পিতৃবৎসলতা
ইয়ুরোপে যে সকল ভদ্রসন্তানেরা সৈন্যসংক্রান্ত কর্ম্মে নিযুক্ত হয়, তাহারা, প্রথমতঃ কিছু দিন, যুদ্ধকার্য্যের উপযোগী বিষয়ে শিক্ষা পাইয়া থাকে। এই শিক্ষা দিবার নিমিত্ত, স্থানে স্থানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত আছে। যাহারা ঐ সকল বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া থাকে, তাহাদিগকে, ভোজন পরিচ্ছদ প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ে, তত্রত্য নিয়মাবলীর অনুবর্ত্তী হইয়া চলিতে হয়, যাহারা অন্যথাচরণ করে, তাহারা বিদ্যালয় হইতে বহিষ্কৃত হইয়া থাকে।
ইংলণ্ডের এইরূপ কোনও বিদ্যালয়ে, একটি বালক নিযুক্ত হইল। সে সুবোধ, সাবধান, সচ্চরিত্র ও কর্ত্তব্য বিষয়ে সম্যক্ অবহিত লক্ষিত হওয়াতে, তথাকার অধ্যক্ষ তাহাকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। বিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে, যখন সকল বালক আহার করিতে যাইত, সে বালকও তাহাদের সঙ্গে আহার করিতে বসিত। অন্য অন্য বালকেরা আহারের সময়, গল্প ও আমোদ করিত, কিন্তু সে সেরূপ করিত না। সে, প্রথমে সূপ ভক্ষণ করিয়া, রুটী ও জল খাইয়া উদরপুর্ত্তি করিত, মাংস প্রভৃতি যে সমস্ত উপাদেয় বস্তু প্রস্তুত হইত, তাহা স্পর্শও করিত না। ইহা দেখিয়া তাহার সহচরেরা কারণ জিজ্ঞাসা করিলে, সে কোনও উত্তর দিত না, বিষণ্ণ বদনে মৌন অবলম্বন করিয়া থাকিত।
ক্রমে ক্রমে এই বিষয় অধ্যক্ষের গোচর হইলে, তিনি তাহাকে কহিলেন, অহে যুবক। তুমি এরূপ আচরণ করিতেছ কেন? তোমায় আহার বিষয়ে, এখানকার নিয়ম অনুসারে চলিতে হইবে, সকলে যেরূপ আহার করে, তোমারও সেইরূপ আহার কবা আবশ্যক। এ সাংগ্রামিক বিদ্যালয়, যে বিষয়ে যে নিয়ম বদ্ধ আছে, কোনও অংশে, তাহার কিছু মাত্র ব্যতিক্রম হইতে পারিবে না, অতএব সাবধান করিয়া দিতেছি, অতঃপর, তুমি রীতিমত আহার করিবে, কদাচ অন্যথাচরণ করিবে না।
অধ্যক্ষ এইরূপে সাবধান করিয়া দিলেও, সেই যুবক পূর্ব্ববৎ সূপ, রুটী ও জল মাত্র আহার করিতে লাগিল। অধ্যক্ষ শুনিয়া অত্যন্ত কুপিত হইলেন, এবং তৎক্ষণাৎ তাহাকে আপন নিকটে আনাইয়া, ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, তুমি অন্যান্য সকল বিষয়ে সুবোধ বটে, কিন্তু এ বিষয়ে তোমায় অত্যন্ত অবাধ্য দেখিতেছি, সে দিন সাবধান করিয়া দিয়াছি, তথাপি তুমি বিদ্যালয়ের নিয়ম লঙ্ঘন করিতেছ। যদি স্বেচ্ছা অনুসারে চলা তোমার অভিপ্রেত হয়, তাহা হইলে, তোমায় বিদ্যালয় হইতে বহিষ্কৃত হইতে হইবে।
এই ভয় প্রদর্শন করাতে, বালক অত্যন্ত ব্যাকুল ও বিষণ্ণ হইল, এবং কৃতাঞ্জলি হইয়া, অশ্রুপূর্ণ লোচনে, কাতর বচনে কহিল, মহাশয়। আমায় ক্ষমা করুন, আমি ইচ্ছা পূর্ব্বক বিদ্যালয়ের নিয়ম লঙ্ঘন, বা আপনার উপদেশে অবহেলা করি নাই। যে কারণে উপাদেয় বস্তু ভক্ষণে বিরত থাকি, তাহা আপনার গোচর করিতেছি। আমার পিতা যার পর নাই নিঃস্ব, অতি কষ্টে আমাদের দিনপাত হয়। যখন বাটীতে ছিলাম, জঘন্য পোড়া রুটী মাত্র খাইতে পাইতাম, তাহাও পর্য্যাপ্ত পরিমাণে নহে, এক দিনও আহার করিয়া পেট ভরিত না। এখানে আমি প্রতিদিন উত্তম সূপ ও উত্তম রুটী পেট ভরিয়া খাইতেছি, এখানে আসিবার পূর্ব্বে, আমি কখনও এরূপ উত্তম ও প্রচুর আহার পাই নাই। আমার পিতা মাতা, প্রায় প্রতিদিন, এক প্রকার উপবাসী থাকেন। আহার করিতে বলিলেই, তাঁহাদিগকে মনে পড়ে, তাঁহাদের আহারের কষ্ট মনে করিয়া, উপাদেয় বস্তু ভক্ষণে আমার প্রবৃত্তি হয় না। সেই সুশীল, সুবোধ বালকের এই সকল কথা শুনিয়া অধ্যক্ষ সাতিশয় চমৎকৃত হইলেন, এবং মনে মনে অত্যন্ত প্রশংসা করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে, তিনি কহিলেন কেন, তোমার পিতা বহুকাল রাজকর্ম্ম করিয়াছিলেন, তিনি কি পেন্শন পান নাই? বালক কহিল, না মহাশয়। তিনি পেন্শন পান নাই, পেনশনের প্রার্থনায়, এক বৎসর কাল রাজধানীতে ছিলেন, কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই, অবশেষে অর্থাভাবে আর এখানে থাকিতে না পারিয়া, হতাশ হইয়া গৃহে প্রতিগমন করিয়াছেন, তিনি পেন্শন পাইলে, আমাদের এত কষ্ট হইত না।
ইহা শুনিয়া অধ্যক্ষ কহিলেন, আমি অঙ্গীকার করিতেছি, যাহাতে তোমার পিতা পেন্শন পান, তাহার উপায় করিব। আর, যখন তোমার পিতার এরূপ দুরবস্থা শুনিতেছি, তখন তিনি, আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্ব্বাহ জন্য, তোমায় আবশ্যক মত অর্থ দিয়াছেন, আমার এরূপ বোধ হইতেছে না, সুতরাং, সে জন্য তোমার বিলক্ষণ কষ্ট হয়, সন্দেহ নাই, আপাততঃ, তুমি তিনটি গিনি লও, ইহা দ্বারা আবশ্যক ব্যয় নির্ব্বাহ করিও, আর যত সত্বর পারি, তোমার পিতার নিকট আগামী ছয় মাসের পেনশন পাঠাইয়া দিতেছি।
বালক শুনিয়া, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইল, এবং অধ্যক্ষের দত্ত তিনটি গিনি, অনিমিষ নয়নে, নিরীক্ষণ করিতে লাগিল, কিয়ৎক্ষণ পরে কহিল, আপনি আমার পিতার নিকট সত্বর টাকা পাঠাইবেন, বলিলেন, কি রূপে ঐ টাকা পাঠাইবেন? অধ্যক্ষ কহিলেন, তোমায় সে ভাবনা করিতে হইবে না, আমরা অনায়াসে তাঁহার নিকট টাকা পাঠাইতে পারিব। বালক কহিল, না মহাশয়। আমি সে ভাবনা করিতেছি না, আমি আপনার নিকট এই প্রার্থনা করিতেছি, যখন আপনি আমার পিতার নিকট টাকা পাঠাইবেন, ঐ সঙ্গে এই তিনটি গিনিও পাঠাইয়া দিবেন, আমি যত দিন এখানে থাকিব, আমার এক পয়সাও প্রয়োজন হইবে না, কিন্তু এই তিনটি গিনি পাইলে, তাঁহার যথেষ্ট উপকার বোধ হইবে।
অধ্যক্ষ, তাহার সদ্বিবেচনা ও পিতৃবৎসলভাব আতিশয্য দর্শনে, অত্যন্ত প্রীত হইলেন, এবং সেই বালকের প্রতি নিরতিশয় সন্তোষ প্রদর্শন করিলেন। অনন্তর তিনি, রাজার গোচর করিয়া, তাহার পিতার পেন্শনের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন, এবং আগামী ছয় মাসের পেন্শন ও সেই তিনটি গিনি তাহার পিতার নিকট প্রেরণ করিলেন।
তদবধি, সেই নিঃস্ব পরিবারের, দুঃখের অবস্থা অতিক্রান্ত হইয়া, পুনরায় সুখের ও স্বচ্ছন্দের অবস্থা উপস্থিত হইল।