যাম্বেলের ছোকরা ডাক্তার বরেন, যে নাকি পেটের রোগেও পেনসিলিন ঝাড়ে। বয়স্করা কেউ বলে পিছনপাকা, কেউ আকাট মুখ। সেই বরেন এসে বলল, লকড জয়েন্ট। হাড়ে হাড়ে খিল খেয়ে গেছে, লাঠিটাঠি দিয়ে পিটিয়ে লক ছাড়াতে হবে।

রুখে দাঁড়াল সিরিল, হোয়াট রাবিশ! আই হিট মাই ডিয়ার মামি আফটার শি’জ ডেড? ইউ ক্রেজি! সিরিলের বউ ডেবরা এবার ডুকরে কেঁদে উঠল, আর তাই শুনে সারাবাড়িতে জমায়েত সমস্ত খ্রিশ্চান সাহেব-মেম, কাচ্চাবাচ্চা জোরে জোরে নিজেদের ক্রস করতে লাগল।

আমার মনে পড়ল সেইসব সন্ধ্যে যখন ছাদের পড়ার ঘরের জানলা খুলে অপেক্ষায় থাকতাম কখন পিছনের অ্যাংলোবাড়ির দোতলায় গ্রামোফোনে এলভিসের রেকর্ড চাপিয়ে আপনমনে নাচ শুরু করবে লোরেন। লোরেন সুইন্টন। সুইট সিক্সটিন অ্যাণ্ড র‍্যাভিশিং।

দিদির সঙ্গে লোরেটোয় পড়ে লোরেন, সামান্য এ প্লাস বি হোলস্কোয়্যার ফর্মুলাও দিদিকে দেখিয়ে দিতে হয়। ও শুধু বলে, আফটার অল, আমি তো আর স্কুল লিভ করা অবধি পড়ছি না। অ্যাজ সুন অ্যাজ আই টার্ন অ্যাডাল্ট আই অ্যাম গোয়িং টু বি আ ক্যাবারে ড্যান্সার।

অ্যালজেব্রা বুঝিয়ে দিদি ওর কাছে নাইট ক্লাব, ক্যাবারে, বেলি ড্যান্সি, ফক্সট্রট, পোল্কা, ডাইভ, শেকের গল্প শোনে। তারপর বাড়ি ফিরে এসে সেইসব রহস্যের কথা উগরে দেয় আমার উপর। শেষে কখনো বলতে ভোলে না, নিতু, প্লিজ কাউকে বলিস না। তা হলে ওর সঙ্গে মেশা বন্ধ হয়ে যাবে। আমি সাততাড়াতাড়ি শুনিয়ে দিই, তুই খেপেছিস, দিদি?

কিন্তু যেটা দিদিকেও সাহস করে বলি না তা হল ওই লোরেনের কেরিয়ারের প্রস্তুতি আমি রোজ একটু একটু দেখতে পাই সন্ধ্যেকালে। যখন আকাশে তারা ফোটে, পাড়া অন্ধকার হয়, সবাই ভিতরে ঘরের আলোর দিকে তাকায়, আমি চিলেকোঠার জানলা দিয়ে অন্ধকার দেখি আর মিনিট গুনি কখন বিশেষ একটা বাড়ির ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো ঝপাংসে খুলে যাবে, গ্রামোফোন থেকে মধুর সুরে গেয়ে উঠবে এলভিস প্রেসলি বা প্যাট বুন, আর একটি ষোড়শী সুন্দরী কখনো গাউন, কখনো শোওয়ার নাইটি, কখনো বা স্রেফ বড়ো বাথ টাওয়েল পরে নাচ শুরু করবে সেই ধ্বনিতে। একদিন এভাবেই একটা তোয়ালে পরে নাচার সময় তোয়ালেটা খুলে পড়ে গিয়েছিল লোরেনের। আর তখন ওই দুধসাদা মেয়েটাকে ওভাবে দেখতে দেখতে…।

না, থেলমা ব্রাগানজার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে আমি ওই দৃশ্য মনে মনেও দেখতে পারি না। আমি কি ভুলে গেছি কী বলেছিল বুড়ি একদিন আমাকে ইন্টালি মার্কেটে রুটির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে? আমি দু-পাউণ্ড রুটি আর আট আনার মাখন কিনে খুচরোর জন্য অপেক্ষা করছি, পিছন থেকে কাঁধে একটা চাপড়। ঘুরে দেখি বুড়ি ব্রাগানজা।

বলল, হাউ সুইট মাই ডার্লিং! হাউ সুইট! আমি বললাম, গুড ডে ম্যাম!

বুড়ি বলল, গুড ডে। তারপর ঝট করে আমার বাঁ কাঁধটা বাগিয়ে ধরে খিঁচিয়ে উঠল, বাট কান্ট ইউ বিহেভ ইয়োরসেলফ ইন দ্য ইভনিং!

আমি থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। আমতা আমতা করে বললাম, কেন, কী হয়েছে? বুড়ি ব্রাগানজা ওর ঝোলা থেকে একটু ললিপপ বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, ধরো। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝালাম, চাই না। বুড়ি বলল, বয়স কত? ললিপপ ফেরত দিচ্ছ যে বড়ো!

বললাম, তেরো, গোয়িং অন ফোর্টিন। বুড়ি মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বলল, আর রোজ সন্ধেয় ওই সব্বোনেশে ধিঙ্গি মেয়েটার রকমসকম দেখছ ফ্যালফ্যাল করে? ওটা কি নাচ হয়? ও তো স্রেফ অসভ্যতা। ও কি ভদ্রলোকের দেখার জিনিস? যেমন মা একটা হোর, তেমনি তৈরি করেছে মেয়েটাকে। তুমি ভালোবাড়ির ছেলে বাপু—

বুড়ি আরও কী সব বলছিল, আমার আর ধৈর্যে ধরেনি। আমি পোঁ পোঁ দৌড়েছি বাড়ির দিকে। খানিকটা মাখনও কলাপাতার থেকে ঠিকরে পড়েছে ট্রামলাইনে।

সন্ধ্যেবেলায় চিলেকোঠার জানালা খুলতে গিয়ে কী ভাষণ দুপদুপুনি বুকের ভিতর। নাচ তো হবে দোতলায়, কিন্তু নীচে অন্ধকারে বুড়ি ব্রাগানজা যে ইজিচেয়ারে বসে কী শাপ-শাপান্ত করবে কে জানে! মুশকিল হল যে বুড়িটা ঘরের আলোও জ্বালে না;অন্ধকারে প্যাঁচার মতো বসে জগৎ পাহারা দেয়। যখন পুরোদমে ন্যাট কিং কোল আর হ্যারি বেলাফন্টে বাজছে আর লোরেন ওর নতুন-শেখা দুর্ধর্ষ সব স্টেপস প্র্যাকটিস করছে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। আমি আস্তে করে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে জানলা খুলে দিলাম। বুড়ি ব্রাগানজার অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমার হাতিয়ার এই অন্ধকার।

কিন্তু জানলা খুলতেই ওই ভীষণ দৃশ্যটা ঘটল। দেখি আজ আর থেলমা ব্রাগানজা ঘর অন্ধকার করে বসে নেই, ঘর এবং উঠোনের বাতি জ্বালিয়ে পায়চারি করছে আর থেকে থেকে উপরের ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো আর লাগোয়া সিঁড়ির দিকে আগুনে দৃষ্টি হেনে বলছে, ডোন্ট ইউ ডেয়ার মেস উইথ দ্যাট ইনোসেন্স, ললিপপ কিড। যেমন মা একটা বেশ্যা, তেমন তৈরি হচ্ছে মেয়ে। যা মরগে যা ক্যাবারে ডান্সার হয়ে, তাই বলে নিষ্পাপ ছেলেটার মাথা খাবি। আর তাই দেখতে হবে আমায় এই মরণকালে বসে বসে?

কতক্ষণ এভাবে চলল জানি না, শেষে লোরেনই স্রেফ একটা বাথটাওয়েলে স্পাইরাল সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াল। নর্তকীরা নাচ শেষে যেমন ভঙ্গিতে বাও করে তেমন একটা কিছু করে বলল, নিটু ইজ ইন্টেলিজেন্ট ইনাফ টু নো হোয়ট আই ডু হিয়র ইন দ্য ইভনিং। ও চাইলে ওর জানলা বন্ধ রাখতেই পারে। আমার ধারণা আমার শরীরটা ওর দেখতে খারাপ লাগে না।

তারপর এক দমফাটা হাসি লোরেনের, যেন চোদ্দখানা কাচের গেলাস একসঙ্গে ভেঙে পড়ল মাটিতে। ব্রাগানজা ফের কীসব বলছিল উলটোদিকে মুখ করে, লোরেন ফের বলল, আন্টি, তুমি ডাক্তার দেখাও না কেন? সেই জন্ম থেকে দেখে আসছি চেয়ারে বসে দিন কাটাচ্ছ। তোমার রাতে নিজের বিছানায় শোওয়ার ইচ্ছে হয় না?

এই শেষ কথাটায় ভেঙে পড়ল বুড়ি। হাউহাউ করে কেঁদে উঠে ঢুকে গেল ভিতরে, আর তারপরই ঝপ করে গোটা নীচের তলাটা অন্ধকার। কী এক অব্যক্ত ভয়ে আর দুঃখে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল আমারও। আমাদের মতো পাড়ায় কোনো বাড়িরই গোপন কথাটা খুব বেশিদিন গোপন থাকে না। সব সত্যি পুরোপুরি না বেরুলেও মিথ্যে, কল্পনা আর গুজব দিয়ে তাদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাইরে বার করা হয়। এসব পাড়ায় আমরা ছেলেপুলেরা বড় তাড়াতাড়ি পেকে যাই। ছেলেদের সম্পর্কে মেয়েদের, আর মেয়েদের সম্পর্কে ছেলেদের কৌতূহল এখানে খুব গভীর। আর বড়োদের জীবনের অদ্ভুত অদ্ভুত সব ব্যাপারস্যাপারও আমরা কী করে, কী করেই না জেনে যাই। যেমন মণিদা কবে ছাদ ডিঙিয়ে চুমু খেয়ে এসেছে ব্রততীকে, উকিল দ্বিজুকাকা কীসব ব্লু ফিলম চালিয়ে দেখে মাঝরাত্তিরে, মুদি ফণীকাকু নাকি কাজের মেয়েদের মুড়ি-চানাচুর খাইয়ে কীসব করে, আর…কত বলব এ সব, এর কি শেষ আছে?

তেমনি একটা সত্য কিংবা মিথ্যে চালু আছে থেলমা ব্রাগানজাকে নিয়েও। ব্রাগানজা আর তার ইজিচেয়ার। থুড়ি, ব্রাগানজা আর তার পরিত্যক্ত বিছানা। আজ মৃত্যুতেও সে-বিছানায় শোয়ানো গেল না মেমসাহেবকে।

এতক্ষণ ওর বটের ঝুরির মতো ভুরু চুলের ফাঁক দিয়ে পিটপিট করে কফিনে-বসা মেমসাহেবকে দেখছিল পরসাদি। পাড়ার জমাদার। বাবুদের পায়খানা সাফ করা তার কাজ, কাউকে হাত দিয়ে স্পর্শ করা ওর অধিকারের অতীত। মেরেধরে শোয়ানো যখন গেলই না তখন মিনমিন করে ওকে বলতেই হল, শায়েদ ইয়ে কোই জিন কা মামলা হ্যায়। ঝাড়ফুকসে কাম হো যায়েগা।

আমার বিজ্ঞানমনস্ক কাকা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিল কে জানে, পরসাদির কথায় যেন ওর চটকা ভাঙল। বলল, না। এবার রওনা দেওয়াই ভালো। এ বার প্রসাদীর ঝাড়ফুকের খেলা শুরু হবে। বলেই বাড়ির দিকে পা চালাল কাকা।

ফাদার মাস্কারেনহাস বললেন, আই কান্ট স্ট্যাণ্ড উইটনেস টু আ ডেভিলস ডান্স। আই মাস্ট লিভ অ্যাট ওয়ানস। কাম মি হোয়েন দ্য পুওর সোল হ্যাজ বিন লেড টু দ্য কফিন।

ভড়কে গিয়েছিল বুড়ির ছেলে সিরিল আর ক্লাইভও। কিন্তু এগিয়ে এল ডেবরা, সিরিলের বউ। বলল, পরসাদি, যো করনা হ্যায় ও করো। মগর মা’ জিকো কফিনমে সুলানা হ্যায়। অউর জলদি করো।

পরসাদি একছুটে ওর ডেরায় গেল আর ঘটিভরা জল, নিমের ডাল, তামার পয়সা আর কী-কী সব নিয়ে এসে বিড়বিড় করে মন্তর পড়ে মড়ার চারপাশে চরকি খেতে শুরু করল।

আমার মনে পড়ল সেই গুজবটা : দিনভর হাসপাতালে খেটে বাড়ি এসে থেলমা ব্রাগানজা দেখেছিল ওর জাহাজের মসালচি বর আব্রাহাম ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এক ঘুড়িকে নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। প্রৌঢ় আব্রাহাম শরীরের কারণে জাহাজে যাওয়া বন্ধ করেছে, কিন্তু মেয়ের রোগে ধরেছে। থেলমার শুধু একটাই কড়ার ছিল—যা করার বাইরে করো, বাড়িতে কোনো ফাজলামো চলবে না। ওর ভাষায়, নো হ্যাগস ইন মাই রুম।

সেটাই সে-দিন করে বসেছিল আব্রাহাম। তারপর বাকি কথার কিছু গুজব, কিছু সত্যি। কেউ বলে থেলমা ঘরের খিল দিয়ে বেদম প্রহার করে বরকে। ঘা পিঠে পড়তেই আব্রাহাম আর তার ছুঁড়ি দুদ্দার করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে খিদিরপুরের ডকে গিয়ে প্রথম কার্গোশিপে চড়ে বসে। কেউ বলে ও সব বাজে বকওয়াস, আব্রাহাম এরপর ওর গোয়র পিতৃভূমিতে ফিরে যায় ট্যাঁকে মেয়েটিকে নিয়ে।

কিন্তু একটা কথা সত্যি। সেইদিন থেকে থেলমা ব্রাগানজা আর ওর বিছানায় শোয়নি। আর কাউকে শুতেও দেয়নি। কারও মতে ও অপেক্ষায় আছে কবে ফের ফিরবে আব্রাহাম আর ওরা ফের শোবে ওদের প্রথম এবং একমাত্র বিছানায়। কারও মত হল বরকে যা বিছানায় পিটিয়ে হেভেনে পাঠানো হল তাতে ফের কী করে শোয় বেচারি! তবে স্বামীকে হত্যা করা নিয়ে কোনো কোর্ট-কাছারি হয়েছিল কি না স্পষ্ট জানি না। উকিল দ্বিজুকাকা বলে, ওয়েল, শি ওয়জ অ্যাকুইটেড অন দ্য গ্রাউণ্ড অফ ক্রাইম কমিটেড আণ্ডার এক্সট্রিম প্রোভোকেশন। দুই অনাথ বালকের খাতিরে মার্সি গ্রাউণ্ডও ছিল। কেউ কেউ আবার বলে, এত মর‍্যাল মহিলা অ্যাংলো সমাজে পাওয়া ভার। সে-কথা কি আর আমি জানি না? সে দিন সেই যে ইন্টালি মার্কেটে…

আমার ভাবনাগুলোয় ছেদ পড়ল হঠাৎ করে ওঠা এক গোঙানির শব্দে। মাই গড! মরা মেমসাহেব কি সত্যিই তা হলে মরেনি! মড়ায় কখনো ধ্বনি দেয়? আর দেখতে দেখতে পড়পড় করে থেলমা ব্রাগানজার বিপুল দেহটা ধসে পড়ল কফিনের মধ্যে। আর প্রায় একই সঙ্গে কফিনের পাশে দাঁড়ানো ডেবরা গোঙাতে গোঙাতে আছাড় খেয়ে পড়ল মাটিতে। বোঝা গেল না গোঙানির ধ্বনিটা কার ছিল—বুড়ির না ছেলে-বউয়ের। ততক্ষণে চাপাস্বরে ‘ভূত ভূত’, ‘দানো-দানো’, করে ভিড় ফাঁকা হতে শুরু করেছে। ছোটোছেলে ক্লাইভ ছুটল পাদরিদের খবর করতে। আর আমরা বাচ্চারা খ্রিশ্চান পরিবারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কাঁদার খুব চেষ্টা করলাম। আর জীবনে নতুন করে ফের শিক্ষা পেলাম যে অন্যের দুঃখে কাঁদার অভ্যেস আমাদের বড় একটা নেই। নিজেদের দুঃখে কত স্বচ্ছন্দে জল আসে চোখে, অথচ পরের বেলায় কত বানাতে হয় দুঃখকষ্টগুলোকে। চারপাশে তাকিয়ে দেখি কত অনায়াসে নরনারী সবাই বানানো দুঃখয় বুক ভাসাচ্ছে। অথচ এরাই একটু আগে কত টীকাটিপ্পনী সহকারে উপভোগ করেছে বুড়ি মেমের কফিন প্রহসন।

হঠাৎ আমার হৃদয় চুপসে গেছে শুধু এক জোড়া চোখের দিকে চোখ পড়ে। লোরেন সুইন্টনের। নীরবে মাতৃহারা বালিকার মতো অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটি। অথচ ওর কোনো আত্মীয় নয়, থেলমা ব্রাগানজা; বরং বুড়ি সুযোগ পেলেই ওকে দু-চারটি মন্দ কথা শোনাত। লোরেনও সুযোগ বুঝে খোঁচা দিতে ছাড়েনি কোনোদিন। আমি একটু একটু করে সরে এলাম লোরেনের দিকে। জিজ্ঞেস করলাম, এত কাঁদার কী আছে লোরেন? মানুষ তো…

আমার কথার মধ্যে এই প্রথম শব্দ করে ভেঙে পড়ল মেয়েটা, বাট নিটু, শি ওয়জ দ্য ওনলি পার্সন হু টুক মি সিরিয়াসলি। একমাত্র ওই আমাকে বলেছে, কেন তুমি ক্যাবারে ডান্সার হবে? ওটা ভালো জীবন নয়। তুমি স্কুল পাস করে স্টেনোগ্রাফি শেখো। ইউ আর সো বিউটিফুল অ্যাণ্ড স্মার্ট। দেয়ার ইজ আ ব্রাইট ফিউচর ওয়েটিং ফর ইউ সামহ্যোয়ার।

শেষে কফিন নিয়ে যখন সবাই রওনা হল আমার মনে হল এইমাত্র বুঝি একটা জন্মদিনের পার্টি ফুরল।

২.

শোনা যায় আব্রাহামকে খুন করার পর ঠিক পঁচিশ বছর তার ইজিচেয়ারের জীবনে বেঁচে ছিল থেলমা ব্রাগানজা। আর মেমের সেই মৃত্যুদিনের ঠিক পঁচিশ বছর পর বেহাত হওয়া পুরনো সেই মিন্টো রো-র বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে নিতু। থুড়ি আমি। থুড়ি নিতু। না, না, আমি। আমার নিতুর মধ্যে কেন যে হঠাৎ হঠাৎ এরকম দেয়াল তুলে দিই আমি…থুড়ি তুলে দেয় নিতু, আমি বুঝি না। থুড়ি নিতু বোঝে না, বা আমি বুঝি না নিতু কেন বোঝে না। কিন্তু এই মুহূর্তে, এই তারকাখচিত সন্ধ্যার তারার অন্ধকারে আমি আর নিতু দিব্যি এক হয়ে স্মৃতি ভাগাভাগি করে ভাবছি আর দেখছি বুড়ি ব্রাগানজার অন্ধকার ঘর, তার উপরে আরেক অন্ধকার ঘর— লোরেন সুইন্টনের। যেখানে কোনো রেকর্ডের বাজনা নেই। রূপসীর নাচ নেই, সদ্য-যুবতী দুধসাদা শরীরের ব্যঙ্গ, কটাক্ষ বা ছুরি নেই। অথচ এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে রক্তপাত হচ্ছে আমার ভিতর। আমাদের বাড়িটা মারোয়াড়ির হাতে পড়ে কুৎসিত মকান হয়ে গেছে, পাশের বাগানেও বাড়ি গজিয়েছে। লোরেনদের এজমালি বাড়িটা কিন্তু অবিকল সেই আগের মতো, শুধু সে-দিনের কোনো বাসিন্দাই আজ আর নেই। বাড়িটার সেরা বাসিন্দা, বিখ্যাত লোরেন সুইন্টন, থুড়ি ইন্টারন্যাশনাল ক্যাবারে ড্যান্সার লাশিয়াস লোলা, গত রাতে দিল্লির পাঁচতারা হোটেলের স্যুইটে অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে দেহরক্ষা করেছে। আমার স্ত্রীই আমার দিকে সকালে খবরের কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, হ্যাঁগো, এই তোমাদের সেই লোরেন সুইন্টন না? আমি খবরটার শেষলাইন অবধি পড়তে পারিনি। এখনও আশা রাখি ওর সঙ্গে একটা শেষ মোলাকাতের। আমার প্রতিহিংসাপরায়ণতার একটা জবাব আমি সেই থেকে আশা করে আছি। পুরো পঁচিশ বছর।

আমি ক্ষমা করতে পারিনি সে-দিন লোরেনের ক্ষমাপরায়ণতাকে। যে-মানুষ আমাকে আর লোরেনকে আলাদা করে দিতে চেয়েছিল তার জন্য ওই কান্না আমি মেনে নিইনি। আমি ব্রাগানজা মেমসাহেবের শবমিছিল থেকে আলাদা হয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শেষ অবধি বাড়ি এলাম না। বলা ভালো নিতুই বাড়ি এল না।

নিতুকে একেক সময় বড়ো ভয় পাই আমি। আমি অনেক কিছুই পারি না যা নিতু অবলীলায় পারে। যেমন আমাদের পাড়ার বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট ডা: ঋতেন বসুর মেয়ে লীলার সঙ্গে আমি যেচে পড়ে কথা কইতে পারি না। কিন্তু নিতু পারে। আমি বরং অনেক স্বস্তি পাই ছাদের ঘরে বসে চেঁচিয়ে লোরেনের সঙ্গে ইংরেজিতে বাতচিত করতে। কিন্তু তেরো বছরের লীলাকে সামনে দেখলে আমার জিভে আঠা ধরে। কখনো সখনো ভিতরে একটা উশখুশে ব্যাপার হয় ঠিকই, যেটা মনে হয় নিতুর ব্যাপার।

আমি লোরেনের চোখের জলে আহত হয়ে যে শেষ অবধি লীলাদের বাড়ি গিয়ে বেল দিলাম সেটা একান্তই নিতুর কারবার। তারপর যখন দরজা খুলে পুলকিত বিস্ময়ে লীলা বলে উঠল, অ্যাঁই তুমি! আমি ভিতরে ভিতরে কাঁপতে শুরু করলাম। কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ মনে হল আমাকে এভাবে এখানে দাঁড় করিয়ে নিতু ভেগে পালিয়েছে। আমি আমার তোতলামি শুরু করে দিলাম। আসলে…আসলে…আমি একটা কথা বলতে…

লীলা বলল, বুঝেছি। আমার গলায় ওই গানটা শুনতে চাও তো?

আমি প্রায় ল্যাবার মতো বলেই ফেলেছিলাম, কোন গানটা বলো তো? আর তক্ষুনি মনে পড়ল লীলার লেখা চিঠিটার কথা—’যদি কখনও আসো আমাদের বাড়ি তালে শোনাব তোমার প্রিয় গানটা। মানবেন্দ্রর ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি। শুনেছি এটা নাকি তোমার খুব প্রিয় গান। বলা বাহুল্য, আমি সে-চিঠির কোনো উত্তর দিইনি। অথচ কী এক টানে এসে দাঁড়িয়েছি ওরই দোরগোড়ায়। বুঝছি না কী বলে সামাল দিই।

ঠিক তখনই বোধ হয় নিতু ফিরে এল আমার মধ্যে। আমি বলে বসলাম, লীলা, ক্যাবারে নাচ দেখেছ কখনো। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে, মুখে কথা সরছে না। অনেকক্ষণ পর কথা ফুটল, ক্যাবারে? তুমি দেখো?

আমি মাথা নেড়ে রীতিমত গর্বের হাসি হেসে বললাম, রোজ!

–রোজ?

–রোজই বলতে গেলে।

–কোথায় হয় এসব?

আমি সংলাপ ছোটো করার জন্য (কারণ আমি ভিতরে ভিতরে কাঁপছি) তাড়াতাড়ি বললাম, সে জায়গা আছে। আগে দেখবে কি না বলো।

আর অমনি লীলা আমার দিদির মতো হয়ে গেল। যে লোরেনের মুখে ক্যাবারে গল্প শুনবে বলে দিনের পর দিন ওর অ্যালজেব্রা কষে দেয়। কী ভাবল, কিংবা কিছুই ভাবল না, শুধু বলল, কবে?

আমি সংলাপ শেষ করার জন্য বললাম, জানা থাকল। যে-কোনো দিন সন্ধেয় ডেকে নেব।

নিতু, থুড়ি আমি এবার পিছনের আলসে ছেড়ে বাড়ির সামনের দিকের আলসেতে এসে ভর দিয়ে দাঁড়ালাম। লীলাদের বাড়ির নীচের চেম্বারে আলো জ্বলছে, তার মানে ওর দাদা নিরুপম পেশেন্ট দেখছে। নীলা তো সেই কবেই বিয়ে করে বিলেতে।

আমি ওদের সুন্দর বাড়িটার ওই মার্বেল করা সিঁড়িটার কথা ভাবছি। না থাক, সে পরে হবে। আমি আস্তে হেঁটে ছেলেবেলার পড়ার ঘরটার পাশে এসে দাঁড়ালাম। ছিটকিনি খুলে ভিতরে ঢোকার বড়ো ইচ্ছে, কিন্তু আমিই যেন নিজেকে বাদ সাধছি। কারণ…কারণ…এই ঘরের মধ্যেই সে-দিন বিদ্যুতের আলোয় সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

ক-দিন পর মনে নেই, তবে দিনটা ভালো ছিল না। বড়ো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। আমি অন্ধকার স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে হাত ধরে লীলাকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলাম চিলেকোঠায় আমার স্টাডিতে। সব দেখেশুনে লীলা বলল, এখানে আবার ক্যাবারে কীসের? আমি ঠোঁটে আঙুল চেপে বললাম, সাইলেন্স! এটাই ক্যাবারে শোয়ের বক্স সিট। বলে খুলে দিলাম পিছনের গরাদহীন জানলা। আর সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল কালো বডিস আর সাদা লং স্কার্টে নৃত্যরতা লোরেনের দৃশ্য। লীলা মুখে দু-দুবার তালুর টোকা মেরে বলল, ও মা! এ কী নাচ নিতু? আমি বললাম, ফ্লোর শো। কেন, তোমার খারাপ লাগছে?

সঙ্গে সঙ্গে লীলা বলল, কেন, আমি কি তাই বলেছি?

আমি বিজ্ঞের মতো বললাম, বলা যায় না, তোমরা তো সব রিচ অ্যাণ্ড কনজারভেটিভ ফ্যামিলির মেয়ে।

লীলা জানলায় বসে একদৃষ্টে লোরেনের নাচ দেখতে দেখতে বলল, আর তুমি?

লোরেন ততক্ষণে লং স্কার্টটাও খুলে ফেলেছে। কালো টু-পিসে মেয়েটা এখন অপ্সরার মতো হয়ে পড়েছে। ও আঁচ করেছে আমার জানলায় আমি সেট হয়ে গেছি। ও জানে না যে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ নয়নে এক ত্রয়োদশী বাঙালি কিশোরী ওর শরীরসুধা পান করছে। আর আমি?

আমি একটা একটা করে ওই নিরেট অন্ধকারে কিশোরীর ফ্রকের পিছনের টিপ বোতামগুলো আলগা করে দিচ্ছি। ক্রমে জামাটা একটু একটু করে তুলে আনছি মাথার দিকে। হঠাৎ এক বিদ্যুৎ ঝলকে দেখলাম কিশোর সদ্যফোঁটা অপূর্ব স্তন দুটি। বিদ্যুৎ ঝলকের সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলেছে লীলা, কিন্তু ওর হাত আমার হাতকে থামানোর কোনোই চেষ্টা করছে না। আমি হঠাৎ এক ঝটকায় ওর মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে প্রচন্ড জোরে চুমু রাখলাম ঠোঁটে। তারপর ওকে কাঠের মেঝেতে শুইয়ে একে একে খুলে নিলাম পরিধানের যাবতীয় উপকরণ।

আমার বুদ্ধিতে যা যা করা যায় একটা সুন্দরী মেয়েকে তার সবই করছি আর ভাবছি এর পর কী? কিছুদূর এগিয়ে ফের ভাবনা—এর পর কী? এরও পর?

ঠিক সেইমুহূর্তে আকাশ ছেয়ে গেল এক দীর্ঘাতিদীর্ঘ বিদ্যুল্লতায় আর আমরা দুজনে দু জনকে সম্পূর্ণ নর ও নারী হিসেবে দেখতে পেলাম। আমার মাথাটা বুকে গুঁজে নিয়ে লীলা ঝটিকায় সোজা হয়ে দাঁড়াল মেঝের ওপর, আর ঘামে ভেজা দেহে কাঁপতে কাঁপতে বলল, কথা দাও, তুমি আর কোনোদিন ওকে ওভাবে দেখবে না। শুধু আমাকে…।

আমি ওকে কথা শেষ করতে দিইনি। তার আগেই বলে দিলাম, কথা দিচ্ছি। শুধু একবার একটা ছোট্ট কাজ…বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ালের সুইচটা অন করে দিলাম লোরেনকে আমার নিজস্ব ফ্লোরশো দেখানোর প্রতিহিংসায়।

আজ বুঝি ওই কীর্তি, আমার নয়। একবার আলো জ্বলে উঠতে একই সঙ্গে চমকে উঠেছিল দুই নারী। লীলা আর লোরেন। এ কী করলে! বলে চিৎকার করে উঠল লীলা, তারপর ছিটকে গিয়ে সুইচ অফ করে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপল। আমি ওর জামাটা গায়ে পরিয়ে দিতে যেতে সরে গিয়ে বলল, ডোন্ট ইউ টাচ মি! ছিঃ! তুমি এই চেয়েছিলে?

জামা পরে দরজা খুলে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে লীলা বাইরে অন্ধকারে ছুটে বেরতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল ছাদ, পাড়া ও শহর জুড়ে। আর ওদিকে দমদম আওয়াজে কবাট পড়ল লোরেনের ঘরেও। মধ্যিখানে আমি এক অন্ধকারে খোলা দেহে বসে রইলাম কাঠের শীতল মেঝের উপর। আমার নিজের অঙ্গই তখন দমকে দমকে উষ্ণতায় ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার শরীর।

কতক্ষণ বৃষ্টি চলেছিল আজ মনে নেই; কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম তাও মনে পড়ে না। শুধু এটাই মনে আছে যে ওই একই সন্ধেয়, একই মুহূর্তে আমি একই সঙ্গে লোরেন আর লীলার থেকে সমান দূরত্বে চলে গিয়েছিলাম। পড়ার ঘরের জানলায় বসা আর সামনের আলসেতে ভর করে লীলাদের ছাদের দিকে চেয়ে থাকা—সব স্বাধীনতাই চলে গেল। একই দিনে আমার পাড়া মিন্টো লেন আমার বৈরী হয়ে গেল। ঘটনার তিনদিন পর চিলেকোঠার ঘর থেকে যাবতীয় বইপত্র নামিয়ে নিয়ে এসে মাকে বললাম, মা, আমাকে বোর্ডিঙে পাঠিয়ে দাও।

অবাক হয়ে বহুক্ষণ চেয়েছিল মা আমার দিকে। তারপর বলল, তুই ঠিক বলছিস তো? বোর্ডিঙে যেতে তোরই তো অত আপত্তি। বললাম, আপত্তি তো আছে। কিন্তু এখানে পড়াশুনো একদম ভাল হচ্ছে না।

মা ফের অবাক হয়ে গেল। কী বাপু, সারাক্ষণ তো বই নিয়ে থাকিস ছাদের ঘরে। কেউ তো বিঘ্ন ঘটায় না। আর অমিয় তো ভালোই পড়ায় বলছিলি তুই।

বললাম, সব ঠিক আছে। কিন্তু আমার ভয় করে।

—ভয়? কীসের ভয়?

বলেই ফেলছিলাম দুটি মেয়েকে। ঠিক সময়ে সামলে নিয়েছিলাম। বললাম, বুড়ি ব্রাগানজাকে মাঝে মধ্যে দেখি। ওর ওই ইজিচেয়ারে বসে আছে অন্ধকারে। পাথরের মতো চোখ নিয়ে। মা তৎক্ষণাৎ শাড়ির আঁচল তুলে মুখে গুঁজে ধরল, সর্বনাশ! তার মানে তো বেশ খারাপ কিছু।

-তা তো বটেই! বিশ্বাস তো আমিও করতে চাই না এসব। কিন্তু…।

—না, না বাপু, তুই উপরে যাওয়া ছাড়ান দে। ভানু যা বলেছিল তা তো তা হলে ঠিক।

হঠাৎ করে উদগ্রীব হয়ে উঠলাম ভানুর কথায়। আমাদের কাজের লোক, বানিয়ে কথা বলায় ওস্তাদ। বললাম, ভানু কী বলছিল মা?

বলছিল ঋতেনবাবুর মেয়ে লীলার উপর নাকি ভর করেছে ব্রাগানজা মেম। পরসাদিকে দিয়ে ঝাড়ানো হচ্ছে ওকে এখন।

এবার গুলতি খাওয়া পাখির মতো আর্তনাদ করে উঠলাম আমি, সে কী? লীলাকে ভর করেছে বুড়ি?

মনে মনে ভাবলাম আমি যা কল্পনার রং চড়িয়ে বললাম তা আসলে মিথ্যে নয়! বুড়ি সত্যিই হয়তো সন্ধেকালে জাঁকিয়ে বসে ওর ইজিচেয়ারে।

আমি ‘আসছি’ বলে ছুট দিলাম ছাদের ঘরের দিকে, সত্যি একবার নজর করে দেখি বুড়ি ওর জায়গায় বসে আছে কি না। ছুটে এলাম ঘরের দরজা অবধি। কিন্তু কিছুতেই সাহস হয় না শিকল নামিয়ে ঘরে ঢোকার। যদি সত্যি সত্যি দেখে ফেলি থেলমা ব্রাগানজা অন্ধকারে বসে পাহারা দিচ্ছে আমাকে।

আজ পঁচিশ বছর পরেও আমার সেই একই বাধা শিকল খুলে আমার ছেলেবেলার পড়ার ঘরে ঢোকার। ঢুকলে কী দেখব আমি জানি না, কিন্তু যা-ই দেখি আমার সহ্য হবে না। আজ থেলমা ব্রাগানজাকে দেখার কথা ভাবছি না, কিন্তু যদি আমি ঘরের জানলা খুলতে দেখি আলো জ্বলে উঠেছে লোরেন সুইন্টনের ঘরে। বেজে উঠেছে গ্রামোফোন। গাইছে এলভিস, প্যাট বুন, ক্লিফ রিচার্ড। আর সেই সুরে, সেই ছন্দে নাচছে…আজ সকালে যার খবর পড়েছি কাগজে।

আজ আমি থমকে দাঁড়িয়ে আছি চিলেকোঠার সামনে, কিন্তু সে দিন আমি ফের দৌড়ে নেমে গিয়েছিলাম নীচে। তারপর আরেক দৌড়ে লীলাদের বাড়ি। গেট খোলা ছিল কী কারণে যেন, খোলা ছিল ঋতেনবাবুর চেম্বারের দরজাও। আমি বেড়ালের মতো নরম পায়ে উঠে গেলাম মার্বেলের সিঁড়ি দিয়ে। দোতলা অবধি উঠে এসেছি যখন কানে এল একটা পরিচিত শব্দ। পরসাদি ওর দেহাতি বুলিতে বলে যাচ্ছে কী সব হাবরজাবর। আর নিমের ডাল দিয়ে পিটছে মাটিতে। সেইসঙ্গে একটা গোঙানির শব্দ বিচিত্র কণ্ঠস্বরে। না, না, এ কখনও লীলার কণ্ঠস্বর হতে পারে না। এ কণ্ঠ আমি চিনি, এ কেবল একজনেরই। আমার মনে আছে সেই সকাল ইন্টালি মার্কেটে, আমি দু-পাউণ্ড রুটি আর আট আনার মাখন কিনে খুচরোর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম, যখন হঠাৎ করে আমার বাঁ কাঁধে একটা হাত…

আমি চমকে ফিরে তাকিয়েছি, আর লীলাদের মার্বেলের সিঁড়ির মাথায়, দোতলার হলের অন্ধকারে দেখি আমার পিছনে পাথরের মতো নিথর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে বুড়ি থেলমা ব্রাগানজা!

সেই ভয়, সেই কাঁটা দেওয়া, সেই হৃৎকম্পন আজও আমার শরীর ছেড়ে যায়নি। এই এতকাল পরেও। আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই চাহনি আর ওই ভৎসনা, হাও ডেয়ার ইউ হার্ম দিস লিটল কিড!

আমি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, বাট আন্টি, হোয়াট হ্যাভ আই ডান? কী করেছি আমি?

বুড়ি ব্রাগানজার হাত আরও জেঁকে বসল আমার কাঁধে, তুমি ভাবছ আমি কিসসু দেখিনি! লোরেনকে আমি ঘৃণা করি তোমাকে নষ্ট করে বলে। কিন্তু তুমিও তো নষ্ট হয়েই আছ। ইউ মাস্ট বি পানিশড!

ওই অন্ধকারে পায়ের তলার মার্বেল যেন আরও ঠাণ্ডা মেরে গেছে। আমি কাঁপছি থরথর করে। কিন্তু তার মধ্যেও আমি বলে ফেলেছিলাম, আমাকে পানিশ করো করো, কিন্তু তুমি লীলাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন?

গর্জে উঠল বুড়ি, আমি ওকে শাস্তি দিইনি, ওকে পরিষ্কার করেছি। ইউ হ্যাড সিনড অন হার। তুমি ওকে অপবিত্র করেছ। আর তোমাকেও পাপ থেকে ছাড়িয়ে আনব। আই উইল ক্লেনজ ইউ অফ ইয়োর সিন।

বুড়ি ব্রাগানজা যখন এসব কথা বলছে তার মধ্যেই আমি অন্ধকার দেখতে শুরু করেছি। ধূপের মতো মধুগন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে। চারদিকের অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য আগুনের উত্তাপ বোধ হচ্ছে। অন্ধকারটা কখনো কালো কড়াইয়ের অন্ধকার, কখনো রাত্রির আকাশের অন্ধকার বলে ঠাওর হচ্ছে। স্কুলের মিসের কাছে হেল বা নরকের যে বিবরণ শুনেছিলাম সেই হেল কি এরকমই উত্তপ্ত অন্ধকার? চিৎকার করে হাসি আর চিৎকার করে কান্না শুনতে পাচ্ছি। পিঠের উপর বিষম ভার চাপছে বোধ হল, মনে হল জিভটা ঠেলে বেরিয়ে আসবে। মনে হচ্ছে আমার ভিতর থেকে নিতুকে কেউ টেনে হেঁচড়ে বার করে নিতে চাইছে। ও প্রাণপণে আমাকে ধরে থাকতে চাইছে আর আমি ওকে। কিন্তু কেউই কাউকে ধরে রাখতে পারছি না। আর এই টানাটানির মধ্যে প্রচন্ড একটা আঘাত মাথায়…অন্ধকারের চেয়েও এক গভীর অন্ধকারে আমি ছিটকে পড়লাম, আর ডুবতে থাকলাম, ডুবতে থাকলাম, ডুব ডুব ডুব ডুব ডুব…

পঁচিশ বছর পর কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকে না। সবকিছু এতটাই বদলে যায় যে পূর্বের স্মৃতিকে মিথ্যে বলে মনে হয়। যেমন আজ মনে হচ্ছে সব কিছুকেই। কিন্তু স্মৃতি তো আর মিছে হয় না, কিংবা আমার মাথার পিছনের এই দাগ। দেড় ইঞ্চির যে-ক্ষত সে দিন তৈরি হয়েছিল লীলাদের বাড়ির মার্বেলের সিঁড়িতে। রক্তাক্ত অবস্থায় যে সন্ধ্যায় সবাই আমাকে খুঁজে পেয়েছিল সিঁড়ির নীচে, অন্ধকারে।

শুনেছি তিনদিনের অজ্ঞান অবস্থা থেকে প্রথম যেই চোখ মেলেছিল লীলা, ঠিক তক্ষুনি সবাই সিঁড়ির তলা থেকে আমার পড়া আর চিৎকারের শব্দ শোনে।

চার দিন পর ক্যাম্বেল হাসপাতালের বেডে প্রথম যখন চোখ মেললাম, দেখি আমার মাথার ব্যাণ্ডেজে আলতো করে হাত রেখে দাঁড়িয়ে লোরেন। আমাকে গুড বাই করতে এসেছে। ওরা মিন্টো লেন ছেড়ে উঠে যাচ্ছে এলিয়ট রোডে সামনের মাসে। এর মধ্যে ও একবার শিলং যাবে। আর হয়তো দেখা হবে না।

আমি একটা কথাও সে দিন বলিনি ওর সঙ্গে। ওর ঈর্ষা জাগাতে গিয়ে নিজের ঢের ক্ষতি করে বসেছি। আর কথা নয়, এরপর প্রতিহিংসা, শুধু প্রতিহিংসা।

লোরেন আমার গালে একটা চুমু খেল। আমি চাইলে ওর চুলে, মুখে হাত ছোঁয়াতে পারতাম। বেডের পাশে তো আর কেউ ছিল না। কিন্তু হাতই তুললাম না। প্রতিহিংসা তোলা থাক প্রতিহিংসার দিনের জন্য। যে দিন সেই দিন আসে।

আমি জানি না আজ সেই দিন কি না। জানি না সকালের ওই মৃত্যুসংবাদের পরও মানুষ পুরোনো খবরের মতো পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ উবে যায় কি না। জানি না প্রেম বা প্রতিহিংসার জন্য আত্মারা অতিরিক্ত সময় জড়িয়ে থাকে কিনা সংসারে। জানি না শেষ বিচারে প্রতিহিংসাই প্রেম বা প্রেমই প্রতিহিংসা কি না জানি না পঁচিশ বছর পরেও নীতীন্দ্র সেনকে লোরেন সুইন্টনের মনে ছিল কি না। আঠারো বছর আগেই তো বিয়ের চিঠিতে আমার নামের বানানে ভুল করে বসেছিল লীলা। ফলে আমিও ওকে একটা গ্রিটিংস কার্ড পাঠিয়েছিলাম ‘লীলা’র জায়গায় ‘নীলা’ লিখে। তাতে ছোট্ট একটা চিঠি লিখেছিল ও আমাকে—এতদিন পরও রাগ কমল না! মেয়েটা জানলই না যে ভুলে যাওয়ার চেয়ে রাগ পোষণ করা অনেক ক্ষুদ্র প্রতিশোধ।

আমি ছাদ থেকে নেমে বাড়ির বাইরে এসে মিন্টো রো ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। সেই আগের মতোই থেকে গেছে পাড়াটা, কেবল বেশি আলো ঝলমলে হয়েছে। পূর্বের সেই অন্ধকারগুলো ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে আর পাড়ার অলংকারের মতো ছিল যে-সব অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পরিবার তারা বরাবরের মতো হারিয়ে গেছে। আসলে পাড়াটার ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে, বাইরেটা প্রায় সেই আগের মতো। এপাড়ার কাউকেই আর চিনতে পারি না, কেউ চিনতে পারে না আমাকেও। এখানকার কেউই হয়তো খবর রাখে না এপাড়ায় আগে ভূত নামত, জমাদার পরসাদি মন্তর পড়ে সেই সব ভূতের গতি করত। এখানে দিনদুপুরে খোলা ছুরি নিয়ে লড়াই বাঁধত, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটত, তারপর বিকেলে সেইসব ছোকরারাই রোয়াকে বসে গাইত অনুরোধের আসরের গান। উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে এসে বাড়ির মেয়েরা বারান্দায় ঝুঁকে শুনত সেই সব গান। আর রাত নামত অ্যাংলো যুবক-যুবতীর মাতাল নাচগানে। আরও অনেকের মতো আমার পকেটেও ভর করেছিল একটা অটোম্যাটিক চাকু। বোতাম টিপলেই ব্লেড খুলে যায়। একটা ব্যাঙও কাটিনি আমি পাড়ার মাস্তানের থেকে উপহার পাওয়া সেই ছুরিতে। আজ পঁচিশ বছর পর সেই চাকুটা জমা দিয়ে এসেছি পুরোনো বাড়ির ছাদের সিঁড়ির ঘুলঘুলিতে। ওই ছুরিতে জগুদা স্ট্যাব করেছিল বেপাড়ায় হুজুতে মাস্তান কেলে বিশেকে। তারপর ওটা ছুড়ে ফেলে দেয় নর্দমায়। তারপর মন্ত্রমুগ্ধ আমার দিকে চেয়ে বলেছিল, ওটা কুড়িয়ে নাও। কাজে আসবে।

আমার বাঁ-পকেটটা তাই আজ ভারমুক্ত, ফাঁকা। তবে একবারে ভোঁ ভোঁ নয়। ওখানে সকালের খবরটার কাটিং আছে, যার শেষটুকু পড়া হয়নি। আমি রাস্তার মোড়ে কাগজটা বার করলাম। তারপর মোড়ের বাসনের দোকানের বিকট আলোয় পড়তে গিয়ে থম মেরে গেলাম। ফের বোধ হয় বুড়ো বয়সে ভূতে ভর করল আমাকে, কী সর্বনাশ, সকালে খবরের আসলটুকু না পড়েই পথে বেরিয়ে পড়েছি!

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না ক্যাবারে ড্যান্সারের মৃত্যুসংবাদে লিখছে—তিন চার বার বিয়ে করেছেন। কিন্তু জীবনের শেষ তিনটে বছর কাটিয়েছেন সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। শেষ দু-বছর ছিলেন প্রায় পঙ্গু, নাচের ফ্লোরে পড়ে গিয়ে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে গিয়ে। তাঁকে নিয়ে জীবনী লিখেছেন ইংরেজ লেখক টম আক্কিন, বইয়ের নাম ‘ক্যাবারে : দ্য লাইফ অফ লাশিয়াস লোলা। তিনি নিজে জীবনের শেষ দিনগুলোয় দুরারোগ্য আথ্রাইটিসে বিছানায় শুতে পর্যন্ত পারতেন না। হুইলচেয়ারের জীবনেই তিনি শেষ করেছেন তাঁর স্মৃতিকথা— ‘লেটার টু অ্যান অ্যাংরি বয়। বইটির মুক্তি অনুষ্ঠানে তিনি শেষবারের মতো দিল্লির ওবেরয় হোটেলে যান। এবং তারপরই পাশের স্যুইটে বিশ্রামে যান ও আঠারোটি ঘুমের বড়ি খেয়ে বরাবরের মতো ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁর মৃত্যুতে কবি ডম মোরেজ বলেছেন যে, এক অসাধারণ, অলৌকিক নাচ শেষ হয়ে গেল।

আমি খবরটা পড়ে ফের কাগজটা প্যান্টের বাঁ-পকেটে গুঁজে দিলাম। আর তা করতে গিয়ে আজ দশম, দ্বাদশ কিংবা চতুর্দশ বারের মতো চমকে উঠলাম। আমার পকেটে জগুদার সেই ভয়ংকর ছুরি এখন আছে! ওটা আমি সিঁড়ির পাশের ঘুলঘুলিতে সরিয়ে রাখিনি। ওটা বরাবরের মতো আমার পকেটে ভর করে আছে। আমি আস্তে আস্তে বার করলাম ছুরিটা। বোতাম টিপতেই খুলে গেল ফলাটা। লকলক করছে সাপের ফণার মতো। এতকাল ধার না দিয়েও ধার মরেনি জন্তুটার। হঠাৎ ফের রক্তের গন্ধে জেগে উঠেছে। আমি জানি এভাবে ওকে বেশিক্ষণ উলঙ্গ করে রাখলে ও আমাকেই খাবে। আজ বড়ো দুর্দিন আমার, ও জানে।

আমি ভোলা ছুরিটা রাস্তাটার পাশের ড্রেনে ফেলে দিলাম। বহুকাল ও আমাকে পাহারা দিয়েছে। আজ ওকে মুক্তি দিলাম।

আমার মনে পড়ল লীলাদের বাড়িতে মূৰ্ছা যাওযার পর মা বলেছিল, সঙ্গে একটা লোহা রাখিস, নিতু। খারাপ হাওয়া-টাওয়া কাছে আসতে পারে না। মা বোঝাতে চেয়েছিল বুড়ি ব্রাগানজার আত্মার ছোঁয়া।

এখন মনে হচ্ছে ছুরিটার সঙ্গেই সব হাওয়া ছাড়া পেল আমার থেকে। এক টুকরো খবরের কাগজ আপাতত লোহার ছুরির মত ভর করেছে আমাকে।

আমি মৌলালির দাসবাবুর দোকান থেকে ক-টা কামপোজ কিনলাম। আজ ঘুম আসা অত সহজ হবে না। জানি ওষুধের ঘুমে বড়ো ভয় আমার গিন্নির, কিন্তু ঘুম আমার চাই। একটু লম্বা ঘুম হলেও বা দোষের কী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *