পুনরপি প্রাচ্য

পুনরপি প্রাচ্য

আর রসিকতা না। এবারে আমাকে সিরিয়স হতে হবে। স্বৰ্গত প্রমথ চৌধুরীও প্রতি বছরে এই শপথ নিতেন এবং সে-লিখিত শপথের কালি শুকোতে না-শুকোতেই সেটি পরমানন্দে ভঙ্গ করতেন। আমি সেই মহাজনপন্থাই অবলম্বন করছি।

প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলনে কী-সব সমস্যা কী-সব বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার কিছু কিছু বিবরণ খবরের কাগজে বেরিয়েছে এবং কয়েকদিন পূর্বে হিন্দুস্থান স্ট্যানডারডের সম্পাদক মহাশয় সে সম্বন্ধে একটি সুচিন্তিত তথা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। কিন্তু যেসব বিষয়বস্তু কনফারেনসে আলোচিত হয়নি সে-সংবাদ জানব কী প্রকারে? তাই আমার মনে দুটি সমস্যা জেগেছে। এ-দুটি নতুন নয়। আমার জীবনে প্রথম এবং শেষ প্রাচ্যবিদ্যাসম্মেলনে আমি যাই তিরুঅনন্তপুরমে বরদা সরকারের প্রতিভূরূপে ত্রিশ দশকের মাঝামাঝি। সেই থেকে।

প্রথম : এই যে গত কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপীয়রা এশিয়াতে রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন– ইংরেজ ফরাসি অস্ট্রিয়ান ডাচ পর্তুগিজ ইত্যাদি ইত্যাদি– এদের মহাফেজখানাতে (আর্কাইভে) বিস্তর দলিলপত্র রয়েছে। এগুলোর সাহায্য বিনা ভারতের গত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস সর্বাঙ্গসুন্দর হয় না। কিন্তু এসব দলিলদস্তাবেজ নিয়ে গবেষণা করে সেগুলোকে প্রকাশিত করাতে স্বভাবতই আজ এদের আর কোনও ইনটরেস্ট নেই। যতদূর মনে পড়ে, একমাত্র ডাচ সরকারই বছর কয়েক পূর্বে এ-কর্ম করার জন্য ভারতীয়দের আমন্ত্রণ জানান এবং দুটি ভালো স্কলারশিপ দিতে চান। এর ফল কী হয়েছে জানিনে। অতএব এসব ভিন্ন ভিন্ন দেশের মহাফেজখানার অমূল্য দলিলদস্তাবেজ নিয়ে গবেষণা করার দায়িত্ব আমাদেরই ভারতীয়দের। … এছাড়া এদের আরকাইভে আছে ভারতীয় ভাষার ব্যাকরণ, অভিধান, পাঠ্যপুস্তক, অনুবাদ ইত্যাদি। সেগুলোও মহামূল্যবান। কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ—না কী যেন নাম– অনেকেই জানেন।

দ্বিতীয় : এবং এইটেই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা। নমস্য প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবরা তো অগাধ গবেষণা করেছেন, যথা মহাভারত রামায়ণের প্রামাণিক পাঠ প্রকাশ করেছেন, করছেন এবং অন্যান্য শাস্ত্রাদির জন্যও ওই পদ্ধতিতে তৎপর। এ কর্মের প্রশংসা অজ্ঞ বিজ্ঞ তাবজ্জন করবেন। কিন্তু প্রশ্ন, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি যে প্রতিদিন ভারতীয়দের ইনটরেট কমে যাচ্ছে, সেটা ঠেকানো যায় কী প্রকারে? অর্থাৎ সংস্কৃত সাহিত্যের উত্তম উত্তম ধন মূল সংস্কৃতে যত না হোক, অনুবাদ মারফত কোন পদ্ধতিতে সাধারণজনের সামনে আকর্ষণীয়রূপে দিতে পারি? এক কথায় সংস্কৃত, অর্ধমাগধী, পালি, প্রাকৃত, সান্ধ্য ইত্যাদিতে লিখিত প্রকৃত হীরাজওহর পপুলারাইজ করি কী প্রকারে? তারা যে কলচরড পাল প্ল্যাসটিক চায়। এবং এটা না করতে পারলে যে প্রাচ্যবিদ্যা তথা প্রাচ্যবিদ্বজ্জনের মহতী বিনষ্টি হবে সে-বিষয়ে অন্তত আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই। কারণ, তুলনা দিয়ে বলি; জনগণ যেন দেশ-গাছের শিকড়, বিদ্বজ্জন ফুল। শিকড় যদি শুকিয়ে যায় তবে ফুলের, ফলের তো কথাই নেই, মরণ অনিবার্য।… যেমন আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নাভিশ্বাসের সময়ে আমাদের চৈতন্য হল এবং আমরা এখন সেটিকে পপুলারাইজ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা দিচ্ছি।

ইউরোপীয়দের ওই একই সমস্যা। আমরা যেমন সংস্কৃতাদি একাধিক সাহিত্যের ওপর এতকাল নির্ভর করে এসেছি, তারা করে দুটি সাহিত্যের ওপর– গ্রিক এবং লাতিন। এবং চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এ-ভাষাগুলোর পড়ুয়া দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিলেতের কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক-লাতিন শেখার জন্য প্রতি বছর পাঁচটি এমনই দিলদরাজ বৃত্তি দেয় যে, যে কোনও বৃত্তিধারী সে-অর্থে হস্টেলের খাইখরচা দিয়ে উত্তম বেশাদি পুস্তকাদি ক্রয় করার পর একাংশ দরিদ্র পিতামাতাকে পাঠাতে পারে। তথাপি, কাগজে পড়েছি, বছর তিনেক পূর্বে সেই পাঁচটি বৃত্তির জন্য মাত্র তিনটি ছাত্র দরখাস্ত পাঠায়!! বছর পঞ্চাশেক পূর্বে আসত দুশো!!

এবং এহ বাহ্য। জনসাধারণও গ্রিক-লাতিন সাহিত্যের অমূল্য অমূল্য সম্পদও ইংরেজি ফরাসি জর্মন অনুবাদে যথা যার দেশ– পড়তে চায় না। এই ইউরোপের বিদ্বজ্জন এসব সম্পদের নবীন নবীন অনুবাদ করেছেন দেশোপযোগী কালোপযোগী করে। এমনকি বাইবেলেরও।

আমাদের প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবরা এ-বিষয়ে কী করছেন?

আমার মনে হয় কবি কালিদাস বাঙালি। প্রমাণ? একমাত্র বাঙালিই যে-ডালে বসে আছে সেটা কাটে। কালিদাসও তাই করতেন। অতঃ কালিদাস বাঙালি। প্রাচ্যজ্ঞরা ডালটা কাটছেন বটে কিন্তু ডালটা যে শিকল্লেখিত রসাভাবে শুষ্ক হয়ে ভেঙে পড়ছে সেদিকে খেয়াল নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *