পুরুলিয়ার মন্দির স্থাপত্য – দীপকরঞ্জন দাশ
১৯৫৬-র ১ নভেম্বর, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশ আংশিকভাবে অনুসরণ করে ধানবাদ মহকুমা এবং চাস, চন্দনকিয়ারী, পটমদা, চান্ডিল ও ইচাগড় থানা ব্যতিত বিহারের মানভূম জেলার বাকি অঞ্চল নিয়ে সৃষ্ট হয় পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা। এই প্রক্রিয়ায় ভূতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক সম্পূর্ণ অবহেলিত হয়। ফলে রাজনৈতিক সীমারেখাভিত্তিক পুরুলিয়া সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনাই অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ছোটোনাগপুর মালভূমির প্রান্তদেশে অবস্থিত পুরুলিয়া জেলার মূল ধমনী কংসাবতী বা কাঁসাই নদী। বৃষ্টিনির্ভর নদী, ক্ষুদ্রকায় প্রাকৃতিক নালা বা জলাধার, কৃষির অনুপযুক্ত উঁচু প্রস্তরময় জমি এবং আদিম উৎপাদন ব্যবস্থা প্রাচীন যুগে এ অঞ্চলে বিস্তৃত জনপদ গড়ে ওঠার পক্ষে প্রতিকূল ছিল। প্রাগৈতিহাসিক কালে নদীগুলির তটভূমিতে প্রাকৃতিক খাদ্য আহরক জনগোষ্ঠীর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের জনজীবনের বহু নিদর্শন এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। ধাতুর প্রচলনের পরেও এ অঞ্চলের জনজীবন কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল, তা এখনও সহজবোধ্য নয়। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বনিয়াদকে স্থানীয় খনিজ সম্পদ কতটা দৃঢ়তা দিয়েছিল, তাও অজ্ঞাত। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে উন্নত কৃষি ও ধাতুশিল্পের দৌলতে সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠেছিল, তখন পুরুলিয়ায় উদ্ভূত তেমন কোথাও জনপদের উল্লেখ অথবা নিদর্শন পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে পুরুলিয়ায় খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর পূর্বের কোনো তথাকথিত ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়নি। লিপি চরিত্রের নিরিখে পুরুলিয়া জেলার সীমান্তবর্তী ইচাগড়ের একটি খন্ডিত শিলালেখ সপ্তম শতাব্দীর বলে অনুমিত হলেও, তা কোনো প্রতিষ্ঠিত লিপিবিশারদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। পুরুলিয়া জেলাসংলগ্ন চান্ডিলের নিকটবর্তী জয়দায় একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত লিপিসংবলিত কয়েকটি পাথরের টুকরো থেকে জানা যায়, জনৈক দামপ্প এই স্থানে ভগবতী ত্রৈলোক্যবিজয়ার (দুর্গার) একটি মন্দির স্থাপন করেন। লিপিচরিত্র অনুযায়ী অনুমান করা যায়, এই মন্দিরটি অষ্টম-নবম শতাব্দীতে নির্মিত হয়। এই অনুমান যথার্থ হলে জয়দার ত্রৈলোক্যবিজয়ার মন্দির এ অঞ্চলে দৃষ্ট দেব-দেউলগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। এই স্থানে প্রাপ্ত মূর্তিগুলির গড়ন, ডৌল, লাঞ্ছন ও আয়ুধের প্রকৃতি এই অনুমানকে সমর্থন করে। ত্রিস্তর কামে বিভক্ত পাদভাগ বা পাভাগ, চতুষ্কোণ ভূমি-আমলক প্রভৃতিও এই কালনির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
জয়দায় ভগ্ন মন্দিরের মধ্যে প্রাপ্ত দুর্গা, কার্তিক, গণেশাদি পৌরাণিক দেব-দেবীর মূর্তি দেখে মনে হয়, খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর প্রারম্ভ বা কিছু পূর্ব থেকেই পুরুলিয়া-সহ মানভূম অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিস্তার ঘটে। সম্ভবত এই ধর্মীয় প্রভাবে মূলত শিকার এবং আদিম কৃষি ও কারিগরি জ্ঞান-নির্ভর সমাজে কৃত্রিম সেচ-সহ কৃষির আধুনিকীকরণ উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। প্রাচীন জৈন অধিবাসীদের বংশোদ্ভূত বলে অনুমিত শরাক শ্রেণি ছিল কৃষিকার্যে বিশেষ দক্ষ। এ অঞ্চলে উন্নত কৃষিব্যবস্থার প্রচলনে শরাকদের পূর্বপুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বলে মনে করা যায়। সেক্ষেত্রে জঙ্গলাকীর্ণ মানভূমে কৃষির উন্নতিতে জৈনধর্ম প্রচারকদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা থেকে থাকতে পারে। সেই সমৃদ্ধি মন্দির-সহ বহু শিল্পচর্চার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। এই অনুমান অবশ্যই পুরাতাত্ত্বিকদের ব্যাপক ক্ষেত্রসমীক্ষা ও সুপরিকল্পিত খননকার্যের অনুমোদন সাপেক্ষ। কিন্তু প্রায় এ সময় থেকেই পুরুলিয়ায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঞ্চলিক গৌণ রাজ্যের উদ্ভব সম্ভবত প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রান্ত কৃষি ব্যবস্থার প্রতিফলক। উদাহরণ : বুধপুরে বিলুপ্তপ্রায় শিবমন্দির প্রাঙ্গণে প্রাপ্ত এক শিলালেখে বড়ধুগ ও আতন্দীচন্দ্র নামধারী দুই রাজপুত্রের উল্লেখ। লেখচরিত্র দশম শতাব্দীর মধ্যে পুরুলিয়ায় বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র উদ্ভবের ইঙ্গিত দেয়। এই জেলায় যুদ্ধে নিহতের স্মৃতিতে স্থাপিত বীরস্তম্ভ ভূমির উপর আধিপত্য রক্ষা অথবা বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাক্ষ্য বহন করে। এই অস্থির অবস্থার অন্তত আংশিক অবসানের ইঙ্গিত পাওয়া যায় বুধপুরে প্রাপ্ত আনুমানিক একাদশ শতাব্দীর একটি শিলালেখে। পঞ্চ অদ্রী অধীশ্বরের রাজ্য-সীমা নির্দেশক এই লিপিতে সীমানা অগ্রাহ্য না করার জন্য সতর্ক করা হয়েছে। এভাবে ক্রমশ অঞ্চলভিত্তিক গৌণ রাজ্যগুলি নির্দিষ্ট সীমারেখা দ্বারা আবদ্ধ হতে থাকে। একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত রামচরিত গ্রন্থ ও টীকা থেকে জানা যায়, তৈলকম্ব (আধুনিক তেলকুপি)-কে কেন্দ্র করে রুদ্রশিখর একটি আঞ্চলিক রাজ্য শাসন করতেন। বোড়ামে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি (আ. ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী)-তে রুদ্রদেব নিজ যুবরাজপুত্র দ্বারা ত্রিভুবন অধীশ্বর চক্রবর্তীরাজরূপে বর্ণিত হয়েছেন। তৈলকম্প-অধিপতি রুদ্রশিখর এবং বোড়াম লিপির রুদ্র অভিন্ন হলে পুরুলিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল বলে সিদ্ধান্ত টানা যায়। পুরুলিয়া জেলায় যে মন্দির স্থাপত্যচর্চার বিকাশ লক্ষ করা যায়, তা এই রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা-নিরপেক্ষ ছিল, এ ধারণা করা সম্ভবত ঠিক হবে না। নবম শতাব্দীর শেষ পাদ অথবা দশম শতাব্দী থেকে এ অঞ্চলে মন্দির স্থাপত্যের সূত্রপাত অনুমিত হলেও তার বিকাশ একাদশ শতাব্দীর পূর্বে সেভাবে পূর্বলক্ষিত হয় না। প্রায় এ সময় থেকেই প্রাচীন তৈলকম্প মন্দির নগরীতে রূপান্তরিত হতে থাকে। একই সঙ্গে অন্যত্রও মন্দির নির্মাণের গতি বৃদ্ধি পায়। প্রায় সমসাময়িক কালেই পুরুলিয়া-সহ ছোটোনাগপুরে জৈন ধর্মের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। পাকবিড়রার পুরাসম্পদের মধ্যে প্রাপ্ত জৈনমূর্তিসমূহের কোনোটিকেই ভাস্কর্যশৈলীর নিরিখে নবম শতাব্দীর অন্তিম পর্বের পূর্বে স্থাপন করা যায় না। পুরুলিয়া শহরের অনতিদূরে ছড়রার পরিত্যক্ত জৈন মন্দিরটিকেও স্থাপত্যগতভাবে দশম শতাব্দীর পূর্বে স্থাপন করা সম্ভব নয়। অনুমান করা যায়, জৈনধর্ম প্রচারকগণ ও তাঁদের অনুগামী কৃষিনির্ভর শরাক শ্রেণির পূর্বপুরুষদের উদ্যোগে দশম শতাব্দীর পর থেকে পুরুলিয়ায় নির্মিত মন্দিরের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পায়।
স্থাপত্য পরিকল্পনার মূলসূত্র
একাদশ শতাব্দী থেকে ছোটোনাগপুর ও তার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জৈন ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুষ্ঠানের প্রয়োজনে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় মন্দির নির্মাণ চলতে থাকে। প্রতিষ্ঠালিপির অভাবে পুরুলিয়ার মন্দিরসমূহের কোনো নির্দিষ্ট ক্রমপঞ্জি স্থির করা সম্ভব নয়। শৈলীগত বিচারে কালানুক্রম অনুমান ক্ষেত্রবিশেষে সহায়ক হতে পারে। পুরুলিয়া জেলায় এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত দেব-দেউলের অধিকাংশই প্রস্তরনির্মিত, তুলনায় ইটের তৈরি মন্দিরের সংখ্যা খুবই কম। সমস্ত পাথরের মন্দিরই ভারতীয় হিন্দুশাস্ত্রবর্ণিত নাগর শ্রেণিভুক্ত। ক্রুশাকৃতি ভূমি-নকশা ও অনেকটা ধনুকাকৃতি শিখর এ ধরনের মন্দিরের প্রধান দু-টি বৈশিষ্ট্য। ভূমি থেকে শীর্ষ পর্যন্ত মন্দিরের উল্লম্ব সীমারেখার বাধাহীন গতির উপর অত্যধিক ঝোঁক থাকায় ওড়িশি শিল্পশাস্ত্রে স্থানীয় নাগর মন্দিরকে রেখমন্দিররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ক্রুশাকৃতি আসনের উদ্গত অংশের সংখ্যা অনুযায়ী মন্দিরের বহির্দেশ তিন কিংবা ততোধিক অংশে বিভক্ত থাকত। রথ নামে আখ্যাত এই অংশগুলির সংখ্যা অনুযায়ী মন্দিরকে ত্রিরথ, পঞ্চরথ ইত্যাদি পঙক্তিভুক্ত করা হয়। সাধারণত পাথরের মন্দিরের দেওয়াল পাথরবিছানো চত্বরের উপর নির্মিত হত। এক্ষেত্রে কোনো বেদি তৈরির প্রথা ছিল না। পরে অধিষ্ঠান নামক পাদপীঠের প্রচলন হয়। উল্লম্ব অক্ষে মূল তিনটি অংশে দেউল বিভক্ত ছিল, যথা : বাড় (খাড়া দেওয়াল), শিখর ও মস্তক (শিখরশীর্ষস্থিত স্থাপতযাঙ্গসমূহের সমষ্টি)। বাড়ের তিনটি উপবিভাগ ছিল, যথা : পাদভাগ বা পাভাগ, জঙ্ঘা (পাভাগের ঠিক উপরে দেওয়ালের মধ্যাংশ) ও বরন্ড (জঙ্ঘাশীর্ষে সাধারণত দু-টি অনুভূমিক কাম ও তার মধ্যস্থিত কন্ঠ নামক খাঁজ দ্বারা সৃষ্ট কার্নিশ)। বাড়বাহিত শিখর কয়েকটি ক্রমহ্রাসমান ভূমিতলে বিভক্ত করা হত। একাধিক ভূমি-বরন্ডিক (অনুভূমিক কাম) ও তদুপরি প্রতিকোণস্থিত একটি ভূমি-আমলক (খন্ডিত আমলকী-ফলের মতো পলকাটা স্থাপত্যাঙ্গ) দ্বারা গঠিত হত প্রতিটি ভূডিম। সর্বোচ্চ ভূমির উপর স্থাপিত বিসম (এক বা একাধিক পাটা যার উপরিভাগ সমতল কিন্তু বহিপ্রান্তদেশ ঢালু) শিখরের চার দেওয়ালের মধ্যের গহ্বরকে আবৃত করত। বিসমের উপর মস্তক যথাক্রমে বেকী বা কন্ঠ (বেলুনাকৃতি গলদেশ), আমলক, খপুরি (আমলকের উপর খোলা ছাতার মতো অংশ), কলস (পল্লব-সহ ঘটাকৃতি অংশ) এবং ধ্বজ (দেউলে অধিষ্ঠিত দেবতার আয়ুধ অথবা অন্যপ্রকার প্রতীক)-এর সমন্বয়ে গঠিত।
মন্দির সম্মুখস্থ বাড়ের প্রশস্ত ও গভীরভাবে উদ্গত মধ্যরথ (ওড়িশি শিল্পশাস্ত্রে রাহা নামে আখ্যাত) ভেদ করে গর্ভগৃহে প্রবেশের পথ করা হত। লহরা পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবেশপথের দু-পাশের দেওয়ালকে ক্রমশ নিকটবর্তী করে যুক্ত করাই ছিল সাধারণ প্রথা। লহরাংশের পাদমূলে একটি পাথরের পাটা প্রবেশপথের উপর সিলিং-এর কাজ করত। পাটাটির বহিপ্রান্ত প্রবেশদ্বারের সরদলের উপর দিয়ে সামনের দিকে সামান্য কিছুটা প্রসারিত থাকত। পাটার এই প্রসারিত অংশের উপর একটি হালকা দেওয়াল লহরাংশ-সৃষ্ট ভল্টের মধ্যবর্তী ত্রিকোণ গহ্বর (ওড়িশার স্থান বিশেষে ‘গমা’ নামে পরিচিত)-কে পর্দার মতো বাইরে থেকে আড়াল করে রাখত। পর্দারূপ দেওয়ালটি টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো শিখরের নিম্নভাগসংলগ্ন হয়ে থাকত বলে শিল্পশাস্ত্রে এই অংশটির নাম শুকনাসা।
সাধারণত শিখরের চার দেওয়ালের অন্তরকে লহরা পদ্ধতির দ্বারা নিকটবর্তী করে তার উপর কয়েকটি পাটাকে আড়াআড়িভাবে সাজিয়ে গর্ভগৃহের সিলিং নির্মাণ করা হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিলিং ছিল একাধিক। ফলে সিলিং-এর সংখ্যা অনুযায়ী শিখরের অন্তর চতুর্দিক আবদ্ধ কয়েকটি তলে বিভক্ত হত। ওড়িশি শিল্পশাস্ত্রে সর্বনিম্ন অর্থাৎ ঠিক গর্ভগৃহের উপরিস্থিত সিলিংকে গর্ভমুদ এবং সর্বোচ্চ সিলিংকে অর্থাৎ বিসমের তলদেশকে রত্নমুদ বলা হত (মুদ-এর অর্থ সিলিং)। টাই-বিমের কাজ করে সিলিং-এর পাটাগুলি সুউচ্চ মন্দির-ভবনের ভারসাম্য বজায় রাখা ও তীব্র বায়ুর আঘাত প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান গ্রহণ করেছিল।
পুরুলিয়া তথা মানভূমের দেউল-পরিকল্পনা, নির্মাণ-প্রক্রিয়া, অঙ্গসজ্জা প্রভৃতির উপর ওড়িশি প্রভাব সুস্পষ্ট। ছোটোনাগপুর মালভূমির মধ্য দিয়ে উপকূলবর্তী ওড়িশার সঙ্গে গাঙ্গেয় উত্তর ভারতের যোগাযোগের অতি প্রাচীন পথ ধরে যে এই প্রভাব পুরুলিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রবাহিত হয়েছিল তা সন্দেহাতীত। গর্ভগৃহের দৈর্ঘ্য-প্রস্থকে দেওয়ালের গভীরতার দ্বিগুণ করা, ত্রিরথ আসনের তিনটি রথেরই সম দৈর্ঘ্য, একটি কন্ঠ দ্বারা পৃথকীকৃত দু-টি আনুভূমিক কাম দ্বারা গঠিত বরন্ড, প্রায় লম্বভাবে উন্নীত শিখর, উত্তল পলকাটা আমলক ও ভূমি-আমলক, শিখরের রাহা বা মধ্যরথের উপর চৈত্যগবাক্ষ নকশার পরস্পর বিজড়িতভাবে পুনরাবৃত্তি, গর্ভগৃহের প্রবেশপথের দুই পার্শ্বদেওয়াল এবং তাদের সংযোগকারী লহরা ভল্টকে পাথরের মুদ বা সিলিং দ্বারা বিভাজন করা, মন্দিরের অন্তরে শিখরকে একাধিক মুদ দ্বারা কয়েকটি বদ্ধতলে বিভক্ত করা, নবগ্রহ সরদল, মনুষ্য-কৌতুকী নামক ঢেউ খেলানো লতায় আরোহণগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মনুষ্যমূর্তি প্রভৃতি অলংকরণের বিষয়বস্তু পুরুলিয়ার মন্দির স্থাপত্যে ওড়িশি প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে। বর্তমানে পার্শ্বদেওয়ালের মধ্যরথের কুলুঙ্গিগুলি সর্বক্ষেত্রেই খালি থাকায় এগুলিতে কী ধরনের মূর্তি থাকত তা অনুমানসাপেক্ষ। বিশেষত উত্তর ভারতে প্রচলিত প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী পুরুলিয়ার শৈব মন্দিরের কুলুঙ্গিগুলিতে দুর্গা, কার্তিক ও গণেশ-এর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত থাকত বলে মনে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জয়দায় মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এই তিন দেব-দেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে। অবশ্য পুরুলিয়ায় যেসব জৈন মন্দির রয়েছে তাদের কুলুঙ্গিগুলিতে একদা প্রতিষ্ঠিত কিন্তু অধুনা অপসৃত পার্শ্বদেবতাদের সম্পর্কে এটুকু অনুমানও সম্ভব নয়।
অধিকাংশ মন্দিরই নিরাভরণ হলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে সীমিত অলংকরণ দেখা যায়। টুরুহুরু, ক্রোশজুড়ি-সহ কয়েকটি স্থানে উন্নতমানের ভাস্কর্যশোভিত দ্বারদেশের চিহ্ন পাওয়া গেছে। পাড়ার লক্ষ্মীমন্দিরগাত্রে ভাস্কর্যের প্রাচুর্য এ অঞ্চলের মন্দিরসজ্জার ক্ষেত্রে এক বিরল ব্যতিক্রম। মন্দিরদ্বারের পার্শ্বস্তম্ভের পাদমূলে গঙ্গা, যমুনা ও দুই দ্বারপালের মূর্তি এবং তার উপর পাশাপাশি কিন্তু প্রলম্বিত পদ্মপাপড়ি, পুতির সারি, হীরকাকৃতি ফ্রেমের মধ্যে চার পাপড়ির ফুল, মনুষ্যকৌতুকী প্রভৃতির উপস্থিতি অল্প কয়েকটি নিদর্শনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দ্বার সরদলের ঠিক মাঝখানে ললাটবিম্ব (টিপের মতো একটি সামান্য উন্নত চতুষ্কোণ ক্ষেত্র) অনেক সময়ই গজ-লক্ষ্মী, গণেশ, সূর্য, লকুলীশের ক্ষুদ্র মূর্তি দ্বারা অধিকৃত হয়ে থাকত। জৈন মন্দিরের ললাটবিম্বে তীর্থংকর অথবা তার শাসন দেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ করার প্রথা ছিল। মূর্তিবিহীন ললাটবিম্বের সংখ্যাও অবশ্য কম নয়।
ছড়রায় কালের কুটির দৃষ্টির অন্তরালে যে দেউলটি এখনও বর্তমান, তার দেওয়ালে জৈব চুনের পলেস্তারার কিছু কিছু নিদর্শন এখনও রয়েছে। এ থেকে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে, অন্তত কোনো কোনো পাথরের মন্দিরের বহির্ভাগ ও অভ্যন্তরে চুনের প্রলেপ দেওয়া হত। এই প্রলেপের কাঁচা অবস্থায় মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ অলংকরণকে মার্জিত রূপ দান করা হত।
পুরুলিয়া ও ওড়িশা : তুলনামূলক রেখশৈলী
মৌলিক সাদৃশ্য থাকলেও পুরুলিয়া ও ওড়িশার মন্দির স্থাপত্যের ক্রমবিকাশ অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়নি। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে ওড়িশায় যখন মন্দির-পরিকল্পনা, অবয়ব ও গঠনে নিয়ত পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও বিবর্তন ঘটেছিল, তখন পুরুলিয়ার শিল্পীকুলকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল রক্ষণশীলতা। পুরুলিয়ার শিল্পগোষ্ঠী সম্ভবত ওড়িশার মন্দির স্থাপত্যের বিবর্তনের পথ অনুসরণে অসমর্থ হয়ে স্থানীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রাথমিক রূপটিকেই যথাসম্ভব অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করে গেছেন। ফলে পুরুলিয়া-সহ মানভূম ভূভাগে বজায় থাকে এক স্বতন্ত্র স্থাপত্যশৈলী, যা মূলত বৈভব বর্জিত রেখশৈলীর সরলীকৃত প্রকাশমাত্র। ভৌগোলিক দূরত্ব এবং যথাযথ ভাববিনিময়ের অভাবের ফলে ওড়িশায় উদ্ভাবিত নব্য স্থাপত্যাঙ্গ এবং তাদের সংস্থাপন পুরুলিয়ার শিল্পীকুলের বোধগম্য হয়নি। যেমন—ঘট-পল্লবের ধারণা সৃষ্টিকারী দেওয়ালের পাদভাগে অন্যান্য কামের সঙ্গে যুগ্মভাবে কুম্ভ (কুম্ভের উদরদেশের বৃত্তাকার পরিধির প্রায় অর্ধাংশের আকৃতিধারী কাম) এবং পাটা বা পট্ট (তৃতীয় বন্ধনীসদৃশ কাম যা কুম্ভমুখ-প্রান্তের আভাসস্বরূপ)-এর সন্নিবেশের অর্থ এ অঞ্চলের শিল্পীদের অবোধ্যই থেকে যায়। তাই এখানে কুম্ভের উপর পাটার বদলে খুর নামক কাম দেখা যায়। কামের সংখ্যা ও প্রকৃতিতেও পার্থক্য নজরে পড়ে। ওড়িশার পাদভাগে পাঁচটির বেশি কাম নেই। কিন্তু পুরুলিয়ায় কামের সংখ্যা ও সন্নিবেশে শৃঙ্খলার অভাব নজরে পড়ে। বিবর্তনের ফলে ওড়িশায় জঙ্ঘ্যাংশ উল্লম অক্ষে তিনটি উপ-অঙ্গে বিভক্ত হয়ে যায়। পুরুলিয়ায় বিরল ক্ষেত্র ব্যতীত এই অঙ্গের একাধিক বিভাগ হয়নি। জঙ্ঘায় মধ্যস্থলের রাহা নামক উদ্গত অংশের দুই পার্শ্ববর্তী রথে সারিবদ্ধ অর্ধস্তম্ভের অবস্থান পুরুলিয়ার মন্দির স্থাপত্যকে এক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দান করেছে। পার্শ্ববর্তী বাঁকুড়া জেলায় এ ধরনের কয়েকটি নিদর্শন আছে। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলায় খিচিং-এর চন্দ্রশেখর ও বিহারের ধানবাদ জেলায় পানড়ার কপিলেশ্বর মন্দিরে অনুরূপ অর্ধস্তম্ভ দেখা যায়। ওড়িশায় বাড় এবং শিখর বিভাজক বরন্ডের খাঁজকাটা কান্টি বা কন্ঠের স্থান কালক্রমে কয়েকটি কাম দ্বারা অধিকৃত হয়। পুরুলিয়ায় প্রথাগত শৈলীর শেষ পর্যায়েও রেখ-দেউলের কান্টি স্থানচ্যুত হয়নি। শিখরের ক্ষেত্রে অবশ্য ওড়িশার মতো পুরুলিয়াতেও প্রথমে সমকোণ ভূমি-আমলক দ্বারা তল বিভাজন করা হলেও, পরবর্তীকালে তা বর্তুলাকার রূপ ধারণ করে। কিন্তু এ অঞ্চলে ওড়িশার অনুরূপ কণিক (শিখরের প্রান্তভাগের রথ) অনুভূমিক অক্ষে কখনোই দু-টি তল—যার বহিপ্রান্তস্থিত উদ্গত তলটি গোলাকার—দেখা যায় না। ফলে কোণগুলি উল্লম্ব অক্ষে বৃত্তাকার হয়ে শিখরকে কমনীয় করতে পারেনি। এজন্য দেউলের ঋজুত্ব প্রাধান্য লাভ করে। একইভাবে রাহা ও তার পার্শ্বদেশের মিলনস্থলে ক্রমহ্রাসমান স্তরে উন্নীত অঙ্গশিখরের অনুপস্থিতি পুরুলিয়ার শিখরকে ওড়িশার শিখর থেকে পৃথক করেছে। অপরপক্ষে ক্রমবিকাশের শেষ পর্যায়ে নির্মিত দেউল-শিখরের রাহা অলংকরণে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত চৈত্যগবাক্ষ নকশা দ্বারা সৃষ্ট জালিকার ব্যবহারে ওড়িশার প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে (যথা বান্দার পরিত্যক্ত দেউল) এই জালিকার পরিবর্তে কুন্ডলীকৃত পত্রপুষ্পশোভিত লতার ব্যবহারে ওড়িশার প্রভাবের ক্ষীণতাই প্রকাশ পায়। পুরুলিয়ার কোনো কোনো মন্দিরে (যেমন পারার লক্ষ্মীমন্দির) হরতনাকৃতি চৈত্যগবাক্ষ অলংকরণের উপকরণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। ওড়িশায় অনুরূপ চৈত্যগবাক্ষ দেখা না গেলেও বিহারের গয়া জেলায় কোচের মন্দিরে এই নকশাটি লক্ষ করা যায়। সাধারণত এই অঞ্চলের দেউল-শিখরে অঙ্গশিখর দেখা যায় না। আনুমানিক পঞ্চদশ শতকে নির্মিত পারার লক্ষ্মীমন্দিরের শিখরের রাহায় সারিবদ্ধ অঙ্গশিখর এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমস্বরূপ। কিন্তু অঙ্গশিখরগুলির অবয়ব ও শিখর তল অতিক্রম করেনি। তাই অন্যান্য অলংকরণের প্রায় অঙ্গীভূত হয়ে নিজস্ব অস্তিত্বকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে অসমর্থ হয়েছে। কিন্তু, পাঞ্চেত জলাধার নির্মাণের ফলে বিনষ্ট তেলকুপির দু-একটি মন্দিরের শিখরাংশে রাহার পাদমূলে বিপুলাকৃতি অঙ্গশিখর এবং মূল শিখরের বক্রতা ও ভারী গড়ন ওড়িশার প্রভাবের ফল হতে পারে। তথাপি বিভিন্ন অংশের অনুপাতে ভারসাম্য রক্ষিত না হওয়ায় এ ধরনের দেউলগুলি এক অবক্ষয়িত শৈলীর প্রতীকে পরিণত হয়। পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো স্থানে এবং ওড়িশা-সহ ভারতের বহু অঞ্চলে দেউল-শিখরের মধ্যভাগ থেকে উদ্গত ঝম্পসিংহ অথবা গজসিংহ মূর্তি দেখা গেলেও, পুরুলিয়ায় অনুরূপ উদাহরণ অতি বিরল। ক্রোশজুড়ির কাশীনাথ শিবমন্দিরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঝম্পসিংহ পাওয়া গেছে, যা ওড়িশাতেও সম্ভবত একাদশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে গজসিংহে পরিণত হয়। ওড়িশার শিখরশীর্ষের পার্শ্বে স্থিত গণ এবং প্রতি কোণে উপবিষ্ট সিংহ মূর্তি পুরুলিয়ায় দৃষ্টিগোচর হয় না। শিখরের চার দেওয়ালের মধ্যস্থিত গহ্বর আবৃতকারী বিসমের উপর স্থাপিত মস্তকের বিশাল পরিধিযুক্ত আমলকের তুলনীয় উদাহরণ আবার ওড়িশায় অনুপস্থিত। বেশ কিছুকাল পরে এই আমলক সামঞ্জস্যহীনভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকার হয়ে যায়। ওড়িশার ন্যায় আমলকের উপর খপুরি স্থাপনের প্রথা অনুসৃত হলেও, তা এখানে চিরকালই এক নগণ্য এবং প্রায় দৃষ্টি-অগোচর স্থাপত্যাঙ্গ।
সুতরাং, জন্মলগ্নে ওড়িশারীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকলেও (যদিও এই অনুপ্রেরণা পরিমাপ করার মতো প্রাচীনতম নিদর্শনগুলি আজ নিশ্চিহ্ন) পুরুলিয়া অঞ্চলের রেখদেউলের বিবর্তন স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহিত। বিবর্তনের পথে ওড়িশার স্থাপত্যশৈলীর কিছু কিছু প্রভাব এসে পড়লেও, পুরুলিয়ার গ্রহণের পদ্ধতি উভয় অঞ্চলের শিল্পীগোষ্ঠীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগের অভাবকেই প্রতিফলিত করে। কালের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী ভাবে এই দুই অঞ্চলের বিবর্তনের ধারার দূরত্বও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
প্রথম থেকেই পুরুলিয়ার মন্দির স্থাপত্যকে আচ্ছন্ন করেছিল এক রক্ষণশীল মনোভাব। ভারতের অন্যান্য প্রদেশে যখন রেখদেউলের আসনের নকশা, দেহগঠন, অলংকরণ, স্থাপত্যাঙ্গে সরলতা থেকে জটিলতার পথে অগ্রসর হওয়ার ইতিহাস, তখন কালের গতি উপেক্ষা করে পুরুলিয়ার দেউল সারল্য-আশ্রিত থেকেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ডপ-সহ দেউল (যথা টুইসামা, বান্দা ও পারার পরিত্যক্ত মন্দিরত্রয়) বা পঞ্চায়তন দেউল (যথা বুধপুরের বুধেশ্বর শিব এবং দেউলির জৈন তীর্থংকর শান্তিনাথের মন্দিরদ্বয়) নির্মিত হলেও অনুষঙ্গবিহীন একক দেউল নির্মাণই ছিল এ অঞ্চলের সাধারণ প্রথা। কয়েকটি ব্যতিক্রম ব্যতীত দেউলের ত্রিরথ আসনের পরিবর্তন ঘটেনি। ক্রমবিকাশের পথে পাদভাগে কামের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলেও, তাতে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। উত্তরকালে কোনো কোনো কামের অতিরিক্ত স্টাইলাইজেশনের ফলে তার আদি রূপটি সম্পূর্ণভাবে অন্তর্হিত হয় (উদাহরণ : পাকবিড়রার মন্দিরসমূহ)। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই যুগ্ম অবস্থানের ফলে কিছু কাম নব কলেবর লাভ করেছে। আনুমানিক দ্বাদশ শতকে নির্মিত কোনো কোনো মন্দিরে প্রবেশপথের দেওয়াল ও তদুপরি খিলানের মধ্যবর্তী প্রস্তর আচ্ছাদনটি অপসারণ করা হয়। ফলে খিলান পরিধির ত্রিকোণাকার গহ্বরসমেত সম্পূর্ণ প্রবেশপথটি বাইরে থেকে দৃশ্যমান হয়ে যায়। এ ধরনের মন্দিরের নিদর্শনস্বরূপ পাকবিড়রার জৈন মন্দিরগুলির উল্লেখ করা যায়। প্রথাগত রেখদেউলের বিবর্তনের শেষ পর্বে অধিষ্ঠান নামক পাদপীঠের উপর মন্দির স্থাপনের রীতির সূত্রপাত হলেও, তার বহুল প্রচলন ঘটেনি। অধিষ্ঠানের আগমন সম্ভবত ওড়িশা অথবা বিহার থেকে। এ সময়েই জঙ্ঘার অর্ধস্তম্ভগুলি উষ্ণীষ-সহ শীর্ণনাগস্তম্ভে পরিণত হয়। পূর্বের ন্যায় স্তম্ভশীর্ষ বরন্ডের তলদেশ পর্যন্ত প্রসারিত হয়নি। জঙ্ঘার রাহায় পার্শ্বদেবতা স্থাপনের কুলুঙ্গিগুলি অনু-রেখদেউলের রূপ পরিগ্রহ করে। শিখরের উল্লম্ব চরিত্রে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু শীর্ষদেশে শিখর দেওয়ালের অন্তর্মুখী ঝোঁকটি অকস্মাৎ অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় দেউলের তীক্ষ্ণ ঊর্ধ্বমুখিতায় এক পীড়াদায়ক ছন্দপতন ঘটে। কালের গতির সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের অবক্ষয়ের চিহ্নগুলি বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুরুলিয়া-সহ পশ্চিমবঙ্গের রেখশৈলীর পরবর্তী বিবর্তনের ইতিহাস উত্তরোত্তর এই অবক্ষয়ের পরিচয়বাহী।
মধ্যযুগ-পূর্ব পুরুলিয়ার স্থাপত্য-নিদর্শনসমূহ রেখশৈলীর মধ্যে থাকলেও পাকবিড়রায় কয়েকটি ভদ্রশৈলী (ক্রমহ্রাসমান স্তরে উন্নীত পরিমিতাকৃতি ছাদযুক্ত দেউল)-র অন্তর্গত প্রস্তরনির্মিত উৎসর্গ দেউল পাওয়া গেছে। এগুলি পুরুলিয়ায় ভদ্রশৈলীর পূর্ণাবয়ব মন্দিরের অস্তিত্বের ইঙ্গিত কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
ইটের মন্দির
সরল ও প্রায় অলংকার-বিবর্জিত পাথরের মন্দিরের পাশাপাশি পুরুলিয়ার কয়েকটি পতনোন্মুখ অলংকৃত ইটের মন্দির বাংলার স্থাপত্যের সম্পদ। সংখ্যায় নগণ্য দেউলগুলির প্রত্যেকটিই ছিল একটি বেদির উপর প্রতিষ্ঠিত (বর্তমানে নিশ্চিহ্ন পাকবিড়রা ও কাঁটাবেড়ার মন্দিরদ্বয়ে এরূপ বেদি ছিল কিনা তা বলা সম্ভব নয়)। মন্দিরের আসনে একাধিক রথ ও উপরথ লক্ষণীয়। রথ ও উপরথসমূহ দেওয়াল ও শিখরবাহিত হয়ে দেউলশীর্ষ পর্যন্ত প্রসারিত। ফলে মন্দিরগাত্রে সৃষ্ট বিভিন্ন তল আলো-ছায়া খেলার সুযোগ এনে দিয়েছে।
মন্দির দেওয়ালের গভীরতা সর্বক্ষেত্রেই গর্ভগৃহের দৈর্ঘ্য/প্রস্থের অর্ধাধিক। বর্গাকার গর্ভগৃহের চাল লহরা পদ্ধতিতে নির্মিত। লহরার সূচনা ও মুদ দ্বারা আবৃত সর্বোচ্চ স্তরের মধ্যবর্তী অংশে কোনো মুদ বা সিলিং নেই। গর্ভগৃহে প্রবেশপথের পার্শ্বদেওয়াল অনেকটা নীচু থেকে লহরা স্তর দ্বারা ক্রমবর্ধমানভাবে নিকটবর্তী হওয়ায় এই পথ প্রায় ত্রিকোণাকৃতি। পাথরের মন্দিরে যেমন প্রবেশপথের প্রলম্ব ও ত্রিকোণাকার অংশ-বিভাজনকারী চাল থাকে, এখানে তেমন কিছু নেই। গর্ভগৃহ থেকে জল নিষ্কাশনের জন্য উত্তর দিকের দেওয়ালে মকরমুখী নালি থাকত।
মন্দিরের বহির্ভাগে প্রলম্ব অক্ষে দেওয়ালে পাদভাগ বা পাভাগ, জঙ্ঘা ও বরন্ড এই তিনটি মূল অঙ্গ দেখা যায়। পাদভাগে অনুভূমিক কামের সংখ্যা প্রথানির্দিষ্ট সংখ্যায় আবদ্ধ থাকত কিনা, তা উদাহরণের স্বল্পতা ও মন্দিরের ভগ্নদশার জন্য বলা সম্ভব নয়। আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অবলুপ্তির ফলে সমস্ত কামের চরিত্রও শনাক্ত করা যায় না। যা অবশিষ্ট রয়েছে তা থেকে বোঝা যায়, কালক্রমে রূপান্তরিত হলেও কামগুলি খুর, কুম্ভ, কট্ট, কণি প্রভৃতি নামধারী ওড়িশি কাম থেকে উদ্ভূত। একটি অনুভূমিক কাম মাঝ বরাবর জঙ্ঘাকে বেষ্টন করে এই অঙ্গকে তল এবং উপর জঙ্ঘা নামক দু-টি উপাঙ্গে বিভক্ত করত। রথগুলিকে দেউলের অনুকৃতি এবং গৌণ রথগুলিকে অর্ধস্তম্ভের রূপ দেওয়া হত। দেউলের অনুকৃতিগুলিকে মন্দিরে উপাস্য দেবতার সঙ্গে সম্পর্কিত দেবতার মূর্তি স্থাপনের কুলুঙ্গিরূপে ব্যবহার করা হত বলে মনে হয়, কিন্তু সমস্ত কুলুঙ্গি থেকেই এখন এরূপ মূর্তি অপসৃত হয়েছে। এধরনের মন্দিররূপী কুলুঙ্গি শ্রেণির মধ্যে রাহা (মধ্যস্থলের রথ)-র কুলুঙ্গিটিই সর্ববৃহৎ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ওড়িশার শিবমন্দিরে তিন দিকের রাহায় দুর্গা, কার্তিক ও গণেশ-এর মূর্তি স্থাপনের প্রথা ছিল। পুরুলিয়াতেও এই প্রথা অনুসৃত হয়ে থাকতে পারে। কিছু কিছু পাথরের মন্দিরে পরিলক্ষিত একটি অনুচ্চ ফিতের মতো পাড় দিয়ে জঙ্ঘার শীর্ষদেশ বেষ্টন করার রীতিও ইটের মন্দিরে অনুসৃত হত। একটি গভীর কন্ঠ বা ফ্রিজের দুই অনুভূমিক প্রান্ত বরাবর ঘনসংবদ্ধ লহরা শ্রেণি-বাহিত দুটি ভারী কাম দ্বারা সৃষ্ট বরন্ড (কার্নিশ) বাড় ও শিখরকে সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত করত। শিখরের উচ্চতা সর্বক্ষেত্রেই দেওয়ালের উচ্চতার চেয়ে অধিক ছিল। নিম্নাঙ্গে অনুপস্থিত শিখরের বক্রতা অত্যন্ত নমনীয়ভাবে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার ফলে শিখরকে প্রায় সরলরেখায় উন্নীত বলে মনে হত। বর্তুলাকার ভূমি-আমলক দ্বারা শিখরকে কয়েকটি ভূমিতলে বিভাজন করা হত। বর্তমানে দৃষ্ট এ ধরনের কোনো মন্দিরের শীর্ষদেশই অক্ষত না থাকায়, শিখরের ভূমিতল কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমাবদ্ধ থাকত কিনা তা বলা সম্ভব নয়। শিখরগাত্রে অঙ্গশিখর (দেউলের অনুকৃতি) সন্নিবেশ করা হলেও তা কখনোই স্বতন্ত্র সত্তায় উপনীত হতে পারেনি। ফলে মন্দিরের উল্লম্ব চরিত্রটি ছিল বাধাহীনভাবে প্রকাশিত। শিখরের রাহা অংশের পাদদেশে একটি বৃহদাকার হরতনাকৃতি চৈত্যগবাক্ষের নকশা লক্ষণীয়। দেউলগাত্রে প্রদর্শিত দেউলের অনুকৃতি থেকে অনুমান করা যায়, বিধ্বস্ত শিখরশীর্ষে স্থাপিত মস্তকের দেহ পর্যায়ক্রমে বেকী, অমলক, খপুরি এবং কলস দ্বারা সৃষ্ট হত। দেউলঘাটার একটি মন্দিরে এরূপ মস্তকে দু-টি আমলকের উপস্থিতি মূল মস্তকেও অনুরূপ যুগ্ম আমলকের অবস্থান সূচিত করে কিনা, তা নির্দ্বিধায় বলা যাবে না। অবশ্য মধ্যপ্রদেশ ও তার প্রতিবেশী কিছু কিছু অঞ্চলে যুগ্ম আমলক দেখা যায়। অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম জেলায় মুখলিঙ্গমে সপ্তম/অষ্টম শতাব্দীর শ্রীমধুকেশ্বর মন্দিরের মস্তকে দৃষ্ট যুগ্ম আমলক সম্ভবত আধুনিক সংরক্ষণের ফল নয়। ওড়িশাতেও কয়েকটি মন্দিরে এরূপ দু-টি আমলক রয়েছে। পুরুলিয়ায় সাধারণভাবে দেউলের প্রসারতা অপেক্ষাকৃত কম রাখায় উচ্চতা প্রদর্শনের ঝোঁক স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এককভাবে নির্মিত হলেও দেউলের সামনে মন্ডপ স্থাপনের প্রথা একেবারে বর্জিত হয়নি। অবশ্য সম্পূর্ণ অবলুপ্তির ফলে এ ধরনের মন্ডপের চরিত্র বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। কেবলমাত্র ভিত্তিভূমির চিহ্ন থেকে অনুমান করা হয়, দেউল অপেক্ষা মন্ডপের বিস্তার অধিক ছিল।
মন্দির নির্মাণে কম-বেশি ২.৫ ইঞ্চি গভীর কিন্তু বিভিন্ন দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের ইট ব্যবহৃত হত। সর্ববৃহৎ ইটের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ছিল যথাক্রমে ১৯ ও ৯ ইঞ্চি। গাঁথনির মশলা হিসাবে খুব মিহি জৈব চুন ব্যবহার করা হত। এই চুনের পাতলা স্তরের উপর ইটগুলি সাজানোর ফলে দু-টি ইটের জোড় এত সূক্ষ্ম হত, যে তার মধ্যে একটি ছুরির ফলা প্রবেশ করানোও কষ্টসাধ্য ছিল। মন্দিরের অন্তর ও বাহির উভয় পার্শ্বেই চুনের প্রলেপ দেওয়া হত। কাঁচা অবস্থায় চুনের প্রলেপের উপর নানারূপ নকশা পরিস্ফুট করে মন্দিরের বহিরঙ্গসজ্জায় যে নৈপুণ্য, অভিনবত্ব ও শিল্পসুষমা প্রকাশ করা হয়েছে তা ভারতীয় স্থাপত্যকলার ক্ষেত্রে তুলনাহীন। প্রকৃতপক্ষে অঙ্গসজ্জার উচ্চ মান ও সমৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গের আরও কয়েকটি স্থান-সহ এ অঞ্চলের প্রাক-ইসলাম পর্বের ইটের মন্দিরগুলিকে স্বতন্ত্র মহিমা দান করেছে। প্রাচুর্য সত্ত্বেও অঙ্গসজ্জা দেউল স্থাপত্যের প্রাধান্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় মন্দিরদেহ কখনোই অলংকরণ দ্বারা ভারাক্রান্ত বলে মনে হয় না। এ ধরনের মন্দিরশৈলির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় পুরুলিয়ায় দেউলঘাটায় পরিত্যক্ত, অবহেলিত ও পতনোন্মুখ জীর্ণদেহী দেবদেউলে। অক্ষত অবস্থায় মন্দিরদেহের এমন কোনো অংশ ছিল না, যা শিল্পীর কুশলী হাতের স্পর্শে দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠেনি। ফুল, লতা, পাতা, মুক্তমালা, জীবজগতের বিভিন্ন প্রাণী, দেব ও মনুষ্য মূর্তি, জ্যামিতিক নকশা প্রভৃতি অলংকরণের বিষয়রূপে গৃহীত হয়েছিল। শিল্পীর দক্ষতায় হরতনাকৃতি চৈত্যগবাক্ষের নকশাটি এক অনবদ্য আকৃতি লাভ করে। তুলনীয়, পারার ইটের মন্দিরে চেত্যগবাক্ষ দেখা গেলেও অন্যত্র এরূপ নিদর্শন হল প্রাণহীন (উদাহরণ : বিহারের গয়া জেলায় কোচের মন্দিরের নকশা)।
গর্ভগৃহের দৈর্ঘ্য/প্রস্থের তুলনায় দেওয়াল অস্বাভাবিকভাবে গভীর। মনে হয় অপ্রশস্ত দেওয়াল সুউচ্চ মন্দিরের ভার বহনে সক্ষম হবে না, এইরকম আশঙ্কা করে স্থপতি গভীরতা বৃদ্ধি করেছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেউলের প্রবেশমুখে দ্বারস্তম্ভ ছিল। দ্বারস্তম্ভের নীচে দ্বারপাল মূর্তি খোদিত থাকত। স্তম্ভবাহিত সরদলের মধ্যস্থলে ললাটবিম্বে গণেশ অথবা গজলক্ষ্মীর ক্ষুদ্রমূর্তি উৎকীর্ণ করা হত বলে মনে হয়।
ইটের মন্দিরের সময়কাল নিয়ে পন্ডিতমহলে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অধিকাংশের মতে এগুলির নির্মাণকাল দশম শতাব্দী হলেও, অনুমান নির্ভর এ সিদ্ধান্তের সমর্থনে যথেষ্ট তথ্য নেই। প্রথমত, বাড় অংশের রাহাকে দেউলসদৃশ কুলুঙ্গির রূপ প্রদান, দেওয়ালকে পাদভাগ, তল জঙ্ঘা, বান্ধনা, উপর জঙ্ঘা ও বরন্ড অংশে বিভাজন, শিখরগাত্রে অঙ্গ-শিখরের সংস্থাপন, বর্তুলাকার ভূমি-আমলকের উপস্থিতি এবং তাদের পাঁচের অধিক সংখ্যা এই মন্দিরগুলির স্থাপনাকালকে একাদশ শতাব্দীর পূর্বে আনয়নের অন্তরায়। উচ্চ বেদির উপর মন্দির প্রতিষ্ঠা, গর্ভগৃহের অর্ধাংশের অধিক গভীর দেওয়াল, পাঁচটির অধিক রথসমন্বিত আসন, পাদভাগ কামের প্রকৃত চরিত্র বিস্মরণ ও কামের সংখ্যা অন্তত পাঁচটির অধিক করা, উচ্চতার প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁক এ অঞ্চলের ইটের মন্দিরসমূহকে একাদশ শতাব্দীর পরবর্তী যুগের স্থাপত্য বলেই ইঙ্গিত দেয়।
চালা ও রত্ন রীতি
ষোড়শ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্যের উচ্চ-নীচ ভেদহীন মানবপ্রেমী ভক্তিবাদী বৈষ্ণবধর্মের সর্বজনীন আবেদন বঙ্গভূমিকে আপ্লুত করায়, বঙ্গীয় মন্দির স্থাপত্যে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। অবক্ষয়িত মার্গরীতিসম্মত রেখশৈলীর গন্ডি বহির্ভূত এক অভিনব লোকায়ত মন্দির স্থাপত্য এ অঞ্চলে রূপ পরিগ্রহ করে। স্থানীয় গ্রামীণ চালাঘরের আদলে এবং পশ্চিম এশীয় নির্মাণকৌশলে যে শৈলী বিকাশ লাভ করে, তা তৎকালীন ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী শিল্পক্ষেত্রের মন্দাক্রান্ত পরিবেশে বিস্ময়কর। একান্তভাবে বাংলার নিজস্ব এই স্থাপত্যশৈলীটি গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম বাহিত হয়ে, এ অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতেও প্রবেশ করে। স্বাভাবিকভাবেই পুরুলিয়া জেলাতেও চালামন্দির তৈরি হতে থাকে বৈচিত্র্যের সঙ্গে। চালামন্দিরের অধিকাংশই ইটের তৈরি, অল্প কয়েকটি পাথরের।
আকৃতিগতভাবে দোচালা কুটিরের অনুকরণে নির্মিত দোচালা বা এক বাংলা এবং দু-টি দোচালা ভবনের দীর্ঘ প্রান্তকে সমান্তরালভাবে সংলগ্ন করে জোড়বাংলা মন্দির, দু-টি ক্রমহ্রাসমান চারচালাকে উপর্যুপরি স্থাপন করে আট চালা মন্দির এবং শিখর-দেউলের রত্ন নামাঙ্কিত অনুকৃতিশীর্ষ রত্নমন্দিরের কয়েকটি নিদর্শন পুরুলিয়ায় রয়েছে।
দোচালা শ্রেণির একটিমাত্র উদাহরণ, গড়পঞ্চকোটে দুর্গের বাইরে অবস্থিত। ছোটো মন্দিরটির সম্মুখভাগে খিলানশীর্ষ প্রবেশপথের উপরের দেওয়ালটি ধসে পড়েছে। কিন্তু প্রবেশপথের উভয় পার্শ্বে পোড়ামাটির অলংকরণের একটি শ্রেণি এবং সারিবদ্ধ নকশার উপস্থিতি এখনও দৃশ্যমান। মন্দিরের ঢালু চালদ্বয় শীর্ষদেশে একটি ধনুকাকৃতি রেখায় মিলিত হয়েছে। ফলে চালের মুদ ধনুকাকৃতি। কার্নিশও বাঁকানো।
এই জেলায় ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা জোড়বাংলা মন্দিরগুলির প্রবেশপথ ত্রি-খিলানযুক্ত। চালের কার্নিশ ও মুদন ধনুকাকৃতি। মুদনের উপর সারিবদ্ধভাবে তিনটি ধ্বজ স্থাপন করা হত। প্রবেশপথের ভিতরে প্রথম বাংলাটি ঢাকা বারান্দা, তার অভ্যন্তরে গর্ভগৃহ। বারান্দা এবং গর্ভগৃহ উভয়েই ক্লায়েস্টার ভল্ট দ্বারা আবৃত।
জোড়বাংলা শ্রেণিভুক্ত দু-টি বৃহৎ মন্দির গড়পঞ্চকোটে অবস্থিত। একটি মন্দির গুল্মাদিতে ঢাকা থাকায় তার অলংকরণ ও চরিত্র বিশ্লেষণ অসম্ভব। দ্বিতীয়টির বাহির ও অভ্যন্তর পলেস্তারা দ্বারা আবৃত করার ফলে সাদামাটা রূপ লাভ করেছে।
চাকোলতোড়ে শামচাঁদের প্রায় অলংকার-বিবর্জিত বর্গাকার জোড়বাংলা মন্দিরটি আকৃতিগতভাবে গড়পঞ্চকোটের মন্দিরের মতো। এটিকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত বলে কেউ কেউ বলেছেন।
গদিবেড়োতে ত্রি-খিলান প্রবেশপথযুক্ত অপর একটি জোড়বাংলা মন্দির রয়েছে। মন্দিরটির কার্নিশ ও চালের মুদন ধনুকাকৃতি।
কাশীপুররাজের গুরুবংশের মন্দিরপ্রাঙ্গণে একটি ত্রি-খিলান প্রবেশপথযুক্ত জীর্ণ জোড়বাংলা মন্দির রয়েছে। কারো কারো মতে মন্দিরটির নির্মাণকাল সপ্তদশ কী অষ্টাদশ শতক।
ঝালদার নিকটবর্তী দঙ্গল গ্রামে এক অনামা পীরের ত্রি-খিলান প্রবেশপথ-সহ একটি জোড়বাংলা দরগা আছে। আধুনিক অবৈজ্ঞানিক সংরক্ষণের ফলে দরগা কারুকার্যবিহীন সরল রূপ লাভ করেছে। দরগার বারান্দা ও গর্ভগৃহ ক্লয়েস্টার ভল্ট দ্বারা আবৃত। দরগাটি সংরক্ষণের ফলে নব কলেবর লাভ করায় এর নির্মাণকাল নির্ধারণ করা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বাংলার প্রাচীনতম জোড়বাংলা ভবনটি গৌড়ের ফত খাঁর সমাধিসৌধ।
আটচালা শৈলীর মুখ্য নিদর্শন চেলিয়ামায় ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত রাধাবিনোদ মন্দিরটি। শ্রীমন্ডিত পোড়ামাটির কারুকার্য মন্দিরটিকে উত্তর-মধ্যযুগীয় চালাদেউল স্থাপত্যের এক সমৃদ্ধ দৃষ্টান্তে পরিণত করেছে। প্রবেশপথের উপর রাম-রাবণ-এর যুদ্ধ, নিশুম্ভের সঙ্গে সংগ্রামরত মাতৃকাবৃন্দ-সহ চন্ডী, বস্ত্রহরণ, রাসমন্ডল প্রভৃতি দৃশ্য প্রদর্শিত হয়েছে। প্রবেশপথের দু-ধারে উল্লম্ব অক্ষে সারিবদ্ধ ছোটো ছোটো অগভীর খোপের ভিতর রয়েছে দশাবতার, বিভিন্ন দেব-দেবী, ভক্ত প্রভৃতি। প্রান্তস্থিত খোপগুলিতে প্রদর্শিত চিত্রসমূহের বৈচিত্র্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর মধ্যে একটি রাখালদেব আরোহণের দৃশ্যে অনেক প্রাচীন মন্দিরের দ্বারস্তম্ভে খোদিত ঢেউ খেলানো বৃক্ষলতায় আরোহণরত বালকবৃন্দের ছায়া রয়েছে বলে মনে করেন। একেবারে নীচে অনুভূমিক ফ্রিজ অধিকার করে রয়েছে সামাজিক দৃশ্যাবলি। এর উপর একইরকম ফ্রিজে জন্ম থেকে কংসবধ পর্যন্ত কৃষ্ণলীলা চিত্রিত হয়েছে। রামায়ণের কিছু কিছু ঘটনাবলিও এখানে স্থান পেয়েছে। কারুকার্যের বিষয়বস্তু, ধরন ও সংস্থাপন হুগলি জেলায় বাঁশবেড়িয়ার বাসুদেব মন্দির (১৬৭৯ খ্রি.)-কে স্মরণ করায়। তৎকালীন ধারা অনুযায়ী, চেলিয়ামার মন্দিরটিতে রয়েছে আর্কুয়েট পদ্ধতি অবলম্বনে নির্মিত পত্রাকার খিলান-শীর্ষ দ্বার। এই দ্বার দিয়ে তিনদিক ঘেরা বারান্দার মধ্যস্থিত গর্ভগৃহে প্রবেশের পথ করা হয়েছে। দক্ষিণদিকে একটি গৌণ দ্বার রয়েছে যার উপস্থিতি সমসাময়িক প্রথা অনুসরণের ফল। গর্ভগৃহের সিলিং তৈরি হয়েছে একটি আর্কুয়েট গম্বুজ দিয়ে। বিধর্মীয় উপাসনালয়ের গম্বুজশীর্ষ বৈশিষ্ট্যকে অপসারণের জন্য সিলিংকে আটচালার আবরণে দৃষ্টির অন্তরালে রাখা হয়েছে। আর্কুয়েট পদ্ধতি বারান্দার উপর ভল্ট নির্মাণের ক্ষেত্রেও অনুসৃত হয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত যে স্বল্পসংখ্যক অন্যান্য মন্দির দেখা যায়, তার অধিকাংশই একরত্ন। সেদিক থেকে চেলিয়ামার রাধাবিনোদ মন্দিরটির গুরুত্ব যথেষ্ট।
আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে গণপুরে বেলেপাথরে নির্মিত ও বর্তমানে পরিত্যক্ত রঘুনাথ মন্দির পুরুলিয়া জেলার অপর একটি উল্লেখযোগ্য আটচালা মন্দির। আটচালা ছাদের দু-টি স্তর বিভাজন প্রায় অবলুপ্ত করে অতি ঘনিষ্ঠ করার ফলে মন্দিরটি খর্বাকৃতি হলেও বিসদৃশ নয়। বিষ্ণুপুরশৈলী নামে পরিচিত এই বৈশিষ্ট্যের প্রচলন বাঁকুড়া জেলা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর আটচালা মন্দিরে দেখা যায়। রঘুনাথ মন্দিরের ত্রিখিলান প্রবেশপথ-সহ দেওয়াল অলংকারবিহীন। বাঁকানো কার্নিশের খোপগুলিও নিরাভরণ। গর্ভগৃহে গম্বুজের পরিবর্তে রয়েছে ভল্ট-সিলিং।
বাঘমুন্ডির রাধাগোবিন্দ মন্দির (১৭৩৩) অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নির্মিত অপর একটি আটচালা মন্দির। সম্মুখভাগ পোড়ামাটির কারুকার্যে ভূষিত হলেও তাতে কোনো মনুষ্যকৃতি নেই।
পরবর্তীকালে এই জেলায় আটচালা মন্দির নির্মাণের প্রথা অব্যাহত থাকলেও তা ক্রমশ বহিরঙ্গ অলংকরণের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ততা ও সরলতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কাঠামোগত দিকও অবহেলিত হওয়ার ফলে মন্দিরের পরিমাপগত সামঞ্জস্য ও আদলের সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়।
কূর্মপৃষ্ঠবৎ ঢালু চতুষ্কোণ চালের উপর ঠিক কেন্দ্রস্থলে একটি এবং চার কোণে অপেক্ষাকৃত চারটি রত্ন-মঞ্চ স্থাপন করে পঞ্চরত্ন দেউল নির্মাণের ব্যাপক প্রচলন এ অঞ্চলে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত কয়েকটি নিদর্শন ব্যতীত পরবর্তী যুগের দেউলসমূহ অনুপাতগত সামঞ্জস্যহীনতা ও অতি সারল্যের দোষে পীড়িত। প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে গড়পঞ্চকোট দুর্গের অভ্যন্তরে দু-টি পঞ্চরত্ন মন্দির অতি জীর্ণ অবস্থায় টিকে আছে। রত্নশিখর ব্যতীত দেউলের উচ্চতা অপেক্ষা অধিক দৈর্ঘ্যের মন্দিরদ্বয়কে উত্তরকালীন বিষ্ণুপুরী পঞ্চরত্নের শ্রেণিভুক্ত বলে মনে করা হয়। গর্ভগৃহবেষ্টিত কিন্তু গুরুভার স্তম্ভবাহিত ত্রিখিলানযুক্ত প্রবেশপথ-সহ ঢাকা এবং কারুকার্যশোভিত বারান্দা মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ কর্তৃক সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত একরত্ন কালাচাঁদ (১৬৫৬) এবং মুরলীমোহন (১৬৬৫) মন্দিরদ্বয়কে স্মরণ করায়। পঞ্চকোটে দু-টি মন্দিরের মধ্যে পূর্বেরটির শীর্ষকেন্দ্রে রয়েছে বৃহদায়তন সুউচ্চ এবং ক্রমহ্রাসমান স্তরে সাজানো অনুভূমিক গভীর শিরায় আবৃত রত্নশিখর। সেইজন্য মন্দিটির সঙ্গে কালাচাঁদ মন্দিরের সাদৃশ্য আরও প্রকট হয়েছে। কিন্তু শিখর ও শিখরশীর্ষে মস্তকের আকৃতিগত কারণে পঞ্চকোটের উদাহরণদ্বয়কে বেশ কিছুটা পরবর্তীকালের বলে মনে হয়। মন্দিরবাটিও গর্ভগৃহবেষ্টিত দেওয়ালের বহির্ভাগে, বিশেষত পূর্বদিকে, পোড়ামাটির অলংকরণ লক্ষণীয়। এমনকী রত্নেও পোড়ামাটির কারুকার্য দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে তুলনীয় মন্দিরের সংখ্যা নগণ্য।
পুরুলিয়া জেলার অপর প্রান্তে বাঘমুন্ডি গ্রামে স্থানীয় রাজাদের দ্বারা নির্মিত একটি নিরাভরণ পঞ্চরত্ন মন্দির আছে, যার শিল্পগত মূল্য যৎসামান্য।
রাসমঞ্চ
বৈষ্ণব ধর্মানুষ্ঠানের প্রয়োজনে দেবায়তন প্রাঙ্গণে রাসমঞ্চ নির্মাণের প্রথা অন্যান্য অঞ্চলের মতো পুরুলিয়াতেও প্রবর্তিত হয়েছিল। বাঘমুন্ডির রাজবাড়ির ভিতর রাসমঞ্চটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আয়তনে ক্ষুদ্র মঞ্চটির আসন অষ্টভুজ এবং মূল শিখর ন-টি শিখরের অনুকৃতি দ্বারা পরিবেষ্টিত। অত্যন্ত স্থূল পোড়ামাটির অলংকরণ-ভূষিত রাসমঞ্চটিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পূর্বে স্থাপন করা যায় না। পারিষদ-সহ রাম-সীতা, কৃষ্ণলীলার বিভিন্ন ঘটনা যথা রাসমন্ডল, গোবর্ধনধারণ, বকাসুর বধ এবং সামাজিক দৃশ্যাবলি ও জীবজন্তু, লতাপাতা প্রভৃতি পোড়ামাটি ভাস্কর্যের মূল বিষয়বস্তু ছিল। অন্যান্য রাসমঞ্চের মধ্যে বড়বাজেরটি অষ্টভুজ কিন্তু বৈশিষ্ট্যহীন। বেগুনকোদরে আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত রাসমঞ্চটি হল নবরত্ন। গণপুরে পাথরের আটচালা মন্দিরপ্রাঙ্গণেও একটি ইটের রাসমঞ্চের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
স্বকীয় বৈশিষ্ট্য
গ্রামসমাজের সমষ্টিগত জীবনযাপনের প্রতীকরূপে পুরুলিয়ায় এক ধরনের সম্পূর্ণ আঞ্চলিক মন্দির স্থাপত্য গড়ে ওঠে। বিশদ ও বিস্তৃত সমীক্ষার অভাবে গবেষকগণ দ্বারা উপেক্ষিত এই স্থাপত্যশৈলীর উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ধারা এখন পর্যন্ত অজানা রয়ে গেছে। তবে বর্তমানে দৃষ্টিগোচর কয়েকটি উদাহরণের অবক্ষয়িত রূপ এই স্থাপত্যশৈলীর সূচনাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদের পূর্বে হওয়ার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করেছে। অষ্টকোণাকৃতি এবং ঢালু-ছাদযুক্ত বারান্দা দ্বারা পরিবেষ্টিত প্রায় স্তম্ভসদৃশ দেবায়তন আলোচ্য শৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য। বারান্দার বিস্তৃতি মন্দিরভবনে বহু ভক্ত সমাবেশে উৎসব-অনুষ্ঠানাদি পালনের ইঙ্গিত বহন করে। মূল দেউলের শিখর বারান্দার ছাদ অতিক্রম করে অনেকটা ঊর্ধ্বে প্রসারিত হওয়ায় মন্দিরের বিস্তার ও উচ্চতার মধ্যে অনুপাতগত সামঞ্জস্যের অভাব প্রকট হয়েছে। পুরুলিয়া শহর-সহ জেলার বহু স্থানে এই স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।
একটি বিশিষ্ট মন্দির
পুরুলিয়া শহর থেকে প্রায় ৪ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ছোটো বলরামপুর গ্রামে মধ্যযুগ-অন্ত্যকালীন একটি নাগরশৈলীর সুউচ্চ ইটের মন্দির আছে। যুগবৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, মন্দিরটির গঠনে সরলীকরণ ঘটেছে। পঞ্চরথ আসনে নির্মিত দেউলের শিখর কিন্তু সপ্তরথ। প্রলম্ব দেওয়াল ও বক্র শিখরের প্রায় সমোচ্চতার ফলে দেউলের দীর্ঘাঙ্গ ভাব অপসৃত। অপরদিকে শিখরের ঊর্ধ্বাংশের অকস্মাৎ দ্রুত অন্তর্মুখী গতি ও ছন্দপতনের কারণ হয়েছে। শেষোক্ত প্রবণতা পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রেখ-শ্রেণির মন্দিরে লক্ষ করা যায়। অপরিসর ও ঘনসংবদ্ধ লহরা এবং বর্গাকার কাম দ্বারা দেওয়াল ও শিখরের বিভাজন করা হয়েছে। শিখরের নিম্নাঙ্গে অঙ্গশিখরের উপস্থিতির চিহ্ন এখনও সুস্পষ্ট। শিখরশীর্ষ ভগ্ন হয়ে যাওয়ার ফলে মন্দিরের মস্তক সম্পর্কে কোনোরূপ ধারণা করা সম্ভব নয়। মন্দিরে প্রবেশের দীর্ঘ পথটি গভীর দেওয়াল ভেদ করে বর্গাকার গর্ভগৃহের সঙ্গে যুক্ত। প্রবেশপথ ও গর্ভগৃহ উভয়ই লহরা পদ্ধতিতে নির্মিত চাল দ্বারা আবৃত। ২:১ এই আনুপাতিক হারে মন্দিরটির দেওয়াল ও গর্ভগৃহের প্রসারতা নির্ধারিত। এই প্রথা একটি অতি প্রাচীন নির্মাণরীতির বহু পরবর্তীকালীন প্রচলনের বিস্ময়কর প্রমাণ দেয়। সমস্ত মন্দির-দেওয়াল একসময় জৈব চুনের মিশ্রণে তৈরি মোটা পলেস্তারায় ঢাকা ছিল। এই পলেস্তারার উপর কোনোরকম কারুকার্য ছিল কিনা তা জানা যায় না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে রচিত বিবরণ থেকে জানা যায়, দেউলটির সম্মুখে একটি মন্ডপ ছিল। সম্ভবত মন্ডপের আর্কুয়েট পদ্ধতিতে নির্মিত গম্বুজটির নিম্নাংশে পেণ্ডেন্টিভ-ব্র্যাকেটের উল্লেখও পাওয়া যায়।
ছোটে ছোটো ইটের ব্যবহার, দেওয়াল ও শিখর বিভাজনকারী বরন্ড নির্দেশক কামে পরস্পর মুখোমুখি অর্দ্ধবৃত্তাকার নকশা, শিখরের শীর্ষভাগের অতিরিক্ত অন্তর্মুখী চাল, ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্ডপে গম্বুজ ও পেণ্ডেন্টিভের উপস্থিতি, গর্ভগৃহে আর্কুয়েট কুলুঙ্গি ছোটো বলরামপুরের মন্দিরটিকে প্রাক-সুলতানি আমলে স্থাপনের অন্তরায়স্বরূপ। কিন্তু দেওয়ালের গায়ে কুলুঙ্গিগুলিকে দেউলসদৃশ রূপ দেওয়ায় মন্দিরটিকে পারার লক্ষ্মীমন্দিরের ঐতিহ্যবাহী বলে মনে হয়। স্থানীয় লোকশ্রুতি অনুযায়ী মন্দিরে রাধা-শ্যাম-এর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত থাকার কাহিনি সত্য হলে এটিকে চৈতন্যোত্তর পর্বে স্থান দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত। সেক্ষেত্রে মন্দিরটি ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম পাদে নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বর্ধমান জেলায় বৈদ্যপুরে প্রায় অনুরূপ কিন্তু কুলুঙ্গি ও চুনের পলেস্তারাবিহীন বাসুদেব মন্দির (১৫৯৮)-কে এই দেউলটির উত্তরসূরী বলে ধরা হয়।
স্বীকৃতি
পুরুলিয়া শিল্পাশ্রমের মাতৃস্বরূপা শ্রদ্ধেয়া লাবণ্যপ্রভা ঘোষের সস্নেহ আতিথ্য, লোকসেবক সঙ্ঘের কর্ণধার শ্রী অরুণচন্দ্র ঘোষের সহৃদয় সহযোগিতা, ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীবৃন্দের পথনির্দেশকরূপে সঙ্গদান, বাংলার স্থাপত্য-ঐতিহ্য অনুরাগী অগ্রজপ্রতিম শ্রী বিমলেন্দু কুমারের সাহচর্য, চেলিয়ামার গ্রামসেবক শ্রী জিনদীরাম মাহাতো ও পুঞ্চার শ্রী হেরম্ব ভট্টাচার্যের অকৃপণ সাহায্য পুরুলিয়া জেলায় মন্দির সংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানে প্রাথমিক পর্যায়ের এক আনন্দময় স্মৃতি। পরবর্তীকালে দুই কৃতী ছাত্র ড. রমাপ্রসাদ মজুমদার ও ড. গৌতম সেনগুপ্ত কোনো কোনো স্থান পুনঃদর্শনে সাথী হওয়ায় মন্দির সমীক্ষার পরিশ্রম অনেকাংশে লাঘব হয়। ছাত্রপ্রতিম শ্রী সুবীর সরকার লেখাটি সংশোধনে সাহায্য করায় ভাষাগত ত্রুটি দূর করা সম্ভব হয়েছে। কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জানিয়ে এদের সকলের ঋণ পরিশোধের প্রচেষ্টা ঋণের বোঝা বৃদ্ধিই করবে।