পুংপুজো
সতীদাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু নারীবিরোধী অনেক প্রথাই বেশ বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে এই ভারতীয় উপমহাদেশে। এসব দুর করার কোনও উদ্যোগ তো নেওয়া হচ্ছেই না, বরং আরও ঘটা করে পালন করার ব্যবস্থা হচ্ছে, আরও জাঁকালো উৎসব হচ্ছে। এসবের। কিছুদিন আগেই বাঙালি হিন্দু মেয়েদের সিঁদুর খেলা হল। দুর্গা-প্রতিমা। বিসর্জনের দিন পরস্পরের মাথায় মুখে গালে কপালে চিবুকে নাকে কানে সিঁদুর মাখামাখি চললো। এই উৎসবটা মূলত– স্বামী দীর্ঘজীবী হোক, অনন্তকাল বেঁচে থাকুক, স্বামীর অসুখ-বিসুখ না হোক, দুর্ঘটনা না ঘটুক, স্বামী সুস্থ থাকুক, কস্মি নকালেও না মরুক, আমাদের যা-ইচ্ছে-তাই হোক, আমাদের সুস্থতা গোল্লায় যাক, আমাদের দীর্ঘজীবনের বারোটা বাজুক-এর উৎসব। বিধবা আর অবিবাহিতদের জন্য সিঁদুর খেলা বারণ। বারণ, কারণ তাদের স্বামী নেই! মাথায় তাদের সিঁদুর ওঠেনি, অথবা সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্ক দুজন মানুষ বিয়ে করলো, দিব্যি একজনের শরীরে শাঁখা সিঁদুর পলা লোহার উপদ্রব চাপানো হয়, আরেকজনের শরীর আক্ষরিক অর্থে রয়ে যায় যেমন ছিল তেমন। কেউ কি এই প্রশ্নটি করে যে, যে কারণে বিবাহিত মেয়েরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে, সেই একই কারণে কেন বিবাহিত পুরুষেরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে না? অথবা যে কারণে বিবাহিত পুরুষেরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে না, সেই একই কারণে কেন বিবাহিত মেয়েরা ওসব পরা থেকে বিরত থাকছে না?
সাফ কথা হলো, পুরুষ বিশ্বাস করে এবং নারীকেও বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটি, মানুষ প্রজাতির মধ্যে পুরুষ নামক যে প্রাণীটি আছে, তার উরুসন্ধিতে দুই বা তিন ইঞ্চি দৈর্ঘের যে লিঙ্গটি ঝুলে থাকে, সেটি। সেটি যাদের আছে, তাদের গায়ে কোনও উপদ্রব চাপাতে হয় না। তাদের জী বন-সঙ্গী বা স্ত্রীটির সুস্থ থাকার জন্য, তার পরমায়ুর জন্য কোনও ব্রত পালন করতে হয় না, তার ধনদৌলত লাভের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করার কোনও আচার অনুষ্ঠানে করতে হয় না, স্ত্রীর মঙ্গলকামনায় তাদের দিনভর উপোস করতে হয় না, সিঁদুর খেলতে হয় না, যেমন স্ত্রীদের খেলতে হয় স্বামীর মঙ্গলকামনায়! পুরুষেরা বরং বেশ জমিয়ে নারীকূলের পুংলিঙ্গ পুজো দূর থেকে উপভোগ করে। পুরুষতা ন্ত্রিক সমাজে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যে যে পুজোটি চলে, সে পুংলিঙ্গ পুজো। পুরুষেরা সমাজের ঈশ্বর, সমাজের মহাশক্তিমান, মহাক্ষমতাবান, পুরুষেরা নারীর প্রভু, অভি ভাবক, অধীশ্বর, নারীর কর্তা, দেবতা। পুরুষের আরও শক্তি, আরও ক্ষমতা, আরও প্রভাব, প্রতাপ এবং প্রাচুর্য বৃদ্ধির জন্য, পুরুষের দীর্ঘজীবন এবং অমরত্বের জন্য, নারীদের, দুর্বলদের, দুর্ভাগাদের, দলিতদের, নির্যাতিত, নিপীড়িতদের উপোস করতে হয়, প্রার্থনা করতে হয় ভগবানের কাছে। পুরুষের মঙ্গলকামনায়, সুখকামনায়, স্বা স্থকামনায় ভাইফোঁটা, শিবরাত্রি, রাখী, শ্রাবণ সোমবার– কত কিছুই না সারাবছর পালন করছে নারীরা।
নারী শিক্ষিত হচ্ছে, এমনকী স্বনির্ভর হচ্ছে, স্বামীর ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা অনেকের প্রায় নেই বললেই চলে, স্বামী ছাড়া চলবে না– এমন কোনও ব্যাপারই নেই, এমন নারীও পুরুষতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থাগুলো দিব্যি মাথা পেতে মেনে নিচ্ছে। কেউ প্রশ্ন করছে না, বিয়ের পর কেন নারীর পদবী পাল্টাতে হবে, পুরুষের পদবী নয়? কেন নারীকে তার শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে হবে, কেন স্ত্রীর মতো পুরুষের কর্তব্য নয় শ্বশুরবাড়িতে বাস করা আর শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করা? পণের নিয়ম যদি পালন করতেই হয়, তবে শুধু স্ত্রী কেন স্বামীকে দেয়, স্বামী কেন স্ত্রীকে পণ দেয় না? যার আছে, তারই শুধু চাই চাই! গোটা সমাজ তাকেই ঢেলে দিচ্ছে, তাকেই ভরে দিচ্ছে, যার অনেক আছে। অত্যাচারীকে করছে আরও দ্বিগুণ অত্যাচারী। ছলে বলে কৌশলে মেয়েদের দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা, তার ওপর ধরে বেঁধে যোগ করা হয়েছে শারীরিক আর মানসিক পরনির্ভরতা।
ভারতবর্ষের বেশ কিছু রাজ্যের বিবাহিত মেয়েরা করবা চৌথ পালন করে। সূর্যোদয় থেকে চন্দ্রোদয় অবধি স্বামীর সুস্বাস্থের জন্য উপোস। চাঁদ দেখবে তবে জলস্পর্শ করবে লক্ষ লক্ষ পতিতা স্ত্রী। এটিও ওই পুংপুজো। এই সব আচার অনুষ্ঠানের একটিই সারকথা, সংসারে স্ত্রীর নয়, স্বামীর জীবনটি মূল্যবান। দরিদ্র অশিক্ষিত-পরনির্ভর মেয়েরা নয়, পুরুষতান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠানগুলো বেশির ভাগই পালন করছে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়েরা। এই মেয়েরাই কিন্তু আজকাল ধর্ষণ এবং অন্যান্য নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে খুব সরব, কিন্তু সিঁদুর খেলা বা করবা চৌহ পালন করছে রীতিমত উৎসব করে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, করবা চৌথ, সিঁদুর খেলা– সবই পুরুষতন্ত্রের নারীবিরোধী উপসর্গ। একসময় ধর্ষণকে অপরাধ ভাবা হত না, ইদানীং ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে ধর্ষণকে ভয়াবহ অপরাধ বলে ভাবা হয়। যদি করবা চৌথএর বিরুদ্ধে মিডিয়া মুখর হয়, মানুষ পথে নামতে থাকে, করবা চৌথকেও বড় অন্যায় কাজ বলে ভেবে নেবে বেশির ভাগ মানুষ। নারীবিরোধী এসব অনুষ্ঠান নিয়ে আজকাল তুমুল বাণিজ্যও হচ্ছে। করবা চৌথের চোখ ধাঁধানো উৎসব এখন সিনেমায়, থিয়েটারে, টিভি সিরিয়ালে। বিজ্ঞাপনে পু রুষতান্ত্রিক আচারাদিতে অলংকৃত লাস্যময়ী নারীদের ঝলমলে দৃশ্য। যে মেয়েরা দূর থেকে দেখে এসব, দুঃখ দুর্দশার জীবন যাদের, তাদের ইচ্ছে হয় সাজগোজ করা ফর্সা ফর্সা সুখী সুখী মেয়েদের মতো উৎসব করতে তারাও একসময় বাণিজ্যের ফাঁদে পাদেয়, শাড়ি গয়না কেনার ফাঁদে। এমনিতেই এই সমাজ মেয়েদের পণ্য বলে ভাবে। পুংপুজোর আচারে অংশ নিয়ে মেয়েরা নিজেদের আরও বড় পণ্য করে তোলে। এসব করে যত বেশি পুরুষকে মূল্যবান করে মেয়েরা, ততবেশি নিজেদের মূল্যহীন করে। পুরুষতান্ত্রিক অসভ্যতাকে, অসাম্যকে, লিঙ্গবৈষম্যকে, নারীবিরোধিতাকে, নারীবিদ্বে ষকে, নোংরামোকে কেবল সহনীয় নয়, আদরণীয় আর আকর্ষণীয় করার পায়তারা চলছে চারদিকে। যেসব রাজ্যে করবা চৌহ পালন হতো না, এখন সেসব রাজ্যেও। পালন হয়। পুরুষতন্ত্র বড় সংক্রামক।
মানুষ সামনে এগোয়। সভ্য হয়। বৈষম্য ঘোচায়। সমাজ বদলায়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে মেয়েরা যত শিক্ষিত হয়, যত নিজের পায়ে দাঁড়ায়, ততই পিতৃতন্ত্রকে মাথায় তুলে নাচা হয়, ততই ধর্মের ঢোল বাজানো হয়। ওপরে ওপরে মনে হয় সমাজ বদলেছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হাজার বছরের পুরোনো সমাজ তার পচা গলা শরীর নিয়ে অন্ধকারে ঠায় বসে আছে, তাকে নাড়ায় সাধ্য কার?
এই সমাজ নারীকে নানাভাবে উৎসাহিত করে পুরুষতন্ত্রের শিকার হতে। পুরুষের অধীনতা মেনে নিলে সমাজ নারীকে বাহবা দেয়। নিজের অধীনে নয়, নারী যেন কোনও না কোনও পুরুষের অধীনে থাকে। নারীর অধীনতাকে বা পরাধীনতাকে নারীর গুণ হিসেবে ধরা হয়। গুণবতী নারী হওয়ার এই পুরস্কারটি যার জোটে, সমাজ তার ওপর খুব খুশি থাকে। সমাজকে খুশি করতে মেয়েরা যে করেই হোক চায়। কারণ একে অখুশি রেখে বা অসন্তুষ্ট রেখে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব।
পুংরা যে সমাজে প্রতিদিন বধূহত্যা করছে, বধূনির্যাতন করছে, ধর্ষণ করছে, গণ ধর্ষণ করছে, কন্যাশিশু হত্যা করছে, সেই সমাজে আড়ম্বর করে মেয়েরাই পুংপুজো। করছে। পুংপুজোর দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি। পুংদের বোধোদয় কি আদৌ ঘটবে কোনওদিন? পুংআধিপত্যবাদের কৌশল শিখে বেড়ে ওঠা পুরুষেরা কি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবে যা শিখেছে সব? ঝেড়ে না ফেললে সমানাধিকারের শিক্ষাটা গ্রহণ করায় যে খুব মুশকিল হবে!সমানাধিকারের কোনও চর্চাই নেই নারী পুরুষের সম্পর্কে। পুরুষ মনে করে তার পুরুষত্ব খানিকটা খসে গেলে বুঝি অপমান হবে তার, নারী মনে করছে তার নারীত্ব কিছুটা কমে গেলে রক্ষে নেই। এক একজন প্রাণপণে বজায় রাখতে চায় পুরুষ আর নারীর জন্য সমাজের বানানো কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পুরুষত্ব, আর নারীত্ব। যদি ধরেই নিই পুরুষের ভেতর তথাকথিত এই পুরুষত্ব আর নারীর ভেতর তথাকথিত এই নারীত্ব আছে, তারপরও কিন্তু নিশ্চয় করে বলা যায় যে পুরুষের ভেতরে যা আছে তার একশভাগই পুরুষত্ব, নারীর ভেতরে যা আছে তার একশভাগই নারীত্ব– এ সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সমাজ চোখরাঙায় বলে পুরুষ প্রকাশ করতে চাইছে না তার ভেতরে যেটুকু নারীত্ব আছে সেটুকু। নারীকে প্রকাশ করতে বাধা দেওয়া হয় তার ভেতরের পুরুষত্বটুকু। যদি সমাজের বাধা না থাকতো, যদি সত্যি সত্যি খুলে মেলে ধরতে পারতো নিজেদের সত্যিকার চরিত্র, তাহলে সমতা আসতো সম্পর্কে। পুরুষও কষ্ট পেলে হু হু করে কাঁদতো, শিশুপালন করতো, ভালোবাসার মানুষকে বেঁধে খাওয়াতো, তার শাড়ি কাপড় কেচে ইস্ত্রি করে রাখতো। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যে মাথার ওপর বসে খবরদারি করছে। পুরুষকে শুধু নৃশংসতা করে যেতে হবে, নারীকে শুধু সর্বংসহার মতো সয়ে যেতে হবে। যতই যা হোক, নারী কিন্তু প্রমাণ করেছে পুরুষ যা পারে নারীও তা পারে। নারী পুরুষের মতোই পোশাক পরতে পারে, পুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে পারে, পুরুষের মতোই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারে, মহাশুন্যে পাড়ি দিতে পারে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে বাণিজ্য করতে যেতে পারে। পুরুষ কিন্তু আজও প্রমাণ করতে পারছে না নারী যা পারে, তা পুরুষও পারে। ঘরদোর সাফ করা, সংসারের রান্নাবান্না করা, খাবার পরিবেশন করা, শিশুর লালন পালন এখনও করছে না পুরুষেরা। যতদিন না করবে, ততদিন এ কথা বলার উপায় নেই যে সংসারে বৈষম্য নেই। যতদিন সমাজে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র টিকে আছে, ততদিন এই সমাজ কাউকে সমতার আর সমানাধিকারের দিকে হাত বাড়াতে দেবে না। হায়ারার্কি বা স্তরতন্ত্র কিন্তু গড়ে উঠেছে পেট্রিয়ার্কি বা পিতৃতন্ত্রের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই। স্তরতন্ত্রে অধীনতা এবং আধিপত্যের অবসান ঘটানো, অথবা ক্ষমতার উঁচু নিচু স্তরকে ভেঙে সমান করে দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব করতে হলে স্তরতন্ত্রটাকেই আগেবাতিল করতে হয়। নারী পুরুষের সমতাও পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তি না হলে কখনও সম্ভব নয়। পণপ্রথা বন্ধ করো, ধর্ষণ বন্ধ করো, বধূ নির্যাতন বন্ধ করো বলে বলে সারাবছর চেঁচালেও এসব উপসর্গ কখনও উবে যাবে না। যতদিন রোগটা আছে, উপসর্গগুলো ঘাপটি মেরে থেকেই যাবে। রোগটা সারাতে হবে।