পুরুষ বনাম পক্ষ

পুরুষ বনাম পক্ষ

পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য এবং ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে নবম-দশম শ্রেণির জন্য প্রথম ভাষা বাংলার সিলেবাস প্রকাশ করেছে। এই সিলেবাসে বাংলার অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ব্যাকরণের পাঠ্যক্রমও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই সিলেবাস প্রকাশিত হবার পর শিক্ষামহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিতর্ক সবচেয়ে ঘনীভূত হয়েছে ব্যাকরণের পাঠ্যক্রম নিয়ে। কারণ, ব্যাকরণের নতুন পাঠ্যক্রমে একদিকে যেমন, ব্যাকরণ রচনার পদ্ধতি পরিবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (চিরাচরিত অবরোহী পদ্ধতির বদলে আরোহী পদ্ধতি), অন্যদিকে তেমনি ব্যাকরণের কিছু কিছু প্রথাগত পরিভাষা ও প্রসঙ্গ বর্জন করে নতুন পরিভাষা ও প্রসঙ্গ প্রবর্তন করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে ব্যাঘাত ঘটলে আপত্তি ওঠা অস্বাভাবিক নয়। তবে, প্রশ্ন হচ্ছে এই আপত্তি কতটা যুক্তিযুক্ত এবং বর্জন-পরিবর্তন যা করা হয়েছে তা-ই বা কতটা যুক্তিপূর্ণ?

প্রশ্নের মীমাংসার জন্য মূল বিষয়ে যাবার আগে দেখা দরকার এই পরিবর্তন সম্পর্কে পর্ষদের কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য ব্যাকরণের যে-সিলেবাস প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় ‘বাংলা ব্যাকরণের নতুন পাঠ্যক্রম সম্পর্কে কয়েকটি কথা’ শিরোনামে একটি দুই পৃষ্ঠা (১২-১৩)-র ভূমিকা আছে। এই ভূমিকায় ব্যাকরণের নতুন পাঠ্যক্রম সম্পর্কে পর্ষদের দিক থেকে কিছু বক্তব্য রাখা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে :

স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ব্যাকরণ একটি নীরস ও দুরূহ পাঠ্যবিষয়। অথচ এমনটা হবার কথা নয়। কারণ, বাংলা ব্যাকরণে যা পড়ানো হয় তা তো তার মাতৃভাষা, যার ব্যবহার সেব্যাকরণ পড়ার আগেই শুরু করে।… তাহলে চেনা জিনিসকে এত দুরূহ ও কষ্টকর মনে করার কারণ কী? এর প্রধান কারণ, ব্যাকরণের বিষয়বিন্যাসে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার অভাব, পড়ানোর বিষয় ও পদ্ধতিতে অনাবশ্যকভাবে সংস্কৃত ভাষার উপযোগী প্রসঙ্গ ও পরিভাষার অবতারণা এবং তদুপরি সংজ্ঞা, সূত্র, আলোচনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য, অপ্রচলিত ও অপরিচিত ভাষারীতির ব্যবহার। এই জন্য ব্যাকরণের পাঠ্যক্রম সংস্কার করতে গিয়ে জোর দেওয়া হয়েছে ব্যাকরণ-পাঠের স্বচ্ছন্দতার ওপর। এ জন্য পাঠ্যতালিকা থেকে বহু অপ্রয়োজনীয। অথচ বহুকাল-প্রচলিত বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভাষাবিজ্ঞানের আধুনিকতত্ত্বের ভিত্তিতে পুরোনো ধারণার পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো দুর্বোধ্য পরিভাষা বর্জন করে নতুন , সহজ ও স্বচ্ছতর পরিভাষা চালু করা হয়েছে। (পৃ: ১২)

পর্ষদের এই ব্যাখ্যা সত্ত্বেও এখানে আর একটি প্রশ্ন অনিবার্যভাবে এসে পড়ে : তাহলে এতদিন যা চলছিল তাতে কি কোনো কাজ হয়নি? পড়াশুনা তো মাথা খাটিয়ে কষ্ট করেই করতে হয়। আমাদের দেশে তো এ ব্যাপারে একটা কথা বহুদিন ধরে চলে আসছে : ছাত্রাণামধ্যয়নং তপঃ—ছাত্রদের পক্ষে তাদের পড়াশুনাই তাদের তপস্যা। আর তপস্যার মন্ত্র তো দুর্বোধ্য ও দুরূহই হয়ে থাকে। তাকে সরল করার চেষ্টা আসলে তাকে তরল করার অপচেষ্টা নয় কি? এতে তো পড়াশুনার সাত্ত্বিক গৌরবটাই নষ্ট হবার আশঙ্কা। —কথাটা হয়তো একদিক থেকে ঠিক, কিন্তু তা একটা সীমা ও সময় পর্যন্ত ঠিক, তারপরে আর নয়। কথাটা কতদিন ও কোন সীমা পর্যন্ত ঠিক—এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, শিক্ষায় যতদিন সমাজের একটা সংখ্যালঘু অথচ প্রভাবশালী অংশের অধিকারই স্বীকৃত থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই কথা সমাজের ওই অংশের সীমার মধ্যে ঠিক বলে বিবেচিত হবে। শিক্ষার এই শ্রেণিনির্ভর একচেটিয়া অবস্থা প্রাচীন ও মধ্যযুগের সমাজব্যবস্থায় তো ছিলই, এদেশে ইংরেজদের শাসনকালে তাদের আনা মানবতাবাদের প্রচার ও প্রসারের পরেও দেশে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীনতার পরেও এ অবস্থার কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি, কারণ, ইংরেজরা চলে গেলেও তাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার আমরা বহন করে চলেছি স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও, যদিও সংবিধানে স্বাধীনতার দশ বছরের মধ্যে শিক্ষার অধিকার সমাজের সংকীর্ণ গন্ডির বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ঠিক এই সময়ে অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় দেশের সমাজব্যবস্থায় কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়নি, একথা ঠিক। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক জুড়ে দেশে যে সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন চলেছিল তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে সুদূরপ্রসারী। সাক্ষরতা আন্দোলনের সাফল্যের মাত্রা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু সত্যের খাতিরে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, এই আন্দোলন শিক্ষাকে শ্রেণিবিশেষের একচেটিয়া অধিকারের জায়গা থেকে মুক্ত করতে পেরেছে। সমাজের নিরন্ন নিরক্ষর পরিবারেও এখন শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। নিজেরা শিক্ষার সুযোগ না পেলেও ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পাক—এটাই এখনকার অর্থাৎ একবিংশ শতকের সূচনাপর্বের অন্যতম সামাজিক অভিপ্রায়। তাই স্কুলে ভরতির সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার সমস্যা পাশাপাশি থাকলেও এখন প্রতিবছর যে, ৫/৬ লক্ষ (সংখ্যাটা ক্রমবর্ধমান) ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নিরক্ষর দম্পতির সন্তান অর্থাৎ প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। এদের সাফল্য ও সাফল্যোত্তর আশা-নিরাশার খবর তো এখন গণমাধ্যমগুলির চর্চার অন্যতম প্রধান প্রসঙ্গ। এই ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষা কোনো আত্মকেন্দ্রিক সমাজবিচ্ছিন্ন ‘তপশ্চর্যা’ নয়, শিক্ষা তাদের কাছে জীবনসংগ্রামের প্রস্তুতি, বই তাদের কাছে সংগ্রামের হাতিয়ার। এটা শুধু এইসব প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদেরই দৃষ্টিভঙ্গি নয়, উন্নয়নমুখী ভারতের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর কাছে শিক্ষা এখন পৌরাণিক তপস্যা নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের কঠোর বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এক সমাজচেতন আধুনিক লড়াইয়ের অঙ্গ, যে-লড়াইয়ে জয়ী হতে পারলে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই মানোন্নয়ন হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এখন শিক্ষাভাবনা, শিক্ষাপরিকল্পনা, শিক্ষাপরিচালনা, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রমের বিন্যাসের ক্ষেত্রে নানা সময়োপযোগী পরিবর্তন ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। শিক্ষাকে তাই এখন মোটামুটি দুটি স্তরে ভাগ করা হয় : প্রারম্ভিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা—এর সঙ্গে সহযোগী হিসাবে আছে বৃত্তিশিক্ষা। প্রারম্ভিক শিক্ষার শুরু শিশুশ্রেণি থেকে, শেষ মাধ্যমিক স্তরে; আর উচ্চশিক্ষার শুরু উচ্চমাধ্যমিক স্তর থেকে, আর শেষ (শেষ না বলে পরিণতি বলাই বোধহয় ভালো) স্নাতকোত্তর স্তরের পরবর্তী নানা স্বীকৃত গবেষণাকর্মে। উচ্চশিক্ষা ও বৃত্তিশিক্ষার নানা পর্যায়ে বিষয়গত ও পদ্ধতিগত প্রয়োজনে তার ভাষা ও পরিভাষা স্বচ্ছ ও সর্বজনবোধ্য না হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু প্রারম্ভিক স্তরে তো শিক্ষার সবটাই ভূমিকাধর্মী, এখানে শ্রেণিনির্বিশেষে শিক্ষিত ও নিরক্ষর পরিবারের ছেলেমেয়েরা একযোগে পরবর্তী উচ্চশিক্ষার ও বৃত্তিশিক্ষার উন্নততর স্তরে যাওয়ার উপযোগী করে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিকভাবে নানা বিষয়ে কিছু সাধারণ জ্ঞান অর্জন করে। এই স্তরের শিক্ষার বিষয়ের মধ্যে যেমন একটা সর্বব্যাপিতা আছে, তেমনি এই শিক্ষার পদ্ধতির মধ্যেও একটা সর্বত্রগামিতার লক্ষ্য নিহিত থাকে। তাই এই স্তরের শিক্ষার ভাষা ও পরিভাষাতেও একটা সর্বাঙ্গীণ স্বচ্ছতা ও সর্বজনীন সহজবোধ্যতা অনেক বেশি পরিমাণে কাম্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ যদি বাংলা ব্যাকরণের নতুন পাঠক্রমে ‘সংজ্ঞা, সূত্র, আলোচনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য, অপ্রচলিত ও অপরিচিত ভাষারীতির ব্যবহার’ বর্জন করে ‘ব্যাকরণপাঠের স্বচ্ছন্দতার উপর’ জোর দেয় এবং ‘অনেকক্ষেত্রে পুরানো দুর্বোধ্য পরিভাষা বর্জন করে নতুন, সহজ ও স্বচ্ছতর পরিভাষা চালু’ করে তবে তাতে, আপত্তি করার বদলে তাকে অভিনন্দন জানানোই হবে সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচায়ক।

দুই

বাংলা ব্যাকরণের নতুন সিলেবাসের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় প্রথাগত ‘পুরুষ’ শব্দের বদলে ‘পক্ষ’ শব্দের ব্যবহার। এই ব্যবহার সম্পর্কে পর্ষদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে :

‘পক্ষ’ শব্দটি ব্যাকরণে প্রচলিত ‘পুরুষ’ শব্দের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণ ‘পুরুষ’ শব্দটিতে একাধিক অর্থ প্রকাশ পায়।….‘পুরুষ’ শব্দের এই অর্থবৈচিত্র্য এই শব্দের দ্রুত বা তাৎক্ষণিক অর্থগ্রহণের পক্ষে সুবিধাজনক নয়।…. এই সূত্রে ব্যাকরণের ক্ষেত্রে প্রচলিত ‘পুরুষে’রও একটি বদলি শব্দ চালু করলে এ-বিষয়ে চর্চা সহজসাধ্য হয়। বস্তুত স্কুলপাঠ্য বাংলা ব্যাকরণের গোড়ার দিককার লেখকেরা ‘পুরুষ’ ও তার শ্রেণিবিভাগের প্রচলিত নামগুলিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। …..এই নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন তখনই অনুভূত হয়েছিল, কিন্তু বাংলা স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের বাজারে কট্টর সংস্কৃতপন্থী পন্ডিতদের ক্রমবর্ধমান ও সংগঠিত চাপের ফলে এই পরিবর্তনের চেষ্টা বেশিদূর এগোয়নি। কিন্তু বর্তমানে যখন শিক্ষিত বাঙালি সমাজে সংস্কৃত ও বাংলা যে-দুটো আলাদা ভাষা এ সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত, তখন পরিবর্তনের জন্য পূর্বসূরিদের এই অপূর্ণ ইচ্ছার সূত্র ধরেই ‘পুরুষ’ ও তার শ্রেণিনামের জায়গায় নতুন, সহজবোধ্য ও স্বচ্ছ শব্দ ব্যবহার করা সঙ্গত মনে হয়। …..দেখা যায়, ভাষায় যত বাক্য ব্যবহার করা হয়, তাতে কোনো-না-কোনো পক্ষের কথা বলা হয়।…..বক্তা বাক্যে কোন পক্ষের কথা বলছে তা বোঝানোর বৈশিষ্ট্যকে সংস্কৃত ও সংস্কৃতানুসারী ব্যাকরণে ‘পুরুষ’ বলা হয়েছে।…..তথাকথিত ‘পুরুষ’ শব্দে যখন উদ্দেশ্যের পক্ষ বোঝা যায় তখন ‘পুরুষ’-এর বদলি শব্দ হিসাবে ‘পক্ষ’ শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া শ্রেণিনামের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সর্বনামের প্রাধান্য অনুসারে উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ ও প্রথম পুরুষের বদলে যথাক্রমে ‘আমি-পক্ষ’, ‘তুমি-পক্ষ’ ও ‘সে-পক্ষ’ ব্যবহার করা যেতে পারে (ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যক্রম, পৃষ্ঠা ২৭-২৯)।

পর্ষদের ব্যাখ্যায় বোঝা যাচ্ছে, ‘পুরুষ’ শব্দটির অর্থগত অস্বচ্ছতার জন্যই তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছতর শব্দ হিসাবেই ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘পক্ষ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাকরণের পরিভাষার ব্যাপারে পর্ষদ যে-স্বচ্ছতার নীতি গ্রহণ করেছে, সেদিক থেকে ‘পুরুষ’-এর তুলনায় ‘পক্ষ’ শব্দটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। কিন্তু কোনো কোনো মহল থেকে এই পরিবর্তনের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে। প্রতিবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে, ব্যাকরণের পরিভাষা হিসেবে ‘পুরুষ’ শব্দটি শিক্ষিত বাঙালি সমাজে সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত, তাই এই পারিভাষিক শব্দের অর্থ সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালির কাছে কোনো অস্পষ্টতা বা দ্বিধাবোধ নেই। কাজেই অর্থগত অস্পষ্টতা বা বিবিধতার কারণ দেখিয়ে ‘পুরুষ’ শব্দটি বর্জন করার কোনো যুক্তি নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাকরণের ‘পুরুষ’ শব্দটির অর্থ নিয়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজে সত্যিই কি কোনো অস্পষ্টতা, অনির্দিষ্টতা বা দ্বিধাবোধ নেই? এ প্রশ্নের মীমাংসার জন্য শিক্ষিত বাঙালি সমাজে দীর্ঘকাল ধরে সুপ্রতিষ্ঠিত দু’খানি বাংলা অভিধানের সাক্ষ্য নেওয়া যাক। এ দুটি অভিধানের একটি হচ্ছে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৩৩-৪৬) এবং অন্যটি হচ্ছে রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৩৭)। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসারে ‘পুরুষ’=‘‘অস্মদাদিভেদে তিঙ বিভক্তির তিন তিনটির সংজ্ঞাবিশেষ, প্রথম ০, মধ্যম ০, উত্তম ০, পা. ১.৪.১০১।’’ অন্যদিকে ‘চলন্তিকা’ অনুসারে ‘পুরুষ’ ‘‘আমি তুমি সেই-র ভেদ (উত্তম-, মধ্যম-, প্রথম-)’’। অর্থাৎ ‘শব্দকোষ’ অনুসারে ‘পুরুষ’ হচ্ছে ‘সর্বনাম’-এর শ্রেণিভেদ। এছাড়া ‘শব্দকোষে’ ‘পুরুষ’-এর ক্রমবিন্যাস সংস্কৃতের অনুসরণে প্রথম, মধ্যম ও উত্তম; কিন্তু ‘চলন্তিকা’য় ‘পুরুষ’-এর ক্রমবিন্যাস সংস্কৃতের অনুগামী নয়, বরং তার বিপরীত : উত্তম, মধ্যম, প্রথম। এ-থেকে বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষিত বাঙালি সমাজে ব্যাকরণের ‘পুরুষ’ শব্দটির অর্থ সুস্পষ্ট বা সুনির্দিষ্ট নয়, বরং দ্বিধাগ্রস্ত এবং এ-ব্যাপারে সংস্কৃতের আদর্শ থেকে সরে আসতেও শিক্ষিত বাঙালি সমাজ অপ্রস্তুত নয় (কারণ, ‘চলন্তিকা’য় ‘পুরুষ’-এর যে-ক্রমভঙ্গ করা হয়েছে তা নিয়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজে কেউ কখনও প্রতিবাদ করেনি)। ব্যাকরণের ‘পুরুষ’-এর ব্যাপারে এটাই যদি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের এক সময়ের মানসিক অবস্থান হয় তবে, সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে পর্ষদ যদি এ কালের শিক্ষার্থীদের সহজবোধ্যতার প্রয়োজনে সংস্কৃত থেকে আরও সরে এসে স্পষ্টতর পরিভাষার সন্ধান করে তবে তাতে আপত্তি করার যুক্তি কী? একমাত্র অন্ধ পশ্চাদগামিতা ছাড়া আপত্তির আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্য তো স্বেচ্ছায় অন্ধত্বকরণ নয়, অন্ধত্ব দূর করে জ্ঞানের উদ্দীপন এবং পশ্চাদগামিতার বদলে অগ্রগামিতা। সুতরাং, শিক্ষার স্বার্থে ‘পুরুষের’ স্বচ্ছতার বদলি শব্দের প্রবর্তন কোনোভাবেই দোষাবহ মনে হয় না। তাছাড়া, সংস্কৃত ব্যাকরণের ইতিহাসেও তো দেখা যায় একই বিষয় বা প্রকরণের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহৃত হওয়ার নজির রয়েছে।

যাই হোক, বিষয়টির আরও গভীরে গিয়ে পর্যালোচনা করা যাক এবং এই প্রসঙ্গে ইংরেজি ভাষার ব্যাকরণে ব্যবহৃত ‘পুরুষ’-বোধক ‘person’ শব্দটির উৎপত্তি ও প্রয়োগের বিষয়টিও বিবেচনা করা যাক। Oxford English Dictionary, Vol. XI (2nd edition, 1989 Clarendon Press, Oxford)-এ দেখা যায় ইংরেজি ব্যাকরণে person শব্দটির ব্যবহার শুরু ১৫২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে, ওই সময় কোনো কোনো ব্যাকরণে person শব্দটির বানান ‘parson’ হিসেবেও পাওয়া যায়। person শব্দটি এসেছে মধ্য-ইংরেজির persone শব্দ থেকে। মধ্য-ইংরেজিতে persone শব্দটি আবার এসেছে ল্যাটিন ভাষার persona শব্দ থেকে, ল্যাটিনে persona শব্দের মূল অর্থ অভিনেতার মুখোশ (এই অর্থের সঙ্গে গ্রিক নাট্যকলার সংস্রব আছে, প্রাচীন গ্রিসে অভিনেতারা নিজেদের ভূমিকা বা চরিত্র অনুসারে এক একরকম মুখোশ পরত)। এখনকার ইংরেজি অভিধানে ব্যাকরণে ব্যবহৃত person শব্দের অর্থ : Oxford Advanced Learner’s Dictionary (6th ed. 2nd reprint 2001) অনুসারে ‘any of the three classes of personal pronouns’, অন্যদিকে Webster’s Encyclopaedic Unabridged Dictionary of English Language (1989) অনুসারে : ‘A category found in many languages that is used to distinguish between the speaker of an utterance and those to or about whom he is speaking’। তাহলে ইংরেজিতে ব্যাকরণের person হচ্ছে বাক্যে বক্তা, বক্তব্য ও বক্তব্যের লক্ষ্যস্থলের মধ্যে পার্থক্য বোঝাবার একটা বৈশিষ্ট্য (category), যা বাক্যের সর্বনাম ও ক্রিয়ারূপের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। এই বৈশিষ্ট্যই বাক্যের সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের রূপগঠনে নির্ণায়ক ভূমিকা (role) গ্রহণ করে। বোঝা যাচ্ছে, এই নির্ণায়ক ভূমিকা (role) বোঝাবার জন্যই ইংরেজি ব্যাকরণের সূচনাপর্বে person শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল এবং মধ্য-ইংরেজিতে ভূমিকা (role) অর্থে person শব্দটি চালু থাকায় ইংরেজি ব্যাকরণের গোড়ার দিকে বাক্যের নির্ণায়ক ভূমিকার নাম হিসাবে ল্যাটিন ব্যাকরণের অনুসরণে person শব্দটির ব্যবহারে কোনো অর্থগত অস্পষ্টতা বা দুর্বোধ্যতা অনুভূত হয়নি। ব্যাকরণের অন্যতম category হিসাবে ইংরেজি-ভাষী শিক্ষিত সমাজে শব্দটি তাই অনায়াসে গৃহীত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে বিষয়টি এইরকম নয়।

ইংরেজি ব্যাকরণের Person শব্দটি ল্যাটিন Persona থেকে মধ্য-ইংরেজির persone-র মধ্য দিয়ে আধুনিক ইংরেজিতে বিবর্তিত হয়ে এসেছে, কিন্তু বাংলা ব্যাকরণে ব্যবহৃত ‘পুরুষ’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে বিবর্তিত হয়ে আসেনি, এসেছে তৎসম শব্দ হিসাবে সরাসরি সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে। সংস্কৃত ভাষার প্রধান ব্যাকরণ ‘অষ্টাধ্যায়ী’তে দেখা যায় ব্যাকরণকার পাণিনি (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী) সংশ্লিষ্ট সূত্রে (১.৪.১০১) ‘পুরুষ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তবে ওই সূত্রে তিনি তিঙ প্রভৃতি ক্রিয়াবিভক্তির প্রথম, মধ্যম ও উত্তম ক্রমনির্দেশ করেছেন। পরবর্তীকালে সর্ববর্মা (৭ম শতাব্দী) কাতন্ত্র ব্যাকরণে পাণিনির ক্রমগুলি উল্লেখ করে ক্রমগুলির একটা সাধারণ নাম (generic term) হিসাবে ‘পুরুষ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এইজন্য The Astadhyayi of Panini গ্রন্থে (1988 Reprint) অষ্টাধ্যায়ীর ইংরেজি অনুবাদক ও সম্পাদক শ্রীশচন্দ্র বসু এই সূত্রটির ব্যাখ্যায় ‘পুরুষ’কে ‘triads of conjudgational affixes’ (Vol I, p-209) বলে উল্লেখ করেছেন। সর্ববর্মা তাঁর সূত্রে ‘পুরুষ’ শব্দটির উল্লেখ করলেও শব্দটি তাঁর নিজের সৃষ্টি নয়। ‘অষ্টাধ্যায়ী’র অপর অনুবাদক ও ব্যাখ্যাতা Sumitra Mangesh Katre তাঁর Astadhyayi of Panini (1st Indian edition, 1989) গ্রন্থে বলেছেন : ‘The word (purdusa) associated with these triplets is considered by Paniniyans as a pre-Paninian Technical term’ (p-102)। প্রকৃতপক্ষে প্রাক-পাণিনীয় শব্দশাস্ত্রের মধ্যে সম্ভবত যাস্ক (আনুমানিক ৮ম-৭ম খ্রিস্টপূর্বাব্দ)-রচিত নিরুক্তেই ‘পুরুষ’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যাকরণের পরিভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ‘নিরুক্তে’ যাস্ক বিভিন্ন বৈদিক মন্ত্রের শাব্দিক বিশ্লেষণ করেছেন। এই রকম একটি বিশ্লেষণে আছে :

তত্র পরোক্ষকৃতা: সর্বাভির্নামবিভক্তিভির্যুজ্যন্তে প্রথমপুরুষৈশ্চাখ্যাতস্য। …অথ প্রত্যক্ষকৃতা মধ্যমপুরুষযোগাস্তত্বমিতি চৈতেন সর্বনাম্না। …অথাধ্যাত্মিক্য উত্তমপুরুষযোগা অহমিতি চৈতেন সর্বনাম্না। (৭/২)

এর ইংরেজি অনুবাদ :

‘Of these the indirectly addressed (hymns) are connected with all the cases of nouns and with the third person of the verb…Now the directly addressed stanzas are connected with the second person and with the pronoun tvam….Now the self-invocations are connected with the first person and the pronoun aham’ (ক্ষিতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক অনূদিত : Technical Terms and Technique of Sanskrit Grammar, 1st Reprint edition, 2003, pp. 153-154)। নিরুক্তে ‘পুরুষ’ শব্দের উল্লেখ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ক্ষিতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পূর্বোক্ত গ্রন্থে বলেছেন :

It would appear from the Nirukta that purusa or person was first used with reference to the verb and then extended to pronouns and then to nouns (p. 154).

তবে ‘পুরুষ’ শব্দটিকে ব্যাকরণের পরিভাষা হিসাবে যাস্ক প্রথম ব্যবহার করলেও শব্দটি তাঁর সৃষ্টি নয়। কারণ তাঁর আগেই ‘পুরুষ’ শব্দটি ভিন্ন অর্থে বৈদিক সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে ব্যবহৃত ‘পুরুষ’-এর সঙ্গে বৈদিক মন্ত্রবাক্যের কোনো শাব্দিক বৈশিষ্ট্যের ক্রিয়াগত (functional) সাদৃশ্য লক্ষ করেই সম্ভবত মন্ত্রবাক্যের ওই শাব্দিক বৈশিষ্ট্যকে ‘পুরুষ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাহলে জানতে হয় ব্যাকরণের বাইরে সাধারণ সাহিত্যে ‘পুরুষ’ শব্দের অর্থ কী।

অভিধানে ‘পুরুষ’ শব্দের অন্তত তিনটি ব্যুৎপত্তি পাওয়া যায় :

১. /পুর (= অগ্রগমন) + উষ (কুষণ) = অগ্রগামী [উণাদিসূত্র ৪.৭৪]।

২. /পূ (= পূরণ করা) + উষ (কর্তৃ) = পূরণকারী।

৩. /পুর (= দেহ) + শী + অ (কতৃ) = দেহশায়ী, আত্মা [বাচস্পত্য অভিধান]।

বলাবাহুল্য, ‘পুরুষ’ শব্দের তিনটি ব্যুৎপত্তিতেই বৈদিক যুগের পুরুষপ্রধান ও অধ্যাত্মবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। এই সমাজব্যবস্থায় পুরুষের ভূমিকা ছিল অগ্রবর্তী, সমাজের নিয়ম-কানুন প্রণয়নে পুরুষই নিত প্রধান নির্ণায়ক ভূমিকা। এরই সাদৃশ্য বাক্যশায়ী যে-বৈশিষ্ট্য বাক্যের অভিমুখ (পরোক্ষ, প্রত্যক্ষ ও আধ্যাত্মিক অর্থাৎ আত্মমুখীন) নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ করে তখনকার শব্দশাস্ত্রে তাকেই ‘পুরুষ’ বলা হয়েছে। সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিভাষা হিসাবে ‘পুরুষ’ শব্দ ব্যবহারের এটাই ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা।

প্রাচীনকালের সংস্কৃত ব্যাকরণ-শিক্ষা পুরুষপ্রধান ও অধ্যাত্মবাদী সমাজব্যবস্থার অঙ্গীভূত থাকায় ব্যাকরণের পরিভাষা হিসাবে ‘পুরুষ’ শব্দ ব্যবহারে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের ‘পুরুষ’ শব্দটির ব্যবহারে গোড়া থেকেই কিছু অসুবিধা ঘটেছে। এই অসুবিধা একদিকে যেমন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন স্কুলপাঠ্য বাংলা ব্যাকরণ রচনার সূচনা হয়েছিল, তখন একবার দেখা দিয়েছিল, আবার এই একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যখন ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এই অঙ্গীকার মাথায় রেখে বাংলা ব্যাকরণ পাঠকেও সহজ, স্বচ্ছ ও স্বচ্ছন্দ করার চেষ্টা চলছে এবং সামগ্রিকভাবে শিক্ষাকে ধর্মীয় সংস্রব ও অন্যান্য বৈষম্যমূলক পক্ষপাত থেকে মুক্ত রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তখন ব্যাকরণে ‘পুরুষ’ শব্দটির ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা ব্যাকরণে ‘পুরুষ’ শব্দটি ব্যবহারের সমস্যা ছিল অন্যরকম। তখন যাঁরা বাংলায় বাংলা ব্যাকরণ লিখতেন তাঁদের সামনে বাংলা ব্যাকরণের কোনো প্রতিষ্ঠিত আদর্শ ছিল না। তখন বাংলা শেখার জন্য ইংরেজিতে কয়েকটি বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়েছিল, সেই সব ব্যাকরণে ইংরেজি ভাষার ব্যাকরণের তখনকার রীতিপদ্ধতি অনুসৃত হয়েছিল। রামমোহনও প্রথমে সেই রীতিপদ্ধতি অনুসরণ করে ইংরেজিতে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লেখেন (১৮২৬), এরপর স্কুল বুক সোসাইটির অনুরোধে বাংলায় ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ (১৮৩৩) লেখার সময়ও তিনি ইংরেজি ব্যাকরণের আদর্শ অনুসরণ করেছেন। ইংরেজি ব্যাকরণে person মূলত সর্বনামের শ্রেণিবিভাগ, তাই রামমোহনও তাঁর ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণে’ ‘প্রতিসংজ্ঞা’ (রামমোহন সর্বনামের বদলে ‘প্রতিসংজ্ঞা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন)-র শ্রেণিবিভাগকে ‘পুরুষ’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তবে এখানে লক্ষণীয় এই যে, ‘চতুর্থ অধ্যায়ে’র ‘প্রতিসংজ্ঞার প্রকরণে’ ‘পুরুষে’র শ্রেণিনাম হিসাবে একবারমাত্র ‘উত্তম পুরুষ’, ‘মধ্যম পুরুষ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করলেও (এখানে পূর্বোক্ত দুটি পুরুষের সঙ্গে ‘তৃতীয় পুরুষ’ শব্দটি উল্লিখিত) বইয়ের আগাগোড়া সর্বত্র ‘প্রতিসংজ্ঞা’র শ্রেণিবিভাগ হিসেবে ক্রমান্বয়ে ‘প্রথম পুরুষ’, ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ ও ‘তৃতীয় পুরুষ’ শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন। বলাবাহুল্য, এগুলি যথাক্রমে ইংরেজি ব্যাকরণের 1st person, 2nd person এবং 3rd person-এর বঙ্গানুবাদ। অর্থাৎ রামমোহন ‘পুরুষে’র আলোচনায় সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে শুধু ‘পুরুষ’ শব্দটি নিয়েছেন, কিন্তু পুরুষের ক্রমনির্দেশে সংস্কৃতের বদলে ইংরেজি ব্যাকরণের ক্রম অনুসরণ করেছেন। অন্যদিকে ওই সময়ের (১৮৪০) অপর বাংলা ব্যাকরণকার ভগবচ্চন্দ্র বিশারদ, যিনি ‘মুগ্ধবোধাভিধেয় সংস্কৃত ব্যাকরণের স্থূলার্থ সংক্ষেপে সংগ্রহ করিয়া সাধুভাষায় সাধুভাষার….ব্যাকরণসার সংগ্রহ নামক গ্রন্থ প্রস্তুত’ করেছেন, তাঁর কাছে তাঁর ব্যাকরণে ‘পুরুষ’ শব্দটি ব্যবহারে অন্য সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তিনি সংস্কৃতপন্থী, সুতরাং তাঁর ব্যাকরণে ‘পুরুষ’ শব্দটির ব্যবহারই প্রত্যাশিত, কিন্তু তাঁর সমস্যা ছিল, সংস্কৃতের অনুসরণে ‘পুরুষ’ শব্দটি ব্যবহার করলে সংস্কৃত ব্যাকরণে ‘পুরুষ’কে যেভাবে দেখানো হয়েছে তাঁকেও সেইভাবে দেখাতে হয়। ইংরেজিতে যেমন person মূলত সর্বনামের শ্রেণিবিভাগ, সংস্কৃতে তেমনি ‘পুরুষ’ মূলত ক্রিয়াবিভক্তির ত্রিধাভাগ, এর সঙ্গে বচনের প্রশ্নটিও জড়িয়ে আছে, অথচ বাংলা ক্রিয়াপদের বৈচিত্র্যকে মাত্র তিনভাগে বিন্যস্ত করা যায় না এবং বচনের প্রশ্নটিও বাংলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এজন্য এই ক্ষেত্রে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণের আশ্রয় নিয়েছেন এবং বিশেষে ভাবে ‘পুরুষ’ শব্দটির অনুষঙ্গিক দায় এড়াবার জন্য এক্ষেত্রে একেবারে ইংরেজি ব্যাকরণের ‘person’ শব্দের বঙ্গানুবাদ করে ‘ব্যক্তি’র ক্রম হিসাবে ইংরেজি ব্যাকরণের অনুকরণে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়—এই ক্রম ব্যবহার করেছেন।

রামমোহন ও ভগবচ্চন্দ্রের দৃষ্টান্তে বোঝা যায় বাংলা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের ‘পুরুষ’-এর ধারণা মিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে কিছু অসংগতি আছে। তবে ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’তে তিঙন্ত প্রকরণের গোড়ায় দেখা যায় ‘পুরুষ’কে ত্রিধাবিভক্তি হিসাবে দেখিয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রথম-উত্তম-মধ্যম—এই ক্রমনামগুলি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তার বিশদ ব্যাখ্যায় ইংরেজি ব্যাকরণের person-এর ক্রম অনুসরণ করে বলা হয়েছে : ‘অস্মদ শব্দে উত্তম পুরুষ বুঝায়; যুষ্মদ শব্দে মধ্যম পুরুষ বুঝায়; তদভিন্ন সমুদয় শব্দে প্রথম পুরুষ বুঝায়।’ আসলে তখনকার ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি ছাত্রদের কাছে সংস্কৃত ব্যাকরণের পাঠ সহজসাধ্য করার জন্যই ইংরেজি ও সংস্কৃত রীতির মধ্যে একটা কাজ চালানো- গোছের সামঞ্জস্য করা হয়েছিল। সেই সামঞ্জস্যের আদর্শ সমকালীন বাংলা ব্যাকরণগুলিতেও অনুসৃত হয়েছিল এবং সেই আদর্শের অনুকরণ আজও অব্যাহত। প্রকৃতপক্ষে এই সামঞ্জস্যের মাধ্যমে একটা সত্য বেরিয়ে আসে যে, সময়ের প্রয়োজনে পূর্বাদর্শ থেকে সরে আসা মোটেই দোষাবহ নয় এবং পূর্বপুরুষেরাও কখনও তা মনে করেননি। এই সত্যের পরিপ্রেক্ষিতেই মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বাংলা ব্যাকরণের সাম্প্রতিক পাঠ্যক্রমে প্রথাগত ‘পুরুষ’ শব্দের বদলে ‘পক্ষ’ শব্দ ব্যবহারের বিষয়টি বিচার করতে হবে। বিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকেই রাষ্ট্রসঙ্ঘের নেতৃত্বে সারাপৃথিবীতে ‘সবার জন্য শিক্ষা’র একটা দাবি উঠেছে এবং এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার লক্ষ্য, আদর্শ ও পদ্ধতি নিয়ে এখন নানা নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে, ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। সম্ভবত, শিক্ষাসংক্রান্ত এই নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বাংলা ব্যাকরণের পঠন-পাঠনে পুরোনো দিনের উচ্চবর্গীয় (elitist) ধ্যানধারণা বর্জন করে ভাষারীতির ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্য ও পরিভাষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার নীতি গ্রহণ করেছে, এবং এই সূত্রে পাঠ্যক্রমে অস্পষ্ট পরিভাষা ‘পুরুষ’-এর বদলে স্বচ্ছতর পরিভাষা ‘পক্ষ’ ব্যবহৃত হয়েছে এবং বিভ্রান্তিকর ‘উত্তম পুরুষ’, ‘মধ্যম পুরুষ’ ও ‘প্রথম পুরুষ’-এর বদলে স্পষ্টতর পরিভাষা যথাক্রমে ‘আমি-পক্ষ’, ‘তুমি-পক্ষ’ এবং ‘সে-পক্ষ’ ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পর্ষদের এই নির্দেশ অনুসারে নতুন ব্যাকরণ রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে এবং সারা পশ্চিমবঙ্গে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ অনুমোদিত বিদ্যালয়গুলিতে এইসব নতুন ব্যাকরণই পড়ানো শুরু হয়েছে। যাঁরা এইসব বই পড়াচ্ছেন, তাঁরা এই নতুন পরিভাষা নিয়ে কোনো আপত্তি করছেন না, বরং নতুন পরিভাষাকে কর্মরত শিক্ষকেরা সহজ মনে গ্রহণ করেছেন। শিক্ষক সংগঠনগুলিও এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কোনো কোনো অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং স্কুলশিক্ষার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন এমন কোনো কোনো প্রবীণ অধ্যাপক নিতান্ত বয়োজ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এ-ব্যাপারে ব্যক্তিগত আপত্তি জানাচ্ছেন। এই আপত্তির পিছনে তাঁরা কোনো অ্যাকাডেমিক যুক্তি দেখাচ্ছেন না, তাহলে তাঁদের আপত্তির সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক কোথায়?

যাই হোক, ‘স্বচ্ছতা’ ছাড়াও ‘পুরুষ’ শব্দটির পরিবর্তনের ব্যাপারে এখন আরও কিছু সময়োপযোগী প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে এখন সমস্ত স্কুলপাঠ্য বইতে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে। এই নির্দেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মনে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমানাধিকারের আদর্শ নিবিড়ভাবে সঞ্চার করা। এইজন্য ভাষা ও সাহিত্য ছাড়াও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যক্রমে ধর্মীয়, জাতপাত ও লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়গুলি যাতে স্থান না পায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। পাঠ্যক্রম তৈরির ব্যাপারে এই সাম্প্রতিক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাকরণের পরিভাষা হিসেবে ‘পুরুষ’ শুধু অস্বচ্ছই নয়, এর মধ্যে একদিকে যেমন পুরুষপ্রাধান্য তথা লিঙ্গবৈষম্য, অন্যদিকে তেমনি হিন্দু অধ্যাত্মবাদের প্রতিফলন আছে। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা ও লিঙ্গ-নিরপেক্ষতার দিক থেকে বিশেষভাবে স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ বইতে ‘পুরুষ’ শব্দটি বর্জন করাই যুক্তিসঙ্গত। তুলনায় ‘পক্ষ’ শব্দটি যেমন স্বচ্ছতর, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ ও লিঙ্গদ্যোতনাহীন। সুতরাং ‘পুরুষ’-এর তুলনায় ‘পক্ষ’ শব্দের ব্যবহারই সময়োপযোগী। এ ছাড়া প্রথাগত উত্তম-মধ্যম-প্রথম পুরুষের চেয়ে আমি-পক্ষ, তুমি-পক্ষ ও সে-পক্ষের ব্যবহারই স্বচ্ছতার দিক থেকে বেশি উপযোগী। কারণ, একই ছাত্র ইংরেজি ব্যাকরণে যেটাকে 3rd person বলে শিখছে, বাংলা ব্যাকরণে সেটাকেই প্রথম পুরুষ হিসাবে শিখছে। এক্ষেত্রে ইংরেজি 3rd শব্দের বাংলা অর্থ দাঁড়াচ্ছে প্রথম, যা ভাষাজ্ঞানের পক্ষে বিভ্রান্তিকর। অন্যদিকে ‘আমি-পক্ষ’, ‘তুমি-পক্ষ’ ও ‘সে-পক্ষ’—এগুলি সমস্তই মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস (যথা, আমি-পক্ষ = আমি-আমরা সংক্রান্ত পক্ষ)। সংস্কৃত ব্যাকরণে একটি বিশেষ উদাহরণ দিয়ে সমগ্রের নাম দেওয়ার নীতি প্রচলিত আছে (যেমন, বহুব্রীহি সমাস = ‘বহুব্রীহি’ জাতীয় সমাস)। সেই রীতি অনুসারেই ‘আমি-পক্ষ’, ‘তুমি-পক্ষ’, ‘সে-পক্ষ’ ব্যবহারে আপত্তি থাকা উচিত নয়। তবে অধিকতর স্বচ্ছতা ও ইংরেজি ব্যাকরণের সঙ্গে সংগতি রাখার প্রয়োজনে ‘আমি-পক্ষ’-র বদলে প্রথম পক্ষ, ‘তুমি-পক্ষ’-র বদলে দ্বিতীয় পক্ষ এবং ‘সে-পক্ষ’-র পদলে তৃতীয় পক্ষ ব্যবহার করলেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

তবে বিষয়টির এখানেই শেষ নয়। যদি ভবিষ্যতে স্বচ্ছতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও লিঙ্গ-নিরপেক্ষতার দিক থেকে ‘পক্ষ’ শব্দের চেয়ে আরও উপযুক্ত শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়, তবে সেই শব্দকে ‘পক্ষ’-এর জায়গায় বসাতে কোনো যুক্তিবাদী মানুষই আপত্তি করবেন না। কেউ কেউ অবশ্য ভগবচ্চন্দ্রের ‘ব্যক্তি’ শব্দটির ব্যবহারের পক্ষে মতপ্রকাশ করছেন, কিন্তু ‘ব্যক্তি’ শব্দটি ধর্মনিরপেক্ষ ও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ হলেও অর্থের দিক থেকে স্বচ্ছ ও একান্ত (exclusive) নয়। সুতরাং আপাতত ‘পক্ষ’ শব্দটিই চালু থাক। যাঁরা বলছেন সমস্ত পৃথিবীর বাংলাভাষী সমাজ কি এই ব্যবস্থা মেনে নেবে? —তাঁদের উদ্দেশে বিনীত নিবেদন, কোনো বড়ো কাজের সূচনা তো ছোটো জায়গা থেকেই করতে হয়। আর, এটা তো রবীন্দ্রনাথেরই সুচিন্তিত পরামর্শ।

__________________________________________________

টীকা-নির্দেশ

১. পর্ষদের সংশ্লিষ্ট সিলেবাসের প্রথম সংস্করণ দ্রষ্টব্য।

২. পর্ষদ-আয়োজিত বিভিন্ন কর্মশালায় প্রায় ৭০% শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানিয়েছেন যে, ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘পক্ষ’ শব্দটি পড়ানো ও বোঝানোর পক্ষে সুবিধাজনক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ত্রিপুরার স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণে ‘পুরুষে’র বদলে ‘পক্ষ’ এখন সর্বজনস্বীকৃত। ঢাকা বাংলা একাডেমীর ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ বইতে (ডিসেম্বর, ২০১১) ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘পক্ষ’ পরিভাষাটিই গৃহীত হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *