পিশাচ – মঞ্জিল সেন
ডাক্তারি জীবনে বহু রোগীর সংস্পর্শে আসতে হয়েছে আমাকে; বিচিত্র মন, বিচিত্র চরিত্রের মানুষ দেখেছি, তাই এখন আর নতুন কোন রোগী আমার মনে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু রাঘব সামন্তকে দেখেই কেন জানি আমি বেশ একটা ধাক্কা খেলাম। আমার মনের ঠিক অনুভূতিটা বুঝিয়ে বলা মুশকিল—কেমন যেন গা ঘিনঘিন আর গা শিরশির করা অনুভূতি। যেন একটা জীবন্ত মৃতদেহের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
গোড়া থেকেই শুরু করি। আমার চেম্বারের কিছু দূরেই একটা মেসবাড়ি। ওখানকার কিছু বাসিন্দা আমার রোগী, মাঝে মাঝে তাই ওখানে যেতে হয় আমাকে। হঠাৎ একদিন বর্ষার রাতে ফাঁকা চেম্বারে বসে উঠব উঠব করছি, এমন সময় মেসের মালিক স্বয়ং হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। দিন কয়েক হল এক নতুন বোর্ডার এসেছেন তাঁর মেসে, ভদ্রলোক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, গুরুতর কিছু বলেই মনে হচ্ছে, আমাকে এখুনি যেতে হবে। যেতে হল।
ছোট্ট একটা চিলেকোঠা ঘরে রোগী শুয়ে আছে। পরে মেসের মালিকের মুখে শুনেছিলাম ভদ্রলোক কারো সঙ্গে ঘর ভাগাভাগি করে থাকতে চাননি, যত হোট বা খারাপই হোক না কেন, ঘরটা সম্পূর্ণ তাঁর চাই, তার জন্য যত বেশি টাকা দিতে হোক না কেন, তিনি রাজী। তেমন কোন ঘর ছিল না, শেষ পর্যন্ত চিলেকোঠা ঘরটার জঞ্জাল পরিষ্কার করে ভদ্রলোককে দেয়া হয়। তিনি খুশিই হয়েছিলেন।
ভদ্রলোক মেসে আসার পর থেকে এ ক’দিন কোথাও বেরোননি। কারো সঙ্গে বিশেষ একটা কথাও বলেননি। ওই ছোট্ট ঘরে দরজা বন্ধ করে নিজেকে যেন বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চেয়েছেন। মেসের চাকর ঘরে খাবার দিয়ে আসে, খাবার জন্যে নিচেও নামেন না তিনি।
আজ একটু আগে রাতের খাবার দিতে গিয়ে ছোকরা চাকর দেখে, ভদ্রলোক মাটিতে পড়ে আছেন—মুখটা হাঁ হয়ে আছে, দু’চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তার চিৎকারে লোকজন ছুটে আসে। নাড়ীর গতি এত মৃদু যে, মনে হয় জীবন-মরণের একটা লড়াই চলছে। ভয় পেয়ে মালিক ভদ্রলোক ছুটে এসেছেন আমার কাছে। মেসে কেউ মারা গেলে সেটা মেসের পক্ষে বদনাম, তাই তাঁর দুর্ভাবনাটাই বেশি।
মালিকের সঙ্গে তাঁর মেসবাড়িতে যেতে হল। যদিও আগে অনেকবারই এখানে এসেছি কিন্তু চিলেকোঠায় কখনো আসিনি। সত্যিই একচিলতে ঘর। তক্তপোশের ধারে মাটিতে যিনি পড়ে আছেন, তাঁকে দেখে আমি চমকেই উঠলাম, সারা শরীরে কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল।
মাথার চুলের ডান দিকটা ধবধবে সাদা, কিন্তু বাঁ দিকটা কালো। মুখে অসংখ্য বলিরেখা। অথচ আমার মনে হল, ভদ্রলোককে যত বুড়ো দেখাচ্ছে, তত বুড়ো নন তিনি, অকালে বুড়িয়ে গেছেন। গায়ের রং ফ্যাকাশে, যেন কেউ রক্ত শুষে নিয়েছে। কেমন যেন একটা মৃত্যুর গন্ধ, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
ভদ্রলোকে শরীর বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে পরীক্ষা করে আমি কিন্তু রোগটা কি, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। প্রথমে ভেবেছিলাম হার্ট অ্যাটাক, কিন্তু ব্লাডপ্রেসার স্বাভাবিক। নিজের বিদ্যে-বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতায় মনে হল, ওসব ব্যাপার নয়। যা হোক, তখনকার মত চাঙ্গা করে তোলবার মত ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করলাম। ভদ্রলোক পরদিনই খাড়া হয়ে উঠলেন। আমি একটু অবাকই হলাম। আগের রাত্রে অমন একটা অবস্থার পর এত তাড়াতাড়ি তিনি সামলে উঠবেন, এ আমি আশাই করতে পারিনি। যা হোক, পরদিন তাঁকে দেখতে যেতেই, তিনি আমাকে বসতে বললেন। আমি লক্ষ্য করলাম, ভদ্রলোকের চোখের সাদা অংশটা একটু বেশি প্রকট, চাউনিতে কেমন একটা অস্থিরতা। আমাকে তিনি একদৃষ্টিতে লক্ষ্য করছেন দেখে, আমার অস্বস্তি হতে লাগল। সেটা কাটাবার জন্যে আমি তাঁকে পরীক্ষা শুরু করলাম। সব কিছুই স্বাভাবিক।
আমার পরীক্ষা শেষ হতেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘আপনি ডাক্তার?’
প্রশ্নটা শুনে আমি থতমত খেলাম। আমার গলায় স্টেথিস্কোপ, হাতে ব্লাডপ্রেসার মাপার যন্ত্র, এতক্ষণ যত্ন করে পরীক্ষা করলাম, তারপরেও অমন প্রশ্নের কারণ কি হতে পারে।
ভদ্রলোক নিজেও বোধ হয় প্রশ্নটার অসারতা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই বললেন, ‘মানে…আমিও একসময় ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখতাম, বছর তিনেক পড়েও ছিলাম।’
‘তাই নাকি!’ আমি এবার কৌতূহল নিয়ে তাকালাম, ‘ছেড়ে দিলেন কেন?’
‘ছাড়তে হল…সে অনেক কথা।’ ভদ্রলোক হঠাৎ আমাদের কথায় যেন ছেদ টানতে চাইলেন। আমি ইঙ্গিতটা বুঝে, ও প্রসঙ্গ নিয়ে আর এগোলাম না।
এ ঘটনার দিন তিনেক পর, ভদ্রলোক হঠাৎ আমার চেম্বারে এসে হাজির হলেন। বর্ষার রাত, সেদিনও চেম্বার বন্ধ করে উঠব উঠব করছিলাম। ভদ্রলোককে দেখে মোটেই খুশি হলাম না আমি, কেন, তা অবশ্য জানি না।
ভদ্রলোক এটা ওটা কথার পর আমার সম্বন্ধে নানান প্রশ্ন করতে লাগলেন। কোন্ মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেছি, কোন্ কোন্ প্রফেসারের কাছে পড়েছি, আমার পরিচিতদের মধ্যে কারা ডাক্তার হিসাবে নাম করেছেন, এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন। বলা বাহুল্য, আমি বিরক্তিই বোধ করছিলাম। হঠাৎ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, ডাক্তার অনাথ চৌধুরী নামে কাউকে চেনেন?’
‘ডাক্তার অনাথ চৌধুরী!’ আমি বেশ অবাক হয়েই বললাম, ‘তিনি তো প্রথম সারির একজন সার্জেন। চিনতেন নাকি আপনি তাঁকে?’
‘হ্যাঁ, একসময় আমার সঙ্গে তাঁর খুবই জানাশোনা ছিল।’
‘কিন্তু ওঁর বয়স তো আপনার মত হয়নি…’
ভদ্রলোক হা হা করে হেসে উঠলেন: ‘ওখানেই আপনার ভুল!’ সি থামিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার চাইতে বয়সে উনি বেশ কিছু বড়ই হবেন। আমার শরীর ভেঙে পড়েছে, তাই বেশি বয়স দেখায়… নয়তো আমারও একসময় জোয়ান চেহারা ছিল। হ্যাঁ, বেশ ভাল রকমই জোয়ান চেহারা ছিল আমার।’
আমার দৃষ্টিতে বোধ হয় অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠেছিল, তা লক্ষ্য করে ভদ্রলোক বললেন, ‘না, আমি আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছি না।’ তারপরই একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘যদি অনাথ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়, তবে জিজ্ঞেস করবেন, রাঘব সামন্তের স্বাস্থ্য কেমন ছিল।’ বলেই আবার হা হা করে হেসে উঠলেন।
বিশ্রী হাসি। আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। রাত হয়ে যাচ্ছে বলে উঠে পড়লাম।
এর পর রাঘব সামন্ত মাঝে মাঝে আমার চেম্বারে আসতেন। ভিড় থাকলে এক কোণে চুপ করে বসে থাকতেন। সবাই চলে যাবার পর আমার মুখোমুখি বসে শুরু করতেন নানান কথা। একদিন হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, আপনারা তো হাল আমলের ডাক্তার, আপনাদের সময় কাটা-ছেঁড়ার জন্য ডেডবডির বোধ হয় তেমন অভাব ছিল না।’ তারপর নিজেই সে প্রশ্নের জবাব দিলেন,‘ হবেই বা কি করে, আজকাল কথায় কথায় লোকে ছুরি চালায়, বোমা মারে। মানুষ মারা এখন ডাল-ভাত হয়ে গেছে। ডেডবডির অভাব নেই, অনেক ক্ষেত্রেই সেসব বডির কোন দাবিদার থাকে না, ফলে মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের সুবিধে হয়েছে। আমাদের সময় এত খুন-জখম ছিল না, ডেডবডিও ছড়িয়ে পড়ে থাকত না। রীতিমত সমস্যা ছিল ডেডবডি পাওয়া, মাঝে মাঝে ডিসেকশান বন্ধ হয়ে যাবার মত অবস্থা হত।’
শরতের মাঝামাঝি রাঘব সামন্ত মারা গেলেন। সেবারেও মেসের ছোকরা চাকর সকালবেলার চা নিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কোন সাড়া না পেয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, ভদ্রলোক মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। মুখটা একটু হাঁ করা, কয়েকটা মাছি ভন্ভন্ করছে মুখের সামনে।
আমি চেম্বারে আসতেই আমার ডাক পড়ল। এবার কিন্তু আর ভুল ছিল না, ভদ্রলোক মারাই গেছেন এবং করোনারি অ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েছে। সার্টিফিকেট লিখে দিতে আমি কোন দ্বিধা করলাম না।
পরের দিন মেসের মালিক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁর হাতে একটা বড় পুরু লেফাফা। ওটা তিনি আমার হাতে দিলেন। আমি লেফাফার ওপর লেখাটায় চোখ বুলিয়ে অবাক হলাম। লেখা আছে, ব্যক্তিগত, আমার মৃত্যুর পর এটা যেন ডাক্তার বিমল ব্যানার্জিকে দেওয়া হয়।
রাতে বাড়ি ফিরে আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে লেফাফাটা খুললাম। আমার স্ত্রী সুষমা, দিন কয়েকের জন্য বাপের বাড়ি গেছে, আমি একা।
প্রথমেই একটা চিঠি।
‘প্রিয় ডাঃ ব্যানার্জি,
আপনি হয়তো ভেবে অবাক হচ্ছেন, এত লোক থাকতে আপনাকেই কেন আমি আমার জবানবন্দি শোনাবার জন্য বেছে নিলাম। আসলে, সত্যিই আমি একদিন ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। যদি আমার জীবনে ওলটপালট না ঘটত, কিংবা যদি ডাঃ অনাথ চৌধুরী আমার জীবনে শনি হয়ে দেখা না দিত, তবে হয়তো আজ আমি একজন সফল ডাক্তার হিসাবে মানুষের জীবন বাঁচাবার মহৎ পেশায় ব্যস্ত থাকতাম। কিন্তু শনি আর রাহু এই দুয়ের মিলন ঘটেছিল আমার ভাগ্যের ঘরে, তাই…যোক, সে কথা। আপনাকে দেখে আমার জীবনের স্বপ্নের কথা মনে পড়েছে, আপনাকে কেন জানি ভাল লেগেছে। তাই আমার জীবনের বিচিত্র কাহিনী আপনার হাতে দিয়ে গেলাম। যদি অবিশ্বাস হয়, তবে ডাঃ অনাথ চৌধুরীকে প্রশ্ন করতে পারেন, সেই সঙ্গে তার মানসিক প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করবেন। তবে সাবধান, তার পথ মাড়াবেন না, সে শুধু লোভী নয়, নিষ্ঠুর। কত বড় নিষ্ঠুর, তা এই কাহিনী থেকেই জানতে পারবেন।
আমার শুভেচ্ছা রইল।
ইতি—
রাঘব সামন্ত
আমার কৌতূহলের লাগামটাকে যেন সামলাতে পারছি না। পাতা উল্টে আসল কাহিনী শুরু করলাম।
‘সে আজ অনেক বছর আগের কথা, যদূর মনে পড়ে, সালটা ছিল ১৯৪৪। দেশ তখনো স্বাধীন হয়নি। ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে আমি ডাক্তারি পড়ি। ছোটবেলা থেকে চট করে কিছু বুঝে নেবার ক্ষমতা ভগবান আমাকে দিয়েছিলেন। তার ওপর ছিলাম পরিশ্রমী, মাস্টারমশাইদের মান্য করে চলতাম, তাই সহজেই তাঁরা আমার প্রতি সদয় হতেন, সহজেই বিশ্বাস করতেন আমাকে। ছাত্র হিসাবেও খারাপ ছিলাম না। আমি যে একদিন ডাক্তারি পাশ করে বেরোব, ডাক্তার হব, এ বিষয়ে মাস্টারমশাইয়ের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না—আমার তো নয়ই।
‘ডাক্তার পাল ছিলেন তখন অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান। নামটা ইচ্ছে করেই আমি গোপন করলাম, কারণ তাঁর তখন দারুণ খ্যাতি, এ কাহিনীর সঙ্গে তাঁকে আর জড়াতে চাই না। মিটফোর্ড হাসপাতাল আর মেডিক্যাল স্কুল ছিল পাশাপাশি, একটা সরু রাস্তা মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। ওই রাস্তার ওপরেই একটা বাড়িতে থাকতেন ডাক্তার পাল। তখন ওই রাস্তায় আর কোন বাড়ি ছিল না। বাড়িটার সদর দরজা দিয়ে বেরোলে হাসপাতালের পাঁচিল আর খিড়কির দরজা দিয়ে বেরোলে মেডিক্যাল ইস্কুলের পাঁচিল। খিড়কির দরজার কয়েক হাত দূরে পাঁচিলের গায়ে একটা দরজা ছিল, ওটা দিয়ে ডাক্তার পাল মেডিক্যাল স্কুলে যাতায়াত করতেন, অনেকটা ঘুরপথ বেঁচে যেত। রাত্তিরে ওই দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝুলত, আর তার চাবি থাকত ডাক্তার পালের কাছে। ওই দরজা দিয়ে ঢুকে খানিকটা গেলে, বাঁ দিকে টিনের ছাউনির টানা লম্বা একটা ঘর। ওখানেই অ্যানাটমি ক্লাস নিতেন ডাক্তার পাল। মড়া কাটা-ছেঁড়া করে সার্জারিতে হাত পাকাত তরুণ সব ছাত্ররা—ভাবী কালের শল্যচিকিৎসক।
‘ডাক্তার পালের বাড়িটা বেশ বড়, আসলে ওটা ছিল হাসপাতালেরই সম্পত্তি। মেডিক্যাল ইস্কুলে পড়ানো ছাড়াও হাসপাতালের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। অ্যানাটমির সব কিছু দায়িত্ব, এমন কি কাটা-ছেড়ার জন্যে মড়া যোগাড় করার ভারও ছিল তাঁর ওপর। ডাক্তার পাল অবশ্য নিজে মড়া যোগাড় করতেন না, তার জন্যে অন্য লোক ছিল, একটা খরচও বরাদ্দ ছিল, কিন্তু তাঁকে সব কিছুর হিসেব রাখতে হত।
‘আমি এসময় ডাক্তার পালের সুনজরে পড়ে গেলাম, তখন আমার সবে তৃতীয় বছর চলছে। অ্যানাটমি ক্লাসের সব দায়িত্ব আস্তে আস্তে তিনি আমার ওপর ছেড়ে দিতে লাগলেন। ঘরটা ছিল লম্বা। ওই ঘরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ছাত্রদের মধ্যে ঠিকমত লাশ ভাগ করে দেওয়া, ঠিকমত হিসেব রাখা এবং যারা লাশ নিয়ে আসে তাদের পাই-পয়সা চুকিয়ে দেওয়া, এসবই তিনি আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন।
‘একটা কথা আগেই বলে রাখি। বৈধভাবে কাটা-ছেঁড়ার জন্যে যে লাশ আমরা পেতাম, তা মোটেই পর্যাপ্ত ছিল না, ফলে প্রায়ই আমাদের চোরা পথে ওটা সংগ্রহ করতে হত, না করে উপায় ছিল না। এসব কিন্তু আসত গভীর রাতে। ডাক্তার পালের খিড়কির দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ থেকে বুঝে নিতে হত যে চালান এসেছে। যারা নিয়ে আসত, তাদের দিয়েই ডিসেকশান রুমে বডিটা নিয়ে, তাদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে আবার পাঁচিলের দরজাটা বন্ধ করে দেবার কাজটা আমার ওপরেই পড়ল। একটা খাতায় হিসেব লিখে রাখতে হত, আর যারা শব নিয়ে আসত, তাদের পাওনা মেটাবার জন্য একটা টিনের বাক্সে সব সময় বেশ কিছু টাকা জমা থাকত। এ প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বলা ভাল, যারা মড়া নিয়ে রাতের আঁধারে চুপি চুপি আসত, তাদের চেহারা এক নজরে দেখেই বুঝতে অসুবিধে হত না যে, তারা অন্ধকার জগতের মানুষ, খুন রাহাজানি এসবই তাদের পেশা। প্রথম প্রথম আমার ভয় করলেও, পরে ব্যাপারটা আমার গা সয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া দরদস্তুরের পর পাওনা টাকা হাতে নিয়ে যখন তারা আমাকে সেলাম করত, তখন আমার নিজেকে খুব শক্তিমান পুরুষ বলেই মনে হত। ডাঃ পাল আমাকে তাঁর বাড়ির একতলায় থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি বড় বাড়ি, ডাক্তার পালের পরিবারের লোকজন কম থাকায় একতলাটা প্রায় খালিই পড়ে ছিল, বিশেষ করে খিড়কির দরজার দিকের অংশটায় আমি ছাড়া আর কেউ থাকত না।
‘ব্যবস্থাটা যে আমার পক্ষে খুব সুখকর হয়েছিল, তা মোটেই নয়। শীতকালে গভীর রাতে কিংবা ভোর রাতে কড়া নাড়ার শব্দে আমাকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হত। ঘুম জড়ানো চোখে হাতড়ে হাতড়ে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে কদর্য চেহারার গুপ্তশ্রেণীর লোক, তাদের সঙ্গে রয়েছে, ‘মাল’, যা দিয়ে সাজানো হবে শবব্যবচ্ছেদের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড টেবিল, শিক্ষানবিসী ছাত্ররা ওই ‘মাল’ কাটা-ছেঁড়ার করে হাত পাকাবে, ভবিষ্যতে জীবিত মানুষের ওপর প্রয়োগ করবে আজকের অর্জিত বিদ্যা। যারা মাল নিয়ে আসত, তাদের পয়সা-কড়ি মিটিয়ে তাদের দিয়েই আমি ডিসেকশান রুমে ওগুলো তুলতাম। তারপর ওরা চলে গেলে একা কিছুক্ষণ থাকতে হত আমাকে ওই ঘরে, যেখানে সাজানো রয়েছে পাশাপাশি মৃতদেহ, আর বিরাজ করছে একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা, হয়তো বা কবরের নিস্তব্ধতা। মেডিক্যাল ইস্কুলের প্রধান দালান থেকে ওটা ছিল বেশ খানিকটা দূরে, তাই নির্জনতাও ছিল যথেষ্ট। একা একা ওখানে ওগুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার যে গা ছমছম করত না, এ কথা বললে মিথ্যে বলা হবে, মনে হত ওরা যেন সব আমাকে লক্ষ্য করছে। তারপর একসময় ওই ঘরের তালা বাইরে থেকে লাগিয়ে আমি ফিরে আসতাম আমার ঘরে, নষ্ট ঘুম পুষিয়ে নেবার জন্য আবার আশ্রয় নিতাম বিছানায়।
‘এইভাবে কাটছিল আমার দিন আর রাত। সাধারণ চোখে আমার তখনকার জীবন মোটেই হিংসে করার মত মনে না হলেও, মেডিক্যাল ছাত্রদের কাছে আমি কিন্তু হিংসের পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ডাঃ পালের আমার প্রতি সদয় ভাবটা তারা পক্ষপাতিত্ব বলেই মনে করত। বিশেষ করে অ্যানাটমি ক্লাসের সম্পূর্ণ ভার আমার ওপর তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে অনেকের যে চোখ টাটাত, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। কাটা-ছেঁড়ার জন্য তাদের মধ্যে লাশ ভাগ করে দেবার ব্যাপারে আমি যে একটু মাতব্বরী করতাম না, কিংবা যারা এ ব্যাপারে আমার অনুগ্রহপ্রার্থী ছিল, তাদের প্রশ্রয় দিতাম না, এ কথা বললে মিথ্যে বলা হবে।
‘এ ধরনের জীবনে মানুষ স্বার্থপর হয়ে ওঠে এবং নিজের ছাড়া অপরের ভালর ব্যাপারে একেবারেই মাথা ঘামায় না বলেই আমার বিশ্বাস। আমার অভিজ্ঞতাও তাই বলে। ডাঃ পালের অনুগ্রহভাজন হবার ফলে আমি নিজের আখেরটা গুছিয়ে নেবার কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম। বিবেকহীন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক যুবক। দিনে দিনে ডাক্তার পালের আমি ডান হাত হয়ে উঠলাম, আমাকে ছাড়া তাঁর চলে না। অ্যানাটমির প্রফেসর হিসাবে তাঁর তখন যথেষ্ট খ্যাতি, কিন্তু তাঁর খুব কাছাকাছি এসে আমার জানতে বাকি ছিল না যে, তাঁর উচ্চাকাঙক্ষার পেছনেও আছে ঘোর স্বার্থপরতা আর বিবেকবর্জিত কার্যকলাপ। সারা দিনের খাটুনির পর তিনি আনন্দ লাভের জন্য এমন কয়েকটি বিশেষ বিশেষ জায়গায় যেতেন, যেখানে সুন্দরী রমণী আর বিলিতি সুরার অভাব ছিল না। কতদিন গভীর রাতে পানোম্মত্ত তাঁকে সদর দরজার সামনে থেকে তুলে এনে আমি ঘরে শুইয়ে দিয়েছি, তার হিসেব নেই। যাক, সে অবান্তর কথা।
‘এদিকে ব্যবচ্ছেদের জন্য নিয়মিত শব সংগ্রহ করা একটা ঘোর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অ্যানাটমির ক্লাসে ছাত্রর সংখ্যা কখনো কম থাকত না, তাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে এক একটি দেহ দেয়া হত, তারা পালা এবং ভাগাভাগি করে সেই বস্তুটির ওপর ছুরি চালাত, কিন্তু তাতেও অনেক সময় চাহিদা মেটানো যেত না। ফলে মাঝে মাঝে একটা বিচ্ছিরি আর অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হত, ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ লেগেই থাকত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাইরের গোপন চালানের ওপর আমাদের বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হচ্ছিল আর তার ফলটাও বিপজ্জনক হয়ে ওঠার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। লাভজনক এই ব্যবসার কারবারীরা মাল সংগ্রহের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠছিল, এবং সেটা যে সমাজের পক্ষে শুভ নয়, তা খুলে বলার অপেক্ষা রাখে না। ডাক্তার পালের এ ব্যাপারে একটা নীতি ছিল, যারা মাল সরবরাহ করে, তাদের কোন প্রশ্ন করবে না। তারা কোথা থেকে বস্তুটা সংগ্রহ করেছে কিংবা কিভাবে করেছে, তা জানার দরকার নেই। ‘ওরা লাশ নিয়ে আসে, আমরা টাকা দিয়ে কিনি।’ তিনি বলতেন, ‘দুֹ’পক্ষই লাভবান, সুতরাং প্রশ্ন করো না।’
‘খুন করে লাশ নিয়ে আসা হয়েছে, এমন প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা ছিল না। ডাক্তার পালের কাছে কেউ এ ব্যাপারে ইঙ্গিত করলে, তিনি যেন আতঙ্কিত হয়ে উঠতেন। কিন্তু এমন একটা ব্যাপারে তাঁর হালকা কথার ধরন থেকেই বোঝা যেত, এ বিষয় নিয়ে আলোচনা তিনি মার্জিত রুচির পরিচয় বলে মনে করতেন না। অনেক সময় আমি লাশ দেখে চমকে উঠেছি—টাটকা মৃতদেহ, যেন সদ্য মারা গেছে। যারা রাতের অন্ধকারে ওগুলো নিয়ে আসত, তাদের ভয়াবহ চেহারা দেখেও কত সময় আমি শিউরে উঠেছি। অনেকবার মনে হয়েছে ডাক্তার পালকে আমার সন্দেহের কথা বলি, কিন্তু এতকাল এ ব্যাপারটা কি তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছে, না ইচ্ছে করেই তিনি চোখ বুজে ছিলেন, এটা বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকাটাই আমি উচিত মনে করেছিলাম। আমার কাজ হল, যে বস্তুটা আনা হচ্ছে তা গ্রহণ করা, দাম চুকিয়ে দেওয়া, আর অপরাধের কোন চিহ্ন থাকলে চোখ ফিরিয়ে রাখা। এ ব্যাপারে আস্তে আস্তে আমি পোক্ত হয়ে উঠতে লাগলাম।
‘পৌষ মাসের এক ভোর রাতে আমার এই চুপ করে থাকা বা চোখ ফিরিয়ে রাখার চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে গেল। সে রাতের কথা আমি ভুলব না।
দাঁতের যন্ত্রণায় ঘুম আসছিল না, বিছানায় ছটফট করছিলাম। রাত দুটোর পর একটু তন্দ্রা এল। ঘন্টাখানেক বোধ হয় ঘুমিয়েছিলাম, বেশ কয়েকবার কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। যে বা যারা কড়া নাড়ছে, বেশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। আকাশে চাঁদের পাতলা আলো, শীতের রাতে হিমেল হাওয়া, সারা শহর ঘুমিয়ে। যারা এসেছিল, তারা একটু দেরি করেই এসেছে। কিন্তু চলে যাবার জন্যে যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ঘুমে আমার চোখ ভেঙে আসছিল, কোনমতে দরজা খুলে তাদের সামনে দাঁড়ালাম। ঘুমের তখনো রেশ কাটেনি, মনে হল ওরা যেন গজগজ করছে। লাশ-কাটা ঘরে বস্তা সমেত মালটা ওরা বয়ে নিয়ে গেল। একটা টেবিলে সেটাকে ফেলে বস্তাটা সরিয়ে নিতেই, ঘরের আলো এসে পড়ল ওটার মুখের ওপর, আর আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। দু’পা এগিয়ে একটু ঝুঁকে ভাল করে দেখে বললাম, এ কি কাণ্ড, এ যে মালতী!
‘যে লোকদুটো বস্তায় মৃতদেহটা পুরে নিয়ে এসেছিল তারা কোন জবাব দিল না, কিন্তু যেন একটু সচকিত ভাবে দরজার দিকে সরে গেল।
‘আমি মেয়েটিকে চিনি। —আমি এবার বেশ জোর দিয়েই বললাম, বাংলাবাজারে ওদের বাড়ি। সন্ধেবেলাও আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি। মেয়েটি যে আধা গেরস্ত, এবং ওর ওখানে আমার যাতায়াত ছিল, তা আর আমি খুলে বললাম না। …সন্ধেবেলা বেঁচে ছিল, কি করে মারা গেল! তোমরা অন্যায় ভাবে এর লাশ এনেছ, কোন অসুখে ও মারা যায়নি।
‘আপনি ভুল করতাছেন কত্তা—, ওদের একজন বলল, আপনার দিষ্টিবেভ্যম হইছে।
‘দ্বিতীয়জন কিন্তু বিচ্ছিরি ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে তখুনি টাকা দাবি করল।
‘লোকটার গলায় একটা অমঙ্গলজনক স্বর আমার কান এড়াল না, ভয় পেলাম। ওই নির্জন ঘরে আমাকে মেরে ফেলে রেখে গেলে, আমার কিছুই করার থাকবে না, হয়তো দিনের বেলা কোন টেবিল শোভা করে একজন ছাত্রের আমি হাত পাকাবার বন্ধু হয়ে দাঁড়াব। আমি আমতা আমতা করে কিছু একটা বললাম, তারপর তাদের নিয়ে চলে এলাম ডাক্তার পালের বাড়িতে। ওদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরের ভেতর থেকে টাকা গুণে এনে হাতে তুলে দিলাম। ওরা চলে যেতেই আমি তাড়াতাড়ি ফিরে গেলাম লাশকাটার ঘরে। মেয়েটার শরীরে কতগুলো মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন আমার চোখে পড়ল, আর আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। আমার সন্দেহ মিথ্যে নয়। কোনমতে পালিয়ে এসে আমি আমার ঘরে আশ্রয় নিলাম। পরে একটু শান্ত হবার পর আমি ভাবতে শুরু করলাম। ডাক্তার পালের উপদেশটা আমার মনে পড়ে গেল। আরো একটা কথা চিন্তা করলাম, যারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে, আমি যদি তাদের বাধা হয়ে দাঁড়াই, তবে আমার পক্ষে সেটা খুব নিরাপদ হবে না। ওই শয়তানগুলো খুনে, নৃশংস। যা হোক, পরের দিন এ ব্যাপারে ডাক্তার পালের সহকারীর সঙ্গে কথা বলব, ঠিক করলাম।
‘সহকারীটি হল একজন তরুণ ডাক্তার, নাম অনাথ চৌধুরী। সুপুরুষ এই তরুণ ডাক্তারটি ছাত্রমহলে তখন খুব প্রিয়। চতুর, ফিটফাট আর উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির, কিন্তু কথার চটকে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করার অসাধারণ তার ক্ষমতা। দেশ-বিদেশেও ঘুরেছে, বিলেত থেকে ডাক্তারি পাশ করে এসেছে, তাই অল্প বয়সেই ছড়িয়ে পড়েছে নাম। তাছাড়া নাটক, অভিনয়, খেলাধুলা, সব কিছুতেই চৌকস। ছাত্রদের সঙ্গে সমানে মিশে যাবার একটা প্রবণতাই তাকে অত জনপ্রিয় করে তোলার মূলে।
‘আমার সঙ্গে তার যথেষ্ট দহরম মহরম ছিল। আগেই বলেছি আমি ডাঃ পালের ডান হাত হয়ে উঠেছিলাম, আর অনাথ চৌধুরী ছিল তাঁর সহকারী, সুতরাং কাজকর্মের ব্যাপারে আমাদের খুব কাছাকাছিই থাকতে হত। যখন শবব্যবচ্ছেদের বস্তুর অভাব পড়ত, তখন আমাদের দুজনকে এ-বিষয়ে শলা-পরামর্শ করে একটা উপায় বার করতে হত। ডাক্তার পালকে এ ব্যাপার নিয়ে আমরা বিব্রত করতে চাইতাম না, তিনিও আকারে ইঙ্গিতে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে এই সামান্য ব্যাপারে তাঁকে যেন আমরা বিরক্ত না করি।
‘সেদিন ডাক্তার অনাথ চৌধুরী একটু আগেই হাসপাতালে এসেছিল। আমি তাঁকে রাতের ঘটনা বললাম, আমার সন্দেহের কথা জানাতেও ভুল করলাম না। মৃতদেহের ক্ষতচিহ্নগুলি পরীক্ষা করে অনাথ চৌধুরী ঘাড় দোলালো, বলল, হুঁ, ব্যাপারটা সন্দেহজনক।
‘আমি এখন কি করব?—আমি প্রশ্ন করলাম।
‘করবে?—ডাক্তার আমার কথাটাই যেন আবার আওড়াল: কিছু করতে চাও নাকি তুমি? কোন ব্যাপার নিয়ে যত কম ভাবা যায়, তত তাড়াতাড়ি সেটা মন থেকে মুছে যায়, এমন একটা প্রবাদ বাক্য শুনেছিলাম যেন।
‘কিন্তু মেয়েটিকে কেউ চিনে ফেলতে পারে,—আমি প্রতিবাদ না করে পারলাম না: আমার মত অনেকেই ওর চারপাশে ঘুরঘুর করত।
‘আমরা আশা করব যে, কেউ ওকে সনাক্ত করবে না—, ডাক্তার চৌধুরী জবাব দিল, তবে কেউ যদি মেয়েটিকে চিনেই ফেলে—তুমি চিনতে পারোনি—ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেল। আসল ব্যাপারটা হল, এ ধরনের ঘটনা অনেকদিন ধরে চলে আসছে। তুমি এ নিয়ে যদি নাড়াচাড়া কর, তবে ডাক্তার পালকে ভয়ানক ঝঞ্ঝাটে ফেলবে। তুমি নিজেও জড়িয়ে পড়বে…মানে, লাশ যোগান দেবার ব্যাপারে একটা চক্র আর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তুমি, আমি—সবাই জড়িয়ে পড়ব। যদি আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় আমাদের দাঁড়াতে হয়, তবে জেরার মুখে কি অবস্থা হবে আমাদের? তাছাড়া কাগজে কাগজে ফলাও করে সব কিছু ছাপা হলে, কি চোখে লোকে আমাদের দেখবে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। খাপ্পা হয়ে উঠবে না সবাই আমাদের ওপর? তবে সত্যি কথাই যদি জানতে চাও, আমাদের বেশির ভাগ চালানই খুন-জখমের লাশ—
‘ডাক্তার চৌধুরী!—আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
‘আ-হা!—অনাথ চৌধুরী আমাকে খিঁচিয়ে উঠল, যেন তুমি নিজে ব্যাপারটা সন্দেহ করনি, এখন এমন ভান করছ যেন নতুন জানছ। যত্তো সব, হুঁ!
‘সন্দেহ করা এক জিনিস—
‘আর প্রমাণ করা অন্য জিনিস। হ্যাঁ, তা জানি আমি; এটা এখানে এসে তোমাকে বড় ভাবিয়ে তুলেছে বুঝতে পারছি—, ছড়ি দিয়ে মালতীর নিশ্চল দেহটাকে মৃদু আঘাত করতে থাকে অনাথ চৌধুরী: সবচেয়ে ভাল হল এটাকে না চেনার ভান করা, তাই করব আমি। —খুব শান্তভাবে কথাগুলো বলল সে: তোমার যদি মন চায়, তবে স্বীকার করতে পার যে, একে তুমি চিনতে। আমি তোমাকে উপদেশ দিতে চাই না, কিন্তু আমার মনে হয়, যে কোন বুদ্ধিমান মানুষই আমার পথে চলবে। তবে একথাটাও বলে রাখি, ডাক্তার পাল নিজেও হয়তো চাইবেন যে, আমরা এই পস্থা গ্রহণ করি। তিনি কেন আমাদের দুজনকেই তাঁর সহকারী হিসাবে বেছে নিয়েছেন, সে কথাও তোমাকে আমি ভেবে দেখতে বলব। নিশ্চয়ই মুখ দেখে তা করেননি তিনি, আমাদের কাজ-কর্মে তাঁর আস্থা জন্মেছিল, এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে আমরা পারব বলেই তিনি আশা করেন।
‘এরপর বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, তা বুঝতে আমার দেরি হল না। তাছাড়া নিজের ভবিষ্যৎ আমাকে ভাবতে হবে না!
‘মালতীর দেহটা কাটা-ছেঁড়া হয়ে গেল, কেউ তাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলল না, আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
‘এরপর ডাক্তার অনাথ চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। একদিন সন্ধের পর আমি নবাবপুরে একটা রেস্তোরাঁয় গেছি। একটা টেবিলে দেখলাম চৌধুরী একজন লোকের সঙ্গে বসে আছে। ছোটখাটো একজন মানুষ, ফ্যাকাশে গায়ের রং, চোখদুটো কয়লার মত কালো। লোকটির হাবভাব বা বেশভূষায় তাকে অতি সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। যেন গেঁয়ো মানুষ, চেহারায় রুক্ষতাই ফুটে উঠেছে, কিন্তু চৌধুরীর মত একজন চৌকস মানুষের ওপর তার প্রভাব দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। যেন তার হুকুম তামিল কার জন্য চৌধুরী ব্যস্ত। কথায় কথায় চৌধুরীকে সে ধমকাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে চৌধুরী হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল, আমি কাছে যাবার পর সেই লোকটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, তাই এই অদ্ভুত ব্যাপারটা নজরে এসেছিল আমার। লোকটির নাম গোবিন্দ বসাক। তার সম্বন্ধে আর কিছু অবশ্য চৌধুরী খুলে বলল না, আমার কৌতূহল সত্ত্বেও আমাকে চুপ করে থাকতে হল। গোবিন্দ বসাক কিন্তু কেন জানি না, আমার ওপর হঠাৎ খুব সদয় হয়ে উঠল। রেস্তোরাঁর একজন ছোকরাকে ডেকে আমার জন্যে মুর্গীর মাংস আর পরোটার হুকুম দিল। তারপর এই অল্প পরিচয়েই আপনা থেকে নিজের বিগত জীবন সম্বন্ধে বলে গেল অনেক কথা। তার বক্তব্যের দশ ভাগের এক ভাগও যদি সত্যি হয়, তবে সে যে একটি পাষণ্ড এবং আস্ত বদমাশ—সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। নিজের দুষ্কর্মের কাহিনী শোনাতে শোনাতে তার চোখে মুখে ফুটে উঠছিল গর্বের ছাপ।
‘আমি খুব খারাপ লোক—, গোবিন্দ বসাক মন্তব্য করল: কিন্তু চৌধুরীর কাছে শিশু। ও হল সাক্ষাৎ শয়তান, ওর আমি নাম দিয়েছি শয়তান চৌধুরী। ওহে শয়তান, তোমার বন্ধুর জন্য আরেক প্লেট মাংসের অডার দাও না। শয়তান কিন্তু মনে মনে আমাকে ঘেন্না করে—,তারপরই চৌধুরীর দিকে ফিরে বলল, হ্যাঁ, শয়তান বাবু, আমি জানি তুমি আমাকে ঘেন্না কর।
‘আমাকে ওই বিচ্ছিরি নামে ডেকো না!—চাপা গর্জন করে উঠল চৌধুরী।
‘শোন ওর কথা—, গোবিন্দ বসাক হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ছুরি মারামারি দেখেছেন? আমার সমস্ত শরীরে ছুরির কোপ বসাতে পারলে ও খুশিই হবে।
‘আমরা যারা ডাক্তারি পড়ছি, তাদের অন্য উপায় আছে। —আমি মন্তব্য না করে পারলাম না: আমরা যাকে পছন্দ করি না, তাকে ফালা ফালা করে কাটা-ছেঁড়া করি।
‘চৌধুরী মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল, ওর দুচোখে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি!
‘বেশ অনেকক্ষণ আমরা ওই রেস্তোরাঁয় কাটালাম। বসাক নিজেও কয়েকবার এটা ওটা খাবারের অর্ডার দিল, চৌধুরীকেও সমানে হুকুম করল মুখরোচক খাবার অর্ডার দেবার। মাঝখান থেকে আমার ভুরিভোজটা ভালই হল। আমরা যখন উঠব উঠব করছি, রেস্তোরাঁর হোকরাটি মোটা একটা বিল এনে আমাদের টেবিলে রাখল। ওটাতে চোখ না বুলিয়েই বসাক আঙুলে টোকা মেরে ওটা চৌধুরীর দিকে ঠেলে দিল। আমি দেখলাম, চৌধুরীর মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল। প্রচণ্ড রাগ আর বাধ্যতা এই দুই পরস্পর বিরোধী অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার মুখে। অতগুলো টাকা ওকে একা দিতে হবে, এটা যেন সে বরদাস্ত করতে পারছে না, কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস নেই।
‘সেদিন ফিরতে একটু রাতই হল। চৌধুরী আর বসাক ধরল এক রাস্তা আর আমি অন্য রাস্তা। পরদিন চৌধুরী ক্লাসে কিংবা হাসপাতালে এল না। আমি মনে মনে হাসলাম, গতকাল রাত্তিরের টাকার শোক ও এখনো ভুলতে পারেনি। কিংবা হয়তো গোবিন্দ বসাকের সঙ্গে কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। গোবিন্দ বসাক যেভাবে ওকে হুকুম করছিল, হুকমু তামিল হতে একটু দেরি হলে তিরিক্ষি মেজাজ করে উঠছিল, তা থেকে আমি ধরে নিয়েছিলাম, ভেতরে কোন ব্যাপার আছে। হয়তো চৌধুরীর কোন কুকীর্তির কথা বসাক জানে, তাই চৌধুরীকে সব সময় তটস্থ থাকতে হয়।
‘সেদিন সন্ধের পর আমি আবার ওদের দুজনের খোঁজে গতকাল রাত্তিরের রেস্তোরাঁয় হানা দিলাম, কিন্তু ওদের দেখা পেলাম না। আরো কয়েকটা সৌখিন রেস্তোরাঁয় উকি মেরে দেখলাম, ওরা নেই। আমি আর রাত করলাম না, ফিরে এলাম। ভোর রাত চারটের সময়, সুপরিচিত সেই কড়া নাড়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলেই আমি থ। চৌধুরী তার পুরোন মডেলের ঝরঝরে অস্টিন গাড়িটা এনে দাঁড় করিয়েছে ওই গলির মধ্যে, একেবারে খিড়কির দরজার সামনে। আমি দরজা খুলতেই, সে একটা বস্তা টেনে বার করল—আমার পরিচিত বস্তা।
‘কি ব্যাপার !—আমি একটু চেঁচিয়েই উঠলাম, আপনি একাই মালের খোঁজে বেরিয়েছিলেন? একা সামলালেন কি করে?
‘চৌধুরী যেন ধমকে আমাকে থামিয়ে দিল, তারপর পাঁচিলের গায়ের দরজাটা খুলতে বলল। দরজার তালা খোলবার পর বস্তাটা দুজনে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেলাম। অ্যানাটমি ক্লাসটা দালান থেকে বেশ দূরে। তবে পাঁচিলের গায়ের ওই দরজা দিয়ে ঢুকলে ডাক্তার পালের খিড়কি থেকে তেমন একটা দূর নয়। সব দিক বিবেচনা করেই বোধ হয় ওই বাড়িটা অ্যানাটমির প্রধানের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছিল। বস্তাটা টেবিলের ওপর রাখার পর চৌধুরী চলে যাবার জন্য ফিরল, তারপর একটু ইতস্তত করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বরং মুখটা একবার দেখে নাও। হ্যাঁ, মুখটা তুমি একবার দেখেই নাও—যেন নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে কথাটা সে বলল।
‘কিন্তু কোথায় এটা পেলেন? কেমন করে? কখন?—আমি না বলে পারলাম না।
‘মুখের দিকে তাকাও!—জবাব এল।
‘আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগল। ডাক্তার চৌধুরী অমন করছে কেন! আমি একবার তার মুখের দিকে, আরেকবার বস্তাটার দিকে তাকাতে লাগলাম। তারপর একসময় বস্তাটা কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলতেই টেবিলের ওপর যে নগ্ন দেহটা আমার চোখের সামনে জেগে উঠল, সেটা দেখে আমি আঁৎকে উঠলাম। এক রাত আগে যার সঙ্গে বসে খানাপিনা আর গল্প করেছি, সেই গোবিন্দ বসাকের লাশ আমার সামনে। চোখদুটো আধবোজা, মুখে যেন একটা বিকৃত হাসি, বীভৎস সে দৃশ্য। আমি চৌধুরীর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না, আতঙ্কে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।
‘চৌধুরীই পেছন থেকে এসে আমার কাঁধে একটা হাত শক্তভাবে রেখে বলল, কমল নাথকে মাথাটা দিও।
‘কমল নাথ আমারই মত একজন ছাত্র, ব্যবচ্ছেদের জন্য একটা মাথা অনেকদিন ধরেই দাবি করে আসছে।
‘আমি কোন জবাব দিতে পারলাম না। খুনী ডাক্তার আবার বলল, এবার লেনদেনের ব্যাপারটায় আসা যাক। মালের জন্য তোমাকে টাকা দিতে হবে, তোমার হিসেবপত্তর ঠিক রাখতে হবে তো?’
‘আমি কোনমতে আমার ভাষা খুঁজে পেলাম। বললাম, টাকা দিতে হবে। এর জন্য আপনাকে টাকা দিতে হবে?
‘নিশ্চয়ই। —জবাব হল: আমি এমনিতে একটা মাল তোমাকে দিতে পারি না, আর তুমিও বিনা মূল্যে ওটা নিতে পার না; আমাদের দুজনের পক্ষেই সেটা সন্দেহজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। ভাল কথা, টাকা-পয়সা কোথায় থাকে?
‘আমি অনেকটা পুতুলের মত তাকে নিয়ে আমার ঘরে ফিরে এলাম। টিনের বাক্সটা আঙুল দিয়ে দেখালাম। চৌধুরী ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলঃ চাবিটা দাও?—
আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা করলাম, তারপর চাবিটা তুলে দিলাম তার হাতে। মনে হল, এতক্ষণে সে যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। হিসেবের খাতাটা একটা ছোট টেবিলের ওপর ছিল। সেটা খুলে সে আমার সামনে ধরল, তারপর চাবি দিয়ে টিনের বাক্সটা খুলে মালের দাম বাবদ যা হওয়া উচিত, তা বার করে বলল, পাওনা টাকা তুমি মিটিয়ে দিলে—এটা হল তোমার ওপর যে বিশ্বাস আশা করা যায়, তার মর্যাদা তুমি রেখেছ। তোমার নিরাপত্তার প্রথম সিঁড়ি হল এটা। এবার দ্বিতীয় ধাপ পার হতে হবে তোমাকে। খরচটা হিসাবের খাতায় লিখে নাও। শয়তানও তারপর তোমার মাথার চুল ছুঁতে পারবে না।
‘পরের কয়েক মুহূর্ত আমার মনের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। স্বার্থপর এবং উচ্চাভিলাষী হলেও, তখনো পর্যন্ত বিবেক একেবারে বর্জন করিনি, কিন্তু সেই মুহূর্তে চৌধুরীর প্রস্তাবে রাজী না হবার মত মনের জোর আমার ছিল না। তাছাড়া তার কথা না শুনলে আমি ভয়ানক বিপদে পড়ব এমন একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি আমাকে সাবধান করে দিল। খাতায় লেনদেনের হিসাবটা লিখে ফেললাম।
‘চমৎকার!—আমাকে যেন উৎসাহ দিয়ে চৌধুরী বলল, পুরস্কারের টাকাটা তোমারই পাওয়া উচিত। আমার পাওনা আমি পেয়ে গেছি। —অর্থপূর্ণভাবে সে হাসল, তারপর টাকাটা তুলে দিল আমার হাতে; ভাল কথা—, টিনের বাক্সের চাবিটা আমাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে চৌধুরী আবার বলল, সংসারে কোন মানুষের হাতে হঠাৎ যদি কিছু টাকা এসে পড়ে,…তোমাকে একথা বলছি বলে কিছু অবশ্য মনে করো না—মানে, এসব ক্ষেত্রে একটা আচরণবিধি মেনে চলার নিয়ম আছে। খানাপিনা, নতুন নতুন জিনিসপত্তর কেন, পুরোন দেনা শোধ করা—এসবের ধার-পাশ দিয়েও যেতে নেই। তা করলেই পাড়া-পড়শী, চেনাজানা মানুষ, সন্দেহ করতে শুরু করবে। কোথা থেকে টাকা আসছে? যত ইচ্ছে ধার কর, কিন্তু কখনো ধার দিও না।
‘ডাক্তার চৌধুরী!—আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, আপনাকে অনুগ্রহ করার জন্যে আমি গলায় ফাঁসির দড়ি পরলাম।
‘আমাকে অনুগ্রহ করার জন্যে?—অনাথ চৌধুরীর গলা থেকে যেন ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল: বেশ মজার কথা বলেছ তো! আমি তো দেখতে পাচ্ছি, তুমি নিজেকে বাঁচাবার জন্যেই আমার কথামত কাজ করেছ। ধর, আমি যদি ঝামেলায় পড়ি, তুমি কি রেহাই পাবে ভেবেছ? আজকের এই ছোট দ্বিতীয় ঘটনাটি প্রথম ঘটনাস্রোতেরই একটি গতি। গোবিন্দ বসাক হল মালতীর অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। শুরু করে তুমি থামতে পার না। শুরু করেই কি তোমাকে চালিয়ে যেতে হবে, এর মাঝামাঝি কোন পথ নেই।
‘আমার চোখের সামনে সব কিছু যেন অন্ধকার হয়ে এল। একটা ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কবলে আমি পড়েছি, তা থেকে উদ্ধারের দ্বিতীয় কোন পথ নেই।
‘হায় ভগবান!—আমি সখেদে বলে উঠলাম, আমি কী এমন অন্যায় করেছি, যার জন্য আমাকে এমন মূল্য গুণতে হচ্ছে? শুরুই বা করলাম আমি কখন?
‘কি ছেলেমানুষী করছ, সামন্ত?—চৌধুরী মৃদু ধমকের সুরে বলল, কি ক্ষতি হয়েছে তোমার? তুমি যদি মুখ না খোল, তবে কী ক্ষতিই বা তোমার হতে পারে? জীবন সম্বন্ধে কোন ধারণাই তোমার নেই দেখছি। পৃথিবীতে দু’ধরনের মানুষ আছে, সিংহ আর মেষশাবক। যদি তুমি মেষশাবক হও, তবে আর পাঁচটা মড়ার মত এই লাশ-কাটা ঘরের টেবিলে তোমার স্থান হবে; যদি সিংহ হও, তবে আমার, ডাক্তার পালের কিংবা পৃথিবীর সাহসী পুরুষদের মত গাড়ি চাপবে, জীবনটা উপভোগ করবে, বুঝেছ বোকারাম? প্রথম ধাক্কাতেই তুমি টাল সামলাতে পারছ না। তুমি ভাগ্যবান বলেই ডাক্তার পালের সুনজরে পড়েছ, তা ভেবে দেখেছ কি? সূত্রগুলো তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ঠিক ঠিক অনুসরণ করবে, এটাই তিনি আশা করেন তোমার কাছে। আর একথাও তোমাকে আজ বলছি, আজ থেকে তিনদিন পরে আজকের কথা ভেবে তুমি নিজেই লজ্জা পাবে, আমি বাজি রাখতে পারি।
‘অনাথ চৌধুরী আর অপেক্ষা করল না। অন্ধকার থাকতে থাকতেই তার সেই ঝরঝরে গাড়িটা নিয়ে চলে গেল। একা একা আমি নিজের অবস্থাটা ভেবে দেখবার চেষ্টা করলাম। নিজের দুর্বলতার জন্য নিজেকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার। চৌধুরীকে সুবিধে দিতে দিতে আমি এত বাড়িয়েছি যে, তার ভাগ্য আমার হাতের মুঠোয় না এসে, আমিই তার কেনা গোলাম হয়ে পড়েছি। আঃ, একটু যদি সাহস থাকত আমার। আমার অবস্থা এখন দাঁড়িয়েছ যেন: অন্যায় যতই ঘটুক না কেন, আমাকে এমন ভাবে চলতে হবে, যেন সেটাই ন্যায়। হিসাবের খাতায় অভিশপ্ত সেই সর্বশেষ লেখাটাই বন্ধ করে দিল আমার মুখ।
‘তারপর একসময় দিনের আলো ফুটল…ঘন্টা গড়িয়ে গেল, শুরু হল ক্লাস। গোবিন্দ বসাকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল, তারাও কোন প্রশ্ন তুলল না। মাথাটা পেয়ে খুশি হল কমল নাথ। দু’দিন ধরে লাশ কাটা-ছেঁড়ার ওপর আমি তীক্ষ লক্ষ্য রাখলাম। যতই কাটা হচ্ছে, ততই ওটাকে চেনার সম্ভাবনা কমে আসছে, আর সাহস ফিরে আসছে আমার মনে।
‘তৃতীয় দিনে অনাথ চৌধুরী এল। এ দুদিন নাকি অসুখ করেছিল বলে আসেনি। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে দু’দিনে যে সময় নষ্ট হয়েছে, তা উশুল করে দেবার জন্য সে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টেবিলে টেবিলে ঘুরে নির্দেশ দিতে লাগল ছাত্রদের—অক্লান্ত কর্মীর মত। বিশেষ করে কমল নাথকে সাহায্য করার জন্য যেন সে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। তার কাছ থেকে অযাচিত উৎসাহ পেয়ে কমল নাথেরও উদ্দীপনার শেষ নেই। নানান কোণ থেকে মাথাটায় ছুরি চালিয়ে পাকাতে লাগল হাত।
‘সপ্তাহটা শেষ হবার আগেই চৌধুরীর ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেল। আমি ভয় কাটিয়ে উঠলাম। মনে মনে একটা গর্ব অনুভব করতে লাগলাম। চৌধুরীর কথামত সিংহের দলেই আমি ভিড়েছি। চৌধুরীর সঙ্গে ক্লাসে দেখা হল, কিন্তু সে রাতের ঘটনা নিয়ে আমরা কেউ উচ্চবাচ্য করি না, যেন একটা অলিখিত চুক্তি হয়েছে আমাদের মধ্যে।
‘কিন্তু ঘটনাচক্রে আবার আমাদের খুব কাছাকাছি আসতে হল। মাল সরবরাহে হঠাৎ টান পড়ল, অ্যানাটমির ক্লাস প্রায় বন্ধ, ছাত্রদের মধ্যে দেখা দিল মৃদু অসন্তোষ। ডাক্তার পাল উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি আমাকে আর চৌধুরীকে ডেকে এ ব্যাপারে তাঁর দুশ্চিন্তার কথা জানালেন। ঠিকমত মাল না পাওয়া গেলে ছাত্রদের পক্ষে কাটা-ছেঁড়া করা সম্ভব হবে না, তাঁর কাছে কর্তৃপক্ষ কৈফিয়ৎ চেয়ে বসবেন। আমাদের তিনি এ ব্যাপারে তৎপর হতে বললেন।
‘আমরাও চিন্তিত হয়েছিলাম। আসলে পুলিশ সে সময় কিছু একটা ঘটনায় বেশ কিছু গুণ্ডাকে আটক করেছিল, ফলেই এই অচলাবস্থা। আমি আর চৌধুরী শলাপরামর্শ করতে লাগলাম, একটা উপায় আমাদের বের করতে হবে। ঠিক এমন সময় শহর ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা দূরে একটা খুব পুরোন কবরখানার খবর এল আমাদের কাছে। ওটার চারপাশে নাকি জঙ্গল, অনেকটা পরিত্যক্ত। খুব কাছের গাঁয়ের কিছু পুরোন মানুষ ছাড়া ওটা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না, একটা নতুন কবরখানা অন্যদিকে হয়েছে, সেখানেই যায়। শুধু পুরোন মানুষরা ভাবপ্রবণতার খাতিরে হোক কিংবা পূর্বপুরুষদের স্মৃতির সম্মানেই হোক, ওটা এখনো ছাড়তে পারেনি। আরো যে খবরটা আমাদের কাছে এল, তা হল খালেদ মিঞা নামে এক বুড়ো চাষীর কমবয়সী বউ বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেছে। মাত্র গতকালই তাকে ওই কবরখানায় সমাধিস্থ করা হয়েছে। আমি আর চৌধুরী পরামর্শ করলাম, এ সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না।
সেদিনই সন্ধের পর চৌধুরীর ঝরঝরে গাড়িতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শহর ছাড়িয়ে বেশ অনেকটা দূরে সেই কবরখানা। ওখানে পৌঁছে কাজ শেষ করে আবার ফিরে আসতে অনেক রাত হয়ে যাবে। শহরের শেষ সীমনায় চৌধুরী গাড়ি থামিয়ে একটু অন্ধকার দেখে রাস্তার পাশে গাড়ি রাখল। পেছনের আসনের পায়ের কাছে ছিল শাবল আর কোদাল, আর ছিল চটের বস্তা। যাতে কারো চোখে না পড়ে, তাই অন্ধকারে গাড়িটা রাখল চৌধুরী। আমরা একটা হোটেলে ঢুকলাম। রাতের খাওয়াটা সেরে নেওয়াই ভাল, নয়তো পেটে কিছু পড়বে না।
মাংস আর পরোটার অর্ডার দিয়ে চৌধুরী পকেটে হাত ঢোকাল, তারপর এক মুঠো টাকা বার করে আমার হাতে গুঁজে বলল, সেদিন আমার সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ কর।
‘আমি টাকাটা পকেটে পুরে বললাম, আপনি একজন দার্শনিক। আপনি ঠিক কথাই বলেছিলেন, তিনদিন পর ও ব্যাপারটা নিয়ে আর আমি মাথা ঘামাইনি। আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না হওয়া পর্যন্ত আমি একটা বুদ্ধ ছিলাম। আপনি আর ডাক্তার পাল—আপনারাই আমাকে সত্যিকার মানুষ বানিয়ে ছাড়বেন। ভগবানকে ধন্যবাদ, আপনাদের নজরে পড়েছিলাম।
‘তা আর বলতে!—চৌধুরী জবাব দিল: মানুষ তোমাকে না বানিয়ে আমরা ছাড়ব না! আর তাই যদি বল, সেদিন আমার পাশে দাঁড়াবার জন্য একজন সাহসী মানুষই আমার দরকার ছিল। প্রকাণ্ড চেহারার অনেক মানুষই এই দৃশ্য দেখে মূর্ছা যেত, কিন্তু তোমার বেলায় তা হয়নি—তুমি মাথা ঠিক রেখেছিলে। আমি লক্ষ্য করছিলাম তোমাকে।
‘মাথা কেন ঠিক রাখব না?—আমি বেশ গর্বের সঙ্গেই জবাব দিলাম। ওটা আমার কোন ব্যাপার নয়, তাছাড়া আপনাকে সাহায্য করার জন্য আপনি চিরকাল আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন, সেটাও কম কথা নয়। —আমার মনে হল, চৌধুরীর কপাল যেন কুঁচকে গেল, চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকাল আমার দিকে। কিন্তু আমি ততক্ষণে বাচাল হয়ে উঠেছি। গলায় অহঙ্কার ফুটিয়ে বললাম, আসল কথা হল, ভয় না পাওয়া। ফাঁসিকাঠে আমি ঝুলতে চাই না একথা সত্যি, কিন্তু সব সময় ন্যায় পথে চলবে, ভগবানে বিশ্বাস রাখবে, এসব আদর্শের বুলি আমার কাছে উপহাস বলেই মনে হয়। আপনার আমার মত সাহসী মানুষদের জন্যেই এ জগৎ।
‘হোটেলের টাকা মিটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ক্রমে রাস্তা নির্জন হয়ে এল, আকাশে আধখানা চাঁদ, খুব অসুবিধে হচ্ছিল না। অবশেষে কবরখানার সামনে পৌঁছলাম। চারপাশে জঙ্গল; একটা পুরোন জীর্ণ মসজিদ, আর তার লাগোয়া কবরখানা। ভাগ্য ভাল, মসজিদে কেউ থাকে না, ওটাও বোধ হয় এখন পরিত্যক্ত।
‘গড়িটা সুবিধে মত জায়গায় রেখে আমরা গাড়ি থেকে দরকার জিনিসপত্তর বের করলাম। একটা টর্চ, একটা লণ্ঠন, শাবল, কোদাল আর বস্তা।
‘আধখানা চাঁদের আলো যেন এক ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। টুঁ শব্দটি নেই, চারদিকে কবরের নিস্তব্ধতা। একটা কাঠের ভাঙা গেট পেরিয়ে আমরা কবরখানার ভেতরে ঢুকলাম। বড় বড় ঘাস হয়েছে চারদিকে, সাপ থাকাও বিচিত্র নয়। সন্তর্পণে পা ফেলে, লণ্ঠন আর টর্চের আলোয় আমরা পথ করে এগোচ্ছিলাম। বড় বড় গাছের ছায়া চাঁদের আলো ঢেকে ফেলে এক এক জায়গায় সৃষ্টি করেছে নিরন্ধ্র অন্ধকার। আমার গা ছমছম করে উঠল। মনে হল, যেন সারি সারি কবরের তলা থেকে চিরনিদ্রিত মৃতদেহগুলো আমাদের এই গোপন অভিসার লক্ষ্য করছে। আমরা তাদের শান্তিতে বাধার সৃষ্টি করেছি, অবৈধভাবে প্রবেশ করেছি তাদের সংরক্ষিত এলাকায়, সেটা তারা পছন্দ করছে না।
‘চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে কিন্তু নির্বিকার। আমার সাহস ফিরে এল। নতুন কবরটা বার করতে বেগ পেতে হল না। বেশির ভাগই বড় বড় ঘাসে ঢাকা পড়েছে, কিন্তু এটা সদ্য তৈরি, তাই ঘাস পরিষ্কার করা হয়েছে, সহজেই চোখে পড়ে।
‘লন্ঠনটা মাটিতে রেখে আমরা দুজন মাটি কোপাতে শুরু করলাম। নরম মাটি, সবে খোঁড়া হয়েছিল, তাই তাড়াতাড়ি গর্তটা বড় হতে লাগল। পরিশ্রমে আমাদের শরীরে নামল ঘামের বন্যা। তারপর একসময় কফিনটা আমাদের চোখে পড়ল। খুব সাবধানে চারপাশে গর্ত করে কফিনের দু’দিক শক্ত মুঠোয় ধরে ওটাকে আমরা মাটির ওপর রাখলাম। শাবলে চাপ দিয়ে টানাটা খুলে ভেতরের মৃতদেহটা শুইয়ে দিলাম, পাশের বড় বড় ঘাসের ওপর। অল্পবয়সী বউয়ের মৃতদেহ, তেমন ভারী নয়। এবার কফিনের ঢাকনাটা আবার বন্ধ করে, গর্তে যেমনটি ছিল, তেমনটি রেখে, ভরাট করে দিলাম মাটি। আমাদের কুকীর্তির প্রমাণ আমরা রাখতে চাই না।
‘বস্তার মধ্যে লাশ ভরে আমরা ধরাধরি করে নিয়ে চললাম চৌধুরীর ছ্যাকরা গাড়িতে। পেছন দিকে পায়ের কাছে বস্তাটা রাখা হল। যন্ত্রপাতি, লণ্ঠন সব নিয়ে এসে আমরা ফিরে চললাম। এত সহজেই একটা লাশ পাওয়া গেছে বা যোগাড় করতে পেরেছি, ভেবে মন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। ওটার বাবদ যে টাকা হওয়া উচিত, সেটা আমরা দুজন ভাগ করে নেব। সহজ ভাবে টাকা রোজগারের ভাল একটা পথ পাওয়া গেছে। চৌধুরী গাড়ি চালাতে চালাতে কুৎসিত একটা রসিকতা করল, দুজনেই হেসে উঠলাম।
‘হঠাৎ শুরু হল ঝিরঝিরে বৃষ্টি, মেঘে ঢাকা পড়ল চাঁদ। আমার পায়ের কাছে বস্তাটা ছিল। চৌধুরীর ঝরঝরে গাড়িতে খুব ঝাঁকুনি হচ্ছিল, আর বস্তাটা বারবার আমার পায়ের ওপর এসে পড়ছিল। আমি যতই পা দিয়ে ওটা ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিলাম, ততই যেন নতুন উদ্যমে ওটা এসে পড়ছিল আমার পায়ের ওপর। এই সংস্পর্শে গা ঘিনঘিন করে উঠছিল আমার! একবার যেন মনে হল, বস্তা থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিল। ভীষণ চমকে উঠলাম আমি। গলা দিয়ে বোধ হয় একটা শব্দ বেরিয়েছিল, চৌধুরী গাড়ি থামিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, কি হল? চেঁচিয়ে উঠলে কেন?
‘আমার কেন জানি ভাল ঠেকছে না। —আমি কোনমতে বললাম, আমার পায়ে কে যেমন সুড়সুড়ি দিল।
‘তোমার দেখছি ভয় ধরেছে!—ব্যঙ্গ কণ্ঠে বলে উঠল চৌধুরী, এই তুমি সাহসী পুরুষ, অ্যাঁ?
‘গাড়ি থামিয়ে ও নেমে এল। বৃষ্টির বেগটা বেড়েছে। হঠাৎ কোথা থেকে কতগুলো কুকুর আমাদের চারপাশে ডাকতে লাগল, তাদের সেই ডাকের মধ্যে হিংস্রতা নেই, আছে একটা কান্নার সুর। চারদিকের জমাটি অন্ধকার, কুকুরের কান্না, আমাদের সঙ্গে ঘর থেকে সদ্য চুরি করে আনা একটি যুবতীর মৃতদেহ—সব মিলিয়ে একটা অশরীরী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের চার পাশে।
‘চৌধুরী আমার বাঁ দিকের দরজাটা খুলে ভেতরে ঝুঁকে বলল, ‘টর্চটা জ্বালাও, মেয়েমানুষের সুড়সুড়িতে তোমার ভয়ের চাইতে আরাম লাগাই উচিত।
‘আমি পাশ থেকে টর্চটা তুলে আলো ফেললাম বস্তাটার ওপর। কয়েক মুহূর্ত আমরা স্তস্তিতের মত তাকিয়ে রইলাম, কারো মুখে কথা নেই। সত্যি বস্তা থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু সেটা রমণীর কোমল হাত নয়, একটি লোমশ হাত। একটা ভয়ানক আতঙ্ক আমার বুকে যেন পাষাণের মত চেপে বসছে।
‘এটা কার হাত !—চৌধুরী ফিসফিস করে বলল, মেয়েমানুষের হাত নয়—
‘কিন্তু আমরা তো মেয়েমানুষের লাশই কবর থেকে তুলে এনেছি—, আমিও ফিসফিস করে জবাব দিলাম।
‘আলোটা আরেকটু উঁচু করে ধর—, চৌধুরী হঠাৎ যেন মরিয়া হয়ে বলে উঠল, মুখটা আমি দেখতে চাই—
‘আমি টর্চের আলোটা বস্তার মুখের কাছে ধরলাম। চৌধুরী এক টানে ওটা সরিয়ে দিতেই, একটা মুখ বেরিয়ে পড়ল। দাড়ি কামানো একটা মুখ, চোখ দুটো খোলা, গভীর কালো দু’চোখের তারা, মুখে যেন ব্যঙ্গের হাসি। আমাদের উপহাস করছে।
‘রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিল আমাদের দুজনের আতঙ্কিত চিৎকার। চৌধুরী এক লাফে সরে গেল, আমি কেমন করে ডান দিকের দরজা খুলে লাফ মেরেছিলাম, জানি না। অন্ধকারে শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়ে হাত-পা ছড়ে গেল, কিন্তু আমার তখন ভ্রুক্ষেপ নেই, দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে আমি ছুটছি তো ছুটছিই।
‘যে মুখটা আমাদের দিকে তাকিয়ে বীভৎস ভাবে হাসছিল, সেটা গোবিন্দ বসাকের মুখ—যাকে লাশ-কাটা ঘরে ফালা ফালা করে কাটা-ছেঁড়া করা হয়েছিল আমাদের দুজনের চোখের সামনে।’