পুণ্যাদাসীর পুণ্যফল – অপূর্বকুমার কুণ্ডু
পুণ্যাদাসীর কেউ নেই! বনের ধারে একটা পাতার কুঁড়ে৷ সেই পাতার কুঁড়ের মধ্যে সে একা থাকে৷ সারাদিন তার কাজ ভিক্ষা করা৷
সন্ধ্যা বেলা ফিরে এসে কাঠকুঠো জ্বেলে যাহোক কিছু তৈরি করে খায়৷
পুণ্যাদাসীকে রাজগৃহের সকলে চেনে৷ ঠাকুরদা চেনেন৷ তাঁর নাতিও চেনে৷ আর চিনবে নাই বা কেন! বয়স তো তার কম হল না৷
আকাশে যখন একটা-দুটো তারা, পুব দিক যখন ভাবছে এবার সুয্যিঠাকুরের দরজা খুলে দেবে, ঠিক তখনই পুণ্যাদাসীর ঘুম ভাঙে৷ ঘুম ভাঙলে আর শুয়ে থাকতে পারে না৷ পাশে রাখা লাঠিটা নিয়ে ঠক ঠক করতে করতে বাইরে এসে দাঁড়ায়৷
-‘এখনও আলো ফোটেনি ভালো করে৷ উঠলে কেন পুণ্যাদাসী?’
-‘ইস, শুয়ে থাকলে কি চলে! এখন আমার কত কাজ৷’
-‘তা কী কাজ তোমার শুনি৷’
-‘বারে, গিদ্ধকূটে এখন প্রভু বাইরে এসে দাঁড়াবেন৷ তাঁকে দেখব যে৷’
-‘এ একটা কাজ হল! তুমি তো রাজগৃহের রাজপথে ভিক্ষা করতে যাও৷ সেখানে গেলেও প্রভুকে দেখতে পাবে৷’
-‘তা পাব৷ তবু সবার আগে প্রভুকে দেখব৷ এই ইচ্ছার জন্য শুয়ে থাকতে পারি না যে৷’
-‘তা পুণ্যাদাসী, এখান থেকে গৃধ্রকুটে তুমি প্রভুকে দেখতে পাও?’
-‘তোমরা চোখ দিয়ে দেখো৷ আমার দৃষ্টি অতদূরে যায় না৷ তবু আমি দেখতে পাই৷’
-‘কেমন করে?’
-‘আমার মনের মধ্যে তাঁর ছবি আছে৷ সেই ছবির সঙ্গে মিলিয়ে আমি দেখি৷’
-‘বাঃ পুণ্যাদাসী, তোমার এমন দেখা যেন সব্বাই দেখে৷’
আকাশ থেকে রাতের তারাগুলো মুছে গেল৷ ভোরের বাতাস রাতে ফোটা ফুলের গন্ধ নিয়ে বয়ে যায়৷ পাখিরা ঘুম থেকে জেগে উঠেই কলরব শুরু করে গাছের ডালে ডালে৷
পুণ্যাদাসী বোঝে, এবার প্রভু বাইরে এসেছেন৷ দু-হাত জোড় করে প্রণাম করে প্রভুর উদ্দেশে৷
পুণ্যাদাসীর ভাবনা কত৷ শুধু ভাবে৷ রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে৷ পথ চলতে চলতে ভাবে৷ ভিক্ষা করতে করতে গাছ তলায় বসে বসেও ভাবে৷ কী সে ভাবনা . . .
প্রভু কি শুধু রাজা-রানি, শ্রেষ্ঠি-বণিকদের সেবা নেবেন? প্রভু কি শুধু ধনীদের? নিঃস্ব-দরিদ্রদের কি কোনো অধিকার নেই প্রভুর কাছে যাওয়ার!
‘কে বলেছে? সবাই তাঁর কাছে যেতে পার৷’
-‘সত্যি বলো তো, প্রভু সবার!’
-‘এমন অবাক হচ্ছ কেন পুণ্যাদাসী, সত্যি তিনি সকলের৷’
-‘যাক বাঁচালে৷ আমার মনের মধ্যে একটা খটকা ছিল৷’
-‘কেন, তুমি জানতে না?’
-‘জানলেও বিশ্বাস হত না৷’
-‘তা হঠাৎ এ-কথা তোমার কেন মনে হল শুনি?’
-‘আমার মনের মধ্যে না একটা ইচ্ছে আছে৷’
-‘কী সে ইচ্ছে, শুনি!’
-‘সকলে প্রভুকে ভিক্ষা দেয়৷ আরও কত কী দেয়৷ আমারও কিছু দিতে ইচ্ছে করে৷’
-‘হাসালে পুণ্যাদাসী৷ তুমি নিজে ভিক্ষা করে খাও৷ তুমি আবার প্রভুকে কী ভিক্ষা দেবে!’
-‘সে আমার যা ইচ্ছা হবে৷ তবে কিছু ভিক্ষা আমি দেবই৷’
-‘নাঃ পুণ্যাদাসী, তোমার সাহস আছে!’
-‘সাহসের কী দেখলে? তুমিই তো বললে প্রভু সবার৷ ধনীরও, দরিদ্রেরও৷’
-‘তুমি হাসালে পুণ্যাদাসী৷ তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পার৷ তাঁর কৃপা ভিক্ষা তুমি করতে পার৷ কিন্তু তুমি তাঁকে ভিক্ষা দিতে চাও কোন সাহসে?’
-‘বুঝেছি, তুমি কী বলতে চাও৷ আমার কিছু নেই বলেই আমি ভিক্ষা দিতে পারব না৷ শোনো, ধনীরা তাদের ধন দেবে৷ রাজা দেবে তার রাজ-ঐশ্বর্য৷ আমার যা ক্ষমতা আমি তাই দেব৷ তা বলে কি তা কম হবে?’
-‘বেশ, তোমার যা ইচ্ছে তাই৷’
-‘আমি তোমাদের প্রভুকে পরীক্ষা করব৷ দেখব সত্যি সত্যি তিনি সবার, না শুধু ধনীর৷’
-‘বেশ, দেখো পরীক্ষা করে৷’
-‘হ্যাঁ, তাই করব৷’
রাজগৃহের রাজপথ জুড়ে অজস্র মানুষ দাঁড়িয়ে৷ কারও মুখে কোনো কথা নেই৷ সকলের চোখে কৌতূহলের ছোঁয়া৷ এমন হওয়ার কারণ কী?
-‘জানো না বুঝি? আজ মহারানি কোশলদেবী প্রভুকে ভিক্ষা দেবেন৷’
-‘তাই বুঝি! তাহলে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে যাই৷’
-‘দাঁড়াও না৷ কে মানা করেছে৷ তবে কথা বোলো না৷’
-‘বেশ, কথা বলব না৷ কিন্তু শুধু তো রাজ্যবাসী পথের দু-ধারে দাঁড়িয়ে৷ কোথায় তোমার রানি আর প্রভুও তো এখনও আসেননি৷’
-‘থামো তো! সময় হলেই সকলে আসবেন৷ এত ছটফট করছ কেন?’
-‘মহারানি নিজের হাতে প্রভুর ভিক্ষাপাত্রে ভিক্ষা দেবেন!’
-‘জানি না৷’
-‘প্রভু একা আসবেন, না শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে আসবেন ভিক্ষাগ্রহণের জন্য?’
-‘দেখো না৷ তোমারও তো চোখ আছে৷’
সহসা দু-জন রাজার প্রহরী ঘোড়া ছুটিয়ে আসে৷ তারা পথ পরিষ্কার করে৷ মহারানি কোশলদেবী বলে কথা! পথের মাঝখানে যেন কেউ অকারণে না দাঁড়িয়ে থাকে৷ তারপর আসেন রাজগৃহের রাজা বিম্বিসার৷ তারপর মহারানির খাসদাসীর দল৷ তাদের প্রত্যেকের হাতে মহার্ঘ বস্তু৷ যা মহারানি প্রভুকে ভিক্ষা দেবেন৷ তারপর ধীরে ধীরে দেখা যায় মহারানির শিবিকা৷
যেন ছোটো একটা রাজপুরী৷ মহামূল্য আভরণে সাজানো৷
রাজার প্রহরী ঘোষণা করে, ‘প্রভু বুদ্ধদেব গৃধ্রকূট পর্বত থেকে নেমে এসেছেন৷ এখনই এসে দাঁড়াবেন৷ তারপর শুরু হবে মহারানির দান পর্ব৷ মহারানির ভিক্ষাদানের আগে কেউ যেন প্রভুর ভিক্ষাপাত্রে কিছু ভিক্ষা না দেয়৷’
সকলে চুপ করে শোনে৷
রাজগৃহ-নৃপতি বিম্বিসার অশ্ব থেকে নেমে প্রভু বুদ্ধর পথের দিকে চেয়ে থাকেন৷ সহসা কোলাহল জাগে৷
কীসের এ কোলাহল!
একজন বৃদ্ধাকে রাজার প্রহরী বাধা দেয়৷ বৃদ্ধা শুধু বলেন, ‘আমাকে একবার যেতে দাও৷’
হাতে তার একটা পুঁটলি ধরে রাখা৷ বৃদ্ধা বলে, ‘এই দেখো, প্রভুকে দেব বলে কোন সকালে আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি৷’
-‘এখন যাও তো৷ আজ মহারানি প্রভুকে প্রথম ভিক্ষা দেবেন৷ জানো না, তার আগে কেউ ভিক্ষা দিতে পারবে না৷’ প্রহরী বলে৷
-‘কেন, প্রভু কি আমাদের কেউ নয়৷ সে কি শুধু তোমাদের৷’ বৃদ্ধা বলে৷
প্রহরী কোনো কথা বলে না৷ বৃদ্ধাকে ধরে রাজপথ থেকে দূরে নিয়ে যায়৷ তারপর বলে, ‘শোনো, এখানেই থাকো৷ এর পর বাড়াবাড়ি করলে ফল ভালো হবে না৷’ বলেই বৃদ্ধাকে ঠেলে দেয়৷ হাতের পুঁটলি ছিটকে পড়ে৷ সঙ্গে বৃদ্ধাও৷
এদিকে রাজপথে মৃদু গুঞ্জন ওঠে৷
প্রভু আসছেন৷ ওই যে প্রভু বুদ্ধকে দেখা যাচ্ছে৷ সঙ্গে ভিক্ষু আনন্দও আছেন৷ সারিপুত্ত আসেননি আজ৷ দেখো, সকলে কেমন উন্মুখ হয়ে আছে প্রভুকে ভিক্ষা দেওয়ার জন্য৷ মহারানির ভিক্ষা দেওয়া দেওয়া শেষ হলে সকলেই কিছু কিছু তুলে দেবে৷
বিম্বিসার রাজপথে নত হয়ে প্রণাম করেন৷ তারপর বলেন, ‘প্রভু, আজ রাজগৃহ-মহারানি আপনার ভিক্ষাপাত্রে কিছু ভিক্ষা দিতে চায়৷ আপনি গ্রহণ করুন৷’
প্রভু বুদ্ধ হাত তুলে সম্মতি দান করেন৷
রাজার ইশারায় খুলে যায় শিবিকার দরজা৷ শিবিকা ছেড়ে নেমে আসেন মহারানি৷ পাথরের পুতুলের মতো দাঁড়ানো মহারানির খাস দাসীরা নড়ে ওঠে৷ মহারানির সঙ্গে তারাও পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় প্রভুর কাছে৷ দাসীদের হাত থেকে ভিক্ষাবস্তু মহারানি নিজের হাতে নিয়ে যখন প্রভুর পাত্রে দেবেন, বুদ্ধদেব বলেন, ‘দাঁড়াও মহারানি৷ তোমার ভিক্ষা আমি আজ নিতে পারব না৷’
চমকে ওঠেন মহারানি৷ চমকে ওঠেন বিম্বিসার৷ থমকে যায় সকলে৷ একী! মহারানির ভিক্ষা ফিরিয়ে দিচ্ছেন প্রভু! কেন?
-‘তোমার মন এখনও অহংকারশূন্য হয়নি রানি৷ তুমি রানি এ-কথাটা সকলকে জানাবার জন্য এমন সাজে, এমনভাবে দাসীদের হাতে আমাকে ভিক্ষা দেওয়ার জন্য ভিক্ষাবস্তুগুলো এনেছ৷ অহংকারের দান আমি নিই না৷ যেদিন সকলের মতো একজন হয়ে ভিক্ষা দিতে আসবে, সেদিন নেব৷’
অবাক হয়ে যায় সকলে৷ তাহলে কি আজ প্রভু ভিক্ষা গ্রহণ করবেন না৷
-‘আজ আমি যার ভিক্ষা নেব তাকে আমি দেখেছি৷ তার অমলিন ভক্তির কথা আমার কানে এসেছে৷ এখানে একটু আগে সে চরম লাঞ্ছনা সহ্য করেছে৷ আজ আমি তার ভিক্ষাটুকু নেব৷’ বলেই প্রভু বুদ্ধ আনন্দকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেন৷
‘পুণ্যা, আমাকে ভিক্ষা দেবে না?’ প্রভু বুদ্ধ বলেন৷
চমকে উঠে বসে পুণ্যাদাসী৷ দু-গালে তার শুকনো জলের দাগ৷
‘প্রভু, তুমি এসেছ নিজে আমার কাছে ভিক্ষা নিতে!’ পুণ্যাদাসী চমকে ওঠে৷ তারপর বলে ‘তবে যে ওরা বলল, আগে মহারানি ভিক্ষা দেবে৷’
‘না, পুণ্যা, আমি আজ শুধু তোমার ভিক্ষা নেব৷’ বুদ্ধদেব বলেন৷
পুণ্যাদাসী বুকের সঙ্গে ধরে রাখা পুঁটলি মাটিতে নামায়৷ তারপর ধীরে ধীরে গিঁট খুলে প্রভুর ভিক্ষাপাত্রে তুলে দেয় কয়েকটা শুকনো রুটি৷ পুণ্যা বলে, ‘প্রভু, তুমি আমার ভুল ভেঙে দিলে৷ তোমাকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম৷ আজ আমি জানলাম সত্যিই তুমি সকলের৷’
প্রভু বুদ্ধদেব রুটিগুলো আনন্দে খেতে শুরু করেন৷ বলেন, ‘আমি এই ভিক্ষাই চাই৷ যে ভিক্ষায় কোনো অহংকারের মালিন্য নেই৷’
পুণ্যাদাসী অবাক হয়ে যায়৷ বুদ্ধদেব ও আনন্দ পরম তৃপ্তিতে সেই শুকনো রুটিগুলো খেতে থাকেন৷
পুণ্যা বলে, ‘আকাশের সূর্য আমাদের দুটো চোখে আলো জ্বালে৷ তুমি সকলের অন্তরে আলো জ্বেলে দাও প্রভু৷ সে আলোয় যেন সকলে পথ খুঁজে পাই৷’
পুণ্যাদাসী আবার প্রণাম করে৷ দু-চোখ ছাপিয়ে জল গড়ায়৷ কেন, তা বুঝতে পারে না পুণ্যাদাসী৷