আমার বয়স ষাট। আমার পুত্র নিষাদের বয়স ষোল মাস। আমি ষাটটা বর্ষা দেখেছি, সে মাত্র দু’টি দেখেছে। জীবনের দু’প্রান্তে দু’জন দাঁড়িয়ে আছি। আমি শুনছি বিদায় সঙ্গীত, সে শুনছে আগমনী সঙ্গীত।
একজন লেখকের প্রধান কাজই হচ্ছে বিশেষভাবে দেখা। সেই দেখার বস্তু যদি নিজের পুত্র হয়, তাহলে তো পুরো ব্যাপারটা আরো বিশেষ হয় দাঁড়ায়। নিষাদের মা তার ছেলের জন্যে একটা বেবি বুক কিনেছে। সেখানে শিশুর বড় হওয়ার বিভিন্ন পর্ব লেখার ব্যবস্থা আছে। যেমন-
শিশুর প্রথম গড়াগড়ি খাওয়া
প্রথম নিজে নিজে উঠে বসা
প্রথম হামাগুড়ি
প্রথম দাঁড়ানো
সব মায়েরাই এই ধরনের বই কেনেন। শুরুর দিকে প্রতিটি ঘটনা আগ্রহ নিয়ে লেখেন। ছয় মাসের মধ্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। শিশু বুকে নতুন কিছু যুক্ত হয় না। আমি যেহেতু সবকিছু স্মৃতিতে ধরে রাখি, মাথার ভেতর আমার লেখা চলতেই থাকে। আমি গভীর আগ্রহে নিষাদকে দেখি। তার অনেক কর্মকাণ্ড আমার গল্প-উপন্যাসে চলে আসে। উদাহরণ দেই-
নিষাদ কথা বলতে শিখে প্রথম শব্দটা বলল- ‘কাক!’ এত শব্দ থাকতে ‘কাক’ কেন? রহস্য উদ্ধার হলো। সে কান্নাকাটি করলেই কাজের মেয়ে তাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় যায় এবং ‘কাক’ দেখিয়ে বলে।। ‘কাক! কাক!’ কাকরা উড়াউড়ি করে। শিশু মহানন্দ পায়। সে প্রথম শব্দ ‘কাক’ শিখবে এটাই তো স্বাভাবিক।
অন্যদিন পত্রিকায় ‘কাকারু’ নামে একটা গল্প লিখলাম। গল্পের শুরুটা-
আশরাফুদ্দিন কাঁটাবন পাখির দোকানে গিয়েছেন কাক কিনতে। তাঁর মেয়ে সুমির জন্মদিনে তিনি একটা ‘কাক’ উপহার দেবেন।
আশরাফুদ্দিন তাঁর মেয়েকে কাক উপহার দিতে চাচ্ছেন, কারণটা হলো আমার পুত্র নিষাদ। সুমিও নিষাদের মতো প্রথম শব্দ বলতে শেখে কাক।
নিষাদের আগেও আমার চারটি সন্তান চোখের সামনেই বড় হয়েছে। তবে তাদেরকে সেভাবে দেখা হয়নি। তখন শিক্ষকতা করি। টাকা-পয়সার বিরাট ঝামেলা। যখনই সময় পাই লেখালেখি করি। বাড়তি কিছু রোজগারের চেষ্টা। মাথা গুঁজে পরীক্ষার খাতা দেখি। সন্তানদের দিকে তাকাবার সময় কোথায়?
আজ আমার অনেক অবসর। ঘরকুনো গর্তজীবী টাইপ মানুষ বলেই ঘর থেকে বের হই না। নিষাদকে সব সময়ই চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখি। একটি শিশুর মানসিকতা তৈরি হবার প্রক্রিয়াটি দেখি। তার মানসিকতা গঠনের প্রক্রিয়ায় আমার ভূমিকা কি ঠিক আছে তা নিয়ে ভাবি। যে ভাবনা আমি অন্য সন্তানদের সময় ভাবতে পারিনি।
ভাবনার নমুনাটা বলি। নিষাদ কোথাও পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে ঐ জায়গাটাকে চড়-থাপ্পড় দিলে তার মুখে হাসি ফোটে। সে নিজেও চড়-থাপ্পড় দেয় এবং বলে- মার! মার!
একদিন মনে হলো, এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমরা কি ছেলেকে প্রতিশোধপরায়ণ হতে শেখাচ্ছি? সে যখন বড় হবে কেউ তাকে ব্যথা দিলে, সে কি শৈশবের শিক্ষা থেকে তাকে ব্যথা দিতে চাইবে? সেটা কি ঠিক হবে?
কেউ ব্যথা দিলেই প্রতিশোধ নেয়া যাবে না- এই তথ্য শেখালে সে যদি বড় হয়ে ভ্যাবদা টাইপ হয় তখন? মার খাবে, কিন্তু প্রতিবাদ করবে না। এটা তো আরো খারাপ।
কী করব বুঝতে না পেরে অস্থির লাগে।
প্রকৃতির সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়েও ঝামেলা। একদিন ঝুম বৃষ্টিতে তাকে ঘাড়ে নিয়ে ছাদে গেলাম। বৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মহানন্দে সে বৃষ্টিতে ভিজল। তার ফল হলো ভয়াবহ। প্রচণ্ড জ্বর, কাশি। ডাক্তার-হাসপাতাল ছোটাছুটি। নিষাদের মা ঘোষণা করল।। আমি শিশু পালনে অক্ষম। আমার কাছে কখনোই নিষাদকে ছাড়া যাবে না।
নিষাদের যে সব কর্মকাণ্ডে আমি আনন্দ পাই, তার মা পায় না। বরং সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়। একদিন দেখি, সে আমার সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছে। হাতে দেয়াশলাই-এর বাক্স। আমি হো হো করে হাসছি। তার মা রেগে অস্থির। সে কঠিন গলায় বলল, ঘরে সিগারেটের প্যাকেট থাকতে পারবে না। সিগারেট খাওয়া জন্মের মতো ছাড়তে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
একদিন শোবার ঘরে লেখালেখি করছি, হঠাৎ দেখি নিষাদ টয়লেটের দিকে রওনা হয়েছে। টয়লেটে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে শুরু করল কান্না। কিছুতেই সে দরজা খুলতে পারছে না। সে কাঁদছে, আমি কান্না শুনছি। নিজে উঠে গিয়ে দরজা খুলছি না। কান্না শুনে এক সময় তার মা এসে দরজা খুলে তাকে বের করল। আমাকে বলল, তুমি ওর কান্না শুনতে পাচ্ছিলে না?
আমি বললাম, অবশ্যই শুনতে পাচ্ছি। আমার সামনে দিয়েই তো সে বাথরুমে ঢুকল।
তাহলে দরজা খুলছিলে না কেন?
আমি বললাম, তোমার পুত্রের ধারণা এ বাসার সবাই সারাক্ষণ তাকে দেখে রাখছে। তার প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখছে। সত্যিকার পৃথিবী এমন না। সেখানে বিপদ আছে। সমস্যা আছে। আমি তাকে সমস্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
দয়া করে তুমি তাকে কোনো কিছুর সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেবে না। একটা অবোধ শিশু ভয় পেয়ে এতক্ষণ ধরে কাঁদছে, আর তুমি থিওরি কপচাচ্ছ!
আমি থিওরি ফলানো বন্ধ করে এখন শুধুই তার বড় হওয়া দেখছি।
তেলাপোকা দেখে একবার তাকে ভয়ে চিৎকার দিতে দেখলাম। আমি খুশি, ভয় নামক অনুভূতির সঙ্গে তার পরিচয় হলো।
পাশের বাসার তার সমবয়েসী অন্বয়কে একদিন সে ধাক্কা দিয়ে ফেলে খামচে ধরল। আমি খুশি, রাগ নামক বিষয়টি তৈরি হচ্ছে। ভেজিটেবল হয়ে কঠিন পৃথিবীতে সে টিকতে পারবে না।
ছোট্ট একটা মেয়ে বাসায় বেড়াতে এসেছে। মেয়েটির হাতে চকলেট। নিষাদ ছুটে গিয়ে মেয়েটির চকলেট কেড়ে নিয়ে মুখে দিয়ে ফেলল। পরের ধন আত্মসাৎ। এর প্রয়োজন কি আছে? বড় হয়ে নিষাদ যদি রাজনীতি করার কথা ভাবে তাহলে অবশ্যই প্রয়োজন আছে। আমি চাচ্ছি না সে ঐ পথে যাক। কাজেই তাকে হা করিয়ে মুখ থেকে চকলেট বের করে বলা হলো- ঘড়, ঘড়, ঘড়.
ছোট শিশু এবং কুকুর ছানাকে ‘না’ বলা হয় ইংরেজিতে। এর কারণ কী কে জানে।
একবার পুত্র নিষাদ আমাকে বড় ধরনের একটা শিক্ষা দিয়েছিল। সেই গল্প বলে ব্যক্তিগত উপাখ্যান শেষ করি।
আমি সিলেট থেকে মাইক্রোবাসে করে ফিরছি। সায়েদাবাদে এসে বিশাল জটে পড়ে গেলাম। সেটা কোনো সমস্যা না। ঘণ্টার পর ঘন্টা এক জায়গায় বসে থাকার অভ্যাস আমার আছে। সমস্যা অন্যখানে। নিষাদের দুধ শেষ। সে ক্ষুধার যন্ত্রণায় শুরু করেছে কান্না। বাসায় না পৌঁছানো পর্যন্ত তাকে দুধ দেয়া যাচ্ছে না। ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না বাবা-মা’র বুকে কীভাবে লাগে সেদিন প্রথম বুঝলাম। তার কান্না আমার কলিজার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে।
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম।
ঠিক এই সময় হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, ছোট্ট নিষাদ বাসায় গেলেই খাবার পাবে। তার খাবারের অভাব হবে না। কিন্তু এই দেশের অসংখ্য শিশু ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদে। তাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের কান্না দেখে কেমন লাগে তাদের বাবা-মা’র?
নিষাদের কথা না, ক্ষুধার্ত শিশুদের বাবা-মা’র কথা ভেবে হঠাৎ করেই আমার চোখে পানি এসে গেল। তাতে কী যায় আসে! ক্ষুধার্ত শিশুদের কাছে একজন মানুষের সাময়িক অশ্রুর মূল্য কী?