পিতা-পুত্র উপাখ্যান
ডুডুয়ার সতীশ রায় মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘দূর মশাই, খাঁটি সোনার গয়না হয় না, তার সঙ্গে ভেজাল মেশাতে হয়। তবেই সেটার চেহারা খোলে। তেমনি মেয়েমানুষের স্বভাবে যদি একটু নষ্টামির ঝোঁক না থাকে তাহলে তাকে আলুনি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারব না। কি বল হে?’
কথা হচ্ছিল সতীশ রায়ের বাগানের বেঞ্চিতে বসে। পাশে বয়ে যাচ্ছে ডুডুয়া নদী। পেছনে সতীশ রায়ের দোতলা বাড়ি। সামনে, বাগানের শেষে কিছুটা হাঁটতেই ন্যাশনাল হাইওয়ে। যাঁরা শুনছিলেন তাঁদের দুজন সতীশের স্তাবক, তৃতীয়জন একজন নামকরা ঘটক।
স্তাবকরা মাথা না নেড়ে বলল, ‘তা ঠিক।’
ঘটক যজ্ঞেশ্বর মুখুজ্যে হাত কচলালেন, ‘আজ্ঞে কোন বাপ বলবে যে তার মেয়ের স্বভাবে একটু নষ্টামি করার ঝোঁক আছে?’
‘বাপ না বলুক মা বলবে, আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীরা বলবে আর কেউ যদি না বলে মেয়ের দিকে তাকালেই আপনি বুঝতে পারবেন। তা যদি না পারেন তাহলে আপনি কীসের ঘটক?’ মুখ বন্ধ করলেন সতীশ রায়।
যজ্ঞেশ্বর বিনীত গলায় বললেন, ‘এরকম পাত্রীর কথা আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে বলেনি। আপনি কেন এমন পাত্রীকে পুত্রবধূ করতে চাইছেন—!’
হাত তুলে থামিয়ে দিলেন সতীশ রায়, ‘আমার ছেলেকে দেখেছেন? শান্ত শিষ্ট। দেখলেই বোঝা যায়, এক ফোঁটা ব্যক্তিত্ব নেই। তা তার বউ যদি ঘোমটা মাথায় গুড়ের বস্তা হয়ে বসে থাকে, লজ্জায় নেতিয়ে থাকে সর্বক্ষণ তাহলে ছেলেটা কখনও মানুষ হবে? আমি চলে গেলে পাঁচ ভূতে লুটেপুটে খাবে সব। ওহে, ঘটকমশাইকে বলে দাও লোকে আমাকে কী বলে?
একজন স্তাবক বলল, ‘ডুডুয়ার সতীশ রায়।’
দ্বিতীয়জন মাথা নাড়ল, ‘সতীশ রায় ছাড়া এই ডুডুয়া গ্রামকে ভাবা যায় না।’
যজ্ঞেশ্বর উঠে দাঁড়ালেন, ‘দেখি চেষ্টা করে।’
‘তা বলে এমন কোনও সম্বন্ধ আনবেন না যার বংশের কোনও পরিচয় নেই।’
‘এ তো একেবারে সোনার পাথরবাটি!’ বিড়বিড় করলেন যজ্ঞেশ্বর।
‘কত উঁচু বংশে ভদ্র পণ্ডিত বাবার সন্তান লম্পট যদি হতে পারে তবে সেরকম পরিবারের মেয়ের একটু নষ্টামি করার ঝোঁক থাকবে না কেন?
‘ওই ঝোঁক কথাটাই যে গোলমালে ঠেকছে।’
‘জলে নেমেছে কিন্তু বেণি ভিজায়নি। হল?যান।’ সতীশ রায় হাত নাড়লেন।
পনেরো দিনের মাথায় হাসিমুখে ফিরে এলেন যজ্ঞেশ্বর মুখার্জি। বিকেলের চা খাচ্ছিলেন সতীশ রায়। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী সন্দেশ?’
‘একেবারে নলের গুড়ের জল ভরা তালশাঁস।’ যজ্ঞেশ্বর বললেন।
‘তাই নাকি? তাই নাকি? ওরে কে আছিস, ঘটকমশাইকে চা দে।
‘একেবারে আপনাদের পালটিঘর। মালবাজারের হরিদাস সেনের নাতনি। কী রূপ-কী রূপ। মুখে খই ফুটছে। বাপ মরা মেয়ে। হরিদাসবাবু নাতনিতে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। তিন-তিনটি পাত্রপক্ষ ওর কথা শুনে কেটে পড়েছে।’ যজ্ঞেশ্বর জানালেন।
‘কেন? খিস্তি খেউড় করে নাকি?’
‘না-না। শেষ পাত্রপক্ষ ওকে যা-যা জিজ্ঞাসা করেছে তার উত্তর সব ঠিকঠাক দিয়েছিল সে। পাত্রপক্ষ খুব খুশি। হঠাৎ মেয়ে বলে বসল, ‘আচ্ছা, আপনাদের ছেলে ম্যাদামারা নয় তো?’ ব্যস, দুধে চোনা পড়ল।’
‘বাঃ। চমত্তার। বয়স কত?’ মাথা নাড়লেন সতীশ রায়।
‘একটু বেশি। এই ধরুন তেইশ।’
‘ধরব কেন? বার্থ সার্টিফিকেট না থাক কুষ্ঠি আছে তো?’
‘তা নিশ্চয়ই আছে।’
‘বেশ, ওদের বলুন ছেলেকে যদি দেখতে চায় তাহলে দিন ঠিক করে চলে আসতে।’ ‘না-না। ওরা ছেলে দেখতে চান না।’ যজ্ঞেশ্বর বললেন।
‘কেন?’
‘হরিদাসবাবু বললেন, ডুডুয়ার সতীশ রায়ের ছেলেকে দেখতে যাওয়ার দরকার নেই।’
‘মানে বুঝলাম না।’ মাথা নাড়লেন সতীশ রায়।
‘আজ্ঞে আপনার ছেলে যখন, তখন দেখার দরকার আছে বলে মনে করেন না ওঁরা।’
‘ওঁরা? এই বললেন হরিদাসবাবু কথাটা বলেছেন।’
‘হ্যাঁ। উনিই বলেছেন। তবে বলার আগে অন্দরমহলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে যখন বললেন কথাটা তখন মনে হল বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আলোচনা করেই বলেছেন। বাড়িতে ওঁর স্ত্রী আছেন, বিধবা মেয়ে, মানে পাত্রীর মা আছেন।’
‘হুম। বাড়ির মহিলারা আমার নাম জেনে বসে আছেন? কেন? আমি কি খুনি না ডাকাত? আমার চাটুকারদের আপনি হার মানালেন।’
যজ্ঞেশ্বর মুখার্জি নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাদের আজ দেখছিনা?’
‘ছেলেকে পাঠিয়েছি সদরে, উকিলবাড়িতে। সে একা যাবে না। তাই ওরা সঙ্গে গেছে। তা আমরা মেয়ে দেখব কবে?’ জিজ্ঞাসা করলেন সতীশ রায়।
‘যেদিন ইচ্ছে। একদিন আগে বললেও চলবে। তবে তার আগে একটা সমস্যার সমধান করে নিতে হবে।’ যজ্ঞেশ্বর হাসলেন।
‘কী সমস্যা?
‘হরিদাসবাবু জানতে চেয়েছেন আপনার দাবি কতটা আর সেটা তিনি দিতে পারবেন কিনা। সক্ষম বোধ করলে মেয়ে দেখাবেন।’
‘দাবি? দাবি তো একটাই। মেয়ের স্বভাবে একটু নষ্টামির ঝোঁক থাকতে হবে। আপনার মুখে যা শুনলাম তাতে তো দাবি পূর্ণ হয়ে গেছে।’ একটু চুপ করে থেকে হো-হো করে হাসলেন সতীশ রায়, ‘ম্যাদামারা! আহা, অপূর্ব।’
‘তাহলে তো হয়েই গেল। সামনের মঙ্গলবারে যাব বলি?
‘বলে দিন। তবে পৌঁছাব বিকেলবেলায়। সন্ধের আগেই চলে আসব। আমার মিষ্টি খাওয়া ডাক্তারের নিষেধে বন্ধ। তেতো চা এক কাপ খেতে পারি।’
*
মঙ্গলবার দুপুরের পর বেশ কিছুটা সময় সাজগোজ করলেন সতীশ রায় যাতে পাত্রের বাবার সম্মান বজায় থাকে। বাইরে গাড়ি, দুই স্তাবক এবং ঘটকমশাই অপেক্ষা করছে। তৈরি হয়ে পুত্রকে ডাকলেন সতীশ রায়, সে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
‘তোমার বয়স এখন কত?’
‘আজ্ঞে–।’
‘বয়স জিজ্ঞাসা করছি!’
‘সাতাশ বছর হতে তিনমাস দেরি আছে।’
‘আজ আমি তোমার সহধর্মিণী হবে এমন একটি মেয়েকে দেখতে যাচ্ছি। যদিও জানি তুমি বিয়ের আগে তাকে দেখতে চাইবে না, তবু জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কি দেখতে চাও?
‘না-না।’ যেন এটা ভাবাও অন্যায়, ওর কথার ধরনে মনে হল।
‘তোমার সঙ্গে আমার পার্থক্য কি জানো? আমি দেখতে চাইতাম।’ কথা শেষ করে বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। স্তাবকরা এবং ঘটক চাপাচাপি করে বসল ড্রাইভারের পাশে, পেছনে। সতীশরায় একা। গাড়ি ছাড়া মাত্র তিনি মাথার ওপর দু-হাত তুলে ঈশ্বরকে প্রণাম জানালেন। স্তাবকরা তাই দেখে হাতজোড় করে নুইয়ে পড়ল। তাতে স্থানসঙ্কুচিত হওয়ায় ঘটক বলল, ‘এই, কী হচ্ছে কি!’
ডুডুয়া থেকে মালবাজার যেতে সময় লাগল পঁয়তাল্লিশ মিনিট। পথে কেউ কোনও শব্দ উচ্চারণ করেনি। মালবাজারে ঢোকার মুখে গাড়ি থামাতে বললেন সতীশ রায়। পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করে একজন স্তাবককে দিলেন, ‘হরি ময়রার দোকান থেকে আমার নাম করে রাজভোগ নিয়ে এসো। মাটির হাঁড়িতে করে আনবে।’
ঘটক বলল, ‘আমি ভাবছিলাম–।’
‘কী ভাবছিলে?’ সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।
‘একেবারে খালি হাতে যাবেন মেয়ে দেখতে?
‘তুমি এখন কী ভাবছ?’
‘আমি আর কী বলব! এইজন্যেই লোকে আপনার সুখ্যাতি করে।’ যজ্ঞেশ্বর মুখার্জি বিনয়ে নুয়ে পড়ল।
হরিদাস সেনের বয়স হয়েছে। দেড়বিঘে জমির ওপর বাগানওয়ালা বাড়ি। আপ্যায়ন করে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী দেব বলুন? চা, কফি বা ঠান্ডা কিছু?’
‘আপনি আমার পিতৃতুল্য। দয়া করে আপনি বলবেন না। না, এখন নয়। সব কথা শেষ হলে এক কাপ চিনি এবং দুধ ছাড়া লিকার চা পেলেই খুশি হবো।’
‘বেশ। আমার এই নাতনি মেয়ের পক্ষে। জামাই মারা গিয়েছিল দুর্ঘটনায়। তিন বছর বয়স থেকেই ও আমার কাছে আছে। এখানকার স্কুলে পড়েছে। পড়াশুনায় তেমন ভালো নয় বলে উচ্চমাধ্যমিকের পর আর পড়াইনি। তবে গৃহকার্যে অতীব নিপুণা।’
মাথা নাড়লেন সতীশ রায়। কিছুটা দূরে বসা যজ্ঞেশ্বর মুখার্জি বললেন, ‘সেন মশাই, এবার নাতনিকে যদি আসতে বলেন।’
হরিদাসবাবু উঠে ভেতরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন যাঁকে নিয়ে সে ডানাকাটা সুন্দরী নয়, কিন্তু খুবই সুশ্রী। পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে বলে তাকে সাজানো হয়েছে। গলায় পাউডারের দাগ। চুল বেশ সময় নিয়ে বাঁধা। তাতে তাকে একটু আড়ষ্ট লাগছে।
হরিদাস সেন বললেন, ‘প্রণাম কর ওঁকে।’
মেয়েটি দাঁড়িয়ে দেখছিল। সতীশ রায় বললেন, ‘থাক-থাক, প্রণাম করতে হবে না। তোমার নাম কী?’
‘সুরঞ্জনা।’
‘সুরঞ্জনা, তুমি ভেতরে যাও। ভালো করে মুখ ধুয়ে, বাড়ির শাড়ি পরে, খোলা চুলে চটপট চলে এসো।’ সতীশ রায় বলা মাত্র মেয়ে ছুটল ভেতরে।
হরিদাস সেন বললেন, ‘ওর গায়ের রং কিন্তু ধুলেও একই রকম দেখাবে।
‘আমি সেই সন্দেহে ধুয়ে আসতে বলিনি। ও সেজেগুঁজে সহজ হতে পারেনি বলেই বললাম। মেয়ের বাবার নাম কী ছিল?’
‘জগন্নাথ বর্মন। শিলিগুড়িতে চাকরি করত। যাক গে, আপনার ডুডুয়াতে আমার এক ভাইপোর বাড়ি ছিল। সেসব বিক্রি করে সে কুচবিহার চলে গেছে।’
‘মধুর কথা বলছেন?মধুসূদন সেন।’
‘বাঃ। মধুকে আপনি চেনেন?
‘চিনব না। ওর জমি-বাড়ি তো আমিই বিক্রি করিয়ে দিয়েছি।’
‘আমি কখনও যাইনি কিন্তু আমার স্ত্রী এবং কন্যা ওর বাড়িতে মাসখানেক ছিল। তা সে অনেকদিন আগের কথা।’
কথাটা শুনে ভাঁজ পড়ল সতীশ রায়ের কপালে। কিন্তু তিনি মুখ খোলার আগেই সুরঞ্জনা ফিরে এল। এখন তাকে খুব স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
সতীশ রায় বললেন, ‘বাঃ। বসো। রান্নায় কষে ঝাল দিতে পারবে?’
ফিক করে হেসে ফেলল সুরঞ্জনা, ‘কেন পারব না?’
‘তুমি কী পড়েছ, কী পারো তা তোমার দাদু বলেছেন। আমি তোমাকে অন্য প্রশ্ন করছি। তার আগে বলল, আমি কেন এসেছি?
‘আমি কেমন তাই দেখতে।’
ভেতর থেকে স্ত্রীকণ্ঠ ভেসে এল, ‘পা দোলাবি না!’
পা স্থির হল। হাসলেন সতীশ রায়, ‘বাইরে থেকে দেখে কী করে বুঝব তুমি কীরকম?’
‘তাই তো ভাবছিলাম।’
‘বাঃ। আচ্ছা, তুমি গালাগালি করতে জানো?’
‘ওমা, কে না জানে?’
‘বেশ, তুমি কী-কী গালাগাল জানো?’
সুরঞ্জনা তার দাদুর দিকে তাকাল। বৃদ্ধ অস্বস্তিতে পড়েছেন দেখে যজ্ঞেশ্বর মুখার্জি বলল, ‘আসুন সেনমশাই, আমরা বাইরে গিয়ে বসি।’
হরিদাস সেন যেন রক্ষা পেলেন।
ওঁরা বেরিয়ে গেলে সুরঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, ‘সত্যি বলব?’
‘হ্যাঁ।’
চোখ বন্ধ করে মনে করল সুরঞ্জনা। তারপর বলল, ‘উল্লুক, অসভ্য, ঢ্যামনা, মাকাল, আমি তো মেয়ে তাই শালা বলি না।’
ভেতরের দরজায় শব্দ হল।
‘ঠিক কথা। আর একটা শব্দ, ম্যাদামারা, বল না?’ সতীশ রায় তাকালেন।
‘হ্যাঁ, মাঝে-মাঝে।’
‘আমি কে জানো?’
‘ডুডুয়ার সতীশ রায়।’
‘এটা তোমাকে কে বলেছেন? তোমার দাদু?’
‘না। মা। মা যখন ছোট ছিল তখন দিদার সঙ্গে এক মামার বাড়িতে গিয়েছিল ডুডুয়ায়। তখন আপনাকে দেখেছিল?’
‘এবার মনে পড়ে গেল, তোমার মায়ের নাম কি শিউলি?’
‘ওমা, আপনার মনে আছে?’
‘হুম। তিনি কি একবার এখানে আসতে পারবেন?’
‘মা,’ চেঁচিয়ে উঠল মেয়ে, ‘তোমাকে উনি ডাকছেন?’
চিৎকার শুনে হরিদাস সেন আর যজ্ঞেশ্বর ঘরে ঢুকলেন। তারপর মাথায় ঘোমটা দেওয়া সাদা শাড়ি পরা যে মহিলা ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তাঁর ফাঁক থেকে চিবুক দেখা যাচ্ছে।
সতীশ রায় উঠে দাঁড়ালেন, হাতজোড় করে বললেন, ‘আপনার মেয়েকে আমার পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে চাই, সম্মতি দেবেন?
‘আপনি তো মাকে তুমি বলতেন, মা বলেছে–’
‘আঃকথা না বলে পারো না! সব কথা সবার মনে থাকে না।’ চাপা স্বরে বললেন মহিলা, ‘আপনার বাড়িতে ও গেলে এই প্রথম মনে হবে ভগবান আছেন।’
বাড়ি ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে গেল। যজ্ঞেশ্বর বললেন, ‘এত রাত্রে বাস পাব না।’
সতীশ রায়ের মন তখন ফুরফুরে। বললেন, ‘রাতটা এখানেই থেকে যান। আপনার জন্যেই এই অভাব পূর্ণ হল। চিন্তা করবেন না, ঘটকবিদায় ভালো ভাবেই হবে।’
‘তা কি আর আমি জানি না।’ যজ্ঞেশ্বর উৎফুল্ল।
স্তাবকদুজন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সন্ধের পর তিন পাত্র খাওয়া সতীশ রায়ের অভ্যেস। স্ত্রী বিয়োগের পর থেকেই এটা আরম্ভ হয়েছিল। তখন থেকে প্রতি সন্ধের সঙ্গী এরা। তবে দুরকম বোতল থাকে। সতীশ রায়ের জন্যে দামি বোতল, ওদের জন্যে সস্তার। তাতে কিছু মনে করে না ওরা। যজ্ঞেশ্বর পান করেন না। চা খেতে-খেতে বললেন, ‘মেয়েটিকে কেমন লাগল?
‘আপনি কি মাকাল? ঢ্যামনা না ম্যাদামারা?’ বলে হো-হো হাসিতে ভেঙে পড়লেন সতীশ রায়। তাঁর হাসিতে গলা মেলাল স্তাবকরা। সতীশ রায় বললেন, ‘বিয়ের দিন ঠিক করতে কি বলতাম পছন্দ না হলে? এখন বলুন, এই কথাগুলোর মানে কী? ঢ্যামনা মানে কী?’
‘বদমায়েস লোক কিন্তু ঢং করে থাকে।’ যজ্ঞেশ্বর বলল।
‘মাকাল?’
‘ওপরটা সুন্দর ভেতরটা নয়।’
‘ম্যাদামারা?’
‘ঠিক বলতে পারব না।’
‘দেখতে চান? অ্যাই, ছোটবাবুকে পাঠিয়ে দে। আমার পুত্র, আসছে। ওকে দেখলেই বুঝবেন ম্যাদামারা কাকে বলে। এই বাড়িতে বউমা এলে তবে যদি ওর চরিত্র বদলায়।’ সতীশ রায় বললেন।
একজন কর্মচারী বললেন, ‘ছোটবাবু বাড়িতে নেই।’
‘নেই? এত রাত্রে তো সে বাইরে থাকার ছেলে নয়! খোঁজ, খুঁজে দ্যাখ।’
যজ্ঞেশ্বর বললেন, ‘মেয়ে দেখতে গেছেন, শুনে বোধহয় মনে আনন্দ হয়েছে–।’
‘সেটা আর পাঁচটা ছেলের হতে পারে, ওর হওয়ার কথা নয়। ম্যাদামারা।’
আধঘণ্টা পরে চিৎকার শোনা গেল, ‘অ্যাই, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, নইলে মেরে ফেলব! আমাকে চেনোনা তোমরা? শালা, ফাটিয়ে দেব সবাইকে।’
সতীশ রায় বললেন, ‘কে?কার এত সাহস?’
যজ্ঞেশ্বর মাথা নাড়লেন, ‘জড়ানো গলা। মাল খেয়ে চেঁচাচ্ছে।’
ততক্ষণে কর্মচারীরা ধরে নিয়ে এসেছে এই ঘরের দরজায় যাকে তাকে দেখে সতীশ রায়ের চক্ষুস্থির, ‘তুমি?’
পুত্র বলল, ‘ইয়েস আমি। বাংলা খেয়েছি।’
যজ্ঞেশ্বর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্বভাবের বাইরের কাজ করলে কেন বাবা?’
‘আমি দেবদাস হব।’ টলছিল পুত্র।
‘দেবদাস?’ যজ্ঞেশ্বর হতভম্ব।
‘আই লভ স্বপ্না। স্বপ্নাকে বিয়ে করতে পারিনি। আমি দেবদাস হব।’
‘জুতিয়ে তোমার মুখ ছিঁড়ে দেব হারামজাদা। তলায়-তলায় এত? আমাকে ভুল বুঝিয়েছ ঢ্যামনা?
কে স্বপ্ন? কোথায় থাকে,’ চিৎকার করলেন সতীশ রায়।
একজন স্তাবক বলল, ‘পোস্টমাস্টারের মেয়ে। গত মাসে বিয়ে হয়ে গেছে।’ হো-হো করে হেসে উঠলেন সতীশ রায়। বললেন, ‘ভালো, বিয়ের আগে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়া ভালো। বউমার কাজটা সহজ হয়ে গেল।’