1 of 2

পুনশ্চ

পুনশ্চ

বিজু বলল—আমি যাচ্ছি না।

সুচেতা বিজুর থুতনিতে আঙুল ছুঁইয়ে ঠোঁটে ঠেকিয়ে চুক করে শব্দ করে বলল—এসো। দেরি কোরো না। টিফিন খেয়ো। জলের বোতল নিয়েছ তো ভরে।

বিজু বিরক্ত হয়ে বলে—আজ ম্যাচ আছে। বোতল-টোতল কেন একগাদা দিলে? কত বই, টিফিন বাক্স! রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় আমি গাধার মতো মোট বয়ে নিয়ে যাই।

—দূর পাগল! সবই কাজে লাগে। কিচ্ছু ফেলনা নয়।

—একদিন সব হারিয়ে আসব দেখো।

ছেলের লম্বাটে ছিমছাম চেহারা, সতেজ মুখের দিকে চেয়ে সুচেতা কয়েক পলক মুগ্ধ থাকে। এই তার রক্তের ডেলা, তার আপন সৃষ্টি, তার গাছের মহার্ঘ ফল। ফের ভাবে, নজর লাগল বুঝি।

তাই বিজুর বাঁ-হাত টেনে নিয়ে দাঁতে একটু কামড়ে গায়ে থুথুঃ করে বলে—সাবধানে যাবে। খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়ো না।

বিজু পিঠে ব্যাগ নেয়, কাঁধে বোতল ঝোলায়। তারপর বুটের শব্দ তুলে সতেজ পায়ে বেরিয়ে যায়।

.

২.

সারাদিন হাওয়া বয় তিনতলার ঘরদোরে। খুব হাওয়া। টুকটাক কাজ আর সুচেতনার শেষ হতে চায় না। কোলের মেয়েটা জ্বালায় বড়। হাম হয়েছে। সারা বাড়ি হামা টেনে বেড়াচ্ছে। মেঝেয় পেচ্ছাপ করে সেই জলে থাপুর-থুপুর করে দুই হাতে।

—এই রে! দেখেছ! বলে উনুন থেকে কড়া নামিয়ে রেখে সুচেতা ছুটে যায়। হামে যদি ঠান্ডা লাগে তবে বিপদ। অরুন্ধতীর ছেলেটা হাম বসে মরতে চলেছিল।

মেয়েকে কোলে নিয়ে আঁচলে তার হাত-পা মোছায়, জাঙিয়া পালটে দেয়। পেচ্ছাপের জায়গাটা মোছে। মেয়েকে খেলা দিয়ে আবার গিয়ে চাপড়ঘণ্টের কড়া চাপায়।

এইভাবেই যৌবন শেষ হয়ে আসে বুঝি। এই তিনতলার ঘরে সংসারে আবদ্ধ জীবন। বেড়ানো, খেলানো নেই, কলেজ জীবনের আড্ডা নেই, রোমাঞ্চ নেই।

শমীক সন্ধে পার করে এল।

–সুচেতা তাকে চা দিয়ে কাছে বসে বলল কী ভেবেছ বলো তো?

–কী ভাবলাম? শমীকের ভীতু গলায় জবাব।

—এইভাবে আমাকে নিঙড়ে শেষ করবে? এর চেয়ে যে ঝি-গিরি অনেক সৎমানের। খাটাচ্ছ, কিন্তু শখ-আহ্লাদও পূর্ণ করবে তো। স্বার্থপর কেন বলো তো?

.

৩.

বিজু ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করে কলেজে ভরতি হল। মেয়ে চন্দনা সিক্স থেকে ফার্স্ট হচ্ছে। ভালো নাচে, গায়।

এক-আধদিন আজকাল শমীক বলে—বড্ড টায়ার্ড লাগে।

-কেন?

–কী জানি। লো প্রেসারটা তো আছেই।

—আমারও মাথা ঘোরে। হজম হয় না।

শমীক বলে—চলো তো দুজনেই ডাক্তারের কাছে যাই আজ।

পাড়ার চেনা ডাক্তার দুজনকেই দেখে বলেন—তেমন কিছু নয়। মিসেস চ্যাটার্জিকে নিয়ে একটু ঘুরে-টুরে আসুন কোথাও।

সুচেতা বলে—ওঁকে ভালো করে দেখুন।

—দেখেছি।

–কী?

—কিছু নয়। চল্লিশের পর শরীরে ক্ষয় শুরু হয়। এসব একটু-আধটু অসুবিধে এখন থেকে হবে। একটু এক্সারসাইজ দরকার।

সুচেতা ভাবল চল্লিশের ওপর? এই সেদিনও তার বরটি মাত্র চব্বিশের ছিল যে! হিসেবে অবশ্য তাই হয়। সে নিজেও আটত্রিশ ছুঁল।

.

৪.

বরপক্ষ চন্দনাকে একবারে পছন্দ করল।

ছেলের বাবা বললেন-দেনা-পাওনার কথা ওঠে না। যা দেওয়ার মেয়েকে দেবেন। ছেলের কিছু চাই না, শুধু লক্ষ্মীমন্ত বউ চাই।

শমীক অলক্ষে সুচেতার দিকে তাকায়। সুচেতার মুখেচোখে মেয়ের জন্য অহংকার। শমীক অতটা খুশি নয়। মেয়ে তার প্রাণ। মেয়ের বিয়ে হলে থাকবে কী করে?

রাত্রিবেলা শুয়ে জনান্তিকে সুচেতাকে বলল—তুমি তো বিয়ের নামে টগবগ করছ। আমি থাকব কী করে?

—আমিও তো মা।

—আমার বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছে।

—টাকার কথা ভাবছ?

—সে ভাবনাও আছে। কিন্তু চন্দিকে ছেড়ে থাকা।

–ভেবো না। সয়ে যাবে।

–মেয়েরা বড় নিষ্ঠুর।

—মেয়েরা নয়, তোমরাই। আমাকে যখন আমার বাপ-মা’র কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলে তখন এত মায়া কোথায় ছিল?

শমীক চুপ করে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে বলে–কিন্তু চন্দির কথা আলাদা।

–সকলের কাছেই নিজের মেয়ে আলাদা।

—তুমি হার্টলেস।

–জানোই তো।

শমীক ঘুমোল। কিন্তু সুচেতা জেগে রইল। একবার উঠে গিয়ে পাশের ঘরে ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখে এল। মাঝরাতে নীরবে চোখের জল ফেলল কিছুক্ষণ। বিজু বিদেশে। মেয়েও চলল শ্বশুরঘর।

.

৫.

বাথরুম থেকে ঘরে আসতে পারছিল না শমীক। কী দূর হয়ে গেছে ঘর! কত দূর! তার গলার স্বর পৌঁছোয় না ঘরে সুচেতার কাছে। তবু সে প্রাণপণে ডাকে—সুচেতা! ডাকটা ফোটে না। অস্ফুট গোঙানির শব্দ হয়।

শেষ রাতে সুচেতা টের পেল, শমীক বিছানায় নেই। অনেকক্ষণ নেই। চমকে ওঠে বুক। বয়সটা ভালো নয় তো! উঠে সে স্বামীকে খোঁজে।

বাথরুমে যখন খুঁজে পায় তখন শমীকের জ্ঞান নেই। গোঁ-গোঁ শব্দ করছে। হাত পায়ে খিচুনি।

ডাক্তার বলল—মাইলড স্ট্রোক। এরপর থেকে কিন্তু খুব সাবধান।

খবর পেয়ে দুর্গাপুর থেকে কর্মব্যস্ত বিজু এল। মুখ থমথমে, গম্ভীর।

চন্দনা এল তার তিন বছর দু-মাসের দুই বাচ্চাকে নিয়ে। বাবার শিয়রে বসে রইল ভাইবোনে। সুচেতা নাতি-নাতনি সামলাতে লাগল।

শমীক বলল–তোরা অমন ভেঙে পড়িস না। আমি এখন ভালো আছি।

চন্দনা কাঁদতে থাকে। বিজু ছুটি বাড়ানোর দরখাস্ত পাঠায়।

শমীক সেরে ওঠে।

যাওয়ার আগে বিজু একদিন আড়ালে মাকে বলে—সবসময় তো বিয়ে-বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছ। ভালো পাত্রী পেয়েছ তো বলো করে ফেলি।

—তিন-তিনটে হাতে রেখেছি। এবারই দেখে পাকা কথা দিয়ে যা।

বিজু খুব লাজুক স্বরে বলল—আর-একটা দেখা তো আছে, বলো তো তোমাদের দেখিয়ে দিই।

—ওমা! তাই বলি–বলে সুচেতার গালে হাত।

.

৬.

বিরক্ত হয়ে শমীক বলল—সবই কি আর মনের মতো হয়? মানিয়ে নিতে হবে।

সুচেতা বলে—তুমি পুরুষমানুষ, আত্মভোলা শিবের জাত। মানিয়ে নিতে পারো। মেয়েরা পারে না।

শমীক মৃদু হেসে বলে—পারো না কেন? মেয়েরা বড় জেলাস, কারও সঙ্গে কারও বনে না। ছেলের বউ তো শাশুড়ির চিরকালের শত্রু।

—না মশাই, আমি আমার শাশুড়ির শত্রু ছিলাম না। তুমি কি ভাবো তোমার ছেলে যে বউটি ঘরে এনেছে সে আমার নখের যুগ্যি?

—তা বলছিনা।

—তাই বলছ। জানো না বলেই বলছ। অত দেমাক কীসের ওর? গায়ের রংটা একটু কটা আর এম-এ পাস যোগ্যতা তো এটুকুই। এম-এ পাস নই বলে আমরাও কম যাই নাকি?

—ওই তো জেলাসির কথা। তোমাকে কম কে বলছে?

—অনেকে হয়তো ভাবে। তুমিও বউকে আশকারা দাও, বউকে কিছু বললে ছেলেরও মুখ ভার। না বাপু, দুর্গাপুরে আর নয়। কলকাতা চলো। ছেলের সংসারে ঢের হয়েছে।

.

৭.

জামাই রবীনের পাতে আরও একটু মুরগি দিয়ে সুচেতা হাসিমাখা মুখে বলে—বলছেই না যখন–

রবীন মুখ তুলল না। চিন্তিতভাবে চুপ করে রইল।

চন্দনা টেবিলের অন্য ধার থেকে বলে—বলবে কী করে? একা ওই-ই তো সংসারের সব খরচ চালায়। ভাইরা কিছু দেয় নাকি? যাও বা দেয় শাশুড়ি তা ব্যাংকে জমা করেন। বড় ছেলেই চক্ষুশূল।

শমীক এসব কথা পছন্দ করে না। সে প্রাচীনপন্থী মুখখানা বিভীষণ করে খাচ্ছিল। অর্ধেক খেয়ে উঠে গেল কিছু না বলে।

সুচেতা লক্ষ করে ব্যাপারটা। তবু মেয়ের স্বার্থ তাকে তো দেখতেই হবে। সে মৃদুস্বরে বলে— সংসারের শান্তি চাইলে কিছু অপ্রিয় কাজও করতে হয়। আমি বলি কি, একটা আলাদা বাসা করে চলে এসো তোমরা। আমার কাছাকাছি চলে এসো, ছেলেমেয়ে আমিও দেখতে পারব’খন।

রবীন জবাব দেয় না। কিন্তু কথাটা ভাবে।

চন্দনা বলে—আমিও তো কবে থেকে তাই ভাবছি। ও কেবল বাপ মায়ের কর্তব্যের নামে থাকতে চায়।

সুচেতা বলল-কর্তব্য দূরে থেকেও করা যায়! বরং বেশিই করা যায়। থোক টাকা দেবে মাসে-মাসে।

রবীন একবার চন্দনার দিকে রাগ-চোখে চায়। কিছু বাদে সে-ও প্রায় ভরা পাত ফেলে ওঠে।

রাতে শমীক সুচেতাকে বলে—এসব প্রশ্রয় দিচ্ছ! পরে ভুগবে।

—আহা, কী কথা! জামাই তার সব রোজগার সংসারে ঢালছে, মেয়েটার ভবিষ্যৎ নেই? দুটো পয়সা রাখতে পারছে না।

শমীক রাগ করে পাশ ফিরে শোয়।

.

৮.

মস্ত প্রোমোশন পেয়ে বিজু বদলি হয়েছে। কলকাতায়। বউ হাসনু আর দুই ছেলেমেয়ে হইহই করে এসে হাজির হল একদিন।

সুচেতার আনন্দ ধরে না। শমীকের গম্ভীর মুখে খুশির বেলুন ফাটল।

সুচেতা বলল—বলতে নেই বউমা, তোমার শরীরটা একটু সেরেছে। বিয়ের সময় যা রোগা ছিলে!

–দুর্গাপুরের জল ভালো মা।

–কলকাতায় এলে তো। এবার বুঝবে।

—তা হোক মা, দুর্গাপুরে লাইফ নেই। এখানে কত লোকজন, আলো। ওখানে যেন মৃত্যুপুরী। কতদিন থেকে আসব-আসব করছি।

খুব সাবধানে সুচেতা জিগ্যেস করে—এ-বাড়িতেই থাকবে তো! নাকি–?

হাসনু মাথা নত করে বলে—ওকে তো অফিস থেকে আলাদা ফ্ল্যাট দেবে।

সুচেতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হাসনু বলে—ওর অবশ্য আপনাদের কাছেই থাকার ইচ্ছে।

—শুধু ওর ইচ্ছেয় তো হওয়ার নয় মা, তোমারও ইচ্ছে থাকা চাই।

হাসনু জবাব দেয় না।

.

৯.

পরদার আড়াল থেকে সুচেতা শুনল, হাসনু বিজুকে বলছে—অফিসের ফ্ল্যাটের কী হল?

—নিচ্ছি না। এই তো বেশ আছি। মা-বাবার কাছে। ছেলে-মেয়ে দুটো দাদু-ঠানু বলতে অস্থির।

বাইরে থেকে তো ভালোই লাগছে। এদিকে যে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। চন্দনা আর রবীন কাছেই ফ্ল্যাট নিয়েছে, রোজ আসে।

—তাতে কী?

–কী আবার। মায়ে মেয়েতে দিনরাত গুজগুজ ফুসফুস। কী বলে কে জানে! বিয়ের পর মেয়েদের বাপের বাড়ির সঙ্গে অত মাখামাখি কেন থাকবে? ওর বরটাও ম্যাদাটে মার্কা। শ্বশুরবাড়ি বলতে অজ্ঞান।

–বাদ দাও।

—কেন বাদ দেব? অশান্তির শুরু এইভাবেই হয়। আমি কিছুতেই এখানে থাকব না। তুমি ফ্ল্যাটে চলো৷ মাসে-মাসে বরং থোক টাকা দিও।

—মা-বাবা যে বড় একলা হয়ে পড়বেন।

—সে ভাবতে হবে না। মেয়ে কাছে এসে উঠেছে। একলা কীসের? বরাবরই দেখেছি মার টান তোমার চেয়ে চন্দনার ওপর বেশি। আমার ছেলেমেয়েদের চাইতে চন্দনার ছেলেমেয়েরা এ বাড়িতে ঢের বেশি আদর পায়।

–যাঃ, ও তোমার মনের ভুল।

—আমি খুকি নই। তুমি স্নেহে অন্ধ বলে দেখতে পাও না। নইলে ব্যাপারটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।

আড়ালে সুচেতা চোখের জল মোছে। ওরা থাকবে না।

.

১০.

জয় বলল—আমি যাচ্ছি মা।

হাসনু জয়ের মাথাটা দুহাতে ধরে একটু আদর করে বলল—এসো গিয়ে। টিফিন খেয়ে কিন্তু। ওয়াটার বটলটা ভুলে যেও না।

জয় বিরক্ত হয়ে বলে—নিয়েছি নিয়েছি।

হাসনু ছেলের লম্বাটে ছিপছিপে চেহারাটা একটু দূর থেকে দেখে। মুখখানায় বুদ্ধির ঝিকিমিকি। দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ খেয়াল হয়, ওরকমভাবে দেখতে নেই। আজকাল সে এসব সংস্কার মানে। ছেলের চোখের আড়ালে সে একটু হাতজোড় করে ঠাকুরের কাছে মনে-মনে প্রার্থনা করে—ভালো রেখো।

বিজু অফিসে, জয় স্কুলে। মেয়েটা এক মনে ছবি আঁকে। আবোল-তাবোল ছবি। জ্বর থেকে সদ্য উঠেছে।

হাসনু মেয়েকে বলে—ধিয়া, দুধ খেলি না?

–না। বমি পায়।

সারাদিন হাসনুর কাজের শেষ নেই। কিছুই তাকে নিজের হাতে করতে হয় না। আয়া, চাকর, রাঁধুনি আছে। তবু সবদিকে চোখ রাখতে হয়। সারা বাড়ি ছুটতে হয়।

সন্ধে পার করে বিজু এল। হাসনু তার মুখোমুখি বসে বলে–কী ভেবেছ? বলো তো!

—এরকম ডাল সন্ধে কাটানো যায়? এর চেয়ে ঝি-গিরি ভালো ছিল। তোমার সংসার দেখছি, আমারও তো কিছু সাধ আহ্লাদ তোমাকে দেখতে হবে!

1 Comment
Collapse Comments

অনন্য বাস্তব চরিত্রায়ন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *