পিতা পুত্রকে – ৪

চার

পাল্টা শক্তি তৈরিতে লেগে গিয়েছিল ইংরেজ সরকার।

গণেশপুর গ্রামেও আমরা এই পাল্টা শক্তির প্রভাব দেখতে পেলাম। অনন্তদার শক্তির পাল্টা শক্তি।

স্কুলের উঁচু শ্রেণী থেকে কলেজ পর্যন্ত যুবকদের মন অন্যদিকে চালিত করা, পাল্টা শক্তি তৈরি করার প্রধান লক্ষ্য।

একদিন স্কুলে ঘোষিত হলো মাদারীপুর মহকুমার আধখানা জুড়ে ২০টি উচ্চ বিদ্যালয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা হবে। যে প্রথম হবে তাকে দেওয়া হবে স্বর্ণপদক।

বিতর্কের বিষয় : ইংরেজ শাসন কি ভারতবর্ষের পক্ষে মঙ্গলপ্রসু হয়নি?

আমাদের গণেশপুরে হাইস্কুলে মাসে একবার বিতর্ক সভা হতো। তার চালক ছিলেন বৈষ্ণব শাস্ত্রে পণ্ডিত শিক্ষক উমেশচন্দ্র সরকার। ইনি আমাকে নির্বাচন করলেন গনেশপুর হাইস্কুলের প্রতিনিধি। জোর তামিল দিলেন কী বলতে হবে তা নিয়ে। ইংরেজ শাসন যে ভারতবর্ষের এত মঙ্গল-কল্যাণ-শ্রী-সুখ-শান্তি ঘটছে আমার জানা ছিল না।

আমাদের অঞ্চলে পালং সবচেয়ে বড় গ্রাম। পালং হাইস্কুলে বিতর্কের স্থান, দিন, ক্ষণ ধার্য হয়েছে।

বিতর্কে সভাপতিত্ব করতে কলকাতা থেকে এক অধ্যাপক এসেছেন। তাঁর নাম কে.ডি. দাস। তিনি কলকাতার সরকারি ডেভিড হেয়ার টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল।

আমারই মতো আরও উনিশটি ছেলে অনেক উপদেশ ও দীর্ঘ তালিম নিয়ে এসেছিল পালং হাইস্কুলের বিতর্কসভায়।

সামিয়ানা খাটিয়ে চেয়ার আর টুল পেতে তৈরি হয়েছে সভার আসর। উঁচু তক্তপোষকে রঙিন কাপড়ে মুড়ে তৈরি হয়েছে সভাপতির আসন। একখানা বড় টেবিল, লাল শালুর কাপড়ে ঢাকা, তাতে মাটির ফুলদানিতে গাঁদা-পদ্ম-জবা-মালতী নানারকম গ্রাম্য ফুলের অমিল স্তবক। টেবিলের পর তিনটে চেয়ার। এখানা গদি বসানো। দেখলেই বোঝা যায় সভাপতির আসন।

আসর ভরে গেছে ছাত্র ও তাদের পুরুষ অভিভাবকদের উপস্থিতিতে। আসরে প্রথম আমরা ২০ জন বিতর্কযুদ্ধের যোদ্ধা। বাকি উনিশ জনের চেহারাগুলো চেয়ে দেখতে গিয়ে বুক আমার এমন কাঁপতে লাগল যে চোখ কিছুই দেখতে পেল না।

নির্দিষ্ট সময় কিছুটা পেরিয়ে সভাপতির সমাগমন হলো। আমাদের সভ্যতার এই প্রাচীন অভ্যেস মোটামুটি আজও অটুট। শ্রোতাদের, প্রার্থীদের, অনুগতদের বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ আবির্ভূত হন।

কে.ডি দাসকে নিয়ে সভায় ঢুকলেন পালং হাইস্কুলের হেডমাস্টার ও আমাদের এলাকার ইন্সপেক্টর অব স্কুলস্। এঁদের নাম মনে নেই আমার।

পেছনে তাকিয়ে দেখলাম উমেশবাবু উপবিষ্ট। তাঁর দীর্ঘ শরীর, প্রকাণ্ড ভুঁড়ি এবং মাংসল চওড়া মুখে চরম প্রশান্তি, গভীর ঔদাসীন্য। মনে হলো না, তিনি আমার বক্তৃতা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত বা ভাবিত। তাঁর সারিতে অন্যান্য শিক্ষকরা যারা বসে আছেন তাঁদের চেহারা যতই ভিন্ন ভিন্ন হোক না, আমার মনে হলো তাঁরা সবাই উমেশবাবু।

সভার অধিপতি কে.ডি. দাস আমাদের ভালো ছাত্র হতে উপদেশ দিলেন। ভালো ছাত্র হতে গেলে শুধু পড়াশুনা নয়, চরিত্র গঠন ও বিশেষ প্রয়োজন। চরিত্র গঠনের জন্য চাই শুভমন, শুভচিন্তা এবং আনুগত্য। আনুগত্য শুধু পিতামাতা, শিক্ষক, সব গুরুজনদের প্রতি নয়, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা-উন্নতি-মঙ্গলের দায়িত্ববাহী শাসকদের প্রতিও। কে.ডি. দাসের একটি বাক্য আমার মনকে কামড়ে দিল—তিনিব বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই জানো না, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নিজের পরিচয় দেন, ‘জনগণের অনুগত ভৃত্য’ হিসেবে। এটাই হলো ইংরেজ রাজত্বের মর্মকথা : শাসক শাসিতের একান্ত অনুগত ভৃত্য।

তিনি আরও বললেন, তোমাদের বিতর্কের বিষয়টা খুবই সময়োচিত। আমি একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই। যারা বিষয়ের প্রতিপক্ষ হবে, তারা সম্পূর্ণ নির্ভয়ে নিজেদের বক্তব্য রাখবে। আমরা জানি বেশ কিছু লোক ইংরেজ প্রশাসনকে সুনজরে দেখছে না। তারা সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারী শোষক ইত্যাদি অনেক গর্হিত শব্দে ইংরেজ শাসনের বর্ণনা করছে। তাদের বক্তব্য অনেক পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, সভা সমিতি শ্রুত হচ্ছে। ও থেকেই বোঝা যায়, ইংরেজ শাসকগণ কতখানি উদার ও ভিন্নমত সহিষ্ণু। ব্রিটেন গণতান্ত্রিক, জনসাধারণ সেখানে প্রকৃত শাসক। ভারত সম্রাটের উদার উদ্দেশ্য এদেশকে স্বয়ং শাসনের অধিকার দেওয়া। সে পথেই ব্রিটিশ সরকার এগিয়ে যাচ্ছেন। “আমার ছোট ছোট বন্ধুগণ, তোমরা নির্ভয়ে বিতর্কে যোগ দাও। মন খুলে কথা বল।”

সভাপতি যখন বিতর্কে অংশগ্রহণকারীদের দু’পক্ষে বিভক্ত হতে বললেন, তখন দেখা গেল বিতর্কে ইংরেজ শাসনের স্বপক্ষে বলবার জন্য একে একে সবাই সভাপতির ডানদিকে হাজির হয়েছে। কেউ ইংরেজ শাসককে সমালোচনা করে কিছু বলতে প্রস্তুত নয়। অথবা সবারই বিশ্বাস ইংরেজ শাসনে ভারতের উন্নতি, শান্তি, স্বস্তি, কল্যাণ ও নিরাময় ছাড়া আর কিছু ঘটেনি।

দৃশ্য দেখে আমার মতিভ্রম হয়ে গেল।

আমি পিছন ফিরে উমেশবাবুর দিকে তাকালাম। তিনি তখন বুঁদ হয়ে রাধাকৃষ্ণ জপ করছেন।

আমি উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম সভাপতির বাম দিকে। সমবেত লোকেদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। আরও একটি ছেলে, তার নাম ভুলে গেছি, কোন্ স্কুলের ছাত্র তাও মনে নেই, আমার পাশে এসে দাঁড়াল।

প্রস্তাবের পক্ষে আঠারোটি বক্তা, বিরুদ্ধে মাত্র দুটি।

সভাপতি কে.ডি. দাস খুশি হলেন, না অখুশি হলেন বোঝা গেল না।

তিনি বললেন, “প্রস্তাবের পক্ষে যেন এত বেশি তখন তাদের কথাই আগে শোনা যাক। ডান দিকে ন’জনের বক্তব্য শেষ হলে, বামদিকের প্রথম বক্তাকে ডাকা হবে। তারপর বামদিকের আরও ন’টি বক্তা; সবশেষে ডানদিকের দ্বিতীয় বক্তা।”

প্রায় সবাই তাদের বক্তব্য লিখে এনেছিল। একে একে সেগুলো পড়া হলো। কেউ পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিল না, যদিও সভাপতি সবাইকে দশ মিনিট সময় দিয়েছিলেন।

ন’জনের বক্তব্য শেষ হবার পর আমার ডাক পড়ল।

মনে আছে, আমি একটা ফর্সা ধুতি, নীল বর্ণের ছিটের শার্ট পরে বিতর্কে গিয়েছিলাম। পায়ে তিন বছরের পুরোনো স্যান্ডেল, খুব সামান্য ব্যবহৃত।

কি বলেছিলাম সব, আমার এখনও মনে আছে। উমেশবাবুর তালিমটা আমার পুরো মুখস্থ ছিল। সেটা ব্রিটিশ শাসনের প্রশস্তি। তাতে ১৯০৮ সাল থেকে কিভাবে ধীরে মন্থরে ইংরেজ ভারতকে স্বায়ত্ত্ব শাসনের জন্য তৈরি করেছে তার বর্ণনা ছিল। সে মুখস্ত বক্তব্যকে মুক্তি দেবার সুযোগ থেকে আমি নিজেকে বঞ্চিত করেছি। কী বক্তব্য রাখব এখন তার বদলে?

অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে একটা বক্তব্য তৈরি করেছিলাম। সভার মানুষদের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম জিভ শুকিয়ে গেছে, গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। তখন নিজেকে একটা তীব্র ভর্ৎসনা আর ধাক্কা দিয়ে উঠলাম। “এই বোকা, এখন ইঁদুর হয়ে পড়েছিস? তুই না রজনীকান্তের নাতি!”

সে ধাক্কাটা আমাকে তড়াক করে জাগিয়ে দিল। আমি যা বললাম তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যটাই লিখছি তোমার জন্য। গণেশপুরের লাইব্রেরি থেকে আনা অনেক বইয়ের পাতা আমার মনে ভেসে উঠল। আমার স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল। একবার পড়লেই পাঠ্য বিষয় প্রায় মুখস্থ হয়ে যেত। যা পড়তাম তার প্রায় অনেকটাই পরিষ্কার মনে থাকত। আমি মাত্র সপ্তাহখানেক আগে রবীন্দ্রনাথের ‘ভারতবর্ষ” ও “ভারতবর্ষের ইতিহাস” প্রবন্ধ দুটি পড়েছিলাম। মাকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। তার অনেকটা আমার স্বচ্ছভাবে মনে ছিল। আমি ঐ দুটি প্রবন্ধের আশ্রয় নিলাম।

“ইংরেজ শাসনে ভারতের শান্তি, স্থিতি, উন্নতি হয়নি এমন কথা বলব না,”– আমি নিবেদন করলাম। “কিন্তু আমরা এখনও অতি দরিদ্র, নিরক্ষর, রোগজীর্ণ, আমরা মানে আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ। আমাদের যা প্রয়োজন, আমরা যা আকাঙ্ক্ষা করছি তা এখনও আমাদের নাগালের অনেক দূরে বলে আমাদের মনে হয়। কিন্তু একদিন আমরা স্বাধীনতা পাব, সেদিন দূর হোক, নিকটে হোক। আমদের ভেবে দেখতে হবে স্বাধীনতা পেয়ে আমরা তার ব্যবহার করব কিভাবে? আমরা শুনে আসছি জাতি হিসেবে, সভ্যতা হিসেবে আমাদের বড় দোষ আমরা অল্পে সন্তুষ্ট। আমাদের কি দীক্ষার অভাব? ইউরোপ অসম্ভবকে আলিঙ্গন করে প্রকৃতিকে জয় করেছে। ভারতবর্ষকে জয় করেছে ইংরেজ। ভারতবর্ষকে প্রকৃতরূপে চিনতে পারলে, ইংরেজ সরকার আমাদের জন্যে কী করেছে, কী করেননি, এ প্রশ্ন দুর্বল হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক প্রবন্ধে ‘অমর ভারতবর্ষের’ কথা লিখেছেন, লিখেছেন, সেই অমর ভারতবর্ষ ‘ফললোলুপ কর্মের অনন্ত তাড়না হইতে মুক্ত হইয়া শান্তির ধ্যানে বিরাজমান, অবিরাম জনতার জড়পেষণ হইতে মুক্ত হইয়া তিনি আপন অবিচলিত মর্যাদার মধ্যে পরিবেশিত। এই যে কর্মের বাসনা, জনসংঘের আকাল ও উত্তেজক হইতে মুক্তি, ইহাই সমস্ত ভারতবর্ষকে ব্রহ্মের পথে ভয়হীন, শোকহীন, মৃত্যুহীন পরম মুক্তির পথে স্থাপিত করিয়াছে। ইউরোপ যাহাকে ‘ফ্রিডম’ বলে সে মুক্তি ইহার কাছে নিতান্তই ক্ষীণ। সে মুক্তি চঞ্চল, দুর্বল ভীরু, তাহা স্পর্ধিত, তাহা নিষ্ঠুর: তাহা পরের প্রতি অন্ধ, তাহা ধর্মকেও নিজেদের সমতুল মনে করে না এবং সত্যকেও নিজের দাসত্বে বিকৃত করিতে চাহে। তাহা কেবল অন্যকে আঘাত করে, এইজন্যে অন্যের আঘাতে ভয়ে রাত্রি-দিন বর্ম-চর্মে অস্ত্রে-শস্ত্রে কণ্টকিত হইয়া বসিয়া থাকে, তাহা আত্মরক্ষার জন্য স্বপক্ষের অধিকাংশ লোককেই দাসত্বনিগড়ে বন্ধ করিয়া রাখে— তাহার অসংখ্য সৈন্য মনুষত্বভ্ৰষ্ট ভীষণ যন্ত্রমাত্র। এই দানবীয় ফ্রিডমের চেয়ে উন্নততর বিশালতর পথ মহত্ব, যে মুক্তি ভারতবর্ষের তপস্যার ধন, তাহা যদি পুনরায় সমাজের মধ্যে আমরা আহ্বান করিয়া আনি, অন্তরের মধ্যে আমরা লাভ করি, তবে ভারবতবের্ষর নগ্নচরণের ধুলিপাতে পৃথিবীর বড় বড় রাজমুকুট পবিত্র হবে।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উদাত্ত বাণীর পর আজকের বিতর্ক সভার প্রশ্ন অবান্তর হয়ে পড়ে। আমার বিশ্বাস ইংরেজ রাজত্ব ভারতবর্ষের যতটুকু কল্যাণ মঙ্গল স্থিতি স্থাপন করতে পেরে থাকুক, তার অন্তর বিশেষ ভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। আমাদের অন্তর থেকে, আত্মা থেকে, উপাদান সংগ্রহ করে একদিন আমরা নতুন ভারতবর্ষ গড়ব, তার জন্যে কত বছর অপেক্ষা করতে হয় সেটা মোটেই বড় কথা নয়, কেননা ভারতের সভ্যতা, ধর্ম, চিত্ত ও মন কালাতীত।”

মনে আছে, বক্তব্যের শেষে আমি সভাশুদ্ধ লোকেদের করতালি পেয়েছিলাম। সভাপতি কে.ডি. দাসও সেই করতালিতে যোগ দিয়েছিলেন। সম্ভবত সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তেরো বছরের এক বালককে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা প্রবন্ধের অতখানি একটানা মুখস্থ বলে যেতে দেখে।

বিতর্কে আমার প্রথম হবার সিদ্ধান্ত সভাপতি ঘোষণা করেছিলেন। আমাকে নিয়ে বেশ একটু হইচই হয়েছিল। পালং স্কুলের হেডমাস্টার আমাকে ও উমেশবাবুকে তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের মিষ্টি খাওয়ালেন। বললেন, এ ছেলে ম্যাট্রিকে নিশ্চয়ই ডিস্ট্রিক স্কলারশিপ পাবে।’

সে ছেলে তা পায়নি। পেয়েছিল সুভাষ ধর, মাদারীপুরের এক উকিলের ছেলে, পরে যে ইউনাইটেড নেশনসে বড় কাজ করছে, এখন অবসর নিয়ে বাস করছে নিউইয়র্ক শহরে। বিবাহ করেছিল স্বনামখ্যাত জি.এল. মেহেতার প্রথম কন্যাকে।

আমার মনে আছে বক্তৃতায় আমি নিজেকেই ধিক্কার দিয়েছিলাম। মন আমার বিষণ্ন হয়ে গিয়েছিল।

উমেশবাবু আমাকে বাহবা দিতে এলে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, “সব মিথ্যে কথা বলেছি। যা বলা উচিত ছিল, বলার ইচ্ছে ছিল, তা কিছুই বলিনি।”

বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেও সোনা কেন, কোনো মেডেলই আমার মেলেনি। হেড মাস্টার মশাই ইন্সপেক্টর অব স্কুলসকে পত্র লিখে জবাব পাননি।

অবশেষে আমি নিজেই কে.ডি. দাসকে চিঠি লিখেছিলাম। মনে আছে, তিনি ভাইস প্রিন্সিপ্যাল, ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ, কলিকাতা।

তিন মাস পরে জবাব এসেছিল। কে.ডি. দাস আমার জীবনে প্রথম “বড় মানুষ”। লিখেছিলেন কি ভীষণ ব্যস্ত তাঁকে থাকতে হয়, কত বড় বড় ব্যাপারে তিনি জড়িত। তবু আমাকে তাঁর মনে আছে। “তোমার সুন্দর বক্তৃতাটাও আমি ভুলে যাইনি।”

কিন্তু মেডেলের কোনো উল্লেখ ছিল না সেই চিঠিতে। “বড় মানুষদের” সম্বন্ধে একটা সন্দেহ আমার মনে লেগেই রইল। এঁরা কি কথার দাম দেন না? সীমান্ত গ্রামের একটি ছেলেকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো তা পালনের কি কোনো দায়িত্ব নেই এই “বড় মানুষটির”?

‘ঢুলি’ নৌকায় পালং যাওয়া আমার জীবনে প্রথম ঘর ছাড়া, ‘বিদেশ’ যাত্রা। স্কুল থেকে পাঠানো হচ্ছে, শিক্ষক উমেশবাবু আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন, জ্যোঠামশাই কোনো আপত্তি করলেন না, মা তাঁর অন্তরের ভয় ও দুশ্চিন্তাটুকু চেপে রেখে হাসিমুখে মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। ছোট্ট নক্সাকাটা টিনের বাক্সে আমার জন্য একটা ধুতি, একটা শার্ট, দুটো ফতুয়া দিয়েছিলেন মা।

ফেরার সময় সন্ধের একটু আগে ‘ঢুলি’ নৌকায় চেপেছিলাম আমি ও উমেশবাবু। উমেশবজাবুর বিপুল বপু ধুতি-পাঞ্জাবি ও নামাবলী চাদরে আবৃত। ছোট মাংসল গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কাঁচাপাকা চুল বাবরি না হলেও বেশ বিস্তর ও ঘন। নাকে লোহার ফ্রেমে মোটা কাচের চশমা। সর্বদা পান চর্বন করেন উমেশবাবু দোক্তার সঙ্গে। অনেক সময় মুখ থেকে পান-দোক্তার লাল ঝরে। আস্তিনে তা মুছে নেন। ঘন ঘন পিক ফেলে উমেশবাবু।

পদ্মাতীরে ঢুলি নৌকা সওয়ারীর অপেক্ষা করছিল। আমরা দুজনে নৌকায় চড়ে দেখলাম আরও তিনটি যাত্রী আগেই এসে গেছে: এক দম্পতি, তাদের বছর পাঁচেকের এক কন্যা। ঘোমটায় বউটির সারা মুখ ঢাকা, তার স্বামীর দেহে জামা নেই, পরনে আধময়লা ধুতি। বাচ্চা ছেলেটা পরেছে ছিট কাপড়ের ইজের, যা এখন আর গ্রামাঞ্চলেও চোখে পড়ে না।

আরও দু’জন যাত্রী এল। এরা মাঝবয়সী জেলে, পথে একটা গ্রামে নেমে পড়বে, সেখানে ওদের নৌকা কাল থেকে বাঁধা রয়েছে। উমেশবাবুর প্রশ্নের জবাবে তারা বলল, এ বছর নদীতে মাছের অভাব, জেলেদের সংখ্যা বেড়েছে, তাদের রোজগার কমে গেছে। এরা, শুনতে পেলাম, দুই ভাই, সেনচৌধুরীদের প্রজা। নৌকা ছাড়ল। তখনও অন্ধকার নেমে আসেনি পদ্মার বুকে, চৈত্র মাসের আকাশে উড়ন্ত মেঘ, রং মাত্র কালো হতে শুরু করেছে। মেঘ, কচি ছেলেমেয়েদের মতো স্বচ্ছন্দ চঞ্চলতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশে। নদীর কিনারে গাছ— আম, বকুল, কদম, শিরীষ, কাঁঠাল, জামরুল, নারিকেল, সুপারি। কামিনী ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে হালকা বাতাসের সঙ্গে, কদম গাছে তখনও ফুল আসেনি, অপেক্ষা করছে বর্ষার। চৈত্র মাসেই বর্ষার প্রথম পদক্ষেপ আমাদের গ্রামে। মাঝে মধ্যে বৃষ্টি, খুব তেজ নেই সে বর্ষণে, বর্ষা ভৈরব গর্জনে আসবার মাসখানেক বাকি। চৈত্র-সংক্রান্তির দিকে গ্রামের খালের পাড়ে বসে যায় তিন দিনের মেলা, চাষিরা নিয়ে আসে চাল, ডাল, কুমড়ো, লাইনের পর লাইন পড়ে যায় চুড়ির দোকানের। সস্তা সব খেলনার। কামারেরা সাজিয়ে বসে বটি, দা সব রকমের কোদাল, খুপরি, লোহার কাটা, (যা দিয়ে ডাল গলান আমাদের মায়েরা) খন্তা, আর কত কী! মুদিরা সাজায় দোকান মসলাপাতি, ডালচালের দোকান। বসে যায় কাপড়ের দোকান। তখন সবেমাত্র তৈরি শার্ট, শায়া বাজারে আসতে শুরু করেছে। বসে যায় জুতোর দোকান, রবারের জুতো, কেম্বিসের, চামড়ারও। বর্ষা ঋতুতে সব কিছুরই অভাব, গ্রাম ভেসে যাবে নদীর উদ্বৃত্ত জলে, গৃহীরা বর্ষা মাসের জন্য কুমড়ো কিনে রেখে দেয়, গায়ে চুন লাগিয়ে, যাতে না পচে, পোকায় না কাটে। অনেকে সারাবছরের মসলাপাতি কিনে রাখে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় সবকিছুর দাম কিছু কম।

জেলে দুই ভাই, অন্য লোকটি ও উমেশবাবু আসন্ন চৈত্রের মেলার কথা বলছিলেন। গত বছর বৃষ্টি ভালো হয়নি, শস্য ভালো ফলেনি আশানুরূপ, কিন্তু খুব খারাপ দশা নয় মাঠে, কিছু বর্ষা এসেছিল ভাদ্র—আশ্বিনে। বৃষ্টি না আসলে গড়পড়তায় প্রতি দু বছরে ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষ হতো, সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা নদীমেখলা বঙ্গভূমিও বাদ পড়ত না। তখন চালের দাম মণ প্রতি দু’টাকা বেড়ে যেত। আমাদের কুড়ি টাকা মাসিক বাজেটে ভীষণ টান পড়ত। মধু ও আমি বেরিয়ে পড়তাম জঙ্গল থেকে ঢেঁকিশাক, পুকুর থেকে কলমি শাক সংগ্রহে, চিনিকাকু ও আমি যেখানে যতটুকু জমি মিলত সবজিক্ষেত তৈরি করতাম। পুকুর থেকে মাটির কলসি করে জল তুলে নিয়ে এসে সিঞ্চিত করতে হতো ক্ষেতকে, ফলত ডাটা, পুঁইশাক, কুমড়ো-লাউ-শশার লতা, ঝিঙে, ধুন্দুল, সীম, বেগুন। মাঝে মধ্যে চুরি করে সেজদাদুর পুকুর থেকে মাছ ধরতাম। বাইরের পুকুরে বড়শি পেতে সারাদিন বসে থাকতেন জ্যেঠামশাই। যেদিন রুই, কাতলা, মৃগেল ধরা পড়ত, ভাগ পেতাম আমরা। পশ্চিমের প্রতিবেশী বাড়ির সঙ্গে সীমানা ছিল একটি সরু খাল, কেবল বর্ষার সময় এটা জীবন্ত হয়ে উঠত। নদীর জল আসত বাইরের পুকুরে। বর্ষার স্রোতের সময় আমরা চিংড়ি ধরার জন্য সরু বাঁশ ও বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি করতাম বেড়াজাল, গলদা মাঝে মাঝে ধরা পড়ত। কুচো চিংড়ির জন্য গামছা পাততাম পুকুরের জলে, গামছার সঙ্গে উঠে আসত অন্তত আধ-মুঠো কুচো চিংড়ি। ডোবার জল নিংড়ে কই, শিঙি, মাগুর, শোল মাছ ধরতাম, সারা শরীরে কাদা মেখে, অনেক পরিশ্রমে।

দুর্ভিক্ষের বছরেও আমাদের মতো গরিব মধ্যবিত্ত মানুষদের পেটে ক্ষুধা নিয়ে দিন বা রাত কাটাতে হতো না।

নৌকায় চারজন পুরুষের আলোচনা আমার মনে এসব ভাবনা এনে দিয়েছিল। চলতি নৌকার সঙ্গে সঙ্গে তীরের গাছ, বাগান, বসত, ধীরে ধীরে পেছনে সরে যাচ্ছে। একটা নিথর স্থির পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে নদী, আকাশ, সমাগত অন্ধকারের মিলনে। পুরুষদের কথা আমার কানে আসছে না, আমি বৈঠা চালক মাঝির পাশে এসে বসেছি, কানে আসছে শুধু বৈঠার সঞ্চালনের ছলছল শব্দ, সে শব্দ বাজছে আমার বুকে, আমার কল্পনায়।

তরুচ্ছায়া সীমারেখা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। নদী ক্ষুরধার, উচ্ছল নয় শান্ত সমাহিত! স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে কচুরিপানা, কাঠের টুকরো, মরা কুকুর বেড়ালের শব। মাঝি নৌকাকে রাখছে তীরের কাছাকাছি, যাতে স্টেশনে নামতে সুবিধা হয়। মায়ের আঁচলের মতো বিস্তৃত শান্তি, নিস্তব্ধতা, সন্ধ্যা অন্ধকার। আমি যেন অসীম সময়ের সীমা ছাড়িয়ে কোথায় চলে গেছি, আমার মনে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। পালং স্কুলে বিতর্ক সভা গেছি ভুলে। ইংরেজ রাজত্বের কি আমি কতটুকু জানি? তার আঘাতে ভারত কতটা ক্ষতবিক্ষত, দগ্ধ, তাও আমার জানা নেই। আমি কেবল জানি আমার গ্রাম গণেশপুর, তার পাশ কেটে প্রবাহিত পদ্মা, আমাদের জেলে প্রজাদের সরল ব্যবহার, আমার মার গভীর স্নেহ। আমার ভক্ত ভাইবোন, যাদের কাছে আমার উপরে কেউ নেই। আমার কৈশোর মানসের প্রান্তদেশে পিতা দুর্জয় সিংহ, যাঁকে আমি একই সঙ্গে ভয় করি, ভালোবাসি। বিলক্ষণ জানি আমাদের বেঁচে থাকার, বড় হবার মূলে তিনি।

ক্রমে ক্রমে অন্ধকার ঘনকৃষ্ণ হয়ে বসেছে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় মাঝি রান্না করছে মোটা চালের ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল। সবার সঙ্গে খেয়ে আবার আমি মাঝির পাশে এসে বসেছি। নিস্তব্ধ রাত্রে নদীতীরে আম্রবন, গৃহবাড়ি, শস্যক্ষেত্র, বিপণী-বাজার সব একাকার হয়ে গেল এক সময় অন্ধকারের সঙ্গে। মাঝি আমাকে বলল, খোকাবাবু তোমার ঘুম আসছে, ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়। আমার কিশোর মনে আঁকা আশার কবিতা নিরবে ঝংকৃত হচ্ছিল, আমার সঙ্গে আকাশের বুকে এক চিলতে চাঁদের তৎক্ষণাৎ মিতালি হয়ে গেল।

আজকে আমি সুখে রব
কিছুই না নিয়ে—
আপন হতে আপন মনে
সুধা ছা’নিয়ে।
বনে হতে বনান্তরে
ঘনধারায় বৃষ্টি ঝরে
নিদ্রাবিহীন নয়ন পরে
স্বপন বানিয়ে।
আজকে পরান ভরে লব
কিছুই না নিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *