পুপলু
সমুদ্র থেকে কী একটা জন্তু উঠেছে, সবাই ভিড় করে সেটা দেখতে যাচ্ছে৷ সারাদিন ধরে দিঘায় কিছুই তো আর করার নেই—শুধু সমুদ্রে চান করা আর সমুদ্র দেখা৷ দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগে৷ এখন নতুন একটা কিছু দেখা যাবে, তাই সকলের এত উৎসাহ৷
হোটেলের বেয়ারার কাছ থেকে খবর শুনেই পুপলু ছুটতে ছুটতে এল নিজেদের ঘরে৷ বাবা বারান্দায় বসে বই পড়ছেন৷ পুপলু এসে বলল, ‘বাবা, শিগগির চলো৷’
বাবা বই থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘কোথায়?’
পুপলু ঠিকমতন সমুদ্র বলতে পারে না৷ সে বলল ‘সমুদ্দরে৷’
বাবা বললেন, ‘এই তো একটু আগে সমুদ্র থেকে ফিরলে৷ এখন আবার গিয়ে কী হবে?’
পুপলু দুটো হাত দু-দিকে ছড়িয়ে চোখ দুটো গোল করে বলল, ‘এই এত বড়ো একটা জন্তু উঠেছে সমুদ্দর থেকে৷ ইয়াসিন বলল৷ হ্যাঁ, সত্যি৷’
হোটেলের বেয়ারা ইয়াসিনের সঙ্গে পুপলুর খুব বন্ধুত্ব৷ সে পুপলুকে বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প বলে৷ বাবা সেই জন্য হেসে বললেন, ‘ইয়াসিন বলেছে তো? কত বড়ো জন্তু? এইখান থেকে আকাশ পর্যন্ত?’
পুপলু আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল, সত্যি কি এতবড়ো জন্তু হয়? তারপর চোখ মিটমিট করে বলল, ‘না অত বড়ো নয়৷ তার থেকে একটু ছোটো৷ চলো না বাবা…’
বাবা বললেন, ‘এই দুপুর রোদ্দুরে আমি আর সমুদ্রের কাছে যেতে পারব না৷’
পুপলু নিরাশ হয়ে গেল৷ বড়োরা কীরকম যেন৷ একটা অদ্ভুত জন্তু উঠেছে, সেটা দেখারও উৎসাহ নেই?
পুপলু গেল মায়ের কাছে৷ মা উলের সোয়েটার বুনছিলেন৷ কথাটা উড়িয়েই দিলেন একেবারে৷ বললেন, ‘না, দুপুরবেলা কেউ সমুদ্রে যায় না৷’
পুপলু বলল, ‘ওই দ্যাখো না, কত লোক যাচ্ছে৷’
এমন সময় বারান্দায় ইয়াসিনকে দেখেই পুপলু লাফিয়ে উঠল৷ চেঁচিয়ে বলল, ‘মা, আমি ইয়াসিনের সঙ্গে যাব?’
মা বললেন, ‘বাবাকে জিজ্ঞেস করো৷’
বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে যাও৷ কিন্তু ইয়াসিনের হাত ছাড়বে না৷’
একটু বাদেই বাবা বারান্দা থেকে দেখতে পেলেন পুপলু লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে৷ ইয়াসিন অনেক পেছনে৷ ভয়ের কিছু নেই৷ এইটুকু জায়গায় পুপলু কোথাও হারিয়ে যাবে না৷ আর পুপলু জলে নামতে ভয় পায়৷
দুপুরবেলা জেলেরা সব সমুদ্র থেকে ফিরে আসে৷ ভোরবেলা তারা চলে যায় মাছ ধরতে, ফেরে এতক্ষণ পরে৷ মাছের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছু ওঠে তাদের জালে৷ বিচিত্র চেহারার সব প্রাণী৷ হাঙরের বাচ্চা ধরা পড়ে মাঝে মাঝে৷
সেদিন জেলেরা সত্যিই একটা অদ্ভুত চেহারার প্রাণী ধরে এনেছে৷ তোশকের মতো বড়ো আর চ্যাপ্টা একটা প্রাণী, সারা গাটা জলের মতন রং৷ জেলেরা সেটা ফেলে রেখেছে বালির ওপর৷ সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছে৷ কেউ বলছে ওটার নাম জেলি মাছ, কেউ বলছে, তিমি মাছের বাচ্চা৷ কেউ বলছে, এরকম প্রাণী আগে কেউ কখনও দেখেনি৷
পুপলু লোকজনকে ঠেলে একেবারে সামনে এগিয়ে যেতেই একজন লোক বললেন, ‘এই খোকা, অত কাছে যেও না৷ কামড়ে দেবে৷’
পুপলু বলল, ‘ওর মুখ কোথায়? কী করে কামড়াবে?’
প্রাণীটার মুখ দেখা যাচ্ছে না৷ একজন বলল, ‘ওর মুখটা পেটের কাছে৷’
পুপলু জিজ্ঞেস করল, ‘ওর হাত কই? ওর পা কই?’
ততক্ষণে ইয়াসিন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ ইয়াসিন বলল, ‘জলের মধ্যে যারা থাকে, তাদের হাতও থাকে না, পা-ও থাকে না! মাছেদের কি হাত-পা থাকে?’
পুপলু বলল, ‘ও তো মাছ নয়! ওর গায়ে তো আঁশ নেই৷’
একজন লোক বললেন, ‘খোকা, শিং মাছেরও তো আঁশ থাকে না৷ অনেক মাছেরই আঁশ থাকে না৷’
কিন্তু পুপলুর কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল না যে ওটা একটা মাছ৷ মাছ কখনও তোশকের মতো দেখতে হয়?
ইয়াসিনকে পুপলু চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়াসিন দাদা, ওটা কী?’
ইয়াসিন ফিসফিস করে বলল, ‘ওটা হচ্ছে সমুদ্রের রাজার ছেলে৷ তোমাকে সেই সমুদ্রের রাজার গল্প বলেছিলুম না? সেই রাজার ছেলে৷’
পুপলু চিন্তিতভাবে বলল, ‘তা হলে কী হবে? ওর মা-বাবা কাঁদবে না? ওকে সমুদ্দরে ফেরত দিতে বলো!’
ইয়াসিন বলল, ‘ও তো মরে গেছে৷ আর যেতে পারবে না৷’
পুপলু বলল, ‘ওই তো নড়ছে! মরে যায়নি তো!’
ইয়াসিন বলল, ‘একটু একটু বেঁচে আছে মাত্তর৷ ওতে কি আর গভীর সমুদ্রে যাওয়া যায়! থাকগে, সমুদ্রের রাজার অনেক ছেলে আছে—একটা মরে গেলে কিছু হবে না৷’
এই সময় দুজন জেলে দুটো ছুরি নিয়ে এল৷ তারপর পড়পড় করে ছুরি দিয়ে কাটতে লাগল সেই প্রাণীটাকে৷ গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত৷
পুপলু ভয় পেয়ে শিউরে উঠে চেপে ধরল ইয়াসিনের হাত৷ আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা ওকে কাটছে কেন?’
ইয়াসিন বলল, ‘এতবড়ো প্রাণীটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া তো অসুবিধে৷ তাই টুকরো টুকরো করে নিয়ে যাচ্ছে৷’
পুপলু জিজ্ঞেস করল, ‘ওর লাগছে না?’
পাশ থেকে একজন লোক হেসে ফেলে বললেন, ‘হ্যাঁ খোকা, ওর খুব লাগছে৷ ভীষণ লাগছে! কী হবে?’
পুপলু ইয়াসিনকে বলল, ‘চলো, আমি হোটেলে যাব৷’
ইয়াসিন বলল, ‘দাঁড়াও৷ এক্ষুনি কী—এই তো এলে৷’
পুপলু বলল, ‘না, এক্ষুনি যাব৷ চলো৷ চলো না৷’
পুপলুর আর দেরি সইছে না৷ এই ঘটনাটা বাবা আর মাকে বলার জন্য ছটফট করছে! আবার লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়োল হোটেলের দিকে৷ অন্যসময় সে সমুদ্রের পারে এলেই কিছুক্ষণ ধরে কাদাখোঁচা পাখিগুলোকে তাড়া করে৷ এখন তা-ও ভুলে গেল৷
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেই চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বলল, ‘মা, কি দেখলাম জানো! মা…’
বাবা বই থেকে মুখ তুলে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দেখলে?’
পুপলুর চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করছে৷ উত্তেজনায় কথা বেরুচ্ছে না৷ একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘ওরা না…ওরা সমুদ্দরের রাজার ছেলেকে ধরে এনেছে৷ এই অ্যাত্ত বড়ো৷ ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে কাটল৷’
বাবা হেসে বললেন, ‘তাই নাকি? সমুদ্রের রাজার ছেলে? তা হলে তো সাংঘাতিক ব্যাপার!’ এই বলেই বাবা গল্প শোনায় আর কোনো উৎসাহ দেখালেন না৷ আবার বই পড়তে লাগলেন৷ মা উল বুনতে বুনতে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ধ্যাৎ, পাগল ছেলে৷ খুব তো রোদ্দুরে ঘোরা হল, এখন ঘুমিয়ে পড়ো তো৷’
পুপলুর খুব দুঃখ হল৷ এখন কি কেউ ঘুমোবার কথা বলে? এইরকম একটা জিনিস দেখে এল সে, তারপরেই ঘুমোবার কথা৷ বড়োরা এরকম অদ্ভুত কেন! কত সব ভালো ভালো জিনিস তারা ইচ্ছে করে দেখে না৷ দেখলেও অবাক হয় না!
পুপলু আজ চোখ বুজে শুয়ে থাকবে, কিছুতেই ঘুমোবে না৷
—