[১৯৯৪ শেষ হয়ে গেল। মানুষ বেঁচে আছে আশা নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে, আজও গান গায়, ছবি আঁকে, বিদেশে বেড়াতে যায়। ছাদের টবে ফুলগাছে ফুল ফোটে, আকাশে বাঁকা চাঁদ ভুলে যায় দু:খের সংসারে আলো দিলে দু:খটাই স্পষ্ট হয়। বোকা পাখি গান গায় সেই এক গান, সৃষ্টির আদিকাল থেকে যা সে গেয়ে আসছে, সেই এক ভাষা, এক নিবেদন। সবই আছে ঠিকঠাক, যেখানে যা কিছু ছিল, শুধু মানুষে মানুষ আর রইল না। তীব্রগতি, তিক্ত সংগ্রাম সব যেন খোঁড়া হয়ে গেল।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩.১.৯৫]
পুজোর পাঁচালি
দুটোই গেঁজে গেছে, পুজো ও প্রকৃতি। পুজোটা না হয় নাই রইল, শরৎটা গেল কোথায়! সেই রোদঝলমলে পাঁপরভাজা দিন! ঝলসানো নীল আকাশে ভারহীন, টুকরো সাদা, সুভদ্র মেঘ! কলকাতা-ভাসান সেই বিশ্রী, বিতিকিচ্ছিরি, সমাজবিরোধী, মহাতঙ্কের মেঘ নয়। মানুষের মতো ঋতুও বেসামাল। বর্ষা শিশিরস্নিগ্ধ শরৎকে এমন জড়িয়ে থাকে, মাঝেসাঝে তার মুখ দেখা গেলেও স্বাধীন স্বপ্রকাশ বড় একটা ঘটে না।
এমনও তো হতে পারে, সবই আছে ঠিক আগের মতোই, আমার বয়স বেড়েছে। মনটাই মাটি হয়ে গেছে। মনে হয়, তা নয়। জলরঙে আঁকা সেই ছলছলে সমাজ সভ্যতা আর নেই। এখন চড়া রঙের পোস্টার কালার। দগদগে, রগরগে। সহজ সরল জীবনদর্শন মুছে দিয়েছে যুক্তিবাদের কর্কশ হাত। মানুষ সব অন্য রকম। ভয়ঙ্কর তর্জনগর্জন। কেউ পুরুষসিংহ, কেউ বজ্রবাঘিনী, অনেক খ্যাঁকশিয়াল। দোষ নেই মানুষের। পরিস্থিতির চাপে এই রকম হয়ে গেছে।
খুব কম মানুষই ধর্মবিশ্বাসী। আমরা অধর্মবিশ্বাসী। মানুষের ধর্ম। সেই ধর্ম হল, চাই আমার চাই। জমিদারি চাই। আচ্ছা, তা যদি না হয়, কয়েক কাঠা জমি চাই। তাও যদি না হয়, একটা ফ্ল্যাট চাই। ফুলের মালা নয়, চাওয়ার মালা দুলছে গলে। গাড়ি, বাড়ি, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, ভোগ, যৌবন। এ গেল তো, পেছনে লাগতে চাই, সর্বনাশ করতে চাই, হামলা করতে চাই, পথের কাঁটা সরাতে চাই, কাজিয়া করতে চাই, ভিটেয় ঘুঘু চরাতে চাই। সেই স্বধর্ম এত প্রবল এখন, ধর্মকর্ম ঘুচে গেছে। ধর্ম বলতে যা বোঝায় তা আর নেই। ধর্ম এখন বিজ্ঞাপন। কাজে লাগার হলে, কপিটা সেইভাবে লিখি। বড় গুরু ধরে দীক্ষা নিই। ক্যালকাটা ক্লাবে ঢোকার মতোই, শিষ্যক্লাবে এনট্রি পাই। গুরু দেখে চ্যালার স্ট্যাটাস বোঝা যায়। তারপরে সুবিধে কত! কমিশনার আমার গুরুভাই! গুরুর বৃত্তে ব্যাবসার যোগাযোগ, মেয়ের বিয়ে, ছেলের চাকরি, চটজলদি কাজ বের করার সুযোগ ঘোরে। প্রয়োজনে ধর্ম ঢোকে রাজনীতিতে। প্রয়োজনে ধর্ম হয় সুবিধা ভোগের আলখাল্লা। প্রকৃত ধর্ম পড়ে আছে, মনে, বনে, কোণে। কিছু মানুষ নীরবে, নিভৃতে তার অনুসরণ করেন আত্মোন্নতির জন্যে, নির্মোহ হওয়ার জন্যে। ধর্ম সেখানে বিজ্ঞান। জল থেকে যেমন পরিস্রুত জল, মানুষ থেকে সেইরকম পরিস্রুত মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়াই ধর্ম।
এই যখন কথা, তখন দুর্গাপুজোকে, পুজো না বলে উৎসব বলাই ভালো। আর তাই বলাও হয়। এই আরাধনায় যে তত্বনিহিত আছে, তার সন্ধান কজনে করেন! প্রয়োজনই বা কী! বেদের নিরাকার শক্তি, পুরাণে সাকার। নিরাকারের ধ্যান জ্ঞানমার্গ। ভক্তিমার্গে যে একটি রূপ চাই। আমি সাজাব যতনে কুসুম রতনে। চিন্ময়স্যাদ্বিতীয়স্য নিষ্কলস্যাশরীরিণ:। উপাসকানাং কার্য্যার্থং ব্রহ্মণো রূপকল্পনা। ভক্তের জন্যে নিরাকারের সাকার হওয়া। একোইহং বহু স্যাম। আমি যেমন এক, মানুষের প্রয়োজনে আমি আবার বহু। ‘পুজা’ শব্দটা তো দ্রাবিড়দের । মানে পুষ্পকর্ম। বৈদিক ফলযজ্ঞ হল পশুকর্ম। ‘পুজা’ শব্দটি সংস্কৃতে স্থান পেল। উপকরণ ও উপচারে ভগবানের পূজা।
মূর্তি নিয়ে রাম-রাবণের মারামারির প্রয়োজন নেই। দুর্গা হলেন রাষ্ট্রের অধীশ্বরী। ঋগবেদের দেবীসূক্তেই আছে—অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাম। আমি তোমাদের রিপাবলিক। অনন্ত শক্তির প্রতীক মা দূর্গা। লক্ষ্মী—ধন। সরস্বতী—জ্ঞান। কার্তিক—বীরত্ব। গণেশ—সাফল্য। মহিষাসুর—অশুভের প্রতীক। ধনে, জ্ঞানে, বীর্যে, সাফল্য রাষ্ট্রকে শক্তিশালী হতে হবে, তা না হলে অশুভশক্তি গ্রাস করবে। রাজার পূজা দুর্গা পূজা। কলির অশ্বমেধ। সেকালের বড় লোকরা মহা সমারোহে স্বগৃহে দুর্গাপূজা করতেন। রাজসিক অহঙ্কার। একালে যাঁদের বাড়িতে পূজা হয় তাঁরাও বলতে ভোলেন না, বাড়িতে দোল, দুর্গোৎসব হয়। অর্থাৎ আমরা অভিজাত। ধারাটিকে ধরে রেখেছি। হে দেবি! তিষ্ঠ দেবিগণৈ: সহ। সপ্তমীর সকালে ঢাকের বাদ্যে নাচতে নাচতে কলাবউ চলেছেন স্নানে। গৃহস্বামী পরিজনসহ পশ্চাতে। সামনে ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছেন কুল-পুরোহিত। গায়ে নামাবলি, পক্ক কেশ। আলিঙ্গনে কলাবউ। আর-এক নাম নবপত্রিকা। উদ্ভিদ জগতের প্রতিনিধি। দুর্গারই প্রতীক। ন’টা গাছের চারা; কদলী, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম, অশোক, মান ও ধান। শ্বেত অপরাজিতা লতার বাঁধনে বাঁধা। প্রতিটি চারায় অধিষ্ঠান করছেন এক-একজন দেবী। কদলীতে আছেন ব্রাহ্মণী। কালিকা রয়েছেন কচুতে। হরিদ্রাতে দুর্গা। কার্তিকী জয়ন্তীতে। শিবা বেলের অধিষ্ঠাত্রী, রক্তদন্তিকা দাড়িম্বের। অশোকে রয়েছেন দেবী শোকরহিতা। মানে—চামুণ্ডা। ধানে—লক্ষ্মী।
বারোয়ারিতে এইসব ব্যাখার প্রয়োজন নেই। প্যান্ডেল খাটাও। মূর্তি বসাও। বাঁশের আড়ায় চোঙা ফিট করো। লাগাও পুজো। মাঠ হলে মাঠ। রাস্তার ধার হলে তাই সই। নর্দমার ওপর পাটাতন ফেলে বসিয়ে দাও গিরি-দুহিতাকে। তিষ্ঠ দেবিগণৈ: সহ। নাকে রুমাল দিন দেবি। পায়ের কাছে অসুর, আদেশ করুন। পুত্র, মার্ডার তো অনেক করলে, পাড়া-বেপাড়ার মস্তান রূপে, এই চারদিন তুমি মশা মারো। এবারে একটু বেশি সচেতন থেক, প্লেগের মাছি পায়ে না কামড়ায়। এরা চাল, কলা খাওয়াবে, টেটরাসাইক্লিন খাওয়াবে না।
জঞ্জালে ফোকাস মেরেছে। লাহা বাড়ির উঁচু ছাতে, চন্দননগরের আলোর শিম্পাঞ্জি সাইকেল চালাচ্ছে। পুজোর লার্জস্কেল, স্মলস্কেল আছে ইন্ডাস্ট্রির মতো। পাড়ার প্রাচীন বারোয়ারি মার খাচ্ছে। কর্মীর অভাব। একালের যুবকদের ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার সময় নেই। কিছু আধপ্রবীণ কোনও রকমে টিংটিং করে টিঁকিয়ে রাখছেন। দুর্গাপুজোর চেয়ে কালীপুজোয় প্রফিট বেশি। যুবসমাজ তাই কালীপুজোর দিকেই ঝুঁকছে বেশি। কালীকে বাসি করা যায় অনেকদিন। দুর্গাপুজোর প্রাচীন ঐতিহ্যের দিকে তাকিয়ে চাঁদা আদায়ে তেমন জুলুম করা যায় না। মা কালীর চাঁদা তোলায় দু-চারটে লাশ ফেলে দিলেও আপত্তি করার কিছু নেই। দুর্গা কালচার আর কালী কালচারে পার্থক্য আছে। এটা বুজুর্য়া, ওটা প্রলেটারিয়েট। কালীকে মাসখানেক ঝুলিয়ে রেখে খুব হল্লা করা যায়। ফাংশান তো থাকবেই। শাক্তমতে আহারাদির ব্যবস্থা।
দুর্গাপুজোর আনন্দ ছিল শিশু আর কিশোরদের। এক মাস আগে থেকেই, পুজো আসছে, পুজো আসছে, বলে নৃত্য। বর্ষা-ভেজা প্রকৃতি রোদে শুকিয়ে ক্রমশই খনখনে হয়ে উঠছে। খেলার মাঠের ছায়াঘেরা জায়গাটায় শামুকরা চরতে বেরিয়েছে। স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ল বলে। বারোয়ারিতলায় ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে। বাঁশের খাঁচা প্রায় কমপ্টি। আমরা চার-পাঁচজন বাঁশের আড়ায় উঠে এপাশ থেকে ওপাশ চোর-পুলিশ খেলছি। পণ্ডিতমশাই যেতে যেতে বলছেন, ‘শাখামৃগরা নেমে আয়। পড়ে গেলে পুজোটা যে শুয়েই কাটাতে হবে। দাঁড়া, তোদের বাড়িতে গিয়ে বলে আসছি।’ শোনা মাত্রই জমির ঊর্ধ্বে আমাদের ঝোলাঝুলি স্তব্ধ। বাড়িতে বললে, কি হয়, সেকালের শিশুদের, কিশোরদের জানা ছিল। সেকালের বাংলা মিডিয়াম পরিবারে কর্তাদের শাসনই ছিল প্রবল। আগে তো পেটা, তারপর দেখা যাবে চাইল্ড সাইকোলজি কী বলে। সেকালের মায়েরা সাপ্লাই লাইনে থাকতেন। পিতা মহেশ্বরকে নানা রকম আয়ুধ এগিয়ে দিতেন পেটাইয়ের জন্যে। কর্তরা অবশ্য জুতোটাই প্রেফার করতেন।
একালের ইংলিশ মিডিয়াম পরিবারের শিশু আর কিশোরদের মানসিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যথেষ্ট আদুরে। সপ্তাহে সপ্তাহে ওজন নিয়ে ছানা, কলার পরিমাণ অ্যাডজাস্ট করা হয়। মা দুর্গার চেয়ে, অরণ্যদেব, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান অনেক প্রিয়। কম্পিউটার নিয়ে নাড়াচাড়া করে। ওয়ার্লড কাপ, টেনিসের স্ট্যাটিসটিক্স কণ্ঠস্থ। হাতে লেডি বার্ড, ওয়াল্ট ডিজনি সিরিজের বই। কর্তারা মিউমিউ, গৃহিণীদের প্রবল শাসন। ভবিষ্যতের স্বপ্নে ছেলেদের মগজে জ্যামিং। বাহন সিংহ নয়, ঘোড়া। জয়েন্ট এনট্রানস, আই. এ. এস, কম্পিউটার, বায়োকেমিস্ট্রি, নিউক্লিয়ার ফিজিকস, আমেরিকা, জার্মানি। ঝুড়ি-ঝুড়ি লেটার। এক নম্বর কম তো আত্মহত্যা।
শিশু, কিশোরদের কলকলরোলে পাড়ার বারোয়ারি আর মাতে না। মায়ের পায়ের তলায় তিনি প্রবীন পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত। চওড়াপাড় সাদাশাড়ি-পরিহিতা প্রবীণা। বনেদি বাড়ির অবশিষ্ট প্রতিনিধি। পুরোনো সংস্কার, দেবদ্বিজে ভক্তির টিংটিং-য়ে প্রদীপ। বিমর্ষ ঢাকি একপাশে বেঞ্চিতে। আগে ফুল প্যান্ডেল হত, এখন কোয়ার্টার প্যান্ডেল। আদায় কমেছে কর্মীর অভাবে।
আজকাল আবার হাউসিং এস্টেট হয়েছে দিকে দিকে। সেখানেও বারোয়ারি। তবে অন্য চেহারা। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ। বিশাল যৌথ পরিবারের পুজোর মতো। মা দুর্গা ইন দি ক্যাম্পাস। অনেকটা প্রবাসে দুর্গাপুজোর মতো। উদ্বোধন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দু-চারটে রবীন্দ্রসংগীত। নাচের দিদিমণির পরিচালনায় ছোটদের নৃত্যানুষ্ঠান, কয়েক লেংথ আবৃত্তি। কর্তারা পাজামা, পাঞ্জাবি পরবেন। সহধর্মিণীদের উদ্ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি। টিনএজার মেয়েরা ঢিলেঢালা ইঙ্গবঙ্গ পোশাকে দোতলতার জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকবেন। পুজো সংখ্যার মাঝখানে আঙুলে পেজমার্ক। একটু বেলায় ঘুমভাঙার আলস্য মুখে চোখে। গোটাকতক ঝকঝকে গাড়ি ক্যাম্পাসের এখানে ওখানে। জিনস আর শার্ট-শোভিত যুবক শহরের অপর প্রান্তের কোনও বান্ধবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলবে, ‘কী করছিস, নাথিং নিউ। জাস্ট পাসিং টাইম। এইবার ম্যাথস নিয়ে বসব। এইমাত্র কাকাবাবুটা শেষ করলুম। তুই! ও স্টেটস থেকে দিদি এসেছে! বিকেলে বেরোবি, ফেস্ট, অ্যান্ড লাইটস, চাইনিজ।’
দত্তপুকুরে ছানা তৈরি হয়। সেখানে এক ছিটেও পাওয়া যাবে না। সব চলে আসে কলকাতায়। পাড়ায় পাড়ায় পুজো। শ্রীহীন পল্লিতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঢাক বাজে। রাস্তাঘাটে আলো জ্বলে না। দাঁত-বের-করা পথ, সুঁড়িপথ। আবর্জনার দুর্গন্ধ। শুনশান প্যান্ডেল। পুজোর সামগ্রী ছড়ানো ছিটানো। নিবুনিবু প্রদীপ। পাহারায় একটা নেড়ি কুকুর। অসহায় কোনও বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। ছানিকাটা চোখে পুরু লেনসের ফ্রেম-ভাঙা চশমা। প্রতিমার দিকে তাকিয়ে দেবীর রহস্য বোঝার চেষ্টা করছেন। পল্লির আর সব গেলেন কোথায়?
কেন? খাশ কলকাতায়। সেখানে সব লার্জস্কেল, বিগ বাজেটের পুজো। প্রতিমার চেয়ে প্যান্ডেলের আকর্ষণই বেশি? প্রতিমা তো সেই এক। দশটা হাত, পায়ের কাছে বুক-চেতানো অসুর। কোনও কোনও অসুরের সাহস একটু বেশি। মায়ের শরীর বেয়ে বুকের দিকে উঠতে চাইছে। সিংহের সেই বিচিত্র ভঙ্গি। মা কোথাও রাজস্থানি, কোথাও বাঙালি। কোথাও অজন্তা। নতুন কিছু নেই। বেশি কেরামতি করার সুযোগ কোথায়। দশটা হাত নিয়েই তো সমস্যা। ব্যাপারটা আবার যুদ্ধ। কেরামতি প্যান্ডেলে। পঞ্চাশ হাজারের প্রতিমা বসে আছেন পাঁচ লাখের প্যান্ডেলে। কয়েক হাজার বাঁশের খেলা। অত্যাশ্চর্য সব শিল্পকর্ম। ভাগাড়ে তাজমহল। লাল কেল্লা। আগ্রা ফোর্ট। হোয়াইট হাউস। ভিকটোরিয়া। ডেকরেটারদের পোয়া বারো।
শহরতলি শূন্য করে কাতারে কাতারে দর্শনাথী কলকাতায়। ট্রাক, টেম্পো, ভাড়া করে ছেলে আর মেয়ের দল হইহই শব্দে ছুটছে কলকাতায়। সারারাতের দাপাদাপি। প্যান্ডেলে ঢোকার জন্য বিশাল বিশাল লাইন। অসীম ধৈর্য। কেরোসিন তেলের লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে এই ধৈর্য রপ্ত হয়েছে। বাসের লাইন, নামি ডাক্তারের চেম্বারও সাহায্য করেছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারি, লাইনে তো দাঁড়াতে শিখেছি।
পুজোর একটা উলটো পিঠ আছে। সেই দিকটাই আসল। বিশাল বিপুল কেনাকাটা। মা এলেন কী গেলেন, সে সব কথা পরে ভাবা যাবে। আগে কেনাকাটা। গুঁতো গুঁতি, ধস্তাধস্তি। হোঁৎহোঁৎ করে সব চলেছেন। পিলপিল মানুষ। ঘেমে সপসপে। থেকে-থেকে কোল্ড ড্রিংকস। ধরছে গলা। ধরছে মাথা। শাড়িবিক্রেতা কাপড় মেলে ধরে বলছেন, সাতশো। দ্যাখেননি, অমুক পত্রিকায় অমুক মডেল পরেছিলেন। মাত্র একশো পিস তৈরি হয়েছে। এই একটাই আছে, আগেরটা টিভির অমুক ঘোষিকা নিয়ে গেলেন। দোকানে দোকানে মেয়েরা আসছেন, পত্রিকা নিয়ে, এই শাড়িটা—ঠিক এই শাড়িটাই চাই। এবারে ফ্যাশান এইটাই। এতটুকু দোকান। ঠাসা মহিলা। কাউন্টারে কাউন্টারে লাট, গাঁট উজাড়। কনুইয়ের কোঁতকা। হংসোমধ্যে বকো যথা। দঙ্গলে ঢুকেছেন এক পুরুষ। গলা উঁচিয়ে কেবলই বলে চলেছেন, দাদা, স্বর্ণকাতান আছে? নারীর দঙ্গলে, প্রমীলা কিংডমে কে শুনছে তাঁর কথা! ধ্যাৎ মশাই স্বর্ণকাতান!
লম্বা একটা লাইন। ঠাঠা রোদে। অতি শান্ত। ছপা-টি হাতে দুজন ভেড়া কন্ট্রোল করার মতো সামাল দিচ্ছেন। দরজায় ঢ্যাঙা একটা লোক, মুখে ময়দার মুখোশ। হাতে লাঠি, আর এক হাতে টুপি। ক্লাউন সেজে মশকরা করছে। টুপি থেকে লজেন্স নয়, ল্যজেন্সের মোড়ক নিয়ে বিতরণ করছেন।
তামাশাটা কী? জুতো কিনছেন বাঙালি! বাঙালির ধাতে এই ডিসিপ্লিন তো নেই। তাহলে! হবে না কেন? এ যে জুতো! প্রভুত্বের প্রতীক। পায়ে যেমন পরে, পিঠেও তেমনি পড়ে। দোকানের দরজা খুলে স্ট্রেচার বেরোচ্ছে। সাফোকেসানে মালিক স্বয়ং অজ্ঞান। অনেক কর্তাও এই পুজোর ঝাপটায় চেত্তা খাবেন। ব্যারোমিটার চড়ছে। বোনাস ফোনাস গিলে পারা এখন পঞ্চাশ হাজারে।
একালের পুজো হল, পারচেজ, বোনাস, বকশিশ, ফতুর, দেনা, টেনশন, হার্টবান, অন্তে সমালোচনা। এই কী একটা দেওয়া হল! বিজয়ার হলাহলি, গলাগলির ফিভার অনেক কমেছে। ওসব আর পোষায় না।
তাহলে রইলটা কী!
ওই যে কমার্স। বিশেষজ্ঞরা ঘুরছেন। পুজো দেখছেন। পয়েন্ট দেবেন। পুজোর ফার্স্ট প্রাইজ, সেকেন্ড প্রাইজ। চিত্তরঞ্জনের কোণে পুজোর বিশাল ব্যানার—ঠাকুর দেখুন। চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি, অমুক তমুক। প্রায় সিনেমার মতোই।
মা, তোমার কী খেলা! একতলা থেকে দোতলা সারা বাড়িতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। হরেক মাপের, হরেক বর্ণের পলিথিনের প্যাকেট, ব্যাগ। সব এসেছিল, শাড়ি, শালোয়ার, ছেলেমেয়েদের বহুমূল্য জামাকাপড়। সবাই গেছে চলে, পড়ে আছে খোল। পঞ্চাশ হাজারের পাওনা। যা দেবি! সর্ব ভূতেষু।