পিপাসার্ত – তানজীম রহমান

পিপাসার্ত

শেষ একটা টান দিয়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল এখলাস মুয়াজ্জিন।

যে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এধরনের বিরাট আলিশান বাড়িতে ওর শ্রেণীর লোকজন শুধু একটা কারণেই আসে। তৈলাক্ত হাসি মুখ নিয়ে ধনী মালিকদের কাছে সাহায্য চাইতে। স্যর, আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন, স্যর, আপনারাই মা-বাপ। স্যর, যদি কিছু দিতে পারেন তা হলে বাচ্চাটা পরের ক্লাস পড়তে পারবে, স্যর, নইলে এত ভাল।

একটা ছাত্রের ভবিষ্যৎ এখানেই শেষ, স্যর।। কিন্তু এখলাস মুয়াজ্জিন এখানে সাহায্য চাইতে আসেনি, বরং বাড়ির মালিক ডেকে এনেছে। একটা ব্যাপারে তার সাহায্য দরকার। এমন একটা ব্যাপারে যেটায় এখলাস ছাড়া। আর কেউ কিছু করতে পারবে না।

নিজের সন্তুষ্ট হাসি গোপন করবার কোনওরকম চেষ্টা না করে এখলাস মুয়াজ্জিন দরজার বেল বাজাল।

একজন বয়স্ক কাজের লোক এসে দরজা খুলে দিল। আসেন, হুজুর, আমার পিছনে আসেন। বাধ্য ছেলের মত এখলাস তার পিছে পিছে একটা বিশাল বসার ঘরে এসে পৌঁছাল। ও এতক্ষণ ইচ্ছা করেই আশপাশে তাকিয়ে দেখেনি, যাতে চাকরটা মনে না করে যে এরকম বড়লোকের বাসায় ওর আগমন এই প্রথম।

কিন্তু ড্রয়িংরুমটায় এসে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এত সুন্দর রুম ও কখনও দেখেনি।

প্রকাণ্ড ঘরটার সবকিছু সাদা রঙ করা, মেঝে, দেয়াল, ছাদ, সবকিছু। দেয়ালে কয়েকটা ছবি টাঙানো, কিন্তু কোনও ফোটো নেই। গোলাকার মেঝের মাঝখানে একটা মাঝারি সাইজের পাথরের টেবিল রাখা, এটাও সাদা রঙের। আর টেবিলের চারপাশ ঘিরে পুরনো আমলের রাজকীয় চেয়ার রাখা, যেগুলোর মধ্যে একটায় ঢোলা, সাদা শার্ট আর জিন্সের পান্ট পরা শীর্ণ, ফর্সা এক যুবক বসে আছে। ছেলেটার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ আর বেপরোয়া।

এখলাসকে দেখে উঠে দাঁড়াল। এখলাস মনে মনে খুশি হলো। বড়লোক হলেও ছোকরা বেয়াদব নয়।

আসোলামু ওয়ালাইকুম। এখলাস বলল।

ছেলেটা সালামের জবাব না দিয়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। আপনি এখলাস মুয়াজ্জিন, তাই না? আসার জন্যে ধন্যবাদ। আপনাকে কি কালাম সাহেব জানিয়েছেন। আমার সমস্যাটা কী?

কালাম জোয়ারদার হচ্ছে এখানকার মসজিদের ইমাম। সে-ই এখলাসকে বলে এখানে আসতে। এখলাস ছেলেটার সাথে করমর্দন করে জবাব দিল, খুব বেশি কিছু নয়। উনি শুধু বললেন যে আপনার বাড়ির ওপর আসর হয়েছে, আর স্থানীয় হুজুররা কেউই কিছু করতে পারছেন না।

ছেলেটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এভাবে বললে। ব্যাপারটা কত তুচ্ছ মনে হয়, তাই না? হাত দিয়ে এখলাসকে ইঙ্গিত করল বসতে, নিজেও মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

আপনি যদি সবকিছু খুলে বলেন তা হলে আপনাকে সাহায্য করতে আমার সুবিধা হবে। এখলাসের মতামত।

অবশ্যই, অবশ্যই, এজন্যেই তো আপনাকে এখানে আনা…মুরাদচাচা, অতিথি আপ্যায়নের বন্দোবস্ত করেন।

হুকুমটা শোনামাত্র বয়স্ক ভৃত্যটি মাথা নিচু করে সম্মতি জানিয়ে গায়েব হয়ে গেল।

ছেলেটা নিষ্প্রাণ, ফ্যাকাসে গলায় নিজের গল্প শুরু করল:

এখলাস সাহেব, আমার নাম হচ্ছে জামিল। জামিল সামাদ। এটা আপনি কালাম সাহেবের কাছ থেকে শুনে। থাকবেন। আমার বাবা ছিলেন এহসান সামাদ, ঢাকার প্রখ্যাত ধনীদের মধ্যে একজন। বড়াই করছি না, যাতে আপনি সবকিছু পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন তাই বলছি। ছেলেটা একটু থামল। এখলাসের মনে হলো ছেলেটা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না পুরো গল্পটা বলবে কিনা। জামিল দম নিয়ে আবার শুরু করল, বাংলাদেশের অন্যান্য বড় ধনী ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের মত বাবাকেও সম্পত্তির সিঁড়ি বেয়ে উঠবার সময় অনেক নোংরা কাজ করতে হয়েছে। তার ফল। হয়েছে এই যে মৃত্যুর সময় ওঁর সাথে কেউ ছিল না। মা আর বাবার অনেক আগেই ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে, আর বছর দুয়েক আগে আমি বাবার অনুমতি না নিয়েই বিদেশে চলে যাই। বাবা এই ব্যাপারটায় প্রচণ্ড রাগ করেন। উনি আমার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। শুধু তাই নয়, উনি এই বাসায় আমার যত চিহ্ন ছিল সব নষ্ট করে দেবার চেষ্টা করেন। আমার ঘরের আসবাবপত্র, আমার ছবি সব পুড়িয়ে ফেলা হয়। এমনকী সেলিমচাচা নামে আমাদের একজন পুরনো, বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিল, যে আমাকে ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করেছে, তাকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেন আমি চলে যাবার পর। তারপরও গত মাসে তার। মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি আবার দেশে ছুটে আসি। আমার জেদ আর রাগের সাথে পরিচিত বলে কোনও আত্মীয়স্বজন আমাকে বাবার অসুস্থতার কথা জানায়নি। আমার ভিসা নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল, আর এসে দেখি বাবার কবর দেয়া হয়ে গেছে।

মুরাদ একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢোকাতে জামিলের কথায় বাধা পড়ল। সে ট্রে থেকে টেবিলে বিস্কিট আর কেকের প্লেট নামিয়ে রাখল। আর এক কাপ চা।

এখলাস একটা কেক হাতে নেবার পর জামিল আবার শুরু করল, এখলাস সাহেব, যতই রাগ করে থাকি, উনি আমার বাবা। মরার আগে একবার ওর সাথে কথাও বলতে। পারলাম না, আর আমি ওঁর চেহারা দেখতে চাই না এ ধারণা নিয়েই উনি মারা গেলেন-এ ব্যাপারটা আমার সহ্য হয়নি। তাই আমি ওঁর সাথে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা নিই।

এখলাসের বিস্মিত দৃষ্টির জন্যে জামিল তৈরি ছিল। না থেমে বলে যেতে লাগল, আমি একজন শিক্ষিত মানুষ, এখলাস সাহেব। কিন্তু পাশাপাশি আমি একজন স্পিরিচুয়াল। মানুষও। আমি মানবাত্মার ব্যাপারে প্রচুর পড়াশোনা করেছি। আমি কোনও নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাস না করলেও এটা বিশ্বাস করি যে মানুষের স্থূল দেহের ভিতর এক ধরনের সূক্ষ্ম দেহ আছে, যার সাথে কিছু নিয়ম, কিছু পদক্ষেপ পালনের মধ্য দিয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব।

ছোকরা তা হলে কাফির? তারচেয়েও খারাপ, এ তো মুশরিক বলে মনে হচ্ছে, যে কালো জাদুতে বিশ্বাস করে।

তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। আমার বাবার মৃত্যু খুব একটা স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ওঁর অসুখ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সাধারণ অসুখ নয়।

কী তা হলে?

জলাতঙ্ক।

এখলাস কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

সাধারণ নয় এ কারণে বলছি যে, বাবা কুকুর একদম পছন্দ করতেন না, এবং আমার জানামতে গত দশ বছরে বাবা কোনও কুকুরের কাছেও ঘেঁষেননি। ডাক্তারও বাবার মৃতদেহ পরীক্ষা করে বলেছেন যে তাঁর শরীরে কোনও কামড়ের দাগ নেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে টানা তিন দিন বাবা পানি খাননি, জোর করে খাওয়াতে গেলে বমি করে বের করে দিয়েছেন, ইঞ্জেকশন দিতে গেলে এমন দাপাদাপি করেছেন। যে ডাক্তাররা কাছে আসতে পারেননি।

জামিল আবার একটু থামল। ওকে এখন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। আমি ঢাকায় আসবার পরের দিন রাতেই বাবার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করি। কিন্তু কোনওরকমের সাড়া পাইনি। ঘণ্টা দুয়েক বসে থাকার পরেও মোমবাতির আলো পর্যন্ত নড়েনি। আমি ভেবেছিলাম বাবা হয়তো আমার সাথে কথা বলতে চান না। কিন্তু ঘটনা ঘটা শুরু করে তার পরের রাত থেকে।

এখলাসের মনে হলো ছেলেটার ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে অন্য কীসের যেন ছাপ পড়েছে। ভয়?

সেদিন রাতে খাবার সময় পানি মুখে দেবার সাথে সাথে আমার বমি এসে পড়ে। পানিতে বিশ্রী, সোঁদা গন্ধ। প্রথমে ভেবেছিলাম জগে হয়তো ফাঙ্গাস পড়েছে, বা পানির ফিল্টারে। কিন্তু চেক করে কিছুই পেলাম না। আমি আর মুরাদচাচা মিলে ছাদের ট্যাঙ্কও দেখলাম, কিন্তু সেখানেও কোনও সমস্যা নেই। শেষ পর্যন্ত মুরাদচাচাকে বললাম দোকান থেকে মিনারেল ওয়াটার কিনে আনতে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি, জানেন?

এখলাস বুঝতে পারছিল ছেলেটা কী বলবে, কিন্তু তারপরও জিজ্ঞেস করল, কী?

দোকানের পানিতেও ঠিক একই গন্ধ! আর গন্ধটা এতই তীব্র যে সে পানি ঠোঁটে ছোঁয়ানোই কঠিন, খাওয়া তো দূরের কথা। সেদিন থেকে শুরু। তারপর থেকে প্রত্যেকদিন একই ব্যাপার। যে পানি খেতে যাই তারই একই অবস্থা। ডাক্তার দেখালাম, কোনও অসুখ ধরা পড়ল না। তা ছাড়া মুরাদচাচা তো একই পানি খাচ্ছেন, ওঁর তো কোনও সমস্যা হচ্ছে না। প্লাম্বার ডেকে পানির পাইপ চেক করালাম, বলা বাহুল্য, কিছুই ধরা পড়ল না। আর ব্যাপারটা আরও সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াল তার পরের রাত থেকে। আমার বাসার প্রত্যেকটা কল থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেল।

এখলাস এবার একটু থমকাল। এটা ও আশা করেনি।

আবারও বলছি এখলাস সাহেব, দম্ভ করছি না, কিন্তু বাবার এখানে প্রচণ্ড প্রতিপত্তি ছিল। আমি যখন এ বাসার নাম্বার থেকে ওয়াসার অফিসে ফোন দিই তখন ওদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় কে এসে পাইপ ঠিক করবে তা নিয়ে। কিন্তু ওরা এসে কোনও সমস্যাই খুঁজে পেল না। না আমার বাসার পাইপিং-এ, না ওদের নিজেদেরগুলোতে।

এখলাসের দিকে তাকাল জামিল।

কোনও সন্দেহ নেই, ছেলেটার চোখজুড়ে ক্লান্তি আর ভয়ের ছাপ পড়েছে।

. গত চার দিন ধরে আমি কোক আর জুস খেয়ে বেঁচে আছি। বাড়ির কাজের পানি বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয়। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে বাবার আত্মা আমার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে নাকি আমি অন্য কিছুকে ডেকে এনেছি। অতিষ্ঠ হয়ে আমি কালাম সাহেবকে খবর দিই। উনি বাড়িতে এসেই ঘাবড়ে যান। বারবার বলতে থাকেন যে এখানে খুব খারাপ কিছু হয়েছে। উনি কোনও অশুভ অস্তিত্ব অনুভব করছেন। উনি আমাকে বলেন যে এসব ব্যাপারে ওঁর তেমন কোনও অভিজ্ঞতা নেই। উনি আপনার কথা বলেন, বলেন যে কারও যদি এই সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা থাকে তা হলে আপনারই থাকবে। এখন বলেন, এখলাস সাহেব, শুনে আপনার কী মনে হয়? সুরাহা করা কি সম্ভব?

এখলাস চিন্তিত মুখে নিৰ্জের দাড়িতে হাত বুলাল।  

দেখেন, জামিল সাহেব, এর আগে আমাকে জিনের আসর হওয়া দুটো বাসায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আল্লাহপাকের দয়ায় ওদের সমস্যাগুলো কিছুদিনের মধ্যেই চলে গেছে। কিন্তু আপনার মত কেস ওদের কারওই ছিল না।

এখলাস একটা কুটিল হাসি গোপন করল। এদেরকে যত টেনশনে রাখা যায় টাকার অঙ্ক ততই বাড়ে।

তাই আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে এখানে আমি কতদূর কী করতে পারব।

উত্তর দেবার সময় জামিলের চোখ উদ্বিগ্ন দেখালেও গলা। ঠাণ্ডাই রইল। আপনার যদি টাকা পয়সা নিয়ে কোনও চিন্তা থেকে থাকে তা হলে তা দূর করে দিন। আমার এই সমস্যাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করতে হবে, ঠিক আছে? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ওর গলা শেষের দিকে কঠিন শোনাল।

এখলাস ভিতরে ভিতরে একটু অবাক হলো। জামিল আসলেই ভয় পেয়েছে। ভীষণ ভয়। ওকে দেখে সহজে ভয় পাবার ছেলে বলে মনে হয় না।

আমি আজ সকাল থেকে জুসও খেতে পারছি না, এখলাস সাহেব, জামিলের গলা ক্লান্ত, ভেঙে পড়া একজন মানুষের গলায় পরিণত হলো। ফলের রস, কোল্ড ড্রিঙ্কস্, যাই খেতে যাই না কেন, ওই অসহ্য গন্ধটা আমার নাকে এসে লাগে। আপনি যদি কিছু না করতে পারেন আমিও বাবার মত পানির পিপাসায় মারা যাব।

.

সেদিন রাতে এখলাস শোবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। সে জামিলকে কথা দিয়ে এসেছে কালকেই জামিলের বাড়ি দোয়া পড়ে বন্ধ করে দিয়ে আসবে। সাধারণত এটা করতে পাঁচজন লাগে, তাই এখলাস আগামীকাল ওর দুই সাগরেদকে নিয়ে যাবে।

বিছানায় মশারি খাঁটিয়ে শুয়ে পড়ল। মগবাজারের একটা। ছোট বাসায় থাকে। বিয়ে-থা করেনি, এখানে থাকতে ওর তেমন সমস্যা হয় না। পুরনো বাসা, তাই হাজারো সমস্যা। মাঝে মাঝে ওর শোবার ঘরের লাইট নিজে থেকেই কয়েক ঘণ্টার জন্যে বন্ধ হয়ে যায়, আর বাথরুমের কল থেকে নিরন্তর টিপ টিপ পানি পড়তে থাকে, কিন্তু এখলাস কখনোই এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়নি।

এখলাস বেশি রাত জাগে না। আজকেও বিছানায় শুয়ে রাতের শব্দ শুনতে শুনতে ওর চোখ বুজে এল ঘুমে। জানালার বাইরে থেকে একটা নিশাচর পাখির কর্কশ ডাক ভেসে আসছে। দেয়ালে টিকটিকির টিক টিক ডাক। ফ্যানের ছন্দময়, যান্ত্রিক সঙ্গীত।

হঠাৎ ওর চোখ খুলে গেল। কী ব্যাপার? কী যেন মিলছে না। কোথায় যেন কী নেই। বিছানায় উঠে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করল কীসের অভাব অনুভব করছে।

পাঁচ মিনিট কেটে গেল। এখলাসের চোখে কিছুই ধরা পড়ল না। আবার শুতে যাবে তখন বিদ্যুৎচমকের মত বুঝতে পারল কোন্ জিনিসটায় ওর অস্বস্তি হচ্ছে।

বাথরুমের কল থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

এখলাস গত দুই বছর ধরে এ বাসায় থাকছে, আর প্রত্যেক রাতে ওর নিদ্রার সঙ্গী ছিল কল থেকে টিপ টিপ পানি পড়ার ওই শব্দটা। কিন্তু আজকে শব্দটা আসছে না।

জামিল না বলেছিল ওর বাসার কলগুলো থেকেও পানি পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে?

এখলাস বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে বাথরুমের লাইটটা জ্বেলে দিল। কিছুই নেই।

সত্যি বলতে কী, আশাও করেনি যে কিছু দেখবে। কিন্তু রাতের পরিবেশটাই এমন। কল্পনা অতি সাধারণ কোন ঘটনাকেও অলৌকিক রূপ দিতে চায়।

বাথরুমে ঢুকে দেখল কোথাও অস্বাভাবিক কিছু আছে। কিনা। ছাদের এক কোনায় একটা বিশাল, গর্ভবতী মাকড়সা ছাড়া চোখে পড়ার মত আর কিছু নেই। কলটা ছাড়তে পানির একটা ক্ষীণ ধারা পড়তে লাগল। সবই ঠিক আছে। লাইটটা নিভিয়ে বিছানায় ফিরতে যাবে এমন সময় জিনিসটা ওর চোখে পড়ল।

ওর মশারির ভিতর কী যেন বসে আছে।

অন্ধকারে একজন মানুষের আবছা আকৃতি দেখা যাচ্ছে। মানুষটা গুটিসুটি হয়ে বসে আছে, দুই হাঁটু বুকের সাথে জড়িয়ে। কপাল হাঁটু দুটোর ওপর রাখা। অসম্ভব শীর্ণ একজন মানুষ।

এখলাস এক কদম এগিয়ে এল।

মানুষটা নড়ল না। কিন্তু এখলাসের গলা থেকে একটা জান্তব গর্জন বেরিয়ে এল। গলাটা অপার্থিব, ভয়ঙ্কর। অনেকক্ষণ চিৎকার করবার পর মানুষের গলা যেমন ভেঙে ফাসফেঁসে হয়ে যায়, অনেকটা সেরকম।

এখলাস বিড়বিড় করে দরুদ পড়তে শুরু করল।

মটমট করে শব্দ হলো। মানুষটা আস্তে আস্তে মাথা তুলছে। ওর হাড়গুলো যেন অনেক পুরনো, ওর শরীরের ভার আর বহন করতে পারছে না।

এখলাস এবার জোরে জোরে দরুদ পড়তে লাগল। ওর কপালে চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে। আস্তে আস্তে বেডরুমের লাইটের সুইচটার দিকে এগোচ্ছিল।

মানুষটার মাথা আস্তে আস্তে এখলাসের দিকে ঘুরল।

দড়াম দড়াম করে প্রচণ্ড জোরে শব্দ হলো দরজায়। একটা গলা ভেসে এল বাইরে থেকে, হুজুর? সব ঠিক আছে। তো?

এখলাসও ঠিক সেই মুহূর্তেই লাইটটা জ্বেলে দিল। কিছুই নেই বিছানায়।

উঁচু গলায় প্রতিবেশীকে বলল, জি, কাদের সাহেব, সব ঠিকই আছে।

.

পরদিন এশার আযানের আগে আগে এখলাস ওর সাগরেদ কলিম আর রাশেদকে নিয়ে জামিলের বাড়িতে হাজির হলো। অল্প কথায় জামিল আর মুরাদকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। জামিল বাড়ির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আযান দেবে, সে। সময় এখলাস, কলিম, রাশেদ আর মুরাদ বাড়ির চারকোনায় সুরা পড়ে একটা করে পেরেক ঠুকবে। এতে ঘরের মধ্যে যদি কোনও অশুভ প্রভাব থেকেও থাকে, সেটার আর কারও ক্ষতি করবার ক্ষমতা থাকবে না।

গতকাল রাতে কী হয়েছে সেটা এখলাস জামিলকে বলেনি। যদি ছোকরা মনে করে যে হুজুর নিজেই ভয় পাচ্ছে। তা হলে এখলাসের বদলে অন্য কাউকে নিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা হলেই এতগুলো টাকা গচ্চা।

এখলাস সবাইকে ওজু করে নিতে বলে নিজেও বাথরুমে ঢুকল। এবং ঢুকেই একবার সাবধানে আশপাশে তাকাল না, কিছু নেই। পানিভরা বালতির পাশে বসে ওজু সেরে নিল।

ড্রয়িংরুমে এসে আরেকবার সবাইকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। তারপর একটা হাতুড়ি আর পেরেক হাতে নিয়ে চলে গেল বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। কলিম, রাশেদ আর মুরাদ বাকি তিন কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আর জামিল দাঁড়াল ড্রয়িংরুমের মাঝখানে। এটাই বাসার কেন্দ্রবিন্দু।

জামিল শুরু করল: আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর…

এখলাসও মনে মনে সুরা পড়তে লাগল। পেরেকের মাথাটা দেয়ালের সাথে চুঁইয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল, যাতে জামিলের আযান শেষ হবার সাথে সাথে পেরেকটা ঠুকে দিতে পারে।

আসসাদু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…

হঠাৎ এখলাসের কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। ওর গলা শুকিয়ে গেছে। ভয়ে নয়, বরং মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ পানি খায়নি।

জামিলের আযান থেমে গেল।

এখলাস হাতুড়ি-পেরেক ফেলে দৌড় দিল ড্রয়িংরুমের দিকে। বাড়িটা এত বড় যে দৌড়ে আসতে আসতেও প্রায় ৩০ সেকেণ্ডের মত লেগে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পা দিল ড্রয়িংরুমের দরজায়।

আর সাথে সাথে বাড়ির সবগুলো আলো নিভে গেল।

এখলাস দেয়ালে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে এল ঘরটার মাঝখানে, যেখানে জামিল দাঁড়িয়ে ছিল। সারা ঘর একটা অদ্ভুত, গা-শিউরানো শব্দে ভরে গেছে। একটা জান্তব, ফাসফেঁসে গলার গর্জন, ঠিক যেমন এখলাস, গতকাল রাতে শুনেছিল।

ঘরের মাঝখানে আসতে পায়ে কীসের সাথে যেন ধাক্কা খেল। সাথে সাথে ভয়ে স্থির হয়ে গেল এখলাস। নিচে তাকাবারও সাহস পেল না।

অন্য তিনজনও ততক্ষণে ড্রয়িংরুমে ছুটে এসেছে। তাদের মধ্যে একজনের হাতে একটা টর্চলাইট। সে আলোটা এখলাসের ওপর ফেলল। একমুহূর্তের জন্যে এখলাসের মনে হলো তীব্র আলোতে ওর চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। তারপর ওর চোখ চলে গেল মেঝেতে।

যে মানুষটা মেঝেতে শুয়ে আছে তাকে দেখে আর জামিল বলে চেনা যায় না। ওর শরীর শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গেছে, গায়ের চামড়া হয়ে গেছে রুক্ষ, খসখসে। ওর ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। কথা বলার চেষ্টা করছে, আর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে অর্থহীন, ফাসফেঁসে শব্দ। ওর চোখে তীব্র, অসহায় আতঙ্ক।

টর্চ হাতে মানুষটা ডুকরে কেঁদে উঠল। মুরাদ। জামিলচাচা! আপনের কী হইল! ইয়া আল্লাহ!

এখলাস কোনওমতে নিজেকে শান্ত করে আয়াতুল কুরসী পড়তে লাগল। কলিম আর রাশেদও কাঁপা কাঁপা গলায় যোগ দিল ওর সাথে।

জামিল শেষ একবার চিৎকার করে উঠল, তারপর স্থির হয়ে পড়ে রইল মাটিতে।

বাসার সবগুলো লাইট আবার জ্বলে উঠল।

.

এক মাস পর।

এখলাস নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমাবার আগে ওর মাথায় আরেকবার ভেসে উঠল সেই কালো দিনের ঘটনাগুলো। প্রায় প্রতি রাতেই ওর মনে পড়ে যায় জামিলের ভয়ঙ্কর, অসহায় চেহারা। ওর, চোখের ভয়। আর মুরাদের স্বীকারোক্তি।

জামিলের মৃত্যুর পর স্বভাবতই পুলিশ আসে। এসে সবাইকে সন্দেহভাজন হিসাবে জেরা করা শুরু করে। মুরাদ এমনিতেই ভেঙে পড়েছিল, পুলিশি জেরার সামনে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। সব সত্য স্বীকার করে।

ওই বাড়িতে আরেকজন কাজের লোক ছিল, সেলিম, যে পেলে বড় করেছে জামিলকে, তাকে আসলে জামিলের বাবা বের করে দেননি। ছেলে না জানিয়ে বিদেশ চলে যাবার পর জামিলের বাবা রাগে উন্মাদ হয়ে যান। জামিলের সব জিনিসে আগুন ধরিয়ে দেবার পর তার চোখ পড়ে সেলিমের ওপর। উনি সেলিমকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে বাসার নিচের একটা ঘরে আটকে রাখেন। তাকে কোনও খাদ্য-পানীয় কিছু দেয়া। হয়নি। মুরাদও তখন ভয়ে কিছু বলতে পারেনি। তিন দিনের মাথায় সেলিম পানির পিপাসায় মারা যায়। মুরাদ ওর লাশ  গভীর রাতে একটা ডোবায় ফেলে দিয়ে আসে। মারা যাবার আগে সেলিমও নাকি শুকিয়ে অস্থি-চর্মসার হয়ে গিয়েছিল।

এটুকু বলেই মুরাদ কান্নায় ভেঙে পড়ে। ও বিলাপ করতে থাকে যে, সেলিমের আত্মাই প্রতিশোধ নিয়েছে জামিল আর ওর বাবার ওপর। ও হয়তো প্রথমে জামিলের ক্ষতি করতে চায়নি, কিন্তু জামিল নিজের বাবার আত্মার সাথে যোগাযোগ করতে চাওয়ার পর জামিলের ওপর রেগে যায়।

এখলাসের চোখে আলো পড়াতে পাশ ফিরে শুলো। এখন সারারাত বাথরুমের আলো জ্বেলে রাখে।

তানজীম রহমান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *