পুরনো বাড়ি

পুরনো বাড়ি

এও কিন্তু সত্যি ঘটনা। আমার জ্যাঠামণির মুখ থেকে শুনেছিলাম। তিনি ঠিক যেভাবে গল্পটা আমাকে বলেছিলেন, আমিও সেইভাবেই তোমাদের বলছি:

আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা।

আমার বয়স তখন কুড়ি-বাইশ। সবে একটা ভারী অসুখ থেকে উঠেছি। ডাক্তার বললেন চেঞ্জে যেতে। একে অসুখে ভুগে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, তার ওপর শরীর সারানোর জন্য বাইরেও যেতে হবে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে কাছেপিঠে দেওঘরেই যাওয়া ঠিক করলাম।

ভোরবেলা ট্রেন থেকে নেমে এক চায়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে বিলাসী টাউনে একটা বাড়ির সন্ধান পেলাম। বাঙালির বাড়ি। পাওয়ামাত্রই টাঙ্গা ভাড়া করে এসে হাজির হলাম সেই বাড়িতে। বাড়িটা পুরনো। তা হোক। চারদিক বেশ ফাঁকা।

টাঙ্গাওলা বাড়ির কাছে টাঙ্গা থামিয়ে বলল, “আপনি এখানে প্রথম আসছেন নাকি বাবু?”

“হ্যাঁ।”

“এরকম জায়গায় আপনি থাকতে পারবেন? এ খুব খারাপ জায়গা কিন্তু।” বিলাসী টাউন নামে টাউন হলেও তখন একেবারে ফাঁকা ও বুনো জায়গা ছিল। দিনের বেলাতেও গা ছমছম করত। বললাম, “খুব পারব। তা ছাড়া বাইরে বেরোলে অত ভয় করলে চলে?”

টাঙ্গাওলা বলল, “আমার সন্ধানে একটা ভাল ঘর ছিল। একেবারে মন্দিরের পাশে। যাবেন বাবু সেখানে?”

আমি মালপত্তর নামাতে নামাতে বললাম, “না, থাক। এখানটা বেশ নির্জন। আমার পক্ষে এই জায়গাই ভাল।” এই বলে টাঙ্গাওলাকে বিদায় দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, কী

জানি, টাঙ্গাওলার কথা শুনে আর কোথাও গিয়ে যদি কোনও পাণ্ডা গুণ্ডার হাতে পড়ি? মালপত্তর বাড়ির রোয়াকে রেখে দরজায় কড়া নাড়তেই একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, “কাকে চাই?”

“আপনার এখানে কোনও ঘর খালি আছে? এক মাস থাকব।”

ভদ্রলোক আমার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বললেন, “পুরো বাড়িটাই খালি আছে। আমি ওপরে থাকি, আপনি নীচে থাকবেন। এক মাসের জন্য কিন্তু দশ টাকা ভাড়া দিতে হবে। পারবেন তো?”

আমি কোনও কথা না বলে দশটা টাকাই বের করে দিলাম।

বাড়িটা ছোট। নীচে দুটি ঘর। রান্নাঘর। ওপরে একটি ঘর। ছাদ ও বারান্দা। বাড়ির বাইরে পাতকো, পায়খানা। চারদিকে গাছপালা, বন। মাঝেমধ্যে দু-একটা ঘরবাড়ি। দূরে পাহাড়ের রেখা।

যাই হোক, ভদ্রলোক টাকা দশটি অগ্রিম নিয়ে ঘর পরিষ্কার করে একটি ক্যাম্পখাট পেতে দিয়ে গেলেন। আমি তাইতেই বিছানা পেতে ফেললাম। তারপর ঘরে তালা দিয়ে দোকান-বাজার করে আনলাম। সঙ্গে স্টোভ ছিল। রান্না করে খেয়েদেয়ে দুপুরটা ঘুমিয়ে কাটালাম। বিকেলে মন্দির ঘুরে কিছুটা ভাল ঘি, প্যাঁড়া ও চমচম কিনে ঘরে ফিরে এলাম। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। কার্তিকের শেষ, অল্প অল্প শীতও পড়েছে তখন। ঘরে এসে তালা খুলেই অবাক! দেখলাম ঘরের ভেতর হারিকেনটা কে যেন জ্বেলে রেখে গেছে। পেরেকে দড়ি বেঁধে তাইতে আমার জামাকাপড় সব সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছে। আমি তো ভেবেই পেলাম না এরকমটা কী করে হল? কেননা, চাবি রইল আমার কাছে অথচ ঘরের কাজ করল কে? বাড়ির মালিকের নাম গজেনবাবু। আমি তাঁকে ডাকলাম। দু-তিনবার ডেকেও যখন কোনও সাড়া পেলাম না, তখন টর্চ জ্বেলে ওপরে উঠেই দেখি, ঘরে তালা দিয়ে একজন মধ্যবয়সী মহিলা নেমে আসছেন।

আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “গজেনবাবু আছেন?”

মহিলা আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে কিছু না বলেই নেমে গেলেন।

আমার। আচ্ছা অভদ্র তো! মেজাজটাও খিঁচড়ে গেল। কেননা, এ ঘরে যখন আর কোনও দরজা নেই, তখন নিশ্চয়ই ডুপ্লিকেট চাবি ব্যবহার করা হয়েছে। এতে অবশ্য আমার উপকারই হয়েছে। তবুও এ জিনিস কখনওই বরদাস্ত করা যায় না। আমি সে-রাতে দু-চারটে পরোটা তৈরি করে প্যাঁড়া, চমচম খেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়ে ঘুমোতে গেলাম।

মনে মনে খুব রাগ হল।

ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল হয়ে গেছে।

ঘুম থেকে উঠেই গজেনবাবুকে বাইরে কুয়োতলায় দাঁতন করতে দেখলাম। আমিও তাড়াতাড়ি দাঁত মাজার সরঞ্জাম নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

গজেনবাবু একগাল হেসে বললেন, “কী ভায়া, রাতে ঘুম হয়েছিল তো?” আমি হেসে বললাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ।” তারপর গতকালের কথাটা বললাম।

শুনে গজেনবাবু একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “টাকাকড়ি সবসময় নিজের কাছে রাখবেন। সন্ধের পর জানলা দরজা বন্ধ করে দেবেন। কেউ কড়া নাড়লে দরজা খুলবেন না। এসব জায়গা ভাল জায়গা নয়। তা ছাড়া রাত্রে আমি এখানে থাকি না। ওধারে আমার আর একটা বাড়ি আছে, সেইখানে থাকি।”

“তা না হয় হল, কিন্তু আমার ঘরে আলোটা জ্বালল কে? আপনার স্ত্রী?”

“আমার স্ত্রী? তিনি তো অনেকদিন গত হয়েছেন।”

“তা হলে ওই মহিলা কে?”

” গজেনবাবু হেসে বললেন, “আপনি ভুল দেখেছেন। এখানে কোনও মহিলা থাকেন না। এমন সময় হঠাৎ একটা ছাগলকে হ্যাট হ্যাট করে তাড়া দিতে দিতে আমার প্রশ্নটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে কেটে পড়লেন গজেনবাবু।”

এর পর সারাদিনে যতবারই গজেনবাবুর সঙ্গে দেখা হল, ততবারই তিনি আমাকে এড়িয়ে যেতে লাগলেন। আজ তাই ঠিক করলাম, বেলাবেলি, মানে সন্ধের আগেই এখানে ফিরে এসে দাঁড়িয়ে দেখব কে কীভাবে ঘরে ঢোকে?

তাই করলাম। সন্ধের আগেই ফিরে এসে দূরে দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সন্ধেটি যেই উত্তীর্ণ হল, অমনই দেখলাম আলো জ্বলে উঠল ঘরের ভেতর। ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল গায়ে। চারদিক নিস্তব্ধ নিঝুম। কেউ কোথাও নেই। আমি টর্চের আলোয় পথ দেখে ঘরে যেতে গিয়ে তালা খুলেই যা দেখলাম, তাইতে সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। দেখলাম আমার এঁটো বাসনপত্তর কে যেন মেজে ঝকঝকে করে রেখেছে। এলোমেলো বিছানা পরিপাটি করে, মায় আমার রাতের খাবারটি পর্যন্ত তৈরি করে রেখেছে।

বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। এ কোথায় এসে উঠেছি আমি? কাউকে যে ডাকব, ভয়ে গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। গজেনবাবুও সন্ধের পর থাকেন না এখানে। কেন যে থাকেন না, তা এবার বুঝতে পারলাম। শুধু বুঝতে পারলাম না ওই মহিলাটি কে? তবে কি—

হতাশভাবে ধপ করে বসে পড়লাম বিছানায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে সাড়ে ছ’টা। চারদিক ঘন অন্ধকারে ঢাকা। এ রাতে কোথায় বা যাব? বসে বসেই মনস্থির করে ফেললাম। আজকের রাত্রিটা যেমন করেই হোক এখানে কাটিয়ে কাল সকাল হলেই পালাব এখান থেকে। কিন্তু সারাটা রাত এখানে যে কী করে কাটাব তা ভেবে পেলাম না।

অনেকক্ষণ বসে থেকে কোনওরকমে রাত ন’টা করলাম। তারপর সঙ্গে আনা প্যাঁড়া চমচমগুলো খেয়ে নিলাম। যে রান্না তৈরি করা ছিল তাতে হাতই দিলাম না। এবার জল খেতে হবে। কিন্তু কলসি গড়াতে গিয়েই অবাক! এ কী! জল কই? বাইরে যাওয়ার আগে জলপূর্ণ কলসি যে আমি নিজে হাতে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। আমার সর্বাঙ্গ তখন নীল হয়ে উঠেছে। তার ওপর ভয়ে এবং প্যাঁড়া চমচম খাওয়ার ফলে তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। কী আর করি, বাইরে কুয়োতলায় গিয়ে জল আনতে ভয় করছিল যদিও, তবুও যেতেই হবে। যেতে গিয়েই বাধা পেলাম। দরজা খুলতে গিয়ে দেখি দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ। অনেক টানাটানি করেও সেই বন্ধ দরজা কিছুতেই খুলতে পারলাম না। এমন সময় হঠাৎ দপদপিয়ে হারিকেনটাও নিভে গেল। আমার গা দিয়ে কলকল করে ঘাম বেরোচ্ছে। ভয়ে ভয়ে আমি জোরেই কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “কে তুমি? কে আমাকে এইভাবে ভয় দেখাচ্ছ? আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। তা ছাড়া তুমি আমার অনেক কাজ এমনিই তো করে দিচ্ছ। তবে কেন এমন করছ আমার সঙ্গে? আমায় তুমি রক্ষা করো।”

হঠাৎ বাইরে কুয়োতলায় ঢিপ করে একটা শব্দ হল। নিশ্চয়ই কেউ জল তুলতে এসেছে। অনেকে এই কুয়ো থেকে দিনের বেলায় জল নিতে আসে দেখেছি। কিন্তু রাতে কেউ আসে কিনা জানি না। কী করেই বা জানব? সবে তো একটা দিন এসেছি। তাড়াতাড়ি জানলা খুলে কুয়োতলায় তাকাতেই দেখলাম, কুয়োর পাড়ে একটা হারিকেন জ্বলছে। আর তারপরেই যা দেখলাম সে এক বীভৎস ব্যাপার। কুয়োতলায় ভাঙা পায়খানার ধারে বড় একটা গাছের ডালে সেই মহিলা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছেন। কী ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য! জিভটা এক হাত বেরিয়ে এসেছে। মুখটা যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে। আর ঠেলে বেরিয়ে আসা বড় বড় চোখ দুটো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

পরদিন সকালে যখন চোখ মেললাম তখন দেখলাম ঘর ভরতি লোক। গজেনবাবু আমার মাথার কাছে বসে হাওয়া করছেন। আমি আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। তারপর সব কিছু খুলে বললাম সকলকে।

আমার বৃত্তান্ত শুনে প্রত্যেকেই বকাবকি করলেন গজেনবাবুকে।

আমি তখনই মালপত্তর গুছিয়ে নিয়ে স্টেশনে চলে এলাম। আবার থাকে এখানে? লোকমুখে শুনলাম, যে মহিলাকে আমি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখেছি, উনিই গজেনবাবুর স্ত্রী। তাঁর বর্তমানে গজেনবাবু দ্বিতীয়বার বিবাহ করায় ভদ্রমহিলা ওই গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *