পিতৃ-শ্রাদ্ধ (“কার শ্রাদ্ধ কেবা করে, খোলা কেটে বামন মরে!”)
প্রথম পরিচ্ছেদ
একটি অনুসন্ধান উপলক্ষে একদিবস দিবা দশটার সময় থানা হইতে বহির্গত হইয়া সহরের ভিতর গমন করিয়াছিলাম। সন্ধ্যা সাতটার সময় প্রত্যাগমন করিয়া দেখিলাম, আমার টেবিলের উপর সরকারী খামে বদ্ধ একখানি পত্র রহিয়াছে। উহার শিরোনামায় আমারই নাম লেখা আছে। খামখানি খুলিয়া দেখিলাম যে, উহা আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর নামে প্রেরিত রামপদ নামক এক ব্যক্তির দরখাস্ত। এই আবেদন পত্রের উপরেই তল্লিখিত বিষয় উত্তমরূপে সন্ধান করিবার নিমিত্ত আমারই প্রতি আদেশলিপি লিখিত আছে। আবেদন-পত্রখানি আদ্যোপান্ত উত্তমরূপে পাঠ করিলাম। উহাতে যে সকল কথা লেখা আছে, তাহা নিতান্ত সামান্য অভিযোগের বিষয় নহে।
আবেদনপত্রে রামপদ ঘোষের ঠিকানা লিখিত ছিল। পরদিবস প্রাতঃকালে সেই আবেদন-পত্রখানি সঙ্গে লইয়া আমি রামপদর নিকট গমন করিলাম। রামপদ বাড়ীতেই ছিলেন, তিনি আমার পরিচয় পাইয়া আমাকে লইয়া একটি নির্জ্জন গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। সেইস্থানে আমরা উভয়ে উপবেশন করিলে, আমি রামপদকে তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলাম। শুনিলাম, তাঁহার বাসস্থান পূর্ব্বে পূর্ব্ববঙ্গে ছিল; কিন্তু বাল্যকাল হইতে কলিকাতায় থাকিয়া লেখাপড়া শিক্ষা করেন, এবং এইস্থানেই বিবাহ করিয়া এখন এইস্থানেই বাস করিতেছেন। কেবলমাত্র চারি বৎসর অতীত হইল, তিনি ওকালতি পরীক্ষায় পাস হইয়া ওকালতি করিতেছেন। কিন্তু ভালরূপ প্রতিপত্তি না হওয়ায়, এখনও পর্যন্ত নিজের বাড়ী-ঘর করিতে পারেন নাই। ভাড়াটিয়া বাড়ীতেই বাস করিতেছেন।
তিনি যে সকল বিষয় আবেদন-পত্রে লিখিয়াছেন, তাহার সমস্ত আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করিতে আমি তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম; তিনিও আমার অনুরোধ রক্ষা করিলেন। রামপদবাবু বলিলেন;—
“আমার স্ত্রী আমার শ্বশুরের একমাত্র কন্যা। যে বাড়ীতে আমার শ্বশুর বাস করেন, তাহা তাঁহার হইলে ও তাঁহার নিজের বাড়ী নহে; উহা আমার শাশুড়ির বাড়ী ও যখন আমার শাশুড়ি পরলোক গমন করেন, সেই সময় তিনি তাঁহার সন্তান-সন্ততির মধ্যে কেবলমাত্র আমার স্ত্রীকে অবিবাহিতা অবস্থায় রাখিয়া যান। তাঁহার পরলোকগমনের প্রায় দুই বৎসর পরে আমার বিবাহ হয়, এবং আমার বিবাহের প্রায় এক বৎসর পরে আমার শ্বশুর পুনরায় বিবাহ করেন। বিবাহের পর আমার স্ত্রী প্রায়ই আমার বাসায় থাকিত, এবং আবশ্যক হইলে তাহার পিতার বাড়ীতেও গমন করিত। শ্বশুর মহাশয়ও প্রায়ই আমার বাসায় আসিতেন, আমিও তাঁহার বাড়ীতে গমন করিতাম। এক কথায় আমাদিগের মধ্যে পরস্পরের সহিত কখন মনোবিবাদ ছিল না; অধিকন্তু বিলক্ষণ সম্প্রীতির সহিত কালযাপন করিয়া আসিতেছিলাম।
“উকীল-পাড়ায় হঠাৎ একদিবস আমি কোনরূপে জানিতে পারিলাম যে আমার শ্বশুর মহাশয় তাঁহার ভদ্রাসন বাড়ী অপরের নিকট বিক্রয় করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়াছেন। বাড়ীর বায়নাও হইয়া গিয়াছে, এবং লেখাপড়া করিবার নিমিত্ত দলিল-পত্ৰ সমস্তই উকীলের বাড়ী প্রদত্ত হইয়াছে। আমি আমার স্ত্রীর নিকট হইতে পূর্ব্বে শ্রবণ করিয়াছিলাম যে, যে বাড়ীতে আমার শ্বশুর বাস করেন, সে বাড়ী তাঁহার নহে, আমার শাশুড়ীর। এরূপ অবস্থায় আমার স্ত্রীর বিনা সম্মতিতে তিনি কিরূপে সেই বাড়ী বিক্রয় করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন, তাহা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। সেই দিবস বাসায় আসিয়া সেই কথা আমি আমার স্ত্রীর নিকট কহিলাম। সে এ সম্বন্ধে আরও একটু ভালরূপ অনুসন্ধান করিতে আমাকে উপদেশ প্রদান করিল। আমিও ভাবিলাম যে, যে উকীলের বাড়ীতে সেই বাড়ী-বিক্রয় সম্বন্ধে লেখাপড়া হইতেছে, তাঁহার নিকট গমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেই সমস্ত ব্যাপার অবগত হইতে পারিব। কিন্তু যে দিবস এই পরামর্শ হইল, তাহার পরদিবস রবিবার হওয়ায় সে অনুসন্ধান সেই দিবসের নিমিত্ত স্থগিত রহিল।
“রবিবার সন্ধার সময় শ্বশুর মহাশয় আমাদিগের বাসায় আগমন করিলেন। সেই সময় আমার স্ত্রী কথায় কথায় তাঁহাকে ভদ্রাসন বাড়ী বিক্রয়ের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি এ বিষয়ে কোনরূপ পরিষ্কার উত্তর প্রদান না করিয়া অন্য কথা পাড়িয়া সে কথা উড়াইয়া দিলেন। বাড়ী ফিরিবার পূর্ব্বে আমাকে কহিলেন যে, কোন বিশিষ্ট প্রয়োজনবশতঃ তিনি পরদিবস প্রাতঃকালে আমার স্ত্রীকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া যাইবেন। তাঁহার প্রস্তাবে আমি কোনরূপ আপত্তি করিলাম না, বরং সম্মতই হইলাম। কারণ, এরূপ ঘটনা প্রায়ই ঘটিয়া থাকে। আমার স্ত্রীকে—তিনিও ইচ্ছামত সৰ্ব্বদা তাঁহার বাড়ীতে লইয়া গিয়া থাকেন, আমিও তাঁহার বাড়ী হইতে আমার বাসায় আনয়ন করিয়া থাকি।
“পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমার স্ত্রীকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত আমার শ্বশুর মহাশয়ের বাড়ী হইতে একখানি গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। আমিও কোনরূপ আপত্তি না করিয়া, আমার স্ত্রীকে সেই গাড়িতেই পাঠাইয়া দিলাম। আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, দুই এক দিবস পরেই আমি আমার স্ত্রীকে আনয়ন করিব। দিবা দশটার পর আমি আমার নিয়মিত কার্য্যে বহির্গত হইয়া গেলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী আমাকে যে বিষয়ের নিমিত্ত অনুসন্ধান করিতে কহিয়াছিল, তাহা ভুলিলাম না। যে উকীলের বাড়ীতে বাড়ী বিক্রয়ের দলিলাদি প্রস্তুত হইতেছিল, সেই উকীলের সহিত আমার পরিচয় ছিল। অবসর-মত আমিও একবার তাঁহার নিকট গমন করিলাম, এবং তাঁহাকে সেই বাড়ী বিক্রয় সম্বন্ধে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু তাঁহার নিকট হইতে কোন বিষয়ই অবগত হইতে পারিলাম না। তিনি আমাকে কহিলেন, “তাদ্য দশটার সময় তোমার শ্বশুর আমার নিকট আগমন করিয়াছিলেন। বাড়ী বিক্রয় সম্বন্ধে কোন কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে বা দলিল-পত্র কাহাকেও দেখাইতে, তিনি পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিয়া গিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় কোন কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করা আমার পক্ষে একবারেই অসম্ভব।’
“উকীল মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে আরও কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল! মনে করিলাম যে সেই বাড়ী-বিক্রয়ের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু রহস্য আছে! কিন্তু কি প্রকারে যে সেই রহস্য উদ্ঘাটিত হইবে, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
“সেইদিবস সন্ধ্যার পর আমি আমার শ্বশুরালয়ে গমন করিলাম। আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল যে, আমার স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহাকে সমস্ত অবস্থা বলিব, এবং বিবেচনা-সিদ্ধ হইলে শ্বশুর মহাশয়ের নিকটও এ বিষয় উত্থাপন করিতে পরাঙ্মুখ হইব না। এই ভাবিয়া আমি আমার শ্বশুরের বাড়ীর ভিতর অসঙ্কুচিত মনে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, বাহির বাড়ীর প্রাঙ্গনে শ্বশুর মহাশয় বসিয়া আছেন। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার সময় তিনি আমাকে দেখিতে পাইলেন, ও আমাকে তাঁহার নিকট ডাকিলেন। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁহার নিকট গমন করিয়া উপবেশন করিলাম। প্রথমতঃ তিনি আমার সহিত মিষ্টকথা আরম্ভ করিয়া ক্রমে তাহার পরিবর্তন করিলেন, এবং নিরর্থক আমার সম্বন্ধে কতকগুলি গ্লানির কথা উল্লেখ পূৰ্ব্বক ক্রমে আমার আমার কটুকাটব্য প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। এতদিবস পর্য্যন্ত যে শ্বশুর আমাকে পুত্রবৎ দেখিতেন, এবং আমিও যাঁহার ব্যবহারে সৰ্ব্বদাই সন্তুষ্ট থাকিতাম, তাদ্য তাঁহার ব্যবহার দেখিয়া আমার মনে অতিশয় কষ্ট হইল। তথাপি আমি তাঁহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, আস্তে আস্তে সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া অন্দর মহলের দিকে গমনোদ্যত হইলাম। হইাও অদ্য তাঁহার সহ্য হইল না, তিনি তাঁহার অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিতে আমাকে নিষেধ করিলেন, কহিলেন, তুমি এরূপ কুলাঙ্গার, তাহা আমি ইতিপূৰ্ব্বে কিছুমাত্র অবগত হইতে পারি নাই। তুমি কি চরিত্রের লোক, তাহার বিন্দুবিসর্গও যদি আমি পূর্ব্বে জানিতে পারিতাম, তাহ হইলে তোমার হস্তে আমার কন্যাকে কখনই সমর্পণ করিতাম না। তুমি আমার বাড়ীতে আর কখন আসিও না। আমি যতদিবস বাঁচিব, তাহার মধ্যে তোমার মুখ আমি আর দেখিতে চাহি না।’
“শ্বশুর মহাশয়ের এই প্রকারের কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনেও অতিশয় ক্রোধের উদয় হইল। কিন্তু তাঁহাকে কোন কথা না বলিয়া, আমি তাঁহার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিলাম।
“পরদিবস একখানি পত্র ও একখানি গাড়ী সহিত একজন পরিচারিকাকে, তাঁহার বাড়ী হইতে আমার স্ত্রীকে আনিবার নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম। সমস্ত দিবস পরে পরিচারিকা খালি গাড়ী লইয়া প্রত্যাগমন করিল ও কহিল যে, যখন সে সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হয়, তখন শ্বশুর মহাশয় বাড়ীতে ছিলেন না। পূর্ব্বে সে যেরূপভাবে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিত, এবার কিন্তু সেরূপভাবে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে পায় নাই। শ্বশুর মহাশয়ের আদেশ-মত দ্বারবান্ তাহাকে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দেয় নাই; সুতরাং যে পর্য্যন্ত শ্বশুর প্রত্যাগমন না করিয়াছিলেন, সেই পর্যন্ত তাহাকে বাড়ীর বাহিরে অবস্থিতি করিতে হইয়াছিল। তিনি আসিবামাত্র পরিচারিকা আমার প্রদত্ত পত্র তাঁহার হস্তে অর্পণ করে। তিনি পত্র পাঠ করিয়া অতিশয় ক্রোধভাবে প্রকাশ করেন ও কহেন যে, যতদিবস তিনি বাঁচিবেন, ততদিবস তিনি তাঁহার কন্যাকে পাঠাইয়া দিবেন না। এই কথা শ্রবণ করিয়া পরিচারিকা আমার স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার প্রার্থনা করে। কিন্তু তাহাতেও বিফল মনোরথ হইয়া নিতান্ত মলিন বদনে প্রত্যাগমন করিয়াছে। এইরূপে দাসী আমার নিকট সমস্ত অবস্থা আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করিল।
“শ্বশুরের নিকট এইরূপ ব্যবহার প্রাপ্ত হইয়া আমি আমার স্ত্রীকে উপর্যুপরি যে কত পত্র লিখিয়াছি, তাহা বর্ণনা করিতে পারি না। সে নিজে লেখাপড়া জানে, এবং পত্রাদিও বেশ লিখিতে পারে; কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যবশতই হউক বা অপর কোন কারণবশতই হউক, আমি সেই সকল পত্রের একখানিরও উত্তর প্রাপ্ত হই নাই। এরূপ অবস্থায় আমি যে কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। যে বাড়ী বিক্রয় করিবার নিমিত্ত শ্বশুর মহাশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে আর কোনরূপ অনুসন্ধান করিতে আমার ইচ্ছা হইল না। সেই সময় কি প্রকারে আমি আমার স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারি, তাহারই ভাবনা ভাবিতে ভাবিতে দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলাম, এবং সময় অসময়ে কেবল আমি আমার শ্বশুর মহাশয়ের বাড়ীর চতুষ্পার্শ্বে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। ইচ্ছা যদি কোন প্রকারে একবার আমি আমার স্ত্রীকে দেখিতে পাই। প্রথম প্রথম আমি আমার স্ত্রীকে দেখিতে পাইতাম না; কিন্তু আজকাল তাহাকে প্রায়ই ছাদের উপর বা অপর কোনস্থানে দেখিতে পাই। সময় সময় তাহার দৃষ্টিও আমার উপর পতিত হয়; কিন্তু আশ্চর্য্যের কথা! আমাকে দেখিবামাত্র চকিতের ন্যায় সে স্থানান্তরে প্রস্থান করে। ইদানীং তাহাকে আর দেখিতে পাই না। পূর্ব্বে যখন তাহাকে দেখিতে পাইতাম না, তখন ভাবিতাম যে, বিষয়ের নিমিত্ত পিতা হয়ত কন্যাকে হত্যা করিয়াছেন। কিন্তু যখন আমি আমার স্ত্রীকে দেখিতে পাইলাম, তখন বুঝিলাম, সে অনুমান সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক। আমার স্ত্রীকে দেখিতে পাইয়া, প্রথমে আমার এইরূপ অনুমান হইল যে, আমার স্ত্রীকে তাঁহার বশে আনয়ন করিবার নিমিত্ত আমার সহিত তিনি এইরূপ ব্যবহার করিতেছেন। কারণ, আমার স্ত্রীর নিজ নাম সহি করাইয়া যদি সেই বিষয় বিক্রীত হয়, তাহা হইলে ভবিষ্যতে কাহারও কোনরূপ কথা কহিবার উপায় থাকে না। তখন আরও ভাবিলাম, এইরূপ উপায়ে যখন সেই বাড়ী বিক্রীত হইয়া যাইবে, তাহার কিছুদিবস পরেই তিনি আমার সহিত আর কলহ করিবেন না, এবং আমার স্ত্রীকে আমার নিকট পাঠাইয়া দিবেন। কিন্তু ক্রমে যখন দেখিলাম, সে সময়ও ক্রমে অতিবাহিত হইয়া গেল, তখন অনন্যোপায় হইয়া আমি অপর আর একজন প্রসিদ্ধ উকীলের সহিত পরামর্শ করিলাম। তাহাতে পরিশেষে এই সিদ্ধান্ত হইল যে, যে বাড়ী লইয়া এই প্রকার গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে, এক্ষণে জানা উচিত সেই বাড়ী বিক্রীত হইয়া গিয়াছে, কি না। আর যদি বিক্রীত হইয়া থাকে, তাহা হইলেই বা কিরূপ অবস্থায় ও কাহার দ্বারা সেই বাড়ি বিক্রীত করা হইয়াছে।
“আমাদিগের মধ্যে এই পরামর্শ স্থির হইলে, রেজিষ্টারী আফিসে গিয়া আমি এ বিষয়ের সন্ধান আরম্ভ করিলাম। এই সন্ধানে আমি তিনটি বিষয় অবগত হইলাম—
১ম। বাড়ী বিক্রীত হইয়া গিয়াছে। আমার শ্বশুর মহাশয় তাঁহার নিজের নাম সহি করিয়া সেই বাড়ী বিক্রয় করিয়াছেন।
২য়। বাড়ী বিক্রয় করিবার প্রায় ছয় মাস পূর্ব্বে সেই বাড়ী রামেশ্বর নামক এক ব্যক্তির নিকট হইতে আমার শ্বশুর মহাশয় খরিদ করিয়া লইয়াছেন।
৩য়। আমার শ্বশুর মহাশয়ের সেই বাড়ী ক্রয় করিবার আরও ছয় সাত মাস পূর্ব্বে আমার শাশুড়ী সেই বাড়ী রামেশ্বর নামক এক ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করিয়াছেন। রেজিষ্টারের নিকট একজন উকীল আমার শ্বশুরকে সনাক্ত করিয়াছেন, এবং আমার শ্বশুর তাঁহার পূর্ব্ব স্ত্রী অর্থাৎ আমার শাশুড়ীকে সনাক্ত করিয়াছেন।
“এই সকল বিষয় অবগত হইয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। কারণ, যে তারিখে আমার শ্বাশুড়ী রামেশ্বরের নিকট তাঁহার বাড়ী বিক্রীত করিতেছেন, এবং যে তারিখে আমার শ্বশুর আমার শ্বাশুড়ীকে রেজিষ্টারের নিকট সনাক্ত করিতেছেন, তাহার বহুদিবস পূর্ব্বে আমার শাশুড়ীর মৃত্যু হইয়াছে। যাহা হউক, তাঁহার মৃত্যুর তারিখ জ্ঞাত হইবার মানসে মিউনিসিপাল আফিসে গমন করিলাম। অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, আমার শাশুড়ীর মৃতদেহ নিমতলার ঘাটে পোড়ান হইয়াছিল, এবং আমার শ্বশুর স্বয়ং সেইস্থানে গমন করিয়া রেজিষ্ট্রারের নিকট মৃত্যুসংবাদ লিখাইয়া আসিয়াছিলেন।
“এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিয়া আমি আমার বন্ধু সেই পুরাতন উকীলের সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ করিয়া আনুপূর্ব্বিক সমস্ত কথা তাঁহার নিকট বর্ণন করিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিয়া তিনিও নিতান্ত বিস্মিত হইলেন। পরিশেষে উভয়ে পরামর্শ করিয়া ও পূর্ব্বকথিত সমস্ত কারণ দর্শাইয়া, এই বিষয়ের যাহাতে আদ্যোপান্ত অনুসন্ধান হয়, তাহার নিমিত্ত আপনাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট এক আবেদন করিয়াছি।
“আপনি অনুসন্ধান করিয়া আমার সমস্ত কথা যদি প্রকৃত বলিয়া জানিতে পারেন, তাহা হইলে বলুন দেখি মহাশয়! আমার শ্বশুর ভৈরবচন্দ্র মিত্র কি ভয়ানক কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছেন! প্রথমতঃ তিনি তাঁহার পরলোকগত বনিতার নাম জাল করিবার সম্পূর্ণরূপ সহায়তা করিয়াছেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি একটি স্ত্রীলোকের পরিবর্তে অপর আর একজন স্ত্রীলোককে রেজিষ্টারের নিকট মিথ্যা করিয়া সনাক্ত করিয়াছেন। তৃতীয়তঃ তিনি তাঁহার কন্যাটিকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চনা করিয়া তাহার বিষয় তাপহরণ করিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় বলুন দেখি মহাশয়! এই প্রকার শ্বশুরের নিমিত্ত কোনরূপ দুঃখ করা উচিত কি না?”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রামপদবাবুর নিকট হইতে সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া, সে সময় সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। রামপা আমাকে যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, পরিশেষে আমি নিজে তাহার একবার অনুসন্ধান করিলাম। দেখিলাম যে ভৈরবচন্দ্র মিত্র প্রকৃতই পূর্ব্ববর্ণিতরূপে তাঁহার বাড়ী বিক্রয় করিয়াছেন, এবং তাঁহার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর অনেক পরে তাপর কোন স্ত্রীলোককে তাঁহার প্রথমা স্ত্রী পরিচয় দিয়া রেজিষ্ট্রারের নিকট সনাক্ত করিতেছেন। এ সকল অপরাধ নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে, সুতরাং এ বিষয়ের আনুপূর্ব্বিক অনুসন্ধান আমাকে করিতে হইল, এবং ভৈরবচন্দ্র মিত্রই বা এ সম্বন্ধে কি বলিতে চাহেন, তাহাও আমার জানিবার প্রয়োজন হইল।
পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি একাকী ভৈরববাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম ও কহিলাম, “আপনার উপর একটি গুরুতর অভিযোগ উপস্থিত হইয়াছে।”
ভৈরব। আমার উপর অভিযোগ! কিসের অভিযোগ? কে আনিয়াছে?
আমি। কি অভিযোগ, তাহা পরে বলিতেছি। কে আনিয়াছে, যদি জানিতে চাহেন, তাহা আমি বলিতে প্রস্তুত আছি। এ অভিযোগের সূত্রপাত প্রথমে আপনার জামাতাই করেন; কিন্তু এখন গবর্ণমেন্ট আপনার উপর বাদী হইয়াছেন।
ভৈরব। আমার জামাতা অতিশয় বদলোক। তাহার দ্বারা এ কাৰ্য্য অনায়াসেই হইতে পারে। তাহার নিতান্ত অসদ্ব্যবহারে আমি বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হইয়া কিছুদিবস হইতে তাহার স্ত্রীকে তাহার বাড়ীতে পাঠাই নাই, এবং তাহাকেও আমার বাড়ীতে প্রবেশ করিতে দেই নাই। এরূপ অবস্থায় তাহার দ্বারা আমার নামে মিথ্যা মোকদ্দমার সূত্রপাত হওয়া অসম্ভব নহে। আমার উপর সে যেরূপ অভিযোগই আনুক না কেন, আমি কিন্তু সহজে তাহার স্ত্রীকে পাঠাইয়া দিতেছি না, ইহা নিশ্চয়।
আমি। আপনি তাহার স্ত্রীকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেন নাই বলিয়া, সে আপনার নামে কোনরূপ অভিযোগ আনয়ন করে নাই। সে যে অভিযোগ আনিয়াছে, তাহা অতিশয় গুরুতর।
ভৈরব। সে কি অভিযোগ আনিয়াছে?
আমি। তাহার অভিযোগ এই যে, আপনি অন্যায় করিয়া তাহার স্ত্রীর বিষয় বিক্রয় করিয়াছেন।
ভৈরব। তাহার স্ত্রীর বিষয় হইল কি প্রকারে? আমার নিজের বিষয় আমি নিজে বিক্রয় করিয়াছি। আর যদি আমার কন্যারই বিষয় হয়, তাহা হইলেই বা তাহার কি? সে আপত্তি করিবার কে? ইহাতে যদি কাহারও আপত্তি থাকে, তাহা আমার কন্যার। কিন্তু এ বিষয়ে সে কোনরূপ আপত্তি করিতেছে না। আর এ বিষয়ে যখন তাহার কোনরূপ অধিকার নাই, তখন সেই বা আপত্তি করিবে কেন? আর যদি কেহ মিথ্যা করিয়া আমার উপর বিষয় বিক্রয় সম্বন্ধীয় কোনরূপ অভিযোগ উপস্থিত করে, তাহা হইলে তাহার নিমিত্ত দেওয়ানী আদালত বর্তমান আছে। ইহার নিমিত্ত পুলিসের অনুসন্ধান কিরূপে হইতে পারে, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
আমি। আমি পুলিস-কর্মচারী হইয়া এ বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত কেন যে আপনার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহা এখনই আপনাকে বুঝাইয়া দিতেছি। আপনার উপর প্রধান অভিযোগ এই যে, আপনি আপনার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর বহুদিবস পরে আপনার সেই স্ত্রী এখন বর্তমান আছেন বলিয়া, রেজিষ্ট্রারের নিকট আপনি তাহাকে সনাক্ত করিতেছেন। অন্যান্য অপরাধ থাকিলেও এই অপরাধের জন্য আপনি প্রধানতঃ অপরাধী এবং সেই অপরাধের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি আগমন করিয়াছি।
ভৈরব। কে বলিল,—আমার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমার সেই স্ত্রী বর্তমান আছে বলিয়া আমি রেজিষ্ট্রারের সম্মুখে সনাক্ত করিয়াছি?
আমি। একথা কাহারও বলিবার প্রয়োজন হয় নাই, অনুসন্ধানে সমস্ত বাহির হইয়া পড়িয়াছে।
ভৈরব। এ মিথ্যা কথা।
আমি। মিথ্যা হইলে আপনার পক্ষেই মঙ্গল। আপনার মনে হয় কি, যে দিবস আপনার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু হয়, সেইদিবস তাহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করিবার নিমিত্ত আপনি নিমতলার ঘাটে গমন করিয়াছিলেন?
ভৈরব। ঠিক মনে পড়ে না, বোধ হয় গিয়াছিলাম।
আমি। আপনি মনে করেন যে, সেই স্থানের রেজিষ্টারী পুস্তক প্রভৃতি থাকিতেও কি আমরা আপনার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর তারিখ স্থির করিতে পারিব না? তাঁহার মৃত্যুর অনেক পরে যে আপনি রেজিষ্ট্রারের সম্মুখে তাঁহাকে সনাক্ত করিতেছেন।
ভৈরব। পূর্ব্বে কি পরে, সে বিষয়ের আলোচনা আমি করিতে চাহি না। আবশ্যক হইলে পরে দেখা যাইবে।
আমি। আপনার প্রথমা স্ত্রী বর্ত্তমান থাকিতে যে সকল চাকর চাকরাণী আপনার বাড়ীতে কর্ম করিত, তাহার মধ্যে কোন ব্যক্তি এখনও আপনার নিকট নিযুক্ত আছে কি?
ভৈরব। সেই সময়ের কোন ব্যক্তিই এখন আমার নিকট নাই, এবং কে কোথায় আছে, তাহাও আমি অবগত নহি।
আমি। আমি আপনাকে আর একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হইবেন না। কারণ, আমাদিগের এ সকল কথা জিজ্ঞাসা না করিলে চলে না। তাই বলি, আপনার বাড়ীতে এখন কয়জন স্ত্রীলোক বাস করেন?
ভৈরব। দুইজন।
আমি। কে কে? আপনার দ্বিতীয় পক্ষের বনিতা, এবং প্রথম পক্ষের কন্যা বোধ হয়?
ভৈরব। হাঁ।
আমি। পরিচারিকা কয়জন আছে।
ভৈরব। একজনও নহে। পরিচারক দ্বারাই সকল কার্য্য নির্ব্বাহ হয়।
আমি। আপনার কন্যাকে আমি দেখিতে চাহি না; কিন্তু তাঁহাকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন আছে। তাহা কিরূপে সম্পন্ন হইতে পারে?
ভৈরব। আমা দ্বারা সে কার্য্য হইতে পারে। আপনার যাহা যাহা জিজ্ঞাস্য আছে, তাহা আমাকে বলিলে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার প্রতি-উত্তর আপনাকে প্রদান করিতে পারি।
আমি। আপনার সম্মুখে জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে বটে; কিন্তু কন্যাকে আপনি জিজ্ঞাসা না করিয়া অপর কাহারও দ্বারা জিজ্ঞাসা করাইলে ভাল হয়।
ভৈরব। আমার বাড়ীতে সেরূপ ব্যক্তি অপর আর কেহই নাই।
আমি। আপনার জামাতাকে ডাকাইয়া তাহার দ্বারা এই সামান্য কার্য্যটুকু করাইয়া লইলে হয় না কি?
ভৈরব। মহাশয়! আপনার সকল কথা আমি শ্রবণ করিব; কিন্তু সেই নরাধমের নাম আমার সম্মুখে গ্রহণ করিবেন না। আমি যতদিবস জীবিত থাকিব, তাহার মধ্যে সেই কুলাঙ্গারকে আমি কখনও আমার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দিব না।
আমাদিগের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় হঠাৎ একটি স্ত্রীলোক সেই বাটীর অন্তঃপুরের মধ্য হইতে একবারে আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং ভৈরববাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “বাবু! আপনি একবার বাড়ীর ভিতর আগমন করুন। কর্ত্রীঠাকুরাণী আপনাকে ডাকিতেছেন।” এই বলিয়া সে পুনরায় অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিল।
আমি। মহাশয় এ স্ত্রীলোকটি কে?
ভৈরব। জনৈক পরিচারিকা।
আমি। ইতিপূৰ্ব্বে মহাশয় বলিলেন না যে, আপনার বাড়ীতে পরিচারিকা নাই?
ভৈরব। ইতিপূর্ব্বেও বলিয়াছি, এখনও বলিতেছি, আমার বাড়ীতে পরিচারিকামাত্রই নাই। ওই স্ত্রীলোকটি অপর কোন বাড়ীর পরিচারিকা, কোন কার্য্যবশতঃ বোধ হয় আমার বাড়ীতে আগমন করিয়াছিল।
আমি। উহাদ্বারা আপনার কন্যাকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিলে চলে না কি?
ভৈরব। হইতে পারিত, কিন্তু আর হইবার উপায় নাই, সে এতক্ষণ চলিয়া গিয়াছে।
ভৈরবচন্দ্রের কথা শ্রবণ করিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, তাহার ইচ্ছা নহে যে, অপর কাহারও দ্বারা তাহার কন্যাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা হয়। সুতরাং সে সম্বন্ধে আমি তাহাকে আর কোন কথা না বলিয়া, সেইস্থানেই বসিয়া রহিলাম, ভৈরবচন্দ্র অন্তঃপুরের ভিতর গমন করিলেন। সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া আমি ভাবিতে লাগিলাম, এই স্ত্রীলোকটি আমার নিকট উত্তমরূপে পরিচিত বলিয়া বোধ হইতেছে; কিন্তু ও কে, এবং কোথায়ই আমার সহিত উহার পরিচয়, তাহা ঠিক মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এইরূপ কিয়ৎক্ষণ ভাবিবার পর হঠাৎ আমার মনে হইল,—কি আশ্চর্য্য! আমি এতক্ষণ ইহাকে চিনিতে পারি নাই, এ যে ‘অলকা!’ সেই সময় ইহাও আমার মনে হইল, অলকা যখন আমাকে দেখিয়াছে, তখন সেও নিশ্চয় আমাকে চিনিয়াছে। এরূপ অবস্থায় আমি যে উহার পরিচিত, একথা ভৈরববাবুর নিকট প্রকাশ করা হইবে না। আমি মনে মনে এই প্রকার ভাবিতেছি, এমন সময় অলকা পুনরায় চকিতের ন্যায় আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, “আপনি এখানে কেন?”
আমি। তুমি কি এখন এই বাড়ীতে থাক?
অলকা। হাঁ।
আমি। আমি যে কেন এখানে আসিয়াছি, সে কথা আমি তোমাকে পরে বলিব। কিন্তু তুমি যে আমার পরিচিত, একথা ভৈরববাবু যেন জানিতে না পারেন। আরও যদি পার, এক দিবসের জন্য ছুটি লইয়া তোমার বাসায় যাইও, সেইস্থানে আমি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিব।
অলকা। আগামী রবিবার আমি ছুটি লইয়া বাসায় যাইব। সেইদিবস আপনি আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। আমিও মনে করিতেছিলাম, আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।
অলকার এই কথা শ্রবণ করিয়া এবং তাহার বাসার ঠিকানা জানিয়া লইয়া তাহাকে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিতে কহিলাম। সেও অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অলকার জন্মস্থান কোথায় জানি না, কিন্তু সে আমার নিকট পরিচিতা। তাহার বাসা কোথায়, তাহাও পূর্ব্বে জানিতাম না; কিন্তু শ্রবণ করিয়াছিলাম যে, বহুবাজারের নিকটবর্তী কোনস্থানে সে অবস্থিতি করিত। ইতিপূর্ব্বে প্রায়ই তাহাকে রাস্তায় কি বাজারে দেখিতে পাইতাম। বহুপূর্ব্বে অর্থাৎ পুলিস বিভাগে প্রবিষ্ট হইবারও পূর্ব্বে যখন দশজনের সহিত একত্র বাস করিয়া আমি এই কলিকাতায় থাকিতাম, সেই সময় অলকা আমাদিগের বাসায় পরিচারিকার কৰ্ম্ম করিত। সেই বাসায় আমাকে অনেক দিবস থাকিতে হয়, তালকাও সেই স্থানে অনেক দিবস অতিবাহিত করে। সুতরাং তাহার নিকট আমিও যেরূপ পরিচিত, আমার নিকটেও সে সেইরূপ পরিচিত। যে সময়ে আমি পুলিস বিভাগে কৰ্ম্ম করিতে নিযুক্ত হই, সেই সময় হইতে আমাকে সেই বাসা পরিত্যাগ করিতে হয়। কিন্তু অলকা সে সময় পর্যন্তও সেই বাসায় নিযুক্ত থাকে, এবং আমি যে পুলিস বিভাগে কৰ্ম্ম করিতেছি, তাহাও সে জানিতে পারে। এই ভালকার পূৰ্ব্ব পরিচয়।
তালকা দেখিতে বিলক্ষণ সুন্দরী না হইলেও একবারে কুরূপা ছিল না, এবং এখন তাহার বয়স কিছু অধিক হইলেও সেরূপ অনুমান করা অপরের পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে। এখনও তাহাকে দূর হইতে দেখিলে প্রৌঢ়া অথবা যুবতী বলিয়া ভ্রম হয়।
অলকার বাসার ঠিকানা আমি পূৰ্ব্ব হইতে জানিতাম না। কিন্তু তাহার নিকট হইতে জানিতে পারিয়া সন্ধান করিয়া তাহার বাসা প্রাপ্ত হইলাম, এবং সেইদিবস হইতে প্রত্যহ তাহার বাসায় গমন করিয়া দেখিতে লাগিলাম। তালকা তাহার বাসায় আগমন করিয়াছে কি না। এইরূপে কয়েক দিবস গত হইলে রবিবারের প্রাতঃকালেই অলকা তাহার বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। যে সময় সে তাহার বাসায় আগমন করিয়াছিল, ঠিক সেই সময়ে আমি তাহার বাসায় উপস্থিত না থাকিলেও তাহার আগমনের কিয়ৎক্ষণ পরেই আমি তাহার বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সে আমাকে দেখিয়া সবিশেষ যত্নের সহিত আমাকে সেইস্থানে বসিতে দিল।
কিছুক্ষণ পরে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভৈরববাবুর বাড়ীতে যে দিবস তুমি আমাকে দেখিতে পাও, সেইদিবস দেখিবামাত্রই কি তুমি আমাকে চিনিতে পারিয়াছিলে?”
অলকা। সে কি মহাশয়! আপনাকে আর চিনিতে পারিব না? যেমন আপনাকে দেখিলাম, অমনি চিনিতে পারিলাম। কিন্তু আপনার সহিত আমার চেনা শুনা আছে, পাছে এই কথা ভৈরববাবু জানিতে পারেন, এই ভয়ে সেইস্থান হইতে শীঘ্র প্রস্থান করিয়াছিলাম।
আমি। তুমি ভৈরববাবুর নিকট কতদিবস হইতে পরিচিত।
অলকা। যে সময় হইতে আমি তাঁহার আশ্রয়ে আছি, সেই সময় হইতে আমি তাঁহার নিকট পরিচিত।
আমি। বহুবাজার হইতে ভৈরববাবুর বাড়ী নিতান্ত সামান্য দূর নহে। এরূপ অবস্থায় তুমি সেইস্থানে গিয়া কিরূপে উপস্থিত হইলে, এবং কিরূপেই বা সেইস্থানে চাকরির সংস্থান করিলে?
অলকা। ভৈরববাবুর বাড়ীতে আমার গমন, সেইস্থানে চাকরির যোগাড়, এবং যেরূপ কাজ কর্ম্মের ভার আমার উপর অর্পিত আছে, তাহা অতিশয় আশ্চর্য্যের বিষয়! ইহাই বলিব বলিয়া, এবং সেইস্থানে আমার কর্ম করা উচিত কি না, তাহারই পরামর্শ লইব বলিয়া, আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর আপনিই আপনাকে আনাইয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া দিলেন।
আমি কিরূপ অবস্থায় ভৈরববাবুর বাড়ীতে তুমি কৰ্ম্ম পাইয়াছ, কিরূপ কৰ্ম্ম তোমাকে নির্ব্বাহ করিতে হয়, এবং সেই বাড়ীর অবস্থাই বা কিরূপ, তাহা যতদূর বর্ণনা করিতে পার, সবিস্তারে আমার নিকট বর্ণন কর। তাহার পর আরও কোন বিষয়ে যদি আমার জিজ্ঞাস্য থাকে, তাহা পরিশেষে আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া লইব।
অলকা। আচ্ছা মহাশয়! আমার যতদূর মনে আছে, আপনার নিকট একে একে বর্ণন করিতেছি, আপনি মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করুন। ভৈরববাবুর কর্ম্মে নিযুক্ত হইবার প্রায় দশদিবস পূর্ব্বে একদিবস দিবা আন্দাজ দশটার আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইয়া বহুবাজারে বাজার করিতে গিয়াছিলাম। বাজার করিয়া যখন আমি আমার বাসায় প্রত্যাগমন করিতেছিলাম, সেই সময় দেখিলাম, একখানি গাড়ী আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিতেছে। পশ্চাৎ পশ্চাৎ গাড়ী আসিতে দেখিয়া আমার মনে ভয় হইল যে, পাছে আমি সেই গাড়ি ব নিম্নে পড়িয়া যাই। এই ভাবিয়া আমি রাস্তার একপার্শ্বে স্থিরভাবে দাঁড়াইলাম। ইচ্ছা—গাড়ীখানি চলিয়া গেলে আমি সেইস্থান হইতে গমন করিব। আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, দেখিলাম, তাহা ঘটিল না। সেই গাড়িখানি চলিয়া না গিয়া আমার সঙ্গে সঙ্গে সেইস্থানে দাঁড়াইল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি পুনরায় চলিলাম, গাড়ীও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। আবার দাঁড়াইলাম, গাড়ীও দাঁড়াইল। এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহের উদয় হইল। মনে করিলাম যে, গাড়ী গমনাগমনের রাস্তা পরিত্যাগ করিয়া সম্মুখে যে কোন ক্ষুদ্র গলি দেখিতে পাইব, তাহারই ভিতর প্রবেশ করিব। এই ভাবিয়া আমি পুনরায় চলিতে আরম্ভ করিলাম, গাড়ীও পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। অতি অল্পদূর গমন করিয়াই দেখিলাম, আমার বামপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র গলি আছে, সেই গলির ভিতর গাড়ী প্রবেশের কোন উপায় নাই। সেই গলির এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমার মনে অতিশয় সাহসের উদয় হইল, এবং আমি সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিতে উদ্যত হইলাম। সেই সময় সেই গাড়ীর মধ্যস্থিত একটি বাবু আমাকে ডাকিলেন। এই বাবুটি যে কে, তাহা আমি সেই সময় জানিতাম না। কিন্তু তাহার পরেই জানিতে পারিয়াছিলাম, ইনিই আমার সেই বর্তমান মনিব—ভৈরববাবু। ভৈরববাবু আমাকে ডাকিতেছেন দেখিয়া, সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিতে আর আমার সাহস হইল না। আমি নিতাত্ত কম্পিত দেহে তাঁহার নিকটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তিনি আমাকে দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি?” তাঁহার কথার উত্তরে আমি আমার নাম বলিলাম, তখন তিনি পুনরায় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি কার্য্য করিয়া তুমি জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া থাক?’ তাহার উত্তরে আমি কহিলাম, ‘আজীবন দাস্যবৃত্তি করিয়াই আমি আমার জীবন যাপন করিয়া আসিতেছি। এখন একটি বাবুর বাড়ীতে দুই টাকা বেতনে কর্ম্ম করিয়া থাকি।’ আমার কথা শ্রবণ করিয়া ভৈরববাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন ভদ্রলোকের বাড়ীতে যদি তুমি ইহার দ্বিগুণ বেতন প্রাপ্ত হও তাহা হইলে তুমি সেইস্থানে কর্ম্ম করিতে প্রস্তুত আছ, কি না?’
‘উত্তরে আমি কহিলাম, আমার ন্যায় দরিদ্র স্ত্রীলোক কোন ভদ্রলোকের বাড়ীতে অধিক বেতনের চাকরি পাইলে না করিবেই বা কেন?’ আমার সহিত দুই চারিটি এই প্রকার কথাবার্তা হইবার পর ভৈরববাবু আমার বাসার ঠিকানা জানিয়া লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং যাইবার সময় বলিয়া গেলেন যে, দুই তিন দিবসের মধ্যে তিনি আমার নিকট আগমন করিবেন।
“ক্রমে দুই তিন দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, ভৈরববাবু আমার নিকটে আর আগমন করিলেন না। আমি ভাবিলাম যে, হয় ভৈরববাবু বড়লোক, তিনি আমার কথা বিস্মৃত হইয়াছেন। নতুবা তিনি জুয়াচোর, কোনরূপ জুয়াচুরি করিবার আশায় আমার নাম ও ঠিকানা জানিয়া লইয়া গিয়াছেন। পঞ্চম দিবসের প্রত্যূষে আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইয়া কার্য্য করিবার নিমিত্ত যখন মনিবের বাড়ীতে গমন করিতেছিলাম, সেই সময় দেখিলাম যে, একটি লোক আমার অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি নিমিত্ত আমার অনুসন্ধান করিতেছ? উত্তরে সে কহিল, ‘বড়রাস্তার উপর গাড়িতে একটি বাবু বসিয়া আছেন, তিনি তোমাকে দেখিতে চান বলিয়া আমি তোমার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছিলাম। সেই লোকটির মুখে এই অবস্থা জানিতে পারিয়া, সেই বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ বড়রাস্তায় গমন করিলাম। দেখিলাম, ভৈরব বাবু তাঁহার গাড়ীর ভিতর বসিয়া আছেন। আরও দেখিলাম, তখন তিনি একাকী নহেন, সেই গাড়ীর ভিতর তাঁহার সহিত একটি স্ত্রীলোকও বসিয়া আছেন। তখন আমি জানিতাম না যে, সেই স্ত্রীলোকটি কে? কিন্তু আমার চাকরি হইবার পরেই জানিতে পারিয়াছিলাম যে, ইনিই আমাদিগের মনিবের দ্বিতীয় পক্ষের পত্নী ও সংসারের একমাত্র কর্ত্রীঠাকুরাণী। “আমি গাড়ীর নিকটে গমন করিলে উভয়েই অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত আমাকে এক দৃষ্টিতে দেখিলেন। তখন কর্ত্রীঠাকুরাণী আমাকে কহিলেন, ‘যদি তুমি আমাদিগের বাড়ীতে চাকরি করিতে প্রবৃত্ত হও, তাহা হইলে দেখিবে
তোমাকে অতি অল্প কাৰ্য্যই সম্পন্ন করিতে হইবে, অথচ বর্তমান মনিবের নিকট তুমি এক্ষণে যে বেতন পাইতেছ, আমি তাহার দ্বিগুণ বেতন প্রদান করিব, এবং আবশ্যক হইলে ক্রমে তোমার বেতন আরও বৃদ্ধি করিয়া দিব।’ কর্ত্রীঠাকুরাণীর কথা শ্রবণ করিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘বহুবাজার হইতে আপনাদিগের বাটী কতদূর?’ তাঁহাদিগের কথায় জানিতে পারিলাম, তাঁহাদিগের বাসস্থান বহুবাজার হইতে দুই মাইলের ন্যূন হইবে না।
“আমি কলিকাতায় আসা পর্যন্ত বহুবাজার অঞ্চলে বাস করিতেছি, এবং সেইস্থান হইতে নিকটবর্তী কোন না কোনস্থানে দাস্যবৃত্তি করিয়া জীবন ধারণ করিয়া আসিতেছি; সুতরাং সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিতে আমার আন্তরিক ইচ্ছা হইল না। কিন্তু বেতনের প্রলোভনটা মধ্যে মধ্যে হৃদয়ে জাগিতে লাগিল। আমি আমার মনের প্রকৃত ভাব তাঁহাদের নিকট প্রকাশ না করিয়া কহিলাম, আপাততঃ আমি এক মনিবের নিকট কর্ম্ম করিতেছি, তাঁহার বিনা-অনুমতিতে তাঁহার কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া আপনাদিগের সহিত গমন করিতে কখনই সম্মত হইতে পারিব না। আমি আমার মনিবকে জিজ্ঞাসা করিব, যদি তিনি অনুমতি দেন বা আমার বেতন আরও কিছু বৃদ্ধি করিয়া না দেন, তাহা হইলে দুই চারি দিবসের মধ্যে আমি তাঁহার কর্ম্ম পরিত্যাগ করিব। এইরূপ অবস্থায় যদি আমি তাঁহার কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া আপনার কর্ম্মে নিযুক্ত হই, তাহা হইলে অপর কেহ আমার উপর কোনরূপ দোষারোপ করিতে পারিবে না। তখন আমি আপনার কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া অনায়াসে আপনার আদেশ প্রতিপালন করিতে সমর্থ হইব।’
“আমার কথা শ্রবণ করিয়া ভৈরববাবুও তাঁহার পত্নী কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। পরে বাবু আমাকে কহিলেন, তোমার প্রস্তাব নিতান্ত অযুক্তি-সঙ্গত নহে। তুমি তোমার মনিবের আদেশ লইয়া প্ৰস্তুত হইয়া থাকিও। আগামী রবিবারে আমি নিজে আসিয়া তোমাকে এ স্থান হইতে আমার বাড়ীতে লইয়া যাইব।’ এই বলিয়া ভৈরববাবু তাঁহার পত্নীর সহিত সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। আমিও আমার বাসায় আগমন করিলাম। আমার বর্ত্তমান মনিবের আদেশানুযায়ী হউক, বা বেতন বৃদ্ধি না করিয়া দিবার ছল অবলম্বন করিয়াই হউক, আমি তাঁহার কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া ভৈরববাবুর কর্ম্মে নিযুক্ত হইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়া থাকিব,—ইহা ভৈরববাবুর নিকট আমি এক প্রকার প্রতিশ্রুত হইয়া আসিয়াছিলাম। কিন্তু সেই রাত্রিতে এই বিষয় সম্বন্ধীয় একটু ভাবনা আসিয়া আমার হৃদয় অধিকার করিল। মনে হইল যে, ভৈরববাবু আমাকে তাঁহার কর্মে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত সপরিবারে এত লোলুপ হইয়াছেন কেন? যে সহরে পরিচারিকার অভাব নাই, দুই টাকা বেতনে যে স্থানে শত শত পরিচারিকা পাওয়া যাইতে পারে, সেইস্থানে দ্বিগুণ বেতন দিয়া আমাকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত তিনি এত ব্যস্ত হইয়াছেন কেন? যদি কোন অভিসন্ধির বশীভূত হইয়া আমাকে তাঁহার বাটীতে লইয়া যাইবার নিমিত্ত ব্যস্ত হইতেন, তাহা হইলে তিনি তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের পত্নীকে সঙ্গে লইয়া কখনই আমার নিকট আগমন করিতেন না। এরূপ অবস্থায় সামান্য অর্থের লোভে এরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত হওয়া আমার পক্ষে কর্তব্য কি না? আবার মনে হইল,—যে অর্থের লোভে স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া বিদেশে আসিয়া দাস্যবৃত্তি করিতেছি এরূপ সুযোগ পাইয়া সে অর্থ পরিত্যাগ করিই বা কেন। আমার বর্তমান মনিবকে সকল কথা স্পষ্ট করিয়া বলার বা প্রয়োজন কি? বা বর্তমান কাৰ্য্য পরিত্যাগ করিবার বা আবশ্যক কি? যে উপায় অবলম্বন করিয়া আমরা মনিববর্গকে চিরদিন প্রতারিত করিয়া থাকি, সেই পুরানো পন্থাই অবলম্বন করি না কেন। আমার দেশ হইতে সংবাদ আসিয়াছে, আমার মাতা অথবা কোন আত্মীয় সঙ্কটাপন্ন রোগে আক্রান্ত হইয়া শয্যাগত আছেন; এই কথা বলিয়া অথবা এইরূপে অপর কোন মিথ্যা কথা দ্বারা মনিবকে প্রতারিত করিয়া এক মাসের ছুটি লই না কেন, তাহা হইলে আমাকে বর্তমান চাকরি পরিত্যাগ করিতে হইবে না। এই একমাস কাল আমি ভৈরববাবুর কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া তাঁহার ইচ্ছানুযায়ী তাঁহার সমস্ত কার্য্য সম্পন্ন করিতে পারিব। যদি কোন সুবিধা বুঝিতে পারি, তাহা হইলে এই একমাস পরেও তাঁহারই কর্ম্ম করিব। আর যদি অসুবিধা বিবেচনা হয়, তাহা হইলে যে মনিবের নিকট হইতে দেশে যাইবার ভান করিয়া এক মাসের ছুটি লইব মনে করিতেছি, তাঁহার নিকট আগমন করিয়া পূর্ব্বের ন্যায় আপন কার্য্যে নিযুক্ত হইব। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ভৈরববাবুর কার্যে নিযুক্ত হওয়াই পরিশেষে সাব্যস্ত করিলাম। মিথ্যা কথা বলিয়া মনিবের নিকট হইতে এক মাসের বিদায় প্রাপ্ত হইলাম। রবিবারে সপত্নীক ভৈরব বাবু তাঁহার কথামত আমার এই ক্ষুদ্র বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কহিলেন, ‘চল, এখন আমাদিগের সহিত চল।’ ‘আমি দ্বিরুক্তিমাত্র না করিয়া তাঁহাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। তাঁহারাও আমাকে তাঁহাদিগের গাড়িতে উঠাইয়া লইয়া তাঁহাদিগের বাড়ীতে লইয়া গেলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ভৈরববাবুর বাড়ী কত বড়, এবং বাড়ীর অবস্থাই বা কি প্রকার, তাহার কিয়দংশ আপনি স্বচক্ষেই দেখিয়া আসিয়াছেন। অন্দরমহল বেশ বড়, এবং উহাতে অনেকগুলি গৃহ আছে। কিন্তু তাহার অধিকাংশেরই ব্যবহার হয় না, সেই গৃহগুলি তালাবদ্ধই রহিয়াছে। পরিবারের মধ্যে বাবু ও তাঁহার পত্নী-ভিন্ন আর কেহই নাই, সুতরাং এতগুলি গৃহ কে ব্যবহার করিবে?
আমি। কেন, বাবুর কন্যাও ত এখন সেই বাটিতে বাস করিতেছেন?
অলকা। কৈ মহাশয়! আমি যে পর্য্যন্ত সেই বাটীতে কর্ম করিতেছি, তাহার মধ্যে বাবুর কন্যাকে কখনও আমি দেখি নাই।
আমি। যেরূপে তোমার চাকরি হইল, তাহা ত আমি শুনিলাম। কিন্তু চাকরি হইবার পর কিরূপ অবস্থায় তুমি ভৈরববাবুর বাটীতে কর্ম্ম করিতেছ, তাহারই আনুপূর্ব্বিক বৃত্তান্ত আমার নিকট বর্ণন কর।
অলকা। তাহাই ত বলিতেছিলাম। যে দিবস ভৈরববাবু ও তাঁহার পত্নী কর্তৃক আমি গৃহীত হইলাম, সেই দিবস হইতে আমি ভৈরববাবুর কর্ম্মে নিযুক্ত হইলাম। চারি টাকা বেতনে ভৈরববাবুর বাড়ীতে আমার কর্ম্ম হইল সত্য; কিন্তু কি কার্য্যের নিমিত্ত যে আমি নিযুক্ত হইলাম, তাহা এখন পর্য্যন্তও বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। আমি নূতন মনিবের বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইবামাত্রই প্রভু-পত্নী একখানি উত্তম বস্তু আনিয়া আমাকে প্রদান করিলেন, কহিলেন, ‘তুমি মনে করিও না যে, তুমি আমার বাড়ীতে দাস্যবৃত্তি করিতে আগমন করিয়াছ। এখানে তোমাকে দাস্যবৃত্তি করিতে হইবে না। তুমি বয়স্যার ন্যায় সর্ব্বদা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকিবে, এবং আমার সহিত বাক্যালাপ করিয়া দিন যাপন করিবে মাত্র। কারণ, এই নির্জ্জন পুরীর ভিতরে স্ত্রীলোকের মধ্যে কেবলমাত্র আমি একাকিনী। সমস্ত দিবসের মধ্যে কাহারও সহিত যে দুইটি কথা কহিয়া মনকে সন্তুষ্ট করিব, এরূপ আর কেহই নাই। এই নিমিত্তই তোমাকে এখানে আনিয়াছি, এবং আশা করি,—তুমি আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবে। আজ হইতে তোমাকে আর মলিন বস্ত্র পরিধান করিতে হইবে না। তুমি তোমার পরিধেয় মলিন বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া, আপাততঃ আমার প্রদত্ত এই বস্ত্র পরিধান কর। পশ্চাৎ আর যত বস্ত্রের প্রয়োজন হইবে, তাহা আমি তোমাকে প্রদান করিব।’
“বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া বাস্তবিক আমি দেখিলাম, দ্বারবান ও অপর দুইটি পরিচারক ভিন্ন আর কেহই নাই। সুতরাং কর্ত্রীঠাকুরাণীর কথা বিশ্বাস হইল। তখন আমি আমার পরিধেয় মলিন বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার প্রদত্ত বস্ত্র পরিধান করিলাম। কর্ত্রীঠাকুরাণী আমাকে যে প্রকার বলিয়াছিলেন, কার্য্যেও আমি ঠিক সেই প্রকার দেখিলাম। সমস্ত রাত্রি ও দিবসের মধ্যে আমাকে কোন কার্য্যই করিতে হয় না। যে পর্য্যন্ত ভৈরববাবু অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ না করেন, সেই পর্য্যন্ত আমাকে কর্ত্রীঠাকুরাণীর সঙ্গে সঙ্গে থাকিতে হয় মাত্র। ভৈরববাবু যে গৃহে শয়ন করেন, তাহার নিকটবর্তী একটি গৃহ আমার থাকিবার নিমিত্ত নিৰ্দ্দিষ্ট আছে। কি দিবাভাগে, কি রাত্রিকালে, যে সময় বাবু অন্তঃপুরের ভিতর অবস্থিতি করেন, সেই সময় আমার সেই নির্দ্দিষ্ট গৃহের মধ্যে আমাকে অবস্থান করিতে হয়। আমি যে গৃহে শয়ন করি, তাহা অন্তঃপুরের ভিতর হইলেও অন্দর মহলের সহিত ইহার কোনরূপ সংস্রব নাই, এবং অন্দর মহলে কি হইতেছে, তাহাও আমার গৃহ হইতে দেখিবার উপায় নাই।
“প্রত্যহ সন্ধ্যার পূর্ব্বে কর্ত্রীঠাকুরাণী বায়ুসেবন করিবার নিমিত্ত ছাদের উপর উঠিয়া থাকেন, আমাকেও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছাদের উপর উঠিতে হয়। সেই ছাদের উপর উচ্চ প্রাচীর না থাকায়, চতুষ্পার্শ্বস্থিত নিকটবর্তী দ্রব্যাদি ও পথ সকল উত্তমরূপে দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। একদিবস সেই ছাদের উপর আমরা উভয়ে বেড়াইতেছি, এমন সময় দেখিতে পাইলাম, একটি যুবাপুরুষ আমার মনিবের বাটীর সম্মুখস্থিত পথের উপর দাঁড়াইয়া আমাদিগকে দর্শন করিতেছে। প্রথম দিবস যখন আমি ইহাকে দেখিলাম, তখন আমার মন সেই দিকে সবিশেষরূপে আকৃষ্ট হইল না। দ্বিতীয় দিবসও ঠিক সেই সময় তাহাকে সেইস্থানে দেখিলাম। তৃতীয় দিবসও দেখিলাম, সে সেইস্থানে দাঁড়াইয়া আছে। এইরূপে আমরা প্রত্যহই তাহাকে সেইস্থানে দেখিতে লাগিলাম। আরও দেখিতে লাগিলাম যে, আমরা যতক্ষণ পর্য্যন্ত সেই ছাদের উপর ভ্রমণ করি, সেও ততক্ষণ পৰ্য্যন্ত সেইস্থানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কেবল আমাদিগকে এক দৃষ্টি দেখিতে থাকে। উহার এই প্রকার অবস্থা দেখিয়া আমার মনে প্রথমে কর্ত্রীঠাকুরাণীর কোনরূপ পরিচিত ব্যক্তি বলিয়া সন্দেহ হয়। কিন্তু দুই চারি দিবস উহার গতি-বিধির প্রতি উত্তমরূপ লক্ষ্য রাখিয়া জানিতে পারিলাম যে, উহার দৃষ্টি কেবল আমারই উপর। কি নিমিত্ত যে সেই ব্যক্তি আমার উপর কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছিল, তাহা কিছুমাত্র অবগত হইতে না পারিয়া, একদিবস আমি সেই যুবাপুরুষকে দেখাইয়া দিয়া কর্ত্রীঠাকুরাণীকে কহিলাম, এ ব্যক্তি সৰ্ব্বদা ঐ স্থানে দাঁড়াইয়া আমাদিগের গতিবিধি লক্ষ্য করেন কেন? আমার কথা শ্রবণ করিয়া কর্ত্রীঠাকুরাণী কহিলেন, ‘এই ব্যক্তিকে আমিও কয়েকবার লক্ষ্য করিয়াছি ও দেখিয়াছি যে, প্রায় সর্ব্বদাই ও ঐ স্থানেই দণ্ডায়মান হইয়া কেবল আমাদিগের উপরই দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া থাকে। ইহার এরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি মনে করিয়াছিলাম যে, এ ব্যক্তি তোমার পরিচিত। তাই তোমাকে দেখিবার নিমিত্ত ঐ স্থানে দণ্ডায়মান হইয়া থাকে। কিন্তু তোমার কথা অনুযায়ী আমার বোধ হইতেছে যে, এ ব্যক্তি তোমার পরিচিত নহে। এরূপ অবস্থায় সহজেই বলা যাইতে পারে যে, ঐ ব্যক্তির অভিসন্ধি ভাল নহে। তাহার মনে কোন প্রকার কু-অভিসন্ধি আছে বলিয়াই অনুমান হয়। সে যাহা হউক, যখন দেখিতেছি, উহার লক্ষ্য কেবল তোমারই উপর, তখন তুমি হস্তদ্বারা ইঙ্গিত করিয়া উহাকে এইস্থান হইতে চলিয়া যাইতে বলিয়া দাও। তখন হয় ত বুঝিতে পারিবে যে, যাহার উপর উহার লক্ষ্য, সেই যখন তাহাকে চলিয়া যাইতে বলিতেছে, তখন নিশ্চয়ই সে তাহার অভিলাষী নহে। এরূপ অবস্থায় হয়ত ভগ্ন-মনোরথ হইয়া এইস্থান হইতে প্রস্থান করিতে পারে।’
“যে পুরুষের নিকট আমি কখনও পরিচিত নহি, ইঙ্গিত দ্বারা তাহাকে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিতে বলা আমার মতে যুক্তিবিরুদ্ধ হইলেও, কর্ত্রীঠাকুরাণীর আদেশ আমাকে প্রতিপালন করিতে হইল। আমিও হস্তদ্বারা ইঙ্গিত করিয়া তাহাকে কহিলাম যে, তুমি এইস্থান হইতে প্রস্থান কর। দেখিলাম, সেও আমার ইঙ্গিত মানিল, এবং তৎক্ষণাৎ সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে চলিয়া গেল। এই ঘটনার পর দুই এক দিবস আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। কিন্তু পরিশেষে তাহাকে পুনরায় সেইস্থানে দেখিলাম, কর্ত্রীঠাকুরাণীর আদেশানুযায়ী পুনরায় তাহাকে ইঙ্গিত করিলাম; পুনরায় সে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। এইরূপে আরও কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। কিন্তু এই ইঙ্গিতের অর্থ আমি কিছুতেই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, এবং আজ পর্য্যন্তও বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। যাহা হউক, আজ কয়েক দিবস পর্য্যন্ত সেই অপরিচিত পুরুষকে সেইস্থানে দেখিতে পাইতেছি না। এরূপ অবস্থায় বলুন দেখি মহাশয়! মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হইতে পারে কি না? আর সেই সন্দেহ ভঞ্জন করিবার নিমিত্তই আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম।
আমি। তোমার মনের সন্দেহ তুমি ত সহজেই ভঞ্জন করিতে পারিতে?
অলকা। কি প্রকারে আমার মনের সন্দেহ দূর হইত?
আমি। সেই অপরিচিত যুবাপুরুষ যে সময় তোমার মনিবের বাটীর সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান থাকিত, সেই সময় বাহিরে আসিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই ত সকল কথা জানিতে পারিতে?
অলকা। সে চেষ্টাও আমি করিয়াছিলাম; কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারি নাই। সাধ্যমত চেষ্টা করিয়াও কোন প্রকারে একবার বাড়ীর বাহিরে গমন করিতে সমর্থ হই নাই। কারণ, আমার উপর ভৈরববাবুর আদেশ আছে যে, তাঁহার বিনা অনুমতিতে আমি তাঁহার বাড়ীর বাহিরে গমন করিতে পারিব না। দ্বারবানের উপর আদেশ আছে কোনরূপেই সে আমাকে বাড়ীর বাহিরে গমন করিতে দিবে না। এরূপ অবস্থায় বলুন দেখি মহাশয়! সে কার্য্য সামান্য হইলেই বা আমাদ্বারা কিরূপে সম্পন্ন হইতে পারে?
আমি। তুমি যাহা সম্পন্ন করিতে পার নাই, তাহা আমি সম্পন্ন করিয়া দিব। এখন তোমার মনে সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, সে সন্দেহ আমি দূর করিব। এখন তুমি ভৈরববাবুর বাটীর অবস্থা যেরূপ আমার নিকট বর্ণন করিতেছ, আরও যতদূর তুমি অবগত আছ, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ আমার নিকট সেইরূপ বর্ণন কর। তোমার নিকট সমস্ত বিষয় উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিলে, এ রহস্য উদ্ঘাটনের পন্থা অতি সহজ হইয়া পড়িবে।
অলকা। আমি যতদূর মনে করিতে পারিয়াছি, তাহা আপনার নিকট বলিয়াছি। কেবল একটিমাত্র বিষয় অবশিষ্ট আছে, তাহা আমি বলিতেছি শ্রবণ করুন। পূর্ব্বে আমি আপনাকে বলিয়াছি যে, অন্দর মহলে যে সকল গৃহ আছে, তাঁহার অধিকাংশই তালাবদ্ধ, এবং সেই সকল গৃহের চাবি বাবু নিজের নিকটেই সর্ব্বদা রাখিয়া থাকেন। সেই সকল গৃহ কখনই খোলা হয় না, বা পরিষ্কার করাও হয় না। একদিবস আমি বাবুকে কহিলাম, তান্দর মহলের কতকগুলি গৃহ আমি আসিয়া পৰ্য্যন্তই তালাবদ্ধ দেখিতেছি। উহার ভিতর যে সকল দ্রব্যাদি আছে, তাহা নিশ্চয়ই নষ্ট হইয়া যাইতেছে। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি সেই সকল গৃহের তালা একবার খুলিয়া দেন, তাহা হইলে আমি গৃহগুলি পরিষ্কার এবং তন্মধ্যস্থ দ্রব্যগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারি।’ উত্তরে বাবু কহিলেন, ‘তালাবদ্ধ গৃহগুলি সমস্তই খালি অবস্থায় পড়িয়া আছে, উহার ভিতর দ্রব্যাদি কিছুই নাই। সুতরাং ওদিকে লক্ষ্য করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।’ এই বলিয়া বাবু অন্য কথা উঠাইলেন। বুঝিলাম,—আমার প্রস্তাব তাঁহার ভাল লাগিল না।
“এই সময় আর একটি বিষয়ের উপর আমার দৃষ্টি পতিত হইল। ভৈরববাবু ও তাঁহার পত্নী দিবাভাগে ও রাত্রিকালে আমার সম্মুখে আহারাদি করিতেন। তাঁহারা দুইজন এবং আমি ভিন্ন অন্তঃপুরের মধ্যে অপর আর কোন লোক না থাকিলেও রাত্রিকালে পাচক-ব্রাহ্মণ একখানি থালায় করিয়া অতি অল্প পরিমাণ অন্ন, কিঞ্চিৎ ব্যঞ্জন ও এক ঘটা পানীয় জল বাবুর গৃহে রাখিয়া যাইত। প্রত্যহ কাহার অন্ন রাখিয়া যায়, একথা একদিবস আমি পাচক-ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, কিন্তু সে সন্তোষজনক কোন প্রকার উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইল না। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল। যে থালে করিয়া ব্রাহ্মণ প্রত্যহ অন্ন রাখিয়া যাইত, আমি সেই থালার উপর লক্ষ্য রাখিলাম। প্রাতঃকালে সেই থাল দেখিতে পাইতাম না, তাহার পরিবর্তে অন্নব্যঞ্জনশূন্য অপর থাল দেখিতে পাইতাম, অর্থাৎ আজ যে থালে অন্ন আসিত, কাল আর সেই থাল দেখিতে পাইতাম না। কিন্তু পরশ্ব দিবস পুনরায় সেই থাল দেখিতে পাইতাম। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল।
“ভৈরববাবু ও তাঁহার পত্নী রাত্রিকালে আহারাদি করিয়া শয়ন করিবার পর সামান্য অন্নব্যঞ্জন লইয়া পুনরায় কি করেন, জানিবার নিমিত্ত আমার অতিশয় কৌতূহল জন্মিল। যে দিবস আমার মনে এইরূপ কৌতূহল আসিয়া উপস্থিত হইল, সেইদিবস রাত্রিতে আমি আমার গৃহে গিয়া নিয়মিতরূপে শয়ন করিলাম; কিন্তু অপর দিবসের ন্যায় নিদ্রিত না হইয়া জাগিয়া রহিলাম। যখন দেখিলাম ভৈরববাবু তাঁহার শয়ন গৃহে আগমন করিয়া দ্বার প্রভৃতি বন্ধ করিয়া দিলেন। সেই সময় আস্তে আস্তে আমার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া ভৈরববাবুর গৃহের সন্নিকটে একটি জানালার অন্তরালে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। জানালাটি পুরাতন হওয়ায় উহার স্থানে স্থানে অল্প অল্প ফাঁক হইয়া পড়িয়াছিল। আমি সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া সেই জানালার ফাঁক দিয়া ভৈরববাবুর গৃহের ভিতর কি হয় না হয়, তাহাই দেখিতে লাগিলাম। ভৈরববাবুর গৃহের ভিতর একটি আলো জ্বলিতেছিল; সুতরাং বাহির হইতে সেই গৃহের ভিতর আমার দৃষ্টি উত্তমরূপ পড়িতে লাগিল।
“প্রথমতঃ দেখিলাম, তাঁহারা উভয়ে পালঙ্কের উপর শয়ন করিয়া নানারূপ গল্পগুজব করিতে লাগিলেন। ক্রমে রাত্রি অধিক হইতে লাগিল; তথাপি তাঁহারা নিদ্রিত হইলেন না। যখন বুঝিলেন, রাত্রি নিতান্ত অধিক হইয়াছে, এবং ভূত্যাদি সকলে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়াছে, সেই সময় উভয়েই আস্তে আস্তে গাত্রোত্থান করিয়া পালঙ্ক হইতে অবতরণ করিলেন। ভৈরববাবু তাঁহার পিরানের পকেট হইতে একগোছা চাবি বাহির করিয়া এক হস্তে গ্রহণ করিলেন, এবং অপর হস্তে তাঁহার গৃহের প্রজ্বলিত প্রদীপটি লইয়া সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইলেন। কর্ত্রীঠাকুরাণী পাচক ব্রাহ্মণের রক্ষিত সেই সামান্য অন্ন সহিত থালখানি এক হস্তে গ্রহণ করিলেন, এবং অপর হস্তে এক ঘটী জল লইয়া উভয়েই অন্দর মহল অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। ইহার পর যে আর কি ঘটিল, তাহা আর আমি দেখিতে পাইলাম না; কিন্তু পরক্ষণে উভয়েই পুনরায় আপন গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। বাবুর হস্তে সেই প্রজ্বলিত প্রদীপ, কিন্তু গৃহিণীর হস্তে অন্নশূন্য একখানি থাল ও জলশূন্য সেই ঘটী। তাঁহারা সেই সকল দ্রব্যাদি যথাস্থানে রাখিয়া পুনরায় শয়ন করিলেন, এবং দেখিতে দেখিতে ক্রমে উভয়েই নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। আমিও সেইস্থান হইতে উঠিয়া আপন গৃহে গিয়া শয়ন করিলাম। শয়ন করিলাম সত্য; কিন্তু নিদ্রা হইল না। নানারূপ চিন্তায় সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। এইরূপে উপর্যুপরি দুই তিন রাত্রি সেই জানালার পার্শ্বে বসিয়া উঁহাদিগের সেই একরূপ কার্য্য দেখিতে লাগিলাম; কিন্তু অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না।
“গভীর রাত্রিকালে কাহাকে ইঁহারা সামান্য অন্ন ও জল প্রদান করেন, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমার মনে অতিশয় কৌতূহল জন্মিল; কিন্তু সেই কৌতূহল নিবারণের সুযোগ কোনরূপেই প্রাপ্ত হইলাম না। আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইবার দুই এক দিবস পূর্ব্বে একদিবস দিবাভাগে ভৈরববাবু তাঁহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। সেই সময় আমি ও কর্ত্রীঠাকুরাণী সেই গৃহে বসিয়াছিলাম। তাঁহার অবস্থা দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, কোন বিশিষ্ট আবশ্যকীয় কার্য্যোপলক্ষে তাঁহাকে তখনই বাহিরে যাইতে হইবে। তিনি শীঘ্র শীঘ্র পরিহিত বস্ত্রাদি পরিত্যাগ করিয়া অপর বস্ত্র পরিধান করিলেন, এবং দ্রুতপদে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া নিজকাৰ্য্যে গমন করিলেন। আমি তাঁহার পরিত্যক্ত বস্ত্রাদি উঠাইয়া লইয়া যথাস্থানে রাখিয়া দিলাম। সেই সময় দেখিলাম, ভৈরববাবুর পরিত্যক্ত পিরানের পকেটে কতকগুলি চাবি রহিয়াছে; বুঝিলাম, ভ্রমক্রমে ভৈরববাবু চাবিগুলি ফেলিয়া গিয়াছেন। আমিও কর্ত্রীঠাকুরাণীকে কিছু না বলিয়া, চাবি-সমেত পিরানটি উঠাইয়া একস্থানে রাখিয়া দিলাম।
“দিবাভাগে কর্ত্রীঠাকুরাণীর নিদ্রা যাওয়া অভ্যাস ছিল। তাঁহার নিকট যাওয়া পর্য্যন্ত ক্রমে আমারও সেইরূপ অভ্যাস হইয়াছিল। ভৈরববাবু বাহিরে গমন করিবার পর, নিয়মিত সময়ে কর্ত্রীঠাকুরাণী শয়ন করিলেন, আমি তাঁহার নিকট বসিয়া তাঁহার সেবা করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, ক্রমে তিনি ও নিদ্রিতা হইয়া পড়িলেন। এরূপ সুযোগ আমার আর ঘটিবে না বিবেচনা করিয়া, ভৈরববাবুর পরিত্যক্ত ঢাবিগুলি লইয়া আমার কৌতূহল নিবারণ করিবার মানসে সেই গৃহ হইতে ধীরে ধীরে বহির্গত হইয়া, অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। যে কয়েকটি গৃহ তালাবদ্ধ ছিল, তখন একটি একটি করিয়া সেই গৃহগুলি খুলিয়া দেখিলাম। প্রথম গৃহটির ভিতর দেখিলাম, দ্রব্যাদি কিছুই নাই। দ্বিতীয় গৃহটি কতকগুলি পুরাতন তৈজসপত্রে পূর্ণ। তৃতীয় গৃহটি খুলিয়া তাহার ভিতর যে দৃশ্য দেখিলাম, তাহাতে আমার মনে নিতান্ত ভয়ের সঞ্চার হইল। দেখিলাম, সেই গৃহের একপার্শ্বে একটি স্ত্রীলোক শুইয়া রহিয়াছে। সেই স্ত্রীলোকটি জীবিত, কি মৃত, তাহা দেখিতে আমার সাহস হইল না। কিন্তু দেখিলাম, তাহার নিকটে একখানি থাল ও একটি ঘটি রহিয়াছে মাত্র। এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি এমন বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না যে, সেই মূৰ্ত্তি প্রকৃতই জীবন্ত কোন স্ত্রীলোকের, বা কোন শবের, অথবা কোন প্রেতযোনি স্ত্রীলোকের মূর্তি ধারণ করিয়া সেইস্থানে শুইয়া রহিয়াছে।
“এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে একরূপ ভয়-বিস্ময়ের উদয় হইল। আমি সেইস্থানে আর ক্ষণমাত্রও দাঁড়াইতে পারিলাম না। সেই গৃহ তালাবদ্ধ করিয়া কম্পিতকলেবরে আমি সেইস্থান হইতে দ্রুতপদে প্রস্থান করিলাম, এবং যে স্থান হইতে আমি চাবিগুলি অপহরণ করিয়াছিলাম, সেই স্থানে উহা রাখিয়া দিয়া আমার গৃহে গিয়া শয়ন করিলাম। সেইদিবস হইতে আমার মনে যে কিরূপ ভয়ের উদয় হইতেছে, তাহা আমি বলিতে পারি না। সেইদিবস হইতে আমি মনে মনে স্থির করিয়াছি যে, যে বাটীতে ভূত প্রেতের বাসস্থান, সেই বাটীতে আমি আর থাকিব না, বা অধিক বেতন পাইলেও আমি আর এরূপ স্থানে কর্ম করিব না। সেইদিবস হইতেই কিরূপে আমি সেই বাটী পরিত্যাগ করিতে পারিব, তাহারই সুযোগ অনুসন্ধান করিতেছিলাম, কিন্তু পলায়নের কোনরূপ উপায় করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। আজ কত মিথ্যা কথা বলিয়া মনিবের নিকট হইতে কেবলমাত্র তিন ঘণ্টার ছুটি পাইয়াছি সত্য; তথাপি তিনি আমাকে একাকী বাহিরে আসিতে দেন নাই। বাবু নিজে তাঁহার গাড়িতে করিয়া আমাকে এইস্থানে রাখিয়া গিয়াছেন। তিনঘণ্টা পরে পুনরায় তিনি আসিয়া আমাকে লইয়া যাইবেন। কিন্তু মহাশয়! আমার ইচ্ছা যে, আমি সে বাটীতে আর গমন করিব না; এখনই এ স্থান হইতে স্থানান্তরে গিয়া লুকাইয়া থাকিব। বাবু অনুসন্ধান করিয়া আমাকে না পাইয়া কাজেই প্রত্যাগমন করিবেন।”
আমি। অলকা! তুমি এমন কার্য্য করিও না, তোমার মনিব তোমাকে লইতে আসিলে তুমি অকুতোভয়ে তাঁহার সহিত গমন করিও। কিন্তু আমার সহিত তোমার যে সকল কথাবার্তা হইল, তাহা যেন তিনি ঘূণাক্ষরেও জানিতে না পারেন। এমন কি, তোমার সহিত আমার যে সাক্ষাৎ হইল, বা তুমি আমার নিকট পরিচিত, ইহাও যেন তাঁহার কর্ণগোচর না হয়। তোমাক আর অধিক দিবস সেইস্থানে থাকিতে হইবে না। তুমি আমাকে যে সকল কথা বলিলে, সেই সকল বিষয়ের রহস্য উদ্ঘাটন করিতে বোধ হয়, দুই এক দিবস মাত্র লাগিবে। তাহার পর তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিতে পারিবে। তখন কেহই তোমার গতির প্রতিরোধ করিবে না।
আমার কথা শ্রবণ করিয়া অলকা তাহার মনিবের সহিত পুনরায় সেইস্থানে গমন করিতে সম্মত হইল। আমিও সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া আপনার বাসায় আসিয়া উপনীত হইলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি ভৈরববাবুর বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। এবার আর আমি একাকী সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম না; কয়েকজন প্রহরী ও আরও দুইজন কর্ম্মচারী সঙ্গে লইয়া ভৈরববাবুর সদর বাড়ীতে গমন করিলাম। বাবু বাড়ীতেই ছিলেন। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে, এবার তাঁহাকে স্পষ্টই কহিলাম, আপনি যে অপরাধে অভিযুক্ত, সেই অপরাধের নিমিত্ত আপনার নামে গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে, এবং আপনাকে ধরিবার নিমিত্তই আজ আমরা আপনার বাড়ীতে আগমন করিয়াছি। তদ্ব্যতীত যে মূল্যে আপনি এই বাড়ী বিক্রয় করিয়াছেন, সেই টাকা এখন আমাদিগের হস্তে অর্পণ করুন। নতুবা বাধ্য হইয়া সেই টাকার নিমিত্ত আপনার বাড়ী সন্ধান করিতে হইবে। আমার কথা শ্রবণ করিয়া ভৈরববাবু একবারেই স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন ও কহিলেন, “বিনা অপরাধে আপনারা আমাকে একে ধৃত করিলেন, তাহার উপর আবার আমার বসতি বাটীর ভিতর খানা-তল্লাসি করিয়া আরও আমাকে অপমানিত করিবেন কেন? যদি আমি এই বাড়ী বিক্রয় করিয়াই থাকি, তাহা হইলে বিক্রয়-লব্ধ সেই টাকা কি এখন পর্যন্ত আমার নিকট থাকিবার সম্ভাবনা?
কেবল টাকার নিমিত্ত ভৈরববাবুর বাড়ী খানা-তল্লাসি করা আমার আন্তরিক উদ্দেশ্য ছিল না। আমার প্রধান উদ্দেশ্য অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তালাবদ্ধ গৃহগুলি একবার উত্তমরূপে দেখিব। দেখিব—অলকা যাহা বলিয়াছিল, তাহা প্রকৃত, কি না। তখন ভৈরববাবুকে আর কোন কথা না বলিয়া, তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার অনিচ্ছা থাকিলেও তাঁহার অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। অলকা যে গৃহে প্রেতমূৰ্ত্তি দেখিয়াছে বলিয়াছিল, প্রথমে আমরা সেই দিকে গমন করিলাম। যে সকল গৃহ তালাবদ্ধ ছিল, তাহার চাবি প্রদান করিবার নিমিত্ত ভৈরববাবুকে অনুরোধ করিলাম। ভৈরববাবু চাবি প্রদান না করিযা কহিলেন, “এ সকল গৃহ দেখিবার প্রয়োজন নাই; কারণ বহুদিবস হইতে এ সকল আবদ্ধ আছে, উহাদের চাবি নাই।”
ভৈরববাবুর কথা শ্রবণ করিয়া বুঝিলাম যে, তিনি মিথ্যা কথা বলিতেছেন। তখন অনন্যোপায় হইয়া সেই গৃহের তালা সকল ক্রমে ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম। প্রথম গৃহ অলকা যেরূপ বলিয়াছিল, সেইরূপ শূন্য অবস্থাতেই ছিল। দ্বিতীয় গৃহ কতকগুলি পুরাতন অপরিষ্কৃত তৈজসপত্র দ্বারা পূর্ণ আছে। ইহার পর তৃতীয় গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, অলকার কথা প্রকৃত সেই গৃহের একপ্রান্তে মৃত্তিকার উপর একটি স্ত্রীলোক অর্দ্ধ-অচেতন অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার চলিবার শক্তি নাই, বা ভাল করিয়া কথা কহিবারও ক্ষমতা নাই। আমরা সেই গৃহের ভিতর যখন প্রবেশ করিলাম, তখন সে কিছুমাত্র বুঝিতে পারিল কি না, জানি না। কিন্তু যখন তাহাকে ডাকিলাম, তখন সে চক্ষু উন্মীলিত করিয়া আমাদিগকে দেখিল, পরন্তু কিছুই বলিল না; কেবলমাত্র তাহার চক্ষু দিয়া জলধারা বহিতে লাগল। যে সময় আমরা সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম, ভৈরববাবুও আমাদিগের সঙ্গে ছিলেন। সেই স্ত্রীলোকটি কে, এবং এরূপ অবস্থাতে গৃহের ভিতর আবদ্ধই বা কেন? এই কথা ভৈরববাবুকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি কোন কথারই উত্তর প্রদান না করিয়া স্থিরভাবে সেইস্থানে দণ্ডায়মান রহিলেন। তখন আমি সেই স্ত্রীলোকটির নিকট গমন করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কে? তোমার নাম কি, এবং কি নিমিত্তই বা এরূপ অবস্থায় এইস্থানে অবস্থিতি করিতেছ?” আমার কথা শ্রবণ করিয়া সেই স্ত্রীলোকটি অতি মৃদুস্বরে কহিল, “আমার নাম প্রমাদিনী।” পূর্ব্বে আমি প্রমাদিনীর নাম শ্রবণ করিয়াছিলাম। রামপদবাবু আমাকে বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার স্ত্রীর নাম প্রমাদিনী। সেই কথা আমার হঠাৎ মনে হইল। আমি তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তবে কি তুমি রামপদবাবুর বনিতা, ও ভৈরববাবুর কন্যা?” উত্তরে তিনি কহিলেন, “হাঁ।” এই কথা শ্রবণ করিয়া প্রমাদিনীকে তখন আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। একখানি পাল্কী ডাকাইয়া সেইস্থান হইতে তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ রামপদবাবুর বাটীতে পাঠাইয়া দিলাম। বলিয়া পাঠাইলাম, “রামপদবাবু! এখন ইঁহার উত্তমরূপে শুশ্রূষা করুন। সময়-মত আমি সেইস্থানে গমন করিয়া উভয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিব এবং বিবেচনায় যাহা কৰ্ত্তব্য হয়, তাহা স্থির করিব।”
এই ঘটনার পর আমি ভৈরববাবুর বাড়ী পরিত্যাগ করিলাম। কিন্তু আবদ্ধ অবস্থায় ভৈরববাবুকে সঙ্গে লইয়া যাইলাম।
রামপদবাবু তাঁহার স্ত্রীকে পাইয়া যে কতদূর সন্তুষ্ট হইলেন, তাহা আর বলিতে পারি না। কিন্তু তাঁহার স্ত্রী এইরূপ অবস্থা দেখিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলেন, এবং সাধ্যমত তিনি তাঁহার স্ত্রীর চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা করাইতে লাগিলেন। যে দিবস আমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল, সেইদিবস তিনি আমাকে কহিলেন, “আমি আমার স্ত্রীকে প্রায় প্রত্যহই দর্শন করিয়াছি। ইনি যে হঠাৎ এরূপ অবস্থাপন্ন হইয়াছেন, তাহার কিছুই আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।”
আমি। ভৈরববাবুর বাটীর ভিতর আপনি যখন প্রবেশ করিতে পারিতেন না, তখন আপনি কি প্রকারে প্রত্যহই আপনার স্ত্রীকে দর্শন করিতে সমর্থ হইতেন?
রামপদ। যখন আমি দেখিলাম, ভৈরববাবু কোনরূপে আমাকে তাঁহার বাটীর ভিতর প্রবেশ করিতে দিলেন না, বা আমার স্ত্রীকেও আমার বাটীতে পাঠাইয়া দিলেন না; তখন আমার মন ক্রমে নিতান্ত অস্থির হইতে লাগিল। আমি অনন্যোপায় হইয়া কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, সর্ব্বদা ভৈরববাবুর বাটীর সন্নিকটেই ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। ইচ্ছা—যদি কোন প্রকারে আমি আমার স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারি। প্রথম প্রথম কিছুদিবস আমার মনোরথ পূর্ণ হইল না। কিন্তু পরিশেষে একদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমি দেখিলাম যে, দুইটি স্ত্রীলোক ভৈরব বাবুর ছাদের উপর ভ্রমণ করিতেছে। প্রথমে মনে করিয়াছিলাম যে, উহারা আমার বিমাতৃশাশুড়ী ও আমার স্ত্রী; কিন্তু এখন বুঝিয়াছি যে, অলকাকেই আকার-সৌসাদৃশ্যে স্ত্রী বলিয়া আমার ভ্রম হইয়াছিল।
এইরূপ বলিয়া রামপদবাবু অলকা-বর্ণিত সমস্ত ব্যাপার বর্ণনা করিল।
পূর্ব্বে আমি অলকার নিকট যে সকল ব্যাপার শ্রবণ করিয়াছিলাম, এবং এখন রামপদবাবুর নিকট হইতে যাহা জানিতে পারিলাম, তাহাতে বুঝিলাম, ভৈরববাবুর কি ভয়ানক ষড়যন্ত্র! কিন্তু আমার মনের কথা সেই সময় কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া, রামপদবাবুকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলাম,এবং প্রমাদিনীর নিকট গমন করিয়া কিরূপে তাঁহার এইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম। আমা কর্তৃক প্রমাদিনীর এই ভয়ানক বিপদ হইতে উদ্ধার হইয়াছে। আমি তাঁহাকে ভৈরববাবুর বাটী হইতে রামপদবাবুর বাটীতে আনয়ন করিয়াছি, এবং আমা-কর্তৃক রামপদবাবু সবিশেষরূপে উপকৃতও হইয়াছেন। এই সকল কারণে অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলে আমার সহিত প্রমাদিনী কথা কহিতে কিছুমাত্র লজ্জিত হইল না; প্রমাদিনী ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, “ যে দিবস পিতা আমাকে তাঁহার বাটীতে লইয়া গেলেন, সেই দিবসই সময় মত আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘পিতা! শুনিয়াছি, পুত্র না থাকিলে আইনানুযায়ী অবিবাহিতা কন্যাই মাতার পরিত্যক্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী হইয়া থাকে। একথা যদি প্রকৃত হয়, তাহ হইলে এই বাটী আমার। আপনি আমার বিনা অনুমতিতে এই বাটী বিক্রয় করিতেছেন কেন?’ উত্তরে পিতা কহিলেন, আইনানুসারে এই বাটীর উত্তরাধিকারী যদি তুমি হও, তাহা হইলে ইহা তোমারই থাকিবে; তাহার জন্য তোমার কোন চিন্তা নাই। এই বলিয়া পিতা মিষ্টকথায় আমাকে বুঝাইলেন, এবং আমার নিকট হইতে প্রস্থান করিয়া বিমাতার সহিত গোপনে কি পরামর্শ করিতে লাগিলেন। তৎপরে সেইদিবস রাত্রিকালে একটি ছল অবলম্বন করিয়া যে গৃহ হইতে আপনারা আমাকে বাহির করিয়া আনিয়াছেন, সেই গৃহের ভিতর লইয়া গেলেন, এবং আমাকে সেই গৃহের ভিতর রাখিয়া বাহির হইতে তালা বন্ধ করিয়া দিলেন। আমি সেই দিবস হইতে কয়েদী অবস্থায় সেই গৃহের ভিতরেই আছি। পিতা হইয়া কন্যাকে এরূপ কয়েদী অবস্থায় যে কেহ রাখিতে পারে তাহা আমি পূর্ব্বে জানিতাম না! যাহা হউক, যে দিবস হইতে আমি সেই গৃহের ভিতর আবদ্ধ হইলাম, সেই দিবস হইতে আমার আহারাদিও একরূপ বন্ধ হইল। সমস্ত দিবস পরে গভীর রাত্রিতে কিছু অন্নব্যঞ্জন ও সামান্য পানীয় জল পাইতাম সত্য কিন্তু ক্রমে ক্রমে তাহাও কমিতে লাগিল। পরিশেষে এরূপ কমিয়া গেল যে, তাহাতে কোনরূপেই আমার জীবন ধারণের উপায় রহিল না। তখন বুঝিলাম যে, ক্রমে আহারীয় পানীয় কমাইয়া দিয়া পিতা আমাকে ক্রমে মারিয়া ফেলিবার উদযোগ করিতেছেন। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মৃত্যুই স্থির করিয়া সমস্ত অত্যাচারই সহ্য করিতে লাগিলাম। কারণ, কোনরূপ উপায়ে সেইস্থান হইতে পলায়ন করিতে পারিব, বা কাহারও নিকট আমার সংবাদ প্রদান করিতে পারিব, তাহার কিছুমাত্র উপায় ছিল না। এরূপ অবস্থায় যেমন দিন সকল অতিবাহিত হইতে লাগিল, আমিও ক্রমে ক্রমে দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িতে লাগিলাম। ক্রমে আমার চলৎ-শক্তি ও উত্থান-শক্তি পর্যন্তও রহিত হইয়া গেল। পরিশেষে, জানি না, কি উপায়ে আপনি আমার দুর্দ্দশা জানিতে পারিয়া আমাকে উদ্ধার করিয়া আনিলেন। ইহা ব্যতীত আমি আর কিছুই অবগত নহি।”
পূর্ব্বে তালকার নিকট সমস্ত অবস্থা জানিতে পারিয়া এবং স্বচক্ষে প্রমাদিনীর অবস্থা দেখিয়া যতদূর বিস্মিত হইয়াছিলাম, এক্ষণে ইহার কথা শ্রবণ করিয়া তদপেক্ষা আরও স্তম্ভিত হইলাম।
পূর্ব্বে অনুসন্ধান করাতে ভৈরববাবুর বিপক্ষে যে সকল অপরাধ প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছিল, পাঠকগণ তাহা পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। পাঠকগণ জানিতে পারিয়াছেন, ভৈরববাবুর প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর বহুদিবস পরে জাল স্ত্রী সাজাইয়া তাঁহার প্রকৃত স্ত্রীর বিষয় অপরের নামে বেনামী করিয়া বিক্রয় করেন। সেই জাল স্ত্রীকে তাঁহার প্রকৃত স্ত্রী বলিয়া রেজিষ্টারের নিকট নিজেই সনাক্ত করেন, এবং পরিশেষে যাহার নামে বেনামী করিয়াছিলেন, তাহার নিকট হইতে নিজে ক্রয় করিয়া লন, এবং সর্ব্বশেষে সেই বাটী অপরের নিকট বিক্রয় করিয়া প্রমাদিনীকে তাহার বিষয় ইহতে বঞ্চিতা করিয়াছেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট এই মোকদ্দমার বিচার হইতে না হইতে তিনি তাঁহার কন্যাকে হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে বহুদিবস পর্য্যন্ত কয়েদী করিয়া রাখিয়াছিলেন, এই অভিযোগও তাঁহার উপর আনীত হইল। মাজিষ্ট্রেট সাহেব এই গুরুতর মোকদ্দমার বিচার নিজে না করিয়া, দায়রায় অর্পণ করিলেন। দায়রায় জজসাহেবের বিচারে ভৈরববাবু কঠিন দণ্ডে দণ্ডিত হইয়া জেলে গমন করিলেন। প্রমাদিনীও পিতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়া পিতার জীবিত অবস্থাতে পিতৃ-শ্রাদ্ধ শেষ করিয়া, আপন স্বামীর গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। এই ঘটনার পর তাঁহার বিমাতার অবস্থা যে কি ঘটিল, তাহা জানিবার সুযোগ আমাদের ভাগ্যে ঘটে নাই।
[পৌষ, ১৩০২]