পিতা পুত্রকে – ৩

তিন

এ নাটকের সূচক অনন্তদা। অনন্ত ঘটক। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে বঙ্গে ও পরে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক জাগরণের সূচনা। অধীনতার বন্ধন ও শৃঙ্খল ছেড়ে স্বাধীন হবার আকাঙ্ক্ষা ও প্রেরণা প্রকৃতির সবচেয়ে মুখর ঐশ্বর্য। গাছ বলো, লতা বলো, পোকামাকড় বলো, পশুপাখি জীবজন্তু সবাই চায় বাড়তে উঠতে, বিকশিত হতে, প্রসারিত হতে। চায় নদী, সমদ্র, পাহাড়, পর্বত।

মানুষই একমাত্র জীব যার মস্তিষ্ক ও মন চিন্তা-ভাবনা করতে পারে, উদ্ভাবন, আবিষ্কার, অভিযান, বিজয়, বিস্তার তাই মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। গত দুই তিনশো বছর এই মানুষ প্রভাবিত বিজয় বিস্তার ক্রমাগত অধিক থেকে অধিকতর বেগ পেয়ে এসেছে: দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হবার পরে এ গতি হয়ে উঠেছে দুর্বার, একে বাগে রাখার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

মানুষ এখন চাঁদ জয় করেছে। আরও বহু উঁচুতে গ্রহে পৌছবার তোড়জোড় করছে, টেস্ট টিউবে শিশুর জন্ম হচ্ছে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি এত বিশাল বিচিত্র পৃথিবীটাকে একটা গ্রামে পরিণত করতে চলেছে, যাকে আমরা বলছি গ্লোবাল ভিলেজ

মনে পড়ছে ১৯৮১ সালে নিমন্ত্রিত হয়ে আমি আমেরিকার পশ্চিমপ্রান্তে বার্কলে শহরে বিখ্যাত লস এনজেলেস বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করতে গিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী তাদের দৈনিক পত্রিকার জন্য আমার সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম জীবনের পনেরো বছর কেটেছে আমার একটি ‘গণ্ডগ্রামে’ যা তখন বাংলাদেশের অন্তর্গত।

আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য সার্থকতার কাহিনি, দুনিয়ার দু’চারটে সমস্যা সম্বন্ধে আমার মতামত জানবার জন্যেই মেয়েটি ইন্টারভিউ চেয়েছিল। কিন্তু বিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল গণেশপুরে আমার বাল্যকাহিনি শুনে। পরের দিন বার্কলের দৈনিক পত্রিকায় ছবিসহ আমার সঙ্গে তার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল, শিরোনাম ছিল “গ্লোবাল ভিলেজার টেলস হিজ স্টোরি”।

আমি যখন গণেশপুর হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তখন গ্লোব বা পৃথিবী সম্বন্ধে আমার ধারণা অতি সামান্য। আমরা অবশ্যি ভূগোল পড়তাম, কিন্তু মাস্টারমশাই আমাদের পৃথিবী সচেতন করতে পারতেন না।

আমরা ইতিহাস পড়তাম, তাতে ইংরেজ সম্রাট ও সাম্রাজ্যের বিস্তর প্রশস্তি থাকত। আমরা জানতে পারতাম ইংরেজ প্রভুত্ব আমাদের সভ্য করেছে, সুখে রেখেছে, শান্তি ও স্বস্তি দিয়েছে।

রজনীকান্ত যে বছর মারা যান সেই ১৯২৮ সালে ইংরেজ সরকার ভারতবর্ষের থিতিয়ে পড়া সংগ্রামকে একটা প্রাণ সঞ্চারী ইনজেকশন দিয়ে বসল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, এটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা রহস্যময় “রীতি”।

একাধিকবার যখন ভারতের রাজনৈতিক সংগ্রাম শিথিল হয়ে এসেছে, তখন ইংরেজ সরকার অবজ্ঞার সঙ্গে এমন একটা কিছু করে বসেছে যার ফলে সে সংগ্রাম আরও প্রাণবন্ত হতে পেরেছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের বিচারটা সম্ভবত ভুল।

ভারতের সংগ্রাম শিথিল হবার সুযোগ নিয়ে ইংরেজ সরকার চেষ্টা করেছে তার সাম্রাজ্যকে দীর্ঘজীবী করতে, সঙ্গে সঙ্গে ভারতবাসী ভবিষ্যতে কখনো স্বায়ত্তশাসন অধিকার পাবে এই ভরসাকেও কিছুটা সজীব করে।

১৯২৮ সালে ইংরেজ সরকার নিযুক্ত করেছিল সাইমন কমিশন। তার দায়িত্ব ছিল ভারতবাসীকে কতটা সময়-সীমার মধ্যে কতটুকু স্বরাজ দেওয়া যেতে পারে তা নির্ধারণ করা।

ভাইসরয় ছিলেন লর্ড আরউইন।

সাইমন কমিশনের সদস্যরা সবাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য। সভাপতি স্যার জন সাইমন। সভ্যদের মধ্যে একজনও ভারতবাসী নন।

সাইমন কমিশনের নিয়োগ স্বাধীনতা সংগ্রামকে আবার চাঙ্গা করে দিল। কমিশনকে বয়কটের আহ্বান দিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। কংগ্রেসের মধ্যে তখন গান্ধী-মতিলাল নেহেরুর ‘ধীরে চলো’ ও জহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখের ‘আগে বাড়ো’ এই দুই দ্বন্দ্বমূলক লাইনের লড়াই চালাচ্ছিলেন। ‘আগে বাড়ো’-দের ডাকে সাধারণ মানুষের প্রচণ্ড সাড়া গান্ধীজীকে বিচলিত করে দিয়েছিল। ১৯৩০ সালে তিনি তাঁর দ্বিতীয় অসহযোগ সংগ্রামের আহ্বান দিলেন। এই সংগ্রামে তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না। ১৯৩১ সালে স্বাক্ষরিত হলো ‘গান্ধী-আরউইন চুক্তি’, তাতে ‘ধীরে চলো’ নীতির বিজয় হলো।

গণেশপুরে এসব ঘটনার খুব সামান্যই আভাস পাওয়া যেত। সারা গ্রামে আসত মাত্র একখানা আনন্দবাজার পত্রিকা, ডাকে, কলকাতায় প্রকাশিত হবার এক সপ্তাহ পরে। আসিত পাবলিক লাইব্রেরিতে, কাড়াকাড়ি পড়ে যেত পত্রিকা পাঠের জন্য। শেষ পর্যন্ত উৎসাহী প্রধান বৃদ্ধরাই ঠিক করলেন পত্রিকা এসে পৌছাবার পর দিন সন্ধ্যায় এক ব্যক্তি তা সশব্দে পাঠ করবেন যাতে সবাই শুনতে পায়।

অবশ্যই আমাদের মতো ক্ষুদে বালকদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ।

পূজার সময় যখন গ্রামের ভদ্র ব্যক্তিরা ‘দেশে’ ফিরতেন তখন ‘নাটক’ যেমন জমতো, তেমনি গ্রাম মুখর হতো রাজনৈতিক গল্প শুনতে। গ্রামের দুজন খাদি পরা পুরুষ কলকাতার উকিল ও কংগ্রেসের সভ্য। দাস বাড়ির অতুল কাকা, সেন বাড়ির নির্মল কাকা। অতুল কাকার বয়স হবে পঁয়ত্রিশ, তিনি গান্ধীপন্থি, নির্মল কাকা তাঁর চেয়ে বছর তিনেকের ছোট, তিনি ‘জওহর-সুভাষ’ পন্থি। আমি নাটকের রিহার্সাল দেখতে প্রায়ই হাজির হতাম। এঁদের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনা আমাকে আকর্ষণ করত, যদিও আমি বুঝতাম খুবই কম। যা বুঝতাম না তা নিয়ে প্রশ্ন করার মতো গ্রামে একজনও ছিলেন না।

১৯২৮ সাল থেকে বিপ্লবী সংগ্রামের শুরু ভারতবর্ষে। লাল লাজপত রায়ের পুলিশের হাতে জখম ও পরে মৃত্যু ইংরেজ পুলিশ সুপার সনডার্সের হত্যা ঘটাল ১৯২৮ সালে। দিল্লির লেজিসলেটিভ এ্যাস্মব্লিতে বোমা নিক্ষেপ হলো পরের বছর।

যতীন দাস ১৯২৭ সালে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আমরণ অনশন ব্রত ৬৪ দিন পালন করে মরে গেলেন ১৯২৮ সালে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত হবার পরের বছর খণ্ডযুদ্ধ হলো জালালাবাদ পাহাড়ে ইংরেজ ও ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে। ভগৎ সিং ও তাঁর সহচরদের ফাঁসি দেওয়া হলো ১৯৩১ সালে। ইংরাজ ও উঁচু পদের অত্যাচারী ভারতীয় লোকদের হত্যার ঘটনা বাড়তে লাগল।

১৯২৯ সালে দক্ষিণ ভারত থেকে দিল্লি ফেরার সময় নিউ দিল্লির সন্নিকটে বোমা ফাটল। লর্ড আরউইনের আয়ু ছিল, তাই বেঁচে গেলেন।

১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে লাহোরে ঝিলম নদীর তীরে বাৎসরিক অধিবেশনে কংগ্রেস সর্বপ্রথম ‘পূর্ণ স্বরাজ’ দাবি জানিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও অনেকখানি এগিয়ে দিল। ‘পূর্ণ স্বরাজের’ দাবিতে মিলিত হলো নেহেরু-সুভাষের দল, একসঙ্গে তাঁরা কংগ্রেসের তিনরঙ পতাকা উড়িয়ে দিলেন ঝিলম নদীর তীরে। ন’বছর পর নেহেরু—গান্ধী-সুভাষের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সময় জওহরলাল পুরোপুরি গান্ধীর সঙ্গে যোগ দিলেন।

সুভাষ বসুর বিপ্লবী পথ তাঁকে দ্রুত জনপ্রিয়তম নেতা করে তুলছিল। এটা সহ্য হলো না গান্ধীর বরপুত্র জওহরলালের। অবশ্যি ভারতবর্ষের মার্কামারা বামপন্থি, সমাজতন্ত্রী জয়প্রকাশ ও সিপিআই, দুই দলই সুভাষচন্দ্রকে পরিত্যাগ অথবা মাঝপথে অবস্থান করে প্রকৃত সংগ্রামের ঐতিহাসিক সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করলেন।

সেই পুরো ত্রিশ দশকে গণেশপুর অজ্ঞানের অন্ধকারে ডুবে থাকার সুযোগ পেল না।

১৯৩৪ সালে, আমার যখন তেরো বছর বয়স ও আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, নির্মল কাকা সহসা শীতের মাসে গণেশপুর চলে এলেন। সঙ্গে তাঁর বাইশ বছরের একটি যুবক।

আমাদের অনন্তদা।

তাঁর চেহারা এখনও মনে রয়েছে।

বেঁটে মানুষ, পাঁচ ফুটের বেশি নয়, সবল মাংসপেশি, সবচেয়ে প্রথম লক্ষণীয় কপালে একটা বড় দাগ, কোনো গভীর আঘাতের অবিনশ্বর হস্তাক্ষর। বড় বড় চোখ দুটো বেড়ালের মতো ক’টা, রাত্রে বেড়াল-চোখের মতো সর্বদা জ্বলন্ত ও সতর্ক। দাড়ি-গোঁফ কামানো, একটা দাঁত নেই, মুখ খুললেই তার শূন্যস্থান চোখে পড়ে। যেন সবাইকে ভর্ৎসনা করে যাদের সব দাঁত অটুট। ভীষণ ক্ষিপ্ৰগতি অনন্তদা। চলেন না তো ছোটেন, চোখের পলকে পথের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সরে যেতে পারেন। কটা চোখের উপর ভারী একজোড়া ভ্রু, যেন দুটো শিশু কাক পাখা ছড়িয়েছে আকাশে উড়বে বলে। মাথার চুল কদমছাঁট, ঘাড় প্রায় নেই বললেই হয়। কাঁধের উপরেই বেশ বড় একটা মাথা। লম্বায় অতটুকু শরীরের ওপর যেন প্রচণ্ড একটা ধমক।

অনন্তদা এমনিতে হাসি-খুশি, গলার স্বর নরম। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে বজ্রকণ্ঠের অধিকার পান তিনি প্রয়োজনের সময়! তখন তাঁর কটা চোখ রাগে লাল, তখন তিনি ভয়ের কারণ, তিনি ‘ভালো মানুষ’ নন।

দাস বাড়ির কাছে মোড় খেয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে খাল পর্যন্ত। এটা পেরিয়ে আমাদের স্কুলে যেতে হতো। সেই রাস্তা থেকে বেরিয়েছে চলতি সাপের মতো আঁকাবাঁকা আর একটা পথ, একেবারে গণেশপুরের শেষ দক্ষিণ সীমানায় অনেক পুরোনো কাঠের পুল পর্যন্ত, যাকে ভয়ে ভয়ে পেরিয়ে আমাদের পৌঁছতে হতো ডিঙ্গামানিক গ্রামে, যে গ্রাম রামঠাকুরের জন্মস্থান হিসেবে বিখ্যাত। পুল পেরোলেই ছিল আর একটা বর্ধিষ্ণু বাড়ি। বাড়ির সব গৃহ ইট-সুরকির দালান। দুর্গামণ্ডপ প্রকাণ্ড, তার সঙ্গে পাকা চিরস্থায়ী নাট্যশালা, যেখানে পূজার সময় নাটক হতো রোজ রাত্রে। দেওয়া হতো মোষ বলি অষ্টমী পূজার দিন। এ বাড়ির প্রধান মালিক ডা. রাধাকান্ত সেন মালয়ে সিভিল সার্জন, কলোনিয়াল মেডিকেল সার্ভিসের লোক। তিনি কদাচ কখনো গ্রামে আসতেন।

নির্মলকাকা এ বাড়ির মানুষ। থাকতেন সবচেয়ে ছোট দালানঘরে, তাঁর বাবা কলকাতার উকিল, তিনিও ওকালতি করেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি করেন স্বদেশী। সুভাষ বসু তাঁর নেতা। নাটকে বিশেষ উৎসাহ ছিল নির্মলকাকার। স্ত্রী লোকের ভূমিকায়, বিশেষ করে তেজী বিদ্রোহী ঝাঁসীর রানি, জাহানারা বেগম এসব ভূমিকায়, তাঁর নাটক প্রতিভা সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পেত।

সেন বাড়ির সংলগ্ন একটি প্রকাণ্ড আম বাগান। জনবিরল ছায়াপথ, জনপথ থেকে দূরে। এই নিরালা আম বাগানে গ্রামের ছেলেদের নিয়ে সভা করলেন নির্মল কাকা। দশ বারোটি যুবক সে সভাতে হাজির ছিল। আমরা তখনও বয়সের অপরাধে সভাতে আহুত হবার যোগ্য নই।

যুবকদের বেশিরভাগই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। দু’তিন জন স্কুলের পড়া শেষ করে—পাশ অথবা না-পাশ—কোনো কিছু কাজ করছে। যেমন, হেরস্ব শীল ম্যাট্রিক পরীক্ষা না দিয়েই তার বাবা গ্রামের ডাক্তার মহেন্দ্র শীলের সহযোগী হয়ে ডাক্তারি শিখছে, এক—আধটু ডাক্তারি করছেও। যেমন, অতুল ঘোষ ক্লাস নাইন থেকে স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক কেটে কিছুই না করতে পেরে ঘরে বসে আছে, বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ইচ্ছে আছে একটা দোকান খুলবার।

নির্মলকাকা যুবকদের সঙ্গে অনন্তদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

যা বললেন তার মর্মকথা হলো : সারা দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে তৈরি হচ্ছে। শাসক ইংরেজ হয়ে উঠেছে হিংস্র, বেপরোয়া। গ্রামে গ্রামে এবার তারা আক্রমণ করবে। নারীদের ইজ্জৎ থাকবে না। জোয়ান যুবকদের ধরে নিয়ে যাবে, বিনা বিচারে হবে বছরের পর বছর সশ্রম কারাবাস। অতএব গ্রামের যুবকদের আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি হতে হবে। অনন্তদা এসেছেন কলকাতা থেকে গ্রামের যুবকদের নিয়ে আত্মরক্ষা, সমাজরক্ষা বাহিনী তৈরি করতে।

লাইব্রেরির সংলগ্ন ব্যায়াম ক্ষেত্রে প্রতিদিন তিনি গ্রামের ছেলেদের ব্যায়াম শেখাবেন। দেহ শক্ত না হলে মন শক্ত হয় না। সপ্তাহে তিন দিন এই আমবাগানে তিনি শেখাবেন লাঠিলেখা, ছোরাখেলা, জুজুৎসু। স্বেচ্ছায় যারা শিখতে আসবে তাদেরই শেখানো হবে। এসব বিদ্যায় যারা পারদর্শী হবে তাদের শেখানো হবে পিস্তল চালানো। অনন্তদার কাছে এখন পিস্তল নেই। দরকার হলে উপযুক্ত সময়ে পিস্তল আসবে।

নির্মলকাকা জানতে চাইলেন, ক’জন ব্যায়াম ও লাঠি-ছোরা খেলা শেখার জন্য তৈরি। হাত তুলতে বললে, সবাই হাত তুলল। যদিও নির্মলকাকা বিলক্ষণ জানতেন, এদের অর্ধেকও শেষ পর্যন্ত আসবে না শিখতে।

অবশেষে নির্মলকাকা বললেন, গণেশপুরে পুলিশ থানা নেই। সবচেয়ে নিকটের পুলিশ থানা দশ বারো মাইল দূর। পাঁচ-ছয় মাইল দূরে ভোজেশ্বরে নতুন থানা খুলবার প্রস্তাব রয়েছে। অর্থাৎ ইংরেজ সরকার থানার সংখ্যা বাড়িয়ে গ্রামগুলোকে শায়েস্তা রাখার জন্য তৈরি হচ্ছে। তবু, আমরা থানা থেকে এখনও দূরে! এটা আমাদের মস্ত সুবিধে।

কিন্তু এই গণেশপুরেই পুলিশের গোয়েন্দা রয়েছে। সরকারি চৌকিদারকে বলা হয়েছে বাড়ি-বাড়ির উপর নজর রাখতে, সপ্তাহে তিন দিন পালং থানায় গিয়ে রিপোর্ট করতে। সম্ভবত চৌকিদারের সংখ্যা বাড়িয়ে এক থেকে তিন করা হবে। বাজারে দোকানদারের মধ্যে, জেলে পাড়ায়, মুচি পাড়ায়, গোয়েন্দাগিরির জন্য লোক খোঁজা হচ্ছে। দু’একজন ভদ্রলোকও এ ধরনের কাজে লিপ্ত হতে পারেন।

গণেশপুরের সুনাম বা দুর্নাম আছে দেশপ্রেমের। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় গণেশপুর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। রজনীকান্তকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কিছুদিন বিরা বিচারে তাঁকে জেলে থাকতে হয়েছিল।

নির্মলকাকা সবাইকে সাবধান করে দিলেন: তোমরা গোয়েন্দাদের বিষয়ে সতর্ক থাকবে। রাস্তায়, বাজারে একত্র হয়ে রাজনীতি বা আমাদের আত্মরক্ষী বাহিনী নিয়ে কোনো আলোচনা করবে না। চৌকিদার বা অন্য কারুর এই সব প্রশ্নে বিস্ময় প্রকাশ করবে। তোমাদের মধ্যে একজনও আজকের ও ভবিষ্যতের আমাদের কাজকর্মের কথা কাউকে বলবে না। বিশ্বাসঘাতকদের গুরুতর শাস্তি দেওয়া হবে। মনে রেখ, আমাদের নিয়ম নিজেদের উপরও নজর রাখা।

আমি এই মিটিং-এর বৃত্তান্ত জেনেছিলাম বছর খানেক পরে।

কিন্তু এই মিটিংয়ের তিন চার মাসের মধ্যেই ব্যায়াম, লাঠি ও ছোরা খেলা শিক্ষা গণেশপুরের যুবক ও কিশোরীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল।

আমার শারীরিক ব্যায়ামে ও খেলাধূলায় বিশেষ উৎসাহ ছিল না! কপাটি ছাড়া অন্য কোনো খেলাতে আমি তেমন যোগ দিতাম না। দু’দশবার ফুটবল খেলতে গিয়ে সারা মাঠ দৌড়ে একবারও বল শর্ট করতে না পেরে এবং গোলকিপার হয়ে বার বার গোল খেয়ে, খেলার উৎসাহ আমার আরও নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল।

আমিও লাঠি ছোরা খেলার দলে সামিল হয়ে গেলাম।

লাঠি তৈরি করে নেওয়া সহজ ছিল। গ্রামে বাঁশঝাড়ের অন্ত ছিল না। আমাদেরই বাগানে পাঁচটা বাঁশঝাড় ছিল, তার দুটোর মালিকানা আমাদের। পূর্ববঙ্গে বরা-বাঁশ লোহার মতো শক্ত, উই কাটতে পারত না সহজে। সাধারণ মানুষদের ঘর বাড়ির থাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো বরা-বাঁশ। যখন আমাদের মাসিক কুড়ি টাকার বাজেটে কড়া টান পড়ত, আমরা দু’একটা বাঁশ বেচে দিতাম প্রজাদের কাছে। এক একটা বাঁশ সেকালেও আট আনা থেকে বারো আনায় বিক্রি হতো।

বাঁশের ডাল কেটে তৈরি হয়ে গেল লাঠি। প্রত্যেক ছাত্র নিজের লাঠি তৈরি করে নিল।

ছোরা খেলার জন্য ছোট ছোট কাঠের ‘ছোরা’ তৈরি করা হলো। যুযুৎসু খেলারও শুরু হয়ে গেল।

অনন্তদা প্রতিদিন প্রশিক্ষার ভার নিতেন। শিক্ষা শুরু হবার আগে দেশপ্রেমের গান হতো সবার সমবেত কণ্ঠে ‘বন্দে মাতরম্’ ছিল প্রধান সংগীত। কখনো কখনো দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’।

যখনকার কথা লিখছি সেটা ১৯৩৪-৩৫। ১৯৩১ সালের ‘রাউন্ড টেবল’ ঘটে গেছে লন্ডনে— গান্ধী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কংগ্রেসে প্রতিনিধি দলের। ইংল্যান্ড তখন বাজে ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে লেবার-লিবারেশন কোয়ালিয়েশন সরকার দ্বারা শাসিত। সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া ছিলেন লর্ড ওয়েজউড্ বেন, লেবার পার্টির মন্ত্রী। তাঁর পুত্র টনি বেন উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত লর্ড উপাধি পরিত্যাগ করে লেবার পার্টির কার্যশালায় বহুদিন ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। টনি বেনকে আমি বন্ধুর পর্যায়ে রাখতে পারি।

১৯৯২ সালের জুন মাসে লন্ডনে তাঁর বাড়িতে এক প্রাতে সাক্ষাৎকারের সময় টনি বেন আমাকে দেখালেন তাঁর পিতা ভাইসরয় আরউইনকে যেসব ‘চিঠি’ লিখেছিলেন তাদের সংগ্রহ—পুরো পাঁচ ভলিউম, এখনও অমুদ্রিত। লর্ড ওয়েজউইড বেন ভাইসরয়কে মৃদু চাপ দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের স্বায়ত্তশাসন তরান্বিত করতে। প্রণয়ন শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৯৩৫ সালের ভারত প্রশাসন আইনের— যা পরে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট নাম দিয়ে অনুমোদন করে। এই আইনের পরিসীমার মধ্যে ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস ৯টি প্রদেশে গঠন করে সরকার। এই যে গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট স্বাধীন ভারতের সংবিধানে সন্দেহজনক ত্বরায় অনেকটাই ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন কংগ্রেসী নেতারা।

ভারতের স্বাধীনতা ছিল না ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বৈপ্লবিক বিচ্ছিন্নতা। প্রাদেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি কলোনিয়াল থেকে গিয়েছিল। আছে এখনও। স্বাধীন হবার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও, ইংরেজ আমলের বহু আইন প্রশাসনের চাকাকে দৃঢ় ও তেজী রেখেছে। স্বাধীন ভারতের সঙ্গে নাট্যমঞ্চ থেকে প্রস্থানকৃত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মর্মের ও দিলের মিল বজায় রাখছে।

এসব প্রসঙ্গে আমি বিস্তারিত ভাবে ফিরে আসব এই পিতৃ—কাহিনির দ্বিতীয় খণ্ডে। এখানে, পুত্র, তোমাকে বলে রাখছি, আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে পরাধীন ও স্বাধীন ভারতের অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ। আমাদের প্রজন্মেই স্বাধীন ভারতবর্ষ তৈরি করা হয়েছে, আমাদের পূর্বসুরি প্রজন্মের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। কি ধরনের ভারতবর্ষ আমরা তৈরি করেছি তার বিবরণ আমাদের জীবন ও অভিজ্ঞান কাহিনির একটা বিরাট অংশ। আমাদের প্রজন্মের যারা কিছু সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, উচ্চতা অর্জন করতে পেরেছে, তাদের জীবনের সঙ্গে স্বাধীন ভারতবর্ষের ধারাবাহিক যোগাযোগ।

আমরা সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়েছি। সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব ও রীতিনীতি থেকে মুক্ত হতে পারিনি।

ত্রিশ দশকে সারা ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে শক্তি দ্রুত বেড়ে উঠেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *