পিশাচ প্রহর । দুই
প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ল বিনতার কপালে। আকস্মিক ঠান্ডা স্পর্শে চমকে উঠল বিনতা। তারপর চিরদীপের দিকে ফিরে বলল, নাও, শুরু হল।
চিরদীপের বলিষ্ঠ হাতের পাঞ্জা স্টিয়ারিংয়ে নিথর। মুঠোর ভঙ্গিতেই আস্থা ও অহঙ্কার স্পষ্ট। সামনের উইন্ডশিল্ড-এ ধারাবাহিক শব্দে এসে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো। আঘাত করেই ওয়াইপারের ঠেলায় ছড়িয়ে যাচ্ছে মসৃণ কাচের ওপর। চিরদীপ টান-টান হয়ে ঋজু স্থাপত্যের মতো বিনতার পাশে বসে। ফরসা মুখ, লম্বা টিকলো নাক, ছোট-ছোট চোখ, চোয়াল সামান্য ভাঙা। পাতলা নীল টেরিকটন জামার নীচে কাঁধের জান্তব পেশি সহজেই চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে যেন কোনও পাকা অ্যাথলিট। এবং সত্যিই চিরদীপ সরকার সারা দেশে সুপরিচিত। এবারের দিল্লির এশিয়ান গেম্স-এ ডেকাথলন ও পেন্টাথলন-এ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবে সে।
বিনতার কথায় ফিরে তাকাল চিরদীপ, বলল, এই হুড খোলা স্পোর্টস কারটা না আনলেই হত। এখন ভিজতে হবে। ওর কথা শেষ না হতেই বৃষ্টির তেজ তিনগুণ বেড়ে গেল। সেইসঙ্গে পাগলা হাওয়ার মাতন।
আকাশে মেঘ সকাল থেকেই ছিল। তবে বৃষ্টি যে নামবে এটা ভাবা যায়নি। কারণ আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে বলা ছিল, বর্ষার আবির্ভাব হতে এখনও দিনদশেক দেরি। তা ছাড়া সকালের আকাশ রোদঝলমল ছিল। দুপুরের দিকে হঠাৎই পশ্চিম কোণে জমে উঠল ঘন মেঘ। ক্রমশ তা শক্তি ও আয়তনে বাড়তে লাগল। বিনতা দু-একবার শঙ্কিত চোখে আকাশের দিকে তাকালেও চিরদীপ ভ্রুক্ষেপহীন। অভ্যাসলব্ধ সহজ ভঙ্গিতে ছুটিয়ে চলেছে গাড়ি। কিন্তু এখন, দীঘা থেকে ওরা যখন মাত্র আধ ঘণ্টার পথ দূরে, তখনই বৃষ্টি নামল বিপুল সমারোহে।
কোনওরকম আত্মরক্ষায় উপায়হীন হয়ে ভিজতে লাগল বিনতা ও চিরদীপ। সময় বিকেল পাঁচটা হলেও অন্ধকার প্রায় রাতের মতোই। রাস্তা একেবারে ধু-ধু, ফলে উজ্জ্বল হেডলাইট ও হলদে সার্চলাইটের আলো সামনের ভিজে রাস্তায় ঢেলে দিয়ে এখনও গাড়ি চালাতে পারছে চিরদীপ। পথের দু-পাশে শুধু ঝোড়ো হাওয়ায় আক্রান্ত গাছপালার আর্তনাদ ও বৃষ্টির খই ফোটানোর শব্দ।
একটু পরেই গাড়ি থামাতে বাধ্য হল ওরা। প্রথমত, বৃষ্টির বেগ যে হারে বেড়ে চলেছে তাতে বেপরোয়া চিরদীপকেও পরোয়া করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পথের ধারে কয়েকটা টিমটিমে আলো ওদের নজরে পড়েছে—সম্ভবত কোনও ছোট দোকান।
গাড়ি থামিয়ে সম্পূর্ণ ভিজে পোশাকে নেমে এল বিনতা ও চিরদীপ। ছুটে এসে ঢুকে পড়ল টিমটিমে আলোয় আলোকিত সেই পলকা আশ্রয়ে। এবং তখনই আবিষ্কার করল, অনুমান ওদের মিথ্যে হয়নি, কারণ জায়গাটা একটা ছোট চায়ের দোকান। যথারীতি দোকানিকে দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে ভাঙা বেঞ্চিতে বসল ওরা। মাটিতে নিকানো মেঝে ওদের পোশাক থেকে ঝরে পড়া জলে কাদা হয়ে উঠেছে।
প্রচণ্ড হাওয়া দোকানের বেড়া ভেদ করে ছুটে এসে ওদের ভিজে শরীর দুটো কাপিয়ে দিচ্ছে। বাঁশের খুঁটির গায়ে ঝোলানো হ্যারিকেন ঠক-ঠক শব্দে দুলছে। ওরা দু’জন ছাড়া দোকানে আরও দু-তিনজন স্থানীয় লোক আটকে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে দু-চারটে কথাও বলছে উৎকলী ভাষায়।
ধূমায়িত চায়ের গ্লাসে প্রথম চুমুক দিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল চিরদীপ, অঘোরচন্দ্র রায় কীরকম লোক?
হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় চিরদীপ যে অনেকক্ষণ ধরেই ওকে লক্ষ করছে সেটা বিনতা টের পেয়েছিল তার দিকে না তাকিয়েই। এখন সরাসরি উত্তর দিল, কীরকম লোক জানি না। কোনওদিন তাঁকে আমি চোখেই দেখিনি।
তোমার ঠাকুর্দা তোমাকে এত ভালোবাসেন—অথচ তুমি তাঁকে চোখেই দ্যাখোনি!—সুন্দর করে হাসল চিরদীপ : রিয়্যালি বিনতা, এই দুর্যোগের পরিবেশে তুমি আর ঠাট্টা কোরো না!
বিনতার মুখ যথেষ্ট গম্ভীর, চোখের দৃষ্টি লক্ষ্যহীন, দূরনিবদ্ধ। ও ধীরে-ধীরে বলল, ঠিকই বলেছ তুমি। ঠাকুর্দার চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে তোমার প্রশ্নগুলোই আমার মাথায় ঘুরছে। বাবা বেঁচে থাকতে শুনেছি, খুব ছোটবেলায় নাকি ঠাকুর্দা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। শুনলে অবাক হবে চিরদীপ, বাবা ছিলেন অঘোরচন্দ্র রায়ের একমাত্র সন্তান।—কিছুক্ষণ চুপ করে রইল বিনতা। যেন কোনও স্মৃতিমন্থনে ব্যস্ত। মন্থনের ফলে কী উঠে আসবে—অমৃত, না হলাহল—তা ও জানে না।
একটু পরে অনিশ্চয়তার ছোঁয়া নিয়ে ও আরও বলল, আমার বাবা, বিলাসচন্দ্র, কী অপরাধে ত্যাজ্যপুত্র হয়েছিলেন জানি না। তবে সেই সময়ে তাঁর মাথার ওপরে ছিল নতুন সংসারের চাপ। আমি তখন খুব ছোট—তখনই হয়তো ঠাকুর্দা আমাকে দেখে থাকবেন।
চিরদীপের চায়ের গ্লাস অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে। কমে এসেছে হাওয়ার দাপট। বৃষ্টির তেজও স্তিমিত। ও বিনতাকে সহজ করার চেষ্টায় বলল, চলো, ওঠা যাক। এই বৃষ্টিতে দিব্যি যাওয়া যাবে—ক’দিন যা গরমে কেটেছে।
চায়ের দাম মিটিয়েই ওরা গাড়িতে এসে উঠল। সীসে-রঙ আকাশে এখন, সামান্য লালচে আভা চোখে পড়ে। ছ’টা বাজতে এখনও কিছু বাকি।
মধ্যগতিতে গাড়ি ছুটিয়ে দিল চিরদীপ। ভিজে নীল জামা এখন ওর শরীরে এঁটে বসেছে, ফলে অ্যাথলিটসুলভ স্বাস্থ্য প্রকট হয়েছে। একইসঙ্গে বিনতা নিজের শারীরিক রেখায় প্রকাশিত। গাড়ির গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃষ্টির ছাট ও এলোমেলো বাতাস ওদের শিউরে দিতে লাগল।
চিরদীপ, আমি কিন্তু প্রথমেই তোমাকে বলেছিলাম, নেমন্তন্নটা আমার একার, আমি একাই যাব। অথচ তুমি বললে—।
বিনতার মুখের কথা কেড়ে নিল চিরদীপ, নতুন বউকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া তোমার ঠাকুর্দা তো আর জানেন না যে সম্প্রতি আমি এক নরাধম, তোমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছি। অতএব শ্রীঅঘোরচন্দ্র রায়ের ঘোরতর আমন্ত্রণে দীঘার সমুদ্রতীরে দু-এক সপ্তাহ কাটিয়ে যাওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারিনি। একই সঙ্গে নেমন্তন্ন ও মধুচন্দ্রিমা, দুইয়ের আকর্ষণে আমি সম্মোহিত হয়েছি।
চিরদীপের নাটকীয় সংলাপে কপট রাগ দেখিয়ে বিনতা বলে উঠল, এবারে দিল্লির গেম্স-এ তুমি ঘেঁচু পাবে।
ওর গম্ভীর ভাব কেটে গেছে ক্ষণিকে। নিজের প্রচেষ্টা সফল হওয়ায় মনে-মনে খুশি হল চিরদীপ। বিনতাকে চিন্তামগ্ন অস্থির দেখলে ওর কষ্ট হয়। ও বিনতার কথায় হাসল : আমি যা পাই, সবই তোমার বিনতা। সুতরাং, অভয় দিচ্ছি, ঘেঁচু-পদকও বাদ যাবে না।
এবারে সত্যিই সন্ধ্যা নামল, এবং ওদের চোখে পড়ল দীঘার জনপদ। চালাঘরের দোকানপাট, লণ্ঠন ও মোমবাতির আলো, সাইকেল রিকশার ভেঁপু, সমুদ্রের চাপা গর্জন, মাঝে-মাঝে ছুটে যাওয়া বাস ও গাড়ির শব্দ, আর সবশেষে ঝোড়ো বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ।
চিরদীপ জিগ্যেস করল, বাড়ির ঠিকানাটা মনে আছে?
হ্যাঁ। রায়ভিলা, নিউ দীঘা।
কাউকে জিগ্যেস করে দেখা যাক।
একটা সাইকেলের দোকান ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাল চিরদীপ। তারপর নেমে এগিয়ে গেল খোঁজ নিতে।
আকস্মিক ঝড়-বৃষ্টিতে বৈদ্যুতিক গোলযোগের সময়, কলকাতার খুব চেনা লোডশেডিং এখানেও আবিষ্কার করল বিনতা। রাস্তাঘাট অনেক নির্জন হয়ে এসেছে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া এই থমথমে আবহাওয়ায় হয়তো কেউ পথে বেরোতে চাইবে না।
চিরদীপ ফিরে এসে বিনতার পাশে স্টিয়ারিংয়ে বসল। বলল, এখনও মিনিট পনেরোর পথ, ম্যাডাম। এই রাস্তা ধরে নাক বরাবর এগিয়ে যেতে হবে।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছুটিয়ে দিল চিরদীপ। তারপর গাইডদের কথার সুর অনুকরণ করে বলতে শুরু করল, এই রাস্তা চলে গেছে উড়িষ্যার দিকে। প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট পথ চললেই আপনাকে মেদিনীপুর উড়িষ্যার সীমানায় পৌঁছে দিতে পারি, ম্যাডাম। তারপর বর্ডার পেরোলেই চন্দনেশ্বর, আর সেখানে দেখতে পাবেন কাজুবাদামের গাছ, আমবাগান, নারকেল গাছের সারি, ও একটি কালীমন্দির। এখন আমরা যে-পথ ধরে এগিয়ে চলেছি, সেই পথের বাঁদিকে টানা এগিয়ে চলেছে সমুদ্র ও ঝাউবন। আর ডানদিকে চোখে পড়বে বিভিন্ন সরকারি আবাস, বাড়ি, দীঘা সরকারি হাসপাতাল, নিউ দীঘা পার্ক ও সরোবর—যদিও এখন আপনি কিছুই দেখতে পাবেন না, কারণ সবই ঘন অন্ধকারে ঢাকা।
বিনতা অধৈর্য হয়ে বলল, মানছি, আমি দীঘায় নতুন, তাই বলে এত জ্ঞান পাওয়ার যোগ্য নই। আসল কথা বলো, রায়ভিলার খবর পাওয়া গেল?
গাড়ির সুরেলা হর্ন সুর করে বাজাল চিরদীপ, বলল, পাওয়া গেছে, দেবী। নিউ দীঘা পার্ক ও লেক-এর ঠিক পাশেই। বিরাট এলাকা জুড়ে রায়ভিলা একেবারে রায়প্রাসাদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব জোরালো বড়লোক তোমার ঠাকুর্দা শ্রীঅঘোরচন্দ্র—।
রাস্তা এখন একেবারে নির্জন ও অন্ধকার। বাঁদিকে ঝাউ ও অন্যান্য গাছের গভীর জঙ্গল। ডানদিকে চিরদীপের ধারাবিবরণের সঙ্গে মিল রেখে কয়েকটা অস্পষ্ট বাড়ি দেখতে পাচ্ছে বিনতা। আকাশে কোনও গ্রহ-তারা চোখে পড়ছে না। বরং আবার জমায়েত হতে শুরু করেছে কালচে লাল মেঘের পাহাড়।
ভিজে শাড়ি গায়ে শুকিয়ে এখন রীতিমতো কাঁপছে বিনতা। কিন্তু চিরদীপের যেন সেসব ভ্রুক্ষেপ নেই। অঘোরচন্দ্র রায়ের রহস্যময় আমন্ত্রণ ওর শরীরে ও মনে হয়তো কোনও নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে।
গাড়ির গতি কমিয়ে দিল চিরদীপ। ডানদিকে ঝুঁকে পড়ে অস্পষ্ট বাড়িগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎই বলে উঠল, বিনতা, পাওয়া গেছে। ওই যে—
তারপর রাস্তা ছেড়ে বাঁক নিল ডানদিকে।
ওদের সামনেই একটা খাটো লোহার দরজা। বন্ধ। রাস্তা ছেড়ে এগিয়ে আসা মেঠো পথ দরজা পেরিয়ে চলে গেছে ভেতরে। যতদূর হেডলাইটের আলো পৌঁছল, ততদুর পর্যন্ত সে-রাস্তা কোনও বাঁক নেয়নি।
লোহার দরজার দু-দিকে বিস্তৃত খাটো পাঁচিল, তার ওপরে ফুটদুয়েক উঁচু কাটাতারের বেড়া।
গাড়ি থেকে নেমে দরজার কাছে এগিয়ে গেল চিরদীপ। লোহার দরজার গা ঘেঁষে সিমেন্টের পাঁচিলে গাঁথা রয়েছে বড় মাপের পাথরের ফলক। তাতে স্পষ্ট কালো হরফে লেখা, ‘রায়ভিলা, নিউ দীঘা।’
এবার লোহার দরজার দিকে নজর দিল চিরদীপ। না, দরজায় কোনও তালা নেই, এমনই ভেজানো রয়েছে।
সুতরাং অযথা সময় নষ্ট না করে বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা গরাদগুলো মুঠোয় চেপে ধরে ঠেলতে শুরু করল ও। বিশ্রী ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তুলে খুলে গেল দরজা।
অন্ধকারে নজর চালিয়ে বহু চেষ্টা করেও কোনও ‘ভিলা’ চোখে পড়ল না চিরদীপের। ও ফিরে এল গাড়িতে।
বিনতা জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার? এই বাড়িটাই?
গাড়ি চালু করে চিরদীপ বলল, আদৌ কোনও বাড়ি ভেতরে আছে কিনা জানি না, তবে দরজার গায়ে ‘রায়ভিলা’ নামেই পাথরের ফলক দেওয়া আছে।
ওরা ঢুকে পড়ল ভেতরে। তারপর গাড়ি থামিয়ে লোহার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এল চিরদীপ।
রায়ভিলার এলাকাটা যে ঠিক কত বড় সেটা কোনওরকম ঠাহর করা যাচ্ছে না। মেঠো রাস্তার দু-পাশে সবুজ ঘাসের জমি। তারপর অন্ধকার ঘন থেকে ঘনতর হয়ে পরিপূর্ণ আঁধারের রূপ নিয়েছে। তবে উদ্দাম হাওয়ায় ঝাঁকড়া গাছের মাতাল দুলুনির খড়খড় শব্দ ওদের কানে আসছে।
আবার গাড়ি নিয়ে অনিশ্চিত পথচলা শুরু হতেই সাময়িক বিরতির পর বৃষ্টিও শুরু হল আবার। পিছনের জঙ্গল থেকে একাধিক শৃগালের সুদীর্ঘ মিলিত আর্তনাদ শোনা গেল।
বিনতা চাপা গলায় বলে উঠল, আমার ভয় করছে! তারপর একটা হাত রাখল চিরদীপের কাঁধে।
চিরদীপ শুধু বলল, ভয় পেলে আমাদের চলে না। আমরা অপেশাদারি হলেও অ্যাথলিট—প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে শরীরচর্চা করি।
হারকিউলিস!—ঠাট্টা করে বলল বিনতা। ওর কাছে আরও সরে এল। এমন সময় বহু দূরে আলোর রেখা ওদের চোখে পড়ল। অঘোরচন্দ্রের হয়তো নিজস্ব বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা আছে, ভাবল চিরদীপ। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। মেঠো রাস্তা এখন উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা চরিত্র প্রকাশ করেছে।
অনেক চেষ্টা করেও বাড়িটার অবয়ব বিনতার চোখে পড়ল না, তবু ও আশ্বস্ত হল এই কথা ভেবে যে, মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই ওরা খুঁজে পেয়েছে।
ওদের চোখের সামনে আলোর রেখা ক্রমে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে।
একসময় গাড়ি এসে থামল প্রাচীন ঢঙে গড়া বিশাল এক গাড়িবারান্দার নীচে। এবং তখনই বৃষ্টি আবার শুরু হল মুষলধারে।
টিমটিম করে একটা বাল্ব জ্বলছে বিশাল ভারী সদর দরজার সামনে। আবলুষ কাঠে বহুদিন ধরে তেল সিঞ্চিত করলে যে চকচকে মজবুত রূপ ফুটে ওঠে, দরজার চেহারা অনেকটা সেইরকম। ভারী ভারী দুটো পিতলের কড়া যেন মহিষাসুরের হাতের বালা। গাড়িবারান্দার সিমেন্টের আস্তর বেশ কয়েক জায়গায় খসে গেছে। রঙ বিবর্ণ মলিন। যেন অঘোরচন্দ্র রায়ের শারীরিক জরাজীর্ণ অবস্থার প্রতীক।
নতুন করে ভেজা পোশাক নিয়ে গাড়ি থেকে নামল চিরদীপ ও বিনতা। কান পেতে বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা কর্মচঞ্চলতার শব্দ শুনতে চেষ্টা করল। কিন্তু নিরাশ হল। চিরদীপের ভুরু কুঁচকে উঠল, বলল, কেউ নেই নাকি বাড়িতে?
বিনতা এত অস্ফুটভাবে ‘জানি না’ বলল যে, শুধু ওর ঠোঁট নড়াটুকুই বোঝা গেল।
চিরদীপ দ্রুত পায়ে গাড়ির কাছে গিয়ে হর্ন বাজাল একবার, দু-বার—।
নিস্তব্ধতাকে ছত্রভঙ্গ করে সেই শব্দের ধ্বনি প্রতিধ্বনির জন্ম দিল। এবং দূরের জঙ্গল থেকে শোনা গেল কোনও জন্তুর একটানা চিৎকার। বৃষ্টির অবিরত শব্দে সমুদ্রের গর্জন এখন আর কানে আসছে না।
হঠাৎই একটা নতুন শব্দে ওরা সচকিত হল। কেউ দরজা খুলছে। ধীরে, অতি ধীরে। দরজার ওপারের আলোছায়া থেকে একটা মূর্তি বেরিয়ে এল গাড়িবারান্দার টিমটিমে আলোর বৃত্তে।
আগন্তুকের কালিপড়া চোখ, খোঁচা-খোঁচা পাকা দাড়ি, ঘন ঝোপের মতো ভুরু, গাল দুটো বসে গেছে বয়েসের ভারে, গায়ের রঙ তামাটে, পরনে সাদা হাফশার্ট ও ধুতি—দুটোই যথেষ্ট ময়লা।
ভুরুর নীচ থেকে দুটো উজ্জ্বল চোখ তাকাল চিরদীপ আর বিনতার দিকে। খুব মৃদু স্বরে সে বলল, বাড়িতে শয্যাশায়ী মানুষ, ওভাবে হর্ন বাজাতে নেই।—একটু থেমে তারপর বলল : আপনারা কোত্থেকে আসছেন—?
বিনতা এবার সামনে এগিয়ে গেল, বলল, আমি বিনতা। ঠাকুর্দার চিঠি পেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি…।
আগন্তুকের মুখে সংশয়ের মেঘ তখনও কাটেনি দেখে বিনতা আরও বিশদে বলল, অঘোরচন্দ্র রায় আমার ঠাকুর্দা। আর ইনি—এবারে ও দু-পা পিছনে দাঁড়ানো চিরদীপের দিকে ইশারা করে বলল, আমার স্বামী—।
আমার নাম চুনীরাম,—আগন্তুক মৃদু অস্পষ্ট গলায় বলল, আসুন, ভেতরে আসুন।
ওরা চুনীরামকে অনুসরণ করল।
দরজা পেরোলেই হলঘর। প্রাচীনতার সাক্ষ্য এখানেও প্রচুর। ঝাড়লণ্ঠন, বাতিদান, পুরু সোফা, ফ্রেমে বাঁধানো বড় বড় ছবি, রঙচটা দেওয়াল, আর সামনে কাঠের সিঁড়ি—সোজা উঠে গেছে দোতলায়।
হলঘরে ঢোকামাত্রই একটা দমবন্ধ করা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ ওদের নাকে এসে ধাক্কা মেরেছে। সেইসঙ্গে একটা চাপা ফোঁস-ফোঁস শব্দ। যেন কোনও কামার তার হাপর চালাচ্ছে প্রাণপণে।
বিনতা চিরদীপের হাত চেপে ধরল। চিরদীপ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় বে-তোয়াক্কা প্রশ্ন ছুড়ে দিল : এই বিশ্রী গন্ধটা কোথা থেকে আসছে, চুনীরামবাবু? আর এই ফোঁস-ফোঁস শব্দটাই বা কীসের—জেনারেটরের নাকি?
হলঘরের মলিন আলোয় ওদের সামনে সিঁড়ি ভেঙে ওঠা চুনীরাম যেন এক শীর্ণ অপচ্ছায়া। সে মুখ না ফিরিয়েই বলল, আপানাদের গাড়ি আমি জায়গামতো সরিয়ে রাখব, চিন্তা করবেন না। ঝড়-জলের রাত, আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন। দিদিমণি যে আসবেন সে-কথা বাবু আমাকে বলেছিলেন, তাই ঘরও আমি তৈরি রেখেছি। তবে দাদাবাবুকে কষ্ট করে ভাঁড়ার ঘরে শুতে হবে।
প্রথমত ওর প্রশ্নের উত্তর সরাসরি পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় চিরদীপ ক্ষুব্ধ হয়েছিল, তার ওপর ভাঁড়ার ঘরে শোওয়ার ব্যাপার ওকে যেন ক্ষিপ্ত করে তুলল।
ভাঁড়ার ঘরের দরকার নেই, বিনতার ঘরেই আমি থাকতে পারব।
দিদিমণির জন্যে বাবু আলাদা ঘর রাখতে বলেছেন।—চিরদীপের রুক্ষতায় চুনীরাম পাথরের মতো নির্বিকার। ভয় নেই, ভাঁড়ার ঘরে আপনার তেমন কোনও অসুবিধে হবে না।
চিরদীপ তাকাল বিনতার দিকে। ও অন্তত এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক। ওর অধিকার আছে। এটা ওর আপন ঠাকুর্দার বাড়ি। কিন্তু বিনতা চুপচাপ। ওর মুখের ওপর ভিজে চুল এসে পড়েছে। কপালের টিপ ধুয়ে গেছে অনেক আগেই। আয়ত চোখ দুটো যেন কোনও স্বপ্নের জগতে চলে গেছে। বিনতা ধীরে ধীরে তাকাল চিরদীপের চোখে, বলল, কয়েকটা রাতের তো ব্যাপার। কষ্ট করে কাটিয়ে দাও।
চিরদীপ ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকাল। অর্থাৎ, পড়েছি মোগলের হাতে…।
দোতলায় উঠতেই হাপরের শব্দ যেন তিনগুণ হয়ে কানে এসে ধাক্কা মারল।
চওড়া অলিন্দ ধরে ওরা হেঁটে চলেছে। পার হয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা বন্ধ দরজা। অবশেষে একটা দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল চুনীরাম, বলল, এই ঘরটি আপনার, দিদিমণি।
চুনীরামের কথায় বিনতা যেন ঘোর কাটিয়ে উঠল, বলল, ঠাকুর্দার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই।
সামান্য হাসল চুনীরাম : দেখা হবে, সময় হলেই দেখা হবে। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে ওনারও তর সইছে না।—এ-কথা বলে ঘরের দরজাটা সে খুলে দিল, বলল, দরকারি জিনিসপত্র সব ঘরেই পাবেন—।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা রক্ত-হিম-করা চিৎকার প্রাসাদোপম জীর্ণ বাড়িটার ভ্যাপসা বাতাস প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে কাঁপিয়ে দিল। মিহি স্বর ক্রমে কর্কশ হয়ে লম্বা টানা এক চিৎকার—যেন নরক থেকে ফিরে আসা কোনও অতৃপ্ত পিশাচের হতাশা ও ক্ষোভের চিৎকার। বাড়ির জরাগ্রস্ত দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল সেই আর্তনাদ।
বিনতার ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এল অস্ফুট শব্দ।
চিরদীপ শরীরের প্রতিটি পেশি টানটান করে ঠাহর করতে চাইল চিৎকারটা কোন দিক থেকে এসেছে।
চুনীরাম আগের কথার জের টেনে বলল, ঘরে যান, দিদিমণি। রাতে একা-একা ঘর ছেড়ে বেরোবেন না।
আপনি আপনি চিৎকার শুনতে পাননি? কে অমন করে চিৎকার করল, চুনীরামবাবু?
চিৎকার নয়, দিদিমণি। সমুদ্রের বাতাস কাঁপছে…।
চিরদীপের দিকে ফিরল চুনীরাম, বলল, আসুন দাদাবাবু, আপনার ঘর দেখিয়ে দিই।
মনে সংশয়, কৌতূহল ও কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে চুনীরামকে অনুসরণ করল চিরদীপ। যাওয়ার আগে বিনতার দিকে একবার চকিতে দেখে নিল। স্মিত হেসে বিনতা যেন বলতে চাইল, কোনও ভয় নেই।
ওরা দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল বিনতা। ঘরের আলোটা কমজোরি হলেও বাকি সব ছিমছাম ও পরিপাটি। অবাক হয়ে দেখল বিছানার ওপর একপ্রস্থ শুকনো পোশাক ওরই জন্য অপেক্ষা করছে। পোশাকগুলো দেখে ওর মনে পড়ল, গাড়িতে একটা সুটকেস ছিল, তার ভেতরে ওর এবং চিরদীপের পোশাক, দরকারি টুকিটাকি সবকিছু রাখা ছিল। সেটা ভুল করে আনা হয়নি। কিন্তু বিছানার পাশে চোখ পড়তেই ওর ভুল ভাঙল। কোন এক মন্ত্রবলে সুটকেসটা ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে। এবং সামান্য অনুসন্ধান করেই ও টের পেল, সুটকেস খুলে কেউ দরকারি সব জিনিসগুলো বের করে ঠিক জায়গামতো সাজিয়ে রেখেছে। ফলে বিছানার ওপর রাখা শাড়ি-ব্লাউজ সব বিনতারই—কলকাতা থেকে সঙ্গে এনেছে।
শরীর শুকিয়ে পোশাক পালটে বিছানার ওপর এসে বসল বিনতা। খুব ক্লান্ত লাগছে। সেই সঙ্গে খিদেও পেয়েছে। তখনই চোখে পড়ল ঘরের এক কোণে সাজানো টেবিল, টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া রয়েছে। নতুন করে আবার অবাক হল বিনতা। বিনা দ্বিধায় আহারপর্ব সেরে নিল। তারপর আলো নিভিয়ে সরাসরি গা এলিয়ে দিল বিছানায়। বাইরে সাইক্লোনের তাণ্ডব শোনা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে ফোঁস-ফোঁস শব্দ। ভ্যাপসা গন্ধটা ইতিমধ্যে নাকে অনেকটা সয়ে গেছে।
শুয়ে শুয়ে ওর মনে পড়ল অঘোরচন্দ্রের চিঠিটার কথা।
সাংবাদিকতায় স্নাতক হওয়ার পর একটা নামি অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি পায় বিনতা। তারপরই বাবাকে হারায়। মাকে নিয়ে গড়ে ওঠে ওর সংসার, কারণ কোনও ভাইবোন ওর ছিল না। চাকরির সূত্রে দিল্লি, বোম্বাই, মাদ্রাজ, নানান জায়গায় ঘুরতে হয় বিনতাকে। ফলে মায়ের ক্ষয়ে যাওয়া অবস্থাটা ওর নজরে পড়েনি। একদিন মা-ও চলে গেলেন। তারপর থেকে ও একা। অবশেষে হঠাৎই চিরদীপের সঙ্গে আলাপ, প্রেম, বিয়ে। তারপর একটা মাস ওরা নানান দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে। শেষে নৈনিতাল থেকে ফিরেই একটা চিঠি হাতে পায়। অঘোরচন্দ্রের চিঠি। প্রায় দেড়মাসের পুরোনো। কাঁপা হাতে ওর কাছে আবেদন করেছেন অঘোরচন্দ্র :
তোমার বাবাকে অন্যায়ভাবে আমি বঞ্চিত করেছি। এই অভিমানে সময়ের আগেই সে চলে গেছে। এখন আমি শয্যাশায়ী। শেষ নিশ্বাস বুকে ধরে শুধু তোমার জন্যেই প্রতীক্ষা করছি। কারণ তুমিই আমার একমাত্র বংশপ্রদীপ। আমার বিপুল সম্পত্তি-বৈভব অপাত্রে বর্তাক তা আমি চাই না। ইতিমধ্যে দুই-একজন দূরসম্পর্কের আত্মীয়-পরিজন রায়ভিলায় এসে উপস্থিত হয়েছে। তোমার আসার খবর নিশ্চিত না জেনে তাদের আমি ফেরাতেও পারছি না। মনে রেখো, শুধু তোমার শরীরেই বয়ে চলেছে রায় বংশের দুর্লভ রক্ত। তাই একান্ত অনুরোধ, আয় মা, এই বুড়োকে আর কষ্ট দিস না। তোর আশায় পথ চেয়ে রইলাম। ইতি—তোর ঠাকুর্দা, অঘোরচন্দ্র রায়, রায়ভিলা, নিউ দীঘা।
কী এক অজানা আকর্ষণে সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছে বিনতা। চিরদীপ ওকে ছেড়ে থাকতে রাজি হয়নি। সুতরাং দুজনেই রওনা হয়ে পড়ছে। কিন্তু ঠাকুর্দা কী করে জানলেন আজই ও এসে পৌঁছবে? ঘর তৈরি, খাবার তৈরি…আশ্চর্য!
এমন সময় তিনতলার কোনও ঘর থেকে হুল্লোড়ের শব্দ কানে এল বিনতার। নারী ও পুরুষ কণ্ঠের খুশি রমরমে চিৎকার। বাড়ির মালিক যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী সেখানে এই উৎসব কি মানায়? এরা কি অঘোরচন্দ্রের সেই অবাঞ্ছিত আত্মীয়-পরিজনের দল? মৃতপ্রায় গরুর শোকে উপস্থিত শকুনের পাল? ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা নেমে এল বিনতার চোখে। চিরদীপ এখন কী করছে কে জানে। হয়তো ও…
বিনতা ঘুমিয়ে পড়ল। ঝোড়ো হাওয়ার গর্জন ক্রমে বেড়ে উঠছে। সেইসঙ্গে হাপরের ফোঁস-ফোঁস শব্দটাও।
ঠক-ঠক-ঠক-ঠক।
ঘুম ভেঙে গেল বিনতার। ঘরের একটা জানলা খুলে গেছে। শোঁ-শোঁ তুফানী হাওয়া ঘরের ভেতরে নিয়ে আসছে বৃষ্টির ছাট।
বাইরে ঘন অন্ধকার। মাঝে মাঝে ক্ষণস্থায়ী উজ্জ্বল বিদ্যুৎ কালো আকাশের বুকে আলোর আঁচড় টানছে। জানলার একটা পাল্লা হাওয়ার দাপটে জোরালো শব্দে আছড়ে পড়ছে দেওয়ালে।
রাত এখন কত? বালিশের নিচ থেকে হাতঘড়ি বের করে ঘুম চোখে দেখল বিনতা। রাত তিনটে। তখনই ও বুঝতে পারল, ঠক-ঠক শব্দটা নেহাতই জানলা থেকে নয়—ওর ঘরের দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। চিরদীপ নাকি?
সংশয় ও দ্বিধা নিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে এল বিনতা। পায়ে পায়ে এগোল বন্ধ দরজার দিকে।
হঠাৎই শোনা গেল এক ভয়ঙ্কর তীব্র বিলাপ—বহুক্ষণ স্থায়ী হয়ে অবশেষে কেঁপে-কেঁপে মিলিয়ে গেল।
বিনতার পা-দুটো যেন পাথরে গেঁথে গেল পলকে। শ্রুতিশক্তি একাগ্র করে ও আরও কিছু শুনতে চাইল। কিন্তু একমাত্র হাপরের ছন্দোময় ফোঁসফোঁসানি ছাড়া আর কোনও নতুন শব্দ ওর কানে এল না। এদিকে দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ ক্রমে অধৈর্য হয়ে উঠছে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বিনতার মনে সাহস ফিরে এল। দৃঢ় পায়ে শেষ পথটুকু অতিক্রম করে ও দরজা খুলে দিল। এবং চমকে উঠল।
দরজায় যে দাঁড়িয়ে আছে তাঁকে বিনতা কখনও দেখেনি। একটা অস্পষ্ট কালো ছায়া। পরনে গেঞ্জি ও ধুতি।
বিনতা চকিতে হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচ টিপল, কিন্তু আলো জ্বলল না।
লোডশেডিং, দিদিমণি।—অন্ধকার অলিন্দে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তি ঘড়ঘড়ে গলায় উত্তর দিল : আমার নাম গুণধর। চলুন, বাবু আপনাকে দেখবার জন্যে বড় উতলা হয়েছেন। আর ওনাকে শান্ত রাখা যাচ্ছে না।
অঘোরচন্দ্র ওকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন? এত রাতে? কিন্তু তিনিই এ-বাড়ির মালিক, বিনতার পরমাত্মীয় এবং মৃত্যুশয্যায়।
অতএব অন্ধকার অলিন্দ ধরে গুণধরের অপচ্ছায়াকে অনুসরণ করল বিনতা।
হঠাৎ কোত্থেকে একটা জ্বলন্ত মোমবাতি আবির্ভূত হল গুণধরের হাতে। তার চলমান স্তিমিত আলো গড়ে তুলল অসংখ্য ছায়ার মিছিল।
হঠাৎই বিনতা বুঝতে পারল ফোঁস-ফোঁস শব্দটা ক্রমে তীব্রতর হচ্ছে। যেন কোনও বিশাল সরীসৃপের নিশ্বাস ওকে সম্মোহিত করে আকর্ষণ করছে।
অলিন্দের আঁকাবাঁকা গোলকধাঁধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল গুণধর।
দরজাটা আধখোলা। তাতেই বোঝা যাচ্ছে, ঘরের ভেতরে লণ্ঠন জ্বলছে। ফোঁস-ফোঁস শব্দটা এখন যেন পরিবেশ ছেয়ে ফেলেছে। ধ্বনি-প্রতিধ্বনি মিলিয়ে এক অপার্থিব শব্দ ঝঙ্কারের সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে একটা দমকা কটু বাতাস বিনতার নাক ছুঁয়ে গেল। বহুদিন পড়ে থাকা শ্যাওলা-ধরা নোনা জলের মাছ যে-গন্ধ ছড়ায়, অনেকটা সেইরকম দুর্গন্ধময় বাতাস—সঙ্গে একটা অদ্ভুত ঝাঁঝ মিশে রয়েছে।
ঘরে যান, দিদিমণি—বাবু অপেক্ষা করছেন। এই কথা বলেই ছায়া-ছায়া অন্ধকারে মোমবাতি সমেত মিলিয়ে গেল গুণধর। বিনতা ধীরে-ধীরে দরজা খুলল, পা রাখল রহস্যময় ঘরের ভেতরে।
ঘরটা আকারে বিশাল, ফলে লণ্ঠনের আলো প্রতিটি আনাচে-কানাচে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে সাদা পরদা দিয়ে ঘেরা একটা ছোট ঘরের মতো। পরদার আলোকিত অভ্যন্তর দেখে বোঝা যায় লণ্ঠনটা রয়েছে পরদাঘেরা ঘরের ভেতরে। এরই কারণে পরদার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা বিছানা, বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটি বাইরে থেকেই নজরে পড়েছে বিনতার। এছাড়া পরদার গায়ে কয়েকটি জিনিসের বিকৃত ছায়া দেখে অনুমান করা যায়, পরদার আড়ালে শুয়ে থাকা রোগীকে নানান ডাক্তারি যন্ত্রে ঘিরে রাখা হয়েছে।
আয়…আয়…কাছে আয়—তীব্র ফিসফিসে স্বর যেন তীরের মতো এসে বিনতার কানে বিঁধল। পচা আঁশটে দুর্গন্ধটা ওর দম বন্ধ করে দিতে চাইছে। বিনতার শরীরে এক চাপা আলোড়ন দেখা দিল। আলো-আঁধারি তন্নতন্ন করে খুঁজেও তৃতীয় কোনও ব্যাক্তিকে ও দেখতে পেল না।
সম্মোহিতের মতো ও পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল পরদাঘেরা ঘরের কাছে। পরদা সরিয়ে ঢুকল ভেতরে। জরাক্রান্ত সাবেকী খাট। খাটের ওপর নীলচে মশারি খাটানো। তবে ভেতরে স্তূপাকার চাদর বালিশ-জামাকাপড়ের ভিড়ে অসংখ্য ভাঁজপড়া অস্পষ্ট একটা মুখ চোখে পড়ছে। অঘোরঠাকুর্দা?
হ্যাঁ রে, আমিই তোর ঠাকুর্দা, অঘোর রায়—ফিসফিস করে শ্বাস টেনে জরাজীর্ণ বৃদ্ধ বলে উঠলেন। বিনতার নীরব সংশয় তিনি টের পেয়েছেন। তিনি শ্বাস টেনে-টেনে আরও বললেন, আয়…কাছে এসে বোস…।
বিছানার পাশেই একটা খাটো টুল। বিনতা তার ওপর বসল। দেখল, অসংখ্য, পাইপ ঢুকে গেছে মশারির ভেতরে। খাটের নীচে দুটো বড় বড় সিলিন্ডার! মাথার কাছে স্ট্যান্ডের সঙ্গে লাগানো রয়েছে রক্তের বোতল। তার সঠিক উৎস বোঝা যাচ্ছে না। একটিমাত্র লণ্ঠন সমস্ত আসবাব, যন্ত্র ও পাইপের ছায়া নানান ভাবে জট পাকিয়ে এক অভেদ্য রহস্য তৈরি করেছে।
বিনতা ভয় ভয় চোখে চারপাশে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
ভয় নেই রে, ভয় নেই…অঘোর রায় অস্ফুট স্বরে বললেন, তুই এসে আমাকে যে কী শান্তি দিলি তা আর বলার নয়। এবারে আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারব।…তুই আমার বংশের একমাত্র মেয়ে…কুলপ্রদীপ। তোর দেহে বইছে আমারই রক্ত। তুই-ই আমার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ…।—একটু থামলেন অঘোর রায়, তারপর বললেন, কই, দেখি, তোর হাতটা দেখি…।
কাপড়ের স্তূপ ভেদ করে মশারির তলা দিয়ে একটা প্রাগৈতিহাসিক হাত বেরিয়ে এল। খসখসে চামড়ায় জড়নো জীর্ণ শুকনো একটি হাত। লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোতেও বিনতা দেখল সেই হাতের প্রতিটি খাঁজে সবুজ ছাতা ধরেছে, খুঁটিয়ে দেখলে আরও চোখে পড়ে পিঁপড়ের আনাগোনা।
একটা অস্বাভাবিক আতঙ্কময় চিৎকারকে অতি কষ্টে রোধ করল বিনতা। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওর ডানহাত এগিয়ে গেল সেই শ্যাওলা পড়া শীর্ণ কঙ্কালসার হাতের সঙ্গে মিলনের প্রত্যাশায়।
বাইরে বিকট শব্দে বাজ পড়ল। সোঁ-সোঁ হাওয়ার দাপট আরও অস্থির আর উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠল। বিদ্যুৎঝলকের তীব্র আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে লাগল বিশাল ছায়াময় কক্ষের প্রতিটি কাচের জানলা। এবং প্রচণ্ড ফোঁস-ফোঁস শব্দ তুলে প্রাগৈতিহাসিক হাতটা ভয়ানক শক্তিকে আঁকড়ে ধরল বিনতার নরম হাত।
বিনতার শরীর যেন অসাড় হয়ে গেল। বরফের মতো ঠান্ডা ও স্যাঁতসেঁতে একটা হিম অনুভূতি হাতের আঙুল বেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে ওর দেহের প্রতিটি প্রান্তে। ভ্যাপসা পচা গন্ধটা যেন কোনও বিশাল চাদর হয়ে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরছে বিনতাকে, ওকে অবশ করে ফেলছে।
মশারির ভেতরে অঘোরচন্দ্র রায়ের অগোছালো শরীরটা অস্থির ছন্দে কেঁপে-কেঁপে উঠছে। ম্লান আলোয় শুধু চোখে পড়ছে আঁধারের বুক থেকে উজ্জ্বল ছুরির মতো সন্ত্রাসী দুটো চোখের তারা।
বিনতা আপ্রাণ চেষ্টাতেও আঙুলের এতটুকু অংশ নড়াতে পারল না। অবশেষে অসহায়ভাবে নিজেকে ছেড়ে দিল পরিস্থিতির হাতে। তখনই অঘোরচন্দ্র কথা বলতে শুরু করলেন।
দীর্ঘ দেড়মাস আমি তোর জন্যে অপেক্ষা করেছি। মরেও আমি মরতে পারিনি। আমার বিষয়-সম্পত্তির লোভে ওরা চারজন সেই কবে থেকে এসে হাজির হয়েছে, কিন্তু আমি শুধু তোর জন্যে অপেক্ষা করেছি…।
অঘোরচন্দ্রের ফিসফিসে মোহময় কণ্ঠস্বর ক্রমে তীব্র হয়ে উঠছে। দূরে কোথাও মিলিত স্বরে শেয়াল ডেকে উঠল। তারপর : আর কোনও চিন্তা নেই। তোর সব পথের কাঁটা দূর হয়ে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে…।
শেষ কথাগুলো যেন অভিশপ্ত কিন্নরীর মতো ঘরের দেওয়ালে-দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে মাথা খুঁড়ে মরতে লাগল।
মশারির পিছনে অঘোরচন্দ্রের অচল-অনড় চৌম্বকশক্তিময় চোখ দুটোর ওপর চোখ পড়ল বিনতার। সবকিছু যেন ওর গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। মনের অস্থিরতা ধীরে-ধীরে প্রশান্ত হয়ে এল। দুর্গন্ধের দম আটকানো চাদর যেন খুলে গেল পাকে পাকে। ফোঁস-ফোঁস হাঁপানির শব্দটাও যেন অনেক কমে গেছে।
বিনতার ফরসা মুখ ঘেমে উঠেছে, আয়ত আঁখি সম্পূর্ণ খোলা, কয়েকগুচ্ছ চুল এসে পড়েছে ডান ভুরুর ওপরে।
তোর সঙ্গের লোকটি কে?—শীতল সুরে প্রশ্নটা ভেসে এল মশারির ভেতর থেকে।
এই প্রথম চিরদীপের কথা মনে পড়ল বিনতার। ও কোথায়, কী করছে? ও কি জানে বিনতার এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা!
চিরদীপ সরকার—আমার স্বামী।
ফোঁস-ফোঁস শব্দটা পলকে পরিণত হল চাপা গজরানিতে : তুই—তুই বিয়ে করেছিস? কই, আমি তো শুনিনি।
বিনতা বলতে পারত, তোমার ঠিকানা আমি জানতাম না যে খবরটা জানাব। কিন্তু ও কোনও উত্তর দিল না। প্রতিবাদ করল না এই ভিত্তিহীন অনুযোগের।
অঘোরঠাকুর্দার নামটুকুই শুধু শুনেছে মা-বাবার কাছে। তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেও কিছুই জানতে পারেনি। কী তাঁর চরিত্র, কী তাঁর বিশ্বাস, কোথায় তাঁর ঠিকানা, কিছুই না। তবুও এই অজ্ঞাতকুলশীল আত্মীয়ের ডাকে কেন জানি না ছুটে এসেছে কিনতা। কিন্তু ওর বিয়ের কথায় তাঁর এই প্রতিক্রিয়া বিনতার মোটেও ভালো লাগল না। ও একটু রুক্ষ স্বরেই জবাব দিতে চাইল, কেন, শুনলে কি বিয়েতে আপত্তি করতেন? কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে ওর ঠোঁট চিরে যে-উত্তর বেরিয়ে এল, সেটা হল, আমাকে ক্ষমা করুন।
ফিসফিসে স্বর উত্তাল উন্মাদ হয়ে উঠল : প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
বিনতা স্থিরভাবে বসে রইল। বন্দি হাতটাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনও চেষ্টা পর্যন্তও করছে না। জটিল আলোছায়া খেলা করছে ওর মুখে, সবুজ হাতে।
…তুই শুধু তুই…আর কাউকে আমি চাই না। আমার এত ঐশ্বর্য, ধন-রত্ন, আমি শুধু তোর হাতে তুলে দেব। তোর জিম্মায় রেখে যাব। তুই-ই পারবি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে এই সম্পত্তি রক্ষা করতে। কারণ তোর শিরায়-শিরায় আমার রক্ত।—একটু স্তিমিত হল কণ্ঠস্বর। তারপর শ্বাস টানার ঘড়ঘড় শব্দ করে আবার বলতে শুরু করল, বিলাস…বিলাসচন্দ্র আমার একমাত্র সন্তান। সে আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। ঐশ্বর্য-বৈভব তার ধাতে সইত না। সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণকে সে লালসা নাম দিয়েছিল। ও তিল-তিল করে বৈভব সঞ্চয়ের মর্ম বোঝেনি। কিন্তু তুই বুঝবি, মা, তুই হবি আমার উত্তরসূরি…শুধু আজকের দিনটা, তারপর…।
জরাজীর্ণ হাতের মরণ বাঁধুনি শিথিল হল। কিন্তু বিনতার হাত যেন আসড় হয়ে গেছে। ওর মনের ভেতরে উথলে উঠছে ঘৃণার ঢেউ…সকলের প্রতি। এই মুহূর্তে প্রিয় শুধু ওর ঠাকুর্দা অঘোরচন্দ্র রায়…আর, ও নিজে…।
ধীরে-ধীরে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিনতা। অস্ফুট স্বরে বলল, আমি এবার যাই।
তারপর পরদার বেষ্টনী পেরিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
প্রকৃতির বুকে ঝঞ্ঝা ও দুর্যোগ তখনও প্রচণ্ড আক্রোশে মাথা খুঁড়ছে। বজ্রপাত ও বিদ্যুৎঝলকের কোনও বিরাম নেই।
দরজার কাছে এসে দাঁড়াল বিনতা। পিছন ফিরে একবার তাকাল পরদার আড়ালে শুয়ে থাকা অদ্ভুত শরীরটার দিকে।
লণ্ঠনের হলদে আলো বিশ্রীভাবে কাঁপছে। ফোঁস-ফোঁস শব্দটা শোনা যাচ্ছে তীব্রভাবে, দুর্গন্ধটাও যেন ফিরে পাচ্ছে নিজের স্বরূপ।
বিনতার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগল। এক ঝটকায় দরজা খুলে দিল ও। খুলেই বিশ্রীভাবে চমকে উঠল।
গুণধর পাথরে খোদাই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি।
চলুন, দিদিমণি, আপনাকে ঘরে পৌঁছে দিই—।
আবার সেই পুরোনো পথ ধরে ফিরে যাওয়া। বিনতার হঠাৎই মনে হল ওর ডান হাতটা কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে পিছল হয়ে গেছে। নাকের কাছে হাতটা নিয়ে আসতেই অস্বাভাবিক গন্ধের আঘ্রাণ পেল ও। কুহেলি জড়ানো অলিন্দ ধরে পথচলার সময় ওর চেতনা এক নতুন শব্দের দিকে আকৃষ্ট হল। খুব কাছেই কোথাও প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি হচ্ছে। কয়েকটা কাটা-কাটা চিৎকারও বিনতার কানে এল। তারপরই একটা ভোঁতা বীভৎস শব্দ। কেউ যেন আর্তনাদ করে উঠল, কিন্তু সে চিৎকার ডুবে গেল ঝড়ের তীব্রতায়।
মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে ও গুণধরকে অনুসরণ করে চলল। ওর মনের মধ্যে বেজে চলেছে এক দ্রিমি স্বর : প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে…প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে…তুই, শুধু তুই…আর কাউকে আমি চাই না…কাউকে আমি চাই না।
একসময় সকাল হল, তবে সে-সকাল শুধু ঘড়ির কাঁটাতেই। কারণ জমাট বাঁধা ঘন কালো মেঘ সবরকম আলোর রেশ মুছে দিয়েছে সযত্নে। মুষলধারে বৃষ্টিরও বিরাম নেই, উত্তাল ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডবও ক্লান্তিহীন।
তিনতলার একটা বিশাল ঘরে প্রাতরাশের আয়োজন হয়েছিল, সেখানেই অন্যান্য অতিথির সঙ্গে পরিচয় হল বিনতার।
গতরাতে অঘোরঠাকুর্দার ঘর থেকে ফিরে আসার পর একটুও ঘুম আসেনি বিনতার। ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলোর মন্থনে সময় কেটে গেছে। এক বিস্ময়কর দায়িত্ববোধ যেন চেপে বসেছে ওর দেহে ও মনে। কখনও কখনও কানে এসেছে সেই রক্ত হিম করে দেওয়া বুকফাটা আর্ত চিৎকার। তবে আগে যে-চিৎকারে ছিল হতাশা ও আক্ষেপের সুর, এখন সেখানে মনে হয় উল্লাসের ছোঁয়া লেগেছে।
একসময় গিয়ে খোলা জানলার কাছে দাঁড়িয়েছে বিনতা। বৃষ্টির ছাটে ভিজেছে নির্লিপ্তভাবে, অনুভব করেছে বিধ্বংসী প্রকৃতিকে শরীরের প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে।
সকালে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়েই চিরদীপের কথা মনে পড়ল বিনতার। আশ্চর্য! এতটা সময় ওর কথা একেবারেই মনে পড়েনি।
চিরদীপের সন্ধানে রওনা হল বিনতা। অন্ধকার অলিন্দে চুনীরামের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাতিদানের গলে-যাওয়া মোমবাতিগুলো সরিয়ে নতুন বাতি বসাচ্ছে।
দাদাবাবু কোথায়, চুনীরামবাবু? এখনও কি ঘুম থেকে ওঠেনি?
কোটরগত চোখ সরাসরি বিনতার দিকে মেলে ধরে চুনীরাম বলল, ওঁর শরীরটা বোধ হয় ভালো নেই। কাল রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন, ভিজে মেঝেতে আছাড় খেয়ে মাথায় সামান্য চোট পেয়েছেন। আমি ঘর ছেড়ে বেরোতে বারণ করেছিলাম, শোনেননি।
চুনীরামের কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট হলেও বক্তব্য বুঝতে কোনও অসুবিধে হল না বিনতার। কিন্তু এই ঘটনায় যতখানি উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা, ততটা ও হতে পারছে কই! চিরদীপ ওর প্রেমিক। ওর স্বামী। ভালোবাসার মানুষ। ওর দুঃখ-কষ্টে বিনতার সুখ নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে দুঃখও যে নেই!
বিনতার দ্বিধাগ্রস্ত মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে চুনীরাম বলল, আপনি ওপরে যান, দিদিমণি। এই বারান্দার শেষে সিঁড়ি আছে। ওপরে খাবার ঘরে আর সব অতিথিরা আপনার জন্যে হয়তো অপেক্ষা করছে।—একটু থেমে সে যোগ করল, দাদাবাবুর শরীরটা ভালো হলে আমি নিয়ে যাব’খন।
নিজেকে অবাক করে দিয়ে তিনতলার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল বিনতা।
খাবার ঘরটা আকারে যেন ফুটবল খেলার মাঠ। লম্বা একটা ডাইনিং টেবিল ঘরের দৈর্ঘ্য বরাবর পাতা। প্রতিটি কাচের জানলা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর—তাই সমবেতভাবে বন্ধ। সিলিংয়ে ঝুলন্ত ঝাড়বাতির আলোয় ঘরের অন্ধকার যেন কিছুটা দূরে সরে গিয়ে ওত পেতে রয়েছে। আবার সুযোগ পাওয়ামাত্রই হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ডাইনিং টেবিলের কারুকার্য করা সাবেকী চেয়ারে বসে আছেন চারজন অতিথি। দুজন প্রাতরাশে মনোযোগ দিয়েছেন, এবং ঘরের দূরপ্রান্তে আধো-আঁধারিতে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে গুণধর।
গুণধরকে বিনতার চিনতে পারার কারণ ঘরের অস্বাভাবিক দৈর্ঘ্য অতিক্রম করেও ওর চাপা কর্কশ স্বর বিনতার কানে এসে পৌঁছল, বসুন, দিদিমণি।
অতিথি চারজনের একজন উঠে দাঁড়লেন। রোগা চেহারার ছিপছিপে যুবক। মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো চুল। লম্বাটে ফরসা মুখে ছেলেমানুষির ছাপ। এবং ঘন-ঘন চোখের পাতা বন্ধ করার মুদ্রদোষ রয়েছে। পরনে তার ফুলহাতা সাদা-কালো চেক শার্ট ও গাঢ় রঙের প্যান্ট। গলায় আশ্চর্যভাবে শোভা পাচ্ছে লাল, নীল, হলদে, সবুজ নানান রঙে রাঙানো একটি মাফলার।
একরাশ কৌতুক গলায় ঢেলে তিনি বলে উঠলেন, আসুন, আসুন, এই শকুন-সম্মেলনে আসন গ্রহণ করতে আজ্ঞা হোক! আপনি এলেন, ব্যস, ষোলোকলা পূর্ণ হল। অধমের নাম সচদেব পাল, যাত্রাদলে অভিনয় করে থাকি, তাতেই বেশ চলে যায়। কিন্তু হঠাৎই কী যে হল,—নাকমুখ কুঁচকে তেতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন সচদেব : বড়লোক আত্মীয় মারা যাচ্ছে শুনে আর স্থির থাকতে পারলেম না, উদাসী বাতাসের মতো ছুটে এলেম আমার মাসতুতো ভাইয়ের পিসতুতো দাদার ঠাকুর্দা শ্রীঅঘোরচন্দ্র রায়ের কাছে—নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত-পা নেড়ে শরীর দুলিয়ে বলে চললেন সচদেব, তবে এটুকু জানতেম, কিছু না কিছু সম্পত্তি আমি পাবই। যাত্রায় অভিনয় করি, অযাত্রা আমার কুষ্ঠিতে লেখা নেই।
সচদেব পাল এবার খাওয়ার কথা ভুলে বিনতার কাছে এগিয়ে এলেন। আবেগজর্জর গলায় শুরু করলেন, কিন্তু দেবী, এখানে এলেম, দেড়মাসব্যাপী থাকলেম, ঘুমোলেম, খেলেম, অঘোরচন্দ্রের মরবার নামটি পর্যন্ত নেই। এই শুনি মরে-মরে-মরে—আবার শুনি বেঁচে উঠেছে। শোনা কথায় বিশ্বাস করা ছাড়া তো উপায় নেই, কারণ এ পর্যন্ত ওঁকে দেখতেই পাইনি। অনুমতি নেই, ডাক্তারের বারণ, আরও কত কী!
সচদেবের ধৈর্য শেষ হল, রুক্ষভাবে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে উঠলেন, শালা, ডাকলে খোদাতালা পর্যন্ত দর্শন দেন, এ আবার কোথাকার কোন ভি. আই. পি. পাঁচু!
সচদেব, বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে।—যিনি ধমকে উঠলেন তাঁর পরনে কালো পাড় সাদা শাড়ি, সিঁথি সিঁদুরবিহীন, গায়ের রঙ মাঝারি, কোথায় যেন একটা চারিত্রিক দৃঢ়তা লুকিয়ে রয়েছে, বয়েস আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ।
সচদেব ক্ষিপ্ত কুকুরের মতো ঘুরে তাকালেন শাসনকারিণীর দিকে। ব্যঙ্গের মিষ্টি গলায় বললেন, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।—তারপর বিনতাকে লক্ষ করে : বিনতাদেবী, এইমাত্র যিনি আমাকে শাসন করলেন, তিনি সত্যিই আমার মাসি, তবে লতায় পাতায়, শিকড়ে নয়। আহা, কী প্রশান্ত মূর্তি, যেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ভারতমাতা!
ভদ্রমহিলার মুখ আরক্ত হল, উনি মাথা নিচু করে প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করতে লাগলেন।
ওঁর পাশে বছর চল্লিশের এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। চোখে চশমা, সম্ভ্রান্ত মুখ, মাথার চুলে কিছুটা পাক ধরেছে, ঠোঁটের ওপর গাম্ভীর্যের গোঁফ, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি ও হালকা সাদা চাদর। তিনি বিধবা মহিলাকে চাপা গলায় বললেন, রুচিরা দেবী, আপনি নিজের মনে থাকুন। সচদেবের কথায় কান দেবেন না।—তারপর বিনতাকে উদ্দেশ করে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্বরে বললেন, আসুন, আসুন, বিনতা দেবী, বসুন, খাওয়া শুরু করুন।
বিনতা ক্রমেই অবাক হচ্ছিল। সচদেব পাল হয়তো মিথ্যে বলেননি। এ-সম্মেলন শকুন-সম্মেলন ছাড়া আর কী? একটা মানুষ কখন মরবে সেই অপেক্ষায় সবাই প্রহর গুনছে। ও পায়ে-পায়ে নির্দিষ্ট চেয়ারে গিয়ে বসল। খাবার সামনে সাজানোই ছিল, ও খেতে শুরু করল।
বিনতাকে যিনি আহ্বান জানিয়েছেন সেই ভদ্রলোক এবারে নিজের পরিচয় দিলেন,
আমার নাম অচিন্ত্য পুরকায়স্থ। আর ইনি আমার স্ত্রী ললিতা—
ললিতা পুরকায়স্থের পাশে একটা চেয়ার ছেড়ে বসে ছিল বিনতা। দেখল, শ্যামবর্ণা, স্বাস্থ্যবতী, লাল ডুরে শাড়ি পরিহিতা শ্রীমতী পুরকায়স্থ খেতে-খেতেই মাথা নাড়লেন। ব্যস্ত মুখ থেকে একটা চাপা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল শুধু।
বিনতা অপ্রতিভ ভঙ্গিমায় হাসল। কিন্তু পরক্ষণেই সচদেব পালের কথায় চমকে উঠল। যেন ধারালো চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল কথাগুলো।
অচিন্ত্যদা, বহু ঘাটের জল পান করেছি, কিন্তু আপনার মতো ন্যাকা পাবলিক দুটো দেখিনি। সচদেব এতক্ষণ ওদের চারজনকে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিলেন, একটু সময় নিয়ে বললেন, ভদ্রতার মোড়কে নিজের হ্যাংলা চরিত্রটা শেষ পর্যন্ত ঢাকতে পারবেন? আপনি, আপনার হোঁদল কুতকুতে বউ, ওই ভারতমাতা, আর আমি—আঙুল উঁচিয়ে প্রত্যেককে দেখালেন সচদেব, এমনকী নিজেকেও, তারপর : এই চারজন গত দেড়মাস ধরে বিনতা দেবীর জন্যে অপেক্ষা করিনি? যতবারই আমরা ভাগ-বাটোয়ারার প্রশ্ন তুলেছি ততবারই গুণধর নয়তো হারামজাদা চুনীরাম এসে খবর দিয়েছে, স্থির ভবো, আরও একজন আসিতে বাকি অছি!—ব্যঙ্গের সুরে ভেংচে উঠলেন সচদেব : আজ সেই বিনতা দেবী উপস্থিত। গত রাতেই খবরটা জানতে পেরে আমরা আশনাই করিনি?
রুচিরা দেবী অস্থিরভাবে অচিন্ত্যকে দেখছেন, বিনতাকে দেখছেন, ললিতাকে দেখছেন। যেন মনে-প্রাণে চাইছেন, কেউ একটা মুখের মতো জবাব দিয়ে সচদেবকে ঠান্ডা করে দিক।
অচিন্ত্য নির্বিকার।
ললিতা খাওয়ায় ব্যস্ত।
বিনতা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
এবং ছায়াময় গুণধর প্রাচীন আসবাব মাত্র।
সচদেব হাত-পা ছুড়ছেন, মুখ বিকৃত করছেন, আর সমানে বলে চলেছেন, এভাবে টাকার লোভ দেখিয়ে টেনে এনে দেড়মাস ধরে আঙুল চুষিয়ে বসিয়ে রাখার কোনও মানে হয় না। বিনতা এসে গেছে, আর দেরি নয়, হেস্তনেস্ত যা করার এখনই করতে হবে। অঘোরচন্দ্রকে মরতেই হবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে রক্ত জমানো এক ভয়ানক চিৎকার আলোছায়াময় ডাইনিং হলের বাতাস কাঁপিয়ে দিল। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভাঙতে-ভাঙতে সেই হিমেল চিৎকারের টুকরো ঘিরে ধরল সবাইকে। পচা ভ্যাপসা একটা দুর্গন্ধ প্রলয়ঙ্কর তরঙ্গের শক্তিতে ওদের দম বন্ধ করে দিতে চাইল। এবং হাপরের ফোঁস-ফোঁস শব্দ আবদ্ধ ঘরে যেন দামামা বাজিয়ে চলেছে।
প্রত্যেকেই চমকে উঠেছেন, শুধু বিনতা ছাড়া। ও বিস্ময়-থমথমে মুখে যেন কোনও কিছু ঘটার অপেক্ষা করছে। ওর কানে বেজে চলেছে এক অপার্থিব ফিসফিসে কণ্ঠস্বর, কাউকে আমি চাই না, আর কাউকে আমি চাই না…।
এই অদ্ভুত পরিস্থিতিকে আরও অদ্ভুত করে তুলল সচদেবের আচরণ। হঠাৎ এক প্রচণ্ড অদৃশ্য ধাক্কায় তাঁর গোটা শরীরটা কেঁপে উঠল। দু-হাতে গলার মাফলারটা আঁকড়ে ধরলেন তিনি। নিজের সঙ্গেই যেন ধস্তাধস্তি শুরু করলেন। কিন্তু সকলের বিস্ফারিত চোখের সামনে ওঁর রঙিন মাফলারটা এক ভয়ঙ্কর সরীসৃপ হয়ে ওঁর গলায় এঁটে বসতে লাগল। দু-প্রান্তের ঝুলন্ত অংশটুকু হঠাৎ যেন প্রাণ পেয়ে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরল সচদেবের কণ্ঠনালী।
সচদেবের শরীর বেঁকে গেল ভয়ঙ্কর আক্ষেপে। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল কাছাকাছি। সাইক্লোনের তুমুল শব্দ ছাপিয়ে আবার শোনা গেল সেই নৃশংস চিৎকার, উল্লাসের চিৎকার।
সচদেবের চোখের কোণ ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। নাকের পাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল সেই রক্তের ধারা। এখনও তিনি গলা থেকে মাফলারটা খোলার চেষ্টায় যুঝে চলেছেন। মুখের প্রতিটি ভাঁজ ও রেখা বিকৃত হয়ে গিয়ে তাঁকে আর চেনা যাচ্ছে না।
চেয়ার ঠেলে লাফিয়ে উঠলেন অচিন্ত্য, ললিতা, ও রুচিরা দেবী। মহিলা দুজন বিশ্রী চিৎকার শুরু করলেন। বিনতা নিজের চেয়ারে স্থির। কোণের আঁধারে গুণধরও।
সচদেব পালের নাক দিয়ে এখনও রক্ত পড়ছে, শরীরের নড়াচড়া অনেক কমে এসেছে।
হঠাৎই তাঁর শরীরটা রণক্লান্ত হয়ে হাঁটু ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেঝেতে। মাফলারটা বেল্টের মতো গলায় কেটে বসেছে, এত চেষ্টাতেও তার বাঁধন শিথিল হয়নি।
একঝলক ঠান্ডা বাতাস ঘরের মধ্যে আলোড়ন তুলে বেরিয়ে গেল। বলে দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই যে, সচদেব পাল মারা গেছেন। বিনতার কানে সম্মোহনী সুরে এখনও কেউ বলে চলেছে, কাউকে আমি চাই না…আর কাউকে আমি চাই না…।
এইবার গুণধরের মধ্যে প্রাণের সাড়া পাওয়া গেল। ও ধীরে-ধীরে এগিয়ে এল সচদেবের মৃতদেহের কাছে। এক হাতে অবলীলায় সেটা কাঁধে তুলে নিল। তারপর অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেল, বাড়ির পেছন দিকে কিছু ঝোপ-জঙ্গলও আছে। সেখানেই পুঁতে দিয়ে আসি। নইলে এই দুর্যোগে সৎকার আর কীভাবে হবে?
সচদেব—সচদেব মরল কেমন করে? আমি কি ভুল দেখলাম?—বিস্ময় ও আতঙ্কে অস্থির অচিন্ত্যর কণ্ঠ চিরে এই জিজ্ঞাসা বেরিয়ে এল। সঙ্গে-সঙ্গেই আর্ত চিৎকার করে জ্ঞান হারালেন রুচিরা দেবী। অচিন্ত্য ও ললিতা তাঁর আলুথালু দেহের ওপর ঝুঁকে পড়লেন।
ঘরের অন্ধকার যেন আরও জমাট বেঁধেছে। কোনও কিছুই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। না। একটা ভিজে দুর্গন্ধময় কুয়াশা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় আবির্ভূত হল চিরদীপ। উদ্ভ্রান্ত চেহারা, চোখের কোলে কালি, মাথায় ভারি ব্যান্ডেজ—রক্তে কিছুটা ভিজে উঠেছে।
বিনতা। বিনতা!—হাঁফাতে হাঁফাতে চেঁচিয়ে উঠল ও, শিগগির। যে করে হোক এখান থেকে আমাদের পালাতে হবে। চলে এসো, এক্ষুনি।
বিনতা যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল। স্পষ্ট চোখ মেলে অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করল চিরদীপকে। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার আর কোথাও যাওয়ার পথ নেই, চিরদীপ।—পায়ে-পায়ে স্বামীর কাছে এগিয়ে গেল বিনতা : আমার ঘরে চলো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
হতভম্ব বিমূঢ় চিরদীপকে নিয়ে বিনতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই রুচিরা দেবীর জ্ঞান ফিরল। উৎকট গন্ধময় বাতাস তিনি আর সইতে পারলেন না। সমস্ত শরীরে পাক দিয়ে হেঁচকি তুলে বমি করতে শুরু করলেন। ললিতা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁকে শান্ত করতে চেষ্টা করছেন।
সশব্দে আবার বাজ পড়ল কোথাও, এবং সাইক্লোনের গজরানি ছাপিয়ে শোনা গেল একপাল শেয়ালের সুদীর্ঘ বিলাপ, যেন কারও শবযাত্রায় শোক-গাথা গাইছে।
বিনতা ঘরের দরজা বন্ধ করতেই ক্ষোভে ফেটে পড়ল চিরদীপ, বিনতা এই একটা রাতে তুমি কি একেবারে বদলে গেলে? তুমি জানো, কাল রাতে কী হয়েছে? এই সৃষ্টিছাড়া বাড়িতে আর একটা মুহূর্তও আমি থাকব না।
শান্ত স্বরে বিনতা জানতে চাইল, কী হয়েছে কাল রাতে? কোনও দুর্ঘটনা? চুনীরামবাবু বলছিলেন ভিজে মেঝেতে পিছলে পড়ে গিয়ে…।
হ্যাঁ, দুর্ঘটনাই বটে, মাথার ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে নিল চিরদীপ। তিক্ত হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটের কোণে। তারপর ধীরে-ধীরে বলল গতকাল রাতের ঘটনা।
রাত তখন কত খেয়াল নেই, হঠাৎই এক ফিসফিস কণ্ঠস্বর শুনতে পায় চিরদীপ। কে যেন প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে হিংস্র স্বরে বলছে, তুমি কে? বিনতার সঙ্গে কেন এসেছ? কে তুমি? তোমাকে আমি চাই না…কাউকে চাই না। শুধু বিনতা…।
চিরদীপ চমকে জেগে ওঠে। ছোট্ট ভাঁড়ার ঘরের জমাট বাতাসে ওর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ফলে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে ও। ঘন অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই ও দেখতে পেল অলিন্দের শেষ প্রান্তে দুটো অপচ্ছায়া মিটমিটে মোমের আলোয় পথ দেখে এগিয়ে চলেছে। কৌতূহল বেড়ে ওঠায় চিরদীপ এদের অনুসরণ করতে শুরু করে, কিন্তু হঠাৎই ওরা হারিয়ে যায়। চিরদীপ তখন বড় একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার ওদের দেখা যায়। কিন্তু ওরা কাছাকাছি এগিয়ে আসার আগেই চিরদীপকে পিছন থেকে কে যেন জাপটে ধরে। ধস্তাধস্তি শুরু হয় অদৃশ্য আততায়ীর সঙ্গে। আশ্চর্যজনকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে চিরদীপ, এবং শেষ মুহূর্তে ভারী একটা কিছু দিয়ে আততায়ী ওকে মাথায় আঘাত করে। ও জ্ঞান হারায়।
এরপরে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ও নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে। সারা শরীরে অবসাদ, ক্লান্তি। মাথাটা প্রচণ্ড ভারী। আধো ঘুমে আধো জাগরণের মধ্যে এরপর শুরু হল ধারাবাহিক দুঃস্বপ্ন। ও দেখল, একজন অল্পবয়েসী যুবক আপ্রাণ শক্তিতে ছটফট করছে, গলায় একটা রঙিন মাফলার, সেটা এঁটে বসেছে মরণ কামড়ে। তারপর ছেলেটির চোখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। চারদিকে শুধু লাল আর লাল। শোনা গেল একটা অলৌকিক উল্লাসের চিৎকার।
বিনতা, ওইসব ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে আমি ভীষণ টায়ার্ড, তা ছাড়া আমার ভয়ও করছে।—চিরদীপ অনুনয় করে বলল, চলো, আমরা ফিরে যাই। অঘোরচন্দ্র রায়ের রাজপ্রাসাদে ঢের বেড়ানো হয়েছে।
বিনতা শ্লথ পদক্ষেপে এগিয়ে গেল খোলা জানলার কাছে।
প্রকৃতির কোনও পরিবর্তন নেই। ঘণ্টায় কম করেও দেড়শো কিলোমিটার বেগে ঝড় বইছে। ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া কাঁঠাল, জামরুল ও অশ্বত্থ গাছগুলো উন্মত্তের মতো এপাশ-ওপাশ দুলছে। ওর ফরসা মুখে এসে ঝাপটা মারছে বড়-বড় বৃষ্টির ফোঁটা। বিনতা স্থির অচঞ্চল গলায় বলল, চিরদীপ, তুমি ইচ্ছে হলে ফিরে যাও। আমি বাধা দেব না। কিন্তু আমি…।
বিনতার কথা শেষ হল না, একটা প্রাণফাটা বিকৃত চিৎকার শোনা গেল, বাঁচাও! বাঁচাও!
তারপর সেই চিৎকার মুমূর্ষু জান্তব আর্তনাদের রূপ নিল। এবং বেজেই চলল।
চিরদীপ বিনতার কথার প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, চট করে ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে।
কে চেঁচাচ্ছে? জিগ্যেস করল চিরদীপ।
জানি না।—বিনতা জবাব দিল।
চিরদীপ একটা মুহূর্ত কী ভাবল, তারপর অসমর্থ শরীর নিয়েই তীরবেগে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ওর ভারী পায়ের শব্দ অলিন্দে ধ্বনি ও প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করল।
চিৎকারের উৎস অনুমান করে তিনতলার একটা ঘরে এসে উপস্থিত হল চিরদীপ। অন্য সবাই, অর্থাৎ, অচিন্ত্য ও ললিতা, সেখানে ইতিমধ্যেই হাজির। আসার পথে চুনীরামকে কাজে ব্যস্ত দেখেছে চিরদীপ। তেল রঙে আঁকা সাবেকী ছবিগুলো বারান্দার এক আঁধারি কোণে বসে পরিষ্কার করছে। ছুটন্ত চিরদীপকে দেখে সে এতটুকু বিচলিত হয়নি। বরং আরও গভীর মনোযোগে হাতের কাজে ডুবে গেছে।
ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্য ও ললিতা অসংলগ্ন কথাবার্তায় কী করবেন ঠিক করার চেষ্টা করছিলেন, চিরদীপ এসে এক ধাক্কায় দরজা খুলে ফেলল।
ঘর খালি, তবে বন্ধ কলঘর থেকে রুচিরা দেবীর প্রাণান্তকর চিৎকার বিকটভাবে কানে এসে বাজছে। বাথরুমের ভেতরে যেন মরিয়া হয়ে ছুটোছুটি করে চলেছেন তিনি। ধস্তাধস্তি করছেন কোনও অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে।
চিরদীপের ইশারায় অচিন্ত্য ওর সাহায্যে এগিয়ে এলেন। দুজনে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাথরুমের বন্ধ দরজার ওপর। ললিতা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শব্দকল্পের জটিলতা সৃষ্টি হল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড আঘাতে ভেঙে গেল কাঠের দরজা। ততক্ষণে রুচিরা দেবীর চিৎকার স্তব্ধ হয়ে গেছে। আবার স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে ঝড়ের গর্জন। বাথরুম থেকে একটা উৎকট বাতাস বেরিয়ে এসে উপস্থিত তিনজনকে শিউরে দিল। এবং ভেতরের দৃশ্যও।
সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে মেঝেতে পড়ে আছেন রুচিরা দেবী। বাথরুমের বড় কাচের জানলা দিয়ে হুহু করে বাতাস ঢুকছে। কারণ, জানলার বড়-বড় শার্সিগুলো ভেঙে চৌচির। এবং ভাঙা কাচের টুকরো একটিও মেঝেতে পড়ে নেই। সুনিপুণভাবে বিঁধে রয়েছে রুচিরার সর্বাঙ্গে। দুটো কাচের ফলা গেঁথে আছে তাঁর বিস্ফারিত দু-চোখের মণিতে, একটা কপালের ঠিক কেন্দ্রস্থলে, আর বাকিগুলো পেটে, মুখে বুকে—দেহের সর্বত্র। রক্তের সরু রেখা অসংখ্য হিলহিলে সাপের মতো জটিল ছবি এঁকেছে রুচিরার মসৃণ ত্বকে। কটু বাতাসটা ঘূর্ণিঝড় তুলল বাথরুমের ভেতরে। তারপর হিস হিস শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল।
ঘটনাস্থলে এবার উপস্থিত হল চুনীরাম ও গুণধর। হাতে একটা চাদর। সবাইকে সরে যেতে অনুরোধ করে ওরা চাদর মুড়ে কাঁধে তুলে নিল রুচিরার মৃতদেহ। চুনীরাম অস্পষ্ট গলায় বলল, ঝোড়ো হাওয়ায় জানলার কাচ ভেঙে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। বড়ই দুঃখের ঘটনা।
সকলেই অবাক, বিমূঢ়। চাপা কান্নায় ও আতঙ্কে ললিতা পুরকায়স্থ ফুলে-ফুলে কেঁপে উঠছেন। চিরদীপের ভুরু কুঁচকে উঠল দুশ্চিন্তায়। এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর স্বাভাবিক কোনও ব্যাখ্যা নেই।
ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে শুনতে পেল হাপরের শব্দের তীব্রতা যেন হঠাৎই শতগুণ বেড়ে গেছে। আর নতুন একটা উল্লাসধ্বনি চিরদীপের মজ্জায়-মজ্জায় যেন ছড়িয়ে দিল বরফের কুচি।
অচিন্ত্য ও ললিতা স্থলিত পায়ে ফিরে চললেন নিজেদের ঘরে। অচিন্ত্য হাতঘড়ি দেখলেন, বেলা বারোটা। এই অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটে গেল দু-দুটো ভয়ঙ্কর অপমৃত্যু। এবারে কার পালা? অচিন্ত্যর, ললিতার, চিরদীপের, না বিনতার?
অচিন্ত্য ও ললিতার ঘর আকারে সামান্য ছোট, কিন্তু চরিত্রে সাবেকী ঢঙের কোনও হেরফের নেই। প্রাচীন খাটের ওপরে আয়েসী শয্যা, তার ওপরে শুয়ে আছেন ওঁরা দুজনে—মুখোমুখি। একটু আগেই মধ্যাহ্নভোজ পর্ব শেষ হয়েছে, কিন্তু দিবানিদ্রার মানসিকতা কারও নেই। কৌতুক ও রঙ্গপ্রিয় সচদেব পালের নিষ্ঠুর মৃত্যু, এবং রুচিরা দেবীর অসহায় জীবনাবসান অচিন্ত্য ও ললিতাকে যেন বার্ধক্যের দিকে দশ বছর করে এগিয়ে দিয়েছে।
কাল সকালেই আমরা ফিরে যাব, ললিতা।—অচিন্ত্য ভারী গলায় থেমে-থেমে বললেন।
ললিতার উত্তর স্পষ্টভাবে শোনা গেল না।
ঘর যথারীতি আবছায়া অন্ধকার। দু-দুটো বিশাল কাচের জানলা দিয়ে বাইরের দামাল প্রকৃতি চোখে পড়ে। তার বুকে মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে সৌদামিনী-রেখার আঁকাবাঁকা জ্বলন্ত চাবুক। জানলার বন্ধ শার্সি ভেদ করে যে-আলো ঘরে এসে পড়েছে, তাকে আলো বলা যায় না। হয়তো সেই কারণে ঘরের দেওয়ালে মোমবাতিদানে বসানো রয়েছে লাল রঙের একটা মোমবাতি। তার হলদে বিবর্ণ শিখা বেহিসেবি ভাবে কাঁপছে।
মোমবাতির আলো এসে পড়েছে পাশ ফিরে শুয়ে থাকা অচিন্ত্যর পিঠে। অচিন্ত্যর ছায়ার আড়ালে ললিতা প্রায় অন্ধকারে। এঁদের মুখাবয়ব অস্পষ্ট। শুধু শোনা যাচ্ছে অচিন্ত্যর ক্লান্ত-শ্রান্ত কথার টুকরো।
যখন এসেছিলাম, মনে আশা ছিল, অঘোরকাকার কাছ থেকে কিছু পেলে ডুবে যাওয়া ব্যবসাটাকে আবার বাঁচাতে পারব, কিন্তু…যাকগে, আপাতত শান্তিতে ফিরে যেতে পারলেই ভালো।—অচিন্ত্যর বুক ঠেলে একটা গভীর নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল : এতগুলো দিন এখানে বেশ আনন্দেই ছিলাম। আকাশ ছিল পরিষ্কার, বাতাস ছিল শান্ত। দীঘার সমুদ্র, নোনা হাওয়া, ঝাউবন—কী ভালোই না লেগেছিল। তারপর বাড়ির কাছেই ওই সুন্দর পার্ক, তার হ্রদ, সেখানে নৌকা বাওয়া, নুড়ি ঢালা উঁচু-নিচু পথ—মনে হচ্ছিল, ইস, এখানেই যদি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম।—স্বপ্নময় আবেশটা এবার অদৃশ্য হল অচিন্ত্যর স্বর থেকে। তিনি সামান্য আশঙ্কাগ্রস্ত সুরে বলতে লাগলেন, কিন্তু ললিতা, গতকাল দুপুর থেকে সব কেমন পালটে যেতে লাগল। আকাশে মেঘ করে শুরু হল সাইক্লোনের তাণ্ডব, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা অচল হল, বাড়ির জেনারেটার গেল বিগড়ে। চারদিকে শুধু অন্ধকার আর আতঙ্ক। অঘোরচন্দ্রকে কোনওদিন দেখিনি, কিন্তু তাঁর আদেশ এমনই যে, লঙ্ঘন করা যায় না। সুতরাং নির্লজ্জের মতো আমরা বিনতার জন্যে অপেক্ষা করেছি। ও এল। আর একই সঙ্গে শুরু হল অলৌকিক ভয়ঙ্কর সব ঘটনা…।
অচিন্ত্য হঠাৎই থামলেন। কারণ তার মনে হল, ললিতা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। এবং একটা কটু বাতাস যেন ঘূর্ণিঝড় তুলেছে ঘরের ভেতরে।
তিনি ললিতার বাহুতে হাত রাখলেন। সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে ওঁকে ডাকলেন, ললিতা…ললিতা…।
জড়ানো অস্ফুট শব্দ করে ললিতা নড়ে উঠলেন।
বন্ধ জানলার একটা শার্সি হঠাৎই ভেঙে পড়ল মেঝেতে। কিন্তু আশ্চর্যভাবেই কোনও শব্দ হল না। ঝোড়ো বাতাস অনুপ্রবেশ করল তাড়া খাওয়া স্বদেশির মতো। বাতিদানে মোমবাতির শিখা কেঁপে উঠল লকলক করে। তারপর যেন মন স্থির করে নিয়ে ক্রমশ দীর্ঘ হতে শুরু করল। একটা লিকলিকে হলদে জিভ যেন এগিয়ে চলেছে বিছানায় শুয়ে থাকা অচিন্ত্য ও ললিতার দিকে। একটা শিখা ধীরে-ধীরে দশটা শিখায় পরিণত হয়েছে। ঝোড়ো বাতাসে ভর করে প্রায় বারো ফুট দূরত্ব শূন্যপথে অতিক্রম করে সেই আগুনের অজগর সাপটা অচিন্ত্যর পিঠে ছোবল বসাল। মুহূর্তে যেন ফুটে উঠল অসংখ্য হলদে ফুল। প্রথমে অচিন্ত্য, তারপর ললিতা। লকলকে শিখার হাজারো জিহ্বা ওঁদের গ্রাস করল পলকে।
দুর্গন্ধময় বাতাসটা উন্মত্ত উল্লাসে ঘরের ভেতরে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে উচ্চগ্রামের এক সুদীর্ঘ চিৎকার। যেন নরকের দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ চিৎকার করে আহ্বান জানাচ্ছে। হাপরের ফোঁস-ফোঁস শব্দ দ্রুতলয়ে বেড়ে উঠে বিশ্বচরাচরকে যেন শব্দব্রহ্মে লুপ্ত করে দিতে চাইল।
একটু পরেই লেলিহান আগুন প্রশমিত হয়ে সরে এল। আবার রূপান্তরিত হল মোমবাতির নিরীহ শিখায়। অক্ষত বিলাসী শয্যায় এখন পড়ে আছে শুধু একরাশ কালো ছাই। ঘরের আর কোনও জিনিসে আগুনের আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। অক্ষত বিছানা, অক্ষত বালিশ, অক্ষত ঘরের প্রতিটি ধূলিকণা। শুধু মুছে গেছেন অচিন্ত্য পুরকায়স্থ ও ললিতা পুরকায়স্থ। ধ্বংসের পূর্বমুহূর্তেও ওঁরা জানতে পারেননি, নিয়তি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবে শেষ মুহূর্তে ললিতার মনে পড়েছিল কলকাতায় রেখে আসা সাত বছরের একমাত্র ছেলের কথা।
আবার ডাক এসেছে। অপ্রতিরোধ্য ডাক। এই ডাক উপেক্ষা করা যায় না। চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায় ডাকের উৎসস্থলে।
সন্ধে পেরিয়ে রাত হয়েছে, কারণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে কিছুই আর চোখে পড়ে না। বিনতার মুখে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে উত্তাল হাওয়া। বৃষ্টির ছাঁটে চুল ভিজে গেছে। চোখের পাতায়, কপালে বিন্দু-বিন্দু জলের ফোঁটা।
চিরদীপ বসে আছে বিছানায়। মুখ গম্ভীর। অনুমান হয়, বিনতার সঙ্গে কোনও বিষয়ে ও একমত হতে পারছে না। ওদের দ্বন্দ্ব-বিহ্বল মুহূর্তে দরজায় এসে দাঁড়াল চুনীরামের ছায়া।
বাবু ডাকছেন, দিদিমণি—।
বিনতা জেগে উঠল আচ্ছন্নতা থেকে। একটিও কথা খরচ না করে রওনা হল চুনীরামকে অনুসরণ করার জন্যে। কিন্তু উঠে এসে ওর পথরোধ করে দাঁড়াল চিরদীপ : তুমি যাবে না, বিনতা।
সরে যাও, চিরদীপ, এ হয় না।—নির্লিপ্ত শান্ত সুরে বলল বিনতা।
না!—গলার স্বর উঁচু হল চিরদীপের : যদি যেতে তোমাকে হয়ই, তাহলে আমিও যাব। স্বচক্ষে মোলাকাত করে আসব তোমার ঠাকুর্দার সঙ্গে।
এইবার এগিয়ে এল চুনীরাম। অস্পষ্ট স্বরে বলল, ছেলেমানুষি করবেন না, দাদাবাবু। কাল রাতের কথা মনে নেই?
চিরদীপের মাথায় যেন আগুন চড়ে গেল। ঋজু দেহটাকে বাঁকিয়ে নিয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল চুনীরামের ওপর। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে চুনীরাম ডান হাতে সামান্য ঝটকা দিল। এবং আসুরিক শক্তিতে বিছানার ওপর নিক্ষিপ্ত হল চিরদীপ। হাত-পা ছড়িয়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে রইল।
চুনীরামের কৃশ শরীরে কোথা থেকে এল মত্ত হাতির শক্তি? চিরদীপের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে বিনতা ও চুনীরাম নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল ঘর থেকে। যাওয়ার আগে বিনতা ছোট্ট করে বলে গেল, তুমি তোমার ঘরে যাও, চিরদীপ। ফিরে এসে আমি একটু একা থাকতে চাই।
আবার সেই চেনা পথ পার হয়ে সেই রহস্যময় দরজা, সেই রহস্যময় ঘর, সেই রহস্যময় প্রাচীন পুরুষ। আজ, এই মুহূর্তে, বিনতার মনে ভয় নেই, নেই কোনও আশঙ্কা। ছায়াময় ঘরের চারদিকে একপলক নজর বুলিয়ে নিয়ে পরদাঘেরা অঞ্চলের দিকে এগোল বিনতা। ঢুকে পড়ল ভেতরে।
লণ্ঠনের আলো আজ অস্বাভাবিক রকম স্তিমিত। তীব্র কটু গন্ধ বিনতাকে আর বিব্রত করতে পারল না। ও আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে গেল টুলের কাছে। বসল। ছোট্ট করে বলল, আমায় ডেকেছেন?
উত্তরে মশারির নীচ দিয়ে খসখসে চামড়ায় ঢাকা ছাতা পড়া সবুজাভ একটা হাত বেরিয়ে এল। ভয়ঙ্কর শক্তিতে চেপে ধরল বিনতার হাত। তারপর শ্বাস টেনে বলল, বিনতা, সময় হয়ে এসেছে…ওরা আর কেউ নেই…সচদেব-অচিন্ত্য…অচিন্ত্যর বউ…রুচিরা…সব গেছে। কাউকে আমার চাই না…কারও প্রয়োজন নেই…
হাতের চাপ ক্রমশ অমানুষিকভাবে বাড়ছে। বিনতা অনুভব করল ওর ধমনীতে এক বিচিত্র জ্বালা। সেই জ্বালা ক্রমে বয়ে চলেছে শরীরের অভ্যন্তর থেকে অভ্যন্তরে। নাকে, মুখে, চোখে, ত্বকে। শ্যাওলার আঁশটে পচা গন্ধ ওকে ঘিরে ধরেছে, জড়িয়ে ধরেছে আকুলভাবে। হাপরের শব্দের ছন্দ ক্রমশ শ্লথ হয়ে আসছে।
গত একমাস ধরে আমি এই দেহে বন্দি রয়েছি মরেও আমি মরতে পারিনি কারণ আমার আসল যে-উত্তরাধিকারী, সে আসেনি…তুই, বিনতা…তোর জন্যে এই অবস্থায় আমি মরে গিয়েও অপেক্ষা করেছি…।—দ্বিতীয় একটা হাত বেরিয়ে এল মশারির বাইরে, দিশেহারা হয়ে যেন কিছু খুঁজছে। তারপর :…আজ আমার সমস্ত কিছু আমি তোকে সমপর্ণ করলাম। সব কিছু…সব কিছু…আমি যাচ্ছি, বিনতা, আমি যাচ্ছি আমার সব কিছু এখন থেকে তোর…সব তোর…।
ফিসফিসে সম্মোহনী শব্দগুলো বিকৃত হয়ে ছুটে বেড়াতে লাগল ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে : সব কিছু তোর…সব কিছু…।
বিনতা যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। মাথার ভেতরে কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, যেন কোনও সুড়ঙ্গের দূর প্রান্ত থেকে কেউ চিৎকার করে ওকে ডাকছে। ঘরের বাতাস হঠাৎ ভীষণ ঠান্ডা হয়ে গেল, বরফের হিম অবশ করে দিতে চাইল প্রতিটি অঙ্গ। একটা অদ্ভুত শন্ শন্ শব্দ শিস কেটে ঝঙ্কার তুলল বাতাসে।
বিনতার চোখের সামনে মশারিটা ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসছে। সবুজাভ হাত দুটো যেন তরল হয়ে ঘন-ঘন ফোঁটায় টপ-টপ করে গলে পড়ছে মেঝেতে।
বিনতা একটুও বিচলিত হল না, জমাট পাথর হয়ে প্রত্যক্ষ করতে লাগল। অতি ক্ষীণ একটা কণ্ঠস্বর ক্রমে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে।
এই বাড়ি…এই প্রাসাদ…বিষয়-আশয় সব তোর…তোকেই সব দেখতে হবে, মা। গুণধর, চুনীরাম রইল…ওরা তোকে সাহায্য করবে…আর…আর আমি তো আছিই…বিনতা, বিনতা, কর্তব্য পালনে যেন কোনও খুঁত না থাকে…দেখিস আমি চললাম চললাম।
উৎকট গন্ধটা ভয়ঙ্কর তীব্র হল। এক সুদীর্ঘ অপার্থিব চিৎকার শুরু হল ঘরের ভিতরে। বিনতার চোখ ঝাপসা, মন ঝাপসা, এমনকী শরীরও ঝাপসা।
অপার্থিব করুণ চিৎকারটা কাঁপতে কাঁপতে ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে…ঘরটা ভরে উঠেছে ঘন ভিজে কুয়াশায়…ঝড়ের তাণ্ডব হয়ে উঠল বহুমুখী…দূর থেকে তীব্র স্বরে ডেকে উঠল শৃগালের দল…বিনতা যেন ক্রমে নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলছে…।
হঠাৎ গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে চমকে উঠল বিনতা। যেন হাওয়ায় ভর করে ও এগিয়ে গেল কাচের জানলার কাছে। জানলা খুলে দিল। উদ্দাম বাতাস ঘরের সাদা পরদাগুলোকে শিরশির করে কাঁপিয়ে দিল। শীত করে উঠল বিনতার। যেন মেরু অঞ্চলের বাতাস নিয়ে এসেছে কোনও গভীর ইঙ্গিত।
ঘন অন্ধকারে স্পোর্টস কারের উজ্জ্বল হেডলাইট দেখতে পেল বিনতা। চিরদীপ গাড়ি নিয়ে ছুটে চলেছে। কোথায় যেতে চায় ও? বিনতার ঠোঁটের কোণে খেলে গেল রহস্যময় হাসি। রায়ভিলাকে চিরদীপ ভয় পেয়েছে, দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাহসী অ্যাথলিট! জানলা ছেড়ে ও রওনা হল ঘরের দিকে।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল গুণধর ও চুনীরাম। বিনতাকে বেরোতে দেখেই অনুগত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকাল। বিনতা স্মিত হাসল। অস্পষ্ট হালকা স্বরে বলল, তোমরা নিজেদের কাজে যাও—।
দাদাবাবু একটু আগে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন।—গুণধর কর্কশ স্বরে বলল।
কে? ওই চিরদীপ সরকার? কাল রাতে যে এসেছিল?
বিনতার বদলে যাওয়া কণ্ঠস্বর ওদের অবাক করে দিল। নিঃশব্দে ছায়ার মতো সরে গেল দুজনে।
অন্ধকার অলিন্দ পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল বিনতা। এই প্রাসাদ যে ওর কতকালের চেনা! এর আনাচেকানাচে সদ্য ফোটা গোলাপের গন্ধ, এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেজে চলেছে সেতারের সুর। এই সুন্দর বাতাস, এই সুন্দর প্রকৃতি, এ যেন অতুলনীয়।
সদর দরজা খুলে গাড়িবারান্দায় এসে উপস্থিত হল বিনতা। স্থির হয়ে দাঁড়াল। চিরদীপের গাড়ি যে-পথে রওনা হয়েছে সেই পথের দিকে ওর শীতল দৃষ্টি অচঞ্চলভাবে নিবদ্ধ। দুরন্ত বাতাসে বিনতার ভিজে চুল উড়ছে, উড়ছে সাদা শিফনের শাড়ি। জলের ফোঁটা মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুটিয়ে তুলছে অনিয়তাকার আলপনা।
কিছুক্ষণ প্রতীক্ষার পর আবার শোনা গেল গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। এদিকেই আসছে। ক্রমে দেখা গেল হলদে সার্চলাইটের আলো। পরক্ষণেই গাড়িবারান্দার কাছে এসে সজোরে ব্রেক কষল চিরদীপ।
ওকে দেখল বিনতা। উদ্ভ্রান্ত চেহারা, মাথার ব্যান্ডেজ জলে ও রক্তে ভিজে বীভৎস রূপ নিয়েছে। চিরদীপের চোখে হতবাক দৃষ্টি। গাড়িটা কী করে এখানে আবার ফিরে এল তা ও বুঝতে পারছে না। বিনতাকে চিরদীপ দেখতে পায়নি। সুতরাং আবার ও গাড়ি স্টার্ট দিল, উন্মাদ গতিতে ছুটিয়ে দিল গাড়ি। যে করে হোক এই রায়ভিলার এলাকা ছেড়ে ওকে বেরোতেই হবে। প্রচণ্ড গর্জন তুলে গাড়িটা মেঠো পথে গতিশীল হল।
দরজায় দাঁড়ানো বিনতার ঠোঁটে আবার ফুটে উঠল একচিলতে হাসি। নির্লিপ্তভাবে ও দাঁড়িয়ে রইল। কোনও উৎকণ্ঠা অথবা ব্যস্ততা নেই আচরণে। শুরু হল প্রতীক্ষা। প্রতীক্ষার অবসান হল পাঁচ মিনিট পরেই। আবার শোনা গেল ইঞ্জিনের ক্ষুব্ধ গর্জন, চোখে পড়ল হেডলাইটের আলো।
গাড়িবারান্দার অবয়ব চোখে পড়তেই চিরদীপ থামল। আবার গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা হল। ভয়ঙ্কর সাইক্লোনকে ও এতটুকুও গ্রাহ্য করছে না। বিনতা নিজের জায়গায় প্রস্তর-প্রতিমা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
একটু পরে আবার শোনা গেল গাড়ি ফিরে আসার শব্দ…। এইভাবে প্রায় আধঘণ্টা ধরে চলল চিরদীপের আসা-যাওয়ার পালা। কী এক অদৃশ্য আকর্ষণ ওকে বিভ্রান্ত করে এই প্রাসাদের দিকে বারবার টেনে নিয়ে আসছে, তা চিরদীপের কল্পনার বাইরে। কিন্তু এই মুহূর্তে, যখন গাড়িবারান্দার চেহারাটা ওর নজরে পড়ল, ও নিরুপায় হয়ে বসে রইল গাড়িতে। বুঝল, বারবার পালিয়ে যাওয়ার এই চেষ্টা বৃথা। ও ব্যর্থ হয়েছে। শ্রান্ত অবসন্ন দেহে গাড়ি থেকে নেমে এল চিরদীপ।
বৃষ্টির তেজ কমে এলেও বাতাস আরও রুক্ষ হয়েছে। হেডলাইটের আলো ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে। সেই আলোয় পথ ঠাহর করে সদর দরজার কাছে এগিয়ে চলল চিরদীপ। ওর কান্না পাচ্ছে। ক্ষোভে ও হতাশায় ইচ্ছে করছে চিৎকার করে উঠতে। বিনতা। বিনতার এই হঠাৎ পালটে যাওয়া ওর এতটুকু ভালো লাগেনি। কোথায় গেল চিরদীপের প্রতি ওর অনুগত ভালোবাসা? এই রায়ভিলাতে এসে বিনতাকে ও হারিয়েছে। হারিয়েছে সুখ শান্তি মানসিক স্থৈর্য। এখন সেই অভিশপ্ত বাড়িতে ফিরে গিয়ে ও কী করবে? অপেক্ষা করবে সকালের জন্যে? তারপর যদি সাইক্লোন থেমে যায়, দিনের আলোয় পথ চিনে রওনা হবে কলকাতায়। এখন, এই অন্ধকারে, গোলকধাঁধায় ঘুরে মরার চেয়ে সে তবু অনেক ভালো।
এইসব ভাবতে-ভাবতে গাড়িবারান্দার নীচে এল চিরদীপ। জামা-প্যান্ট ভিজে লেপটে আছে শরীরের সঙ্গে। ঠান্ডায় যেন কাঁপুনি দিচ্ছে। তখনই ওর নজরে পড়ল, সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা ছায়াময় শরীর। বিনতা।
বিনতা! বিনতা!—উত্তেজনায় ডেকে উঠল চিরদীপ। ছুটে এগিয়ে গেল ওর কাছে : আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, বিনতা। আমি পথ চিনতে পারছি না। বারবার এই হতচ্ছাড়া গাড়িটা ফিরে আসছে এই অভিশপ্ত বাড়ির কাছে। আমার সঙ্গে তুমি যাবে, বিনতা?
বিনতার কয়েক হাতের মধ্যে আসতেই বিশ্রী পচা ভ্যাপসা গন্ধটা চিরদীপের নাকে এসে যেন ধাক্কা মারল। একটা হিমেল বাতাস ওকে জড়িয়ে ধরল পাকে-পাকে। দূরের জঙ্গল থেকে ভেসে এল শেয়ালের চিৎকার। শুরু হল গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। ক্রমে সেটা তীব্রতায় বাড়তে লাগল। যেন কোনও অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপ হাপরের মতো হাঁফাচ্ছে।
চিরদীপ আরও কাছে এগিয়ে যেতেই শুনতে পেল বিনতার ফিসফিস স্বর, তোমার আর ফেরার পথ নেই…এসো এসো চলে এসো…।
সাদা শাড়ির আড়াল থেকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল বিনতা। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়ঙ্কর চিৎকার চিরদীপের হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। যেন নরকবাসী কোনও প্রেতাত্মার উন্নাসী আর্তনাদ।
মোহাবিষ্টের মতো আরও কাছে এগিয়ে গেল চিরদীপ। বিনতার হাত ওর হাত চেপে ধরল। প্রচণ্ডতায় অমানুষিক সে-বন্ধন। কোথা থেকে এই আসুরিক শক্তি পেল বিনতা? পরক্ষণেই বিনতার হাতের ওপর চোখ পড়ল চিরদীপের। অসংখ্য ভাঁজ পড়া সবুজ ছত্রাকে আক্রান্ত একটা শীর্ণ জীর্ণ হাত। শ্যাওলা পচা আঁশটে গন্ধটা চিরদীপের সমস্ত চেতনাকে যেন আচ্ছন্ন করে দিতে চাইল। ওর ঠোঁট চিরে শেষ শব্দটুকু বেরিয়ে এল, বিনতা!
উত্তরে একটা কর্কশ পুরুষালী স্বর হেসে উঠল, বলল, আর কাউকে আমার প্রয়োজন নেই…কাউকে আমি চাই না…।
শীতল বাতাস ক্রমে শীতলতর হয়ে যেন পৌঁছে যেতে চাইল হিমাঙ্কের শত ডিগ্রি নীচে। সাইক্লোনের দাপটে হঠাৎ দুলে ওঠা ঝাঁকড়া গাছগুলো যেন সমস্বরে হাহাকার করে উঠল…।
কিছুদিন পর কলকাতার খবরের কাগজে প্রখ্যাত অ্যাথলিট চিরদীপ সরকারের সস্ত্রীক নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা প্রকাশ পায়।
সে সস্ত্রীক দীঘার দিকে রওনা হয়েছিল জানা গেলেও তন্নতন্ন অনুসন্ধানে সেখানে তাদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সরকারি ক্রীড়ামহল আশঙ্কা করছেন যে, আগামী এশিয়ান গেম্স-এ ভারতের সোনা পাওয়ার আশা সম্ভবত চিরদীপ সরকারের সঙ্গেই বিলীন হয়ে গেল।