পুরনো কলকাতা
সকলেই অবগত আছেন যে কলম্বাস সমুদ্রপথে আরব সাগর হইয়া ভারত মহাসাগরের অপর প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের খাঁড়ি পর্যন্ত আসিয়াছিলেন। তাহার পর সেখান হইতে ফিরিয়ে যান। এবং পরে দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছান।
ধুরন্ধর নাবিক কলম্বাস একটি মারাত্মক ভুল বুঝিয়েছিলেন। তিনি বঙ্গোপাসগরের উপকূলে গিয়া যখন জায়গাটা কী তাহা অনুসন্ধান করেন, তখন জানিতে পারেন জায়গাটার নাম কলকাতা। তাঁহার ধারণা হইয়াছিল তাঁহার নাম কলম্বাস হইতে এই স্থানের নাম কলকাতা হইয়াছে। তিনি ধরিয়া লন যে এই স্থানে আমি পূর্বে আসিয়াছিলাম, সুতরাং আবার নতুন করিয়া অবতরণের দরকার নাই। সুতরাং আবার হারা-উদ্দেশ্য সমুদ্রপথে রওনা হন এবং আমেরিকায় পদার্পণ করেন।
কিন্তু কলম্বাস তো মাত্র কয়েক শতাব্দী আগের কথা। ইহারও পূর্বে কলকাতা বিদ্যমান ছিল। কয়েক সহস্র বৎসর আগের কথা বলিতেছি। ইহা মহাভারতের যুগের কথা।
কপট পাশা খেলায় পরাজিত হইয়া, যুধিষ্ঠিরকে দীর্ঘ দ্বাদশ বৎসর বনবাস এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে থাকিতে হয়।
স্ত্রী দ্রৌপদী এবং ভ্রাতাদের সঙ্গে লইয়া অজ্ঞাতবাসের সময় যুধিষ্ঠিরকে নানা জায়গা লুক্কায়িত থাকিতে হয়। ধরা পড়িলে আবার প্রথম হইতে বনবাস আরম্ভ করিতে হইবে, সুতরাং তাঁহারা বন পথে আত্মগোপন করিয়া ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ত্রয়োদশ বৎসরটি আত্মগোপন করিয়া থাকেন।
কথায় আছে, পাণ্ডব বর্জিত বঙ্গদেশ। কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ সত্য নয়। আত্মগোপনের সময় একবার তাঁহারা গঙ্গা নদীর প্রায় শেষ প্রান্তে আসিয়া উপস্থিত হন।
গ্রীষ্মের এক অপরাহ্ণে ক্লান্ত যুধিষ্ঠির নদীর তীরে আসিয়া স্থির করেন, নদীর ওপারে রাত্রিবাস করা যাইতে পারে। ওপারে খোলা মাঠ আছে। শ্বাপদসংকুল অপরিচিত অঞ্চলে খোলা মাঠে রাত্রিবাস করা কিঞ্চিৎ নিরাপদ।
যুধিষ্ঠির তাহার বলবান ভ্রাতা ভীমচন্দ্রকে বলিলেন, ‘মধ্যম পাণ্ডব, ওই পারে গিয়া দেখ স্থানটি বাসযোগ্য কি না?’
আদেশ পাইবামাত্র মধ্যম পাণ্ডব গদা হস্তে লইয়া নদী সাঁতরাইয়া ওপারে চলিয়া গেলেন। ওপারে গিয়া তাঁহার মধ্যে কীরকম পরিবর্তন দেখা গেল। তিনি খোলা মাঠের জমি পায়ে হাঁটিয়া পরিমাপ করিতে লাগলেন এবং গদার খোঁচায় জমি চিহ্নিত করিতে লাগিলেন।
যুধিষ্ঠির দেখিলেন আর দেরি করা যায় না। সন্ধ্যা সমাগত। অচেনা জায়গায় অন্ধকারে বিপদ হইতে পারে, তিনি চিৎকার করিয়া ভীমকে বলিলেন, ‘অত মাপঝোপ করিতে হইবে না। তুমি জানাও আমরা আসিব কি না।’
ভীম এই প্রশ্নের জবাবে যুধিষ্ঠিরের দিকে ঘুরিয়া তাহাকে কয়েকবার ‘থামস আপ’ দেখাইলেন।
যুধিষ্ঠির তখন ভাবিলেন প্রবল গ্রীষ্মে মধ্যম ভ্রাতার মস্তিষ্কে বিকার হইয়াছে। তিনি বলিলেন, ‘ভীম আর দেরি করা যায় না। আমরা আসিতেছি।’
যুধিষ্ঠির সকলকে সাঁতার দিয়া ওপারে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে বলিলেন। ইহা শুনিয়া ওপারে ভীম দাঁত কিড়মিড় করিয়া গদা উঁচাইয়া বলিল, ‘এদিকে যে আসিবে তাহার মস্তক চূর্ণ করিয়া দিব।’ অবস্থার গতিক দেখিয়া যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বলিলেন, ‘সব্যসাচী তুমি অবিলম্বে ওপারে গিয়া ভীমকে পাগলামি হইতে নিবৃত্ত কর।’ আজ্ঞাবহ অর্জন সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিয়া দ্রুত সাঁতরাইয়া ওপারে গিয়া উঠিল। ততক্ষণে ভীম দৌড়াইয়া আসিয়া গদা তুলিয়া অর্জুনকে বার বার বলিতে লাগিল, ‘এইসব ভূমি আমার, এইখানে কেউ আসিবে না। ভাগো হিঁয়াসে।’
ওপারে পৌঁছিয়া অর্জুনেরও কী যেন ভাবান্তর হইয়াছিল। অর্জনও ভীমকে বলিতে লাগিল, ‘ভাগো হিঁয়াসে। এইসব জমি আমার।’
মহা বুদ্ধিমান যুধিষ্ঠির ব্যাপারটা অনুমান করিতে পারিয়াছিলেন। নকুল সহদেব ওপারে দুই ভাইয়ের ঝগড়া থামাইবার জন্য জলে নামিতে যাইতেছিল, যুধিষ্ঠির তাহাদের থামাইলেন, এবং উচ্চস্বরে বলিলেন, ‘ওহে ভীম, ওহে অর্জুন ওইদিকের ওই সামান্য ভুখণ্ড লইয়া তোমরা কলহ করিতে থাক। কিন্তু এই দিকের এই আসমুদ্র হিমাচল ভূমিখণ্ড ইহা আমাদের রহিল।’
এই কথা শুনিবামাত্র ভীম ও অর্জুন জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিতে আসিল। কিন্তু মধ্যগঙ্গায় আসিয়া তাহারা কেমন বদলাইয়া গেল। দুইজনার মুখের মধ্যে পূর্বের মতো শান্ত ভাব। দুইজনাই লজ্জিত। তাহারা তীরে উঠিয়া আসিয়া যুধিষ্ঠিরের পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাহিল। বলিতে লাগিল, ‘আমাদিগের যে কী হইয়াছিল বুঝিতে পারিতেছি না।’ যুধিষ্ঠির মৃদু হাসিয়া বলিলেন, ‘তোমাদের কোনও দোষ নেই। আমরা ভয়ংকর জায়গায় আসিয়াছি। ওই পার হইতেই পুরাণোক্ত কলকাতা জনপদ শুরু হইয়াছে। ওইখানে বিনা কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি, মারামারি, রক্তারক্তি হয়। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা সমীচীন নয়।’ এই বলিয়া সন্ধ্যার আগেই যুধিষ্ঠির স্ত্রী ও ভ্রাতাদের লইয়া যতদূর সম্ভব পশ্চিমে সরিয়া গেলেন।
শুধু মহাভারত নয়, কলকাতার প্রাচীনত্ব অন্যত্রও জানা যায়। মহাপ্লাবনের কালে মহামতি নোয়া যে বিশাল জলযান তৈয়ারি করিয়াছিলেন তাহাতে সবরকম জীবজন্তু তরুলতা তুলিয়াছিলেন যাহাতে ভূমণ্ডল সম্পূর্ণ জলমগ্ন হওয়ার পরেও অন্তত এক জোড়া করিয়া জীবজন্তু রক্ষা পায়, ঈশ্বরের সৃষ্টি বিলুপ্ত না হইয়া যায়।
সেই সময় মহাপ্লাবনের কয়েকদিন পূর্বে একজন পরিদর্শক নোয়াকে জানাইলেন, প্রায় সমস্তই সংগৃহীত হইয়াছে শুধু বাংলার রাজা বাঘ ব্যতীত। নোয়া প্রশ্ন করিলেন, ‘বাংলার রাজা বাঘ কোথায় পাওয়া যাইবে?’ পরিদর্শক খোঁজখবর লইয়া জানাইলেন বঙ্গোপসাগরের প্রান্তে কলকাতা জনপদ আছে। সেই জনপদের উপকণ্ঠে এইসব রাজা বাঘের বাসস্থান। দ্রুত ধাবমান নৌকা করিয়া তখনই নোয়ার নৌ সেনাপতি কলকাতায় আসিয়া পশ্চাদবর্তী জঙ্গল হইতে এক জোড়া ব্যাঘ্র শিশু সংগ্রহ করিয়া লইয়া গেলেন।
বলাবাহুল্য শাস্ত্রোক্ত সেই মহাপ্লাবনে কলকাতা নামক জনপদও সম্পূর্ণ নিমগ্ন হইয়াছিল। জল নামিয়া গেলে নোয়ার লোকেরা আসিয়া সুন্দরী গাছ দেখিয়া কোনও রকমে কলকাতাকে চিহ্নিত করেন এবং পার্শ্ববর্তী নবজায়মান অরণ্যে বাঘের বাচ্চা দুইটিকে ছাড়িয়া দিলেন। তখন অবশ্য তাহারা আর বাচ্চা নাই। রীতিমতো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাঘ্র যুবক আর ব্যাঘ্র যুবতী।
পুনশ্চ: কলকাতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে আর কোনও উদাহরণ প্রয়োজন আছে কি থাকিলে কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের পূর্ব মেঘ অংশে, আরব্য উপন্যাসের কাহিনীতে, এমনকী আইন-ই-আকবরিতে এবং মঙ্গলকাব্যে কলকাতা স্পষ্টতই প্রতীয়মান। যাচাই করিয়া দেখিবেন।
হাড়হাভাতে জোব চার্নক তথা জব চার্নককে যাঁহারা কলকাতার জনক বলিয়া ভাবেন তাঁহারা নিজেরাই জানেন না যে তাঁহাদের এই পরম পিতার নাম জব না জোব, জব চার্নক না জোব চার্নক? যাহাই হউক বৈঠকখানা রোডের খালের পাশের বাদামতলায় হুক্কাসেবী এই সাহেবকে আমাদের কল্লোলিনী কলকাতার জন্মদাতা পিতা হিসাবে ভাবিতে পারি না। সুবে বাংলায় একদা একটি কথা ছিল ‘ম্লেচ্ছ দোষ’। যাঁহাদের ম্লেচ্ছ দোষ আছে তাঁহারা ভাবেন তো ভাবিবেন।