মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে এক চলচ্চিত্র প্রযোজক আমাকে চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লিখতে অনুরোধ করেছিলেন এবং বেশ করে বলে দিয়েছিলেন, গল্পটা যেন খুব জুসি হয়, যেন পুরোটা গল্পজুড়ে থাকে হিরোকে পাওয়ার জন্য দুটো মেয়ের মধ্যে কাড়াকাড়ি মারামারি কামড়াকামড়ি। প্রযোজকের আমন্ত্রণ আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, মুখের ওপর বলে দিয়েছিলাম, ‘এ ধরনের বিচ্ছিরি গল্প আমার দ্বারা সম্ভব নয় লেখা। আপনি অন্য লেখক দেখুন’।
আমি পছন্দ না করলেও এ ধরনের বিচ্ছিরি গল্প বাস্তবে অহরহই ঘটে। পুরুষ প্রেম করে বা ফষ্টিনষ্টি করে একাধিক মেয়ের সঙ্গে, আর পুরুষকে দোষ না দিয়ে মেয়েরা একে অপরকে দোষারূপ করে। শুধু দোষারূপই নয়, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-লড়াই এমন পর্যায়ে ওঠে যে খুনোখুনি পর্যন্ত ঘটে, আত্দহত্যা তো আছেই। আর পুরুষ, ধোয়া তুলসী পাতা, দূরে দাঁড়িয়ে মজা লোটে। এই সেদিন ভারতের বিশাল মঞ্চেই ঘটে গেল এরকম ঘটনা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদর্শন শশী থারুর পাকিস্তানি সাংবাদিক মেহর তারারের সঙ্গে প্রেম করেছেন লুকিয়ে, এর প্রমাণ পেয়ে তার স্ত্রী সুনন্দা পুশকার স্বামী শশীকে দোষ না দিয়ে দোষ দিলেন মেহর তারারকে। উত্তেজিত, ক্রোধান্বিত সুনন্দা মেহর তারারকে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী দলের দূত বলেও ঘোষণা করেছেন। মেহর তারারও সুনন্দা পুশকারকে কটাক্ষ করেছেন। শুধু মুখটি খোলেননি শশী থারুর। পুরুষেরা চুপ থাকে। মেয়েরা চুলোচুলি চালিয়ে যায়। আর এরকম ঘটনায় যদি প্রাণ যায় কারুর, সে মেয়েদের। পরকীয়া করলেন শশী থারুর, মৃত্যু হলো তার স্ত্রীর।
আত্দহত্যা নাকি হত্যা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে এসব ঘটনায় দুঃখ হলো, দোষী বা অভিযুক্ত নয়, রীতিমত নির্দোষ ব্যক্তিকে প্রাণ হারাতে হয়। এসব ঘটনা আসলে কোনও বয়স মানে না। ষোল বছরের নবীনা যা করে, ষাটের প্রবীণাও তাই করে। এমনিতে হিংসে দ্বেষ ঘৃণা মেয়েদের তুলনায় পুরুষের মধ্যে অনেক বেশি, কিন্তু পুরুষের পরকীয়ায় বা দ্বিচারিতায় প্রকাশ হয় মেয়েদের হিংসেমি। তাও আবার অনর্থক আরেক মেয়ের বিরুদ্ধে। পুরুষের এক শিকার আরেক শিকারের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লাগে, আর শিকারী পুরুষ, আগেই বলেছি, বসে বসে উপভোগ করে গোটা ঘটনা। জনগণ হাসাহাসি করে মেয়েদের নিয়ে, ছি ছি করে মেয়েদের, লেখকরা গল্প উপন্যাস লিখে ফেলে মেয়েদের অতি আবেগ, অতি নির্বুদ্ধিতা আর অতি কুট-কচাল নিয়ে। মেয়েরা হয়ে ওঠে কৌতুকের বস্তু। একে যৌনবস্তু, তার ওপর কৌতুকের বস্তু। সমাজে মেয়েদের স্থান নিচে নামতে নামতে তলায় গিয়ে ঠেকেছে। এ থেকে কে তাদের উদ্ধার করবে কে জানে। নিজেদের বোধোদয় না ঘটলে অবশ্য উদ্ধার করা দুরূহ।
মেয়েদের পেছনে মেয়েদের লেলিয়ে দেওয়া_ পুরুষতন্ত্রেরই কারসাজি, তাই দেখি শাশুড়ি আর বউ-এর মনোমালিন্য, স্বামীকে দোষ না দিয়ে স্বামীর প্রেমিকাকে দোষ দেওয়া, এরকম হাজারো ঘটনা। পুরুষকে পুজো করো, পুরুষকে বাঁচাও, পুরুষকে শান্তিতে-স্বস্তিতে আর নির্বিঘ্নে নিরাপদে রাখো, পুরুষকে আমোদে আহলাদে ডোবাও কারণ পুরুষেরা আমাদের চেয়ে বেশি জানে, বেশি বোঝে, বেশি টাকা উপার্জন করে। পুরুষেরা আমাদের চেয়ে বেশি জানে, বেশি বোঝে, বেশি টাকা উপার্জন করের মতো ভুল এবং নারীবিদ্বেষী ধারণা নিয়ে শুধু পুরুষ নয়, আমরা নারীরাও বেঁচে আছি। মেয়েদের মধ্যে যদি একতা থাকতো, তবে পুরুষতন্ত্র এত দীর্ঘকালব্যাপী এত শতাব্দী ধরে রাজত্ব করতে পারতো না। নারীকে যৌনবস্তু আর কৌতুকের বস্তু হিসেবে বেঁচে থাকতে হচ্ছে, এর পেছনে শুধু পুরুষের বদমাইশিই কাজ করছে না, নারীর বোকামোও কাজ করছে।
সুনন্দা পুশকার, যতদূর অাঁচ করা যাচ্ছে, আত্দহত্যা করেছেন। স্বনির্ভর তিনি, সফল ব্যবসায়ী তিনি। কিন্তু নিজের জীবনের কোনো মূল্য তার কাছে ছিল না। নিজেকে তিনি ভালোবাসেননি। বেসেছিলেন শশী থারুরকে, পুরুষকে। প্রেম পুরুষকে আদৌ কিছু করে কি না জানি না, তবে নারীকে করে অন্ধ, বধির, বোকা, বুদ্ধু, ছ্যাবলা, ক্যাবলা, স্থূলবুদ্ধি। তোমার স্বামী তোমাকে ঠকিয়েছে, অপমান করেছে, অপদস্থ করেছে, স্বামীকে ধরো, স্বামীকে মারো, স্বামীকে ছাড়ো। স্বামী যার সঙ্গে তোমাকে লুকিয়ে প্রেম করছে, তার কোনো দোষ নেই, সেই মেয়ে তোমাকে অপমানও করেনি, ঠকায়ওনি, তার সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি তোমার, কোনো শর্ত দাওনি তুমি, তবে কেন আক্রোশ তার ওপর পড়ে তোমার! পুরুষরা তো তাদের ব্যভিচারী স্ত্রীকে ক্ষমা করে না, যার সঙ্গে স্ত্রী ব্যভিচার করেছে, তাকে শাসিয়ে শাস্তি দিয়ে, স্ত্রীকে ভালোবাসি বলে চুমু খায় না। বরং স্ত্রীকে তালাক দেয়, তাড়িয়ে দেয়, নয়তো হত্যা করে। যদি সুনন্দা পুশকার দ্বিচারিতা করতেন, শশী থারুর কি আত্দহত্যা করতেন? তা করতেন না। বড়জোর স্ত্রীকে তিনি তালাক দিতেন, বা তাড়িয়ে দিতেন। স্বামীর ওপর যারা অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, তারা যদি স্বামীকে শাস্তি দিতে না চায় স্বামীর কোনো অপকর্মের জন্য, তাহলে অন্তত এইটুকু আমরা বুঝতে পারি যে তারা ভয় পাচ্ছে, অথবা তারা নিরুপায় বলে নিজেদের ভাবছে। কিন্তু অর্থনৈতিক নির্ভরতা যাদের নেই, তাদের কিসের ভয়? সামাজিক, মানসিক নির্ভরতার কথা ভেবেই মুখ বুজে থাকা?
পৃথিবীতে নারীই একমাত্র জীব, যারা নিজেদের অত্যাচারী, ধর্ষক আর খুনীর সঙ্গে ভালোবেসে বাস করে। অন্য সব প্রাণীরা নিজেদের নির্যাতনকারী বা অনিষ্টকারী থেকে নিরাপদ দূরত্বে বাস করে। ওদের সঙ্গে চলে না, বসে না, খায় না, শোয় না।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ছলেবলে কৌশলে নারীকে বাধ্য করে পুরুষকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসতে। পুরুষকে যে যত ভালোবাসে, সে তত মর্যাদা পায় সমাজে। পতিব্রতা স্ত্রীর যত কদর, স্ত্রৈণ স্বামীর তত বদনাম। পুরুষকে ভালোবেসে নারী আত্দহত্যা করলে তার মৃত্যুকে বা আত্দত্যাগকে মহিমান্বিত করা হয়, সেই নারী নিয়ে গর্ব করা হয়, আর নারীকে ভালোবেসে পুরুষ আত্দহত্যা করলে সেই পুরুষ নিয়ে কারও কোনো গৌরব হয় না, বরং ‘পুরুষের মতো পুরুষ’ নয় বলে বড় রাগ হয়।
‘পুরুষের মতো পুরুষ’রা স্ত্রীলোকদের জন্য দিওয়ানা হয় না। ‘নারীর মতো নারী’রা পুরুষের জন্য দিওয়ানা হয়। ঠিক উল্টো। সুনন্দা পুশকারের মৃত্যুর পর সুনন্দার প্রশংসায় ভারতবাসী পঞ্চমুখ। সুনন্দা যদি শশীকে শশীর পরকীয়ার জন্য তালাক দিত, তাহলে যারা আজ সুনন্দার প্রশংসা করছে, তারাই হয়তো নিন্দা করতো।
সেই যে বলেছিলাম, সেই পঁচিশ বছর আগে, যে ‘তাহলে কি এই সত্য যে নারীর না মরে মুক্তি নেই’? আজও দেখছি আমার সেই কথাটিই সত্যি হয় পদে পদে। নারীর না মরে মুক্তি নেই। সাকসেসফুল বিজনেসউওম্যান সুনন্দা পুশকারেরও না মরে মুক্তি ছিল না। এই নারীবিরোধী পুরুষতন্ত্রের কবল থেকে নারীর যতদিন মুক্তি না হয়, ততদিন নারীর না মরেও মুক্তি নেই। তবে যেমন তেমন মরা নয়, নারীকে মরতে হবে পুরুষের জন্য, পুরুষের স্বার্থে।
কী ভয়ঙ্কর এই পৃথিবী! গোটা জনসংখ্যার অর্ধেক আমরা বাস করছি শুধু নিম্নলিঙ্গ হয়ে, শিকার হয়ে, খাদ্য হয়ে, দাসী হয়ে, যৌনবস্তু হয়ে, কৌতুকের বস্তু হয়ে, কারণ তিন ইঞ্চি বা চার ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি পুরুষাঙ্গ নেই আমাদের শরীরে। পুরুষাঙ্গহীনতার দোষে জীবনভর আমাদের ভুগতে হয়। আমরা এখনও অর্ধেক জনতাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি না, যা তারা করছে তা ভুল করছে, আর তাদের যা ইচ্ছা তাই করতে দেওয়া যাবে না। ঝাঁকুনি কি করে দেবো! আমি কি একা ঝাঁকালে কাজ হবে! সবাই মিলে ঝাঁকালে কাজ হয়। আমাদের মধ্যে একতা নেই। আমরা নিজেদের দোষ ধরতে, বদনাম করতে, নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি করতে ব্যস্ত। ব্যস্ত বলেই অত্যাচারীরা মহানন্দে অত্যাচার করে যেতে পারে আমাদের। আমাদের একতা নষ্ট করা পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র। আমরা আর কতকাল এই ষড়যন্ত্রের শিকার হবো। এখনও কি সময় আসেনি ঐক্য গড়ে তোলার? এখনও কি সময় আসেনি নারীর ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করে মানুষ প্রজাতিকে সভ্য করার, বাঁচাবার! নারীই তো বাঁচাতে বাঁচাতে এই প্রজাতিকে নিয়ে এসেছে এত দূর! এবার পুরুষ, যারা নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করে না, তারা হয় সভ্য হোক, নয় নিশ্চিহ্ন হোক। শুধু বাঁচলেই হয় না, বৈষম্যহীনভাবে বাঁচতে হয়, তা না হলে সে বাঁচার কোনও অর্থ নেই। বাংলাদেশ প্রতিদিন।
সূত্রঃ বিডি হেরাল্ড ডটকম