1 of 2

পুতলি বাই কী গোলি

পুতলি বাই কী গোলি

রমিতা খাটে বসে ছিল। জোড়াসনে। কোলের উপর জাপানি কাচের রেকাবিতে কদবেল মাখা নিয়ে। কাঁচালঙ্কা আর ধনেপাতা দিয়ে কদবেল মেখে, জম্পেস করে খাচ্ছিল সে রবিবারের দুপুরে রেডিয়োর বাংলা নাটক শুনতে শুনতে।

পাশে গোপী ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছিল। তার সময় নেই সময় নষ্ট করবার। কচ্ছপের মাংস আর কুচোচিংড়ির ঝাল দিয়ে ভরপেট ভাত খেয়ে সে সবে আরামে রোববারের ঘুম ঘুমিয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার পর বেশিক্ষণ জেগে থাকার অভ্যেসই নেই গোপীর। প্রত্যেক ছুটির দিন খাওয়া শেষ হলেই এবং শনিবার রাতেও একটা সিগারেট ধরিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে হুস হুস করে টানতে টানতে শুয়ে পড়ে রমিতাকে বলে, আসবে তো এসো। তাড়াতাড়ি। আমার ঘুম পেয়েছে।

পেটের খিদের মতোই তীব্র অথবা যে-খিদে পেটের খিদের মতো যখন-তখন এবং সহজে মেটানো যায় না সেই খিদের তাগিদে অপমানিত এবং অসম্মানিত বোধ করলেও রমিতা গোপীর কাছে আসে, পাশে শোয়, শায়ার বাঁধন আলগা করে। তার স্বামী যে তাকে খেতে-পরতে দেয়। গাড়ি চড়তে দেয় টাকা দেয় গয়নাও দেয় মাঝেমধ্যে, তার বিনিময়ে নিদেনপক্ষে তার শরীরটাকে তো দিতেই হবে স্বামীর হাতে। লেন-দেনের আর এক নামই সংসার।

গোপী কোনোদিনও ভালো আদর করতে পারত না। ইদানীং আরও পারে না। গোপীর খেমতা ভালো কী খারাপ এ খবর রমিতার জানার কথা ছিল না, যদি যোগেন তার জীবনে না আসত।

যোগেন গোপীর স্কুলের বন্ধু। গোপী এক অশিক্ষিত বড়োলোকের ছেলে। পড়াশুনোতে কখনোই ভালো ছিল না। আই-কমটা কোনোরকমে পাশ করে বাবার কারখানায় ঢুকে পড়েছে। বাবা মারা গেছেন। এক ছোটো ভাই ছিল। তাকে কারখানার ত্রিসীমানাতেও আসতে দেয়নি গোপী। সম্পত্তি আলাদা করে এবং ব্যবসার এক নম্বরের ভাগ শুধু দিয়ে, দু-নম্বর পুরো নিজে হজম করে নিজের। ভবিষ্যৎ পোক্ত করে নিয়ে, হাভাতে শ্বশুর দেখে তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে লক্ষ্মী এবং সুখশান্তি সবই নিজের কলতলগত করে রেখেছে। পড়াশুনো করে যে গাড়িচাপা পড়ে সে একথা গোপী পড়াশুনোনা করে প্রমাণ করেছে।

রমিতা কদবেলের রেকাবি রেখে, ঘরের লাগোয়া বাথরুমে হাত ধুয়ে এল। এসে দেখল, গোপী তখন গভীর ঘুমে অসাড়। ঘুম ভাঙলেই চা খাবে, বাড়িতে বানানো সিঙাড়া কী চপ, কি আলুচাট, কী অন্য কিছু জলখাবারের সঙ্গে। আজ রোববার বলে ব্যাপার। তারপর চান করে, বগলে। পাউডার মেখে গা-দেখানো আদ্দির পাঞ্জাবি পরে, দেরাজ খুলে একটি হুইস্কির বোতল বের করে গাড়ি নিয়ে চলে যাবে।

প্রতি রবিবারেই তাস খেলতে যায় গোপী বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। চৌরঙ্গীপাড়াতে একটি হোটেলে তাদের নাকি একটি ঘর ঠিক করা আছে। সেখানেই বন্ধুরা মিলে তাস খেলে। কানা ঘুমোয়। শুনেছে তাস ছাড়াও অন্য কিছুও খেলে। গোপী ফেরে সেই এগারোটা নাগাদ। আরেকবার চান করে, খায়। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে ভোঁস ভোঁস।

রমিতার জীবনে সবই আছে। তার একটি সন্তানও আছে। তাকে রমিতার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সায়েব করার জন্যে দার্জিলিং-এ পড়তে পঠিয়েছে গোপী। রমিতার জীবনে অনেকই ফাঁক আছে। যেমন ভরাটও আছে অনেক কিছু। ফাঁক দিয়ে যোগেন ডাক্তার কখন যে অনবধানে ঢুকে পড়েছে তা রমিতা বুঝতে পর্যন্ত পারেনি।

কিন্তু যোগেনকে কাছে পেয়ে সে পুলকিত হয়। মনের কাছে, শরীরের ভেতরে। ফাঁক-ফোকর ভরে ওঠে। যোগেন পাখির ডাক ভালোবাসে, বৃষ্টিপড়ার শব্দ ভালোবাসে, বাংলা গদ্য এবং কবিতাও। এবং মদ-টদও খায় না।

গোপীর এমন কোনো বন্ধু নেই যে, মদ খায় না।

আগে আগে বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় চলত। এখন রমিতার রাগারাগিতে তা বন্ধ হয়েছে। মদ খাওয়ার মধ্যে কিছু খারাপ দেখে না রমিতা। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ মদ খেলেই তাদের আসল রূপটি প্রকাশিত করে ফেলে। এমন কথা বলে, বা এমন কিছু করে, যা মদ না খেলে কখনো বলত না বা করত না। খারাপ বা অপ্রিয় কথা বলার মতো, শোনাও যে অত্যন্ত অশান্তির। তা ছাড়া, কেউ কেউ মারামারি, চেঁচামেচিও করে। এসব ভালো লাগত না রমিতার।

যোগেন ডাক্তার, ডাক্তার হিসেবে কেমন, তা রমিতা জানে না। ভালো হলে সে এতদিনে বাড়ি গাড়ি করতে পারত। পসারও তেমন কিছুই নেই। তবে মানুষটি বড়ো ভালো। মেয়েদের বোঝে এবং আদর করতে জানে। পুরুষের গায়ে জোর থাকা ভালো। কিন্তু সেই জোর যে সব ক্ষেত্রে। প্রয়োগের নয়, একথা যোগেন জানে। গোপী জানে না। সব জোর সব জায়গায় খাটে না। তার হাতের ছোঁয়ায় রমিতা পাগল হয়ে যায়। বশীভূতা খরগোশের মতো যোগেনের কথাতে শৃঙ্গারবনে এমন এমন সব ফুল তোলে নিজের হাতে রমিতা, যা গোপী চাবুক মারলেও তুলতে পারত না। কোনো কোনো ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী পারে, যা চায় তারা, তা পেতে, তাদের নিজেদের মতন করে।

গোপী যদি একথাটা জানত!

ঘুম ভেঙে উঠে গোপী বারান্দায় টবের পাশে গেঞ্জি পরে ইজিচেয়ারে বসল। রবিবারের বিকেল। একটা ঢিলেঢালা ভাব। পথেরও তাই। রেলিং-এ ঠ্যাং তুলে দিয়ে সিগারেট খেলো একটা। তারপর বলল, কই গো! চা-ফা কী হল? আজ তাড়াতাড়ি বেরুব।

হাতকাটা গেঞ্জিতে পুরুষদের ভারি অসভ্য দেখে রমিতা, শুধু ব্রেসিয়ার-পরা মেয়েদের যেমন দেখে। বগলের চুল দেখা যায়, বুকের চুল লেপ্টে থাকে, এর চেয়ে খালি-গায়ে থাকলেও অনেক ভদ্র দেখায়। অথচ গোপী সবসময় হাতকাটা গেঞ্জিই পরবে, পায়জামাটাকে উঠোবে উরু পর্যন্ত, তারপর দু-পা তুলে দেবে রেলিং-এর উপর। একবারও ভাববে না যে গলির উলটোদিকের বাড়ির শীলা বৌদি ও শেলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এসব কোনো বোধই নেই গোপীর।

চা খাওয়া শেষ হলে রমিতা বলল, কোন পাঞ্জাবি দেব? সিল্কের না আদ্দির? চটি পরবে, না কাবলি?

ভাবছি আজ বাড়িতেই থাকব। তুমি রোজ চেঁচামেচি করো। এবার থেকে রবিবার রবিবার টিভি দেখব বউ-এর পাশে বসে গুড-হাজব্যান্ডদের মতো।

বাবাঃ! হলটা কী? রামের সুমতি? আর মদটা? বাড়িতে আবারও মদ শুরু করবে? খোকনের বয়স মোটে পাঁচ। ওকে তুমিই বকিয়ে দেবে।

ছেলে বকে বাপের জন্যে না, নিজেরই জন্যে। আমার বাপ কোনোদিনও মদ কাকে বলে জানত না। হ্যাঁ, তবে তার রক্ষিতা ছিল। সে মদের চেয়ে অনেক ভালো জিনিস। আজকাল আগের দিন নেই, হ্যাপা অনেক। খরচ বিস্তর। কিন্তু রাখতে পারলে ভালো হত। তোমার সঙ্গে প্রেমে কখনো চিড় ধরত না। যারাই এ সম্বন্ধে জানে তারা প্রত্যেকেই বলে। তা তো হল না। বাপের বেটা না হয়ে আমি হলাম মাতাল। আমাকে মদ খেতে দেখছে বলেই খোকন খুব সম্ভব মদ ছোঁবেই না। আমি এমন অনেক কেস দেখেছি।

তা দেখেছ। আবার আমিও দেখেছি যে, বাপকে দেখে ছেলে দশ বছর বয়স থেকেই মদ খেতে আর বাঘ মারতে শিখেছে। আমার পাঁচুমামা ছিল খিচুমারির জমিদার।

সবাই পাঁচু নয়, বুঝেছ! সবাই খিচুমারির জমিদারও নয়। আমি মদ ছেড়ে দেব বলেছি। ছেড়ে দেব। যোগেনের সঙ্গে একটা ব্যাপারে পরামর্শ করতে হবে।

রমিতার বুকটা ধক করে উঠল। ন্যাকা সেজে বলল, হ্যাঁগো! তোমার সে বন্ধুটির খবর কী? অসুখ-বিসুখ না হলে, ডাক্তারবাবু হিসেবে তাকে কল না দিলে তো তার টিকিটিও দেখার জো নেই। যায় কি তোমাদের তাসের আড্ডায়?

রমিতা ভালো করেই জানে যে যায় না। কারণ গোপীরা যখন তাসের আড্ডায় যায়, ঠিক তখনই প্রায় যোগেন আসে তার কাছে। কখনো দুপুর বেলাতেও আসে। যখন পাড়া নিস্তব্ধ, শুধু। আলসেতে পায়রার বকবকম আর স্টেইনলেস স্টিলের বাসনওয়ালির বাসন হেঁকে যাওয়ার ডাক। পায়রাদের মতোই তখন ঘরের মধ্যে যোগেন আর রমিতা বকবকম খেলায় মাতে।

তাস তো ডাক্তার খেলে না। ও-শালার কোনো মাইনর ভাইস নেই।

গোপী বলল তাচ্ছিল্যর গলায়।

মদও তো খায় না।

রমিতা বলল।

গোপী রমিতার দিকে চেয়ে বলল, মদের বোতলের চেয়েও অনেক সুন্দর নরম বোতলে, মদের চেয়েও অনেক ভালো মাল পাওয়া যায়। ও শালা মদ খাবে কোন দুঃখে?

সে আবার কী জিনিস? কারখানা আর মিস্ত্রি নিয়ে মশগুল স্বামীর ভাষা শুনে অবাক-হওয়া গলায় রমিতা স্বামীকে বলল, নিজের বুকের আঁচল টেনে।

গোপী আবার হাসল। তার চোখ দুটি রমিতার দু-চোখের খাপে খাপে আটকে নিয়ে নিজের চোখের কোনো সুইচ টিপে হেডলাইট জ্বালল। ফোকাস ফেলল রমিতার চোখে। চোখের মণি, মণির পাশের সাদা অংশ, চোখের পাতা, সব আঁতিপাতি করে খুঁজতে লাগল।

যোগেনের প্রসঙ্গ ওঠায় এবং গোপীর ওই র কঠিন দৃষ্টিতে রমিতার চোখের দৃষ্টি ধরা পড়ে গেল। নরম হয়ে এল শেষ বিকেলের রোদের মতো। আস্তে আস্তে চোখ নামিয়ে নিল ও গোপীর দৃষ্টির প্রখর তাপ থেকে।

গোপী যা বোঝার তা বুঝল। ও জানত যে, অপরাধীর শরীরের আর যেখানেই যত জোর থাকুক না কেন, তার চোখে জোর থাকে না কখনো। আর থাকে না মেরুদণ্ডে।

তাহলে পায়জামা পাঞ্জাবি বের করব না?

রমিতা কথা ঘুরিয়ে বলল।

বের করো। চান করে, একটু রাবড়ি কিনে নিয়ে আসি শর্মার দোকান থেকে। নিজে গেলে ভালো জিনিসটা পাব। তারপরই ফিরে আসব বাড়ি। কী ছবি আছে গো আজ টিভি-তে?

যিসকা বাঁদরী ওহি নাচায়।

রমিতা বলল।

বাঃ! ফার্স্ট ক্লাস নাম তো! যিসকা বাঁদরী ওহিনাচায়! সংসারে তেমনই তো হবার কথা! কিন্তু মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রমও ঘটে।

বলেই, রমিতার চোখের দিকে চেয়ে বলল, কী বল?

গোপী বাইরে গিয়ে রাবড়ি কিনে তার যে আসল ডাক্তার তার কাছে গিয়ে বলল, একটা এমন ইনজেকশান ঠুকে দাও তো ডাক্তার যেন প্যারালিটিক রোগীও যেকোনো ছুঁড়ির বাপের নাম খগেন করে দিতে পারে। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে।

ডাক্তার খ্যাঁকশেয়ালের মতো ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল। বলল, দিচ্ছি দিয়ে। তবে এ কেবল কালেভদ্রে নেবেন গোপীবাবু। নইলে চিরদিনেরই মতো নারীসঙ্গ বঞ্চিত থাকতে হবে।

ইনজেকশান নিয়ে গোপী বলল, সে দেখা যাবেখন। বর্তমানে তো বাঁচি ভবিষ্যতের কথা পরে। কিন্তু ইনজেকশানের এফেক্ট থাকবে কতক্ষণ?

আরম্ভ হবে, ঘন্টাখানেক পর, থাকবে তিন ঘন্টা।

এক-শো টাকার নোট বের করে ডাক্তারকে দিল গোপী।

রাবড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরে টিভি-তে হিন্দি ছবি যিসকা বাঁদরী ওহিনাচায় দেখতে দেখতে গোপী চাকর হরিকে ডেকে বলল, এক গ্লাস দুধ ফ্রিজ থেকে নিয়ে আসতে, দুটো বরফের কিউব ফেলে। দুধটা হরি আনলে, পকেট থেকে একটা কালো গুলি বের করে তাতে ফেলে চামচ দিয়ে ভালো করে মেড়ে নিয়েই খেয়ে নিল গোপী।

তারপর হরিকে বলল, রাবড়ি দে দেখি আড়াই-শোটাক! সঙ্গে জমবে ভালো।

রমিতা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, কী খেলে গো?

গোপী রাবড়ি খেতে খেতে চোখ নাচিয়ে বলল, পুতলি বাই কী গোলি।

মানে? কী সেটা?

হরির দিকে চেয়ে গোপীবলল, পরে বলব তোমাকে। এখন ছবি দেখো।

ছবি শেষ হলে খেয়ে-দেয়ে ওরা ঘরে এল। আজ গোপীর কী হয়েছে রমিতা বুঝতে পারল না। এত গভীর, এতবার ও এত দীর্ঘকালের পৌনঃপুনিক আনন্দ যেকোনো পুরুষ কোনো নারীকে দিতে পারে, তা তার সম্পূর্ণ অজানাই ছিল। দশটা যোগেনেও তার এত আনন্দ হত না।

পুতলি বাই কী গোলি কী জিনিস গো?

সোহাগের গলায় রমিতা শুধাল।

কী জিনিস? বুঝতে পারছ না?

হেসে ফেলল রমিতা। কিছু গোপীর বলার ধরনে, বাকিটা নিবিড় আনন্দে।

ডাকাইত পুতলি বাই যখন যে পুরুষের সঙ্গে শুত, তাকে শোওয়ার ঠিক দু-ঘন্টা আগে এই গোলি খাইয়ে নিত। আমার এক সাপ্লায়ার এনে দিয়েছে ভোপাল থেকে।

ভোপাল কোথায়?

আঃ! ভোপাল, গোয়ালিয়র এসবের নাম শোনোনি? ডাকাতদের জায়গা।

তুমি তোমার সাপ্লায়ারকে বললে কী করে যে, তুমি ভালো…?

তাই কি আর বলি? বলেছি, আমার এক বন্ধুর জন্যে নিচ্ছি। কোনো বন্ধুর সত্যি সত্যি দরকার থাকলে তাদেরও দেব।

রমিতা চুপ করে রইল। এত সুখ পেয়েছে ও পাচ্ছে আজ যে যোগেনকে বেমালুম ভুলেই গেল ও। মেয়েরা হয়তো এরকমই হয়। ভাবছিল রমিতা।

সেদিন ঘুমোতে ঘুমোতে রাত দেড়টা। বিয়ের ঠিক পরের দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ছিল রমিতার। পুতলি বাই-এর একটা ফোটো থাকলে সে ফোটোর পায়ে রোজ সকালে ফুল দিত ও।

২.

যোগেন সাধারণত মাসে কম করে তিন-চারদিন আসে। সপ্তাহের বুধ আর শুক্রবারের দুপুরে। কোনোদিন বৃহস্পতিবারও। রাতে আসে শুধু রবিবারেই। ফোন করে। কাল ফোন করেছিল। যোগেন রবিবার ছিল বলে। গোপী তখন টিভি দেখছিল। রমিতা পাকা অভিনেত্রীর মতো হেসে বলেছিল, বল শিউলি! না রে, আজকে নয় রে। আজকে আমার বরের কি মতি হয়েছে জানি না, তাস খেলতে যায়নি। তারপর হাসতে হাসতেই বলেছিল, অন্য কোনো রবিবার যাব।

গোপী কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অহেতুক কৌতূহল তার স্বভাবে নেই।

কিন্তু রমিতা নিজেই বলল, শিউলি, কথা ছিল যে আমরা দু-জনে ভেলপুরি খেতে যাব গড়ের মাঠে।

শিউলি? এখন?

শরতের তো অনেকই দেরি!

স্বগতোক্তির মতো বলেছিল গোপী।

রাতে শোবার সময় পরদিনই, মানে সোমবার গোপীর মুখে মদের গন্ধ পেল রমিতা।

কী হল? আবার মদ খেলে? বললে না যে, ছেড়ে দেবে? পুতলি বাই কী গোলি কী হল?

গোপী হাসল। বলল, আজকে একজন বড়ো ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হল। সাউথে গেছিলাম একজন কাস্টোমারের সঙ্গে, এ এ ই আই ক্লাবে। তিনি বললেন, মাসে একবারের বেশি ও জিনিস খেলে যন্ত্রপাতি বরাবরের মতো বিকল হয়ে যাবে। বুয়েচো?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমিতা বলল, না বোজার কী আছে!

দু-টি মাত্র গোলি এনে দিয়েছিল সাপ্লায়ার ট্রায়ালের জন্যে। কিন্তু শুনলাম, এক মাস ও জিনিস ঘরে রাখা যায় না। পরে ভোপাল থেকে রেগুলার সাপ্লাই আসবে আমার মাসে মাসে। এমন। একটি জিনিস, নষ্ট করব? একটি গোলি তো রয়েছে। কিন্তু খাওয়া মানা মাস না পেরোলে। কাকে দিয়ে দেওয়া যায় বলো তো? প্রমিতার বরকে দেব? ঘাচুকে?

রমিতা বলল, ঘাচুকে আর দিয়ে দরকার নেই, পতু যা বলে, তাতে তো মনে হয় এমনিতেই বেচারিকে ঘাচু যা করার উপক্রম করেছে তার উপরে আবার পুতলি বাই কী গোলি! তা ছাড়া ঘাচুর দরকারই বা কী? সাতাশ বছরের ছেলে!

তাহলে কাকে এ ওষুধ দিয়ে কার বউ ভাগাব বিনা দোষে? তার চেয়ে দরকার নেই। ওটা ফেলেই দিও। আপদ যাক।

ফেলে দোব?

অবাক হয়ে রমিতা বলল।

তা কী করবে? তুমিও কি পুতলি বাই-এর মতো কাউকে খাওয়াতে চাও?

ছিঃ ছিঃ! কী খারাপ তুমি! বলল রমিতা। কিন্তু বুকটা ধক করে উঠল।

তাহলে ফেলেই দিও। দেখো, চাকর-বাকর-ঠাকুর কেউ খেয়ে না ফেলে। মরবে তুমিই। তবে যদি চাও তো খাওয়াতে পার। আমার আপত্তি নেই হরি ব্যাটাতো খেতেও দেখেছে আমাকে।

এত অসভ্য! কথার কোনো মাথা-মুণ্ডু নেই।

আমি মিস্ত্রি মানুষ। হাতের পায়ের কাজ বুঝি। কথার কী জানি?

পরদিন গোপী কারখানায় চলে গেল। সেই লিলুয়াতে কারখানা। বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে গেলে অনেকক্ষণের মনে শান্তি। আসতে-যেতেই ঘন্টাদুয়েকের ব্যাপার। যোগেন এসেছে, রমিতার সঙ্গে শুয়েছে জানতে পেরেও, আসতে আসতেই ঘন্টা কাবার হয়ে যাবে গোপীর।

যোগেন এল চুপি চুপি, দুপুরে চুরি করে মাছ-খাওয়া বেড়ালের মতো অতি সন্তর্পণে। তখন হরি অন্যদের সঙ্গে চিলেকোঠায় বসে তাস খেলে। ঠাকুর মুখ হাঁ করে তাদের ঘরে ঘুমোয়। কষ বেয়ে লাল গড়ায় তার। বেচারার বয়স হয়েছে।

যোগেন এসেই প্রতিবারের মতো প্যান্টখানা খুলে পাট-পাট করে খাটের বাজুতে ভাঁজ করে রাখতে গেল। কিন্তু রমিতা বলল, না না, আজ নয়। আজ একটা ওষুধ দিচ্ছি। বাড়ি নিয়ে গিয়ে কাল খাবে। আমার এখানে আসবার ঠিক দুঘন্টা আগে। তারপর দেখবে।

ডাক্তারকে ওষুধ খাওয়াচ্ছ তুমি! কেন? আমি কি ইম্পো?

রমিতা বলল, ইম্পোই তো! পুতলি বাই কী গোলির টেম্পো যারা দেখেনি, তারা সবাই ইম্পো!

এই কথা?

এই কথা।

আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। তুমি তো জান, বড়ো সুন্দর তুমি। তুমি এই ওষুধ খেলে যে আমার কী হবে! অত সুখ যে কোথায় রাখব?

রমিতা উত্তেজনায়রুদ্ধ গলায় বলল।

গডরেজের আলমারি কিনে দেব একটা। সুখ রাখবার জন্যে।

যোগেন খুলে-ফেলা প্যান্ট পরতে পরতে বলল।

রমিতা ফ্রিজ থেকে গুলিটা বের করে এনে, পরিষ্কার কাগজে মুড়ে যোগেনকে দিল। বলল, সাবধানে রেখো। আর কালকে এসো কিন্তু। কাল তোমারই এনে-দেওয়া ক্যামে সাবান দিয়ে ভালো করে চান করে তোমার জন্যেই তৈরি হয়ে থাকব। খসস আতর মাখব, সারা গায়ে।

যোগেন খুব অবাক হল।

রমিতা সাধারণত এসব ব্যাপারে নিরুচ্চার থাকে। বেশিরভাগ মেয়েরাই থাকে। হঠাৎ এমন নির্লজ্জ হয়ে উঠল? তাদের কথা যা সব চোখে-চোখে, ঠোঁটের আভাসে। পুতলি বাই কী গোলি

রমিতার এ কী ভাবান্তর ঘটিয়ে দিল!

পেলে কোত্থেকে গোলি? যোগেন শুধোলো।

ভোপাল থেকে এনে দিয়েছে। তোমার বন্ধুর সাপ্লায়ার।

ভোপাল থেকে?

হ্যাঁ! ওসব ডাকাতদের জায়গা জান না?

হুঁ। বলে, যোগেন চলে গেল।

৩.

গোপীর কারখানার এক কোণায় ছোট্ট ঘর কয়েকটি। মধ্যেরটি গোপীর। একজন সাধু লাল পোশাক পরে গলায় রুদ্রাক্ষর মালা ঝুলিয়ে বাইরে দাঁড়িয়েছিল। গোপী তাকে ভিতরে ডাকল। বেয়ারাকে ডেকে বলল, আর কাউকে ঘরে ঢুকতে দিবি না।

সাধু বসল উলটোদিকের চেয়ারে।

গোপী ড্রয়ার থেকে থ্রি-এক্স রাম-এর একটি পাঁইট বের করে সাধুকে দিল। সাধু বলল, ব্যোমশংকর।

বলেই, ঢক ঢক করে জলের মতো খেয়ে ফেলল।

গোপীও বলল, ব্যোমশংকর।

গোপী বলল, ও সমরা, কেস ক্যাঁচাইন করবে না তো হে?

সমরা কখনো ক্যাঁচাইন করেনি গোপীদা। কোন ফুটোয় কোন তেল দিতে হয় এবং কোথায় কী কখন করতে হয় তা এই সমরার মতো আর কেউই জানে না। নইলে কি আর এত অল্পদিনে এত বড়ো সাধু হয়ে উঠি? কত নামডাক আমার! কে না চেনে আমাকে? আমেরিকায় নিয়ে যাবে। আমেরিকান সরকার কী মুখ দেখে? আরো কত ভেলকি শিখে আসব সেখান থেকে। কতরকম। গুপ্তি-বিদ্যা। মধ্যে মাল না থাকলে গোপীদা, এতদূরে ওঠা যায় না কখনো। মোহান্ত বাবাকে তো কম মাল খাওয়াইনি, কম তেলও লাগাইনি। আমার অসাধ্য কিছুই নেই। নিজের ঘর ভেঙেছি, অন্যের ঘর ভেঙেছি কতবার, আর ছুঁচো-ইঁদুর মারতে পারব না দু-একটা।

গোপী ওকে পাঁচশ টাকা দিল ড্রয়ার থেকে বের করে। বলল, কাজটা যদি নির্বিঘ্নে হয়ে যায়, তাহলে আরও পাঁচশ নিয়ে যেয়ো। তবে এখানে নয়। অন্য কোনোখানে। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আচ্ছা একটা কথা বল দেখি, মরণ-গুলি নয়, আমার গুলিটা কী দিয়ে বানিয়েছিলে সমরা?

সমরা হাসল। বলল, তুমিও যেমন! বুঝতে পারলে না? ও তো সিদ্ধি।

গোপী বলল, অ! বেড়ে খেতে। আগে খাইনি কখনো।

যোগেন ঘড়িটা দেখল। বেলা বারোটা বাজে। সবে সার্পেনটাইন লেনে একটা রোগী দেখে বেরুল সে। ভেবেছিল, রমিতার দেওয়া ওষুধটা রোগীর বাড়িতেই এক গ্লাস জল চেয়ে নিয়ে খাবে।

তারপর ভাবল, নাঃ! কে কী ভাববে? অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার নিজে গুলি-গোলা খাচ্ছে দেখে ডাক্তারের উপর ভক্তিই চটে যাবে হয়তো। নিজেও সে খেত না, কিন্তু ডাকাইত পুতলি বাইয়ের আবাহন, তারপর রমিতার কাছে যা শুনেছে তাতে লোভ সামলাতে পারল না। ভাবছিল, কী এমন অ্যাফ্রোডিসিয়াক ওই গোলির মধ্যে থাকতে পারে? রমিতার বুকের খাঁজের গন্ধর জন্যে, ওর শরীরের মৃত্তিকাগন্ধী ছায়ায় ছায়াচ্ছন্ন থাকার জন্যে যোগেন সব কিছুই করতে পারে। মেয়েদের শরীরটা যে পুরুষের কাছে কত বড়ো, বিশেষ নারীর শরীর বিশেষ-পুরুষের কাছে, তা মেয়েরা নিজেরা যদি জানত তাহলে সেই বিশেষ পুরুষকে চিরদিনই বান্দা করে রাখতে পারত।

কেউ কেউ জানে, সকলে জানে না।

যোগেন একটা রেস্তোরাঁতে ঢুকল। এক কাপ চা এবং ভেজিটেবল চপ-এর অর্ডার দিল। তার আগে জল চাইল এক গ্লাস। এদিক ওদিক চেয়ে দেখে নিল। ভরদুপুরে, উইক ডেজে রেস্তোরাঁ ফাঁকাই। দু-জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া। কিউবিকলে বসে ফিসফিস করছে, পায়ের উপর পা দিয়ে চাপ দিচ্ছে, চকিতে ব্লাউজের উপরে মুখ রাখছে।

যোগেন মনে মনে বলল, বালখিল্য। ওরা জানে না যে, এসবে খিদেই শুধু বাড়ে, খিদে মরে না। খিদেকে চনচনে করে রাখতে হলে, বার বার খিদেকে মারতে হয়।

পুতলি বাইয়ের ছবি সে দেখেছিল কাগজে। একবার পুতলি বাই আর একবার রমিতার মুখ মনে করে, পকেট থেকে গুলিটা বের করে ও গিলে ফেলল জলের সঙ্গে।

চা এল, চপও এল, কিন্তু যোগেনের শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল। খেতে পারল না কিছুই। তাড়াতাড়ি টাকা বের করে দিল বেয়ারাকে। কিন্তু চেঞ্জ নেবার ধৈর্য পর্যন্ত যোগেনের রইল না। ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সিতে উঠে বলল, শ্যামবাজার। ট্যাক্সি চলতে লাগল মিটার-ডাউন করে। পেছনের সিটে শরীর এলিয়ে যোগেন শুয়ে পড়ল।

দুটো বেজে গেল। যোগেন এল না। চারটে বাজলেই চাকর আসবে চা করতে। পাঁচটা বাজলে, ঠাকুর। ভাঁড়ার দিতে হবে। দুটো থেকে বড়ো জোর সাড়ে তিনটে ওরা সময় পেত। রমিতা। ডাকাইত পুতলি বাই-এর মতোই রেগে উঠতে লাগল, ফুসতে লাগল যোগেনের উপর। যাঁরাই ব্যর্থকাম রমণীর রাগ দেখেছেন তাঁরাই একমাত্র তা অনুমান করতে পারবেন। পুতলি বাই কী। গোলির অসদব্যবহারের জন্যে এবং তাকে এমন উন্মত্ত অধীর অপেক্ষায় বসিয়ে রেখেছে বলে। আলসের পায়রাগুলো বকবকম করে এ ওর ঘাড়ে উঠে নেমে পড়ে…বকবকম বকবকম করেই যেতে লাগল। ক্লান্তিহীন কথা ওদের, যতিহীন কাম।

শ্যামবাজারের মোড়ে পৌঁছে ফুটপাথের বাঁ-দিক ঘেঁষে ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়েই পিছন ফিরে ট্যাক্সিওয়ালা দেখল প্যাসেঞ্জারের মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়। সঙ্গে সঙ্গে ভিড় হয়ে গেল। পুলিশ এল। পুলিশ বলল, থানায় যেতে হবে। পাড়ার লোকেরা ডাক্তার ডেকে আনল। ডাক্তার নাড়ি দেখে আর স্টেথিস্কোপ বসিয়ে বললেন, মরে গেছে।

গোপী মিস্ত্রিদের সঙ্গে খুব চেঁচামেচি করছিল। বড়োই মুখ খারাপ ওর। নিজে ছোটোলোক না হলে ছোটোলোকদের নিয়ে কাজ করা যায় না। একথা বিশ্বাস করে গোপী।

এমন সময় বেয়ারা এসে বলল, বৌদির ফোন, বাড়ি থেকে।

গোপী এসে ফোন ধরল।

রমিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমার বন্ধু যোগেন ডাক্তারের ছোটো ভাই খগেন ফোন করেছিল এক্ষুনি। যোগেন মরে গেছে।

মরে গেছে? বল কী? কী হয়েছিল?

যেন খুবই ধাক্কা খেয়েছে এমন গলায় বলল গোপী।

জানি না। খগেন বলল, কেউ ওকে বিষ খাইয়েছে। থানায় আছে এখনও ডড-বডি। মর্গে নিয়ে যাবে।

কোন থানায়?

উত্তর নেই কোনো ওপাশ থেকে। একটি সংক্ষিপ্ত ফোঁফানির আওয়াজ হল। তারপরই লাইনটা কট করে রেখে দেওয়ার শব্দ শোনা গেল।

সমরার আখড়ায় একটা ফোন করল গোপী।

বল গুরু। সমরা বলল, ওপাশ থেকে। কাজ এখনও হয়নি। কিন্তু আমি একটু কলকাতার বাইরে যাব। তুমি টাকাটা নিয়ে যেও এসে।

আজই দাও না গুরু। মোহান্তকে একটু খাতির করতে হবে।

ঠিক আছে। তুমি তাহলে ব্রাবোর্ন রোডের ফ্লাইওভারের নীচে এসে দাঁড়াও, আমি রওয়ানা হচ্ছি

এখুনি। লাশটা পড়ে ছিল থানার মেঝেতেই।

ট্যাক্সিওয়ালা বলল, আমাকে এবারে ছেড়ে দিন বাবু।

এখুনি? কার জেনানার মুখ দেখে উঠেছিলে বাছা আজ সকালে?

রমিতা ভাবছিল, যাক গে যাক। যোগেন মরেছে তো কি? পুতলি বাইকী গোলি তো আছে। গোপীকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *