গৌড়ানন্দ কবি ভনে

পি ডি এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন

পি ডি এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন

[সদ্য লোকান্তরিত পি ডি এ-র শ্রাদ্ধবাসরে তাঁহার ওয়ারিশানগণ কর্তৃক আচার্য গৌড়ানন্দ কবি কর্তৃক বিরচিত এই সশ্রদ্ধ নিবেদন পঠিত হইবে।]

আমাদের পরমারাধ্য প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, পাবলিকের নিকট যিনি পি ডি এ নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন, আমাদিগকে অকুল শোকসাগরে ভাসাইয়া সাধনোচিত ধামে গমন করিয়াছেন। কিছুকাল যাবৎ তাঁহার স্বাস্থ্য বিশেষ ভাল যাইতেছিল না। তিনি যে কোন্ কালব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়াছেন, শেষ পর্যন্ত তাহা নির্ণয় করা গেল না। যদিও শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকগণ বেশ কিছু দিন পূর্বেই আশা ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, তথাপি তাঁহার শোকসন্তপ্ত ওয়ারিশ হিসাবে আমরা আশা ছাড়িতে ভরসা পাই নাই।

হায় আশা কুহকিনী! কাল পূর্ণ হইলেও আশা ছাড়িতে চাহে না। জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? কবির এই সতর্ক বাণী সতত কৰ্ণে বাজিলেও মায়াবদ্ধ জীব ইহাকে এই প্রপঞ্চময় সংসারে কখনোই আমল দিতে চাহে না। তাই আমাদের পরমারাধ্য পি ডি এ তাঁহার অস্তিত্বের অবিনাশী ছত্রচ্ছায়ায় আমাদিগের অস্তিত্বকে নিরবধি কাল অবধি ঢাকিয়া রাখিবেন, হায় মুঢ় আমরা মনের কোণে এমন একটি আম্বা সযত্নে লালন করিয়াছিলাম! ভাবিয়াছিলাম পি ডি এ-র ছাতা আড়াল দিয়া আমরা সাপের গালেও চুমু খাইব ব্যাঙের গালেও চুমু খাইব, গাছেরও খাইব তলারও কুড়াইব, ডুডুও খাইব টামাকও খাইব, সরকারের শরিকও হইব, আবার অপজিশন অপজিশন খেলা খেলিয়া নিজেদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল রাখিব, কংগ্রেস দলের শ্রাদ্ধ করিব আবার প্রগতিশীল কংগ্রেসীদের যথাস্থানে চুমু-কুড়ি দিয়া পুলকের রোঁয়া চাগাইয়া তুলিব, কেহ টের পাইবে না। হায়, বিধি বড় দারুণ! খেলা সাঙ্গ হইবার পূর্বেই ঘুঁটি গুটাইয়া লইতে হইল। অকালে অকূলে ভাসাইয়া পরমারাধ্য পি ডি এ আমাদিগকে ছাড়িয়া চিরবিদায় গ্রহণ করিলেন।

এই তো সেদিনের কথা। সন ১৯৭২ সাল। সাধুদিগের পরিত্রাণ এবং দুর্জন দিগের বিনাশ নিমিত্ত আমাদের পরমারাধ্য পি ডি এ সাকিন কলিকাতায় ভূমিষ্ঠ হইলেন। এবং গণতান্ত্রিক ভোট ব্যবস্থায় প্রগতিশীল রণকৌশল প্রয়োগ করিয়া মারি পারি যে কৌশলে নীতিতে দুর্জনদিগকে ধরাশায়ী করিলেন। পবিত্র সতের দফার কেতন উড়াইয়া পি ডি এ পশ্চিমবঙ্গের রাজদণ্ড হাতে লইলেন। সেই ডামাডোলে পি ডি এ-র প্রসাদে আমরা ছত্রিশটা আসন পাইয়া ছোট তরফের গৌরব গায়ে মাখিয়া ছাগলের তৃতীয় বৎসের স্থানটি অধিকার করিলাম। আমাদের পি ডি এ-র বড় তরফ নিজেই যে প্রথম ও দ্বিতীয় বৎসের স্থান লইয়া স্থায়িভাবে ছাগী মাতার দুইটি বাঁটের সকল দুগ্ধ চুষিয়া লইবে এবং আমাদিগকে তাহা দেখিয়া শুধুই তৃতীয় বৎসের ন্যায় অহৈতুকী আহ্লাদে তিড়িং তিড়িং করিয়া লাফাইতে হইবে, ইহা গোড়ায় বুঝিতে পারি নাই।

তাই পরমারাধ্য পি ডি এ-র ছত্রতলে থাকিবার সুযোগ লইয়া কেবলই কৌশল খাটাইতে হইল। সেই কৌশলেরই নীট ফলে একটি অত্যাশ্চর্য পলিটিক্যাল ইকোয়েশন সৃষ্ট হইল। উক্ত পলিটিক্যাল ইকোয়েশন হইল ইহাই:

কংগ্রেসী + প্রগতিশীল কংগ্রেসী = গদিনশিন কংগ্রেসী

লোকে জানিত জোড়া বলদ আদি কংগ্রেসই দক্ষিণপন্থী অথবা প্রতিক্রিয়াশীল এবং নব কংগ্রেস ওরফে গাইবাছুর কংগ্রেস ওরফে ইন্দিরা কংগ্রেস ওরফে গদিনশিন কংগ্রেস = প্রগতিশীল কংগ্রেস। আমাদের কৌশলেই লোকে বুঝিতে শিখিল ইন্দিরা কংগ্রেস = গদিনশিন কংগ্রেস = কংগ্রেসী + প্রগতিশীল কংগ্রেসী। এবং প্রগতিশীল কংগ্রেসী = কমরেড কংগ্রেসী + আমাদিগের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন কংগ্রেসী ওরফে প্রিয় কংগ্রেসী।

পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসী রাজনীতিতে আমাদিগের পরমারাধ্য পি ডি এ-র এইটিই হইল মোক্ষম অবদান। আজ পি ড়ি এ নাই। তবু তাঁহার শোকসন্তপ্ত ওয়ারিশগণের নিকট ইহাই বড় সান্ত্বনা যে তাঁহার অক্ষয় কীর্তিটি বহিয়া গেল। পশ্চিমবঙ্গে আজ কংগ্রেস বলিয়া কোনও অখণ্ড সত্তা নাই। আছে শুধু ডায়েলেকটিক্‌স্‌ অর্থাৎ প্রিয় কংগ্রেসী এবং অপ্রিয় কংগ্রেসীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। এই দ্বন্দ্বই আমাদিগের শোকের সান্ত্বনা ভবিষ্যতের ভরসা। ইহাই পরমারাধ্য পি ডি এ-র স্পিরিট। আজ যদিও পি ডি এ নাই এবং সেই কারণে আমরা শোকার্ত তথাপি পি ডি এ-র স্পিরিট আছে এই সত্য আমাদিগকে গভীর শোকের অকূল দরিয়া পার করিয়া সান্ত্বনার আলোকিত প্রোজ্জ্বল কূলে পৌঁছাইয়া দিবে। আমরা সত্যের ভূমিতে দণ্ডায়মান হইয়া দৃঢ়ভাবে বলিতে পারিব ‘পি ডি এ নোহসি।’ পি ডি এ তুমি আছ।

আমরা বলি বটে যে, বিচ্ছেদ হইয়াছে, কিন্তু সত্যের সহিত কখনোই আমাদিগের ওইরূপ বিকার জন্মে।

অতএব ‘পি ডি এ নোহসি’ এই সত্য গ্রহণ করিলে কোনও শোকই আমাদিগের উপর মোহ বিস্তার করিতে পারিবে না। সর্বদাই আমরা উপলব্ধি করিতে পারিব পি ডি এ আছেন, তবে আমরা তাঁহাকে দেখিতে পাইতেছি না, এই মাত্র তফাৎ। এতদিন তিনি আমাদিগের চোখের বাহিরে ছিলেন, আজ হইতে পি ডি এ আমাদিগের অন্তরে স্থিত হইলেন। তাই কবি গাহিয়াছেন, ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।’

উপনিষৎ বলিয়াছেন, ‘সূক্ষ্মাচ্চ তৎ সূক্ষ্মতরং বিভাতি।’ অর্থাৎ তিনি সূক্ষ্ম হইতেও সূক্ষ্মতর বিবিধ রূপে প্রকাশ পান। আবার এই কথাও বলা হইয়াছে :

‘দূরাৎ সুদূরে তদিহান্তিকে চ
পশ্যাৎস্বিহৈব নিহিতং গুহায়াম্।।’

অর্থাৎ তিনি (অজ্ঞানীর নিকট) দূর হইতেও সুদূরে, আবার (জ্ঞানীর নিকট) এই দেহেই অতি নিকটে অবস্থিত : দ্রষ্টাদিগের নিকট দেহস্থ হৃদয়-গুহাতেই তিনি নিহিত আছেন। ইহাতে তাঁহার প্রভাব আদৌ খর্ব হইল না, বরং আরও বাড়িয়া গেল। এখন তিনি শুধুমাত্র আমাদের অর্থাৎ তাঁহার মুষ্টিমেয় কয়েকজন ওয়ারিশানগণের অধিকারে রহিলেন না। তিনি সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর বিবিধ রূপে প্রকাশ পাইতে থাকিবেন। আমাদের প্রিয় কংগ্রেসীদিগের নিকট তিনি প্রিয়তর হইবেন। যে সকল কংগ্রেসী প্রিয়তর ছিলেন তাঁহাদিগের প্রিয়তম হইবার পথ আরও প্রশস্ত হইল। এবং তাঁহার অলক্ষ্য প্রভাবে আমাদের এবং আমাদের প্রিয়দিগের এবং প্রিয়তরদিগের এবং প্রিয়তমদিগের মিলনের পথ আরও খুলিয়া গেল। এবং অপ্রিয় কংগ্রেসীদিগের সহিত আমাদিগের এবং আমাদের প্রিয় গোষ্ঠীর সংঘাত অনিবার্য হইয়া উঠিল আমরা যেন এই সত্যকে প্রসন্ন মনে আমাদের পরমারাধ্য পি ডি এ-রই করুণার দান বলিয়া গ্রহণ করি।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিং শান্তিঃ।।

১৯ জুন ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *