পিপে
অপরাহ্ন প্রায় সন্ধ্যার বুড়ি ছুঁয়ে ফেলেছে। আকাশের বুকে অস্তপ্রায় সূর্যের লালাভা। ভাসা ভাসা মেঘের বুকে রক্তিমাভার অপূর্ব উল্লাস। সারা দিনের অন্বেষণ শেষ করে ঘরে ফেরায় ব্যস্ত পাখিসকল৷ আকাশে বুকে পাড়ি জমিয়েছে সারি বেঁধে। গাছপালার ঝোপে-ঝাড়ে ঘনিয়ে আসছে রাতের অন্ধকার। কেমন যেন ধ্যানমগ্ন সন্ধ্যা।
নেশাগ্রস্তের মতন ডেকচেয়ারে বসে থাকেন ড. প্রতীপ নারায়ণ সেনশর্মা। দিনের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা কাটে ল্যাবরেটরি ঘরে। বায়োলজি নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। প্রাণ… প্রাণ কী, প্রাণের স্বরূপ কী? প্রাণের উৎপত্তি কোথায়? এই মহাবিশ্বের বিশাল প্রাঙ্গণে আর কি কোথাও আছে প্রাণের স্পন্দন, বুদ্ধিমান জীব মানুষই কি মহাবিশ্বের একমাত্র বিস্ময়… নানান প্রশ্নের সমাধানে ক্লান্ত ড. সেনশর্মা।
না না, সেন… বেশ বুঝতে পারছি এগুলোর কোনও মানেই হয় না। কেঁচো, কাঁকড়া বিছে, ইঁদুর, কুকুর, অক্টোপাস, জেলিফিস… এ সমস্তই প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল ছাড়া আর কিছুই নয়। গ্রহে গ্রহে এর রকমফের অবশ্যম্ভাবী। কারণ বুদ্ধিমত্তা বা প্রাণের উৎকর্ষতা বলে তো কিছুই নেই ওদের। তবে হ্যাঁ, দৈবাৎ যদি কোনও গ্রহে বুদ্ধিমান জীবের বিকাশ ঘটে তাহলে তাদের আকৃতি হবে নির্ঘাত আমাদের মতো৷ পাশের চেয়ারে বসতে বসতে কথাগুলো বললেন প্র. গুণ। শুধু সহপাঠী বললে ভুল হবে। ড. সেনশর্মার প্রাণের বন্ধু এই প্র. অসীমান গুণ গবেষণারও একমাত্র সঙ্গী।
এ তোমার নিছক অনুমান৷ প্রমাণ আছে কি কিছু? মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন ড. সেনশর্মা।
প্রমাণ! প্রমাণই কি সবং এ হচ্ছে আমার বিশ্বাস–আমাদের অনুকরণেই তৈরি হতে হবে আমাদের মতো মস্তিষ্ক-সর্বস্ব জীবদের। আমাদের মতোই দেখতে হবে তাদের সৃষ্টিকর্তার এটাই বোধ হয় একমাত্র বিধান।
দারুণ বিশ্বাস তো তোমার। এসব শুনলে তো পরম নাস্তিকও ভগবৎ বিশ্বাসী হয়ে উঠবে গুণ। তুমি কি ধর্মকর্মে মন দিলে নাকি শেষকালে?
হো হো করে হেসে উঠলেন প্ৰ, গুণ। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, না হে না, ধর্মে আর মতি হবে না এ জীবনে। তবে প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের পাশাপাশি রয়েছে নিয়মের কড়া শাসন। রয়েছে অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যে অবিরাম সংগ্রাম আর প্রাকৃতিক নির্বাচন। মহাবিশ্বের গ্রহে গ্রহে এই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম নেই। অর্থাৎ কিনা প্রাণ বিকাশের অগ্রগতির এরাই হচ্ছে আসল দিশারী।
তার মানে ফুটবল বা হকি খেলার মতন। একই খেলা… শুধু বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নিয়মে খেলা হয়। হালকাভাবেই কথাগুলো বললেন ড. সেনশর্মা।
এ তো খুব স্বাভাবিক। এক-এক দেশে এক-এক নিয়ম। তবে নিয়মের ফারাক থাকে না কেন, একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, সব নিয়মের মূলেই রয়েছে কতকগুলো সাধারণ সূত্র। সেই রামকৃষ্ণদেবের কথাগুলো ভেবে দেখো–ওয়াটার, জল, পানি–সব কিন্তু একটি বস্তুকে বোঝায়… শুধু প্রকাশভঙ্গির পার্থক্য।
প্র. গুণের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কোনও কথা বললেন না ড. সেনশর্মা। ছোট পাইপটা টেনে বার করে নিলেন বুক পকেট থেকে। পাউচ থেকে তামাক ভরে আগুন ধরিয়ে নিঃশব্দে ধূমপান শুরু করলেন ডক্টর। গোলাকার ধোঁয়ার মালাগুলো শূন্যে মিলিয়ে গেল একে একে। সন্ধে হয়ে এসেছে। দূর আকাশের বুকে আলোর হালকা হাতছানি। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চারপাশে। দু-একটা তারা উঁকি দিচ্ছে আকাশের বুকে। গ্রীষ্মের দারুণ দাবদাহ সন্ধ্যার স্নিগ্ধ স্পর্শে পরম রমণীয় হয়ে উঠছে। সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা মৃদু মন্দ বাতাসে।
আমি কী ভাবছি জানো গুণ, এত বেশি স্থিরনিশ্চয় হলে কী করে তুমি? প্রমাণ তো কিছু পাইনি আমরা। প্রমাণ না পেলে…
কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলেন প্র. গুণ। বললেন, কেবল প্রমাণ, প্রমাণ আর প্রমাণ। সব কিছুর কি প্রমাণ মেলে? অনেক কিছু দেখার পর অনুমান করাও কি উচিত হবে না? আমি বলছি আমাদের মতোই দেখতে হবে অন্য গ্রহের বুদ্ধিমান জীবদের। বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো বললেন প্র. গুণ।
বিচিত্র এক হাসি ফুটল ড. সেনশর্মার মুখে।
অবাক করে দিচ্ছ ভাই। বহির্বিশ্বের জীবদের সম্বন্ধে কতটুকুই বা জানি আমরা। শুধু অনুমান মাত্রই সার। আর সেই অনুমানের উপর নির্ভর করে এত বড় সিদ্ধান্তে আসা কি উচিত হবে আমাদের? শুধু একটিমাত্র বুদ্ধিমান জীবের পরিচয় পেয়েছি আমরা। সে হচ্ছে এই পৃথিবীর মানুষ। নিজেদের দেখেই কি বহির্বিশ্বের প্রাণীজগৎ সম্বন্ধে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে? নিশ্চয়ই অনুমান করব আমরা। তবে সে অনুমান কেবল ব্যক্তিগত ইচ্ছারই ফসল হয়ে দাঁড়াচ্ছে মাত্র। কোনও মিল থাকবে না বাস্তবের সঙ্গে।
চেয়ারে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে শুনছিলেন প্র. গুণ। ভ্রূ দুটো কুঁচকে উঠছিল মাঝে মাঝে। তোমার আরগুমেন্ট শুনলাম সেন। কিন্তু রেগে যাচ্ছ কেন বলো তো? রাগ তো আর যুক্তি নয়। মানসিক আবেগ মাত্র। ধীরে ধীরে বললেন প্র. গুণ।
চেয়ারের উপর সোজা হয়ে বসলেন ড. সেনশর্মা। একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন প্র, গুণের দিকে।
ঠিক… ঠিক বলেছ গুণ। এটা এক মানসিক আবেগ মাত্র। কিন্তু মনঃস্তত্ত্ববিদরা কী বলেন জানো তো? ওঁরা বলেন যে রাগের উৎপত্তি হয় স্বল্প জ্ঞান বা অল্প জানা থেকে।
হ্যাঁ হ্যাঁ… তুমি… তোমার কম আছে জ্ঞানের। গর্জে উঠলেন প্ৰ, গুণ, সহজ সরল বিষয়টাকে কেবলই জটিল করে তুলছো কেন বুঝি না। একটু চিন্তা করলেই জলের মতো সহজ হয়ে যাবে সব। এ-কথা তো নিশ্চয়ই জানো যে মানুষই এই পৃথিবীতে একমাত্র যুক্তিবাদী প্রাণী। তোমার কাছে হয়তো খুবই সামান্য এই ঘটনা। আপাত সামান্য এই ঘটনাই অসামান্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে। আমার যুক্তির সূত্রপাত এখান থেকেই। একবার শুধু ভেবে দেখো যে এই পৃথিবীরই দেশে দেশে কত তফাত ভৌগোলিক আবহাওয়ায়। নিদারুণ ঠান্ডা আর তার পরেই রোদে জ্বলা ধু ধু মরুভূমির প্রচণ্ড উত্তাপ। একদিকে উত্তুঙ্গ আকাশ ছোঁয়া পাহাড় অন্যদিকে নীল সাগরের কী অতলান্ত গভীরতা। অথচ এত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আর কোনও প্রাণীই কিন্তু বুদ্ধিমান হয়ে উঠল না বিশেষ কোনও স্থানের সব সুযোগ সুবিধে নিয়ে। ভৌগোলিক তারতম্য নির্বিশেষে মানুষ নামক হোমোস্যাপিয়েনই হল একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী এই বিশাল পৃথিবীর বুকে। আমার অনুমান গড়ে উঠেছে একান্তই এই বাস্তব সত্যের উপর। এটাই কি প্রমাণ করে না যে গ্রহে গ্রহান্তরে নানান বৈষম্যের মধ্যেও যদি কোনও বুদ্ধিমান জীবের উদ্ভব হয়, তাহলে তারা হবে ঠিক আমাদের মতোই মানুষ? এবার ভেবে দেখো সেন, আমাদের অনুমান কি যুক্তি নির্ভর নয়? তর্কে জেতার সম্ভাবনায় জ্বলজ্বল করে উঠল প্র, গুণের চোখদুটো।
বাঃ বাঃ অপূর্ব যুক্তিপূর্ণ তোমার অনুমান, একেবারে নতুন চিন্তা। সত্যি বিশ্বাস করো গুণ, আমার মাথায় আসেনি এসব! চেয়ার থেকে উঠে দু-হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন প্র, গুণকে।
শুধু এইটুকুই নয় সেন, আরও আছে।
আরও আছে? বলো বলো গুণ… অদ্ভুত অপূর্ব তোমার দৃষ্টিভঙ্গি।
আমি জানি সেন এ বিষয়েও তুমি নিশ্চয়ই একমত হবে আমার সঙ্গে যে, বুদ্ধিমান জীবমাত্রের মস্তিষ্ক বা মস্তিষ্কের অনুরূপ থাকবে কিছু ওর দেহে।
হ্যাঁ, সে বিষয়ে আর কথা কী… নিশ্চয়ই মস্তিষ্ক থাকবে তার! জোর দিয়ে বন্ধুকে সায় দিলেন ড. সেনশর্মা।
বেশ–তাহলে নানান যোগসূত্র থাকবে নিশ্চয়ই বিভিন্ন ইমপালস আদান প্রদানের জন্য। যেমন ধরো না–শব্দ, বৈদ্যুতিক চৌম্বকীয় তরঙ্গ, গন্ধ, আলো ইত্যাদি। আবার চোখ-কান নাকের মতো নিশ্চয় কোনও প্রত্যঙ্গ থাকবে ওদের।
প্র. গুণের চোখে মুখে দারুণ উত্তেজনা। প্রতিটি বক্তব্যে স্বীকৃতি লাভের আশায় অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন ওর মুখের দিকে।
ড. সেনশর্মার দু-চোখেও উত্তেজনার আভা। তা হলে সেন, চোখ-নাক-কান সব থাকতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, আমার স্থির বিশ্বাস যে স্টিরিয়োস্কোপিক অনুভূতি আর স্টিরিয়োফোনিক শব্দ শোনার জন্য নিশ্চয়ই দুটো করে থাকবে ওই প্রত্যঙ্গগুলো।
না গুণ, এবার কিন্তু তোমার বক্তব্য মানতে পারলাম না। দুটোর বদলে তিনটে চোখ হলে অনেক সুবিধে হয় মানুষের। পেছনে যদি একটা চোখ থাকত আমাদের তাহলে সামনে পেছনে সব দেখতে পেতাম একসঙ্গে। কী বলো হে?
না না সেন… তোমার কথা মানতে পারলাম না কিন্তু। চোখ বা অন্য প্রত্যঙ্গ বেশি থাকলে নিশ্চয়ই প্রাবল্য ঘটবে ইম্পালসের। তার ফলে নার্ভাস ব্রেকডাউন হওয়া বিচিত্র নয় কিছু।
তা কেন হবে গুণ। গাড়ি চালাবার সময় তো একসঙ্গে সামনের আর আয়নার পিছনের দিক সমান নজর রাখতে হয়। তখন তো ইম্পালসের আধিক্য ঘটে না। এ বিষয়ে কিছু বলার আছে তোমার? একটু ঠাট্টার ছলে বলে উঠলেন ড. সেনশর্মা।
হু! একটু চুপ করে চিন্তা করলেন প্র, গুণ, দেখো সেন, সামনে পেছনে আমরা দেখি বটে। তবে একসঙ্গে নিশ্চয়ই দেখি না। তাই না সেন?
সাবাশ! সত্যি অকাট্য তোমার যুক্তি। তবে প্রয়োজনমতো সামনের আর পেছনের চোখও তো ব্যবহার করা যেতে পারে?
না… হ্যাঁ… তা যেতে পারে বটে। তবে এ বিষয়ে চিন্তা করিনি এখনও। চিন্তার সুরে বললেন প্র. গুণ।
ঠিক আছে। এ প্রশ্নটা না-হয় ছেড়ে দিলাম এখন। কিন্তু দুটোর বদলে চারটে চোখ হলে কী অসুবিধে হত বলো তো?
একটু চুপ করে গেলেন প্র. গুণ। এই নতুন যুক্তির উপযুক্ত উত্তর তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মনে মনে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরও জুতসই কোনও জবাব যে খুঁজে পেলেন না সেটা ওঁর মুখের চেহারা দেখেই স্পষ্ট বোঝা গেল। কথা বলার সময়ও দৃঢ়তা রইল না কণ্ঠস্বরে।
এ বিষয়েও ভেবে দেখিনি এখনও। তবে আমার বক্তব্যও শেষ হয়নি এখনও। যাক যে কথা বলছিলাম–অকল্পনীয় দ্রুত গতিতে সংকেতের আদান প্রদান ঘটে আমাদের এই নার্ভ টিসুর মধ্যে দিয়ে আর সেই জন্যেই মাথার খুব কাছেই হওয়া উচিত চোখ-কান-নাক প্রভৃতি প্রত্যঙ্গগুলো। মানে যতদূর সম্ভব মস্তিষ্কের কাছে থাকতে হবে ওদের। তা নয়তো সংকেত আদান প্রদানের বিলম্ব ঘটবে অনেক। অতএব বুদ্ধিমান জীব মাত্রেরই মাথার মতো কিছু থাকতে বাধ্য।
কোনও উত্তর করলেন না ড. সেনশর্মা৷৷
আবার দেখো সেন, বুদ্ধিমান জীবমাত্রই কাজ করবে আর কাজ করতে হলে আমাদের হাতের মতো কোনও প্রত্যঙ্গ থাকতেই হবে তাদের। শুধু থাকলেই হবে না, ইচ্ছেমতো নড়াচড়ার ক্ষমতাও থাকতে হবে, আর সেই জন্যে পা থাকবে প্রতিটি বুদ্ধিমান জীবের।
কিন্তু পা কেন… চাকা থাকলে তো সবচেয়ে ভালো হয়? ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেন ড. সেনশর্মা।
চাকা? পায়ের বদলে চাকা? নিশ্চয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? একটু রাগত স্বরে বলে উঠলেন প্র, গুণ।
কিন্তু কেন? চাকা তো অনেক দরকারি। পায়ের চেয়ে তুমিও তো গতির নির্ভর করো বেশি। গতি মানেই চাকা আর চাকা মানেই তো দ্রুত গতির প্রতীক।
কেমন যেন হোঁচট খেলেন প্র, গুণ। এরকম যুক্তি শোনেননি কখনও এর আগে।
সত্যি এবারে হাসালে সেন। এ কি একটা যুক্তি হল। বেশ তো, তাই যদি হয় তবে হাঁটবে কী করে বনের মধ্যে, কাদার ভেতরে? রাস্তা না থাকলে চাকা তো অকেজো! প্র. গুণের সুরে ব্যঙ্গের আভাস।
এক সুন্দর হাসি ফুটে উঠল ড. সেনশর্মার মুখে। মনে মনে উপভোগ করছেন বেশ।
এখনও হারিনি গুণ। আরও আছে। পা আর চাকা থাকলেই বা কী এসে যায়। সাপের কথাই ধরো না। না আছে পা, না আছে চাকা। অথচ গতি কী দ্রুত ওর।
প্রতিবাদ করার আর সময় পেলেন না প্র. গুণ। প্রচণ্ড শব্দে দীৰ্ণ বিদীর্ণ হয়ে গেল আকাশ বাতাস। শব্দের বন্যা নামছে মহাকাশের বুক চিরে। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে লালচে আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চতুর্দিক। ঘটনার ঘনঘটায় হতচকিত হয়ে উঠল দুই বন্ধু। গাছপালার ছায়াগুলো ক্রমেই বৃহদাকার ধারণ করছে ঘাসে ঢাকা মাঠের উপর। কোনও কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই বিচিত্র আকারের এক মহাকাশযান নেমে পড়ল ওদের সামনে মাঠের উপর। কী অদ্ভুত বিস্ময়কর মহাকাশযান! লাল উজ্জ্বল আভায় ভরে উঠেছে মহাকাশযানের চারপাশ।
অজানা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে প্র. গুণের মুখ। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সামনের দিকে। অথচ সম্পূর্ণ বিপরীত ড. সেনশর্মার আচরণ। অবাক হয়েছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু সমস্ত মুখে এক কৌতুকের হাসি। বেশ রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছেন সমস্ত ঘটনা।
ভায়া হে, এবার যাচাই করে দেখো না তোমার থিয়োরি? ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন ড. সেনশর্মা।
কী বলছ তুমি? এখনও তোমার রসিকতা। স্নায়বিক দৌর্বল্য এখন কাটিয়ে উঠতে পারেননি প্রঃ গুণ।
জীবনটাই তো এক পরম রসিকতা হে৷ ভগবান নামক জাদুকরটা কেমন পুতুল নাচ নাচাচ্ছে বলো তো আমাদের! দেখো… দেখো এবার…
গুম গুম করে আওয়াজ উঠল মহাকাশযান থেকে। লাল আলোটা কমে গেল এক দিকে। ধীরে ধীরে যেন গলে গেল একপাশের অন্ধকার ধাতব আবরণটা। চৌকাকার কালো এক বস্তু যেন বেরিয়ে আসছে মহাকাশযানের অভ্যন্তর থেকে। ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে.. আরও… আরও উঠছে উপরে… ভাসছে এবার মহাকাশযানের উপর। লম্বা চৌকাকার এক পিপে ভাসছে জমি থেকে বেশ উপরে হাওয়ার মধ্যে। লালচে আভায় চকচক করছে ওর মসৃণ ধাতব দেহ।
ভালো ম্যাজিক তো? পিপে ভাসছে আকাশে! ভিনগ্রহীদের আক্রমণ শুরু হয়ে গেল পৃথিবীতে। প্রাণ বাঁচানোই দায় এখন! চাপা গলায় বললেন প্র, গুণ।
ওদের সামনে ভাসতে ভাসতে চারপাশে ঘুরতে শুরু করল পিপেটা। মাঝে মাঝে এগিয়ে আসছে, আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। মনে হল খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ওঁদের। এবার আরও সামনে এগিয়ে এল পিপেটা। কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন ওঁরা।
না, একেবারে ঘাড়ের উপর এল না বা ওঁদের আক্রমণও করল না। ওঁদের সামনে ভাসতে ভাসতে কাঁপতে শুরু করল। অদ্ভুত ছন্দে মৃদুমন্দ গতিতে নাচ শুরু করল মহাকাশের আগন্তুক।
স্কাউট রোবট নাকি সেন? একটু ইতস্তত করে বললেন প্র, গুণ।
ভুল করছেন আপনারা… আমি রোবট নই মোটেই। আমি তো আপনাদের মতোই জীবন্ত প্রাণী। পরিষ্কার স্বরে কাটা কাটা ভাবে কথা বলে উঠল পিপেটা।
চকিতের মধ্যে চারচোখের দৃষ্টি বিনিময় হল ওঁদের।
বোকা পেয়েছে আমাদের। এরকমভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে নিশ্চয় রোবটটাকে। একটু জোর দিয়েই কথাগুলো বললেন প্র, গুণ।
এ কথা বলছ কেন গুণ। প্রোগ্রাম করা হবে কেন? আমাদের দেখতে পাচ্ছে, সব কথা শুনতে পাচ্ছে… তা ছাড়া আমাদের চিন্তাও পড়তে পারছে বলে মনে হয় আমার। তা ছাড়া কথা বলল কী করে আমাদের ভাষায়? আরও আছে… এবার চেয়ে দেখো ভায়া… পা নেই, চাকাও নেই… অথচ কী অনায়াস গতিতে চলাফেরা করছে দেখো। তাহলে এবার কী বলবে গুণ? হাসিমুখে বন্ধুর দিকে তাকালেন ড. সেনশর্মা।
হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার মানছি তোমার যুক্তি। কিন্তু জীবন্ত নয় মোটেই পিপেটা।
বেশ তো, কী প্রমাণ চাও বলো? বেশ জোর দিয়ে বললেন ড. সেনশর্মা।
প্রমাণ করুন! প্রমাণ দিতে প্রস্তুত। কথা বলে উঠল পিপে।
প্রমাণ… প্রমাণ… একটিমাত্রই প্রমাণ চাই। তাহলেই বুঝব… বিড় বিড় করে বললেন প্র. গুণ।
বেশ তো…ইতস্তত কেন… কী প্রমাণ চান বলুন? মুহূর্তের মধ্যে উত্তর দিল পিপে।
জীবন্ত প্রাণীমাত্রই নিজের মতো প্রাণ সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে… জীবন্ত হলে জন্ম দিন ঠিক আপনার মতো একটা পিপে! আদেশের সুরে বলে উঠলেন প্র. গুণ।
উত্তর করল না পিপে। আরও তীব্র হয়ে উঠল গুমগুমে আওয়াজ। থর থর করে কাঁপতে শুরু করল। কাঁপুনি বাড়ছে ক্রমেই। কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে উঠল সমস্ত পিপেটা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রয়েছেন ড. সেনশর্মা আর প্র, গুণ। হঠাৎ খুলে গেল যেন একটা পাশ। ছোট্ট এক পিপে বেরিয়ে এল আগন্তুক পিপের মধ্যে থেকে। একই রকম দেখতে অথচ খুবই ছোট আকারের! বড়টার সামনেই ভাসছে সদ্যোজাত নবজাতক। কাঁপছে ধীরে ধীরে। মুহূর্ত কয়েক বাদেই ঘটল আরও চমকপ্রদ ঘটনা। ফুলে উঠতে শুরু করল নবজাতক। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আর কোনও পার্থক্য রইল না পিতা পুত্রের মধ্যে। সমানাকারের বড় দুটো পিপে ভাসছে চোখের সামনে।
মাঝে মাঝে মাথা ঠেকিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে পিপে দুটো। কৌতুক খেলায় মেতে উঠেছে পিতা পুত্র!
একটু পরেই নাচতে নাচতে ভেসে চলল নবজাতক মহাকাশযানের দিকে। তারপর এক সময়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে মহাকাশযানের অভ্যন্তরে।
এবার কথা বলে উঠল পিপে, আপনাদের অতিথি আমি… আর অতিথি বলে কেমন যেন লাগছে কথাটা বলতে… আমি যে জীবন্ত তার প্রমাণ তো দিলাম… কিন্তু আপনাদের প্রমাণ পেলেই নিশ্চিন্ত হতাম আমি।
প্রমাণ? কিসের প্রমাণ? সব যেন যেমন গোলমাল হয়ে গেল প্র, গুণের।
আপনারও যে জীবন্ত–রোবট নন… তার প্রমাণ!
অপূর্ব! অপূর্ব! সজোরে তারিফ করে উঠলেন ড. সেনশর্মা।
সেটা–সেটা কী করে সম্ভব হবে… প্রতিবাদের সুরে বলে উঠলেন প্র, গুণ।
সম্ভব করতেই হবে! এটাই তো ওর ন্যায্য দাবী। ওর বেলায় তুমিও তো তাই চেয়েছিলে না? ড. সেনশর্মার কণ্ঠে রসিকতার আমেজ।
কিন্তু কী করে করব আমরা?
কেন ঠিক যেমন করে আমি প্রমাণ দিলাম! গম্ভীর স্বরে বলে উঠল পিপে।
মানে… মানে কী করে বোঝাব ওকে? বন্ধুর দিকে নিরুপায় ভঙ্গিতে তাকালেন প্র. গুণ।
রীতিমতো জটিল হয়ে পড়ছে পরিস্থিতি। ড. সেনশর্মা গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন সমস্যাটা।
হ্যাঁ, দেখুন মহাকাশের আগন্তুক, আপনার মতো সহজভাবে জন্ম দিতে পারি না আমরা নবজাতকদের। তাই অন্য কোনও প্রমাণ যদি চান… তাহলে…
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি এবার। নবজাতক বংশধর সৃষ্টির ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে আছেন আপনারা। প্রায় প্রাগৈতিহাসিক যুগেই পড়ে আছেন দেখছি! খুব গম্ভীরভাবে বলে উঠল মহাকাশচারী পিপে।
ঠিক ধরেছেন আপনি! তবে কিনা…
ড. সেনশর্মাকে বাধা দিয়ে আবার প্রশ্ন করল পিপে, কোনও নবজাতক আপনাদের শিশু বংশধরদের দেখতে পারি একবার? শিশুদের দেখলেই সব বুঝতে পারব।
নিশ্চয়। নিশ্চয়। প্র. গুণেরই তো ছেলে আছে। কলেজে পড়ে… এখান থেকে অনেক দূর কলেজ। তবে ছবি আছে বাড়ির ভেতরে। যদি বলেন তো..
এক মিনিট অপেক্ষা করুন… ছবি নিয়ে আসছি আমি… চকিতে একবার ড. সেনশর্মার দিকে তাকিয়ে একরকম দৌড়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেলেন প্র. গুণ। একটু পরে বাইরে বেরিয়ে এলেন প্রকাণ্ড এক বাঁধানো ছবি নিয়ে।
ভাসতে ভাসতে আরও সামনে এগিয়ে এল পিপে। প্রফেসারও মাথার উপরে তুলে ধরলেন ছবিটা।
এবার এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটল ওঁদের সামনে। দুই বন্ধু হতবাক! হাত-পা ছাড়াও কী দ্রুত কাজ করে চলেছে অদ্ভুত পিপেটা।
প্রফেসারের হাত থেকে ছবিটা উড়ে গেল পিপেটার সামনে। জোর হয়ে উঠল গুমগুম আওয়াজ। কাঁপুনিও শুরু হয়ে গেল আস্তে আস্তে। ম্যাজিকের মতো পিপের সামনে শূন্যে ভাসছে ছবি। একটু একটু করে দুলছে পিপে। পর্যবেক্ষণ করছে খুব ভালো করে।
কেমন করে করছেন এসব? বিস্ময় চাপতে পারল না প্র. গুণ।
কেন? খুব সোজা। ফোর্সফিল্ডের সাহায্যে এসব অতি সহজ। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল পিপে।
নির্বাক দুই বন্ধু। কী-ই বা বলার আছে এর পরে। কয়েক মিনিট পরে আস্তে আস্তে ছবিটা নেমে এসে দাঁড়াল প্র. গুণের হাতের সামনে। যন্ত্রচালিতের মতো ধরে নিলেন প্রফেসার।
ধন্যবাদ অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের। সব কিছু বুঝতে পেরেছি এখন। এবার আমার বিদায় নেবার পালা। যেতে হবে আমাকে অনেক দূরে পিপের কণ্ঠস্বরে কি কষ্টের আভাস?
সে কী? মহাকাশের সীমাহীন দূরত্ব পেরিয়ে এলেন শুধু এইটুকু জানতে? মাত্র কয়েক মিনিট থাকবার জন্যে আমাদের গ্রহে? নিজের অজ্ঞাতসারে বলে উঠলেন ড. সেনশর্মা।
এখানে আসার একটাই উদ্দেশ্য ছিল। সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে আমার। এখন তো যেতে হবে আমাকে।
কী সে উদ্দেশ্য আপনার? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন প্র, গুণ।
আমাদের গ্রহের সমস্ত বিজ্ঞানীরাই এই মত পোষণ করেন যে মহাবিশ্বের যাবতীয় জীবন্ত প্রাণীরাই আমাদের মতন দেখতে। আমি কিন্তু প্রতিবাদ করেছিলাম। হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল ওরা আমার কথা! তাই প্রমাণ সংগ্রহে বেরিয়েছিলাম। প্রমাণও পেয়ে গেলাম হাতে নাতে।
অথচ পৃথিবীর একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এই যে প্রফেসার গুণ বহুদিন আগেই প্রমাণ করেছেন যে মহাবিশ্বের বুদ্ধিমান জীব মাত্রই বিভিন্নরূপে প্রকাশমান। বেশ গম্ভীর ভাবে বলে উঠলেন ড. সেনশর্মা। বন্ধুর ব্যবহারে বাক্যহারা প্রফেসর।
খুব ভালো হল… আপনাদের মূল্যবান অভিমতের কথা নিশ্চয় জানাব আমাদের বিজ্ঞানীদের। বেশ উৎসাহভরে কথাগুলো বলে উঠল পিপে।
বিদায়–বিদায় বন্ধু–আপনাদের উন্নত সভ্যতার কথা চিরদিন মনে রাখব আমরা
একসময়ে আকাশের বুকে অদৃশ্য হয়ে গেল অজানা বিশ্বের মহাকাশযান।
একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা বললে যে সেন? একটুও বাধল না তোমার?
যাই হোক বন্ধু, হেরে গেছ তুমি। হাসতে হাসতে বললেন ড. সেনশর্মা, শুধুমাত্র আমার তোমার সকলের–বিশ্বের ইজ্জত বাড়াবার জন্য মিথ্যা বললাম। তা নয়তো কী ভাবতো বলো তো পিপেটা?
[প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, সেপ্টেম্বর ১৯৭৯]