পিপাসা
সক্কাল সক্কাল একচোট ঝগড়া হয়ে গেল সুনন্দিনীর সঙ্গে। দিনদিন বড্ড ঘ্যানঘ্যানে হয়ে উঠছে মেয়েটা। মাত্র মাস চারেক হল বিয়ে হয়েছে আমাদের। তাও সম্বন্ধ করে। এরই মধ্যে ও নাকি আমার মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে। আমি নাকি ওকে আর ভালোবাসি না। তাই ক’দিন পর পরই ওকে ছেড়ে এখানে সেখানে চলে যাই। আরে বাবা, কে বোঝাবে যে, আমি বরাবরই খুব ডানপিটে। অ্যাডভেঞ্চার আমার রক্তে নেশা ধরিয়ে দেয়। বিশেষ করে রহস্যের গন্ধ পেলে আমার কোনও দিকেই নজর থাকে না আর। এই তো, কয়েকদিন আগেই হিমাচলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে একের পর এক মানুষের রক্তশূন্য দেহ পাওয়া যাচ্ছে, এই খবরটা খবরের কাগজে পড়া মাত্রই ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এসব কাজে আমি একা যেতেই পছন্দ করি। সঙ্গে কাউকে নেওয়া মানেই হেডেক। তবে এবার নিয়েছিলাম। সদ্য বিয়ে করা বউকে একা ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। তাছাড়া হিমাচল-এর ছবির মতো গ্রামে মধুচন্দ্রিমা যাপনের এই সুযোগ ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। ওখান থেকে ফেরার পর থেকে অবশ্য প্রায়ই বেড়িয়ে পড়ি নিজের তাড়নায়। তবে সুনন্দিনীকে হিমাচলে যাওয়ার আসল কারণটা বলিনি। যা ভীতু মেয়ে! নিজে তো যাবেই না, চেঁচামেচি করে আমাকেও আটকে দিত।
এর আগেও এরকম বেশ কিছু অভিজ্ঞতা আছে আমার ঝুলিতে। পরে কখনো সুযোগ পেলে বলব। সুযোগ পেলে! যাই হোক, হিমাচলের এই গ্রাম আমার জীবন পালটে দিয়েছে। তাই এই গল্পটা আমাকে বলতেই হবে। ওখানে গিয়ে শুনেছিলাম এক অদ্ভুত গল্প। গ্রাম থেকে ২ কিলোমিটার মতো দক্ষিণে গেলে একটা বিরাট বড় পাহাড়ি তালাব বা পুকুর। টলটলে কাকচক্ষু জল এতই ঠান্ডা, যেন মানুষের শরীরে ছুরি চালায়। তালাবের ওপারে পাহাড়। তালাব আর পাহাড়ের মধ্যিখানে কিছুটা জায়গা যেন নো ম্যানস ল্যান্ড। গ্রামবাসীরা পারতপক্ষে ওই তালাবের ধারে পাশে যায় না, ওপারে তো কথাই নেই। আমি গ্রামে পৌঁছে খোঁজ খবর করা শুরু করলাম।
কিন্তু যাকেই জিজ্ঞেস করি, রক্তশূন্য লাশের রহস্য তারা কিছু জানে কি না? ফ্যাকাশে মুখ আর চোখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছায়া নিয়ে পত্রপাঠ কেটে পড়ত। শেষপর্যন্ত আমরা যার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম দিনে মাত্র ৪০০ টাকার বিনিময়ে, সেই বৃদ্ধা জানিয়েছিলেন এমন এক কাহিনি, যা পাহাড়ী গ্রাম্য লোককথা হিসেবে যতই আকর্ষনীয় লাগুক, একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস করা অতীব কঠিন। এখানে একটু বলে নিই, বৃদ্ধার কাছে যখন এসব গল্প শুনছিলাম, সুনন্দিনী তখন স্নানে গিয়েছিল। বলতে পারেন, সেই সুযোগটাই নিয়েছিলাম আমি। এবার আসি সেই গল্পে।
বহুকাল আগে এই গ্রামে বাস করতো এক অবস্থাপন্ন চাষীর পরিবার। চাষীর একমাত্র ছেলে বছর পনেরো বয়সে হঠাৎই উধাও হয়ে যায়। যথাসাধ্য খোঁজখবর করেও তার কোনও হদিশ পান না চাষী। একসময়ে হাল ছেড়ে দেন তিনি। সেই সময় পাহাড়ের এক নির্জন উপত্যকায় তাঁবু ফেলেছিল একদল যাযাবর উপজাতি। গ্রামের মানুষ তাদের এড়িয়ে চলত, ভয় পেত। তারা নানা রকম তন্ত্র মন্ত্র জানতো। মানুষের ভালো করার চেয়ে খারাপই করতো বেশি। এমনকি অনেকে বলতো, ওদের পোষা অপদেবতা আছে। রাত-বিরেতে উপত্যকা থেকে বয়ে-আসা ঠান্ডা হাওয়া নিজের সঙ্গে বয়ে আনতো অস্বাভাবিক আর হাড় হিম করে দেওয়া কিছু বিকট শব্দ। সেগুলো যে কীসের শব্দ, তা কেউ জানতো না। যেন এক বিশাল দানব হঠাৎ জেগে উঠে নিজের বন্দিত্ব ঘোচানোর প্রবল প্রচেষ্টায় উন্মত্ত ক্রোধে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চাষীর ছেলে পদম যেদিন উধাও হল, সেদিন রাতারাতি এই যাযাবরের দল তাদের তাঁবু গুটিয়ে কোথায় চলে গেল কেউ জানে না। পদম নিরুদ্দেশ হওয়ার পর কেউ কেউ বলতে লাগল, “তারা পদমকে প্রায়ই সন্ধ্যার আলো আঁধারে ওদের তাঁবুতে যেতে দেখেছে। কাজেই গ্রামের লোকের ধারণা হল ছেলেটি ওদের সঙ্গেই চলে গেছে।”
জলের বুদ্বুদের মতোই একদিন পদমের কথাও মিলিয়ে গেল গ্রামবাসীর মন থেকে। চাষী আর চাষী বউ শুধু বুকে একটা শূন্যস্থান নিয়ে দিন যাপন করতে লাগলেন। এরপর কেটে যায় প্রায় বারো বছর। চাষী বউ মারা গেলেন। সেদিনই, যেমন গিয়েছিল তেমনি ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হল পদম। হিমাচলিরা এমনিতেই সুন্দর; কিন্তু পদমের দিক থেকে যেন চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। এক জ্যোতির্বলয় যেন ঘিরে রয়েছে তাকে। টকটকে ফর্সা গালদুটো আপেলের মতো লাল। চাষী বুঝতে পারলো না কী করবে। বউ এর মরার শোক, না ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। বৃদ্ধার মৃত্যুশোক ছাপিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠল গ্রামের লোক। শুধু একজন বাদে।
শুধু একজন দূর থেকে লক্ষ্য করছিল সবকিছু। তার বলিরেখা পড়া কপাল আরও কুঁচকে রয়েছে কোনও এক অজানা আশঙ্কায়। গাঁওবুড়ো কাঁসিরাম। সব সমস্যার সমাধান ছিল এই লোকটির কাছে। জড়িবুটি চিকিৎসা থেকে শুরু করে ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবচ সব কিছুতেই গ্রামবাসী এরই শরণাপন্ন হতো। কাজ হতো কিনা জানি না, তবে বিশ্বাসেই বোধহয় বেশিরভাগ সুরাহা হতো।
যাই হোক না কেন, ঠিক দু’দিন পর থেকেই গ্রামে দেখা দিল এক আতঙ্ক। কয়েকদিনের ব্যবধানে গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যেতে থাকলো এক একটি তরতাজা মানুষ। উধাও হওয়ার দু-একদিন পর সেই নো ম্যানস ল্যান্ডে মিলত তার দেহ। রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। যেন সারা শরীরের রক্ত কেউ নিংড়ে বের করে নিয়েছে। ক্ষত বলতে ঠিক বুকের ওপর একটা গর্ত। কেউ বা কিছুতে যেন খুবলে বের করে নিয়েছে তার হৃদপিণ্ড আর সেই পথেই বয়ে গেছে তার শরীরের রক্ত, যদিও দেহের আশেপাশে কোথাও কোনও রক্তের ফোঁটা পর্যন্ত নেই। এইরকম ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিল যতই বাড়তে লাগল, ততই গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো প্রতিকারের আশায় ভিড় জমাতে লাগল কাঁসিরামের কুটিরে। সন্দেহ তো তার আগেই হয়েছিল, এবারে মানুষের কান্নায় যেন তার ঠান্ডা হয়ে আসা বৃদ্ধ রক্ত রাগে ফুটতে লাগল।
গ্রামের কয়েকজন যুবককে নিয়ে একটা গোপন সভা করল সে। তারা ছাড়া কাকপক্ষীটিও জানতে পারল না। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে পরের অমাবস্যায় সূর্য ডোবার ঘণ্টা দুয়েক পর ঘর থেকে বেরোল বিক্রান্ত। বাইশ বছরের টগবগে তরুণ। আর তাকে নিঃশব্দে বেড়ালের মতো অনুসরণ করল এক দীর্ঘদেহী ব্যক্তি, যে জানতো না, তার ঠিক কয়েক গজ দূরেই লাঠি সোটা, দড়ি নিয়ে ছায়ার মতো হেঁটে আসছে কয়েকজন।
বিক্রান্তকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে পদমকে হাতে-নাতে ধরার এই পরিকল্পনা সফল হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু বিক্রান্তের প্রাণের বিনিময়ে। অমাবস্যার অন্ধকারে শেষ মুহূর্তে শিকারকে নিয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়েছিল পদম। ঝোপ জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খুঁজে যখন তাদের পাওয়া যায়, তখন বিক্রান্তের ছিন্ন হৃদপিণ্ড হাতে নিয়ে তার বুকের গর্তে মুখ ডুবিয়ে আকণ্ঠ রক্তপিপাসা মেটাতে ব্যস্ত পদম। পিঠে ঘাড়ে একের পর এক লাঠির আঘাত এসে পড়তেই বিক্রান্তকে ছেড়ে দিয়ে আকস্মিক আক্রমণকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। কিন্তু এতজনের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। অবশেষে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় তালাব আর পাহাড়ের মধ্যিখানের সেই স্থানে। আট দশটা মশালের আলোয় দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠল অমাবস্যার রাত। একটি গাছের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয় পদমকে। খবর পেয়ে সেই রাতে এসে জুটেছিল শয়ে শয়ে গ্রামবাসী। মশালের আলোয় পদমের রক্তমাখা মুখ ও জান্তব আক্রোশের গর্জন তাদের রক্ত হিম করে দিয়েছিল। গাঁওবুড়ো কাঁসিরামের আদেশে গ্রামবাসীরা মিলে ওখানেই জ্যান্ত কবর দিয়েছিল পদমকে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গর্তে ফেলে যখন মাটি দেওয়া চলছে, তখন নাকি পদম চিৎকার করে বলেছিল যে তার কোনও দোষ নেই। তার ভিতরে পরজীবীর মতো বসবাস করছে একটা পিশাচ। যে উপজাতির সঙ্গে সে চলে গিয়েছিল তাদের বিদ্যা শিখবে বলে, তাদেরই কোনও একজন মাতব্বরের কন্যাকে নিয়ে দল ছাড়তে চেয়েছিল সে। সেই অপরাধে তার আত্মাকে এই পিশাচের কাছে চিরকালের মতো জিম্মা করে দেয় তারা। তাকে হত্যা করলেও এই পিশাচ শেষ হবে না। সময় ও সুযোগ বুঝে সে আবার কব্জা করবে কোনও না কোনও মানবদেহকে আর তার আত্মাকে। পদমের হয়তো আরও কিছু বলার ছিল। কিন্তু এক চাঙড় মাটি তার কথা জীবনের মতো বন্ধ করে দেয়। সেই রাতে ঘরমুখো গ্রামবাসীদের মিছিলের একদম শেষে মাত্র দুটো চোখেই শুধু জল ছিল। পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা তার মতো আর কেই বা জানে?
প্রায় সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে হিমাচল-এর এই অখ্যাত গ্রাম তার এই নিরুচ্চার রহস্য বুকে নিয়ে দৈনন্দিন জীবনযাপন করে এসেছে। আজ আবার এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে, যা মানুষগুলোর মনে সেই সত্তর বছর আগের আতঙ্ক ফিরিয়ে এনেছে। সেই সময়ের মানুষগুলো আজ বেশিরভাগই নেই। যে দু-একজন আছে, তারাও সেই সময় নেহাতই শিশু। তবু মা ঠাকুমার মুখে শোনা কাহিনি যেন তাদের শিরদাঁড়ায় হিমশীতল স্রোত এনে দেয়। একে একে এ যাবৎ পাঁচটি তরতাজা প্রাণ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। সবার মনেই প্রশ্ন, এবার কার পালা? কেউ আলোচনা করে না, তবু সবাই জানে, হয়তো সেই আতঙ্ক আবার ফিরে এসেছে।
বৃদ্ধার এই গল্প আমার মনে কৌতূহল জাগালেও ভয় দেখাতে পারল না। আমার আগের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝেছি যে ভূত প্রেত বা পিশাচের এইসব কাহিনিকে ঢাল করে কুকীর্তি চালিয়ে যায় মানুষই। খুব ইচ্ছে করছিল তালাবের ওপারের পরিত্যক্ত জায়গাটা ঘুরে আসি। দেখে আসি, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে মাটির তলায় শুয়ে থাকা মানুষটার শেষ আর্তনাদ এখনও সেখানকার বাতাসে ভেসে বেড়ায় কিনা। সুনন্দিনী ইতিমধ্যে স্নান সেরে রেডি হয়ে গেছে দেখে ওকে ট্রেক করতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলাম। তুষার ঢাকা সফেদ পাহাড়ের ছায়া বুকে নিয়ে শুয়ে থাকা তালাবের কথা শুনেই ও এককথায় রাজি হয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে বারোটা। এখনই বেরিয়ে পড়লে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ফিরে আসা যাবে। এই তো ২ কিলোমিটার পথ। ফিরে এসে না-হয় লাঞ্চ সারবো।
আমাদের বেরোতে দেখে বৃদ্ধা মালকিন বোধহয় কিছু আঁচ করেছিলেন। আমার দিকে শাসনের দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি সুনন্দিনীকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। এক্ষুনি কেলো করেছিল আর কি! কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। পিছন থেকে ডেকে দাঁড়াতে বললেন বৃদ্ধা। দু-হাতে দুটো তাবিজ জতীয় বস্তু নিয়ে এগিয়ে এলেন। লাল হলুদ সুতোয় গাঁথা ছোটছোট কালো বীজ জাতীয় জিনিস। পরম মমতায় আমাদের হাতে বেঁধে দিলেন। জানলাম, ওটা হল গ্রামের জ্বালামুখী দেবীর মন্দিরের মন্ত্রপূতঃ ধাগা। গ্রামবাসীর বিশ্বাস এই ধাগা হাতে থাকলে কোনও বিপদ ছুঁতে পারে না। ভদ্রমহিলার বিশ্বাসে আঘাত করতে চাইনি। কিন্তু এসব ব্যাপারে আমি বড়ই নাস্তিক। দেবতা বা পিশাচ কোনওটাই আমার ভরসা জিততে পারে না। সুনন্দিনী বেশ ভক্তি ভরে হাতসুদ্ধ ধাগাটা কপালে ঠেকালো দেখে আমার একটু হাসিই পেয়ে গেল। যাই হোক, বেরিয়ে পড়া গেল।
কোনও উচ্চমানের শিল্পীর হাতের মাস্টারপিস যেন হিমাচলের প্রকৃতি। ২ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে লেগে গেল প্রায় চল্লিশ মিনিট। প্রকৃতি যেন তার ভাণ্ডার উপচে দিয়েছে পথের দু’পাশে। হাঁ করে দেখতে দেখতে কখনো হারিয়ে ফেলেছি নিজেদের, কখনো বা ফটো সেশনে সময় কাটালাম। এভাবে কখন যেন পৌঁছে গেলাম তালাবের ধারে। আমি আর সুনন্দিনী দু’জনেই চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। এই সৌন্দর্যের সামনে সাংসারিক চিন্তা, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ‘থোড় বড়ি খাড়া’ রুটিন, বিদ্বেষ, বিবাদ, পাওয়া না-পাওয়া— সবকিছু কেই কেমন অবাস্তব মনে হয়। মনে হয়, আমি চিরকাল এখানেই ছিলাম। এখানেই স্বয়ম্ভূ আমি সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই স্বৰ্গীয় সৌন্দর্যকে নিজের আত্মায় ধারণ করে রেখেছি।
হুঁশ ফিরল সুনন্দিনীর ডাকে। আমার হাত ধরে টেনে ও নিয়ে যেতে চাইছে তালাবের ওই পারে। ও, বলা হয়নি। পথে আসতে আসতেই আমার হাতের ধাগাটা খুলে পকেটে রেখেছি। সুনন্দিনীকেও খুলে ফেলতে বলেছিলাম। কিন্তু ও পরে থাকতে চাইলো বলে আর আপত্তি করিনি। তালাবের পাশ দিয়ে একটা সরু আলপথ ধরনের রাস্তা চলে গেছে ওপারে।
ওপারে পৌঁছে প্রথম একটা জিনিসই অনুভব করলাম। সেটা হল ঠান্ডাটা যেন এক ধাক্কায় বেশ কিছুটা বেড়ে গেল। পাহাড়ের দিক থেকে কনকনে একটা হাওয়া তালাবের ধারে দাঁড়িয়েই টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু এপারে যেন তাপমাত্রা আরও পাঁচ ছ-ডিগ্রি কম। হতে পারে সেটা এপারে পাহাড়ের জন্য রোদ কম পড়ে বলে। খুব একটা মাথা ঘামালাম না ব্যাপারটা নিয়ে। আমার চোখ ছিল মাটির দিকে। এখানে ঠিক কোন্ অংশে সত্তর বছর আগে এক মনুষ্যরূপী পিশাচকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছিল, তা আজ আর জানা সম্ভব নয়।
সুনন্দিনীর অস্ফুট চিৎকার কানে যেতেই ফিরে তাকালাম। ও আমাকে ছেড়ে ডানদিকে চার-পাঁচ ফুট মতো সামনে এগিয়ে গেছে। আমি দৌড়ে সেখানে গেলাম। যে জিনিসটার দিকে ও আঙুল দেখাল, সেটা আমার কপালেও ভাঁজ ফেলল। সেটা একটা ফতুয়া ধরনের জামা। হিমাচলিদের পরনে প্রায়ই দেখা যায়। আর সেটার মধ্যে কালো হয়ে শুকিয়ে আছে যে জিনিসটা, সেটা রক্ত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আমি একটা গাছের শুকনো ডাল জোগাড় করে তার আগায় জামাটাকে তুলে ধরতেই আর একটা জিনিস চোখে পড়ল। সেটা হল জামাটার বুকের কাছে বাঁ দিক ঘেঁসে একটা বেশ বড়ো গর্ত। গর্তটা এমন যেন, ওই জায়গার কাপড় কেউ একটানে উপড়ে নিয়েছে। আমি ওটা ফেলে দিয়ে সুনন্দিনীর হাত ধরে সরিয়ে আনলাম ওখান থেকে। বোঝালাম, নির্জন জায়গা, হয়তো অপরাধীদের আড্ডাখানা। কিন্তু নিজে মনে মনে একটু দমে যাচ্ছিলাম। বৃদ্ধার গল্পের সঙ্গে যেন মিলে যাচ্ছে না? ফিরতে ফিরতেই ঠিক করলাম আবার যাব। কিন্তু এবার আর দিনে নয়, রাতে। সুনন্দিনী ঘুমিয়ে পড়ার পর। রহস্যটা আমাকে জানতেই হবে। –
সেদিন বিকেলে সুনন্দিনী না-চাইলেও ধাগাটা ওর হাত থেকে খুলে ফেলতেই হল। হাতের যেখানে ওটা বাঁধা ছিল, সেখানটা লাল হয়ে কেমন ফোসকা ফোসকা মতো পড়ে গেছে। বীভৎস লাগছে দেখতে। একটু রাতের দিকে বেশ জ্বর এল ওর। সঙ্গে যা ওষুধপত্র ছিল, তাই খাইয়ে শুইয়ে দিলাম। তালাবের ঠান্ডা হাওয়াটা বোধহয় নিতে পারেনি ওর শরীর। একদিন বাদেই ফেরার টিকিট কাটা। তাই একটু চিন্তা হচ্ছিল। ভালোয় ভালোয় ফিরতে পারলে হয়। দুপুরে ওখান থেকে ফিরে অবধি কিছু দাঁতে কাটেনি মেয়েটা। বলল ইচ্ছে করছে না। আর রাতে তো জ্বর এসে গেল।
রাত দশটা নাগাদ সুনন্দিনীর গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরটা একটু কম। সারা দিন শুধু জল খেয়েই রয়েছে ও। খালি বলছে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। জ্বরের উপসর্গ ভেবে খুব একটা মাথা ঘামাইনি। এখন টেবিলের উপর জলের খালি বোতলগুলো দেখে আমার টনক নড়লো। গুনে দেখলাম তেরোটা। এখানে এসেই আমি মিনারেল ওয়াটার এর পেটি কিনে নিয়েছিলাম। দুপুর তিনটে থেকে রাত দশটার মধ্যে সুনন্দিনী তেরো লিটার জল খেয়েছে! ওকে অঘোরে ঘুমোতে দেখে আর বিরক্ত করলাম না। হাতের ফোসকাগুলো আরও বড়ো হয়ে উঠেছে। আমি দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আশা করি ও জাগবে না। তাড়াতাড়ি ফিরবো ভেবেই বেরিয়েছিলাম। আজ ভাবি, শুধু সেই রাতে নয়, দুপুরেও যদি ওখানে না-যেতাম; যদি ওই গ্রামেই না-যেতাম তাহলে জীবনটা হয়তো অন্য খাতে বইতো।
কনকনে ঠান্ডা বাইরে। ভিতরে দুটো সোয়েটার, জ্যাকেট, উলের টুপি, গ্লাভস—কোনও কিছুই যেন যথেষ্ট নয়। রাতে প্রকৃতিও অন্ধকারে ঢাকা। তাই দুপুরের চেয়ে বেশ কিছু কম সময়ই লাগল পৌঁছতে। তালাবের কাছাকাছি যেতেই একটা অদৃশ্য শক্তি যেন আমার পা দুটোকে বেঁধে ফেলতে চাইল। তালাবের উপরে ঘন কুয়াশার জন্য ওপারটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা অস্পষ্ট শব্দ আমার কানে আসছে। শব্দটা একনাগাড়ে একই সময়ের ব্যবধানে হয়ে চলেছে। ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ। আর যদি খুব ভুল না করি, তবে সেটা আসছে তালাবের ওপার থেকে। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে আমার বিপদের সঙ্গী .৩৮ ফাইভ শটারটাকে অনুভব করতেই যেন সাহস ফিরে পেলাম। আমার এই ছোট্ট অস্ত্রটার খবর সুনন্দিনী এখনও জানে না। আলপথের রাস্তাটা বেয়ে ওপারে পৌঁছতেই একটা দৃশ্য আমার মতো ডাকাবুকোকেও স্তব্ধ করে দিল। যেখানে সেই রক্তমাখা জামাটা পড়ে থাকতে দেখেছিলাম দুপুরে, তার পাশাপাশি বেশ কিছুটা জমি যেন লাফাচ্ছে। ভালো করে দেখে বুঝলাম মাটির নীচ থেকে একটা ক্রমাগত আঘাতে সেই অংশটা উপর দিকে ঠেলে ঠেলে উঠছে। স্পষ্ট বুঝলাম, এই সেই জায়গা, যেখানে পদমকে কবর দেওয়া হয়েছিল। একটানা শব্দটাও আসছে মাটির নীচ থেকে। এক পা, এক পা করে পিছিয়ে এসে আশ্রয় নিলাম একটা গাছের পিছনে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। মাটির উপরের অংশে অনেকগুলো ফাটল তৈরি হয়েছে। একসময়ে দেখলাম দুটো হাত মাটির তলা থেকে বেরিয়ে প্রাণপণে মিজের বুকের উপর থেকে মাটি সরাচ্ছে। আস্তে আস্তে পুরো চেহারাটাই উঠে এল মাটির তলা থেকে। সেটাকে চেহারা বলব, না কেবল একটা অবয়ব—বুঝতে পারছি না। লিকলিকে সরু বাঁকাচোরা একটা দেহ; অন্ধকারে খুব ভালো দেখতে না পেলেও বুঝলাম হাত পাগুলো অস্বাভাবিক লম্বা। বেঁকেচুরে চলে ফিরে বেড়াতে লাগল আমার বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে। ঠিক যেন একটা কিলবিলে পোকা মানুষের মতো দুপায়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। মুখ বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু একরাশ অন্ধকারের মধ্যে লাল আগুনের আংরার মতো ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা জিনিস দুটো যে ওটার চোখ, তা বলে দিতে হল না। মাঝে মাঝে একটা জান্তব স্বর বেরোচ্ছে ওটার গলা দিয়ে। বুকের রক্ত জল করে দেওয়া চিৎকারটা শুনে মনে হল, এই কি সেই শব্দ যা সত্তর বছর আগে যাযাবরদের তাঁবু থেকে ভেসে এসে বুক কাঁপিয়ে দিত গ্রামবাসীদের?
বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে হল। এটা তবে পদম নয়। পদমের দেহ হয়তো এতদিনে প্রকৃতির নিয়মেই মাটিতে মিশে গেছে। এ সেই পরজীবী পিশাচ। পদমের দেহে বাস করে নিজের রক্ততৃষ্ণা মেটাতো। আর কোনও এক অজানা কারণে এতদিন বাদে আবার সে জেগে উঠেছে। লোকচক্ষুর আড়ালে কবর থেকে উঠে নিজের পিপাসা মিটিয়ে আবার ঢুকে পড়ে কবরে। তবে তো… তবে তো পিশাচ আবার এক মানবদেহ খুঁজবে। আর আমি এখন এখানে দাঁড়িয়ে। ছুটে পালানোর কথা মাথায় আসলেও নড়তে ভয় করছিল। হঠাৎ দেখলাম পিশাচটা বেঁকেচুরে এগিয়ে আসতে লাগলো আমি যে গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে আছি, সেদিকেই। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। জানি না ও আমাকে দেখেই এদিকে আসছে, না এমনিই। ছুটে পালাতে গেলে আরও বেশি করে নজরে পড়বো। এই বিভীষিকার হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারব, তার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না। হঠাৎ মনে পড়ল জ্যাকেটের পকেটে জ্বালামুখী দেবীর ধাগাটার কথা। কাঁপা কাঁপা হাতে বের করে হাতে পড়লাম ওটা। এটা যে আমি, সেটাই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ধাগার জন্য কিনা জানি না, পিশাচটা থমকে গেল। লাল চোখদুটো যেন বশীভূত করে ফেলছে আমাকে। আর কিছুক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে থাকলে অজ্ঞান হয়ে যাব। হয়তো কাল সকালে আমারও হৃৎপিণ্ড ওপড়ানো রক্তশূন্য লাশ পাওয়া যাবে। এসব ভাবছি একটা ঘোরের মধ্যে। হঠাৎ পিছনে একটা আওয়াজ পেয়ে চমকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।
সুনন্দিনী! ও যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটছে। এভাবেই এতটা পথ এসেছে ও? মাথাটা বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছে। এলোমেলো চুলগুলো মুখের দু’পাশ দিয়ে, ওপর থেকে ঝুলে পড়ে মুখটাকে ঢেকে দিয়েছে। গলা দিয়ে একটা গোঙানির মতো শব্দ। এটা সুনন্দিনীর গলা বলে চিনতে পারছি না আমি। ও এগিয়ে যাচ্ছে খুব ধীরে। ওকে বাধা দেব, সে ক্ষমতা হল না আমার। নিজের স্ত্রীকে ভয় পাচ্ছি আমি। সেই পিশাচটা আবার আকাশ ফাটিয়ে গর্জন করে উঠল। সুনন্দিনী প্ৰায় পৌঁছে গেছে ওর কাছে। গলা চিরে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল আমার, “নন্দিনী…”।
পিশাচটা আমার দিকে সরাসরি তাকালো। আমার কি হল জানি না। কোথা থেকে এত সাহস সঞ্চয় করলাম! গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে ছুটে গেলাম সুনন্দিনীর পাশে। ওকে জড়িয়ে ধরে সরিয়ে আনতে চাইলাম ওখান থেকে। পিশাচ যদি আমার আত্মা চায়, নিক। কিন্তু সুনন্দিনীকে নয়। অথচ একচুল নড়াতে পারলাম না ওকে। পিশাচটা এগিয়ে এসেছে আরও কাছে, আরও কাছে, আরও…।
*****
ঘুম ভাঙল বিছানায়। ভোরের আলো ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে ঢুকছে ঘরে। ভেবে পেলাম না, কীভাবে এখানে এসে পৌঁছলাম। পাশে সুনন্দিনী ঘুমিয়ে। ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর নেই। হাতের ফোসকা গুলোও নেই। অদ্ভুত তো! এখনও ওর মুখ চুলে ঢাকা। আঙুল দিয়ে সরাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। ওর মুখে গালে শুকিয়ে রয়েছে রক্তের দাগ। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। একটা রুমাল ভিজিয়ে আস্তে আস্তে মুছে দিলাম দাগগুলো। সেদিন আরও একটা মৃতদেহ পাওয়া গেল তালাবের পাশে। সেদিনই ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে সুনন্দিনীকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম ওই গ্রাম থেকে।
তারপর থেকে এই তিনমাস ধরে প্রায়ই সুনন্দিনী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় গভীর রাতে। আমি ওর ছটফটানি আর জল খাওয়ার বহর দেখেই বুঝে যাই। আগেই ব্যাগ গুছিয়ে কোথাও যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে পড়ি বাড়ি থেকে। বাইরে থেকে নজর রাখি ওর উপর। ওকে ঠিকঠাক অক্ষত ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তো আমারই। বাড়িতে ফিরে ওর মুখে হাতে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে দিই। সুনন্দিনীর এসব কিছুই মনে থাকে না। তাই অভিমান করে আমার উপর। কলকাতার বাড়ি বিক্রি করে একটু মফস্বলে বাড়ি নিয়েছি। জানি না হয়তো ওর হাতেই কোনওদিন মরতে হবে আমাকে। তবু যতদিন আছি, নিজের কর্মের প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে।