পুজোর ছুটি
সেই যে অনেকদিন আগে ছোটদের কাগজের এক পুজো সংখ্যায় কে একজন ছড়াকার ইনিয়ে বিনিয়ে লিখেছিল।
‘জানেন ছোটবাবু
আমার ছুটি নাই।’
সেই লোকটা ছড়া লিখে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি, কিন্তু তার ছড়ার এই ভাঙা পঙ্ক্তি দুটো এখনও আমার মাথার মধ্যে ঘোরে। বিশেষ করে যখন বৃষ্টিধোয়া ঝলমলে নীল আকাশে মাথানড়া তুলোর পুতুলবুড়োর সাদা চুলের মতো মেঘ আর পুরনো দিনের কটন মিলের নতুন ধোলাই ধুতির মতো ধবধবে ফিনফিনে সাদা রোদ সেই সঙ্গে বাতাসে উত্তরের হিম আভাস আমার কেমন যেন মনে হয় এ জীবনে ছুটি বড় কম, এমন ভাল ভাল দিন হেলায় চলে যাচ্ছে।
ইয়োর অনার, মি লর্ড, উকিলবাবু, ব্যারিস্টার সাহেব আমি আপনাদের হিংসে করি। মাস্টারমশাই, প্রফেসার স্যার আমি আপনাদের ঈর্ষা করি।
কত দীর্ঘ শারদীয় অবকাশ আপনাদের, আশ্বিনের আশ্চর্য দিনগুলি, তার শিউলির সৌরভ, শিশিরের স্নিগ্ধতা, তার আলোছায়ার কারুকাজ—সবই শুধু আপনাদের জন্যে। আমাদের জন্যে ভিক্ষুকের ভাঙা এনামেলের তোড়ানো বাটিতে পয়সা ছোড়ার শব্দের মতো টুংটাং সামান্য দু’-চারদিন।
ইংরেজ কবি এপ্রিল মাসের কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন, এপ্রিল হল নিষ্ঠুরতম মাস। সাদা বাংলায় এপ্রিল নয়, আশ্বিন হল নিষ্ঠুরতম মাস। মনে হয়, এই বুঝি সব ফিরিয়ে দিল, যা কিছু হারিয়ে গিয়েছিল জীবন থেকে। যা কিছু ভুলে গিয়েছিলাম, গন্ধময় কুসুম, শুভ্রতাময় মেঘ, হাস্যময় রোদ আর স্নেহময় শিশির—সবই ঘরের কাছে পৌঁছে দেয় আশ্বিন, কিন্তু পাওয়ার আগেই সব কিছু মিলিয়ে যায়, বেজে ওঠে ছুটি শেষের ঘণ্টা, তালা খোলে অফিসের দরজার।
পুজোর ছুটি মানেই বেড়াতে যাওয়া, বাক্স প্যাটরা বাঁধা, রেলের টিকিট কাটা, বাঙালির একটাই বিলাস, ভ্রমণ।
পরশুরাম তাঁর বিখ্যাত গল্প কচি সংসদে লিখেছিলেন,…‘আর বৃষ্টি হইবে না।…জলে স্থলে মরুৎ-ব্যোমে দেহ মনে শরৎ আত্মপ্রকাশ করিতেছে। সেকালে রাজারা এই সময়ে দিগবিজয়ে যাইতেন।…ভ্রমণের নেশা আমার মাথা খাইয়া…এই দারুণ শরৎকালে মন চায় ধরিত্রীর বুক বিদীর্ণ করিয়া সগর্জনে ছুটিয়া যাইতে। বড় বড় মাঠ, সারি সারি তালগাছ, ছোট ছোট পাহাড়, নিমেষে নিমেষে পট পরিবর্তন…’
বেড়ানো আবার একেকজনের একেকরকম। কেউ একই জায়গায় বছরের পর বছর যায়, কেউ একেক বছর একেক জায়গায় যায়।
প্রত্যেক বছর পুজোর ছুটিতে আমার এক প্রবীণ আত্মীয় হাজারিবাগে যেতেন, হাজারিবাগ ছাড়া তিনি আর কোথাও যাবেন না। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বারবার হাজারিবাগ কেন? একঘেয়ে লাগে না?’
তিনি বলেছিলেন, ‘একঘেয়ে লাগলে কী হবে, ওখানকার জল হাওয়ার কোনও তুলনা হয় না।’
আমি বলেছিলাম, ‘খুব ভাল জল হাওয়া?’
তিনি বললেন, ‘ভাল মানে কী? গত তিন বছরে ওখানে মাত্র পাঁচজন লোক মারা গেছে। তার মধ্যে তিনজন হল ওখানকার শ্মশানের ডোম, আর বাকি দু’জন হল কবরখানার মজুর। বেচারারা দিনের পর দিন কোনও কাজ না পেয়ে পয়সার অভাবে না খেয়ে মারা গেছে।’
এ অবশ্য নিতান্ত বাজে গল্প।
শুধু পুজোর ছুটি নয়, তবু আমার মতো করে বলছি।
এক সওদাগরি অফিসের বড় কর্তা অর্থাৎ মালিকের কাছে একবার জানতে চেয়েছিলাম, ‘আপনার অফিসের সাধারণ কর্মচারীরা, কেরানি পিওন—এঁরা বছরে কতদিন ছুটি পান?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘এক মাস।’
আমি সরকারি কাজে গিয়েছিলাম। আগে থেকেই কিছু কিছু খবর আমার হাতে ছিল, কর্মচারী ইউনিয়নগুলি সেসব তথ্য সরবরাহ করেছিল, আমি সেই তথ্যের ওপরে নির্ভর করে বললাম, ‘কিন্তু আমি শুনলাম, এক মাস নয়, বছরে পনেরো দিন ছুটি দেন আপনি।’
কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে, কিঞ্চিৎ চিন্তা করে তারপরে ব্যবসায়ী মহোদয় বললেন, ‘আপনি ঠিকই শুনেছেন কিন্তু ব্যাপারটা তো ঠিক তা নয়। ওরা পনেরো দিনের ছুটিই পায়, কিন্তু আসলে সেটা এক মাস।’
আমি বললাম, ‘ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
ভদ্রলোক বুঝিয়ে বললেন, ‘দেখুন, বছরে আমিও পনেরো দিনের ছুটি নিই। সেই পনেরো দিন আমি নেই, সুতরাং অফিস ভোঁ ভোঁ, এদেরও পুরো ছুটি। তাই পনেরো দিন প্লাস পনেরো দিন, এক মাস বলেছি।’
অনুমান করি, এবার পুজোর ছুটিতে খুব বেশি লোক বাইরে যাবেন না। কাগজে দেখছি দার্জিলিং যাওয়ার খুব ভিড়। কারণ দার্জিলিং নিরাপদ। কাশ্মীর পাঞ্জাব যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া অসম বা শিলং যেতেও অনেকে ভরসা পাচ্ছেন না। উত্তর, পশ্চিম বা দক্ষিণ ভারতেও রেল অবরোধ, সড়ক অবরোধ। কোথাও গিয়ে, পৌঁছিয়ে নামতেই হয়তো দেখা যাবে সেদিনই আটচল্লিশ ঘণ্টার বন্ধ ডাকা হয়েছে।
যাঁদের টাকা পয়সা আছে, তাঁরা যদি এই পুজোর ছুটিতে ব্যাঙ্কক বা সিঙ্গাপুর, ইউরোপ বা আমেরিকায় যান তাঁদের কথা আলাদা। তবে আমাদের মতো লোকের পক্ষে এই পুজোয় কলকাতায় থাকাই সবচেয়ে সোজা ও ভাল; অন্তত পুজোর কয়দিন যে কলকাতায় কোনও গোলমাল হবে না, এমনকী হয়তো লোডশেডিং পর্যন্ত নয়—একথা কলকাতার অতি বড় নিন্দুকেও জানে।
সুতরাং কোথাও যাব না, গলিতেই থাকব।
পুজোর ছুটির পর কেউ হয়তো জানতে চাইবেন, ‘পুজোর ছুটিতে পুরী যাবেন বলেছিলেন, কেমন লাগল পুরী?’
আমি বলব, ‘পুরী তো গতবছর যাওয়ার কথা ছিল, গতবছর পুরী যাইনি। এ বছর তো দিল্লি যাব বলেছিলাম।’
তিনি হয়তো জানতে চাইবেন, ‘কেমন লাগল এবার দিল্লিতে?’
আমি ম্লান হেসে বলব, ‘দিল্লিও যাইনি।’