পুবদিকের জানলা
আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও, মানুষ এত ব্যস্ত ছিল না৷ সকালে থলে নিয়ে বাজার করতে যেত, ভাতের আগে দু-দণ্ড মুড়ি চেবাত৷ তখনকার গল্প- উপন্যাসও চলত ঢিমেতালে৷ তারপর দুমদাড়াক্কা এসে গেল মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ই-মেল-এইসব৷ আপনি ভাবছেন এই সমস্ত হল বিজ্ঞানের উন্নতি৷ কিন্তু সে গুড়ে, বালি৷ আসলে এইসব হল আমাকে-আপনাকে দিয়ে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার ফিকির৷ আমরা ছোটবেলায় শুনেছিলাম যে যাঁরা নাকি রেললাইনে কাটা পড়ত, তারা স্কন্দকাটা নামে বিচ্ছিরি এক ধরনের ভূত হয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াত৷ ইন্টারনেট আসতে যখন জানলাম যে তেমন কিছু আদৌ হয় না, তখন আমার আর ফাঁকা রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থাকতে গা শিরশির করত না৷ শৈশবের রোম্যান্সকে খুন করার এ এক অশ্বমেধ যজ্ঞ চলছে৷
কোনও গল্পই বোধহয়, পুরোটা বানিয়ে লেখা যায় না৷ আমাদের এ গল্পটারও, খানিকটা, জীবন থেকে চুরি করে নেওয়া৷ শুধু আমাদের না— আপনার-আমার—আমাদের পূর্ববর্তী মানুষদের৷ আমরাও হয়তো সব গল্প বলে যেতে পারব না—আজ আছি, তাই তার মধ্যে থেকে লিখে রাখলাম একখানা৷
দীর্ঘদিনের পুরনো তালাটা সশব্দে খুলে যেতেই একরাশ পুরনো স্মৃতি এসে ঘিরে ধরল আমাকে৷ ছেলেবেলার বারোটা বছর নিমেষে চারপাশ চুরি করে নিল৷ সব তালা খুলতে কি একই রকম শব্দ হয়? বোধহয় না৷ কারণ এই মাত্র তালা খোলার যে শব্দটা হল সেটা আমার কাছে ভীষণ পরিচিত৷ আমার মধ্য কলকাতার টু বিএইচকে ফ্ল্যাটের দরজা বিনা শব্দে খুলে যায়, অফিসের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে নিজে থেকেই দু-পাশে সরে পথ করে দেয়৷ কিন্তু তালা খোলার এই খট-খটাং শব্দে একটা অকৃত্রিম নিরাপত্তা আছে৷ চাবিটা আমার হাতে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল মাধো৷ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ তালাটা এখনও পাল্টাওনি?’
মাধো একটুখানি হেসে মাথা নাড়ল, ‘ইংরেজ আমলে দেশি কোম্পানির তালা, এ তালা একবার চড়ালে আর নষ্ট হয় না৷ এখনকার ইয়েল- লকগুলোর খালি দেখনদারি আছে৷ কাজে কিছু নেই৷’
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এলাম৷ প্রথম দেখায় একটু অচেনা লাগল ঘরটা৷ তারপর ধীরে-ধীরে চিনতে পারলাম৷ আমার ছোটবেলায় দেখা আসবাবপত্র কিছুই নেই৷ দেওয়ালের রং বদলেছে৷ পায়ের নীচে এখন আর সিমেন্ট নেই৷ মার্বেল বসেছে৷ একই রকম আছে শুধু জানলাগুলো৷ এইটুকুনি ছোট ঘরে চারটে ছাদছোঁয়া জানলা৷ দাদু বাড়িটা যখন বানিয়েছিলেন সে সময়ে বেশি করে জানলা বানানোর একটা রেওয়াজ ছিল৷ এখনকার বাড়িতে তত জানলা হলে প্রাইভেসি নষ্ট হয় বলে ইঞ্জিনিয়াররা সে বালাই রাখেন না৷ দাদুর কথা মনে পড়তেই ডানদিকের দেওয়ালের উপরে চোখ চলে গেল৷ ছবিটা নেই সেখানে৷ মনটা খারাপ হয়ে গেল, পিছন ঘুরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে, এ দেওয়ালে দাদুর একটা ছবি ছিল, কোথায় আছে জানিস?’
মাধো খানিক ভেবে নিয়ে বলল, ‘এর আগে তো ভাড়াটে থাকত এখানে, তখন থেকেই নেই৷ বড় সাহেবকে জিজ্ঞেস করে দেখব ওনার কাছে আছে কি না৷’
এখানে আসার আগে ইচ্ছা করেই ঘরে বেশি জিনিসপত্র রাখতে বারণ করেছিলাম৷ শোবার মতো একটা খাট হলেই চলে যায় আমার৷ সাথে একটা চেয়ার৷ এতকাল বিছানার উপর আড় হয়ে শুয়েই লেখাপড়া করে এসেছি৷ ইদানীং চোখে ব্যথা হওয়ার জন্য ডাক্তার অত কাছ থেকে লিখতে বা পড়তে বারণ করেছে৷ তাই চেয়ারের ব্যবস্থা৷ ব্যাগ থেকে টুকিটাকি জিনিসপত্র বের করে আপাতত চেয়ারের উপরেই রাখলাম৷
‘জানলাগুলো খুলে দিন স্যার, গুমোট হয়ে আছে…’
মাধো নিজেই জানলা খুলতে যাচ্ছিল৷ বাধা দিলাম তাকে৷ বললাম, ‘থাক গে, আমিই খুলে নেব৷ তুমি এসো এখন৷’
‘বিকেলে আবার আসব স্যার, কিছু দরকার হলে ফোন করে দেবেন৷ তবে এ বাড়িতে অসুবিধার কিছু নেই৷’
‘হুঁ… উপরের ভাড়াটেরা লোক কেমন?’
‘নিরীহ, সাতে-পাঁচে থাকে না৷ উপরে যে লোক আছে বুঝতেই পারবেন না৷’
‘বেশ৷ সেই ভালো৷ তুমি ছবিটার ব্যবস্থা করো৷’
মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মাধো৷ আমি ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে জানলাগুলো খুলে দিলাম৷ প্রথমে উত্তর দিকেরগুলো তারপর পুবের জানলাটার কাছে এসে দাঁড়ালাম৷ পাল্লাদুটোর আংটা গ্রিলের সাথে নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা৷ গ্রিলগুলো এখনও আগের মতোই আছে৷ লম্বা গরাদের ফাঁকে মাঝে-মাঝে গোলগোল চাকতি৷ সত্যি কথা বলতে এই জানলাটার জন্যই এখানে এসেছি আমি৷ গ্রিলের উপর হাত বুলাতে-বুলাতে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল৷ এই জানলার উল্টোদিকেই তখন একটা খাট পাতা থাকত৷ ঘরে একা শুতাম আমি৷ প্রথমদিকে বেশ ভয় লাগত; ধীরে ধীরে সেটা কেটেও গেছিল৷ শুধু অন্ধকার ঘরে এই খোলা জানলাটার দিকে তাকালে বুকের ভিতরটা কেমন যেন ছমছম করত৷ অন্য জানলাগুলোয় কিন্তু তেমন হত না৷ তার একটা কারণও অবশ্য ছিল৷ মায়ের কাছে শুনেছিলাম দাদু বাড়িটা করার আগে গ্রামের কোনও গবাদি পশু মারা গেলে লোকেরা তাকে এইখানে পুঁতে দিয়ে যেত৷ তাছাড়া জমির খানিকটা জায়গা দাদু কিনতে পারেননি৷ ফলে সেই জায়গাটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিয়ে তবে বাড়ি করতে পেরেছিলেন৷ পুব দিকের ওই জানলাটা দিয়ে তাকালে সেই ঘেরা পাঁচিলটা দেখা যেত৷ এমনিতে জায়গাটা মিটার পাঁচেকের বেশি বড় হবে না৷ কিন্তু ছেলেবেলায় ওই নির্বাক ইটগুলোই আমার মনের ভিতরে থেকে-থেকে খোঁচা দিত৷ কী আছে ওর আড়ালে? রাত্রিবেলা জানলা খোলা থাকলে বারবার চোখ পড়ত সেখানে৷ থাক-থাক নিশ্চল ইটের উপর চাঁদের আলো পড়ে কী মায়াময় দেখাত জায়গাটা৷ মনে হত এই বুঝি কেউ সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে৷
এখন সেইসব ভেবে মনে-মনে কেমন যেন হাসি পেল৷ সেখান থেকেই আমার ভূত নিয়ে ভাবনাচিন্তার শুরু৷ এসব কথা তো বড়দের বলা যায় না৷ নিজের মনের মধ্যেই রেখে দিতাম৷ কিন্তু মনের ভিতর জায়গাই বা কত আর! ফলে খাতায় লিখতে শুরু করলাম৷ সে খাতাখানা এখন হারিয়ে গেছে৷ এর মাঝে সময় তো কম কাটল না৷ প্রায় বছর পনেরো৷ ভূতের গল্পও নেহাত কম লিখিনি, কিন্তু তার মাঝেই এখন একটা সমস্যা এসে দেখা দিয়েছে৷ সে কথায় পরে আসছি৷
দড়ির গিঁট খুলে জানলার একটা পাল্লায় ঠেলা দিলাম৷ সেটা ধীরে-ধীরে খুলে গেল৷ ওপারের এক ঝলক আলো অনেকদিন পর পথ পেয়ে ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরের ভিতরে৷ আমার চোখও প্রথম গিয়ে পড়ল সেই ঘেরা পাঁচিলটার উপরে৷ হ্যাঁ! সেটা এখনও আগের মতোই আছে৷ শুধু কয়েক জায়গায় ইট খসে সিমেন্টের গাঁথনি বেরিয়ে পড়েছে৷ ফুট ছয়েকের উঁচু পাঁচিল৷ তার সামনে কাঁটা ঝোপ আর বুনো ফুলের জঙ্গল৷ এখন সেটা আরও লতাপাতায় ঢাকা পড়েছে৷ এতদিন যারা এখানে থাকত তারা পরিষ্কার করায়নি নাকি? জানলার গ্রিলটা ঠান্ডা হয়ে ছিল৷ হাতের আঙুলগুলো ছোঁয়াতেই শিরশির করে উঠল৷ সরে এলাম সেদিক থেকে৷ সেকালে সাপখোপের আস্তানা ছিল বলে ছোটদের পাঁচিলের ওদিকটায় যেতে দেওয়া হত না৷ মাঝে-মাঝে নাকি বাড়ির পাইপ বেয়ে দোতলায় সাপ উঠে আসত৷ তাও একদিন বাড়ির লোকের চোখ এড়িয়ে পাঁচিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম৷ কিন্তু ওই পর্যন্তই! অনেক লাফালাফি করেও পাঁচিলটা টপকে ওপারটা দেখতে পারিনি৷ সাথে ভয়ও লাগছিল৷ একবার ওদিকে গিয়ে পড়লে আর যদি এপারে আসতে না পারি? সেদিন ফিরে এসেছিলাম৷ ভেবেছিলাম আর একটু লম্বা হলে আবার চেষ্টা করে দেখব৷ কিন্তু সে সুযোগ আর পাইনি৷ আমার বারো বছর হতে না হতেই বাবার কলকাতায় বদলি৷ সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি৷ বাড়িটার একতলায় এতদিন ভাড়াটে ছিল৷ মাসতিনেক হল তারা উঠে যাওয়ায় এবং নতুন ভাড়াটের খোঁজ এখনও অবধি না পাওয়ায় আমিই আপাতত আস্তানা গেড়েছি৷
দুপুরে খেয়ে-দেয়ে শহরটা একপাক ঘুরে এলাম৷ পুরনো দোকানপাট বেশিরভাগই নেই৷ যেগুলো আছে তাতেও চেনা পরিচিত লোকজন উধাও৷ বিকেলে ঘরে ফিরেই দেখলাম মাধো বাইরে অপেক্ষা করছে, হাতে খবরের কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট৷ বুঝলাম—ছবিটা৷ আমাকে দেখেই সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘অনেক খোঁজাখুঁজি করে বের করতে হল স্যার৷ প্রায় হারিয়েই গেছিল৷’
আমি হাসলাম৷ ছবিখানা হাতে নিতে-নিতে বললাম, ‘এ ছবিটা ঘরে না থাকলে চিনতেই পারি না ঘরটা৷ আর একটা উপকার করে দিও বাবা৷’
‘বলুন না৷’
‘বাড়ির পুবদিকের পাঁচিলটা এখনও আছে দেখলাম৷’
‘ওই ভাঙা পাঁচিলটা?’
‘হ্যাঁ৷ আজ জানলা দিয়ে চোখে পড়ল৷’
একটু যেন অবাক হল মাধো৷ তারপর কী যেন ভেবে বলল, ‘বছর খানেক আগে জায়গাটা সাফা করে পাঁচিলটা ভেঙে ফেলার কথা হয়েছিল কিন্তু জায়গার দলিল নিয়ে কীসব মোকদ্দমা চলছে শুনেছি৷ তাই আর ভাঙা যায়নি৷’
‘ভেঙে ফেলেবে কেন? খারাপ কিছু আছে ওখানে?’ প্রশ্নটা করেই মনে হল বোকামি করে ফেলেছি৷ আসলে ভূতের গল্প লিখতে-লিখতে এমন অভ্যাস হয়েছে যে সহজ স্বাভাবিক কারণগুলোই আর ভেবে দেখি না৷
‘খারাপ কিছু বলতে, সাপখোপ পোকামাকড় তো কম নেই৷ রাস্তার একধারে ছেলেপুলেরা ক্রিকেট খেলে৷ মাঝে মধ্যে ওখানে বল এসে পড়ে৷ তাই আর কী…৷’
আমি একটু থেমে বললাম ‘কাউকে দিয়ে জায়গাটা একটু পরিষ্কার করিও তো৷’
‘কেন স্যার?’ মাধোর গলাটা এবার কৌতূহলী শোনাল৷
‘একটু ঘুরে দেখব৷’
সে কী যেন বলতে গিয়ে একটু ইতস্তত করল৷ তারপর বলল, ‘দেখার মতো তো কিছু নেই৷ ঝোপঝাড় খালি৷ তবে বলছেন যখন কালই পরিষ্কার করিয়ে রাখব৷ আপনার গামবুট আছে?’
‘বাড়িতে আছে৷ এখানে আনা হয়নি৷’
একবার মাথা নাড়িয়ে মাধো উঠে পড়ল৷ জায়গাটা পরিষ্কার করতে বলে তাকে যে বেশ ঝামেলায় ফেলেছি সেটা মনে-মনে বুঝতে পারলেও মুখে কিছু বললাম না৷ পাঁচিলটার ওপারে ঠিক কী আছে সেটা দেখতেই আমার এতদূর আসা৷ তার সাথে আরও একটা কারণ আছে বটে তবে সেটার ব্যবস্থা রাত না হলে করা যাবে না৷ ঘরে ঢুকতেই খোলা জানলাটা চোখে পড়ল৷ বিকেল হয়ে আসায় ওপারের আলো ক্ষীণ হয়ে এসেছে৷ কী যেন একটা মোহময় হাতছানিতে ডাকে জানলাটা৷ ছোটবেলাতেও ঠিক এইভাবেই খোলা জানলার বাইরে চোখ পড়ত আমার৷ মাথায় একগাদা কিম্ভূত খেয়াল ভিড় করে আসত৷ মনে হত—এই বুঝি কেউ এসে দাঁড়াল সেখানে, গ্রিলের গোল চাকতিগুলোর মাঝখান থেকে এগিয়ে এল একটা হাত, পাঁচিলের ওপার থেকে উঠে এল কোনও মুন্ডুহীন ধড়৷ ব্যাপার হয়েছে কী, আমাদের লেখককুলের একটা ক্রনিক রোগ আছে৷ থেকে-থেকে মাথায় গল্পের জন্য নতুন প্লট আসতে চায় না৷ কলম বাগিয়ে বসে মাথা খুঁড়ে ফেললেও একলাইন গল্প এগোয় না৷ কিছুদিন হল আমার এ রোগটা অসহ্যরকম বেড়ে উঠেছে৷ অনেক সাধ্যসাধনা করে কিছু মাথায় এলেও পরক্ষণেই মনে হচ্ছে—ধুর! এ জিনিস তো আগেই লিখে ফেলেছি৷ এ রোগের কোনও ওষুধ নেই জানি কিন্তু না লিখেই বা কতদিন থাকা যায়৷ শেষে মনে পড়ল এই জানলাটার কথা৷ মনে হল, একটা রাতও যদি এই ঘরটায় শুয়ে খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি তাহলে নতুন কিছু মাথায় খেলতে পারে৷ ছোটবেলায় যখন আসত তখন এই বয়সে একেবারে বিমুখ করবে বলে মনে হয় না৷
কাগজের মোড়কটা খুলে ছবিটা বের করে আনলাম৷ বুঝলাম মাধো সেটাকে আগে থেকেই ভালো করে ধুলোঝাড়া করে রেখেছে৷ আগের ভাড়াটেরা বোধহয় হুকে ক্যালেন্ডার টাঙাত৷ সেটুকু জায়গার দেওয়ালে এখনও কালচে রং ধরেনি৷ ছবিটার পিছনে দড়ি লাগানো ছিল; সেটা হুকে টাঙিয়ে দিলাম৷ দাদুর শেষ বয়সের ছবি—সাদাকালো৷ কাচের ফ্রেম দিয়ে ঢাকা থাকায় ভিতরের ছবিটা এখনও বোঝা যায়৷ সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই আচমকা কিছু পুরনো কথা মনে পড়ে গেল৷ কী আশ্চর্য! এই কথাগুলো এতদিনে প্রায় ভুলেই গেছিলাম৷ কলকাতায় অফিস ছিল বলে দাদু এখানে থাকতেন না৷ বড়সড় ছুটি পড়লে তখন আসতেন৷ সে ক-টা দিন তাঁর হাবভাবই বদলে যেত৷ তখন তিনিই বা কে আর বড়লাটই বা কে৷ সকালবেলা ঝোলা নিয়ে বাজার করতে বেরতেন৷ তারপর বাড়ি ফিরে ঝোলা রেখেই ক্লাবে ছুটতেন তাস খেলতে৷ সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে শতরঞ্চি বগলদাবা করে সোজা ছাদে৷ দাদু এখানে থাকলে আমারও পড়াশোনায় দিন কয়েকের ছুটি মিলত৷ ফলে সন্ধে গাঢ় হলে আমিও গুটি-গুটি পায়ে ছাদে চলে আসতাম৷ খোলা আকাশের নীচে সেই শতরঞ্চিতে শুয়ে একটার পর একটা গল্প বলতেন দাদু৷ তার বেশিরভাগই নাকি সত্যি ঘটনা এবং সত্যি ঘটনার বেশিরভাগটাই আবার ভূতের৷ গোটা সন্ধে হাঁ করে সেইসব গল্প গিলতাম আমি৷ আকাশে জ্বলজ্বলে জ্যোৎস্নার ঘন রাত নামত৷ মনে হত চাঁদ আর তারাগুলোও নেশায় ডুবে স্থির হয়ে শুনছে৷ কলকাতায় থাকতে কিন্তু দাদু তেমন একটা আসতেন না আমাদের বাড়িতে৷ এলেও তাকে চিনতে অসুবিধা হত আমার৷ গ্রামের দাদু আর শহরের দাদু যেন দুটো আলাদা মানুষ৷
ভালো করে সন্ধে নামার আগেই মশারি টাঙিয়ে ফেললাম৷ এদিকটায় মশার ভারী উপদ্রব৷ মশারির ভিতর খাতা-কলম নিয়েই ঢুকেছিলাম৷ খানিকক্ষণ গল্পের আশায় বসে থাকলাম, কোনও লাভ হল না৷ রাত না হলে কিছু আসবে বলে মনে হয় না৷ ব্যাপারটা মনে হতেই অন্য একটা আশঙ্কা এসে চেপে ধরল আমাকে৷ আচ্ছা আমি যদি আর ভয় না পাই? আর কিছু না হোক, এর মাঝে পনেরোটা বছর কেটে গেছে৷ এতদিনে আমি আর ভিতু নই৷ জানলার দিকে তাকিয়ে থাকলেও যদি মাথায় কিছুই না আসে? মশারি থেকে বেরিয়ে জানলার দিকে এগিয়ে গেলাম৷ গ্রিলগুলোতে আবার হাত ছুঁইয়ে দেখলাম৷ মৃতদেহের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে তারা৷ একটা শিরশিরে হাওয়া চোখে মুখে এসে লাগল আমার৷ মনে হল কিছুক্ষণের জন্য যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে জানলাটা৷ যদি সত্যি তাই হয়, আমাকে কি মনে পড়বে তার? একটানা বারোটা বছর এই ঘরে কাটিয়ে গেছি, ভুলে যাওয়ার তো কথা নয়৷
‘কিরে, মনে আছে আমাকে?’
অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এল মুখ থেকে৷ কানের পাশে শনশনে হাওয়ার ঝাপটা লাগছে৷ বাইরের অন্ধকার কাঁটা ঝোপের আড়াল থেকে একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে৷ জং ধরা খসখসে গ্রিল৷ জং নয়, যেন বয়সের ভারে বৃদ্ধ জানলাটার চামড়া কুঁচকে আছে৷ হঠাৎ খানিকটা দূরে শুকনো পাতার উপর খসখস আওয়াজ হল৷ মনে হল কেউ যেন হেঁটে সরে যাচ্ছে সেদিক থেকে৷ চমকে উঠলাম৷ এত রাতে কে আসবে ওদিকে? টর্চটা ব্যাগ থেকে বের করা হয়নি৷ তাড়াহুড়ো করে সেটা বের করে আলো জ্বেলে জানলার বাইরে ধরলাম৷ মিহি হলুদ আলোর রেখা জঙ্গল ভেদ করে ভাঙা পাঁচিলটার উপর গিয়ে পড়ল৷ নাঃ৷ কেউ নেই সেখানে৷ তবে কি ভুল শুনলাম? অবশ্য বিড়াল বা কুকুর জাতীয় প্রাণীও হতে পারে৷ এর মধ্যেই দু-একটা ধুরন্ধর মশা হাতের উপর এসে বসেছিল৷ সেখানটা চাপড়ে নিয়ে ফিরে আসার জন্য পিছন ফিরতেই থমকে গেলাম৷ এই মাত্র আবার শুনতে পেয়েছি শব্দটা৷ তবে এবার আর দূরে নয়৷ যেন জানলার ঠিক নীচ থেকেই এসেছে সেটা৷ মনে হল, এই মুহূর্তে আমার ঠিক পিছনেই জানলার গ্রিল ধরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মাছের মতো নিশ্চল চোখের দৃষ্টি এসে পরেছে আমার ঘাড়ে৷ আমি পিছন ফিরে দেখার সাহস পেলাম না৷ পাখার হাওয়ায় মশারির কাপড়টা দুলছে৷ এখন আর পিঠে হাওয়ার ঝাপটা লাগছে না৷ অর্থাৎ হাওয়ার পথ আটকে সত্যি কেউ দাঁড়িয়েছে জানলায়৷ এক পা- এক পা করে আমি সরে এলাম সেদিক থেকে৷ চকিতে পিছন ফিরলাম৷ সাথে-সাথে মনে হল পিছন ফেরার ঠিক আগের মুহূর্তেই কেউ সরে গেল সেখান থেকে৷ দুরু দুরু বুকে মশারির ভিতরে ঢুকে এলাম৷ তবে কি সত্যি কিছু আছে জানলার ওপারে? আমার ছোটবেলার কল্পনাটা অমূলক মিথ্যে নয়? নাঃ! এখনই নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না৷ শুধু একটা ব্যাপার নিয়ে আর সন্দেহ নেই আমার মনে৷ ভয় আমি, এখনও পাই৷ আগের মতোই… হয়তো বা তার থেকে বেশি৷
হোটেল থেকে খেয়েদেয়ে ফিরতে-ফিরতে সাড়ে দশটা বেজে গেল৷ ঘরের আলোটা জ্বেলেই গেছিলাম৷ আজ রাতে ঘুম যে হবে না তা বেশ বুঝতে পারছি৷ অবশ্য সেটা না হলেই ভালো৷ আমি তো এখানে ঘুমাতে আসিনি৷ ফেরার সময় মাধোর সাথেও দেখা করে এলাম৷ সে বলল কাল সকালেই জায়গাটা পরিষ্কার করে দেবে৷ তেমনটা যদি হয় তাহলে কাল বিকেলের দিকেই কলকাতা রওনা দেব৷
হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় ছেড়ে আবার গিয়ে ঢুকলাম মশারির ভিতরে৷ আলোটা নিভিয়ে দিলাম৷ ক’দিন পরেই হয়তো পূর্ণিমা৷ ফিনফিনে আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে৷ জানলা দিয়ে কয়েকটা উড়ন্ত জোনাকির আলো চোখে পড়ছে৷ হাজারো ব্যাঙ-ব্যাঙাচি যেন একসাথে ডেকে চলেছে৷ সেই সাথে ঘরের ভিতর পুরনো পাখার ঘটর-ঘটর আওয়াজ৷ সব কিছু মিলেমিশে আমার চারপাশটা কুয়াশার মতো অবাস্তব মনে হচ্ছে৷ জানলার দিকে চোখ দিয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আমি—ছেলেবেলার বন্ধুদের কথা, আমার মা, বাবা, এই বাড়ির অতীত ঘিরে থাকা মানুষগুলোর কথা৷ তাদের কেউ আর এখানে থাকে না৷ তাদের পরিচিত হাঁকডাক আর শোনা যায় না এখানে৷ সে সবের সাথে কি মানিয়ে নিয়েছে বাড়িটা? নাকি এখনও সে ভুলতে পারেনি আমাদের? মানুষ পরিবর্তনশীল, মরণশীল, সেকথা কি তাকে জানিয়েছে কেউ?
ঘুম নামছে ধীরে-ধীরে৷ একটা মোহময় অনুভূতি এসে গ্রাস করছে আমাকে—দোতলায় আমার মা শুয়ে ঘুমাচ্ছেন, একটু পরেই ঘুম ভাঙবে তার৷ জড়ানো গলায় ডাক দেবেন, ‘খেতে আয় সমু…’
দাদু ছাদ থেকে তড়িঘড়ি নেমে এসে বলবেন, ‘দেখবি চল আজ টকটকে লাল চাঁদ উঠেছে আকাশে, আজকের রাতে জল থেকে তোলা খড়ের মূর্তিগুলো সব জীবন্ত হয়ে ওঠে…’
পাশের বাড়ির জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে বুদুন বলবে, ‘আজ চোট্টামি করে জিতলি তোরা, কাল দেখিয়ে দেব, কেঞ্চর দান ভেংচো যাবে…’
আমি অবিশ্বাসে চিৎকার করে উঠব, ‘তোমরা সব মিথ্যেবাদী৷ তোমরা কবেই এখান থেকে চলে গেছো৷’
সবাই একসাথে হেসে উঠবে, ‘আমরা! আমার কোথায় গেলাম রে? একবার দেখ নিজের দিকে৷’
আমি সেই মুহূর্তে চশমাটা খুঁজে পাব না৷ আমার ফুলপ্যান্ট ব্যঙ্গ করে হাসবে৷ বইয়ের মলাট হয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডার আবার ডানা মেলে উঠে আসবে দেওয়ালে৷ টেবিলের উপর থেকে মাটিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে ঘড়িটা৷ খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত শরীরে আমি মুখ ঢেকে শোব৷ ঠিক সেই সময়ে নিরাপদ দুটো হাত এসে জড়িয়ে ধরবে আমাকে৷
মনে হল মাথার ভিতরে অবাস্তব গল্পের কাঠামো ফুটে উঠছে৷ ভাবলাম উঠে বসে আলো জ্বেলে এখনই লিখে ফেলি৷ পরক্ষণেই ঘরের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘না, আজ নয়৷ গল্প হারিয়ে যাবে না৷ এখন ঘুমিয়ে পড়ো৷’
ধীরে-ধীরে গভীর ঘুম নামছে আমার চোখে৷ প্রায় বন্ধ হয়ে আসা চোখের পাতায় একটু একটু করে মিলিয়ে আসছে আমার ছোটবেলার জানলাটা…
সকালবেলা মাধোর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল৷ ঘড়িতে দেখলাম প্রায় সাড়ে ন-টা বেজেছে৷ আমি ঘর থেকে বাইরে এসে দরজা খুলতেই সে কান পর্যন্ত হেসে বলল, ‘পাঁচিলের ওদিকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে স্যার৷ সকাল থেকে লোক লাগিয়ে দিয়েছি৷’
‘সেকি! এত সকালে!’
‘আমরা গ্রামের দিকের লোক সকালেই উঠি৷’ কথাটা বলে সে বাইরে পা বাড়াল৷
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘তা বটে৷ আগে যখন এ ঘরে শুতাম তখন ওই পুবের জানলা দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়লেই ঘুম ভেঙে যেত৷ আজ যে কেন ভাঙল না সেটাই ভাবছি৷’
‘আলো পড়বে কি করে স্যার? জানলাটাই তো নেই৷’ মাধো অবাক হয়ে বলল৷
মনে-মনে যেন খেপে উঠলাম আমি, ‘জানলা নেই! কী ফাজলামো করছ?’
মাধো একটা বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘একটা গোটা দিন কাটালেন অথচ লক্ষ করলেন না! বড়কাকা বহুবছর আগেই সে জানলা বুজিয়ে দিয়েছে৷’
মুহূর্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম আমি৷ প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকলাম৷ আর ঢুকতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ ঘরে তিনটে জানলা৷ কাল সারারাত যে খোলা জানলাটার দিকে তাকিয়ে শুয়েছিলাম, সেখানে এখন মোটা ইট আর সিমেন্টের আস্তরণ৷ সারা ঘরের দেওয়ালের সাথে সে জায়গাটার কোনও পার্থক্য নেই৷ এত বছর পরে আর সেটা থাকার কথাও নয়৷
ধীরে-ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেলাম আমি৷ দেওয়ালের উপরে হাত রাখলাম৷ ওই দেওয়ালের নীচে আমার ছেলেবেলার জানলাটা সমাধিস্থ আছে৷ একটা সময় প্রতি রাতে আমাকে গল্প বলত সে৷ আমার বিনিদ্র চোখ জুড়ে কল্পনার মায়াজাল বুনত৷ একটু-একটু করে মেলে ধরত ওপারের জগৎ৷ আজ সে মৃত৷ ঠিক দাদুর মতোই৷ ছোটবেলার মানুষগুলোর মতোই অফুরন্ত গল্পের ঝুলি নিয়ে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে৷ কেউ তার সব গল্প বলে যায় না, কেউ না… অব্যক্ত গল্পরা মানুষগুলোর সাথেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়…
পিছনে তাকিয়ে দেখলাম মাধো এসে দাঁড়িয়েছে৷ সে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ একটু থেমে বলল, ‘জুতো পরে নিন স্যার, দেখে আসবেন বাইরেটা৷’
‘না থাক৷ আমি দেখব না৷ আজ বিকেলে কী ট্রেন আছে দেখো তো৷’
আমার খামখেয়লি শখে একটা বিরক্তি ফুটে উঠল তার মুখে, ‘কাল যে বলেছিলেন দেখবেন…’
মাথা নাড়লাম৷ কত গল্পই তো শোনা হল না—আমার মায়ের ভূত দেখার গল্প—বাবার মাছ ধরার গল্প—ছোড়দিদির ছাদ ডিঙিয়ে ঘুড়ি ধরার গল্প৷ আমার বহু বিনিদ্র রাতের সঙ্গীও আমার অজান্তেই বহুদিন আগে তার গল্পের ঝোলা গুটিয়ে বিদায় নিয়েছে চিরদিনের মতো৷ তার সিমেন্ট চাপা কবরের উপর শেষবার হাত রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম আমি…