পিতা পুত্রকে – ২৮

আঠাশ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম.এ. পড়বার প্রথম বছরে তিনটি ঘটনা আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। প্রথম, ক্লাসে ক্লাসে ঢুকে ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে ছাত্র ফেডারেশনের সভা-সমিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের আহ্বান। দ্বিতীয়, আমার জীবনের প্রথম প্রেম, যে কাহিনি বলব একটু পরে। তৃতীয়, চাকরির সন্ধান।

চাকরির জন্য অনেকের সঙ্গে দেখা করলাম। আমাদের তখনকার সুব্রতদা, পরে যিনি বিজ্ঞাপন জগতে সুব্রত সেনগুপ্ত নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন, এ.আর.পি-র একজন হোমরা-চোমরা ব্যক্তি ছিলেন। এ.আর.পি. মানে ‘এয়ার রেড প্রিকশন’। অর্থাৎ শত্রু বিমান কলকাতার কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠবে বুক কাঁপানো সাইরেন এবং সবাই প্রাণ রক্ষার জন্য আশ্রয় নেবে একতলার সিঁড়ির নিচে, রাস্তায় বাফেলওয়াল ও ট্রেঞ্চে। সুব্রতদার কাছে চাকরির জন্য হাজির হলে তিনি এক সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সেই সাহেবের অফিসে আধঘণ্টা বসে থাকার পর মনে এমন ধিক্কার এল যে আমি হনহন করে বেরিয়ে গেলাম। তখন দরখাস্ত করলেই মিলিটারি একাউন্টসে কেরানির চাকরি পাওয়া যেত। আমার দু-তিনটি সহপাঠী এই চাকরি পেয়েওছিল। আমিও দরখাস্ত করলাম, চাকরির নিয়োগপত্র এসে গেল। কিন্তু কেরানি হিসেবে জীবন শুরু করব এই নিশ্চয়তা আমার এমন তিক্ত মনে হলো যে আমি নিয়োগপত্র ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। মনে আছে এক সুখ্যাত ইংরেজ আই.সি.এস, আর্থার হিউজ—এর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি যুদ্ধে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ ধার্য করার জন্য স্থাপিত একটা বড় অফিসের প্রধান। হিউজ সাহেব সুন্দর বাংলা বলতেন। আমার বক্তব্য শুনে ও পরীক্ষার রেজাল্টবাহী কাগজপত্র দেখে পরিষ্কার বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, “জীবন এমনি করে নষ্ট কর না। চাকরি আমি এখুনি তোমাকে দিতে পারি; কিন্তু কেরানি হয়ে শুরু করলে কোথায় পৌঁছবে? বেশিরভাগ কেরানি হয়েই জীবন শেষ করে। তুমি এম.এটা পাস করে নাও।”

এমন সময় একদিন মার্কাস গ্রে’র একখানা চিঠি হাতে এল। লিখেছেন, “ইয়ান স্টিফেন্সকে তোমার কথা লিখেছি। তুমি তার সঙ্গে সত্বর দেখা কর।”

আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেটস্ম্যানস হাউসের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড বাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। হৃদকম্পের শব্দ নিজের কানে ধাক্কা মারতে লাগল। মনে মনে ভাবলাম এ বাড়িতে ঢুকে স্টিফেন্স সাহেবের সঙ্গে দেখা করে চাকরি সংগ্রহ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

বাবা-মা, ভাই-বোন তখন সবাই থাকে খুলনায়। আমিও গেলাম তাদের কাছে। সাত দিন থেকে মনটা ভীষণ বিগড়ে গেল। এতটুকু সাহস আমার নেই যে ‘স্টেটসম্যানের’ এডিটরের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে পারি? বাবা বলেছিলেন, আইসিএস, বিসিএস, কম করে ভারত সরকারের অ্যাসিস্টেন্টের পরীক্ষাটা দিয়ে দাও— এটাও খুব ভালো চাকরি।

ছোটবেলা থেকে ইংরেজ সরকারের চাকরি করব না, একরকম প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলাম।

কলকাতায় ফিরে এলাম। ‘স্টেটস্ম্যান’ অফিসে যাওয়ার মতো আমার না আছে প্যান্ট, না শার্ট, না জুতো। স্কটিশে পড়ার সময় জীবনে সর্বপ্রথম যে দুটি প্যান্ট তৈরি করিয়েছিলাম বিবেকানন্দ রোড ও কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের মোড়ে ‘রায় অ্যান্ড রায়’ দর্জির দোকানে, তার একটাও তখন পরার মতোন নয়।

পিসতুতো ভাইয়ের কাছ থেকে প্যান্ট ধার করে নেওয়া হলো। তিনি একটা শার্ট দিলেন। আমার খুড়তুতো ভাই বাদলের জুতো দেখা গেল পায়ে বেশ লেগে যায়।

এভাবে বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে পাহাড় প্রমাণ সাহস সঞ্চয় করে ‘স্টেটস্ম্যান হাউস’-এর দরজা পেরিয়ে কাচের ঘূর্ণি দরজার মধ্যে দিয়ে একতলায় ঢুকে গেলাম। দেখলাম ডান ও বাঁ দু’দিকে তিনজন করে কাজ করে যাচ্ছে। একটু লক্ষ্য করে বোঝা গেল এরা খুচরো বিজ্ঞাপন নিচ্ছে। এদের মধ্যে একজন প্রায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক, আমার মনে হলো, উপরতলার সাহেবদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মাধ্যম।

আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোকের দীর্ঘ একজোড়া পাকা গোঁফ। মাথার চুলও সাদা। চোখে পুরু কাচের চশমা।

চশমাটা নাকের মাঝখানে। চশমার উপর দিয়ে দুটি চোখ আমার দিকে নিক্ষেপ করে তিনি বললেন, অবশ্যই ইংরেজিতে, “কী চাই তোমার?”

আমি বললাম, “আমি মিস্টার ইয়ান স্টিফেন্সের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

ভদ্রলোকের চোখদুটি আমার আপাদমস্তক বার বার দেখে নিল। প্রশ্ন হলো, “এপয়েন্টমেন্ট আছে?”

“আজ্ঞে না।”

ভদ্রলোক তক্ষকের ডাকের মতো শব্দ করে হেসে উঠলেন। গুরুগম্ভীর স্বরে আমাকে বললেন, “স্টেটসম্যানে’র এডিটর এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করেন না। আপনার সঙ্গে দেখা হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।”

আমার তখন জিদ চেপে গেছে।

“স্টিফেন্স সাহেবের বন্ধু অধ্যাপক মার্কাস ডি. গ্রে আমাকে লিখেছেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। এই দেখুন চিঠি। হয় আমাকে উপরে যেতে দিন, নয় স্টিফেন্স সাহেবকে ফোন করে আমার এপয়েন্টমেন্ট পাইয়ে দিন।”

ভদ্রলোক আবার কিছুক্ষণ আমার আপাদমস্তক দেখে নিল।

একটা স্লিপ আমার হাতে দিয়ে বললেন, “নাম লিখুন আর সঙ্গে ওই প্রফেসর গ্রে’র চিঠিটাও গেঁথে দিন।”

দেওয়া হলো। ভদ্রলোক আমাকে বসতে বললেন না। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। এক পেয়াদা আমার নাম ও অধ্যাপক গ্রে-র চিঠি নিয়ে উপরে চলে গেল।

মিনিটপাঁচেক পরে সে ফিরে এল। ভদ্রলোককে বলল, “সাহেব একে সেলাম দিয়েছেন।”

এতক্ষণে আমার ভদ্রলোকের নাম মনে পড়েছে। মনমোহনবাবু—এবার আমার দিকে বিস্ময় ও অসন্তোষের দৃষ্টি হানলেন, বললেন, “যান এর সঙ্গে।”

বেয়ারার পিছু পিছু আমি লিফট-এ চড়ে দোতলায় উঠলাম। সে আমাকে একটা প্রকাণ্ড ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের চার দেওয়ালে বার্মাটিক কাঠের তৈরি শেল্ফ-এর উপর কেবল বই আর বই। ঘরে দুটো সোফাসেট। দুটোরই মাঝখানে কাচের টেবিলের উপর দুই প্রকাণ্ড ফুলের স্তবক। কার্পেটে সারা মেঝে আবৃত। শুধু ঝকঝকে পরিষ্কার নয়, সমস্ত পরিবেশ নিস্তব্ধ। একপাশে এডিটরের কক্ষ। দরজার কাছাকাছি বসে আছেন এক ভদ্রলোক একটা প্রকাণ্ড টেবিলের সামনে, যার কাছে বেয়ারা আমাকে হাজির করল।

ভদ্রলোক উঠে করমর্দন করলেন। বললেন, “আমার নাম রবার্ট মেডমেন্ট, আমি এডিটরের পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট এবং ‘স্টেটম্যানে’র অ্যাসিসটেন্ট এডিটর। মিস্টার স্টিফেন্স তোমার সঙ্গে দেখা করবেন, কিন্তু একটু অপেক্ষা করতে হবে।”

আমি দেখতে পেলাম মেডমেন্টের দেহের বর্ণ তামাটে, উচ্চারণও ঠিক সাহেবদের মতো নয়। অনুমান করে নিলাম ইনি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। বললাম, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে এসে হাজির হয়েছি। নিশ্চয়ই অপেক্ষা করব। “

এমন সময় পাশের দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন দীর্ঘকায় এক পুরুষ। মাথার চুল বিরল হতে শুরু করেছে, দীর্ঘ নাক, লম্বা মুখখানার চোয়াল চওড়া। চিবুক একটা প্রাচীরের শেষাংশ। হাতে একগাদা প্রুফ। মেডমেন্টের সঙ্গে দু’চারটে কথা বলে প্রুফগুলো তাঁর টেবিলের উপরে রাখলেন। তখন নজরে পড়ল অদূরে দণ্ডায়মান আমার উপর। বলে উঠলেন, “ও এই হচ্ছে সেই ছেলেটি, তুমি আমার ঘরে বসো।”

এডিটরের ঘরও বেশ বড়সড়। সমস্ত ঘরে কাগজপত্র আকর্ষণীয় বিশৃঙ্খলার সঙ্গে ছড়িয়ে আছে। কয়েকটি চেয়ারের উপর স্তূপাকার বই, একপাশে একটা টেবিলের উপর একরাশি পেপার ক্লিপিং, কালো মলাটে একই সাইজে বাঁধানো, প্রত্যেক খণ্ডের শিরদাঁড়ায় প্রত্যেক খণ্ডের নাম ও নির্ধারিত সময় লিখিত।

ইয়ান স্টিফেন্স কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাইপস পেয়ে কিছুদিন ওখানকারই একটা কলেজে প্রথমে টিউটর পরে লেকচারার হয়েছিলেন। দৈর্ঘ্যে ছয় ফুট দু’ইঞ্চি, কৃশ মজবুত শরীর। যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করল তা হলো তার দুই ঘন গভীর নীল চোখ। আমি নীলা পাথর দেখেছি, কিন্তু এ যেন সাগরের গভীর জলের নীলটুকু পাথরে রূপান্তরিত! গভীর নীল চোখদুটি অতিশয় জীবন্ত। মুখের ভাষার চেয়ে চোখের ভাষা ত্বরান্বিত ও স্বচ্ছ।

চল্লিশ দশকের প্রথমে ইয়ান স্টিফেন্স ভারত সরকারের প্রিন্সিপ্যাল ইনফরমেশন অফিসার হয়ে দিল্লিতে আসেন। পেশায়, অতএব তিনি সাংবাদিক ছিলেন না। যুদ্ধের শেষদিকে দীর্ঘকালীন সম্পাদক আর্থার মূরের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের মতান্তর ঘটে পত্রিকার ভারতনীতি নিয়ে। আর্থার মূর চেয়েছিলেন ইংরেজ সরকার যুদ্ধান্তে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্বন্ধে অঙ্গীকারে নিবদ্ধ হোন। কংগ্রেসেরও দাবি তাই ছিল। ‘স্টেটস্ম্যানে’র কর্তৃপক্ষ আর্থার মূরের কংগ্রেসী গন্ধ পেতে লাগলেন ১৯৪৩ সাল থেকে। সে বছর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আশুতোষ হলে ছাত্র ও অধ্যাপকদের এক সভায় আর্থার মূরকে নিমন্ত্রণ করে ‘মহাযুদ্ধ ও ভারতবর্ষ’ বিষয়ে তাঁর বক্তৃতা শোনবার পরিকল্পনা হয়েছিল। আর্থার মূরকে নিমন্ত্রণ করতে যাবার দায়িত্ব পড়েছিল যে তিনটি ছেলের উপর, আমি তাদের মধ্যে একজন। আমরা তাঁর সঙ্গে ক্যালকাটা ক্লাবে দেখা করেছিলাম। কথাবার্তার বেশির ভাগটাই ছাত্রদের পক্ষ থেকে চালাতে হয়েছিল আমাকে। আর্থার মূর কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলেন, যার তাৎপর্য ছিল যুবকরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্বন্ধে কী ভাবছে। জবাবে কী বলেছিলাম তা মনে নেই, মনে আছে তিনি বেশ খুশি হয়েই বক্তৃতা করতে যেতে রাজি হয়েছিলেন।

সভা উপলক্ষে ‘আশুতোষ হল’ জনাকীর্ণ। আর্থার মূর নিজেই চলে এসেছিলেন। ইউনিভার্সিটি গেটে আমরা তাঁকে অভ্যর্থনা করেছিলাম, মালা পরিয়ে নয়, নমস্কার করে। জনাকীর্ণ আশুতোষ হল তাঁকে খুব খুশি করেছিল। সভার কাছে আর্থার মূরের পরিচয় দেবার ভার ও পড়েছিল আমার উপর। তিনি তাঁর বক্তৃতা শুধু লিখে নয়, ছাপিয়ে এনেছিলেন। তার কয়েকশো কপি সভায় উপস্থিত লোকেদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। সেই বক্তৃতার কয়েকটা অংশে আর্থার মূর পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, মিত্র শক্তির আটলান্টিক চার্টার এবং ফোর ফ্রিডমস্—অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসন হতে ক্ষুধা অশিক্ষা ও অস্বাস্থ্য থেকে মুক্তি যদি ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত না হয় তাহলে ইতিহাসে হয়ে দাঁড়াবে কয়েকটি ফাঁকা আওয়াজ। উচ্ছ্বসিত করতালির মধ্যে আর্থার মূরের বক্তৃতা শেষ হয়েছিল।

ফিরে যাবার সময় তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আমি আর বেশিদিন ‘স্টেটস্ম্যানে’র এডিটর থাকব না। তোমার যদি জার্নালিজম করার ইচ্ছা থাকে তুমি নতুন এডিটর ইয়ান স্টিফেন্সের সঙ্গে দেখা কর।”

.

ইয়ান স্টিফেন্স খুব তাড়াতাড়ি কথা বলেন, ফলে আমার পক্ষে বুঝতে অসুবিধা হয়। তবু বুঝতে পারলাম তিনি আমাকে বলছেন, “মার্কাস গ্রে’র চিঠি এসেছে প্রায় দশদিন হলো। তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?”

“খুলনা শহরে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ওখানে আমার বাবা-মা, ভাই—বোন বাস করেন!”

“পালিয়ে গিয়েছিলে কেন?”

“ভয়ে। আপনার সঙ্গে দেখা করার সাহস হচ্ছিল না।”

হেসে উঠলেন ইয়ান স্টিফেন্স। বললেন, “এখনও ভয় করছে?”

“না।”

“তাহলে তুমি কিছুক্ষণ ওই কোণের চেয়ারটায় বসো। আমার হাতে কিছু জরুরি কাজের চাপ আছে। এগুলো শেষ করে তোমার সঙ্গে কথা বলব। ওখানে আজকের পত্রিকাগুলো সবই আছে। যেটা ইচ্ছা পড়তে পার।”

প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল জরুরি কাজ থেকে মুক্তি পেতে ইয়ান স্টিফেনের। এর মধ্যে তিন-চারবার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলেন। দু’বার তাঁর সেক্রেটারি মিস কেলিকে ডেকে ডিকটেশন দিয়েছেন। অন্তত পাঁচ-ছ’জন লোক তাঁর ঘরে ঢুকে সংক্ষিপ্ত বাক্য বিনিময়ে কাজের নির্দেশ নিয়ে প্রস্থান করেছেন। তিনবার টেলিফোনে কথা বলতে হয়েছে তাঁকে।

আমার মণিবন্ধে কাকামণির ঘড়ি। তার উপর আমার সজাগ দৃষ্টি। ঠিক আধঘণ্টা পর স্টিফেন্স আমাকে বললেন, “এসো, আমার সামনে বসো। এবার আমরা কথা বলি।”

সামনাসামনি বসতে তিনি বললেন, “মার্কাস গ্রে আমার সহপাঠী ও বিশেষ বন্ধু। টমোড়ি হোস্টেলে তার বাড়িতে আমি অনেকবার গেছি। তোমার মনে নেই, কিন্তু আমার মনে আছে, দু’বার অধ্যাপক গ্রে’র বাড়িতে আমি তোমাকে দেখেছি।”

“অধ্যাপক গ্রে আমাকে খুব স্নেহ করেন।”

“শুধু তাই নয়, তোমার খুব প্রশংসাও করেন। কিন্তু তাঁর পত্রে তিনি লিখেছেন যে তুমি কমিউনিস্ট। তুমি কতখানি কমিউনিস্ট?”

“আমি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য নই। ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। আমি নিজেকে কমিউনিস্ট বলি না। বরং মার্কসিস্ট বলি।”

“দুটোতে তফাত কী?“

“কমিউনিস্টরা বিপ্লবী সংগ্রামে সংযুক্ত। আমি তা নই। আমার মধ্যে বিদ্রোহ নেই। প্রতিবাদ আছে। মার্কসিষ্ট মানে সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষণ করার একটা নির্ভরযোগ্য পথ।”

“স্টেটস্ম্যান কমিউনিস্টদের পছন্দ করে না। কিন্তু এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েট ইউনিয়ন মিত্রশক্তিদের অন্যতম। আমাদের মধ্যে বর্তমানে কোনো ঝগড়া নেই। তোমার মার্কসিজম্ বা কমিউনিজম আমার কাছে বর্তমানে আপত্তিকর কিছু নয়। এখন বল আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?”

আমি খুব সংক্ষেপে নিজের অবস্থার বর্ণনা করলাম। বললাম, “এখন পরীক্ষাটা শেষ করার খুব ইচ্ছে। আমি কি ‘স্টেটস্ম্যানে’ বুক রিভিউ বা ছোটখাটো কিছু লিখতে পারি? তাহলে আমার পড়ার খরচটা এসে যায়।”

স্টিফেন্স বললেন, “দুটোর একটাও সম্ভব নয়। যুদ্ধ পত্রিকার সাইজকে কী রকম ছোট করে দিয়েছে তা তো তুমি জান। বুক রিভিউ আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। দিল্লি ও কলকাতা অফিসের স্টাফদের লেখার জায়গা দিতে পারছি না।”

আমার মুখে নৈরাশ্যের কালো মেঘ দেখে ইয়ান স্টিফেন্স বললেন, “স্টেটম্যানে’ লেখবার সুযোগ নেই। কিন্তু চাকরি হতে পারে। হোয়াট অ্যাবাউট এ জব হিয়ার?”

এবার আমার বাক্যহীনতা একেবারে অন্য কারণে!

একটু পরে বললাম, “অতটা আশা করার মতো সাহস আমার একেবারে ছিল না। “

“এখুনি কিছু হবে না। তবে দু-তিন মাসে আমরা একজন সাব—এডিটর নিতে পারি। অন্য কিছু সম্ভাবনাও ঘটতে পারে। তুমি মিস্টার মেডমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। আর এখন তুমি দেখা করবে আমাদের নিউজ এডিটর অ্যালেক রীডের সঙ্গে।”

আমি ধন্যবাদ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। স্টিফেন্স নিজেই আমাকে মেডমেন্টের টেবিল পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। যাবার আগে বললেন, “আর একজন লোক তোমার কথা আমাকে বলেছেন।”

আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতে তিনি বললেন, “শুনে একটু অবাক হবে— তার নাম আর্থার মূর।”

মেডমেন্টের কাছে আমাকে নিয়ে এসে স্টিফেন্স বললেন, “এই ছেলেটি তোমার সঙ্গে সংযোগ রাখবে। এখন ওকে রীডের কাছে পাঠিয়ে দাও।”

অ্যালেক রীড স্কটল্যান্ডের মানুষ। বিরাট চেহারা। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে কথা বলেন। শাসক ইংরেজ সমাজে তিনি ঘোরতর অপরাধ করেছিলেন এলা সেনকে বিবাহ করে। এলা সেন পাণ্ডিত্য ও সুরুচির জন্য সারা দেশে সুপরিচিত। শুনেছি দু’চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া সাহেবরা বিবাহে যোগ দেননি। রীড সাহেব শ্বশুরবাড়ি ভারতবর্ষের উপর অনুচিতভাবে আকৃষ্ট। শাসক সমাজে তাঁর জন্য চেয়ার পাতা নেই।

একজন পেয়াদা আমাকে রীড সাহেবের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘোঁৎ ঘোঁৎ স্কটিশ উচ্চারণ বুঝে নিতে আমার তো বিশেষ বিপদ। রীড সাহেব প্রশ্ন করলেন, “তুমি কী ধরনের কাজে উপযুক্ত?”

আমি বললাম, “সব কাজেরই। কেননা কোনো কাজই আমি এখনও করিনি।”

মুখের বিকৃতি দেখে মনে হলো রীড সাহেব হাসলেন।

“কত মাইনে আশা কর?”

এবার আমি সত্যিকারের বিপদে পড়লাম। দেখলাম গলা শুকিয়ে গেছে, তবু সাহসে বুক বেঁধে বললাম, “ষাট টাকা।”

এবার রীড সাহেব ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে হেসে উঠলেন। বললেন, “স্টেটম্যানে’ দেড়শো টাকার কমে মাইনা হয় না। উইল দ্যাট বী টু লিটল ফর ইউ?”

“নো স্যার, বাট ইট উইল নট বী টু মাচ ফর মী।”

রীড সাহেব বললেন, “আমার প্ল্যান আছে একটি রেফারেন্স সেকশন খোলার। তুমি তার দায়িত্ব নিতে পারবে?”

“পারব।”

“এখনও প্ল্যান ফাইনাল হয়নি। মাসখানেকের মধ্যে তুমি জানতে পারবে।”

এই এক মাসের মধ্যেই অনেক কিছু পারিবারিক পরিবর্তনস হয়েছে। কাকামণি পুনরায় চাকরি পেয়ে পাঞ্জাব চলে গেছেন। আমি বাস করছি পিসিমার সঙ্গে। একদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরতে পিসিমা আমার পিঠে হাত দিয়ে তাঁর নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বুঝিয়ে—সুঝিয়ে যা বললেন, তার মানে হলো জীবনে অনেক ব্যর্থতা আসে, তাতে ঘাবড়াতে নেই।

এবার আসল খবরটা ভাঙলেন। রীড সাহেব দুঃখ জানিয়ে একটি ছোট চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটি আমি পড়লাম। “আমাদের রেফারেন্স সেকশন খোলবার প্ল্যান পরিত্যক্ত হয়েছে। সুতরাং এখানে তোমার চাকরির সম্ভাবনা নেই। আমি বিশেষ দুঃখিত।”

দু’দিন পরে আমি সোজা মেডমেন্টের অফিসে গিয়ে হাজির। তিনি বললেন, “তোমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এডিটর তোমার সম্বন্ধে বেশ খুশি। একটা কিছু হয়ে যাবে।” একটু থেমে বললেন, “আসলে হয়েই যেত। একটা সাব-এডিটর পদ খালি ছিল, কিন্তু দিল্লি থেকে একজন নিয়োগ করতে হলো।”

আমি বললাম, “আমার সহনশীলতার বাকি নেই। আমি আপনাদের এই বিরাট অফিসে যে কোনো পদে, যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, শুরু করতে রাজি। শুধু আমার জন্য উপরে ওঠার দরজা যদি খোলা থাকে।”

জীবনে কীসে কী হয়ে যায়। কোন্ কথা কীভাবে কার মনে কী প্রতিধ্বনি তোলে, এ প্রশ্নের শেষ নেই। মেডমেন্ট সাহেব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, বললেন, “ইয়ংম্যান, পঁচিশ বছর আগে ঠিক এই কথা বলেই আমি এই অফিসে কাজ পেয়েছিলাম। পঁচিশ বছর পর তোমার মুখে শুনতে পেলাম সেই কথা। তুমি প্রুফ রিডার হিসেবে ঢুকতে রাজি আছ?”

“আছি।”

মেডমেন্ট সাহেব আলেক রীডকে ফোন করলেন। আমাকে বললেন, “গো অ্যান্ড সী মিস্টার রীড।”

আমি রীড সাহেবের ঘরে ঢুকতেই তিনি আমাকে বললেন, “কাছে এসে এই চেয়ারটায় বসো।” বসলে বললেন, “আমাদের এখুনি একজন প্রুফ রীডার চাই। তুমি প্রুফ রিডিং জানো?”

“না। কিন্তু চিহ্নগুলো জানা আছে। খুব বেশি হলে তিন-চার দিন সময় লাগবে।”

“বেশ, কাল থেকে জয়েন কর। নাইট ডিউটি। রাত্রি ন’টা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত। তোমাকে নিজেই আসতে হবে। অফিসের গাড়ি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।”

আমি অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

রীড সাহেব বললেন, “কত মাইনে পাবে তা তো জিজ্ঞেস করলে না?”

“আপন বলেছিলেন এ অফিসে দেড়শো টাকার নিচে কোনো মাইনে শুরু হয় না। মাইনে ঠিক করবেন আপনি। আমি কাজটা তো ভালো করে শিখি।”

রীড সাহেব বললেন, “তোমার স্টার্টিং স্যালারি একশো পঁচাত্তর টাকা। এক বছরের প্রবেশন। এক বছর ভালো কাজ করলে সাব—এডিটর হবার সম্ভাবনা। স্টেটস্ম্যান থেকে সস্তায় রেশন ও ধুতি কাপড় দেওয়া হয়। এখন তুমি আসতে পার।”

শুরু হলো আমার কর্মজীবন। সাংবাদিকতা। তিন মাস প্রুফ রিডিং চলল। এবং তারই মধ্যে বুঝতে পারলাম অন্তত নিউজ রুমে ভারতীয়দের সম্মান নেই। তিন মাস যেদিন শেষ হবে সেদিন সকালে স্টেটসম্যানের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় রকমের ভুল চোখে পড়ল, যার দায়িত্ব আমার। সারাদিন কাটল ভয়ে ভয়ে, দুশ্চিন্তায়। রাত্রে অফিসে এসে সোজা প্রুফ রীডারদের ঘরে ঢুকে আমার টেবিলের উপর রাখা প্রুফ পড়তে শুরু করলাম।

রীড সাহেব ঠিক রাত ন’টায় দ্বিতীয়বার অফিসে আসতেন, থাকতেন এগারেটা কি বারোটা পর্যন্ত। বেশ খানিকটা মদ্যপান করে আসতেন। বড়সড় কুমড়োর মতো মুখখানা ভীষণ থমথমে ও রক্তবর্ণ দেখাত। কথা বলতেন খুব কম।

বেয়ারা এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “রীড সাহেব সেলাম দিয়েছেন।”

আমার বুক ভীষণ কেঁপে উঠল। নির্ঘাত চাকরি থাকবে না। প্রবেশন বছরের মাত্র এক-চতুর্থাংশ কাটানো গেছে। এবার আবার রাস্তায় দাঁড়াতে হবে।

রীড সাহেবের ঘরের দরজায় মৃদু আঘাত করলাম। ভিতর থেকে যেন হুঙ্কার এল, “কাম ইন।”

আমি ভিতরে গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াতে তিনি বললেন, “আজ তো শনিবার, না? তুমি কাল ছুটি নাও, পরশু থেকে তুমি সাব-এডিটর।”

আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, বিহ্বল হয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

রীড ভাবলেন, তাঁর কথা বুঝতে পারিনি। পুনরায় একটু আস্তে আস্তে সেই কথাগুলো বললেন।

এতক্ষণে আমার মুখে কথা এল। আমি বললাম, “আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”

রীড বললেন, “ধন্যবাদ দিও তিন মাস পরে। তোমার তিন মাসের প্রবেশন। হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি তোমার মাইনে হবে আড়াইশো টাকা।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *