পিতা পুত্রকে – ২৭

সাতাশ

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে সরগরম। একদিকে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের উত্তাপ, অন্যদিকে সুভাষ বসুর আইএনএ এনেছে দারুণ উত্তেজনা এবং ঐ দুইয়ের মাঝখানে কমিউনিস্ট পার্টির গণযুদ্ধ আন্দোলন। আমি এক গোঁড়া ব্ৰাহ্মণ বাড়িতে একটি কলেজ ছাত্রী ও দুটি উঁচু ক্লাসের স্কুল ছাত্রছাত্রী, এই তিন ভাই বোনের গৃহশিক্ষক। দশ টাকা মাইনে ছিল এমএ পড়ার জন্য, সেটাও প্রতি মাসে দেওয়া সম্ভব হতো না। ছাত্র ফেডারেশন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোর বিরুদ্ধে, অতএব জাতীয়তাবাদ বনাম কমিউনিস্ট সংঘর্ষ তীব্র। এ সংঘর্ষ অবশ্য আজকালকার মতোন হাতাহাতি ঘুষোঘুষি বন্দুক-পিস্তলবাহীতে পরিণত হয়নি; তর্ক-বিতর্ক, সভা-প্রতিসভা, মিছিল-প্রতিমিছিল, পোস্টার ও হ্যান্ডবিল বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পরের জীবনে ভাবলে মস্তিষ্ক অবশ হয়ে আসত যে নেতাদের প্রদত্ত সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করবার অধিকার বা প্রয়োজন পার্টি কর্মীদের ছিল না, আমার মতো যারা পার্টির সক্রিয় সমর্থক তাদের তো নয়ই। অনেক বছর পরে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা যখন স্বীকার করলেন যে সমগ্র চল্লিশ দশকে তাঁদের রাজনীতি ভুল পথে চলেছে, তখন ক্ষয়ক্ষতি হিসেব করার মতো সৎসাহস থাকলেও রাজনীতির প্রধান স্রোত থেকে কমিউনিস্টদের যে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে সেজন্য খুব বড় রকমের দাম কাউকে দিতে হয়নিস। পি.সি. যোশী পদত্যাগ করলেন। ‘পিপলস ওয়ার’ সাপ্তাহিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। “দৈনিক স্বাধীনতা” পত্রিকার তেজ ক্রমশ কমে এল। কমিউনিস্ট পার্টি হঠাৎ যুদ্ধ সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে দেশ বিভাগেরও প্রচণ্ড অথচ নিষ্ফল প্রতিরোধ ঘোষণা করল। তাতে ঘটনার অগ্রগতি ব্যাহত হলো না।

বলেইতোছি, চল্লিশ দশক ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, ঘটনাবহুল জীবন-কাঁপন দশক। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ সোজাসুজি পাকিস্তান দাবি করে বলল, “সে দাবি কমিউনিস্টরা কিছুটা সমর্থন করল। তারপর ক্যাবিনেট মিশন। ক্যাবিনেট মিশনের মস্তিষ্ক থেকে একের পর এক ভারত সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা। তা নিয়ে, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলগুলোর নেতাদের দিবারাত্রি জল্পনা। তার আগেই ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন, কংগ্রেসের মধ্যে জঙ্গিপন্থি সমাজবাদী নেতাদের আহ্বানে ভারতবাসীর মনে ইংরেজ খেদাও সংকল্পের কিছু দৃঢ়তা। তারপর আইএনএ। আইএনএ ছিল ভারত রঙ্গভূমিতে এক বিরাট অভিনীত নাটক। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আইএনএ-র কিছু সৈন্য মণিপুর রাজ্যের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু সেখানে ইংরেজ তাদের প্রতিরোধে সক্ষম হলো। দু’বার কলকাতায় জাপানি বিমান দু-তিনটে বোমা নিক্ষেপ করে বার্মায় পলায়ন করল। কলকাতার অর্ধেক লোক পালিয়ে গেল গ্রামে-গঞ্জে জিলা শহরে। তিন মাসের জন্য আমিও পালিয়েছিলাম ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের একটি গ্রামে, আমার কাকার পরিবারের সঙ্গে। যুদ্ধ বাধবার দু-তিন বছরের মধ্যেই কাকামণির বাহওয়ালপুর কলেজের চাকরি চলে গিয়েছিল, তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তিন মাস পরে কলকাতা শহরে ফিরে আসার ঘটনাটা আমার মনের পর্দায় এখনও পরিষ্কার। বেশিরভাগ রাস্তাঘাট জনশূন্য, মধ্য ও উত্তর কলকাতার অনেক বাড়ি খালি। ইউনিভার্সিটির ছাত্রসংখ্যা কমে এক-চতুর্থাংশে দাঁড়িয়েছে। তারপর একদিন ঘটল সেই মহা দুর্ঘটনা, প্রধানমন্ত্রী শহিদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতিশ্রুতি অনুসারে কলকাতায় ডাইরেক্টর অ্যাকশান। হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান একে অন্যকে পিটিয়ে মারল। মারল ছোরার আঘাতে, দেশি বন্দুকের গুলিতে। মানুষগুলো হঠাৎ হয়ে গেল সশস্ত্র হিংসায় প্রাণবন্ত পশু। মহাত্মা গান্ধী কলকাতায় এলেন দাঙ্গা থামাতে। শুরু করলেন আমরণ অনশন। এক অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের আলো নেমে এল কলকাতার বুকে। দাঙ্গা গেল থেমে। শত শত মানুষ তাদের সঞ্চিত অস্ত্র বহন করে বেলেঘাটায় গান্ধীর অনশন ব্রতের আশ্রমে বিনা শর্তে সমর্পণ করল।

এসব ঘটনাগুলো স্মৃতিচারণের বস্তু নয়। এরা ভারত রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি। ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী হিসেবে ছোট ছোট দলের সঙ্গে দাঙ্গা—দগ্ধ কয়েকটি পল্লিতে ‘জনসেবা’র জন্য গিয়েছিলাম। শান্তির বাণী ও শান্তির জল সঙ্গে করে, এখনও আমার মনে আছে মানুষের বীভৎস বিপন্ন চেহারা, তার চেয়ে ভয়ানক, তাদের মারমুখী মানসিকতা। সারা ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে একটি মহামানুষ এই নিদারুণ বীভৎস ভূমিকম্পের মর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যেদিন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো। তিনি, জাতির পিতা, রাজধানীর বহুবর্ণ জৌলুস থেকে অনেক দূরে বিহারের গ্রামে গ্রামে মানুষের বুকের লেলিহান আগুন নির্বাপণের চেষ্টায় ব্যস্ত। স্বাধীনতা তাঁকে আনন্দ দেয়নি, দিয়েছে বেদনা। তিনি চাননি স্বাধীনতা আসুক এই ভয়াল রক্তাক্ত পথে। স্বাধীনতা তাঁর সারা জীবনের স্বপ্নকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমার স্থান দিল্লিতে নয়, এখানে এই বঙ্গে, বিহারে, যতদিন মানুষ মানুষকে মারবে। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল, ওখানে যে অনেক উৎসব হচ্ছে! তিনি ব্যথাভরা স্বরে জবাব দিয়েছিলেন, হতে দাও। ওখানে যা হচ্ছে তা হোক, ও সব আমার জন্যে নয়।

পরিণত বয়সে একই সঙ্গে আশ্চর্য ও লজ্জার সঙ্গে আমি দেখতে পেয়েছিলাম যে চল্লিশ দশকের ঘোর রক্তিম প্রভঞ্জন বাঙালির সৃষ্টিশীল মানসিকতার উপরে খুব কমই প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। বুদ্ধদেব বসু ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে এক উগ্র-রাজনীতিক মতবাদের বলিষ্ঠ স্বামীর সঙ্গে একটি সাধারণ দুর্বল বাঙালি কন্যার বিবাহ ঘটিয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র ১৯৪১ সালে লিখিত একটি গল্পসংগ্রহে মহানগরীর প্রান্তশায়িনী নদীর অতি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছিলেন, এক মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি ও কুহেলিগুণ্ঠিত তুষার পরিবেশে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘সত্যাসত্য’ উপন্যাসের শেষ খণ্ড প্রকাশিত হলো ১৯৪২ সালে, গান্ধীবাদে এমন ভাবপ্লাবন অন্য কোনো বাংলা উপন্যাসে তার আগে বা পরে দেখা যায়নি। ‘উজ্জয়নী’কে কেউ কেউ ভারতবর্ষের নারী আন্দোলনের উদ্যোক্তার ভূমিকায় দেখেছেন। কিন্তু ছ’খানা উপন্যাসের একখানাতেও ৩২ থেকে ৪২ এই দশ বছরের জটিল ও সাংঘাতিক ভারতীয় অভিজ্ঞতার ছায়া বিশেষ নেই। বাদল, উজ্জয়নী, সুধী দে সরকার, অশোকা সবাই কোনো এক প্রাচীন পথের পথিক, নতুন কোনো পথের জন্য দিকভ্রান্ত অন্বেষণ। তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘মনন্তর’ : সবই চল্লিশ দশকের লেখা। এঁদের মধ্যে আছে অসহযোগ সংগ্রাম, সন্ত্রাসবাদ, জমিদারদের অবক্ষয়, চাষির প্রথম সমবেত সংগ্রাম, কিছুটা তরল মার্কসবাদ। “হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’য় দেখতে পাই নীচু স্তরের মানুষ উচ্চবৰ্ণ হিন্দুদের প্রভাব ও নেতৃত্ব বিনা বিদ্বেষে, বিনা সংঘামে মেনে নিয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে প্রথম পূর্ণ উপন্যাস লিখেছেন “শহরতলী”—যশোদা বাংলা উপন্যাসের এক অতুলনীয় চরিত্র। ‘উপনিবেশ’ উপন্যাসে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সমাজের প্রথম স্ফুলিঙ্গ দেখিয়েছিলেন, দুঃসাহসের সঙ্গে ঘোষণা করছিলেন, বিপ্লবের সার্থকতার জন্য ‘আরণ্যক’ হিংস্রতার সাহায্য অপরিহার্য।

কিন্তু পুরো চল্লিশ দশকের বাংলা উপন্যাস অথবা কাব্যে দেশবিভাগের আয়োজন কলকাতার চিরকুখ্যাত দাঙ্গা যে পথে এল স্বরাজ সে পথটাই আকাঙ্ক্ষিত ও ফলপ্রসূ হলো কি না, হতে পারবে কি না, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ভাবতে আমার বিস্ময় লাগে স্বাধীনতাকে বিষয়বস্তু করে উপন্যাস রচিত হয়নি, বঙ্গভাষায়। মনোজ বসু ছোট একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘ভুলি নাই’। বিষয়বস্তু ছিল কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন। এটা কি বিধাতার কঠোর পরিহাস নয় যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নিয়ে প্রথম মর্মস্পর্শী উপন্যাস লিখলেন এক লন্ডন প্রবাসী ভারত-পাকিস্তানি লেখক। তাঁর ভাষায়, আমরা সবাই মিডনাইটস চিলড্রেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *