পুজোর আয়োজন সহজ নয়
ছেলেবেলায় আমার এক পাড়াতুতো দাদাকে দেখেছিলাম। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। সমাজসেবী। চোখে মুখে ভীষণ একটা গম্ভীর ভাব। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘এয়ার’, সেইরকম একটা এয়ার নিয়ে ঘুরতেন। তাঁর নিজস্ব ‘লেটারপ্যাড’ ছিল। ‘লেটারপ্যাড’ থাকা ভীষণ এক গৌরবের ব্যাপার ছিল আমাদের চোখে। একটা মানুষের গৌরব কোনও-কোনও জিনিস বাড়ায়! বাড়ির বাইরে পাথরের ফলকে বাড়ির নাম। নিজের নাম লেখা কার্ড। লেটার-হেড আর ফোন। এর যে-কোন একটা থাকা মানে, সে সাধারণ নয়। আমার এই দাদার লেটারহেডে লেখা ছিল, নিজের নাম ঠিকানা আর তার পদ। পদমালা বিশেষ, যেমন, সম্পাদক, দরিদ্র বান্ধব ভান্ডার, সহসম্পাদক, কিশোর গ্রন্থাগার, কোষাধ্যক্ষ, নবপল্লী ব্যায়ামাগার, সভাপতি, বাইশপল্লী সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি। আমরা হাসাহাসি করতুম।
পরে বুঝেছিলুম, বারোয়ারি পুজো পরিচালনা করার মতো ঝকমারি কাজ আর দুটো নেই। এ সকলের দ্বারা সম্ভব নয়। চিফ মিনিস্টারকে যদি বলা হয়, মশাই এবারের পাড়ার পুজোটা আপনি দয়া করে আয়োজন করে দিন না। আপনার এত বড় সংগঠনী ক্ষমতা! দেখা যাবে তিনি পারবেন না। দেশ চালানো এক জিনিস, পুজো চালানো এক জিনিস। যেমন সাইকেল চালানো আর মটোর গাড়ি চালানো। মটোর চালাতে পারে বলেই সাইকেল চালাতে পারবে, এমন কোনও কথা নেই। দুটো দু-ধরনের ম্যানেজমেন্ট।
পুজো ঠিকমত করতে হলে, প্রথমেই চাই একটা বারোয়ারি পুজো কমিটি। পুজো আসার আগেই সেই কমিটি তৈরি করতে হবে। কে করবে! কেউ না কেউ করবে! একজন বেশ শাঁসালো ভদ্রলোককে সভাপতি করতে হবে। যাঁর বেশ ইনফ্লুয়েনস আছে, নাম আছে, দাপট আর ব্যাঙ্ক ব্যালেনস আছে। বলি না দিলে পুজো হয় না। ওইরকম একজন কারোকে প্রথম চোটেই বলি দিতে হবে। এখন কে গলা বাড়াবে! বাড়াবে না। গলাটাকে টেনে আনতে হবে। পয়সা আছে, এইবার একটু নামের মোহ হয়েছে। বোঝাতে হবে ওপর দিকে ওঠার প্রথম ধাপ হল পুজো কমিটি, তারপর স্কুল কমিটি, তারপর কমিশনার কি, কাউন্সিলার, তারপর এম এল এ। তার মানে মাকে ভালো করে সেবা করো। সেই জোরে সোজা রাইটার্স। ছোট-খাটো একটা মন্ত্রী। এই ষড়যন্ত্রটা আগে করে নিতে হবে, দু-চার জনে মিলে একপাশে বসে। ভুল বানান, ঠিক বানান, যে কোনও বানানে একটি চিঠি তৈরি করে পাঠাতে হবে। এইটাকেই বলা যেতে পারে এ-কালের বোধন।
এই প্রসঙ্গে বলে নি, পুজো দু-রকমের—গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী। গণতান্ত্রিক ধাঁচে ডিকটেটারশিপ। এলাকার বিশেষ একজনকে একেবারে সাম্রাজ্য শাসনের কায়দায় গদি খুলে বসতে হবে। তার নামটাকে আগেই নানারকম কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে একটু ভীতিপ্রদ করে তুলতে হবে। ছোটদের ঘুম পাড়াবার সময় মা যেমন বলতেন—ওই জুজু আসছে। স্বৈরাচারী পুজো হবে বড়-বড় কারবারিকে বেশ করে দোহন করে। কিছু করার নেই। যে-পুজোর যেমন নৈবেদ্য। চাঁদার পরিমাণ হাজার এক থেকে শুরু। প্রতিনিধি বলবে, ছাড়তে হয় ছাড়, তা না হলে শরীর খারাপ হবে। আজকাল দু-রকমের মায়ের ভোগ চালু হয়েছে—এক, চাল-কলা, ফল-মূল, নৈবেদ্য আর এক হল টাটকা মানুষ, যাকে পুজো ছাড়াই মায়ের ভোগে পাঠান যায়। হয় চাঁদা দাও, না হয় মায়ের ভোগে যাও।
সে যাই হোক পুজো হল টাকার পুজো। সবার আগে কামাই। তারপর সাফাই। ইংরেজি শব্দটা বড় মনে আসছে—’শেভিং’। বাংলার উচ্চারণগত ভাবে দুটো মানে হবে। এক হল সঞ্চয় আর এক হল চুল-দাড়ি কামানো। এই শেষোক্ত কামানোর ওপরেই কি বড়, কি ছোট, কি টিং টিং-এ সব পুজো নির্ভর করছে। এই ক্ষৌরকর্মটি হল—বাড়ি-বাড়ি ঘুরে, দোকানে-দোকানে ঘুরে চাঁদা আদায়। অনেকটা খাজনা আদায়ের মতো। মায়ের জমিদারির গোমস্তারা বেরিয়ে পড়ল আদায়ে। এর জন্যে ব্যাটেলিয়ান চাই। যে-পুজোর উদ্যোক্তা বেশ ভয় পাইয়ে দেবার মতো কোনও মানুষ, তাঁর অনেক সুবিধে। চাঁদা হেঁটে-হেঁটে চলে আসে। আর দাতারাও বেশ বড়-বড়। মধ্যবিত্ত পাড়ার খাঁটি বারোয়ারির অনেক অসুবিধে। প্রধান অসুবিধে হল লোকবল। প্রথমত, গত বছরের আয়-ব্যয়ের হিসেব সহ শ্রী শ্রী দুর্গাশরণং। একটু ছোটমতো একটা সাহিত্য করতে হবে। আনন্দময়ীর আগমনে সুধি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। পিছনে, আয় এত টাকা ব্যয় এত টাকা, একেবারে কাটায়-কাঁটায় মেলানো। প্রতিমা থেকে শুরু করে দশ পয়সার সিদ্ধি পর্যন্ত। এদিকে খরচ, ওদিকে বিলবই গতে আদায় অত টাকা। হিসাব পরীক্ষক যে কেউ হতে পারে, পাঁচুদাস খামরুই থেকে গদাই নস্কর। প্রথমে এই প্যামফ্লেটটি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ফেলে আসতে হবে। একে বলে, জানান দেওয়া। গেরস্থ প্রস্তুত হও, মা আসছেন, মানে আমরাও আসছি। পরবর্তী পর্যায় হল, ঝোলাঝুলি, টানাটানি, চটি ক্ষয়াক্ষয়ি। এ-বাড়ি থেকে সে-বাড়ি। কড়া নাড়ো, বেল টেপো, গলাবাজি করো। মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা কমছে কি না কে জানে! বাবা চাঁদাটা চাওয়ামাত্রই দিয়ে দিলুম, যা চাইলুম তা দিলুম, তা নয়। এ যেন ভিক্ষে চাওয়া। আজ নয় কাল এসো, সকালে নয় বিকেলে এসো। মা এখন বাড়ি নেই। বাবা এখন বাড়ি নেই।
বিলবই হাতে ঘুরতে-ঘুরতে পায়ের খিল খুলে যাবার যোগাড়। তারপরে আবার কতরকমের ইন্টারভিউ। লাস্ট ইয়ারে কত দিয়েছিলুম। বিলের কাউন্টারপার্ট আছে? অনেকে আবার নিজেরাই বিল ফাইল করে রাখেন। এত বড় একটা গন্ধমাদন এনে খুঁজতে লাগলেন, তাঁতিপাড়া সার্বজনীন দুর্গোৎসব সংঘ। পরিশ্রমের কারণ—গত বছরে দু-টাকা দিয়ে থাকলে, এ বছরেও তাই দেবেন। শুরু হল, কচলাকচলি। রগড়ারগড়ি। সব কিছুর দাম বাড়ছে —প্রতিমা, প্যান্ডেল, পুরোহিত মায় হিন্দিগান বাজাবার খরচ। এই বোঝাতে গিয়েই যত তর্কাতর্কি ঝগড়াঝাঁটি। আসলে অধিকাংশ মানুষ বারোয়ারি পুজোকে ভাবেন জোচ্চুরি। ধর্মের নামে চাঁদা আদায় করে কিছু চ্যাংড়া ছেলের ক-দিনের ফূর্তি। ভাবমূর্তিটা নষ্ট হয়ে গেছে। চাকরিবাকরি করে পাড়ার প্রাচীন পুজো সামলাবার অনেক হ্যাঁপা। দোরে-দোরে ঘুরে চাঁদা আদায়ের সময় দাঁড়ায় রাত আটটা থেকে এগোরোটা । মানুষ ভীষণ বিরক্ত হন। মাঝ-রাতে চাঁদা চাইতে এসেছে।
চাঁদার পরেই সমস্যা হল—প্যান্ডেল, প্রতিমা, ডেকরেশান, মাইক, পুজোর জোগাড় দেবার পূণ্যবতী মহিলা। পুজোর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়তেই হবে। লোকসংখ্যা বাড়ছে। নতুন-নতুন কলোনি হচ্ছে। ডেকরেটারদের পোয়া বারো। অনেক তেল দিলে তবেই প্যান্ডেলে কিছুটা চেকনাই আসে। প্রতিমা আনতে হবে প্রতিমা পাড়া থেকে লরি করে। এর জন্যে লোকবল চাই। আলোর জন্যে পারমিশান নিতে হবে। ইলেকট্রিসিয়ানরা বিদ্যুতের মতোই চপলা-চঞ্চলা। চেপে ধরতে হবে, মা যেমন ধরেছিলেন মহিষাসুরকে। দশমীর দিনই বিসর্জন। পুলিশের আইন বড় কড়া। সেখানেও তদবির চাই। মাকে ধরে রাখার জন্যে কয়েকদিন। এরপর সেই নিরঞ্জনী সমারোহ। বাদ্য-বাজনা সহকারে—আসছে বছর আবার হবার প্রতিশ্রুতি।
সব শেষে একদিন একটু ফাংশান। একটা কথা—চেষ্টা চরিত্র করে দুর্গাদেবীকেও যদিও পর্বত থেকে মর্তে নামানো যায়, উদ্বোধনের জন্যে কোনও স্বনামধন্য সাহিত্যিককে টলানো যায় না। তাঁরা জানেন না মায়ের ক্যাডারে মা সরস্বতীও আছেন। সব চেয়ে মজার কথা ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন—যত মত তত পথ। এখন হয়েছে, যত বাঙালি তত দলাদলি। পুজো হবে, না নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি হবে।