পুরানো সেই দিনের কথা

পুরানো সেই দিনের কথা

ভারতের জীবন ও দর্শনের ওপর বেদ আর উপনিষদের বিপুল প্রভাব বহু যুগের। উপনিষদগুলি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল বৈদিক যুগের শেষভাগে, বেদকে আশ্রয় করেই।

বেদের দুটি ভাগ। একটি ভাগে আলোচিত যজ্ঞ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক পর্ব। অন্যভাগে বিশ্বরহস্যকে জানবার, বোঝবার ব্যাখ্যা করবার প্রচেষ্টা। প্রথম ভাগটিকে বলা হয় ‘কর্মকাণ্ড’। আর দ্বিতীয় ভাগ হল ‘জ্ঞানকাণ্ড’।

হাজার হাজার বছর ধরে এই জ্ঞানকাণ্ডই প্রধান হয়ে দাঁড়াল। ভারতের প্রাচীন ঋষিরা এই জ্ঞানকাণ্ডেই প্রথম প্রকাশ করেছিলেন এই বার্তা যে তাঁরা জানতে চান এই জগৎকে, তাঁরা ভেদ করতে চান সৃষ্টির রহস্য দার্শনিক প্রশ্ন ও সমাধানের সাহায্যে। এই ঋষিরা মূলত গভীরপ্রসারী দার্শনিক, জ্ঞানী ও কবি। তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দুটি— এই সৃষ্টি কোথা থেকে এল? এই সৃষ্টির উৎস কি এক না বহু?

কিন্তু তাঁরা জানবেন কীভাবে? মহাবিশ্বকে জানবার শক্তি তাঁরা পাবেন কোথা থেকে? মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের কোনও সূত্র, কোনও সংকেত সভ্যতার সেই সুদূর ভোরবেলায় ঋষিদের জানা ছিল না। তাঁদের একমাত্র অবলম্বন ছিল তাঁদের দার্শনিক মনের ধীময়তা, তাঁদের গভীর উপলব্ধি, তাঁদের সূক্ষ্ম অনুভব, তাঁদের ধ্যানের গহন মগ্নতা।

আলো জ্বলে উঠেছিল তাঁদের ধ্যানের মধ্যে। তাঁরা ক্রমশ উপলব্ধি করলেন সমস্ত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে সৃষ্টির উপাদান। আজকের বিজ্ঞান ঠিক একই কথা বলছে। তবে হাজার হাজার বছর আগে বৈদিক ঋষিরা এই সত্যের উদ্ভাস পেয়েছিলেন তাঁদের ধ্যানের মধ্যে। তাঁরা উপলব্ধিও করলেন, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে এক মহাচৈতন্য, সেই নিহিত বুদ্ধিমত্তার কাছেই প্রার্থনা করলেন, হে বিশ্বস্রষ্টা, আমায় দাও সেই ধীশক্তি, সেই মেধা, সেই চেতনা যাতে আমি এই মহাজগৎকে বুঝতে পারি— ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ।

মহাজগৎ কী? সত্য না মায়া? কেমন করে সৃষ্টি হল এই মহাবিশ্ব? এই বিশাল সৃষ্টির উৎস কি এক? না বহু?

মূলত এই প্রশ্নগুলিকে ঘিরেই ঋষিদের প্রশ্ন এবং সমাধান। এই পথেই গড়ে উঠেছে উপনিষদের দর্শন— যে-দর্শন বলছে সারা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত এক আদিসত্তা। এই আদিসত্তা এক ও অদ্বিতীয়। একমেবাদ্বিতীয়ম্।

এই বিশ্ববোধ বা দর্শনে কিন্তু ঋষিরা খুব তাড়াতাড়ি যে পৌঁছেছিলেন, এমন নয়। বেদের সংহিতা অংশে আমরা দেখছি বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছেন বহুদেবতা। কিন্তু এই বহুদেবতা-নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব থেকে ক্রমশ সরে এলেন উপনিষদের সত্যসন্ধানী দার্শনিক ঋষিরা। তাঁরা উপলব্ধি করলেন এক এবং অদ্বিতীয় আদিসত্তার দ্বারা এই মহাজগৎ নিয়ন্ত্রিত। এই আদিসত্তাকেই ঋষিরা বললেন ‘ব্রহ্ম’।

কেমন এই ‘ব্রহ্ম’? কীভাবে এই বিশ্বসত্তাকে বর্ণনা করা যায়? উপনিষদে ক্রমে এই প্রশ্নটাই সবথেকে বড় হয়ে উঠল। উপনিষদের দার্শনিক ঋষি ক্রমে এই সত্যে উপনীত হলেন যে এই ‘ব্রহ্ম’ সারা বিশ্বব্যাপী এক প্রচ্ছন্ন সত্তা— মহাবিশ্বের প্রতি কণায় ‘ব্রহ্ম’ উপস্থিত। ‘ব্রহ্ম’ শব্দটির ধ্বনিগত অর্থ হল, যা সর্বব্যাপী, যা সকল বস্তুর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ব্যাপ্ত। কঠোপনিষদের আর একটি মন্ত্রে একই কথা বলা হয়েছে এইভাবে— ‘একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ’। অর্থাৎ একই আত্মা, মানে আদিসত্তা বা সৃষ্টির আদি-উৎস বিভিন্ন জীবের রূপে প্রকাশিত হয়েছে। এই একই আদিসত্তারও বহুরূপে প্রকাশ। সুতরাং উপনিষদ যে বলছে একই অদ্বিতীয় ব্রহ্ম বিশ্বের সবকিছুর মধ্যে থেকেই বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই হল উপনিষদের ব্রহ্মবাদের সারাৎসার। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের মধ্যে উপনিষদের এই মূল বাণীটিকেই রূপ দিয়েছেন:

প্রথম আদি তব শক্তি—

আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে

গগনে গগনে॥

উপনিষদের ঋষিদের মনের মধ্যে সেই প্রাচীনকালে আরও একটি দার্শনিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল— কেমন এই জগৎ? এই বিশ্বজগৎ কি খণ্ড খণ্ড ভাবে ভাগ হয়ে আছে, না কি এই বিশ্বজগৎ অখণ্ড?

উপনিষদের ঋষিরা এই প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন এইভাবে— বিশ্ব হল সৃষ্টি, ব্রহ্ম হল স্রষ্টা। কিন্তু উভয়েই পরস্পরের মধ্যে এক হয়ে আছে। তার কারণ, ব্রহ্ম যদিও এই জগতের স্রষ্টা, এই জগতের উপাদানও ব্রহ্ম। অর্থাৎ একই সত্তা বিশ্বের আশ্রয় এবং বিশ্বকে একমণ্ডিত করছে। যেহেতু আদিসত্তা বা বিশ্বের উৎস বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান, তাই এই মহাবিশ্ব অখণ্ড। এই মহাবিশ্বের সবকিছুই ব্রহ্ম। ব্রহ্মই তার জন্মের উৎস। ব্রহ্মের মধ্যেই তার ব্যাপ্তি। ব্রহ্মেই তার বিলয়।

নিবিড় ঘন আঁধারে এই সত্যের ধ্রুবতারা জ্বলে উঠেছিল কোন আদি যুগে উপনিষদের ঋষির ধ্যানে। রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের এই উপলব্ধ সত্যকেই কত সহজে উচ্চারণ করলেন তাঁর গানে—

তুমি আদিকবি, কবিগুরু তুমি হে,/মন্ত্র তোমার মন্দ্রিত সব ভুবনে।

সেই পুরাকালে উপনিষদের ঋষি বলেছিলেন— অপাবৃণু। অর্থাৎ, হে জগতের অন্তরসত্য, আবরণ সরিয়ে তুমি উন্মোচিত হও। আমি যেন নিজেকে তোমার মধ্যে দেখতে পাই। যেন উপলব্ধি করি তোমার-আমার কোনও ভেদ নেই। তুমি আর আমি এক। অহং ব্রহ্মাস্মি। প্রাচীন বেদের এই ধ্যানলব্ধ সত্য ফিরে এসেছে কত যুগ পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানে—

আর রেখো না আঁধারে, আমায় দেখতে দাও।

তোমার মাঝে আমার আপনারে দেখতে দাও॥

উপনিষদের ঋষির মনের মধ্যে এবার জেগে উঠল আরও এক প্রশ্ন। বোঝা গেল, এই জগতের সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছে ব্রহ্ম, অর্থাৎ জগতের উৎস। বোঝা গেল, এই জগৎকে একত্বমণ্ডিত করেছে আদিসত্তার সর্বব্যাপী বিরাজমানতা। বোঝা গেল, সেই আদিসত্তা চিরন্তন, পরিবর্তনহীন। এই নিয়ামক সত্তা নিত্য। তাই অমৃত।

ঋষির মনের মধ্যে এবার যে প্রশ্ন জাগল, তা হল, আদিসত্তা অপরিবর্তনীয়, চিরন্তন অথচ এই মহাজগতে সর্বক্ষণ এত পরিবর্তন কেন? ব্রহ্ম যদি চিরন্তন, তা হলে তার মূর্ত রূপের মধ্যে কেন পরিবর্তন ঘটছে সর্বক্ষণ? এ-প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পেলেন সেই প্রাচীনকালের ঋষি, বললেন দেহ অর্থাৎ মূর্ত রূপের পরিবর্তন হয়। কিন্তু জগতের অমূর্ত নিয়ামক বা আদিসত্তার কোনও পরিবর্তন হয় না। তাই এই আদিসত্তা চিরন্তন, মৃত্যুহীন। এ-কথা বলা আছে বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৩।৭।১৫)। বিস্মিত হই যখন দেখি আজকের বিজ্ঞান উপনিষদের এই উপলব্ধিকে কতটা সমর্থন করছে। আজকের কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি অনুসারে, সৃষ্টির অমূর্ত উৎস চিরন্তন, সৃষ্টির মূর্ত প্রকাশ সর্বদা পরিবর্তনশীল।

কিন্তু এইখানেই শেষ হল না উপনিষদের ঋষির দার্শনিক যাত্রা। সৃষ্টির কারণ কী? কেন ব্রহ্ম সৃষ্টি করলেন জগৎ? এই রহস্যময় গূঢ় প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেন উপনিষদের ঋষি। যে উত্তরটি পেলেন তাও তাঁর ধ্যানের মধ্যেই।

বিশ্বসৃষ্টির কারণ কী? উপনিষদের ঋষি বললেন, রসের আস্বাদন। তৈত্তিরীয় উপনিষদে ভারতের আদি ঋষি জানালেন, ব্রহ্ম রস উপলব্ধি করতে পারেন। অর্থাৎ বিশ্বের আদিসত্তা চেতনাহীন নয়। সেই আদিসত্তার মধ্যে রসোপলব্ধির ক্ষমতা আছে। সৃষ্টির রস উপভোগ করে আনন্দ পেতে চাইলেন আদিসত্তা। উপনিষদ বলছে, আদিতে ব্রহ্ম একক-সত্তা হিসেবে একা বোধ করছিলেন, কোনও আনন্দ পাচ্ছিলেন না। তাই আনন্দের জন্যে সেই আদি ও একক সত্তা বহু হলেন। ‘একাকী থেকে আনন্দ পেলেন না বলে তিনি দ্বিতীয়কে চাইলেন।’

এই হল উপনিষদের ব্রহ্মবাদের মূল্যবান বার্তা— ব্রহ্মের যেন একা একা ভাল লাগছিল না। তিনি সৃষ্টির রসাস্বাদনের জন্যে দ্বিতীয় হতে চাইলেন, অর্থাৎ নিজেকেই জগত্রূপে সৃষ্টি করলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কত সহজে ধরা পড়েছে উপনিষদ-উপলব্ধ এই সত্য—

যে ভাবে পরম-এক আনন্দে উত্সুক

আপনারে দুই করি লভিছেন সুখ,

দুয়ের মিলনঘাতে বিচিত্র বেদনা

নিত্য বর্ণ, গন্ধ, গীত, করিছে রচনা।

বিশ্বসৃষ্টিরহস্য প্রসঙ্গে উপনিষদের বাণী কি শুধুই দার্শনিক বা কবির কল্পনা? বিস্মিত হবেন যদি বলি, না, আজকের বিজ্ঞান সৃষ্টিরহস্যের এই সমাধানকে প্রায় সমর্থনও করছে।

একটা রূপকের কথা ভাবা যেতে পারে এখানে। ধরা যাক কেউ একটা পার্টি দিয়েছে। কিন্তু সেই পার্টিতে কেউ এল না।

প্রথম প্রশ্ন— কে দিয়েছে এই পার্টি? দ্বিতীয় প্রশ্ন, কেউ যদি না আসে তা হলে কি পার্টি বলা যাবে? তৃতীয় প্রশ্ন, সেটা কেমন পার্টি যে-পার্টিতে অতিথিরা দেখতেই পেল না যে নেমন্তন্ন করেছে তাকে!

এবার এই গল্পে পার্টির জায়গায় নিয়ে আসুন মহাবিশ্বকে। সৃষ্টি হল মহাবিশ্ব। অথচ সেটি দেখার জন্যে কেউ নেই সেখানে।

এই ধারণা বা হেঁয়ালিটা কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এই ধারণার একটা বৈজ্ঞানিক নাম আছে— উইক অ্যানথ্রোপিক কসমোলজিকাল প্রিন্সিপল। এই ভাবনার ভিতরে একটি ছোট্ট বার্তা আছে। বার্তাটি এই— আমাদের মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা যা ছিল, তা না হয়ে যদি অন্যরকম হত, তা হলে মহাবিশ্বকে দেখার জন্যে কেউ আমরা এখানে উপস্থিত হতে পারতাম না!

অর্থাৎ মহাবিশ্বের একেবারে প্রাথমিক অবস্থার মধ্যেই এই ভবিষ্যৎ-প্রতিশ্রুতি ছিল যে সেখানে একদিন, বহুযুগ পেরিয়ে, আমাদের মতো বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণীর আবির্ভাব হবে!

পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন বলেছেন, The universe in some sense must have known that we were coming— আমরা যে একদিন আসছি বিশ্ব কোনওভাবে সেকথা জানত।

জন হুইলারের মতো আজকের কিছু বিজ্ঞানী উপনিষদের ঋষির মতোই বলছেন, এই মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ নয় আমাদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছাড়া। রবীন্দ্রনাথের গানে প্রকাশিত হল সেই ঔপনিষদিক উপলব্ধি—

বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো

সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।

ব্রহ্মের এই বহুপ্রকাশকে উপনিষদ বর্ণনা করল ‘মধুময়’ বলে। রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মের এই মধুময়, আনন্দস্বরূপ প্রকাশকেই বললেন ‘অরূপের কত রূপদরশন, অমৃতের কত রসবরষণ।’

কিন্তু ব্রহ্মের এই ‘মধুময়’ প্রকাশকেই ‘মায়াময়’ বলে বর্ণনা করলেন শংকরাচার্য আজ থেকে হাজার বছর আগে, নবম শতাব্দীতে। বললেন, ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।’ উপনিষদের নতুন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জন্ম দিলেন মায়াবাদের। শংকরাচার্যের অদ্বৈতবাদের আর একটি নাম মায়াবাদ।

তিনি অবশ্যই ছিলেন মহাপণ্ডিত। বেদ ও উপনিষদে প্রাজ্ঞ। কিন্তু তিনি প্রচার করলেন সারা ভারত জুড়ে এমন একটি বাণী— ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা— যা সম্ভবত ভারতের সভ্যতার ইতিহাসকেই পিছিয়ে দিল হাজার বছর, আমাদের কর্মসংস্কৃতিকেই শিথিল করে দিল। জগৎকে মায়া ও মিথ্যা জ্ঞান করে আমরা কর্মবিমুখ হয়ে উঠলাম।

কেন তিনি ব্রহ্মের ‘মধুময়’ প্রকাশকে ‘মায়া’ বললেন? আমার মনে হয় তাঁর মতো মেধাবী শাস্ত্রবিদ, দার্শনিকও দ্বন্দ্বে পড়েছিলেন বিশ্বের সৃষ্টিরহস্য প্রসঙ্গে। তিনি বিশ্বকে একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্মের প্রকাশ হিসেবেই দেখেছিলেন।

কিন্তু সেই ব্রহ্মের বহুরূপকে গ্রহণ করতে গিয়ে তিনি দ্বিধায় পড়ে বললেন, আমরা ভুল করে ব্রহ্মকে বহু আকারে দেখছি। এই দেখা মিথ্যা। এই সবই মায়া। এই মায়াময় জগৎকে ত্যাগ করে এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মকেই সত্য বলে মেনে নিতে হবে।

উপনিষদ বলল, ব্রহ্মের মধুময় প্রকাশ ব্রহ্মেরই মতো সত্য। শংকরাচার্য বললেন, ব্রহ্মের মায়াময় প্রকাশ মিথ্যা। তিনি আক্ষরিক অর্থে ব্রহ্মকে এক এবং অদ্বিতীয় মনে করে বলতে চেয়েছিলেন ব্রহ্ম কোনও অবস্থাতেই বহু হন না। অর্থাৎ এই জগৎ, যাকে আমরা ব্রহ্মের বহুরূপ ভাবছি, তা ভাবছি মায়ার ছলনায়। বিশ্বের মধ্যে আমরা ব্রহ্মের যে বহু সত্তা দেখছি, বহু রূপে প্রকাশ দেখছি, তা সম্পূর্ণ ভুল দেখা। আমরা জগতের মায়ার ফাঁদে পড়ে এই ভুলটা করছি। অতএব ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে, একমাত্র সত্য বলে মেনে নিতে আমাদের জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করতে হবে।

শংকরাচার্য অত বড় পণ্ডিত ও জ্ঞানী হয়েও ব্রহ্মের মূর্ত রূপকে সত্য বলে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর কাছে ব্রহ্মের অমূর্ত রূপই একমাত্র সত্য। অথচ উপনিষদ ব্রহ্মের দুই রূপ, অমূর্ত ও মূর্ত, মর্ত্য ও অমৃত, স্থিতিশীল ও গতিশীল, সত্তাশীল ও অব্যক্ত বলে গ্রহণ করেছে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে। উপনিষদের এই মন্ত্রকেই হৃদয়ে গ্রহণ করে শংকরাচার্যের হাজার বছর পরে রবীন্দ্রনাথ রূপসাগরেই ডুব দিলেন অরূপ রতন আশা করে।

পুরানো সেই দিনের কথা শেষ করার আগে একটি কথা না বলে উপায় নেই।

শংকরাচার্য নিজে ছিলেন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। তিনি জগৎকে মিথ্যা বলে সন্ন্যাসের পথে সর্বত্যাগী হয়ে চলে যেতেই পারেন।

কিন্তু সারা ভারতকে সেই পথে যেতে উপদেশ দিয়ে তিনি ভারতের মঙ্গল করেছিলেন কি? সমস্ত বিশ্ব যদি সন্ন্যাসের পথে যায়, জগৎকে মিথ্যা জ্ঞান করে, তা হলে তো সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। তা হলে বিজ্ঞানপ্রমাণিত প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছরের এই বিবর্তনের কী প্রয়োজন ছিল?

অথচ তাঁর এই ‘স্লোগান’ ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ হাজার বছর ধরে ভারতের সমবেত চেতনায় গেঁথে আছে।

‘জগৎ মিথ্যা’ এই ধারণা থেকে এবার আমাদের সমবেতভাবে বেরোতেই হবে। ফিরে আসতে হবে কর্মের পথে। আমাদের নতুন ‘স্লোগান’ যেন হয় ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য’। আজকের বিজ্ঞানেরও একই মত।

.

১. একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি। কঠোপনিষদে এই মন্ত্রটির আক্ষরিক অর্থ হল, একই ব্ৰহ্ম বিভিন্ন রূপ ধারণ করে বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে জগতের সমস্ত কিছুতে প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত।

২. সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি: ছান্দোগ্য উপনিষদ— ৩।১৪।১

৩. স বৈ নৈব রেমে। স দ্বিতীয়মৈচ্ছ। বৃহদারণ্যক— ৬।৩।৬

৪. দ্বে বাব ব্ৰহ্মণো রূপে মূর্তং চৈবামূর্তং চঃ। (বৃহদারণ্যক ২।৩।১)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *