পুনরুজ্জীবন – ডান্নি প্লাচটা
গ্রাহাম ক্রাকেন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। বিস্ফারিত নেত্ৰদুটি অস্পষ্ট আবছা, সিলিং পানে গ্রী নিবন্ধ। মনে হয় যেন কত দূর। মনে মনে আশ্বাসবাণীগুলো ঘুরে ফিরে আসছে।
–সব সম্ভাবনাই কিন্তু আপনার অনুকূলে। ডাক্তারের কণ্ঠে আশ্বাসবাণী।
অসাড় দেহটার নিচে শয্যাটা বড় শক্ত মনে হল। স্প্রিংগুলো কি নমনীয়তা হারাল? হালকা মেঘের মতো ভাবনাটা ক্রাকেনের মনে উদয় হল।
ডাক্তার আবার কথা বলে উঠলেন। মনে হল যেন বহুদূর থেকে মধুর কোনও ধ্বনি ভেসে এল।
কোনও একদিন চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হবে… মরণ ঘুম থেকে আপনাকে ফিরিয়ে আনার কোনও সমস্যা থাকবে না। আপনার হিমায়িত দেহের কিন্তু কোনও ক্ষতি হবে না। তারপর একদিন বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আপনার ঘুম ভাঙবে… দুরারোগ্য অসুখও সেরে যাবে… আবার আপনি পুরোনো জীবনে ফিরে যাবেন। উঃ, ডাক্তারের কথা তো নয়। ঠিক যেন অমৃত- মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে পুনরুজ্জীবনের আশ্বাস যেন অমৃত… মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে পুনরুজ্জীবনের আশ্বাস যেন শুষ্ক তপ্ত মরুর বুকে টলটলে এক দীঘি।
গভীর শান্তির মধ্যে গ্রাহাম চিরনিদ্রায় ঢলে পড়লেন। মৃতদেহও হিমায়িত হল বিজ্ঞানসম্মতভাবে।
***
মিয়ামির সাগরবেলার স্বপ্নের ঘুম ভাঙল। চোখ মেললেন গ্রাহাম। চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হলেও অস্পষ্ট আলোয় চোখ দুটো পিটপিট করে উঠল। দৃষ্টি স্বচ্ছ হলে দেখলেন বিছানার পাশে এক অপরিচিত ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন।
–সুপ্রভাত। শুভেচ্ছা জানালেন ভদ্রলোক।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর গ্রাহাম দেখলেন ভদ্রলোকের বেশ বয়স হয়েছে। মাথাজোড়া টাক। সহাস্য মুখমণ্ডল। কিন্তু কানের লতিতে দু’দুটো তারাফুল।
-সত্যি, কানের ফুলগুলো কিন্তু বেশ চমৎকার।
-–ধন্যবাদ। তবে ওগুলো অ্যান্টেনা…
-তাই নাকি?
–কানের লতিতে ট্রানজিস্টার রেডিয়ো পোরা আছে।
–সত্যি!
–হ্যাঁ… স্টিরিয়ো
–বাঃ.. কী চমৎকার! কিন্তু বন্ধ করেন কী করে?
–না না… এত কথা বলবেন না প্লীজ।
আমার ভুল হয়ে গেছে… বুঝতে পারিনি। কয়েক মিনিট বিরতি। দুই চোখ বুজে কী যেন চিন্তা করলেন।
–কিন্তু ওরা কি কিছু করছে? জানেন কিছু?
–হ্যাঁ… করেছিল। কিন্তু আশা দিতে পারেনি।
–নানান মুনির নানান মত নিশ্চয়!
–হ্যাঁ, আমার তো সেইরকমই মনে হয়।
–তাহলে? হতাশায় মন ভরে উঠল। পুরু পর্দাটানা জানালার দিকে মুখ ফেরালেন গ্রাহাম। পরক্ষণেই ঝনঝন করে উঠল জানালার কাঁচগুলো।
–কী হল? দাঙ্গা বাধল? সভয়ে প্রশ্ন করলেন গ্রাহাম।
–না না… সুপারসনিক পরিবহন বিমানের শব্দ! কয়েক মিনিট পরে আবার সেই ঝনঝনানি।
-–এখন দেখি অনেক সুপারসনিক ওড়ে।
–তা যা বলেছেন… সুপারসনিকের যুগ এটা। হরদম উঠছে আর নামছে।
-–আচ্ছা এখন কোন সাল? প্রশ্ন করলেন গ্রাহাম।
–২৮০০ সাল।
–তাহলে বেশ কয়েক শতাব্দী পার করে দিলাম।
–তা যা বলেছেন। সহাস্যমুখে বললেন ভদ্রলোক।
-–আচ্ছা, অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন এখন? আমার জমিদারি থেকে নিয়মিত টাকা আসছে তো? অনেক প্রশ্নই ভিড় করে আসছে গ্রাহামের মনে।
–আমি দুঃখিত মি. গ্রাহাম… জমিদারি আর নেই। টাকাপয়সার ব্যাপার জানি না। তবে আমি আমার পয়সা খরচা করেই আপনার ঘুম ভাঙিয়েছি। সে-ও অনেক টাকা।
–আপনার টাকায় বেঁচে উঠেছি। আপনার মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ। ভাববিহ্বল কণ্ঠে বললেন গ্রাহাম। পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মি তো ঘরে ঢুকে পড়েছে। জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা।
কনুই-এ ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলেন গ্রাহাম। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণায় অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল।
–আরে আরে করেন কী? নড়াচড়া করে বিপদ ডেকে আনবেন না প্লীজ। হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের আগে রুগির শারীরিক মানসিক সুস্থ থাকা একান্তই জরুরি।
–হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট! আমার হার্টের কি কোনও দোষ ধরা পড়েছে? বিছানায় শুয়ে পড়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন গ্রাহাম।
এইবার আগন্তুক ভদ্রলোক বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নির্নিমেষ নয়নে কয়েক মুহূর্ত ওঁর দিকে তাকিয়ে বললেন– না না… আপনার হার্ট খুব ভালো আছে। আর সেইজন্যেই তো বেছে বেছে আপনাকেই জাগিয়ে তুলেছি। আমার হার্টটাই খারাপ।