পিতা পুত্রকে – ৫

পাঁচ

তরুণদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদ থেকে সরিয়ে নেবার জন্যে ইংরেজ সরকার সারা বঙ্গের স্কুলে কালচারেল আন্দোলনের প্রবর্তন করেছিলেন। তার নাম ‘ব্রতচারী’ এক ডাকসাইটে আইসিএস গুরুসদয় দত্ত, যিনি পরে ‘নাইটহুড’ পেয়ে স্যার গুরুসদয় দত্ত হয়েছিলেন এবং যাঁর নাম দক্ষিণ কলকাতার একটি রাস্তায় অমর হয়ে রয়েছে, তিনিই ‘ব্রতচারী’ আন্দোলনের প্রণেতা। ছড়া বেঁধে তাতে সুর লাগিয়ে, নৃত্য-গানের রূপ দেওয়া হয়েছিল ব্রতচারী আন্দোলনের। অনেকগুলো ছড়ার সঙ্গে দেশের মাটির সম্পর্কে চাষি, মজুর, ধোপা, গোয়ালা এদের সঙ্গে ব্রতচারীদের জীবনের সংযোগ।

গণেশপুর হাই স্কুলেও ‘ব্রতচারী’ চালু হয়েছিল। মহকুমা প্রশাসন থেকে এক বিশেষ যুবক শিক্ষক এসেছিলেন আমাদের ব্রতচারীর নাচগান শেখাতে। সব নাচগুলোকেই ফোক-ড্যান্স, গ্রামের মানুষদের বিশেষ করে সাঁওতালদের নাচের অনুকরণ বা সমীকরণ। লাঠি হাতে নিয়ে করতে হতো কয়েকটা নাচ, কয়েকটা নাচ হাতে হাত মিলিয়ে, বাহুতে বাহু সংলগ্ন করে। গানগুলো বলত, আমরা চাষির বন্ধু, কোদাল দিয়ে মাটি কাটি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রুজি রোজগার করতে হয় আমাদের, আমরা দুঃস্থের সেবক, ক্ষুধার্তকে অন্ন, রোগীর সেবা, নিরক্ষরকে সাক্ষর করা, রাস্তা বানানো, খাল কাটা, এসব আমাদের জীবনযাত্রার উপাদান, লেখাপড়া শিখবার সঙ্গে সঙ্গে। ভদ্রলোক বাড়ির সন্তান হয়ে আমরা গরিব গ্রামবাসী মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাইনি, তারাই আসলে আমাদের প্রকৃত বন্ধু, তারাই দেশের নব্বই ভাগ লোক।

ব্রতচারী নৃত্যসংগীত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বেশ ভালোই হতে পারত, যদি না সবাই জানত কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংস্কৃতি অনুষ্ঠান ভূমিস্থ করা হয়েছে। গানগুলো বেশ ভালোই রচিত, সুরের মধ্যে ছিল গ্রামের মানুষের মনের টান, নৃত্যের মধ্যে ছিল গ্রামীণ জীবনের হিল্লোল। তথাপি গণেশপুরের হাই স্কুলে শিক্ষক ও ছাত্রদের মন কেড়ে নিতে পারেনি ‘ব্রতচারী’।

যে যুবক শিক্ষকটি মাদারীপুর থেকে এসেছিলেন ব্রতচারী শেখাতে, তাকেও কেমন কেমন দোষা হিসেবে দেখত সবাই। তাঁর নাম মনে নেই, আমার বাল্য ও যৌবনের প্রখর স্মৃতিশক্তি এই তিনকুড়ি দশ পরিণত বয়সে হারিয়ে গেছে। এখন নাম ভুলে যাই, মুখ মনে রাখতে পারি না। যদি ভদ্রলোকের নাম যতীন হয়ে থাকে, যতীনবাবু মানুষটি বড় সূক্ষ্ম ছিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর জোরালো ও মধুর, ছিপছিপে শরীর নৃত্যপটু। তিনি সর্বদা হাসিখুশি, বন্ধুত্বপূর্ণ। নাচ শুরু হবার আগে ও শেষ হবার পরে তিনি আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন, গ্রামের খবর নিতেন, কী হচ্ছে না হচ্ছে জানতে চাইতেন। মাঝে মধ্যে বাতাসা লজেন্স নিয়ে আসতেন পকেটে করে। বিলিয়ে দিতেন আমাদের। ‘ব্রতচারী’ ছাড়াও অন্য খেলাতেও ছাত্রদের সঙ্গে তিনি যোগ দিতেন।

যতীনবাবু থাকতেন ডিঙ্গামানিক গ্রামে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে। তখন গণেশপুর গ্রামে দু-তিনটে সাইকেল এসে গেছে। প্রত্যেকটাই জমিদার বাড়ির কর্মচারীদের ব্যবহারের জন্য, মাঝে মাঝে জমিদারের ছেলেরাও সাইকেলে চেপে স্কুলের পাশ দিয়ে যে বড় রাস্তাটা পদ্মাপার পর্যন্ত চলে গেছে তার ওপর ছুটোছুটি করত। যতীনবাবুরও একটি সাইকেল ছিল। এটা ছিল আমাদের কাছে বড় এক বিস্ময়। স্কুলের শিক্ষকেরা যা বেতন পেতেন তাতে তাদের কোনোক্রমে সংসার সংকুলান হতো। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন এক রাজবন্দী শিক্ষক এলেন, বি.এ. পাস, অঙ্কের তুখোড়। বেশিরভাগ শিক্ষকরাই ইন্টারমিডিয়েট পাস ছিলেন। এই নতুন শিক্ষকটিকে আমরা বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম, তিনি স্বদেশি করে জেল খেটেছেন, ডেটিনিউদের নিয়ে আমাদের বুকে একটা রোমান্টিক চাঞ্চল্য ছিল, আমরা ভাবতাম এরা ভীষণ বীরপুরুষ, ইংরেজের সঙ্গে লড়ছে। এই মাস্টার মশাই, যার নাম ছিল পুলিন রায়, বেতন পেতেন মাত্র কুড়ি টাকা। নিজেই একদিন আমাদের ক্লাসে বলেছিলেন। বছর দুই আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন না, যিনি ঐ পদে বহাল ছিলেন তার নাম যতীন চক্রবর্তী, তিনি অন্য স্কুলে চলে গিয়েছিলেন। আমার দশম ক্লাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, চব্বিশ-পরগনা থেকে এলেন এক নতুন হেডমাস্টার। পুরো এম.এ. বি.টি। চমৎকার সহজ ইংরেজি লিখতেন, আর সব শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ইংরেজিতে গলগল করে বক্তৃতা করতে পারতেন। তাঁর মাইনে ছিল ষাট টাকা। স্কুলের সংলগ্ন হেড মাস্টার মশাইয়ের জন্য একটা বাড়ি ছিল, অনেকখানি জায়গা নিয়ে; সে বাড়ির পরেই পথের উপর পোস্ট অফিস, যাকে সরকারি ভাষায় বলা হতো সাবপোস্ট অফিস, স্কুলের খেলার মাঠ ও এই দুটো বাড়ির মধ্যে ছিল বেশ বড় একটা পুকুর। নতুন হেড মাস্টার প্রমোদবাবুকে আমরা সবাই ভালোবাসতাম। যতীন বাবুর মতো তিনি বেত হাতে নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন না, মারতেন না কাউকে। আমার সঙ্গে তাঁর একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তিনি বলতেন, ইংরেজিতে দশম শ্রেণিতে আমি সবচেয়ে ভালো ছাত্র, অঙ্কে সবচেয়ে খারাপ। প্রমোদবাবুর ষাট টাকা (তখনকার দিনে এ তো অনেক টাকা, আমি কল্পনা করতে পারতমা না।) মাইনে পেয়েও সাইকেল কিনতে পারেন নি। পায়ে হেঁটেই তাঁকে যাতায়াত করতে হতো।

‘ব্রতচারী’ শিক্ষক ‘যতীনবাবু আমাকে কাছে ডেকে একদিন জানতে চাইলেন আমাদের পরিবারের কথা। আমি অবাক হলাম যখন তিনি বললেন, রজনীকান্তের কাহিনি তাঁর অজানা নয়, তিনি বিখ্যাত বক্তা ছিলেন, তাঁর একটা ‘ডাকাত’ দল ছিল, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি জেলে গিয়েছিরেন। আমার পিতা খুলনায় বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন জেনে খুশি হয়েছিলেন যতীনবাবু : ‘তোমার বাবা ও আমি একই জীবিকার মানুষ।” আমি মা আর ভাই—বোনদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকি শুনতে পেয়ে জানতে চেয়েছিলেন আমাদের অভিভাবক কে। আমি বলেছিলাম, অভিভাবক দুজন, মা এবং জ্যেঠামশাই, যিনি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। নিজের সামাজিক ওজন বাড়াবার জন্য ‘যতীন’বাবুকে জানিয়েছিলাম, আমার কাকা সুদূর পাঞ্জাবে গণিতের অধ্যাপক, তিনি প্রথম শ্রেণিতে এ.এ. পাস করেছিলেন। এসব আলাপচারিতার পরে যতীনবাবু বললেন, “তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে আমাকে? তোমার মা’র সঙ্গে পরিচিত হবার ইচ্ছে হচ্ছে।”

দারুণ খুশিতে মা’র অনুমতি নিয়ে যতীনবাবুকে আমি একদিন বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম স্কুল ছুটির পর। পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছিল তাঁকে, খালের ওপর বাঁশের সাঁকো, সাইকেল পথ অবশ্য নয়, তাছাড়া আমি সাইকেলের পেছনে চাপতে রাজি নই।

মার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন যতীনবাবু। আমার মা সুন্দর কথা বলতে পারতেন, বোঝা যেত তিনি হাই স্কুল পাস না করেও বেশ শিক্ষিতা। অনেক তাঁর পড়া, এমনকি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলোও, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র তো বটেই। অনেক বই নিয়ে আলোচনার ক্ষমতাও তাঁর ছিল। এক সময়ে যতীনবাবু বললেন, “মাসিমা, আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি সাহিত্য পড়েছেন। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, সাহিত্য বেশি পড়িনি।”

যতীনবাবু আমাকে গ্রাম সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন করলেন। গণেশপুর লাইব্রেরিতে কত বই, কারা রীতিমতো লাইব্রেরিতে আসে, বিশেষ করে যুবকরা, ব্যায়াম করে ক’জন, ব্যায়াম কে শেখায়, আমি ব্যায়াম করতে যাই কিনা। ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন।

কথায় কথায় যতীনবাবু অনন্তদার প্রসঙ্গে পৌছলেন।

“তুমি চেন অনন্তদাকে?”

“চিনি, তবে দূরে থেকে।

“তার তো সুনাম গণেশপুরে।”

“অনন্তদা দারুণ ভালো, আমাদের সবাইকে অত্যন্ত ভালোবাসেন।”

“কী করতে বলেন তোমাদের?”

“বলেন, শরীর ও চরিত্র গঠন করতে হবে, তা না হলে প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না।”

“খুব ঠিক কথা, অনন্তদার খ্যাতি দশখানা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।”

“আপনি চেনেন অনন্তদাকে?”

“না, পরিচয়ের সুযোগ হয়নি।”

“ব্যায়াম যেখানে হয় সেখানে গেলেই পরিচয় হবে।”

“তোমাদের গ্রামে তো নিৰ্মল কাকা আছেন, তাই না?”

“হ্যাঁ, তবে তিনি কলকাতায় আছেন।”

“তুমি তাকে চেন?”

“দেখেছি, নির্মলকাকাকে।”

“তিনি তো রাজবন্দী ছিলেন, তাই না?”

“তাই শুনেছি আমরা।”

“রাজবন্দী মানে জানো?”

“না।”

“যাঁরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে রাখা হয়। বিচারের প্রয়োজন হয় না। কিছুদিন পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরাই হলেন রাজবন্দী। ইংরেজিতে ‘ডেটিনিউ’ অর্থাৎ যাকে ‘ডিটেন’ করা হয়েছে, আটক করা হয়েছে।”

আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম, বুঝেছি।

যতীনবাবু বললেন, “তুমি বড় হয়ে কী করবে?”

আমি এ কথাটা একদম ভাবিনি। বললাম, “জানি না। সে তো অনেক দূরের কথা! স্কুল পাস করে কলকাতার কলেজে পড়ব, এখন এটুকুই জানি।”

“স্কুলে তো তোমার খুব ভালো ছাত্র হিসেবে সুনাম। হেডমাস্টার তোমার ইংরেজি ও বাংলার ওপর দখলের কথা কমনরুমে প্রায়ই বলেন।”

“আমি অঙ্কে ভীষণ কাঁচা। অঙ্ক করতে আমার একটুও ভালো লাগে না। দেখবেন আমার অঙ্কের সব খাতা, অ্যারিথমেটিক, অ্যালজেব্রা, জিওমেট্রি! তিনটে খাতাই খালি পাতায় ভরা।

“অঙ্ক তো খুব ইন্টারেস্টিং। একবার মন বসলে আর মন সরাতে পারবে না। আমি তোমাকে অঙ্ক শেখাব।”

আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললেন, “না, না, ট্যুইশনি নয়। আমি এমনিতেই সপ্তাহে একদিন তোমাদের বাড়ি এসে তোমাকে অঙ্ক শেখাব। তোমার মাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। অপরকে সহজে আপন করে নিতে পারেন।”

মা যতীনবাবুকে মুড়ি ও চা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “বিস্কুট নেই আমাদের ঘরে। আমার ছেলেমেয়েরা সারা গ্রীষ্ম ও শরৎ সকালে পান্তা খায়, লঙ্কা আর নারকেলের টুকরো দিয়ে। এটাই এদের ‘ব্রেকফাস্ট’।

যতীনবাবু বলেছিলেন, “পান্তা খেতে আমিও ভালোবাসি। কিন্তু ঘুম পেয়ে যায়। জানেন তো পান্তা থেকে আমাদের দেশের সাধারণ লোকেরা ঘরোয়া মদ তৈরি করে।”

এ খবরটা আমারও জানা ছিল। আমি বলে উঠলাম, “মহুয়া থেকেও মদ তৈরি হয়। আমাদের গ্রামে অবশ্যি মহুয়া তৈরি হয় না।”

যতীনবাবু বিদায় নিলেন। মা বললেন, “বড় ভালো ছেলেটি। খুব সহজে ভাব জমাতে পারে।” সপ্তাহে আমাকে একদিন বাড়ি এসে অঙ্ক শেখাবেন শুনে মা যতীন বাবুর উপর আরও খুশি হলেন।

এই ঘটনার দুই সপ্তাহ পরে যতীনবাবুকে কে বা কারা খুন করে ফেলল। তাঁর নিজের শয়নঘরে, বড় এক পাথর খণ্ডে তাঁর ঘুমন্ত মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ করে।

গণেশপুরে ভীষণ শোরগোল হয়ে গেল।

আমরা শুনতে পেলাম যতীনবাবু সরকারের স্পাই, গোয়েন্দা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *