পিশাচের দ্বীপ
ইতিহাসের ছাত্র এলিয়টের প্রাচীন ইউরোপীয় সভ্যতার পীঠস্থান রোম ও গ্রিস সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ছিল। তাই সে ফ্রান্সের মার্সাই থেকে প্রথমে রোমে এবং তারপর ইতালি হয়ে গ্রীসের রাজধানী এথেন্সে এসে পৌঁছাল। সেখান থেকে ঈজিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জে যাতায়াত করা একটি যাত্রীবাহী জাহাজে চড়ে বসল। তারপর ঘুরে বেড়াতে লাগল দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। সংগ্রহ করতে লাগল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
ইকারিয়া থেকে জাহাজ ছাড়বার পর সমুদ্রে ঝড় উঠল। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে জাহাজের ইঞ্জিনগুলি বন্ধ করে দেয়া হলো। ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে জাহাজ শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায়। ঝড় থামলে আবার চলতে আরম্ভ করে। গন্তব্যস্থল তাইকলাডিস দ্বীপমালা।
সুনীল জলরাশি ভেদ করে বেশ স্বাভাবিক গতিতেই জাহাজ চলছিল। হঠাৎ অদূরে একটা ছোট্ট দ্বীপ চোখে পড়ল এলিয়টের।
চোখে বিইনোকুলার লাগিয়ে সেদিকে নজর দিল এলিয়ট। চোখের সামনে ভেসে উঠল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটি দ্বীপ। কিন্তু এ কোন দ্বীপ? সে যদুর জানে এদিকে কোনো দ্বীপ নেই।
ক্যাপ্টেনকে ডেকে দ্বীপটির কথা বলতে ক্যাপ্টেন বললেন, হ্যাঁ, আমিও দেখছি দ্বীপটি। ওটা একটা ছোটো দ্বীপ।
ওখানে কারা থাকে?
তাচ্ছিল্যের স্বরে ক্যাপ্টেন বললেন, থাকে কয়েক ঘর গরিব প্রজা।
কিন্তু ঐ দ্বীপটির চারপাশে যে উঁচু প্রাচীরের বেস্টনী আছে তা লক্ষ্য করেছেন কি?
ঈজিয়ান সভ্যতার নিদর্শন ওটা। এখানে প্রায় সব দ্বীপেই এটা দেখা যায়।
এলিয়ট বলল, আচ্ছা, ওখানে কি একবার যাওয়া যায় না?
যাওয়া যাবে না কেননা? কিন্তু ঐ ভগ্নদ্বীপে গিয়ে আপনার কী লাভ? ওখানে না পাবেন থাকার জায়গা, না পাবেন ভালো খাবার।
দেখুন, তা আমি জানি। কিন্তু আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছি ওখানে না গেলে তা সফল হবে না।
আপনি কী উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছেন বলুন তো? ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে বিরক্তি।
আমি প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলি দেখতে চাই, জানতে চাই, পরিচিত হতে চাই সেই সভ্যতার সঙ্গে।
কিন্তু ওখানে তেমন কোনো নিদর্শন নেই দূর থেকে যে প্রাচীরটি দেখছেন, হয়তো ওটাই একমাত্র নিদর্শন।
আমি প্রাচীরটিই দেখতে চাই।
কিন্তু আমাদের জাহাজ ঐ দ্বীপে যাবে না।
বেশ তো, আপনার জাহাজ না যাক, জাহাজ থেকে আমাকে একটা নৌকা দিন আমি তাতে চেপে ওখানে যাব। এলিয়টের স্বরে দৃঢ়তা ফুটে উঠে।
দেখুন, দ্বীপটি এখান থেকে অনেক দূরে। আপনি যদি নৌকায় করে সেখানে গিয়ে এই জাহাজে আবার ফিরে আসতে চান, তাহলে অনেকটা সময় লাগবে। আর জাহাজ কতক্ষণ আপনার জন্য অপেক্ষা করবে?
দেখুন, আমি হাওয়া খেতে বের হইনি। বেরিয়েছি ঈজিয়ানের দ্বীপগুলি দেখতে। তা যদি না পারি, তবে আর এত কষ্ট করে জাহাজে চাপা কেনো? আপনি একটি নৌকা ও আপনার জাহাজের একজন কর্মীকে দিন–আমি তাকে নিয়েই ঐ দ্বীপে যাব।
আপনার সঙ্গে যদি আমি তোক দিই, সে কিন্তু ঐ নির্জন অজানা দ্বীপে নামতে চাইবে না, বা আপনার সঙ্গে রাতে থাকতেও রাজি হবে না।
তার কোনো দরকার নেই।
তা হলে আপনি ফিরবেন কী করে?
সে জন্য আপনাকে ভাবতে হবে না। ওখানে একবার পৌঁছাতে পারলে আমি ঠিক ফিরতে পারব।
এলিয়টকে কিছুতেই ঐ অজানা দ্বীপে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে না পেরে ক্যাপ্টেন একবার শেষ চেষ্টা করলেন–এবার তার স্বরে মিনতি ঝরে পড়ল–আপনার কি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ঐ দ্বীপে না গেলেই নয়?
আমার বিপদ হবে ভাবছেন কেনো?
তাহলে আপনি যাবেনই।
হ্যাঁ, তবে আপনি আমাকে নৌকা ও মাঝি না দিলে সে ইচ্ছা পূরণ হবে কী করে?
শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও এলিয়টকে একটি নৌকা দিতে বাধ্য হলেন।
নৌকার মাঝি এলিয়টকে সেই অজানা নির্জন দ্বীপে পৌঁছে দিয়েই দ্রুত জাহাজে ফিরে এল।
দ্বীপে পৌঁছেই একটি গ্রাম্য মেঠো পথ ধরে এলিয়ট এগিয়ে চলল।
পথ জনহীন। সমুদ্রের তীরে অবশ্য কয়েকখানা নৌকা দেখা গেল। তাতে লোকজন আছে কি না বোঝা গেল না।
কিছুদূর এগোতেই একটি সরাইখানা চোখে পড়ল। সরাইখানার পাশে একটি পাহাড়। তার নিচে ছাগল চরে বেড়াচ্ছে।
গোটা দ্বীপ ঘিরে রেখেছে যে প্রাচীর তা এলিয়টের কাছে এক পরম বিস্ময়ের ব্যাপার। কবে কারা এমন উন্নত ধরনের প্রাচীর তৈরি করেছিল?
ঐ দ্বীপের একমাত্র সরাইখানায় ঢুকে এককাপ ছাগলের দুধ পান করে আবার চলতে শুরু করল এলিয়ট। তবে তখনও মসৃণ উঁচু পাঁচিলের বাইরেই সে। প্রাচীর যখন আছে তখন তার গেটও আছে–এটা অনুমান করে সে প্রাচীরের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলো। উদ্দেশ্য প্রাচীরের ভিতরে ঢোকার গেটটি খুঁজে বের করা।
প্রাচীরের চারদিকে কোনো গেট খুঁজে পেল না এলিয়ট। প্রাচীরটি প্রাচীন হলেও তা ভেঙে ভিতরে ঢোকার উপায় নেই–কারণ সেটি বেশ মজবুত। আর টপকানোরও কোন উপায় নেই কারণ সেটি মসৃণও। প্রাচীরের যে মুখটি খোলা সেটি আবার সমুদ্রের দিকে, আর সেখানেই কয়েকটি নৌকা বাঁধা আছে। এতএব একমাত্র নৌকা ছাড়া প্রাচীরের ভিতরে ঢোকা অসম্ভব।
কীভাবে প্রাচীরের ভিতর ঢুকবে ভাবতে ভাবতে এলিয়ট মৃদুপায়ে এগোচ্ছিলো, হঠাৎ একটি কলতান কানে এল। মনে হলো কোনো জায়গা থেকে পানি বের হচ্ছে বা প্রবেশ করছে।
শব্দটা যেন দেওয়ালের গা থেকেই আসছে। দেওয়ালে কান পাততেই বুঝতে পারলো শব্দটা দেওয়ালের ভিতর থেকে আসছে। খুব ভালোভাবে দেওয়ালের দিকে নজর দিতেই একটি ফাটল চোখে পড়ল।
দূরবিন চোখে দিয়ে সেই ফাটলে চোখ রাখতেই এলিয়টের চোখ দুটি স্থির হয়ে গেল।
প্রাচীরের ভিতরে একটি ছোটো ঝরণা দিয়ে ঝিরঝির করে জল ঝরে পড়ছে। ঝরণার পাশে মা ও ছেলের মর্মর মূর্তি। ছেলেটা মায়ের কোলে ওঠার চেষ্টায় তার হাঁটু দুটি জড়িয়ে ধরেছে।
কী অপূর্ব সৌন্দর্যময়ী ঐ মর্মর নারী মূর্তিটি আর তার সন্তানের চোখে মায়ের কোলে ওঠার জন্য কী গভীর আকুলতা। দুটি মূর্তিই যেন জীবন্ত। মা একটু নীচু হয়ে আছে ছেলেটিকে কোলে তুলে নেওয়ার আগ্রহ নিয়ে।
কোন যুগে কোন ভাস্কর এমন মূর্তি তৈরি করেছিল কে জানে? কোন বইতে বা প্রত্নতত্ত্ববিদের আবিষ্কারে তো এই দ্বীপ ও তার ভাস্কর্যের কথা লেখা হয়নি।
এই দ্বীপে আসা তাহলে ব্যর্থ হয়নি। এখানকার এই ভাস্কর্যের কথা এলিয়ট সমগ্র বিশ্ববাসীর দরবারে পৌঁছে দেবে। এই আবিষ্কারের একমাত্র সাক্ষী সে। সেই হবে এই আবিষ্কারের কর্ণধার। কিন্তু এই মূর্তি দুটিকে এখান থেকে নিজের দেশে না নিয়ে গেলে তো আর কেউ বিশ্বাস করবে না।
এই মূর্তি দুটি তার দেশের মিউজিয়ামের শোভা যেমন বৃদ্ধি করবে, তেমনি তার পাশে তার নামও থাকবে। এই বাগানের মালিককে খুঁজে বের করবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সে আবার ফিরে এল সেই সরাইখানায়।
.
সরাইখানার যে কামরায় তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সেখানে নিজের জুতা পরিষ্কার করার জন্য এলিয়ট ব্যাগ থেকে ব্রাশ আর কালি বের করে জুতায় কালি করতে যাবে, হঠাৎ শুনতে পেলো কে যেন বলছে–দিন আমি করে দিচ্ছি।
পেছন ফিরে এলিয়ট দেখল বছর পনেরোর একটি ছেলে দরজার কাছে। দাঁড়িয়ে আছে। সে এলিয়টের হাত থেকে জুতাটা নিয়ে তাতে কালি দিতে লাগল আর এলিয়ট সেদিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইল। এলিয়ট ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল–প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ঐ বাগানটার মালিক কে বলতে পার?
না, আমি জন্ম থেকেই ওটাকে অমন দেখছি।
তুমি না জানতে পার, কিন্তু তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই জানেন।
আমার বাবা মা কেউ নেই। তবে যতদূর জানি গরডন নামে একজন ঐ বাগানের মালিক।
তুমি আমাকে তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পার?
কী করে পারব, ঐ পাঁচিলের ভিতরে ঢোকার তো কোনো পথ নেই।
কিন্তু সমুদ্রের দিকের পথ তো ভোলা। ছেলেটি একথা শুনে কোনো জবাব দিল না। এলিয়ট তাকে তার পারিশ্রমিক দিতে সে মৃদু হেসে চলে গেল।
এলিয়টের ঘরের সামনে তখন কয়েকজন কৌতূহলী লোক দাঁড়িয়ে জটলা করছিল।
এলিয়ট তাদের ভিতর একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল–আমি ঐ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাগানের মালিকের সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই। আপনাদের মধ্যে কেউ কি আমাকে সে সুযোগ করে দিতে পারেন?
এলিয়টের কথা শুনে আঁতকে উঠে সকলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল।
এলিয়ট জানত এই লোকগুলো খুব গরিব তাই এদের টাকার লোভ। দেখালে এরা তাকে তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে দিতে দ্বিধা করবে না, তাই সে অনেকগুলো টাকা বের করে বলল–দেখ, তোমাদের মধ্যে আমাকে ঐ পাঁচিল ঘেরা বাগানের ভিতর যে নিয়ে যাবে তাকে আমি একশো ড্রাকমা দেবো।
কিন্তু এলিয়টের প্রস্তাবে কেউ সাড়া দিল না।
সমস্ত গ্রাম খুঁজেও এলিয়ট একটি লোককেও পেল না যে, তাকে ঐ পাঁচিল ঘেরা বাগানের ভিতর নিয়ে যাবে। তারা ঐ প্রাচীরের নাম শুনেই ভয়ে আঁতকে উঠে দ্রুত পালিয়ে গেল।
অগত্যা নিতান্ত নিরাশ হয়ে ওকে আবার সরাইখানায় ফিরে আসতে হলো।
.
গভীর রাত।
সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম নেই শুধু এলিয়টের চোখে। তার চোখের সামনে তখন শুধু একটি দৃশ্য ফুটে উঠেছে। তা ঐ মা ও ছেলের প্রস্তর মূর্তির।
এমন সময় পদশব্দ শুনে ফিরে দেখল তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সকালের সেই জুতা পালিশ করা ছেলেটা।
এত রাতে এই ছেলেটা এখানে কেনো? ও কোথায় থাকে? ও কি এই সরাইখানাতে থাকে?
এলিয়ট ছেলেটির নাম জিজ্ঞাসা করার আগেই সে এগিয়ে এসে এলিয়টকে বলল–আমি আপনাকে আমার নৌকায় করে ঐ পাঁচিল ঘেরা বাগানের ভিতর নিয়ে যাবো। আমায় একশো ড্রাকমা দেবেন তো?
কেন দেবো না। নিশ্চয় দেবো। তবে আমরা যাবো কখন?
কাল সকালে। তবে কথাটা কাউকে যেন বলবেন না।
বেশ, তাই হবে।
ছেলেটি চলে গেল। এলিয়টের মন আবার স্বপ্নের জাল বুনতে বসল। সে ঐ বাগানের ভিতর থেকে মা ও ছেলের মূর্তি দেশে নিয়ে যাবে। ওটা একটি পরম বিস্ময় হিসেবে মিউজিয়ামে শোভা পাবে। তার নামও প্রত্নতাত্ত্বিকের খাতায় লেখা থাকবে।
পরেরদিন ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই এলিয়ট এসে হাজির সমুদ্রতটে।
সেই ছেলেটি একটি পালহীন ছোটো নৌকায় সেখানে অপেক্ষা করছিল।
এলিয়ট এসে নৌকায় পা রাখতেই ছেলেটি নৌকা ছেড়ে দিল। পাঁচিলটির বিপরীত দিকে তাকিয়ে সে নৌকা বেয়ে চলল। ওদিকে সে তাকাতেই চায় না। কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব ছেলেটির চোখে মুখে।
হঠাৎ নৌকাটা থেমে গেল।
এলিয়ট দেখল একটি কালো পাথরের গায়ে নৌকাটা থেমেছে।
কী, এসে গেছি?
হ্যাঁ, আমি কিন্তু আর এগোব না। আপনি কি আমার পাওনাটা এখনি মিটিয়ে দেবেন?
কেন দেব না। এই নাও। মানি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে এলিয়ট ছেলেটিকে দিল। তারপর বলল–আর একটু এগিয়ে নিয়ে চল না। ঐ তো ঘাট দেখা যাচ্ছে।
এখানে কোনো ঘাট নেই। আমি যে পর্যন্ত আসতে পারি এসেছি আর এক কদমও এগোতে পারব না।
বেশ তো তোমার নৌকাটি তবে খানিকক্ষণের জন্য আমায় ধার দাও–আমি ওখানে পৌঁছে মালিকের সঙ্গে দেখা করেই ফিরে আসব।
না। আমি তা পারব না। বলে সে বৈঠা তুলে নৌকাটাকে দূরে সরিয়ে নিতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে জলের ভিতর পড়ে তলিয়ে গেল।
যে ছেলেটি এত কষ্ট করে এলিয়টকে এখানে নিয়ে এসেছে দ্বীপবাসীর কথা অগ্রাহ্য করে তাকে এভাবে চোখের সামনে ডুবে মরতে দিতে চায় না এলিয়ট। সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার অচেতন দেহটাকে টেনে হেঁচড়ে পানি থেকে তুলে নিয়ে এল।
বালির চরায় পৌঁছে অনেক কসরত করে ছেলেটির পেট থেকে পানি বের করে তাকে সুস্থ করে তুলতেই ছেলেটি অবাক হয়ে এলিয়টের মুখের দিকে চেয়ে রইল।
সে দিকে তাকিয়ে এলিয়ট বলল–এখন কেমন বোধ করছ?
ছেলেটির মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। এলিয়ট তাকে সেখানে বসিয়ে রেখে নৌকা খুঁজতে বের হলো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে নৌকাটাকে পাওয়া গেল। নৌকায় উঠে সেটিকে তীরের দিকে এনে নোঙর করে চেয়ে দেখল ছেলেটা একটা পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছে।
কি হে, এখন আর আমার সঙ্গে যেতে তোমার কোনো আপত্তি নেই। তো? আপত্তি থাকলে এখানে অপেক্ষা করো। আমি বাগানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে আসছি।
ছেলেটি নির্বাক। মুখ থেকে কোনো টু বের হচ্ছে না দেখে এলিয়টের বেশ রাগ হলো। চিৎকার করে বলল–কি, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না।
তবুও কোনো জবাব নেই। এবার এলিয়ট এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির কাঁধে হাত রাখল এবং সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল। এতো মানুষের দেহ নয়। এ যে নিরেট পাথর।
এটা যদি পাথরের মূর্তি হয় তবে ছেলেটি কোথায় গেল? একথা মনে হতেই সাগরের যে বেলাভূমিতে ছেলেটিকে শুইয়ে রেখে সে নৌকার খোঁজে গিয়েছিল সেখানে গেল।
সেখানে বালির উপরে শায়িত ছেলেটির ছাপ দেখতে পেল এলিয়েট। আরও একটি পদচিহ্ন চোখে পড়ল। খুব সম্ভবত কোন নারীর পায়ের ছাপ।
তখনই ইতিহাসের ছাত্র এলিয়টের একটি পৌরাণিক কাহিনীর কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু সেটার তো কোনো ঐতিহাসিক স্বীকৃতি নেই। সেটা তো নিছক একটা কিংবদন্তি। গ্রিক পুরাণে বর্ণিত কাহিনীটি হলো স্থেনো, মেডুসা ও ইউরিয়েল নামে তিন দানবী বাস করত গরগন দ্বীপে। তারা ছিল মানুষের কাছে এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক।
তাদের মাথায় চুলের বদলে থাকত জীবন্ত সাপ। ওরা দেখতে এত কদাকার ছিল যে, যে কেউ ওদের দিকে তাকালে সে পাথরে পরিণত হয়ে যেত।
এসব কাহিনী যে মিথ্যা নয় তার প্রমাণ তো তার সামনেই। ঐ তো খানিক আগে যে ছেলেটির সঙ্গে এলিয়ট কথা বলেছে, সে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এলিয়টের তখন আর বুঝতে বাকি রইল না যে, কেনো গোটা দ্বীপ থেকে এই প্রাচীর ঘেরা স্থানটি বিচ্ছিন্ন। কেনো এই জায়গাটার কথা স্থানীয় লোকেরা মুখে পর্যন্ত আনতে চায় না। কেনো গরিব হয়েও লোকগুলো তার অতগুলো টাকার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিল, কেনো ছেলেটি ঐ প্রাচীরের দিকে না তাকিয়ে নৌকা চালাচ্ছিল।
এই সেই গরগনের বাগান। পুরাণ শাস্ত্রে বর্ণিত কাহিনীতে জানা যায় মহাবীর পারসিউস তিন দানবীর মধ্যে মেডুসাকে হত্যা করতে সমর্থ হন, কিন্তু নো ও ইউরিয়েলকে হত্যা করতে পারেননি। কিন্তু সে তো কয়েক সহস্র বছর আগের কাহিনী। তারা কি এখনও বেঁচে আছে? তারা কি অমর? এসব নানান চিন্তা ঐ নির্জন দ্বীপের জমিতে দাঁড়িয়ে এলিয়টের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
কিংবদন্তি যে সত্যে পরিণত হতে পারে এটা তো এলিয়টের কল্পনাতেও স্থান পায়নি। কিন্তু বাস্তব তো তার সামনে। ঐ তো ঈষৎ ঘাড় বাঁকানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তার দেখা সেই ছেলেটা। ওর কাঁধে এখনও সমুদ্রের নোনা জল লেগে আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে জীবন্ত গ্রিক ভাস্কর্যের প্রতিরূপ। তাহলে তো ঐ মা ও ছেলের মূর্তিটিও এমনই একটি জীবিত মা ও ছেলের প্রতিমূর্তি।
ভাবনার স্রোত বেশি দূর গড়ানোর আগেই পেছনে লঘু পদ সঞ্চারের শব্দ শোনা গেল। মনে হলো কেউ যেন গাউন পরে তার দিকে আসছে। সমুদ্রের হাওয়ায় গাউনের খস্ খস্ শব্দ কানে আসছে। খুব কাছে থেকে একটি সুরভিত সুগন্ধি ভেসে এল। যা কেবল কোনো নারীর দেহ থেকে পাওয়া যায়। এবার শোনা গেল একটি ফ্যাসফেসে কণ্ঠস্বর। সে ভাষা বোঝার সাধ্য নেই এলিয়টের।
এলিয়টের বুঝতে বাকি রইল না যে, মূর্তিমতি মৃত্যু তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে দিকে তাকালে সেও পাথরে পরিণত হবে।
এলিয়ট পেছন ফিরে না তাকানোর সংকল্প নিয়ে এগিয়ে চলল কিন্তু এক দুর্নিবার শক্তি তাকে বার বার পিছু ফিরে তাকানোর জন্য তাড়না শুরু করল। তাকাবে না তাকাবে না করেও সে ফিরে চাইল…