পুণ্যধাম উজ্জয়িনীর পুণ্যকথা
পুণ্যধাম উজ্জয়িনী। কবির নগর উজ্জয়িনী। উজ্জয়িনী নগর পুণ্যভূমি কেন না এই নগরে মহাকালেশ্বরের অধিষ্ঠান। এই পুণ্যধামে শিবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের একটি লিঙ্গমূর্তি রয়েছে মহালেশ্বর মন্দিরে। এই লিঙ্গমূর্তিকে শিবের সাক্ষাত- মূর্তি মনে করা হয়। শিবের জ্যোতিরলিঙ্গের কাহিনি রয়েছে শিব পুরাণে। একবার ব্রহ্মা ও বিষ্ণু কলহে মত্ত হন কে তাদের ভিতরে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে। তখন মহেশ্বর শিব ত্রিভুবন ভেদ করে এক অন্তহীন আলোকস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হন। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এই জ্যোতির্ময় আলোকলিঙ্গের উৎস সন্ধানে একজন যান আকাশে একজন যান পাতালে। আকাশ-পাতালে খোঁজ করেও কেউই লিঙ্গের উৎস সন্ধান করতে পারেন না। কিন্তু ব্রহ্মা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য বিষ্ণুকে বলেন তিনি খুঁজে পেয়েছেন লিঙ্গের উৎস। বিষ্ণু মেনে নিলেন তা। শিব তখন আর এক জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আত্মপ্রকাশ করে মিথ্যা বলার জন্য ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিলেন যে কোনো অনুষ্ঠানেই ব্রহ্মার স্থান হবে না। তিনি পূজিত হবেন না। আর বিষ্ণুকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, তিনি অনাদি অনন্তকাল পূজিত হবেন। জ্যোতির্লিঙ্গ হলো সত্যের প্রতীক। সত্যম শিবম সুন্দরম – এই বাক্যই যেন জ্যোতির্লিঙ্গে উদ্ভাসিত। শিবই সত্যের অংশ। শিবই সুন্দর। এদেশের বারোটি মন্দিরে জ্যোতির্লিঙ্গ শিব আছেন। গুজরাতের সোমনাথ মন্দির, অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈলমের মল্লিকার্জুন, উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর, উজ্জয়িনীর নিকটবর্তী ওংকারেশ্বর, কেদারনাথ, মহারাষ্ট্রের ভীমশঙ্কর, বারানসীর বিশ্বনাথ, মহারাষ্ট্রের ত্র্যম্বকেশ্বর, দেওঘরের বৈদ্যনাথ, গুজরাতের দ্বারকার নাগেশ্বর, তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের রামেশ্বর এবং মহারাষ্ট্রের আওরাঙ্গাবাদের জ্যোতির্লিঙ্গ মূর্তি। উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর শিবের মুখ দক্ষিণ দিকে। গর্ভগৃহে মহাকালেশ্বরের অধিষ্ঠান। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে মহাকালেশ্বর শিবই উজ্জয়িনীর রক্ষাকর্তা। পুরাণে কথিত আছে, এই নগরের নাম ছিল অবন্তিকা। এই নগর ছিল শাস্ত্র শিক্ষার জন্য সুখ্যাত। আর ছিল ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ। অবন্তিকার রাজা চন্দ্রসেন ছিলেন শিবের উপাসক। অবন্তিকা নগর একবার আক্রান্ত হয় বহিঃশত্রু দ্বারা। চন্দ্রসেন পরাস্ত হয়ে শিবের কাছে প্রার্থনা করেন বিপর্যয় থেকে মুক্ত হবার জন্য। তখন শিবের আবির্ভাব হয় মহাকালেশ্বর রূপে, তিনি অবন্তিকা নগরকে শত্রুমুক্ত করেন। সেই থেকে তিনিই এই পুণ্যভূমির রক্ষা কর্তা। অবন্তিকা নগরের আর এক নাম হয় উজ্জয়িনী। উজ্জয়িনীর আর এক নাম আছে। বিশালা। উজ্জয়িনীর বড় উৎসব শিবরাত্রি। আর হয় কুম্ভ। মহাকুম্ভের সময় বৈশাখ। এখানে প্রয়াগ হরিদ্বারের মতো অর্ধ কুম্ভ হয় না। বারো বছর অন্তর পূর্ণ কুম্ভ। বৈশাখ মাসে সূর্য যখন মেষ রাশিতে, চন্দ্র তুলা রাশিতে এবং বৃহস্পতির অবস্থান সিংহ রাশিতে, তখন বারো বছর অন্তর সিংহস্থ। এই কুম্ভ স্নানের নাম সিংহস্থ। হরিদ্বারে কুম্ভের যে শাহি স্নান তা হয় দুপুরে, প্রয়াগে ভোরে, আর উজ্জয়িনীর শিপ্রা নদীতে কুম্ভের শাহি স্নান হয় গভীর রাতে। বৈশাখে এই পুণ্যধামে জলকষ্ট ভয়ানক। এমনি উত্তর পশ্চিমের এই মালব মালভূমির দেশে বছরে ১৪-১৫ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। বৈশাখে তাপমাত্রা হয় ৪৪ ডিগ্রি। তার ভিতরে সিংহস্থ কুম্ভ স্নানে সারা ভারতের পুণ্যারথীরা আসেন, শিপ্রায় জল নেই। শিপ্রা আসলে ছিল ক্ষিপ্রা নদী। তার সেই ক্ষিপ্রতা নেই। তবু সেই নদী মহাকালেশ্বরের নদী, মঙ্গলনাথের নদী, মহাকবি কালিদাসের নগরের নদী। আর এক নদী আছে এই নগরের উপকন্ঠে। খান নদী। সেই নদীও বিশুষ্ক প্রায়। মেঘদূত কাব্যে বর্ণিত গম্ভীরা নদী আছে এই নগরে কাছেই। সবই গ্রীষ্মে হারায় গতিপথ।
উজ্জয়িনী নগর পুণ্যধাম, কেন না এই নগর ভুবন শ্রেষ্ট মহাকবি কালিদাসের নগর। আমি খুব অল্প বয়সে যখন উজ্জয়িনী নগরের কথা পড়েছি কালিদাসের মেঘদূতম কাব্যে, ভেবেছিলাম এ বুঝি কবি-কল্পনার নগর। এই নগরের অস্তিত্ব নেই এই ভুবনে। এখন মনে পড়ে অতি প্রত্যুষে, তখনো উষার আলো ফোটেনি, বিলাসপুর ইন্দোর এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে নেমেছি উজ্জয়িনীতে। মার্চ মাস। ভোরে বেশ ঠাণ্ডা। স্টেশনেই দাঁড়িয়ে থাকত আব্দুল কিংবা ইসমাইলের বড় বড় শাদা ঘোড়ার টাঙ্গা। টাঙ্গায় চেপেই আত্মীয়গৃহে। আবার সেই টাঙ্গায় চেপে উজ্জয়িনী নগর পরিক্রমা ছিল এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। আর নগর পরিক্রমায় প্রথম দর্শন মহাকালেশ্বর মন্দির। এখন যা রুদ্র সাগর নামের এক হ্রদ কিংবা জলাশয়ের তীরে, প্রাচীন ভারতে তা ছিল গন্ধবতী নদীর তীরে। মেঘদূতম কাব্যে কালিদাস গন্ধবতীর কথাই বলেছেন। উজ্জয়িনী যেতে এখন শিপ্রা এক্সপ্রেস হয়েছে, সরাসরি চলে যায় সেই ট্রেন। তখন ভোপাল, উজ্জয়িনী, ইন্দোর যেতে আহমেদাবাদ এক্সপ্রেসে ইন্দোর বগি থাকত। বিলাসপুর কিংবা নাগপুরে ইন্দোর বগিটি বিলাসপুর ইন্দোর এক্সপ্রেসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হতো। ৩৬ ঘন্টা লাগত হাওড়া থেকে উজ্জয়িনী। উজ্জয়িনী মন্দির নগরী। মহাকাল তো আছেনই। আছে কালিদাসের শিপ্রা নদীর তীরে মন্দির আর মন্দির। সন্ধ্যায় শিপ্রার তীরে রাম ঘাটে সাধুদের স্তোত্র উচ্চারণ এবং প্রদীপ হাতে আরতি দর্শন এক বিরল অভিজ্ঞতা। কেন বিরল, না তার ভিতরেই বহুদূর থেকে ভেসে আসছে মগরিবের আজান ধ্বনি। সব কিছুই শান্ত। সব কিছুই পবিত্র। শিপ্রা তীরে হাঁটু মুড়ে নমাজ আদায় বসেছেন ধর্মপ্রাণ প্রবীণ। শিপ্রা তীরে বড় গণেশের মূর্তি, চিন্তামণি গণেশ, সিদ্ধ বট, হনুমান মন্দির যেমন আছে, শিপ্রাতীরে রয়েছে মঙ্গলনাথের মন্দির। মঙ্গলনাথ হলেন মঙ্গল গ্রহ। প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির এই নগরেই বাস করতেন। তিনি অঙ্ক কষেই নাকি মঙ্গল গ্রহকে খুঁজে পেয়েছিলেন প্রথম। এই শিপ্রাতীর থেকেই লাল তারাটিকে তিনি রাত্রির আকাশ-মণ্ডলে দেখতে পান। কল্পনাই হয়তো। কিন্তু সন্ধ্যায় আপনি যখন মঙ্গলগ্রহের মন্দিরের সামনে বসবেন শিপ্রাতীরে, মনে হবে তাইই সত্য। না মঙ্গলনাথ নিয়ে এখানে ধুমধাম নেই। মঙ্গলনাথ তাঁর মন্দিরে একাই থাকেন। তাঁরও লিঙ্গ মূর্তি। সমুখে একটি মেষ। দিনে একবার পূজারী এসে পুজো করে দিয়ে যায়। দরজার চাবি তাঁর কাছে। খুব কাছেই থাকেন তিনি। মন্দিরের ভিতরে সিঁদুর চর্চিত লিঙ্গ দেবতা মঙ্গলনাথকে আমি দেখেছিলাম। তিনি সামান্যতে তুষ্ট। মুসুর আর অড়হর ডাল দিন, দিন একটি সূর্যমুখী ফুল, মঙ্গলনাথ গ্রহণ করবেন। উজ্জয়িনী নগরে জ্যোতিষ চর্চা চলে রমরম করে। জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা আর জ্যোতিষ চর্চা তো এক নয়। কিন্তু জ্যোতিষ চর্চা নাকি এই নগরে অনেক প্রাচীন এক অভ্যাস। যাক সে কথা, মনে পড়ে সেই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যার কথা। শিপ্রাতীরে একাকী বসেই মনে হয়েছিল কিছু একটা কাছে এসে চলে যাচ্ছে। তা কি মন্দিরে অবহেলায় পড়ে থাকা দেবতা মঙ্গল গ্রহ? না, অন্য কিছু। আমার কাছে মঙ্গলময় কিছু আসছে, যা কিনা এই পুণ্যধামে এসে আমার অর্জন। মহাকালেশ্বর দর্শনে আমার অর্জন। সিদ্ধ বট, শিপ্রা নদী দেখে আমার অর্জন। কালিদাস একাডেমিতে সন্ধ্যায় সংস্কৃত নাটক অভিজ্ঞান শকুন্তলম দেখাও ছিল আমার অর্জন। লোক বিশ্বাস শিপ্রা তীরে গড় কালিকা মন্দিরে কালিদাস শিবের আরাধনা করতেন। সেই মন্দির দেখাও ছিল আমার অর্জন। হ্যাঁ, আমি অর্জন করে ছিলাম পুণ্য। এই ধাম দর্শনের পুণ্য। নির্জন মঙ্গলনাথের মন্দির, শিপ্রা নদী তীরের সেই সন্ধ্যাই আমাকে দিয়েছিল ধ্রুবপুত্র উপন্যাস লেখার ভাবনা। তারপর সেই লেখার জন্য কতবার যে গিয়েছি ওই নগরে। উজ্জয়িনী নগর অতি পুণ্যধাম। ওই নগরের মাটিই পুণ্য। আমি তো লিখতে পেরেছিলাম ঐ দূর দেশের জনপদটিকে নিয়ে যা ছিল আমার কাছে এক অলীক নগরীই। কালিদাসের মেঘদূতম কাব্যে যক্ষ মেঘকে উজ্জয়িনী নগর ঘুরে উত্তরে হিমালয়ের দিকে অলকা পুরীর পথে যেতে বলেছিল। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ স্মরণ করি।
জেনেছো, উত্তরে তোমার অভিযান; যদি বা পথ হয় বক্র,
ভুলো না দেখে নিতে উজ্জয়িনীপুরে সৌধসমূহের উপরিতল;
সেখানে সুন্দরী আছেন যাঁরা, তুমি তাঁদের চঞ্চল চাহনির
স্ফুরিত বিদ্যুতে না যদি প্রীত হও, হবে যে বঞ্চিত নিদারুণ।
(২৮ নং শ্লোক, পূর্বমেঘ)
অপরূপ বর্ণনা আছে এই পুণ্য ধামের। এই অবন্তী দেশে গ্রামবৃদ্ধেরা সন্ধ্যায় বসে বিশালা নগরীর পূর্ব গৌরবের কথা শোনায়। বলে বৎস্যরাজ উদয়ন এবং বাসবদত্তার প্রেমের কাহিনি। হে মেঘ তুমি চলতে চলতে ক্ষণিক বিশ্রামে যেও মহাকাল মন্দিরের মাথায়। মন্দ্র, গম্ভীর, শ্লাঘ্য নিনাদের পুণ্যফল অর্জন করবে তুমি মেঘ। আমি তো মেঘের গর্জন শুনিনি ঘোর শ্রাবণে গিয়েও। মনে হয়েছিল মেঘদূতম কাব্য যেন কবির বৃষ্টির প্রার্থনা মন্ত্র। বৃষ্টি নেই, তাই বৃষ্টির স্মৃতিকে ধরে রাখা। মালব মালভূমি আসলে অনাবৃষ্টির পৃথিবী। আর অনাবৃষ্টি, জলহীনতার বিরুদ্ধে মানুষের উৎসব যেন সিংহস্থ।
শিপ্রাতীরেই আছে ভর্তৃহরি গুম্ফা। এই গুম্ফা-গুহা নিয়ে যে কাহিনি আছে, তা না জানলেই নয়। ভর্তৃহরি ছিলেন উজ্জয়িনীর রাজা। তিনি প্রাচীন ভারতের কবি ভর্তৃহরিই হবেন অনুমানে। রাজমহিষীর সঙ্গে রাজার বৈমাত্রেয় ভাই বিক্রমের অবৈধ সম্পর্কের কথা জেনে রাজ্যপাট ত্যাগ করে তিনি এই গুম্ফায় আশ্রয় নিয়ে ২৪ বছর উপাসনা করেন গোরক্ষনাথের। বিক্রমাদিত্য উজ্জয়িনীর রাজা হলেন। আসলে তখন যিনি সিংহাসনে বসতেন, বিক্রমাদিত্য উপাধি তাঁরই হতো। উজ্জয়িনী নাথ যোগীদেরও তীর্থক্ষেত্র। উজ্জয়িনীতে সূর্যঘড়ি আছে। আছে পাঠান আমলের কেল্লা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। ছিল যে শাদা ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা, তা এখন নাকি নেই। অটোয় চেপে মহাকাল দর্শন হয় না। ফুলওয়ালারা বেশিরভাগ দেখেছিলাম মুসলমান। টাঙ্গাওয়ালারা তো নিশ্চয়ই। সে বড় সুখের পুণ্যধাম ছিল উজ্জয়িনী নগর। এখন যাইনি কতদিন। জানি মহাকালেশ্বর রক্ষা করেন। তিনি আছেন। তিনি উজ্জয়িনী নগরের সকল মানুষকে বাঁচিয়ে রাখেন। আমি ভাবি দেবতার কোনো ধর্ম নেই। ধর্ম নিয়ে দেবতার মাথা ব্যথা নেই। সব আছে মানুষের।