পুনর্জন্ম
গভীর বনে শুয়ে ছিলেন খাইরুল। মাথার ওপরে গাছের শাখা-প্রশাখাগুলো ওপরে উঠে আকাশ স্পর্শ করেছে। ওপরে কালো আকাশ। রাতের আকাশ। আকাশে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে সূর্য। একটা শীতল বাতাস বয়ে গেল। খাইরুল দুই হাতে নিজের শরীর আবৃত করতে চাইলেন। পারলেন না। হাত-পা’গুলো সাদা সাদা সাথে জড়িয়ে ধরতে শুরু করেছে। ধরুক। খাইরুল সূর্যের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকলেন। শীতের ভেতরেই তিনি আজ শুয়ে থাকবেন। শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করবেন!
হঠাৎ গাছগুলো গম গম কথা বলতে শুরু করল, “ছার। ছার আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? ওই দেখি টর্চ সরা। আরেটটু ব্যান্ডেজ দে। একটা কম্বল নিয়ে আয় আর এটা। ছার, ও ছার।”
গাছগুলো তাকে স্যার বলে কেন ডাকছে? তিনি তো আর স্যার নেই। তিনি এখন সাধারণ একজন মানুষ। চাকরিবাকরিহীন এক বেকার যুবক। তাহলে গাছগুলো কেন তাকে স্যার ডাকবে? আকাশ থেকে সূর্যটা সরে গেল। সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। খাইরুল চেতনা ফিরে পেতেই নিজেকে আবিষ্কার করলেন একটা ছোট লোহার খাটের ওপরে। তাকে ঘিরে তিনটা মানুষ। তাদের একজন একটু পর পর টর্চের আলো ফেলছে তার চোখে। আরেকজন বলল, “ওই টর্চ মারিস না আর। জ্ঞান ফিরছে। ছার। আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আমি তালেব। তালেব মাস্টার। আমার কথা শুনতে পাইলে পলক ফেলেন।”
খাইরুল সাহেবের কণ্ঠনালী কেঁপে উঠল, “শুনতে পাচ্ছি।”
“আমাকে চিনছেন ছার?’ লোকটা আবার প্রশ্ন করল।
খাইরুল মনে করার চেষ্টা করলেন এই নামে কাউকে চেনেন কিনা। মাথার ভেতরে একটা চাপা ব্যথা। সব কিছু ঘোলাটে মনে হল। বেশ কিছুক্ষণ পরে খাইরুল সাহেবের মনে পড়ল, অটোচালক সমিতির সভাপতি তালেব মাস্টারের কথা। তিনি খুব কষ্ট করে বললেন, “হ্যাঁ চিনতে পারছি।”
“মাশাল্লাহ। ছার আমারে চিনছেন!” লোকটা বলল। কণ্ঠ শুনে মনে হল খাইরুল তাকে চিনতে পারায় লোকটা ভীষণ খুশি হয়েছেন। লোকটা একটা লোহার টুল টেনে খাইরুলের খাটের পাশে বসল। একজন একটা কম্বল এনে খাইরুলের গায়ে দিয়ে দিল। তারপর তালেব দুজনকে ইশারা করতেই দুজন বেরিয়ে গেল। খাইরুল মাথা তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে একটা তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠলেন। তালেব মাস্টার বলল, “আরে আরে আরে শোন শোন। শুয়ে থাকেন। চিন্তার কোন কারণ নাই। এইটা আমার গ্যারেজ। আলো ফুটলেই আপনারে হাসপাতালে নিয়ে যাব। উঠবেন না একদম উঠবেন না। কিছু লাগলে আমারে বলবেন।”
খাইরুল দেখলেন একটু দূরেই সিলিং-এ একটা অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। সেটাকে ঘিরে পোকা উড়ছে। ঐটুকু জায়গা বাদে সম্পূর্ণ ঘরটাই অন্ধকার। তার প্রায় সারা শরীরেই সাদা ব্যান্ডেজ মোড়ানো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কটা বাজে?”
তালেব মাস্টার বলল, “ভোর চারটা ছার। ছার, মতি নগরে ক্যান গেছিলেন ছার? আপনি ওই জাহান্নামে কী করতে গেছিলেন? আপনে জানেন ওইখানে কারা যায়? আমি তো আপনাকে রিং-এ দেইখেই চিক্কুর দিছি। আরেকটু হইলে তো জিন্দা বারাইতে পারতেন না। ঘা শুকানোর জায়গা ওইটা না ছার। ঘা শুকানের জায়গায় যাইতে চাইতেন তো আমারে বলতেন।”
খাইরুলের মনে পড়ল সেই সাদা মুখোশ পরিহিত যমদুতের কথা। ওটা তাহলে তালেব ছিল। তিনি বললেন, “পানি খাব তালেব।” তালেব ব্যস্ত হয়ে অন্ধকারের ভেতরে কোথা থেকে যেন পানি আনল। এক হাতে খাইরুলের মাথাটা তুলে ধরে ঠোঁটের কাছে পানির গ্লাস ধরতেই খাইরুল ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নিলেন। ভেতরটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।
তালেব বলল, “ছার, একজন আপনার সাথে দেখা করতে চায়। আপনি ভালো বোধ করলে তারে আসতে বলি? বলতেছে খুব আর্জেন্ট।”
“কে?”
“নাম বলে নাই আমাকে। বলছে আপনার সাথেই শুধু কথা বলবে। আসতে বলি? আপনি কোন কথা বলবেন না কিন্তু। শুধু শোনবেন। কথা বললে আবার রক্ত বেরানে শুরু হবে।”
“আসতে বল।”
তালেব মাথা নেড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। খাইরুল একটা মিষ্টি গন্ধ পেলেন। মশার কয়েলের গন্ধ সম্ভবত। তালেব কি জানে যে তিনি আর ওসি নেই? ইস্তফা দিয়ে এসেছেন। তালেব যদি না জানে তাহলে তাকে জানাতে হবে। যে শুধু চেয়ারকে স্যালুট করে তার স্যালুটের দরকার নেই। খাইরুল নিজের এই ধরনের চিন্তায় নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। একটা মানুষ তার জীবন বাঁচিয়েছে। কোথায় তিনি তার প্রতি কৃতজ্ঞ হবেন তা না করে তিনি এখনও তার আত্মসম্মানবোধ নিয়ে পড়ে আছেন!
দরজা খুলে একটা লোক প্রবেশ করল। আবছা আলোয় লোকটাকে চিনতে খাইরুল সাহেবের এতটুকু অসুবিধা হল না। এই সেই প্রতিপক্ষ। যার হাতে আর একটু হলেই খাইরুল নিজের জীবনটা খুইয়ে বসতেন। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, তালেব তাকে ফাঁদে ফেলেছে। খাইরুল শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। পারলেন না! প্রচণ্ড ব্যথায় আবার বিছানায় পড়ে গেলেন। একটা বোবা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করতে শুরু করল। লোকটা এগিয়ে আসছে। অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না।
লোকটা স্বাভাবিকভাবেই লোহার টুল টেনে বসলেন। বললেন, “আমার নাম শংকর। শংকর সাহা। সাবেক জেলসুপার। অস্থির হবেন না খাইরুল। রিঙে যা হয়েছে তার জন্য আমি খুব দুঃখিত। পুরো ঘটনাটা শুনলে আপনি হয়ত আমাকে ক্ষমা করে দিতেও পারেন।”